মুসলিম রবীন্দ্রনাথ

তো ‘মৃত কবি’ ‘প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে তাঁর সৃষ্টি’ এসব যারা বলেন তারা ঠিক নজরুলকে দেখতে পান না, কেউ কেউ দেখতে চান না, কিন্তু আমরা যারা জানি, বাংলা কবিতার আধুনিকতার সঞ্চার নজরুলের কবিতাকে ঘিরেই ঘটেছিল, তারা কোনোভাবেই আবার মেনে নিতে পারি না, তাকেই বলা হয় ‘মুসলিম রবীন্দ্রনাথ’। কী ভয়ংকর আমাদের সমাজ আর কী বিভৎস আমাদের কবিতা ভাবনা, প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি চিন্তার সূত্রে, কী অমোঘ নিয়মে হিন্দুমুসলমান বিভেদটি ঢুকিয়ে দিতে না পারলে, কোনো এক অদৃশ্য শক্তি মনে হয় আমাদের লাঠিপেটা করে, আমরা আধুনিকতার কোনো কিছুই কোনোদিন আয়ত্ত করতে পারব না যতদিন না আমরা ব্যক্তি হয়ে অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপ্তিকে চিনতে না পারব। নজরুল আমাদের ভাষার ব্যাপ্তি বাড়িয়েছেন, কাজেই বাংলা ভাষা না মরলে তিনিও মরবেন না। নজরুল সৃষ্টিতে এমনই মুখর ছিলেন তার সৃষ্টি কোনোদিনই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। নজরুল কত বড় মাপের স্রষ্টা তার প্রমাণ বাংলা ভাষায় অসাধারণ সব গজল সৃষ্টি : “করুণ কেন অরুণ আঁখি / দাও গো সাকি দাও সরাব”। শুধু এই সফলতাই আর কিছু না হলেও বাংলায় নজরুলকে অমর করত। কিন্তু নজরুল আরো অনেক কিছু—দুর্দমনীয় নিঃসংশয় ইয়ার দোস্তের মতো এমন বাঁধনহারা বাঙালি চরিত্র আর কোথায়? এমন বিখ্যাত বিদ্রোহ বাংলা কবিতায় আর কি কখনো ঘটেছে? : “ আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, / মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস, / আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর! / আমি দুর্বার, / আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার।” আর প্রেম? নজরুলের প্রেমের গানের ও কবিতার সে পৃথিবী আমাদের অচেনা, কিন্তু সে এক সময় ছিল, সেই অতীতের প্রেমের সুর খোঁজার জন্য নজরুলে অবগাহনের মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই : “দুধে আলতা রঙ যেন তার / সোনার অঙ্গ ছেয়ে / সে ভিন গাঁয়েরই মেয়ে।” অথবা “ পউষের শূন্য মাঠে একলা বাটে চাও বিরহিণী / দুহুঁ হায় চাই বিষাদে মধ্যে কাঁদে তৃষ্ণা জলধি।” অথবা “ ওগো আমার দরদী / পাঠালে ঘূর্ণীদূতী ঝড় কপোতী বৈশাখে সখি / বরষায় সেই ভরসায় মোর পানে চায় জল ভরা নদী।”
কবি প্রণাম না করে, কবি বন্দনা না করে, কবির হাতে ইসলামের ঝান্ডা তুলে না দিয়ে, কবিকে পঠন-পাঠন যদি আমরা বাড়াতে পারি; রবীন্দ্রনাথ, মুসলিম রবীন্দ্রনাথ এইসব বিভেদ ভুলে গিয়ে যদি বাংলা ভাষার উৎকর্ষের দিকে নিজেদের নিয়োজিত করতে পারি—তবেই আমাদের সাহিত্যিক সামাজিক মানবিক বিবর্তনের দুর্দশা থেকে আমরা মুক্তি পাব। তা না হলে বিভেদের অতলে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন শুধুই নিরুদ্দেশ হবে।

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

৯ comments

  1. রায়হান রশিদ - ২৮ মে ২০০৯ (১০:০৩ অপরাহ্ণ)

    স্বীকার করতেই হচ্ছে রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম পোস্টের শিরোনাম দেখে।

