আঞ্চলিক! আঞ্চলিক!

নিজের গ্রামে যাই না প্রায় এক যুগ হতে চলল। আগে প্রতিবছর ২/৩ বার গ্রামের বাড়ি যাওয়া হতোই। কর্মসূত্রে সমবয়সীদের গ্রামছাড়ার কারণেই আমার গ্রামে যাওয়া কমতে কমতে বন্ধই হয়ে গেল। কিন্তু আমার সব সময়ের ভালো লাগা ভাষা রয়ে গেল আজো আমার মনে। আক্ষেপ, নিয়মিত যাওয়া আসা থাকলে আরো ভালোভাবে আরো বেশী নোয়াখাইল্যা শব্দ এখানে উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা করতে পারতাম। প্রতিটি ভাষার বিশেষ্য, বিশেষণ ও ক্রিয়াপদই তার মূল ভিত্তি। তবে ভাষার সুন্দরতম অংশ বিশেষ্য পদগুলো : আমার এ পোস্টের মূল লক্ষ্য, সবাইকে আহবান জানাব সবাই যেন তার আঞ্চলিক ভাষার কিছু না কিছু শব্দ ও তার ব্যাখ্যা মন্তব্যে তুলে দেন। ব্যাখ্যা না করতে পারলেও কোনো শব্দ জানা থাকলে শুধু শব্দটাই তুলে দিতে পারেন, তাতে অন্য কেউ তার ব্যাখ্যা দিতে পারবে—অথবা তিনি নিজেও পরে জেনে ব্যাখ্যা দিতে পারেন।

নোয়াখাইল্যা শব্দ

উরুম মুড়ি।
হগার ~ পগার‌‍ ~ প্রাকার। প্রাকার মানে দূর্গের দেয়াল হলেও, নোয়াখাইল্যা ভাষায় এ অর্থে ব্যবহৃত হয় না। রাস্তা থেকে বাড়ি আলাদা করতে যে গাছপালার দেয়াল বানানো হয় তাকেই হগার বলে। দুই বাড়িকে আলাদা রাখতেও হগার গড়ে তোলা হয়।
হাঁনখ হাঁপ গোখরো সাপ।
মাইডগা হাঁপ ছোট্ট নির্বিষ সাপ। ধান খেতে বেশী পাওয়া যায়। ধান কাটা হয়ে গেলে খালি ধান খেতে সহজে দেখা যায় বলে সকলের আক্রমণের শিকার হয়ে অকাতরে প্রাণ হারায়।
এরিও দূর থেকে কেউ কাউকে ডাকতে এ ধ্বনি ব্যবহৃত হয়। হাট বাজার খেত খামারে খুব শোনা যায়। শুধু দূর থেকে কাউকে ডাকতে নয় কাছাকাছি কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এ ধ্বনি ব্যবহৃত হয়।
হাঁছা* সত্য। (Six-সিক্স, এখানে S-এর উচ্চারণের মতো।)
আন্তা ছোট মাছ ধরার এক ধরনের বাক্সের মতো ফাঁদ। একটি খুবই সরল ল্যাবেরিন্থ। দেখতে ট্রানজিস্টারের মতো বলে নোয়াখালিতে ট্রানজিস্টারকে মজা করে আন্তা বলা হয়।
বইছা* বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছকে একসাথে এ নামে ডাকা হয়।(Six-সিক্স, এখানে S-এর উচ্চারণের মতো।)
লোব ~ Loaves, পাউরুটি।
ছৈঁ* শিম। (Six-সিক্স, এখানে S-এর উচ্চারণের মতো।)
হিডা ~ পিঠা।
হ্যানকারচিফ ~ Handkerchief, রুমাল
রসি ঘর ~ রসই ঘর, রান্না ঘর।
কঁইডা সব্জী বিশেষ। ঠিক কী রকম বোঝাতে পারছি না। পরে ব্যাখ্যা করব।
[* ‘ছ’ ব্যবহার করেছি। চট্টগ্রামে ‘ছালাম’ ‘ইছলাম’ এভাবে লেখা হয়, এ দৃষ্টান্তকে মাথায় রেখে। ]

