তো ‘মৃত কবি’ ‘প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে তাঁর সৃষ্টি’ এসব যারা বলেন তারা ঠিক নজরুলকে দেখতে পান না, কেউ কেউ দেখতে চান না, কিন্তু আমরা যারা জানি, বাংলা কবিতার আধুনিকতার সঞ্চার নজরুলের কবিতাকে ঘিরেই ঘটেছিল, তারা কোনোভাবেই আবার মেনে নিতে পারি না, তাকেই বলা হয় ‘মুসলিম রবীন্দ্রনাথ’। কী ভয়ংকর আমাদের সমাজ আর কী বিভৎস আমাদের কবিতা ভাবনা, প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি চিন্তার সূত্রে, কী অমোঘ নিয়মে হিন্দুমুসলমান বিভেদটি ঢুকিয়ে দিতে না পারলে, কোনো এক অদৃশ্য শক্তি মনে হয় আমাদের লাঠিপেটা করে, আমরা আধুনিকতার কোনো কিছুই কোনোদিন আয়ত্ত করতে পারব না যতদিন না আমরা ব্যক্তি হয়ে অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপ্তিকে চিনতে না পারব। নজরুল আমাদের ভাষার ব্যাপ্তি বাড়িয়েছেন, কাজেই বাংলা ভাষা না মরলে তিনিও মরবেন না। নজরুল সৃষ্টিতে এমনই মুখর ছিলেন তার সৃষ্টি কোনোদিনই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। নজরুল কত বড় মাপের স্রষ্টা তার প্রমাণ বাংলা ভাষায় অসাধারণ সব গজল সৃষ্টি : “করুণ কেন অরুণ আঁখি / দাও গো সাকি দাও সরাব”। শুধু এই সফলতাই আর কিছু না হলেও বাংলায় নজরুলকে অমর করত। কিন্তু নজরুল আরো অনেক কিছু—দুর্দমনীয় নিঃসংশয় ইয়ার দোস্তের মতো এমন বাঁধনহারা বাঙালি চরিত্র আর কোথায়? এমন বিখ্যাত বিদ্রোহ বাংলা কবিতায় আর কি কখনো ঘটেছে? : “ আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, / মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস, / আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর! / আমি দুর্বার, / আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার।” আর প্রেম? নজরুলের প্রেমের গানের ও কবিতার সে পৃথিবী আমাদের অচেনা, কিন্তু সে এক সময় ছিল, সেই অতীতের প্রেমের সুর খোঁজার জন্য নজরুলে অবগাহনের মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই : “দুধে আলতা রঙ যেন তার / সোনার অঙ্গ ছেয়ে / সে ভিন গাঁয়েরই মেয়ে।” অথবা “ পউষের শূন্য মাঠে একলা বাটে চাও বিরহিণী / দুহুঁ হায় চাই বিষাদে মধ্যে কাঁদে তৃষ্ণা জলধি।” অথবা “ ওগো আমার দরদী / পাঠালে ঘূর্ণীদূতী ঝড় কপোতী বৈশাখে সখি / বরষায় সেই ভরসায় মোর পানে চায় জল ভরা নদী।”
কবি প্রণাম না করে, কবি বন্দনা না করে, কবির হাতে ইসলামের ঝান্ডা তুলে না দিয়ে, কবিকে পঠন-পাঠন যদি আমরা বাড়াতে পারি; রবীন্দ্রনাথ, মুসলিম রবীন্দ্রনাথ এইসব বিভেদ ভুলে গিয়ে যদি বাংলা ভাষার উৎকর্ষের দিকে নিজেদের নিয়োজিত করতে পারি—তবেই আমাদের সাহিত্যিক সামাজিক মানবিক বিবর্তনের দুর্দশা থেকে আমরা মুক্তি পাব। তা না হলে বিভেদের অতলে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন শুধুই নিরুদ্দেশ হবে।
মাসুদ করিম
লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৯ comments
রায়হান রশিদ - ২৮ মে ২০০৯ (১০:০৩ অপরাহ্ণ)
স্বীকার করতেই হচ্ছে রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম পোস্টের শিরোনাম দেখে।
শাহীন ইসলাম - ২৯ মে ২০০৯ (১০:৪৯ অপরাহ্ণ)
“বাংগালী মুসলমানের দূর্ভাগ্য, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ছিলেন”; কথাটি বল্ল আমার এক বন্ধু। যদি রবীন্দ্রনাথ মুসলামন হতেন … (interesting counterfactual )
রেজাউল করিম সুমন - ৫ জুন ২০০৯ (৯:০২ পূর্বাহ্ণ)
এই বাক্যের “আমরা” কারা? আর কারাই-বা নজরুলকে ‘মুসলিম রবীন্দ্রনাথ’ বলেন?
