বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্ম-চরিত-এ বৃটিশ আমলে বা পাকিস্থান আমলের শুরুতেও যে মধুমতীর কথা পড়া যায়, সেখানে একসময় স্টীমারও চলতো। আজ সেই মধুমতী বড় শান্ত, শীর্ণ ও মৃদু। তবু এই শান্ত মধুমতী পাড়ের মানুষগুলোই দেখালো কিভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়। 'জ্বলি ন উধিম কিত্তেই (রুখে দাঁড়াবো না কেন)’?

The article has compared the recent situation of Bangladesh with Ragnarok.

Ragnarok in Bangladesh

 গত বছরের জুলাই থেকেই বাংলাদেশ যেন এক অবর্ণনীয়রাগনারোক’-এর ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। নর্স পুরাণে বা উত্তর মেরুর স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলো খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণের আগে তাদের বহু  দেবদেবীর ধর্মীয় পুরাণে ব্যবহৃত এই শব্দটির অর্থ হলোচূড়ান্ত ধ্বংসবাপ্রলয়কাল। এমন এক ভয়ানক বিধ্বংসী সময় যখন নর্স পুরাণের সব বড় দেবদেবী (ওদিন, থর, তির, ফ্রেইর, হিমদাল এবং লোকি) পরষ্পর সংঘাতে জড়িয়ে পড়বেন এবং ক্রমাগত প্রাকৃতিক দূর্যোগের মুখোমুখি হবে পৃথিবী। প্রথমে পুরো পৃথিবী পুড়ে যাবে এবং তারপর মাতা ধরিত্রী তলিয়ে যাবে জলের অতলে। তেরো শতকের নর্স সাহিত্যে বর্ণিত এইপ্রলয়কালবারাগনারোকসম্পর্কে বলা হচ্ছে 

ভাইয়েরা যুদ্ধ করবে পরষ্পর, 

হত্যা করবে একে অন্যকে আহা- 

বোনের সন্তানেরা টুটাবে জ্ঞাতি-বন্ধন, 

কুঠারযুগ, তরবারী যুগ- 

ঢাল ভেঙে টুকরো টুকরো 

 বাতাসের যুগ, একটি নেকড়ে যুগ-  

গোটা পৃথিবী হঠকারী হবার আগে 

 কোন মানুষেরই দয়া মায়া থাকবে না অন্য কারো প্রতি।‘ 

 

সম্ভবত: ৫৩৫-৫৩৬ অব্দে গোটা উত্তর ইউরোপে তাপমাত্রা ভয়াবহ কমে আসার সময়টি এই পুরাণকথায় বর্ণিত। ৬৫০ অব্দে নর্ডিক দেশগুলোয় সূচীত এক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেখানে নর্ডিক তাম্র যুগের শেষ হয়। এই জলবায়ু পরিবর্তনের আগে নর্ডিক দেশগুলোয় জলবায়ু তুলনামূলক উত্তপ্ত এবং আরামদায়ক ছিল। প্রাচীন নর্স ভাষায় ‘ফিম্বুল উইন্টার’ অর্থ তাই ভয়াবহ শীত। এই নিষ্করুণ শীতে নেমে আসবে অনি:শেষ রক্তক্ষয়ী আর ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ। নর্স পুরাণে এই সময়কেটোয়াইলাইট অফ দ্য গডসবাদেবতাদের গোধূলি ক্ষণ’- বলা হয়। উনিশ শতকে বিখ্যাত জার্মান সুরকার রিচার্ড ওয়াগনারেরগটডের ডামেরাঙসিম্ফনী এইরাগনারোক’-এর ধ্বংসলীলাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত, দূর্ভাগ্যজনক ভাবে হিটলার যাকে রণসঙ্গীত বানিয়েছিলেন।  