  2. শাহীন ইসলাম - ২৯ মে ২০০৯ (১০:৪৯ অপরাহ্ণ)

    “বাংগালী মুসলমানের দূর্ভাগ্য, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ছিলেন”; কথাটি বল্ল আমার এক বন্ধু। যদি রবীন্দ্রনাথ মুসলামন হতেন … (interesting counterfactual )

  3. রেজাউল করিম সুমন - ৫ জুন ২০০৯ (৯:০২ পূর্বাহ্ণ)

    […] কিন্তু আমরা যারা জানি, বাংলা কবিতার আধুনিকতার সঞ্চার নজরুলের কবিতাকে ঘিরেই ঘটেছিল, তারা কোনোভাবেই আবার মেনে নিতে পারি না, তাকেই বলা হয় ‘মুসলিম রবীন্দ্রনাথ’।

    এই বাক্যের “আমরা” কারা? আর কারাই-বা নজরুলকে ‘মুসলিম রবীন্দ্রনাথ’ বলেন?

  4. Mohammed Munim - ৩০ জুলাই ২০০৯ (৬:১৩ পূর্বাহ্ণ)

    আমি বাংলা বা অন্য কোন সাহিত্যই তেমন পরিনি। নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক মূল্যায়নের যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু নজরুলকে ‘মুসলিম রবীন্দ্রনাথ’ হিসাবে দেখার ব্যাপারটি খুবই সত্যি। প্রয়াত হুমায়ুন আজাদের নজরুলের ব্যাপারে একটা উন্নাসিক ভাব ছিল, তিনি একবার বলেছিলেন বাংলাদেশের নজরুল গবেষকরা আসলে গবেষক নন, তাঁরা ‘নজরুলের মাজারের খাদেম’। আবার পশ্চিমবঙ্গের এক নজরুল গবেষক বললেন কোলকাতার হিন্দুপ্রধান লেখকসমাজ এবং সাহিত্য সম্পাদকেরা কখনোই নজরুলকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেননি এবং এখনো দিতে অনিচ্ছুক। নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষনা করার মাধ্যমে ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তাবাদকে establish করার চেষ্টা করেছিলেন জিয়াউর রহমান, এমন একটা theory পড়েছিলাম কোন এক পত্রিকায়। নজরুলকে বাংলাদেশে এনেছিলেন আওয়ামী লীগ সরকার, ১৯৭২ এ, জাতীয় কবি খেতাব কোন সরকার দিয়েছিল, সেটা ঠিক জানিনা। অসুস্থ নজরুল কোলকাতার এক বস্তিতে দারিদ্রে দিন কাটাচ্ছিলেন, এমন একটা তথ্যও দেখলাম এক ওয়েবসাইটে। সেটা কি তিনি মুসলিম বলে, নাকি ভারত সরকারের স্বভাবজাত লালফিতার কারনে, তা জানিনা (ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভুষন খেতাব দিয়েছিল, ১৯৬০ সালে)। এরশাদের এবং বিএনপি আমলে BTV তে নজরুলের গান্ধী টুপি পরা যে ছবিটি প্রায়ই দেখানো হতো, সেটি সম্ভবত তাঁকে একটি muslim identity দেওয়ার জন্যই।

    এসব দেখলে নজরুল রেগে যেতেন সন্দেহ নেই, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে তাঁর রাগী লেখার সাথে আমাদের সবারই পরিচয় আছে। একটি পশ্চাদপদ সমাজের আরও পশ্চাদপদ অংশে তাঁর জন্ম, মাদ্রাসা শিক্ষা ছাড়া কিছু জোটেনি কপালে, সেখান থেকে এপিক উথ্থান। মাত্র ২৪ বছর বয়সে অসমসাহসী জবানবন্দী (অসংখ্য হিন্দু metaphor এ সাজানো জবানবন্দী)। তারপর জেলে দীর্ঘ অনশন করে প্রায় মরে যাওয়া। জেল থেকে বের হয়ে শুরু হলো নিরন্তর লড়াই, একই সাথে মুসলিম আর হিন্দু সাম্প্রদাযিকতার বিরুদ্বে। সেই সাথে চললো গান লেখা, প্রেমের গান, বিদ্রোহের গান, সমাজবদলের গান। জামাত শিবিরের অতি প্রিয় হামদ ও নাত, তাঁরই লেখা, আবার একই সাথে লিখেছেন কীর্তন (কখনো শু্নেছি বলে মনে পড়ে না)। মাত্র ৪২ বছর বয়সে চুপ হয়ে যাওয়া, কেন হলেন কে জানে (হুমায়ুন আজাদের মতে তাঁর সিফিলিস হয়েছিল)।

