বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্ম-চরিত-এ বৃটিশ আমলে বা পাকিস্থান আমলের শুরুতেও যে মধুমতীর কথা পড়া যায়, সেখানে একসময় স্টীমারও চলতো। আজ সেই মধুমতী বড় শান্ত, শীর্ণ ও মৃদু। তবু এই শান্ত মধুমতী পাড়ের মানুষগুলোই দেখালো কিভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়। 'জ্বলি ন উধিম কিত্তেই (রুখে দাঁড়াবো না কেন)’?

The article has compared the recent situation of Bangladesh with Ragnarok.

Ragnarok in Bangladesh

 গত বছরের জুলাই থেকেই বাংলাদেশ যেন এক অবর্ণনীয় ’রাগনারোক’-এর ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। নর্স পুরাণে বা উত্তর মেরুর স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলো খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণের আগে তাদের বহু  দেব-দেবীর ধর্মীয় পুরাণে ব্যবহৃত এই শব্দটির অর্থ হলো ‘চূড়ান্ত ধ্বংস’ বা ‘প্রলয়কাল।’ এ এমন এক ভয়ানক বিধ্বংসী সময় যখন নর্স পুরাণের সব বড় দেব-দেবী (ওদিন, থর, তির, ফ্রেইর, হিমদাল এবং লোকি) পরষ্পর সংঘাতে জড়িয়ে পড়বেন এবং ক্রমাগত প্রাকৃতিক দূর্যোগের মুখোমুখি হবে পৃথিবী। প্রথমে পুরো পৃথিবী পুড়ে যাবে এবং তারপর মাতা ধরিত্রী তলিয়ে যাবে জলের অতলে। তেরো শতকের নর্স সাহিত্যে বর্ণিত এই 'প্রলয়কাল’ বা ‘রাগনারোক’ সম্পর্কে বলা হচ্ছে:   ‘ভাইয়েরা যুদ্ধ করবে পরষ্পর,  হত্যা করবে একে অন্যকে আহা-  বোনের সন্তানেরা টুটাবে জ্ঞাতি-বন্ধন,  কুঠারযুগ, তরবারী যুগ-  ঢাল ভেঙে টুকরো টুকরো   বাতাসের যুগ, একটি নেকড়ে যুগ-   গোটা পৃথিবী হঠকারী হবার আগে   কোন মানুষেরই দয়া মায়া থাকবে না অন্য কারো প্রতি।‘    সম্ভবত: ৫৩৫-৫৩৬ অব্দে গোটা উত্তর ইউরোপে তাপমাত্রা ভয়াবহ কমে আসার সময়টি এই পুরাণকথায় বর্ণিত। ৬৫০ অব্দে নর্ডিক দেশগুলোয় সূচীত এক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেখানে নর্ডিক তাম্র যুগের শেষ

হয়। এই জলবায়ু পরিবর্তনের আগে নর্ডিক দেশগুলোয় জলবায়ু তুলনামূলক উত্তপ্ত এবং আরামদায়ক ছিল। প্রাচীন নর্স ভাষায় ‘ফিম্বুল উইন্টার' অর্থ তাই ভয়াবহ শীত। এই নিষ্করুণ শীতে নেমে আসবে অনি:শেষ রক্তক্ষয়ী আর ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ। নর্স পুরাণে এই সময়কে 'টোয়াইলাইট অফ দ্য গডস’ বা 'দেবতাদের গোধূলি ক্ষণ’-ও বলা হয়। উনিশ শতকে বিখ্যাত জার্মান সুরকার রিচার্ড ওয়াগনারের 'গটডের ডামেরাঙ’ সিম্ফনী এই 'রাগনারোক’-এর ধ্বংসলীলাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত, দূর্ভাগ্যজনক ভাবে হিটলার যাকে রণসঙ্গীত বানিয়েছিলেন।   বাংলায় প্রবল শীত নেই। কিন্ত  আছে মুষলধারে বর্ষণ। নেপোলিয়ন রাশিয়ার 'জেনারেল উইন্টারে’-র সাথে যুদ্ধে পারেননি আর পাকবাহিনী হেরে গেছিলো আমাদের 'জেনারেল মনসুন'-এর কাছে। অথচ, বাঙ্গালীর অনাদিকালের ভালবাসার এই শ্রাবণ মাসেই গত বছর মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিরোধী এক চক্র আপাত: মেষ চর্ম পরিধান করে তাদের নেকড়ের দাঁত-নখ লুকিয়ে এক ভয়ানক প্রলয়যজ্ঞে মাতে। আমরা পারিনি। ট্রয়ের ঘোড়ার ভেতর ঢুকে পড়া গ্রীক সৈন্যদের চাতুরীর কাছে যেমন পতন হয়েছিল এক সুপ্রাচীন সভ্যতার, আমরা তেমন ভাবেই হেরে গেছি। সেই দানবীয়, পাশব শক্তি ক্ষমতায় এসেই জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা বদল, শত শত হত্যা, রাষ্ট্রীয় নানা অবকাঠামো ধ্বংস,…

