ডলু নদীতে এখন অনেক পানি, অথবা হয়তো পানি তেমন নাই, তবু ঐ দিক থেকে ভিজা হাওয়া বয়ে আসে, এবং এই হাওয়ার সঙ্গে আসে নদী পাড়ের বাঁশ ঝাড়ের ভেতরকার গুয়ের গন্ধ; তখন আহম্মদ তৈমুর আলি চৌধুরি তার বাসার সামনের রাস্তার পাশে একটা নিচা ইজি চেয়ারের ভিতরে পোটলার মত ঝুলে বসে থাকে। হয়তো সে রোদের ভেতর ঘুমিয়ে পড়ে, অথবা ডলু নদীর সকালের শুকনা গুয়ের গন্ধ সত্ত্বেও আরামে এমনি তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তখন সে তার ডান পা বাম পায়ের হাঁটুর ওপর তুলে দেয়, ফলে লুঙ্গি নিচের দিকে নেমে হাঁ হয়ে থাকে এবং ফাঁক দিয়ে বড় তালের আঁটির মত তার প্রাচীন হোলের বিচি দেখা যায়! সাতকানিয়ার লোকেরা, যারা বাজারে যায় অথবা বাজার থেকে বোয়ালিয়া পাড়া কিংবা সতী পাড়ার দিকে ফেরে, তারা মসজিদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখে যে, তৈমুর আলি লুঙ্গি ফাঁক করে রেখে ইজি চেয়ারে বসে ঘুমায়, তাদের হয়তো মনে হয় যে, কত বড় বিচি, অথবা তারা হয়তো কিছু দেখে না, হয়তো ভাবে একই জিনিস প্রত্যেক দিন দেখার দরকার কি, তারা হয়তো কেবল ইজি চেয়ারের খোলের ভিতরে কুঁজো হয়ে বসা তার কাত হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকায়, সেখানে হয়তো একটা/দুইটা নীল কিংবা কালা মাছি বসে গালের লালা খায়; তারপর রোদ গরম হয়ে উঠলে সে ইজি চেয়ার ছেড়ে বাড়ির ভিতরে যায়, সেখানে তার স্ত্রী, বুড়া সমর্ত বানু নাস্তা বানিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে। […] এ বিষয়ে তৈমুর আলি আর কিছু বলে না, এবং তখন মনে হয় যে, গোলেনুর হয়তো বিষয়টা জানে; তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে পুনরায় তার বিছানায় উঠে বসার চেষ্টা করে, তারপর শুয়ে থেকে বলে, আঁর বৌয়ের কথা পুছাললদ্দে না, বা’জি? ওর মায়তো মগ আছিলদে, আঁরা বার্মায় আছিলাম, কিন্তু আঁরা মগ ন আছিলাম। তখন তাকে হীরার আংটির কথা কথা জিজ্ঞেস করা হলে সে বলে যে, সে হীরার আংটির কথা জানে না, তবে বোঝা যায় সে সমর্তের উপরে খুশি না। এক শালিখ দেখার পর এইসব শুরু হয়, সেদিন তৈমুর আলির কথা শুনে ইউসুফ অথবা নুরে আলম রাস্তা থেকে নেমে ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে গিয়ে সমর্ত বানুকে ডেকে আনে, গরীবের মেয়ে…
তো ‘মৃত কবি’ ‘প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে তাঁর সৃষ্টি’ এসব যারা বলেন তারা ঠিক নজরুলকে দেখতে পান না, কেউ কেউ দেখতে চান না, কিন্তু আমরা যারা জানি, বাংলা কবিতার আধুনিকতার সঞ্চার নজরুলের কবিতাকে ঘিরেই ঘটেছিল, তারা কোনোভাবেই আবার মেনে নিতে পারি না, তাকেই বলা হয় ‘মুসলিম রবীন্দ্রনাথ’। কী ভয়ংকর আমাদের সমাজ আর কী বিভৎস আমাদের কবিতা ভাবনা, প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি চিন্তার সূত্রে, কী অমোঘ নিয়মে হিন্দুমুসলমান বিভেদটি ঢুকিয়ে দিতে না পারলে, কোনো এক অদৃশ্য শক্তি মনে হয় আমাদের লাঠিপেটা করে, আমরা আধুনিকতার কোনো কিছুই কোনোদিন আয়ত্ত করতে পারব না যতদিন না আমরা ব্যক্তি হয়ে অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপ্তিকে চিনতে না পারব। নজরুল আমাদের ভাষার ব্যাপ্তি বাড়িয়েছেন, কাজেই বাংলা ভাষা না মরলে তিনিও মরবেন না। নজরুল সৃষ্টিতে এমনই মুখর ছিলেন তার সৃষ্টি কোনোদিনই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। নজরুল কত বড় মাপের স্রষ্টা তার প্রমাণ বাংলা ভাষায় অসাধারণ সব গজল সৃষ্টি : “করুণ কেন অরুণ আঁখি / দাও গো সাকি দাও সরাব”। শুধু এই সফলতাই আর কিছু না হলেও বাংলায় নজরুলকে অমর করত। কিন্তু নজরুল আরো অনেক কিছু—দুর্দমনীয় নিঃসংশয় ইয়ার দোস্তের মতো এমন বাঁধনহারা বাঙালি চরিত্র আর কোথায়? এমন বিখ্যাত বিদ্রোহ বাংলা কবিতায় আর কি কখনো ঘটেছে? : “ আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, / মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস, / আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর! / আমি দুর্বার, / আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার।” আর