Mohammed Munim - ৩০ জুলাই ২০০৯ (৬:১৩ পূর্বাহ্ণ)
আমি বাংলা বা অন্য কোন সাহিত্যই তেমন পরিনি। নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক মূল্যায়নের যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু নজরুলকে ‘মুসলিম রবীন্দ্রনাথ’ হিসাবে দেখার ব্যাপারটি খুবই সত্যি। প্রয়াত হুমায়ুন আজাদের নজরুলের ব্যাপারে একটা উন্নাসিক ভাব ছিল, তিনি একবার বলেছিলেন বাংলাদেশের নজরুল গবেষকরা আসলে গবেষক নন, তাঁরা ‘নজরুলের মাজারের খাদেম’। আবার পশ্চিমবঙ্গের এক নজরুল গবেষক বললেন কোলকাতার হিন্দুপ্রধান লেখকসমাজ এবং সাহিত্য সম্পাদকেরা কখনোই নজরুলকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেননি এবং এখনো দিতে অনিচ্ছুক। নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষনা করার মাধ্যমে ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তাবাদকে establish করার চেষ্টা করেছিলেন জিয়াউর রহমান, এমন একটা theory পড়েছিলাম কোন এক পত্রিকায়। নজরুলকে বাংলাদেশে এনেছিলেন আওয়ামী লীগ সরকার, ১৯৭২ এ, জাতীয় কবি খেতাব কোন সরকার দিয়েছিল, সেটা ঠিক জানিনা। অসুস্থ নজরুল কোলকাতার এক বস্তিতে দারিদ্রে দিন কাটাচ্ছিলেন, এমন একটা তথ্যও দেখলাম এক ওয়েবসাইটে। সেটা কি তিনি মুসলিম বলে, নাকি ভারত সরকারের স্বভাবজাত লালফিতার কারনে, তা জানিনা (ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভুষন খেতাব দিয়েছিল, ১৯৬০ সালে)। এরশাদের এবং বিএনপি আমলে BTV তে নজরুলের গান্ধী টুপি পরা যে ছবিটি প্রায়ই দেখানো হতো, সেটি সম্ভবত তাঁকে একটি muslim identity দেওয়ার জন্যই।
এসব দেখলে নজরুল রেগে যেতেন সন্দেহ নেই, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে তাঁর রাগী লেখার সাথে আমাদের সবারই পরিচয় আছে। একটি পশ্চাদপদ সমাজের আরও পশ্চাদপদ অংশে তাঁর জন্ম, মাদ্রাসা শিক্ষা ছাড়া কিছু জোটেনি কপালে, সেখান থেকে এপিক উথ্থান। মাত্র ২৪ বছর বয়সে অসমসাহসী জবানবন্দী (অসংখ্য হিন্দু metaphor এ সাজানো জবানবন্দী)। তারপর জেলে দীর্ঘ অনশন করে প্রায় মরে যাওয়া। জেল থেকে বের হয়ে শুরু হলো নিরন্তর লড়াই, একই সাথে মুসলিম আর হিন্দু সাম্প্রদাযিকতার বিরুদ্বে। সেই সাথে চললো গান লেখা, প্রেমের গান, বিদ্রোহের গান, সমাজবদলের গান। জামাত শিবিরের অতি প্রিয় হামদ ও নাত, তাঁরই লেখা, আবার একই সাথে লিখেছেন কীর্তন (কখনো শু্নেছি বলে মনে পড়ে না)। মাত্র ৪২ বছর বয়সে চুপ হয়ে যাওয়া, কেন হলেন কে জানে (হুমায়ুন আজাদের মতে তাঁর সিফিলিস হয়েছিল)।