    এমন প্রচন্ড পুরুষ, এমন প্রচন্ড প্রেমিক, এমন খেয়ালি মানুষ আমাদের মাঝে খুব বেশী আসেননি। কোন খেয়ালে বলেছিলেন ‘মসজিদের পাশে’ কবর দিতে, তাঁর কবর হলো মসজিদের পাশে, হয়ে গেলো নজরুলের মাজার। নজরুলকে পুরোপুরি বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই, আবার তাঁর প্রভাব এড়ানোর ক্ষমতাও নেই, তাই খন্ডিত নজরুল আমাদের কারো কাছে ‘মুসলিম রবীন্দ্রনাথ’ কারো কাছে ‘অপ্রাসঙ্গিক কবি’।

  5. মাসুদ করিম - ২১ আগস্ট ২০০৯ (৮:৩১ পূর্বাহ্ণ)

    আজকের প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে আহমদ কবির লিখেছেন : সম্প্রীতির পয়লা নম্বর

  6. মাসুদ করিম - ২৬ মে ২০১১ (১:০৯ পূর্বাহ্ণ)

    প্রায় সতেরো আঠারো বছর পর গত কয়েকদিন ধরে আবার একনাগাড়ে নজরুল ইসলামের অনেকগুলো কবিতা পড়লাম। এখনো নজরুলের সেরা কবিতা ওই ‘বিদ্রোহী’কেই বলব।

    আমি চির-শিশু, চির-কিশোর,
    আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর!
    আমি উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাস পূরবী হাওয়া,
    আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
    আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি,
    আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি!
    আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, একি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
    আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!

    ভাল লেগেছে ‘অ-কেজোর গান’ এই ছোট্ট কবিতাটি।

    আজ কাশ-বনে কে শ্বাস ফেলে যায় মরা নদীর কূলে
    ও তার হলদে আঁচল চলতে জড়ায় অড়হরের ফুলে!
    ঐ বাবলা ফুলের নাকছাবি তার
    গায় শাড়ি নীল অপরাজিতার

    নজরুলের ‘আমার কৈফিয়ৎ’ আমার প্রিয় ভাষণ কবিতা।

    ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
    বেলা বয়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
    কেঁদে ছুটি আসি পাগলের প্রায়,
    স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!
    কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজও আছ কি? কালি ও চুন
    কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?

    ‘প্রলয়োল্লাস’ প্রাণ খুলে আবৃত্তি করার মতো কবিতা।

    ভেঙ্গে আবার গড়তে জানে যে চির-সুন্দর!
    তোরা সব জয়ধ্বনি কর্।
    ঐ ভাঙ্গা-গড়া খেলা যে তার কিসের তবে ডর?
    তোরা সব জয়ধ্বনি কর্।
    বধূরা প্রদীপ তুলে ধর্।
    কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর!
    তোরা সব জয়ধ্বনি কর্।
    তোরা সব জয়ধ্বনি কর্।

    ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ একটি জোরালো কবিতা।

    দুর্গম গিরি, কান্তার, মরু, দুস্তর পারাবার
    লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!

    দুলিতেছি তরী ফুলিতেছে দুল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
    ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
    কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাকিছে ভবিষ্যৎ।
    এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।।

    ‘প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়’ আমার একটি প্রিয় কালচেতনার কবিতা।

    বর্ষ-সতী-স্কন্ধে ঐ
    নাচছে কাল
    থৈ তা থৈ।
    কই সে কই
    চক্রধর,
    ঐ মায়ায়
    খণ্ড কর
    শব-মায়ায়
    শিব যে যায়
    ছিন্ন কর
    ঐ মায়ায় –
    প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়
    প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!