যেহেতু চট্টগ্রামে থাকি সেহেতু চট্টগ্রামের অনেক শব্দও এখানে তুলে দিতে পারব আশা করি। তবে চট্টগ্রামের কেউ সে কাজ নি:সন্দেহে আরো অনকে ভালো পারবেন। আমি চট্টগ্রামের সামুদ্রিক মাছের নামগুলোর ভীষন ভক্ত, জানি না নামগুলো কি চট্টগ্রামের নিজের না অন্য কোনো ভাষার অপভ্রংশ।

চাঁটগাঁইয়া শব্দ
লইট্টা মাছ বিশেষ।
ফাইস্যা মাছ বিশেষ।
ছুরি মাছ বিশেষ। (Six-সিক্স, এখানে S-এর উচ্চারণের মতো।)
পোয়া মাছ বিশেষ।
লাক্ষ্যা মাছ বিশেষ।
গুদাম মাটির ঘর।

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

১০ comments

  1. মাসুদ করিম - ২৫ অক্টোবর ২০০৮ (২:৫৪ পূর্বাহ্ণ)

    আরো কিছু নোয়াখাইল্যা শব্দ
    ড্যাগা কাঁচা।
    বাতি পাকা।
    হ্যাঁ।
    লাই জিনিসপত্র বহনের বড় ঝুড়ি।
    হাবিয়া পেঁপে।
    ডাইগ্যা গাছের ডাল।
    লাডি ~ লাঠি।
    খলি ছোট মাছ নেয়ার ঝুড়ি।
    ভান্ড ~ ভান্ডার; তৈরী খাবার রাখার টিন,বোতল এই অর্থে ব্যবহৃত। যেমন : তেলের ভান্ড, আচারের ভান্ড।
    শিশি ছোট বোতল। ওষুধের ছোট বোতলগুলো ভালো করে ধুয়ে, সরিষার তেল রাখার জন্য ব্যবহৃত হতো। গ্রামের রিসাইক্লিং ভাবনা।

  2. মাসুদ করিম - ২ নভেম্বর ২০০৮ (২:৩০ পূর্বাহ্ণ)

    আরো কিছু নোয়াখাইল্যা শব্দ
    লাইয়া ছৈঁ* বরবটি। (Six-সিক্স, এখানে S-এর উচ্চারণের মতো।)
    কিসিঞ্জারি প্যাঁচ লাগানো, ক্যারপ্যাট করা। সম্প্রতি আমাদের এক বিশ্বখ্যাত আইনজীবি ড. কামাল হোসেন বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে কয়েকজন কিসিঞ্জার খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু তিনি আসলে বলতে চেয়েছেন বর্তমান সরকারের কিছু উপদেষ্টা কিসিঞ্জারি করছেন। এই নোয়াখাইল্যা শব্দটির অপপ্রয়োগ উপদেষ্টাদের বিষয়ে তার মন্তব্যের ভুল অর্থ তৈরী করেছে; যেখানে তিনি বলতে চেয়েছেন সরকারের কিছু উপদেষ্টা প্যাঁচ লাগাচ্ছেন, সেখানে তিনি এই উপদেষ্টাদের কিসিঞ্জারের পর্যায়ে তুলে দিয়েছেন। এর ফলে সাম্প্রতিক সময়ে তার বিবিধ গুনাসমূহের সাথে শব্দের অপপ্রয়োগ সংক্রান্ত গুনাও যোগ হলো।
    হ্যাঁচ‍‌‌~প্যাঁচ।
    শয়তানি দুষ্টামি।
    ব্যান সকাল।
    হফ ব্যান ভোর।
    দিপ্রহর দুপুর।
    বৈকাল বিকাল।
    হান্জুইন্যা রাত।
    [* ‘ছ’ ব্যবহার করেছি। চট্টগ্রামে ‘ছালাম’ ‘ইছলাম’ এভাবে লেখা হয়, এ দৃষ্টান্তকে মাথায় রেখে। ]