বাংলায় প্রবল শীত নেই। কিন্ত  আছে মুষলধারে বর্ষণ। নেপোলিয়ন রাশিয়ারজেনারেল উইন্টারে’- সাথে যুদ্ধে পারেননি আর পাকবাহিনী হেরে গেছিলো আমাদেরজেনারেল মনসুন’এর কাছে। অথচ, বাঙ্গালীর অনাদিকালের ভালবাসার এই শ্রাবণ মাসেই গত বছর মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিরোধী এক চক্র আপাত: মেষ চর্ম পরিধান করে তাদের নেকড়ের দাঁতনখ লুকিয়ে এক ভয়ানক প্রলয়যজ্ঞে মাতে। আমরা পারিনি। ট্রয়ের ঘোড়ার ভেতর ঢুকে পড়া গ্রীক সৈন্যদের চাতুরীর কাছে যেমন পতন হয়েছিল এক সুপ্রাচীন সভ্যতার, আমরা তেমন ভাবেই হেরে গেছি। সেই দানবীয়, পাশব শক্তি ক্ষমতায় এসেই জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা বদল, শত শত হত্যা, রাষ্ট্রীয় নানা অবকাঠামো ধ্বংস, মাজারমন্দির ভাস্কর্য ধ্বংস, সূফীআহমদিয়াহিন্দুআদিবাসী খুন, অবাধ নারী নির্যাতন, অর্থনীতির বিনাশ সহ এক পৈশাচিক উন্মত্ততায় মেতেছে। ২০২৫এর ফেব্রুয়ারি মাসে তারা ঘোষণা দিয়ে ধানমন্ডি৩২ বঙ্গবন্ধুর বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর প্রচণ্ড দুঃসাহসে ৬৪ জেলায় পদযাত্রার নামে বঙ্গবন্ধুর আত্মার শহর গোপালগঞ্জে গিয়ে তাঁর সমাধিস্থান ধ্বংসের ঘোষণা দিলে ক্ষুব্ধ হয় গোপালগঞ্জবাসী। বারবারমুজিববাদ মুর্দাবাদশ্লোগান এবং প্রয়াত জাতির পিতার নামে অকথ্য সব কথা বলতে থাকলে গোপালগঞ্জের হিন্দুমুসলিম, নরনারীশিশু সহ সবাই প্রতিরোধে নামে। একদল অর্ধশিক্ষিত, প্রতিক্রিয়াশীল তরুণ যারা সংবিধানে নারী, আদিবাসী সহ যাবতীয় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠির জন্যইতিবাচক বৈষম্যপ্রথা রদের নামে গত বছর থেকে এ পর্যন্ত প্রমাণিত ৪৬ জন পুলিশ হত্যা সহ নানা দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়েছিল, তারা জনতার তীব্র প্রতিবাদের মুখে সেনাবাহিনীরআর্মড পার্সোনাল কারবাএপিএসগাড়িতে উঠে পালায়। কিন্ত প্রতিরোধের এই দুর্গ গড়তে গিয়ে নিহত হয় ১৯ থেকে ত্রিশের কোঠার পাঁচ জন যুবকঅবশ্য এটা নিতান্ত সরকারী হিসাব। বেসরকারী হিসাব বলছে ১২ থেকে ৫০ জনের মৃত্যুর কথা।  

 

ইরাণী চলচ্চিত্রকার সামিরা মখমলবাফের মতে, আজকের যুগের ডিজিটাল ক্যামেরা বা মোবাইল ফোনে তোলা ছবি রাষ্ট্রীয় বা কর্পোরেট সেন্সরশীপে আক্রান্ত মূলধারার গণমাধ্যমের বদলে সমাজের নিতান্ত প্রান্তিক মানুষটির হাতেও এনে দিয়েছে তার প্রতি প্রতিদিনের ঘটা নানা অন্যায়ের ছবি ভিডিও তুলে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেবার সুযোগ।দ্য ডেইলী স্টারবাপ্রথম আলো’- মত তথাকথিতস্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলো নির্লজ্জভাবে যখন গোটা গোপালগঞ্জ জেলার আবালবৃদ্ধবণিতাকেআওয়ামি লীগতথাঅপরাধীএবংগণহত্যাযোগ্যজাতীয় প্রতিবেদন ছেপে বিদ্যমান ইন্টেরিম সরকারের পদলেহন করছে, ’ফ্যাসিবাদচলে গিয়ে রাষ্ট্র যখনজামাতবাদ’- আক্রান্ত, সাধারণ মানুষের হাতে হাতে মোবাইলে তোলা অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ আমরা পাচ্ছি সামাজিক মাধ্যমে যা দেখে মনে হয় এখনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। কোথাও একটি সাত বছরের ছোট শিশুকে সাত/আট জন সেনাবাহিনীর জওয়ান মিলে নির্দয়ভাবে পেটাচ্ছে। ঐটুকু শিশু কি বোঝে? সে যদিজয় বাংলাজয় বঙ্গবন্ধুশ্লোগান দেয়ও যা এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাযুদ্ধের শ্লোগানও ছিল, তাকে অমন ভাবে মারতে হবে? যে সেনাবাহিনী একটা ছিনতাইকারী ধরতে পারেনা? আমরা দেখলাম গুলিতে বিদ্ধ যুবককে টানাহেঁচড়া করা হচ্ছে, কারো গায়ে লাথি মারছে সেনাবাহিনীর বুট। এই সেই সেনাবাহিনী যারা গত বছর মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে সহ রাষ্ট্রীয় যাবতীয় প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ নাশকতা, .৬২ ¯স্নাইপারে শিবিরকর্মীদের অব্যাহত মানুষ খুন এবং পুলিশের অসংখ্য কর্মকর্তাকে হত্যার পরও নির্বিকার ছিল জাতিসঙ্ঘ মিশনে মোটা বেতনের চাকরির লোভে। আজ তারাই প্রবল উন্মত্ততায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিরীহ মানুষের উপর। কি সত্যিই প্রলয়কাল? কি সত্যিইরাগনারোক?’  