    ‘অভিশাপ’ কবিতাটিতে অস্তিত্বের ঘোষণা অসাধারণ।

    আমি বিধির বিধান ভাঙ্গিয়াছি আমি এমনই শক্তিমান।
    মম চরণের তলে মরণের মার খেয়ে মরে ভগবান!
    আদি ও অন্তহীন
    আজ মনে পড়ে সেই দিন –
    প্রথম যেদিন আপনার মাঝে আপনি জাগিনু আমি,
    আর চীৎকার করি’ কাঁদিয়া উঠিল তোদের জগৎস্বামী!

    ‘শিকল-পরার গান’ কবিতাটিতে দেশাত্মবোধ অন্য মাত্রা পেয়েছে। এ ধরনের দেশাত্মবোধ নজরুল ছাড়া আর কারো মধ্যে আগে প্রকাশিত হয়নি।

    এই শিকল-পরা ছল মোদের এ
    শিকল-পরা ছল।
    এই শিকল প’রেই শিকল তোদের
    করব রে বিকল।।

    তোদের বন্ধ কারায় আসা মোদের বন্দী হ’তে নয়।
    ওরে ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাঁধন-ভয়।
    ওই শিকল-বাঁধা পা নয় এ শিকল-ভাঙ্গা কল।।

    প্রায় শ’ খানেক কবিতা পড়ে এই আটটি কবিতাই আমি বাছাই করতে পেরেছি।

    • মাসুদ করিম - ২৭ মে ২০১১ (১:৩৯ অপরাহ্ণ)

      ‘বিদ্রোহী’ নিয়ে শুধু আমিই অভিভূত নই,’বিদ্রোহী’ নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন বিশ্বপরিব্রাজক বাঙালি পণ্ডিত বিনয় কুমার সরকার (১৮৮৭-১৯৪৯)। তিনি বলতেন, নজরুলের ‘আমি’ আসলে কবি নজুরল নয় যেপাঠক ‘বিদ্রোহী’ পড়ে সেই পাঠক নিজে — ‘বিদ্রোহী’ হল ‘ব্যক্তির উপনিষদ’। আজকের কালের কণ্ঠের সাময়িকী ‘শিলালিপি’তে সুব্রত কুমার দাসের লেখা থেকে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্যের পাশাপাশি বিনয় কুমার সরকার ও এই অসাধারণ প্রতিভাশালী মানুষটির নজরুল ভাবনার পরিচয় পাওয়া যাবে।

      জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বহু অর্থেই যুগান্তকারী, বহুল পঠিত এবং বহুল আলোচিত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ রচনা করেছিলেন ১৯২১ সালের শেষ সপ্তাহে। ইতিমধ্যে নজরুলের সাহিত্যকর্ম নিয়ে দু-একটি ছোটখাটো কথাবার্তাও আসা শুরু হয়েছিল। যার কারণে কবিতা-গল্প-উপন্যাস ছাড়িয়ে তাঁর সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’র জন্য প্রথম অশ্বেতাঙ্গ নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাণীও পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু…’ ‘ধূমকেতু’র প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ১২ আগস্ট, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে। একই বছরের ৩০ আগস্ট তারিখে ইংরেজি ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ লিখেছিল ‘The editor (কাজী নজরুল ইসলাম) has already made his mark as a powerful poet and some of his recent poems, particularly the ‘Bidrohi’ are among the most well-known in the Bengali literature…।’ এসব তথ্য-মন্তব্যের বাইরে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো হলো, ১৯২২ সালে জার্মানির বার্লিন শহর থেকে প্রকাশিত প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার বই The Futurism of Young Asia গ্রন্থে বাংলা সাহিত্যের সাম্প্রতিক আলোচনা নিয়ে রচিত প্রবন্ধ ‘Recent Bengali Thought’-এ কাজী নজরুল ইসলাম এবং তাঁর কবিতা ‘বিদ্রোহী’ প্রসঙ্গ। ইংরেজি ভাষায় রচিত সে গ্রন্থের লেখক আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি পণ্ডিত বিনয় কুমার সরকার (১৮৮৭-১৯৪৯), যিনি বিনয় সরকার নামেও পরিচিত।
      ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৩২৮ বঙ্গাব্দে, অন্তত চারটি সাহিত্য সাময়িকীতে। ১৯১৯ সালের মে-জুন মাসে প্রকাশিত প্রথম রচনা ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ থেকে ‘বিদ্রোহী’র দূরত্ব আড়াই বছর। একজন সাহিত্যিকের জীবনে আড়াই বছর সময়টি একেবারে হ্রস্ব নয়, যদি সেটি ফলদ হয়। নজরুলের ক্ষেত্রেও সে কালটি প্রসব করেছে গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’ এবং উপন্যাস ‘বাঁধনহারা’ (গ্রন্থে তত দিনে না হলেও পত্রিকায় তো বটে)। আর কবিতায় এসেছে ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার’, ‘মোহররম’, ‘খেয়াপারের তরণী’র মতো কবিতা ছাড়াও বেশ কিছু। জার্মানিতে বসে ‘বিদ্রোহী’ পড়েই বিশ্বপরিব্রাজক বিনয় কুমার যেন চিনে নিয়েছিলেন নজরুলের শক্তিকে, তাঁর কাব্যিক অনন্যতাকে।
      The Futurism of Young Asia গ্রন্থের উপশিরোনামে রয়েছে ‘and other essays/on the relations between the East and the West’। বার্লিনে অবস্থানকালে গ্রন্থটি রচিত এবং প্রকাশিত। বহুপাঠী এবং দ্রুতলিপিকার বিনয় কুমার সরকারের চোখ কলকাতার বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের লেখার প্রতি শুধু আকৃষ্টই হয়নি, তিনি কবির রচনায় শুনতে পেয়েছিলেন নতুনত্বের ধ্বনি। এত তরুণ একজন লেখককে এমন করে চিহ্নিত করার কাজটি প্রবীণ পণ্ডিতদের কাছ থেকে বাংলা ভাষায় খুব বেশি হয়েছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না।
