১১ সেপ্টেম্বর ২০০৯: শহীদুল জহিরের মৃত্যুপর দ্বিতীয় জন্মবার্ষিকী

ডলু নদীতে এখন অনেক পানি, অথবা হয়তো পানি তেমন নাই, তবু ঐ দিক থেকে ভিজা হাওয়া বয়ে আসে, এবং এই হাওয়ার সঙ্গে আসে নদী পাড়ের বাঁশ ঝাড়ের ভেতরকার গুয়ের গন্ধ; তখন আহম্মদ তৈমুর আলি চৌধুরি তার বাসার সামনের রাস্তার পাশে একটা নিচা ইজি চেয়ারের ভিতরে পোটলার মত ঝুলে বসে থাকে। হয়তো সে রোদের ভেতর ঘুমিয়ে পড়ে, অথবা ডলু নদীর সকালের শুকনা গুয়ের গন্ধ সত্ত্বেও আরামে এমনি তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তখন সে তার ডান পা বাম পায়ের হাঁটুর ওপর তুলে দেয়, ফলে লুঙ্গি নিচের দিকে নেমে হাঁ হয়ে থাকে এবং ফাঁক দিয়ে বড় তালের আঁটির মত তার প্রাচীন হোলের বিচি দেখা যায়!

সাতকানিয়ার লোকেরা, যারা বাজারে যায় অথবা বাজার থেকে বোয়ালিয়া পাড়া কিংবা সতী পাড়ার দিকে ফেরে, তারা মসজিদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখে যে, তৈমুর আলি লুঙ্গি ফাঁক করে রেখে ইজি চেয়ারে বসে ঘুমায়, তাদের হয়তো মনে হয় যে, কত বড় বিচি, অথবা তারা হয়তো কিছু দেখে না, হয়তো ভাবে একই জিনিস প্রত্যেক দিন দেখার দরকার কি, তারা হয়তো কেবল ইজি চেয়ারের খোলের ভিতরে কুঁজো হয়ে বসা তার কাত হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকায়, সেখানে হয়তো একটা/দুইটা নীল কিংবা কালা মাছি বসে গালের লালা খায়; তারপর রোদ গরম হয়ে উঠলে সে ইজি চেয়ার ছেড়ে বাড়ির ভিতরে যায়, সেখানে তার স্ত্রী, বুড়া সমর্ত বানু নাস্তা বানিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে।

[…]
এ বিষয়ে তৈমুর আলি আর কিছু বলে না, এবং তখন মনে হয় যে, গোলেনুর হয়তো বিষয়টা জানে; তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে পুনরায় তার বিছানায় উঠে বসার চেষ্টা করে, তারপর শুয়ে থেকে বলে, আঁর বৌয়ের কথা পুছাললদ্দে না, বা’জি? ওর মায়তো মগ আছিলদে, আঁরা বার্মায় আছিলাম, কিন্তু আঁরা মগ ন আছিলাম। তখন তাকে হীরার আংটির কথা কথা জিজ্ঞেস করা হলে সে বলে যে, সে হীরার আংটির কথা জানে না, তবে বোঝা যায় সে সমর্তের উপরে খুশি না।
এক শালিখ দেখার পর এইসব শুরু হয়, সেদিন তৈমুর আলির কথা শুনে ইউসুফ অথবা নুরে আলম রাস্তা থেকে নেমে ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে গিয়ে সমর্ত বানুকে ডেকে আনে, গরীবের মেয়ে হওয়ায় সাহেবরা ডাকার কারণে সমর্ত কিছু জিজ্ঞাস না করেই এগিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়, বলে, অ’নে আঁরে ডাইক্কন কিয়া?
– আঁরে তুঁই চিনোদ্দে না?
– ন চিনি, কিয়া, অ’নে ক’ন?
– আঁই তুঁয়ারে, আঁরার বাড়িত খাম করিবার লাই রাইক্কম?
– আঁই খাম ন করি!
– কিয়া?
– ন কইরগম!