আজকের বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট এর পূর্ববর্তী ৫২টি বিজয় দিবস থেকে ভিন্ন। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার মাস আগে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়, রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে শুরু হয় একটা রিসেট বাটন প্রেস করার নিরলস প্রচেষ্টা। ধ্বংসপ্রায় মুক্তিযুদ্ধের বহু ভাস্কর্য এবং স্মৃতিচিহ্ন, যার বিবরণ ৯ ডিসেম্বরের সমকাল পত্রিকায় প্রতিবেদন থেকে খুবই পরিষ্কার। মুজিবনগরের স্মৃতিস্তম্ভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য চত্বর, অসংখ্য উদাহরণের মাত্র দুটি।

প্রথমেই বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই ৩০ লাখ শহীদ ও ৪ লাখ মা-বোনকে, যাদের অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। শ্রদ্ধা জানাই অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধাকে, যারা সমাজের বিভিন্ন স্তরে, নিজ-নিজ অবস্থান থেকে, যার যা আছে, তাই নিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখেছিলেন। সব সেক্টর কমান্ডারকে জানাই আমার শ্রদ্ধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সুদীর্ঘ ২৩/২৪ বছরের নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের ফসল। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালের নির্বাচন, ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধ (Epic Liberation War) ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১, বাংলাদেশ সময় বিকেল পাঁচটা এক মিনিটে দেশ হানাদার মুক্ত হয়, ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার দীর্ঘ পটভুমিতে রয়েছে ধারাবাহিক গণসম্পৃক্ত আন্দোলন। বিভিন্ন পর্যায়ে অগ্রপথিকের ভূমিকায় ছিলেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। একজন তরুন নেতা হিসেবে

সব আন্দোলনেই সরব উপস্থিতি ছিলো শেখ মুজিবুর রহমানের। বিশেষত ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে তাঁর ভূমিকা ছিলো সর্বাধিক সুস্পষ্ট এবং তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার অসন্দিগ্ধু প্রতিভূ। তাঁর অবর্তমানে স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস অত্যন্ত প্রতিকুল সময়ে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান। তাঁদের সবার প্রতি আমার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। আজকের বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট এর পূর্ববর্তী ৫২টি বিজয় দিবস থেকে ভিন্ন। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার মাস আগে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়, রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে শুরু হয় একটা রিসেট বাটন প্রেস করার নিরলস প্রচেষ্টা। ধ্বংসপ্রায় মুক্তিযুদ্ধের বহু ভাস্কর্য এবং স্মৃতিচিহ্ন, যার বিবরণ ৯ ডিসেম্বরের সমকাল পত্রিকায় প্রতিবেদন থেকে খুবই পরিষ্কার। মুজিবনগরের স্মৃতিস্তম্ভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য চত্বর, অসংখ্য উদাহরণের মাত্র দুটি। বিজয় দিবসের সরকারী ব্যানারে ২০২৪ জুলাই গণঅভুত্থানে নিহত আবু সাঈদের ছবি সাঁটানো কতটা শোভন, কতটা প্রাসঙ্গিক? আবু সাঈদ কতটা শ্রদ্ধা পেলেন। বিজয় মহিমা ও গৌরবকে ছোট করতে কেন এই ব্যর্থ প্রয়াস? এসব করে কি একাত্তরকে মুছে ফেলা যাবে? আর…