      পৈতৃক নিবাস ঢাকার বিক্রমপুরের সন্তান আটটি ভাষায় দক্ষ বিনয় কুমার ২০ বছর বয়সেই অধ্যাপনায় যুক্ত হন এবং শিক্ষাবিষয়ক বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ছিলেন এমন একজন বাঙালি পণ্ডিত, যাঁর ইংরেজি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল আমেরিকা, চীন, জাপান, জার্মানি, ইংল্যান্ড ইত্যাদি দেশের বিভিন্ন শহর থেকে। ১৯১২ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর The Science of History and the hope of Mankind। একই বছর বাংলায় ছাপা হয়েছে তাঁর দুটি গ্রন্থ ‘ঐতিহাসিক প্রবন্ধ’ এবং ‘সাধনা’। তাঁর পরবর্তী গ্রন্থগুলো হলো_The Aids to General Culture Series ‰es The Science of Education and the Inductive Method of Teaching Series। ১৯১৪ সালে প্রকাশিত তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো_’নিগ্রো জাতির কর্মবীর’। ১৯১৬ সালে চীন থেকে প্রকাশিত হয় Love in Hindu Literature এবং The Beginning of Hindu Culture as World Power। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ The Bliss of a Moment। ১৯১৪ সাল থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিশ্বপরিব্রাজক। সে ১১ বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর ভ্রমণের দেশগুলো নিয়ে দীর্ঘ বিশাল বিশাল গ্রন্থ লিখেছেন, যেগুলো ১৩ খণ্ডে ‘বর্তমান জগৎ’ নামে প্রকাশিত হয়। জাপান, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাপুষ্ট সে পণ্ডিত মানুষটির রয়েছে বাংলা ও ইংরেজি প্রতিটি ভাষায় মুদ্রিত ১২ হাজারের অধিক করে মোট প্রায় ২৮ হাজার পৃষ্ঠা রচনা ছাড়াও ফরাসি, জার্মান ও ইতালিয়ান ভাষায় রচিত গবেষণা প্রবন্ধ।
      The Futurism of Young Asia গ্রন্থের উৎস হিসেবে ১৯১৭ সালে আমেরিকার ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনয় কুমারের একটি বক্তৃতাকে চিহ্নিত করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানিকে পুনর্গঠনে বিনয় কুমারের গ্রন্থটি বিশেষ প্রেরণা জুগিয়েছিল বলে জানা যায়। প্রাচ্য সমাজ ও সভ্যতা নিয়ে শ্বেতাঙ্গদের ব্যাখ্যা ও যুক্তির প্রতিবাদ হিসেবে রচিত বিনয় কুমারের গ্রন্থটিতে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিবাদী কবি অন্তর্ভুক্ত হবেন_এটাই হয়তো স্বাভাবিক ছিল।
      কি লিখেছিলেন বিনয় কুমার কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব নিয়ে? সে গ্রন্থের Currents in the Literature of Young India অধ্যায়ে (পৃ. ৩০৭) Recent Bengali Thought উপশিরোনামযুক্ত ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, মুসলমান লেখকদের আবির্ভাব।’ শুধু সাংবাদিকতায়ই নয়, কথাসাহিত্য ও অন্য সব সৃজনশীল সাহিত্য ধারায়ও তাঁদের উপস্থিতি উল্লেখ করার মতো। সে প্রসঙ্গেই বিনয় কুমার ‘বিদ্রোহী’র উদাহরণ দেন। বিনয় কুমার অনূদিত ‘বিদ্রোহী’র কয়েকটি পঙ্ক্তি এমন :
      Say, Hero!
      Say! ‘Erect is my head!
      Seeing my head that Himalayan peak
      Bends low in shame’
      নজরুলকে নিয়ে বিনয় কুমারের ভাবনা কিন্তু সে গ্রন্থেই থেমে যায়নি। তবে বহু ভাষায় রচিত তাঁর বিপুল রচনার কোথায় কোথায় কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য প্রাসঙ্গিক হয়েছিল, সেটি আজ গবেষণার বিষয়। তবে জীবনভর আয়ত্ত তাঁর জ্ঞানরাজির সংক্ষিপ্ত একটি রূপের সন্ধান পাওয়া যায় ‘বিনয় সরকারের বৈঠকে’ গ্রন্থে। প্রশ্নোত্তরের আকারে লিখিত শ-পাঁচেক পৃষ্ঠার সে গ্রন্থের প্রথম খণ্ড ১৯৪২ সালে প্রকাশ পেলেও ১৯৪৪-৪৫ সালে দুই খণ্ডে দেড় হাজার পৃষ্ঠায় রূপ নেয় সে ‘বৈঠক’ গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে কাজী নজরুল ইসলামের প্রসঙ্গ এসেছে কুড়িবার_কখনো ইঙ্গিতে, কখনো বিস্তৃতে। নজরুলের গান শোনা নিয়ে এক প্রশ্নোত্তরে তিনি ‘বিদ্রোহী’ প্রসঙ্গে জানান : ‘এই কবিতার চরম তারিফ করেছিলেন ‘ফিউচারিজম অব ইয়ং এশিয়া’ বইতে।’ প্রশ্নকর্তা সুবোধ কুমার ঘোষালের প্রশ্ন_’চরম তারিফটা কী?’-এর তাৎক্ষণিক উত্তর_’নজরুল আধুনিক বাংলা কাব্যের যুগপ্রবর্তক’।