তৈমুর আলি চৌধুরির রাগ হয় এবং তার এই রাগ সমর্ত বানুর পুরুষ সঙ্গীটার উপর গিয়ে পড়ে; সে তখন পুরুষটা কে জানতে চায়, মরদ ফোয়া ওডে তিয়াই রইয়ে ইবা ক’ন? তখন সমর্ত বাঁকা কথা বলে, অ’নে জানিয়েরে কি করিবেনদে, ইবার নাম সুরত জামাল, জামাইলল্যা!
তৈমুর আলির কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় না, সে বলে, সুরত জামাল ইবা ক’ন? তুঁয়ার ভাই?
– নয়অ, কিয়া?
– এ্যাডে তোরা ক্যান করদ্দে?
– ক্যান কইরগম? কিছু ন করি!
– কিছু ন করি কি? দিনের বেলা ফ্রেম করদ্দে না ওডি?
– অ’নে ইন খতা আঁরে ন কইওন!
সেদিন তারপর তৈমুর আলি আর কথা না বলে চলে যায়, সুরত জামাল জইসস্যা করাতির সঙ্গে সমদর পাড়া, কাঞ্চনা অথবা মির্জাখিলে কাঠের গোলায় কাজ করে আর সুযোগ মত সমর্ত বানুকে ফুসলায়; তৈমুর আলি হয়তো বোকার মত এই কথা তার বাপ মওলা বকশকে বলে এবং তার কথা শুনে মওলা বকশ বুঝতে পারে না সে কি করবে, আঁই কি কইরগম?

শহীদুল জহিরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৯ বৃহষ্পতিবারের সংবাদ সাময়িকীর আয়োজনটা সুপারিশকৃত লিন্কে দিতে গিয়ে ফিরে এলাম, মনে হলো, একটা পোস্ট না হলে এই জন্মদিনটি পাঠক ঠিকমতো খেয়াল নাও করতে পারেন।

এইবার, এইখানে, এই চোরাস্রোতের টানে পড়ে যাদুবাস্তবতার প্রসঙ্গটা তুলতেই হয়, যদিও সাহিত্যে যাদুবাস্তবতার তত্ত্বটা প্রায় অবান্তর বলেই মনে হওয়া সম্ভব। একালে যাদুবাস্তববাদী লেখক বলে যাঁদের দেগে-দেওয়া হয়েছে, তাঁদের প্রায় সবাই কেন যে লাতিন আমেরিকা আর আফ্রিকা মহাদেশ থেকে মাথাচাড়া দিয়েছেন,[…] মার্কেজ চমৎকৃত করেছিলেন শহীদুল জহিরকে। তাঁর উপন্যাস যেমন চাঁদে-পাওয়া, তিনিও তেমনি কোনো তত্ত্বে নয়, একজন লেখকের রীতিতে আচ্ছন্ন।
বিস্তারিত পড়ুন, সোনা-মোড়া কথাশিল্প: শহীদুল জহির, লিখেছেন হাসান আজিজুল হক।

কেমন ছিলেন লেখক শহীদুল জহির বা আমলা মোঃ শহীদুল হক বা আটপৌরে শহীদ? মোটাদাগে বিভক্ত এ তিন স্বরূপেই বেশ কাছে থেকে তাঁকে খানিকটা দেখার, বোঝার সুযোগ নিয়তিনির্দিষ্ট কারণে ঘটেছে।
এখানে পড়ুন, আমাদের বন্ধু শহীদুল জহির, পূর্ণিমায় নিঃসঙ্গ পথিক, লিখেছেন ইলিয়াস আহমেদ

বহু বিলম্বে(বিশেষত তাঁর মৃত্যুর পরে) আবিষ্কৃত শহীদুল জহির কেন বাংলা সাহিত্যে বেঁচে থাকবেন? এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন বেশ ক’জন বরেণ্য সাহিত্য সমালোচক।
আরো পড়ুন, শহীদুল জহির মৃত্যু যাকে জন্ম দিয়েছে, মোহাম্মদ আবদুর রশীদ

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

৫ comments

  1. মাসুদ করিম - ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৯:১৪ পূর্বাহ্ণ)

    ‘সংবাদ’-এর আর্কাইভ কাজ করছে না। এ হল বাংলায় ব্লগ লেখার আরেক ঝামেলা। লিন্ক ব্লগের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, কিন্তু প্রায় সময় এসব নিয়ে বিভিন্ন রকম ঝামেলায় পড়তে হয়। আমি যখন ব্লগটি তৈরি করছিলাম তখন আর্কাইভ কাজ করছিল, কিন্তু যখন তুলতে যাব তখন দেখি আর আর্কাইভ কাজ করছে না। ভাবছি এখন থেকে আগে লিন্কগুলো সেভ করে ফেলব, তারপর ব্লগ লিখতে শুরু করব।