  3. মাসুদ করিম - ১৪ নভেম্বর ২০০৯ (১২:১৬ পূর্বাহ্ণ)

    আরো কতাগাইন নোয়াখাইল্যা বুলি নোয়াখালির আরো কিছু শব্দ।
    অমলই অমলকি।
    গইয়া/গোয়ুম পেয়ারা।
    জলপি জলপাই।
    শুয়ারি শুপারি।
    টক বাইগুন টমেটো।
    তেঁতি তেঁতুল।
    হাঙ্গা বিয়ে। স্ল্যাং। নারী-পুরুষের ‘কারনাল’ সম্পর্ক বা বিবাহিত দম্পতির মধ্যে ‘দৈহিক উন্মাদনা’র প্রকাশ দেখলে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
    জাইল্যা জেলে।
    লাই প্রশ্রয়
    কোষা নোকা এক ধরনের ছোটো নৌকা। পুকুর থেকে হাত দিয়ে পানি খাওয়ার সময় দুহাতের পাতার যেমন কোষ হয়, সেরকম দেখতে।
    হাগলা কোঁদা মরা তাল গাছের মাঝখানটা চিরে বানানো এক ধরনের নৌকা। পানির ওপর এটির ভারসাম্য রাখা খুবই কঠিন, তাই হাগলা — মানে পাগলা।

  4. মাসুদ করিম - ৪ ডিসেম্বর ২০১১ (৭:০৮ অপরাহ্ণ)

    হাডায় হুতায় ঘষাঘষি মরিচের হরান যায় (শিল পাটায় ঘষাঘষিতে মরিচের প্রাণ যায়), ইংল্যান্ডের লেবার নেতা এড মিলিব্যান্ড এই নোয়াখাইল্যা প্রবাদের সারমর্ম গ্রহণ করে মন্দায় কবলিত ইংরেজ সরকারের আরোপিত কর ও মধ্যবিত্তের জীবনের প্রত্যাশার ঘষাঘষির মাঝখানে পড়ে প্রাণওষ্ঠাগত মধ্যবিত্তের অবস্থা বোঝাতে প্রথম ব্যবহার করেন squeezed middle শব্দযুগল। এবং এই শব্দই আবার অক্সফোর্ড অভিধানের এবারের বর্ষসেরা শব্দের স্বীকৃতি লাভ করে

  5. মাসুদ করিম - ৭ অক্টোবর ২০১২ (১:১৭ অপরাহ্ণ)

    গ্রামে এক সমবায়ের জনৈক প্রভাবশালী সদস্যের কাছে জানতে চাইলাম আপনারা নাকি এক নিরীহ প্রতিবেশীর কিছু জায়গা মাছ ও সব্জি চাষের জন্য লিজ নিয়ে তার দ্বিগুণ জায়গা দখলের চেষ্টা করছেন। তিনি আমাকে বললেন, আঁগ সংগঠন ভাঙ্গনের লাই কিছু মানুষের ইন্ধনের কারণে এই ঘটনা ঘইটত হারে, বুইঝেননি। আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না তিনি এত অবলীলায় ‘কিছু মানুষের ইন্ধনের কারণে‘র মতো কঠিন ও যথাযথ বাক্যাংশ কী চমৎকার ব্যবহার করলেন! আমাদের দৈনন্দিন কথোপকথনে নানা আঞ্চলিক সংলাপ এখনো প্রচুর। কিন্তু সেটার নাটকে ব্যবহার খুব হাস্যকর। কারণ, ‘টান’ যথাযথ ধরতে প্রায় অভিনেতাই অসফল, ফলে অত্যন্ত গম্ভীর আলোচনাও হাসাহাসির কারণ হয়। যেমন, এই সংলাপটিই আমি বাস্তব জীবনে না শুনে কোনো অভিনেতার অদক্ষ সংলাপ হিসাবে শুনলে আমি এত চমৎকৃত হতাম না। আঁগ সংগঠ[ট]ন ভা[বা]ঙ্গনের লাই কিছু[চু] মানুষের ইন্ধ[ন্দ]নের কারণে, এই ঘ[গ]টনা ঘ[গ]ইটত হারে, বুইঝে[জ]ননি। নোয়াখাইল্যা ভাষায় মহাপ্রাণ বর্ণের এক বিশেষ ‘টান’ একে মহাপ্রাণ-অল্পপ্রাণের মাঝামাঝি এমন একটা স্তরে রাখে যেটা আয়ত্ত করা আয়াসসাধ্য।