প্রেম? নজরুলের প্রেমের গানের ও কবিতার সে পৃথিবী আমাদের অচেনা, কিন্তু সে এক সময় ছিল, সেই অতীতের প্রেমের সুর খোঁজার জন্য নজরুলে অবগাহনের মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই : “দুধে আলতা রঙ যেন তার / সোনার অঙ্গ ছেয়ে / সে ভিন গাঁয়েরই মেয়ে।” অথবা “ পউষের শূন্য মাঠে একলা বাটে চাও বিরহিণী / দুহুঁ হায় চাই বিষাদে মধ্যে কাঁদে তৃষ্ণা জলধি।” অথবা “ ওগো আমার দরদী / পাঠালে ঘূর্ণীদূতী ঝড় কপোতী বৈশাখে সখি / বরষায় সেই ভরসায় মোর পানে চায় জল ভরা নদী।” কবি প্রণাম না করে, কবি বন্দনা না করে, কবির হাতে ইসলামের ঝান্ডা তুলে না দিয়ে, কবিকে পঠন-পাঠন যদি আমরা বাড়াতে পারি; রবীন্দ্রনাথ, মুসলিম রবীন্দ্রনাথ এইসব বিভেদ…
৬০০০ ভাষার মধ্যে ২৪৯৮টিই বিপন্ন। পাঁচ রকমের বিপন্নতায় ভাগ করা হয়েছে বিপন্ন ভাষাগুলোকে। বিপন্ন (শিশুরা এ ভাষায় কথা বলে, কিন্তু সব সময় সব জায়গায় বলে না) ৬০৭টি, নিশ্চিত ভাবে বিপন্ন (মাতৃভাষা হিসেবে শিশুরা ঘরে আর ভাষাটি শেখে না) ৬৩২টি, ভয়াবহ ভাবে বিপন্ন (দাদা-দাদিরা বা বুড়ো প্রজন্ম এ ভাষায় কথা বলে, বাবা-মারা বা তাদের প্রজন্ম সে ভাষা বুঝতে পারে, কিন্তু নিজেদের মধ্যে তারা এ ভাষায় কথা বলে না এবং শিশুদেরও ভাষাটি আর শেখায় না) ৫০২টি, চূড়ান্ত বিপন্ন ( বুড়ো প্রজন্মই শুধু ভাষাটি ব্যবহার করে, কিন্তু তাদের মধ্যেও অনেকেই ভাষাটি ভুলে গেছে এবং যারা জানে তারাও সব সময় সে ভাষায় কথা বলে না) ৫৩৮টি ও অবলুপ্ত ( কেউই আর ভাষাটিতে কথা বলে না) ২১৯টি। বাংলাদেশে পাঁচটি ভাষাকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ককবরক, বিষ্ণুপ্রিয়-মণিপুরী, কুরুক্স –এই তিনটি বিপন্ন, বম নিশ্চিত ভাবে বিপন্ন এবং সাক ভয়াবহ ভাবে বিপন্ন। ১৯৬টি বিপন্ন ভাষা নিয়ে তালিকার শীর্ষে রয়েছে ভারত, তার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৯২), ব্রাজিল(১৯০), ইন্দোনেশিয়া (১৪৭) ও মেক্সিকো (১৪৪)। ভয়াবহ ভাবে বিপন্ন, মাত্র ২৯০০০ ভাষাভাষী নিয়ে বিপন্ন ভাষা, এভেন্কি। সে ভাষায় লেখা একটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পেয়েছি ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে। If I forget my native speech, And the songs that my people sing What use are my eyes and ears? What use is my mouth? If I forget the smell of the earth And do not serve it well What use are my hands? Why am I living in the world? How can I believe the foolish idea That my language is weak and poor If my mother’s last words Were in Evenki? -- Alitet Nemtushkin, Evenki poet এই পোস্টের সব তথ্যই সংগৃহীত হয়েছে ইউনেস্কোর ওয়েবসাইট থেকে। ২০০৮ এর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ইউনেস্কো প্রকাশ করেছে ‘বিপন্ন ভাষা’র মানচিত্রের নতুন সংস্করণ। অষ্ট্রেলিয়ার ভাষাবিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার মোসলের সম্পাদনায় সারা পৃথিবীর ৩০ জন ভাষাতত্ত্ববিদের পরিশ্রমে তৈরি হয়েছে এ বারের মানচিত্র। মানচিত্রটি দেখুন ও বিষয়টি আরো বিস্তারিত জানুন।
নিজের গ্রামে যাই না প্রায় এক যুগ হতে চলল। আগে প্রতিবছর ২/৩ বার গ্রামের বাড়ি যাওয়া হতোই। কর্মসূত্রে সমবয়সীদের গ্রামছাড়ার কারণেই আমার গ্রামে যাওয়া কমতে কমতে বন্ধই হয়ে গেল। কিন্তু আমার সব সময়ের ভালো লাগা ভাষা রয়ে গেল আজো আমার মনে। আক্ষেপ, নিয়মিত যাওয়া আসা থাকলে আরো ভালোভাবে আরো বেশী নোয়াখাইল্যা শব্দ এখানে উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা করতে পারতাম। প্রতিটি ভাষার বিশেষ্য, বিশেষণ ও ক্রিয়াপদই তার মূল ভিত্তি। তবে ভাষার সুন্দরতম অংশ বিশেষ্য পদগুলো : আমার এ পোস্টের মূল লক্ষ্য, সবাইকে আহবান জানাব সবাই যেন তার আঞ্চলিক ভাষার কিছু না কিছু শব্দ ও তার ব্যাখ্যা মন্তব্যে তুলে দেন। ব্যাখ্যা না করতে পারলেও কোনো শব্দ জানা থাকলে শুধু শব্দটাই তুলে দিতে পারেন, তাতে অন্য কেউ তার ব্যাখ্যা দিতে পারবে—অথবা তিনি নিজেও পরে জেনে ব্যাখ্যা দিতে পারেন। (more…)
স্বাগতম।