 

শান্ত মধুমতী তবু জানে কীভাবে হতে হয়স্তালিনগ্রাদের লৌহ দুর্গ’! 

আজ জামাতের আমিরের সমাবেশ চলাকালীন সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ’জুলাইয়ের যে বাম বিপ্লবী (নী)’-রা তার রোগমুক্তি চেয়ে সমাজ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিচ্ছে, এই ভয়ানক স্বার্থপর, কুটিল মানুষগুলো গত বছর যাত্রাবাড়িতে মাদ্রাসার ছাত্রদের লড়াইকে মহিমান্বিত করতে ’যাত্রাবাড়ি আমাদের স্তালিনগ্রাদ’ বলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিল। মার্কিনীকালার রেভল্যুশনে এই ক্রিড়নকেরা আমাদের প্রবাল দ্বীপ বেচে দিয়ে, বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশন এনে এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের যাবতীয় পণ্যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক এনে একনয়া নীলদর্পণে মুখোমুখি করার খেলায় আছে। 

বছর না ঘুরতে যখন বাংলাদেশের জিডিপি অর্দ্ধেক এবং যে কোন দোকানে গেলে ফিসফিস করে, খেটে খাওয়া সেলসম্যান বা সেলসগার্ল বলবে যে সে বা তারা ’আপার জন্য অপেক্ষা করছে,’ তখন মধুমতীর মানুষ দেখালো কীভাবে গত পনেরো বছরের ’দানবীয় অর্থনীতি হতে থাকা বাংলাদেশ’-এর মানুষ হিসেবে প্রতিক্রিয়া-নৈরাজ্য-মৌলবাদের অন্ধকারের বিরুদ্ধে সত্যিকারের স্তালিনগ্রাদ হয়ে দাঁড়ানো যায়! 

বঙ্গবন্ধুরঅসমাপ্ত আত্মচরিত বৃটিশ আমলে বা পাকিস্থান আমলের শুরুতেও যে মধুমতীর কথা পড়া যায়, সেখানে একসময় স্টীমারও চলতো। আজ সেই মধুমতী বড় শান্ত, শীর্ণ মৃদু। তবু এই শান্ত মধুমতী পাড়ের মানুষগুলোই দেখালো কিভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়।জ্বলি উধিম কিত্তেই (রুখে দাঁড়াবো না কেন)’? ঢাকার তুলনামূলক আয়েশী মধ্যবিত্ত আমরা হতভম্ব হয়ে দেখলাম যে পথে সেনাবাহিনীর ট্যঙ্কের সামনে দিয়ে হোন্ডা চালাতে চালাতে অকুতোভয় যুবক বলছে, ’জয় বাংলাজয় বঙ্গবন্ধু।আমরা দেখলাম তিন বছরের শিশু তার টলটলে পায়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হাতে আঁকড়ে ধরেছে একটি প্রতিরোধের লাঠি। 

আমরা জানি না আগস্টে কি হতে যাচ্ছে! সেই লড়াইয়ে আমরা আমাদের সম্মান ও স্বাধীণতা রক্ষা করতে পারব কিনা জানি না, তবে বহু বহু দিন পরে মধুমতী পাড়ের নর-নারীও কি গাইবে:  

’…এক দিন ভীষণ লড়াই হয়েছিল, এই গাঁয়ে 

গুলির দাগে বীরের গাঁথা লেখা

দেয়ালেরই গায়ে গায়ে।।‘’ 

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

1 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
1
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.