১৯৭২ সালের কিছু পুরোনো সংবাদপত্রের রিপোর্ট ঘাটতে ঘাটতে একটা জায়গায় এসে চোখ আটকে গেল। মন চলে গেল সেই ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তরুণ বাঙ্গালী অফিসার ক্যাপ্টেন কাদের। ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছেন বিয়ে করতে। হাতের মেহেদির রং তখনো উজ্জ্বল, ঠিক এমনই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর গণহত্যা শুরু হয়ে গেছে দেশ জুড়ে। প্রতিরোধের যুদ্ধও শুরু হয়ে গেছে। মাতৃভূমির এই চরম দুর্দিনে নিজের পক্ষ ও কর্তব্য স্থির করতে ক্যাপ্টেন কাদের এক মুহুর্তও দেরী করেননি। সাথের ছয় জন বাঙ্গালী সৈনিক নিয়ে রামগড় এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত ঘাঁটিতে আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। অত্যন্ত অসম সে যুদ্ধ, সবাই তাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করে, কিন্তু ক্যাপ্টেন কাদের সিদ্ধান্তে অটল। এই অদ্ভুত "পাগলামী"র পেছনে ক্যাপ্টেন কাদের এর যুক্তিটি তাহলে শুনুন। তিনি বললেন - এক একটি পশ্চিমা সেনা যদি কয়েক শ করে বাঙ্গালী হত্যা করে তাহলে এক একটি শত্রু সেনা খতম করার অর্থ হচ্ছে পুরো যুদ্ধের সময়টায় কয়েক হাজার বাঙ্গালীর জীবন রক্ষা করা। [সূত্র: দৈনিক বাংলা, ১৪ জানুয়ারী ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৮] নাম না জানা ছয় জন সহযোদ্ধা নিয়ে ক্যাপ্টেন কাদের ঠিকই রামগড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ করে তার পতন ঘটান। অসম সে যুদ্ধে নিজেরাও প্রাণ দিয়েছিলেন, কিন্তু বেঁচে থাকবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন আরও কয়েক হাজার মানুষকে। সেইসাথে রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন এই দেশটি স্বাধীন হবেই। এবার একটু বর্তমানে ফিরি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ভিন্ন আরেক ধরণের যুদ্ধে জড়িয়ে আছে এই প্রজন্ম। এই যুদ্ধ সবসময় চোখে দেখা যায় না, কিন্তু আর সব যুদ্ধের মতো এখানেও জড়িয়ে আছে ত্যাগ, সংগ্রাম আর পরিশ্রম। আর আছে ক্যাপ্টেন কাদেরের মতো সহজ কিন্তু পাগলামী কিছু যুক্তি আর হিসাব। যদি ভেবে থাকেন - ২২ জন যুদ্ধাপরাধীর তো রায় হয়ে গেছে, ৪ জনের তো ফাঁসী হয়ে গেছে, কয়েকজন তো বিচারাধীন অবস্থাতেই মরে গেছে - অতএব বিজয় অর্জিত হয়ে গেছে - তাহলে ভুল ভাবছেন। যুদ্ধটা এবার নতুন লেভেলে উন্নীত হয়েছে মাত্র। প্রতিটি যুদ্ধের মতো এই যুদ্ধেও সহযোদ্ধাদের উপস্থিতি দরকার। আপনি আমি সবাই জানি - আমাদের এই সহযোদ্ধারা কেউ বেতনভূক একটিভিস্ট বা কর্মচারী/কর্মকর্তা না, সবাই স্বেচ্ছাসেবক মাত্র। শুধু প্রাণের তাগিদে তারা এই লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন। কিন্তু…

পিটার কাস্টারসের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নেমে এসেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে, যে দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য সব কিছু তিনি ছেড়ে এসেছিলেন। জেনারেল জিয়া ঢাকা কারাগারের অভ্যন্তরে গোপন মার্শাল ল ট্রাইব্যুনালে প্রহসনের বিচার শুরু করে কর্নেল তাহেরসহ অনেকের বিরুদ্ধে। পিটার কাস্টার্সকেও গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হল। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা সাজানো হল তাঁর বিরুদ্ধে।