  2. মুয়িন পার্ভেজ - ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (১১:৪১ পূর্বাহ্ণ)

    সংবাদ-এর লিঙ্ক থেকে হাসান আজিজুল হকের লেখাটি (‌‘সোনা-মোড়া কথাশিল্প : শহীদুল জহির’) প’ড়ে ভালো লাগল। শহীদুলের উপন্যাস জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা-র প্রসঙ্গে হাসান বলছেন :

    তবে এখনো আমি কেন মার্কেজ আর যাদুবাস্তবতার কথা তুলছি না সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। দেখি না কতক্ষণ না তুলে পারা যায়।

    জহিরের কথা উঠলেই যাঁদের মার্কেজের মুখ মনে পড়ে, হাসানের আত্মবিশ্বাসী উক্তি তাঁদের ভাবাতেও পারে একবার।

  3. বিনয়ভূষণ ধর - ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৭:৩৮ অপরাহ্ণ)

    @মাসুদ করিম!
    আপনার লিখিত উক্ত পোস্টখানায় দেয়া সংবাদ পত্রিকার সংবাদ সাময়িকীর সবগুলো লিংক্ চমৎকারভাবে খোলা যাচ্ছে।
    ২০০৮সালের ৭ই নভেম্বর বিডিনিউজ২৪.কম-এর আর্টসের পাতায় কবি টোকন ঠাকুরও লিখেছিলেন কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির-কে নিয়ে…

  4. মাসুদ করিম - ২৭ জুলাই ২০১১ (১০:০৭ অপরাহ্ণ)

    শহীদুল জহিরের গল্প উপন্যাস নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট কথাশিল্পী অমর মিত্র কলকাতার দৈনিক পত্রিকা ‘সকালবেলা’র রবিবারের সাহিত্যপাতায় এক সংক্ষিপ্ত ভাষ্যে লিখছেন

    শহিদুল জহিরের একটি ৪৫ পাতার নভেলেট ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ আমি এনেছিলাম এগারো বছর আগে। পড়ে বিচলিত হয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের আরম্ভের ঢাকা শহরে মিলিটারি নামল, রাজাকারের দল ধীরে ধীরে সক্রিয় হল; বাস্তবতা যে ভাষা আর আঙ্গিকে এসেছিল এই নভেলেটটিতে, তেমন আগে পাইনি। ‘ডলু নদীর হাওয়া’ গল্পের বই। এই বইয়ের গল্পগুলি আমাকে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কয়েকটি গল্প পাঠের সুযোগ করে দিল। ইঁদুর-বিলাই খেলা, কোথায় পাব তারে, ডলু নদীর হাওয়া পড়লে ধরা যাবে তিনি কেমন লেখক ছিলেন। ক’বছর আগে এই গুণী লেখক প্রয়াত হয়েছেন। বাস্তবতা আর পরা-বাস্তবতার কোনও ভেদ থাকে না তাঁর লেখায়। ঢাকা শহরে কোথায় আছে ভূতের গলি, সেই গলি-মানুষের বেঁচে থাকার নানা কৃৎ-কৌশল, গোপন স্বপ্নের ফানুস, শক্তিমানের সঙ্গে বারবার হেরে গিয়েও আবার লড়াইয়ে নামতে বাধ্য হওয়া, কত কিছুই না আছে এই গল্পগুলিতে। ভূতের গলি কি এই কলকাতা শহরে নেই? কেন লিখতে পারলাম না তার কথা আমাদের মতো করে? হ্যাঁ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নেই, আমাদের সব বিপন্নতা আমাদের পিতৃপুরুষ বহন করেছিলেন। আমরা এই একঘেয়ে জীবনের কথাই বা কেন লিখব না, এই দোলাচালহীন জীবনের কথা? আমাদের গ্রামে-গঞ্জে জঙ্গলমহলে সেনাবাহিনী নেমেছে। সে কথা লিখবে কে? সালোয়া জুডুম বা অস্ত্র শিবিরের কথা?

    লিন্ক এখানে

  5. Azad Uddin Ahmed - ২০ মার্চ ২০১৪ (১:১৮ অপরাহ্ণ)

    23rd March is the 6th death anniversary of Shahidul Zahir. Do not know if there is any program on HIS life and works anywhere in the dhaka city. Please let me know if any one knows.

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.