    এখন এই একই সংলাপ যদি চাঁটগাঁইয়া ভাষায় অনুবাদ করি, আঞ্চলিক ভাষার শব্দগ্রহণের ব্যখ্যাহীন নিজস্বতার কারণে একবারেই অন্য ভাবে সংলাপটি উপস্থাপিত হতে পারে। আমি চেষ্টা করছি, কিন্তু যেহেতু আমি চাঁটগাঁইয়া নই এবং ভাষাটাও সেভাবে জানি না, কাজেই আমি চাঁটগাঁইয়া বা এই ভাষা ভাল জানেন তার কাছ থেকে সাহায্যপ্রার্থী। আমার ভার্সন : আঁরার সংগঠন ভাঙ্গিবার লাই ‘কিছু মানুষের ইন্ধনের কারণে‘ এই ঘটনা ঘটিত ফারে, ন বুঝন। চাঁটগাঁইয়া ভাষায় ‘ইন্ধন’ শব্দটাকে ঠিক এভাবে নিবে কিনা আমার সন্দেহ আছে, মনে হয় এখানে এই বাক্যাংশের এদিক ওদিক পরিবর্তন হবে। দেখি কেউ সাহায্যে এগিয়ে আনে কি না।

  6. সবুজ পাহাড়ের রাজা - ৭ অক্টোবর ২০১২ (৩:২৩ অপরাহ্ণ)

    যথাসম্ভব প্রকৃত চাঁটগাইয়া উচ্চারণ ব্যবহারের চেষ্টা করলাম।
    ‘আঁরার সংগটন বাঙিবেরলাই কিছূ মাইনসের ইন্ধনত-তুন এই গডনা গডিত ফাঁরের, ন বুঝন।’

    • মাসুদ করিম - ৭ অক্টোবর ২০১২ (৫:৪৮ অপরাহ্ণ)

      আঁরার সংগটন বাঙিবেরলাই কিছূ মাইনসের ইন্ধনত-তুন এই গডনা গডিত ফাঁরের, ন বুঝন।

      এবার চাঁটগাঁইয়া মনে হচ্ছে। চমৎকার।

  7. মাসুদ করিম - ৮ জানুয়ারি ২০১৩ (১:১৯ অপরাহ্ণ)

    বদারেশন শব্দটি ইংরেজরা এখন কতটুকু ব্যবহার করে ঠিক জানি না, তবে নোয়াখাইল্যাদের কাছে এটা একটা অতি প্রচলিত শব্দ, মানে, ওই একই, ঝুট ঝামেলাই।

    গগলজ এই শব্দটা খুবই গুরত্বের সাথে ব্যবহার করে নোয়াখাইল্যারা, বিশেষ করে কালো চশমা হলে তো কথাই নেই। ইংরেজির এই ফ্যাশনদুরস্ত শব্দ কিভাবে ঢুকে গেল দেহাতি নোয়াখাইল্যায় কে জানে?

  8. মাসুদ করিম - ১৪ নভেম্বর ২০১৩ (২:৪৮ অপরাহ্ণ)

  9. মাসুদ করিম - ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ (৯:১৮ পূর্বাহ্ণ)

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.