  কাটা বেঁছে কই মাছ খাওয়া আমাদের বাঙালিদের জন্যও সহজ কাজ নয়। এই ৬৬ বছর বয়সে কই মাছের দোপেয়াজা খেতে গিয়ে তা আবার মনে হলো। মন চলে গেল ৪১ বছর আগে, যখন আমার বয়সী পিটার কাস্টারসের সাথে পরিচয় হয়েছিল। ঢাকার একেবারে সাধারণ একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাব আমরা। পিটারই এখানে আমাকে নিয়ে এসেছেন। ভাত আর কই মাছের ঝোল তিনিই অর্ডার করেছেন। ‘কাটা বেঁছে আপনি খেতে পারবেন?’ পিটারের মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হলো। ‘চিন্তা নাই, ভালই পারি।’ অবাক হয়ে লক্ষ্য করি কি নিপুণ হাতে কাটা বেঁছে পিটার বাঙালির ভাত-মাছ খেলেন গভীর পরিতৃপ্তি নিয়ে। ‘পেট ঠিক থাকবে তো?’ আবারো পিটারের মুখে হাসি। ‘বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে এত ঘুরেছি, কত রকমের খাবার খেয়েছি। এখন আর সমস্যা হয় না। আপনাদের একটা প্রবাদ আছে না, “শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহাও তাহাই সয়।” আমারও সয়ে গেছে। কই মাছ আমার খুব প্রিয়।’ সমবয়সী আমরা বন্ধুর মতই ছিলাম। তারপরও আমাকে আপনি বলতেন পিটার। যতদূর মনে আছে, সবাইকে আপনি বলতেন। গায়ে সুতির পাজাম-পাঞ্জাবি পায়ে সাধারণ চপ্পল। এমন পোশাকেই দেখা যেত পিটারকে। ফর্সা পা মশার কামড়ে লাল হয়ে আছে। ‘ঘরে মশারি টানান না?’ ‘দেখুন গ্রামের গরিব মানুষের মশারি কিনবার সামর্থ্য নেই। আর আপনাদের দেশে মশার কামড়ে এখন আর ম্যালেরিয়া হয় না। তাই মশারি ব্যবহার করি না।’ পিটারের কথা শুনে স্তম্ভিত হই। বর্ষার পানিতে ভিজে ভিজে তাঁর খোলা পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে ঘা হয়েছে। পিটার দেখেছেন ক্ষেতে-খামারে কাঁদা মাটিতে কাজ করা গ্রামের গরিবদের পায়ে এমন ঘা। ‘সস্তা কোন ওষুধ নেই এই ঘা সারাতে?’ পিটারের এ প্রশ্নের উত্তরে জানাই পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট গুলিয়ে লাগালে সারতে পারে। তুত ডলে দিলেও কাজ হয়। তবে তা তো সব সময় পাওয়া যায় না। দিনকয় পরে তাঁর সাথে দেখা। ফর্সা পা রঙিন হয়ে আছে। উজ্জ্বল হাঁসি পিটারের মুখে। ‘দারুণ কাজে লেগেছে আপনার পরামর্শ। পারমাঙ্গানেটের রং লেগে থাকলেও ঘা ভাল হয়ে গেছে। ঠিক করেছি, এবার গ্রামে যাবার সময় পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট কিনে নিয়ে যাব। গরীবদের খুব কাজে লাগবে।’ গত ৩রা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ তারিখে নিজ দেশ হল্যান্ডের লেইডেনে তার বাড়িতে পিটার কাস্টারস ইহধাম ত্যাগ করেছেন। তারপর থেকে কতবার বসেছি তাঁর উপর কিছু লিখবো বলে।…

যুক্তিবাদী বিশ্বদৃষ্টির সাথে অন্ধ বিশ্বাসপ্রবণদের দ্বন্দ্বের সর্বশেষ শহিদ অভিজিৎ রায়। অভিজিৎদের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর হয়ে চলেছে কয়েক দশক ধরে। অথচ বাংলাদেশের কথা ছিল তার সবটুকু শক্তি দিয়ে সেক্যুলার মুক্তচিন্তার পরিবেশ গড়ে তোলার [. . .]