      তিনি বলেছেন : “‘বিদ্রোহী’ চোখে পড়বামাত্রই নজরে ভেসে উঠলো আমার অতি প্রিয় কবি মার্কিন হুইটম্যান। বিদ্রোহী হুইটম্যান সম্বন্ধে ১৯১৫ সনে লিখেছিলেন ‘হুইটম্যান তো মানুষ নয়, সে যে ইয়াঙ্গিদের নায়াগ্রা ঝোরা।’ … সেই নায়াগ্রা ঝোরার ছন্দই মূর্তি পেয়েছে ‘বিদ্রোহী’তে।” মার্কিন কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের সঙ্গে বাংলার কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিতুলনার সূত্রও বোধ হয় এখান থেকে লাভ করা যেতে পারে। তাঁর মতে, ‘বিদ্রোহী’র ছন্দ হুইটম্যানকে ‘নকড়া-ছকড়া করে ছেড়ে দিয়েছে’। রবীন্দ্রনাথের বিদ্রোহী চেতনা প্রসঙ্গে আলাপকালে বিনয় কুমার জানান : “‘বিদ্রোহী’ দেখবামাত্র নজরুলের ভেতর আমি হুইটম্যান আর রবীন্দ্রনাথ দুজনকে একই সঙ্গে পাকড়াও করেছিলাম। তবু বুঝে নিলাম, লেখক বাপকা বেটা। বিংশ শতাব্দীর প্রথম কুরুক্ষেত্রের পরবর্তী অন্যতম যুগপ্রবর্তক বাঙালির বাচ্চা নজরুল।” বিনয় কুমার ব্যাখ্যা করেছেন নজরুলের ‘আমি’ আসলে কবি নজরুল নয়, যে পাঠক ‘বিদ্রোহী’ পড়ে সেই পাঠক নিজে। তাঁর মতে, ‘বিদ্রোহী’ হলো ‘ব্যক্তির উপনিষদ’। বিদ্রোহী আমির স্রোতে এমনভাবে বাঙালি ১৯২১ সালের আগে ভাসেনি বলেই তিনি উল্লেখ করেছেন। বিশ্বচিন্তায় নজরুলের আমিত্বকে বিনয় কুমার আবিষ্কার করেন বেদের ভেতর। অথর্ব বেদের ১২/১/৫৪ শ্লোকটির উল্লেখ করে বিনয় কুমার এর যে বাংলা অনুবাদ উচ্চারণ করেন তা এমন : ‘জেতা আমি বিশ্বজয়ী,/জন্ম আমার দিকে দিকে/বিজয় কেতন উড়াতে।’
      নজরুলের গান নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন স্বকালে যেমন অভিনবত্বের সঞ্চার ঘটিয়েছে, তেমনি আজকের গবেষকের কাছেও কম উদ্দীপক নয়। বিনয় কুমারের স্পষ্ট মূল্যায়ন_নজরুল কবিতা-গান বাংলার পাঁচালী-যাত্রাগানের-উত্তরাধিকার। পাড়াগাঁয়ের মেঠো-মিঠে শব্দের প্রতি নজরুলের আকর্ষণ বিনয় কুমারের প্রধান ভালোলাগা। নজরুলের কবিতা-গানের একনিষ্ঠ পাঠক বিনয় কুমারের পাঠতালিকায় যেমন ছিল সে কালের সাহিত্যসম্ভার, তেমনি তরুণ লেখক নজরুলের রচনাও। তাঁর মতে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে শুরু হয়েছে রৈবিক সুরের ধারার, আর তার বছর পঁচিশেক পর শুরু হয় নজরুলি ধারা। ‘এই দুই সুরের ধারা অনেকটা আলাদা আলাদাভাবে বাঙলার নরনারীকে তাতাতে-তাতাতে চলবে।’ বিনয় কুমার নজরুল সাহিত্যের পটভূমিও নির্দেশ করেছেন, নজরুল সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবও নির্দেশ করেছেন। কিন্তু তার পরও বলেছেন, ‘রাবীন্দ্রিক চিত্ত নজরুলের নয়’।

      সুদূর বার্লিন শহর থেকে প্রকাশিত The Futurism of Young Asia গ্রন্থ থেকে শুরু করে কাজী নজরুল ইসলাম এবং তাঁর সাহিত্য প্রসঙ্গে বিশ্বভ্রামণিক বাঙালি পণ্ডিত বিনয় কুমার সরকার আমৃত্যু আগ্রহ দেখিয়েছেন, যদিও নজরুল অনুরাগীদের তালিকায় তাঁর নাম উচ্চারিত হয়নি কখনো।

      লেখাটির লিন্ক এখানে

  7. Pingback: নজরুল তুমি নজরুল | প্রাত্যহিক পাঠ

  8. মাসুদ করিম - ১৪ জুলাই ২০১৪ (১২:৫৬ অপরাহ্ণ)

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.