এমন প্রচন্ড পুরুষ, এমন প্রচন্ড প্রেমিক, এমন খেয়ালি মানুষ আমাদের মাঝে খুব বেশী আসেননি। কোন খেয়ালে বলেছিলেন ‘মসজিদের পাশে’ কবর দিতে, তাঁর কবর হলো মসজিদের পাশে, হয়ে গেলো নজরুলের মাজার। নজরুলকে পুরোপুরি বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই, আবার তাঁর প্রভাব এড়ানোর ক্ষমতাও নেই, তাই খন্ডিত নজরুল আমাদের কারো কাছে ‘মুসলিম রবীন্দ্রনাথ’ কারো কাছে ‘অপ্রাসঙ্গিক কবি’।
মাসুদ করিম - ২১ আগস্ট ২০০৯ (৮:৩১ পূর্বাহ্ণ)
আজকের প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে আহমদ কবির লিখেছেন : সম্প্রীতির পয়লা নম্বর।
মাসুদ করিম - ২৬ মে ২০১১ (১:০৯ পূর্বাহ্ণ)
প্রায় সতেরো আঠারো বছর পর গত কয়েকদিন ধরে আবার একনাগাড়ে নজরুল ইসলামের অনেকগুলো কবিতা পড়লাম। এখনো নজরুলের সেরা কবিতা ওই ‘বিদ্রোহী’কেই বলব।
ভাল লেগেছে ‘অ-কেজোর গান’ এই ছোট্ট কবিতাটি।
নজরুলের ‘আমার কৈফিয়ৎ’ আমার প্রিয় ভাষণ কবিতা।
‘প্রলয়োল্লাস’ প্রাণ খুলে আবৃত্তি করার মতো কবিতা।
‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ একটি জোরালো কবিতা।
‘প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়’ আমার একটি প্রিয় কালচেতনার কবিতা।
‘অভিশাপ’ কবিতাটিতে অস্তিত্বের ঘোষণা অসাধারণ।
‘শিকল-পরার গান’ কবিতাটিতে দেশাত্মবোধ অন্য মাত্রা পেয়েছে। এ ধরনের দেশাত্মবোধ নজরুল ছাড়া আর কারো মধ্যে আগে প্রকাশিত হয়নি।
প্রায় শ’ খানেক কবিতা পড়ে এই আটটি কবিতাই আমি বাছাই করতে পেরেছি।
মাসুদ করিম - ২৭ মে ২০১১ (১:৩৯ অপরাহ্ণ)
‘বিদ্রোহী’ নিয়ে শুধু আমিই অভিভূত নই,’বিদ্রোহী’ নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন বিশ্বপরিব্রাজক বাঙালি পণ্ডিত বিনয় কুমার সরকার (১৮৮৭-১৯৪৯)। তিনি বলতেন, নজরুলের ‘আমি’ আসলে কবি নজুরল নয় যেপাঠক ‘বিদ্রোহী’ পড়ে সেই পাঠক নিজে — ‘বিদ্রোহী’ হল ‘ব্যক্তির উপনিষদ’। আজকের কালের কণ্ঠের সাময়িকী ‘শিলালিপি’তে সুব্রত কুমার দাসের লেখা থেকে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্যের পাশাপাশি বিনয় কুমার সরকার ও এই অসাধারণ প্রতিভাশালী মানুষটির নজরুল ভাবনার পরিচয় পাওয়া যাবে।
লেখাটির লিন্ক এখানে।
Pingback: নজরুল তুমি নজরুল | প্রাত্যহিক পাঠ
মাসুদ করিম - ১৪ জুলাই ২০১৪ (১২:৫৬ অপরাহ্ণ)