এক. আমেরিকা-প্রবাসী ড. অভিজিৎ রায় (জন্ম ১৯৭১) এবার বাংলাদেশে এসেছিলেন অমর একুশের বইমেলায় যোগ দিতে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামপন্থী আততায়ীরা তাঁকে বইমেলা সংলগ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। আততায়ীদের আক্রমণে অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন, যিনি নিজেও একজন ব্লগার এবং লেখিকা; ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ (২০০৭) গ্রন্থটি তাঁরই। কাছাকাছি স্থানেই এই ফেব্রুয়ারি মাসেই এক দশক আগে (২০০৪) মুক্তচিন্তার আরেক পথিকৃৎ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের উপরও ঠিক এভাবেই আক্রমণ করেছিল ইসলামপন্থী জঙ্গিরা। ছোটবেলা থেকে অভিজিতের বেড়ে ওঠা এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই। বিদেশে ডক্টরেট করতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এ তাঁর পড়াশোনা। সে বুয়েট ক্যাম্পাসও অদূরেই। আমেরিকায় একটি কোম্পানিতে কর্মরত প্রকৌশলী অভিজিৎ। পেশাগত জীবনের পাশাপাশি অভিজিৎ শুধু লিখেছেন। প্রচুর লিখেছেন। ব্লগ থেকে শুরু করে গবেষণা নিবন্ধ, মতামত কলাম থেকে শুরু করে বই। একক এবং দ্বৈত প্রকাশনা মিলিয়ে ড. অভিজিৎ রায়ের প্রকাশিত বইগুলো হলো: ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৫), ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ (২০০৭), ‘স্বতন্ত্র ভাবনা: মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি’ (২০০৮), ‘সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ (২০১০), ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (২০১১), ‘ভালোবাসা কারে কয়’ (২০১২), ‘বিশ্বাস ও দর্শন’ (২০১২), ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ (২০১৪) এবং ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে’(২০১৫)। অভিজিৎ রায়ের পিতা পদার্থবিজ্ঞানের পণ্ডিত অধ্যাপক অজয় রায়, বর্তমানে অবসরে। তরুণ বয়সে অজয় রায় নিজে সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এর পর সারা জীবন জ্ঞান সাধনা, এবং শিক্ষকতার মহান ব্রত নিয়ে মানুষ গড়ার পাশাপাশি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত করেছেন প্রগতিশীল-সেক্যুলার-বৈষম্যহীন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার কাজে। তাই, সন্তানহারা পিতার কাছেও এই দেশটির জবাবদিহিতার মুহূর্ত এটা। দুই. অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডে পুরো দেশ এখনও স্তম্ভিত। সামাজিক মিডিয়াসহ পুরো বাংলা ব্লগমণ্ডল প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে, অভিজিৎ রায়ের লেখাগুলো সর্বশক্তিতে পুনঃপ্রচারে নেমেছে অনেকগুলো প্ল্যাটফর্ম। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে, আর দেশের বাইরে লন্ডন, টরন্টো, নিউইয়র্ক, বার্লিন, সিডনি-তে মানব-বন্ধন থেকে শুরু করে অসংখ্য প্রতিবাদ সমাবেশ হয়ে গেছে গত কয়েক দিনে। অনলাইন আর অফলাইন এর প্রতিবাদে বারবার হ্যাশট্যাগে উঠে এসেছে: 'JeSuisAvijit', 'আমিই অভিজিৎ', 'আমরা অভিজিৎ'। সুষ্ঠু তদন্ত আর বিচারের পাশাপশি মুক্তচিন্তার অনুসারীদের নিরাপত্তার দাবিই এ মুহূর্তে মুখ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই অভিজিৎ রায়ের স্মৃতিস্তম্ভ দাবি নিয়েও এগিয়ে এসেছে সেক্টর কমান্ডার'স ফোরাম। ইতিমধ্যে হত্যার উস্কানিদাতা এক জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছে। তদন্ত চলছে। আমেরিকা থেকে এফবিআই-এর একটি তদন্ত…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.