এক.
আমেরিকা-প্রবাসী ড. অভিজিৎ রায় (জন্ম ১৯৭১) এবার বাংলাদেশে এসেছিলেন অমর একুশের বইমেলায় যোগ দিতে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামপন্থী আততায়ীরা তাঁকে বইমেলা সংলগ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। আততায়ীদের আক্রমণে অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন, যিনি নিজেও একজন ব্লগার এবং লেখিকা; ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ (২০০৭) গ্রন্থটি তাঁরই। কাছাকাছি স্থানেই এই ফেব্রুয়ারি মাসেই এক দশক আগে (২০০৪) মুক্তচিন্তার আরেক পথিকৃৎ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের উপরও ঠিক এভাবেই আক্রমণ করেছিল ইসলামপন্থী জঙ্গিরা।
ছোটবেলা থেকে অভিজিতের বেড়ে ওঠা এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই। বিদেশে ডক্টরেট করতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এ তাঁর পড়াশোনা। সে বুয়েট ক্যাম্পাসও অদূরেই। আমেরিকায় একটি কোম্পানিতে কর্মরত প্রকৌশলী অভিজিৎ। পেশাগত জীবনের পাশাপাশি অভিজিৎ শুধু লিখেছেন। প্রচুর লিখেছেন। ব্লগ থেকে শুরু করে গবেষণা নিবন্ধ, মতামত কলাম থেকে শুরু করে বই। একক এবং দ্বৈত প্রকাশনা মিলিয়ে ড. অভিজিৎ রায়ের প্রকাশিত বইগুলো হলো: ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৫), ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ (২০০৭), ‘স্বতন্ত্র ভাবনা: মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি’ (২০০৮), ‘সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ (২০১০), ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (২০১১), ‘ভালোবাসা কারে কয়’ (২০১২), ‘বিশ্বাস ও দর্শন’ (২০১২), ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ (২০১৪) এবং ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে’(২০১৫)।
অভিজিৎ রায়ের পিতা পদার্থবিজ্ঞানের পণ্ডিত অধ্যাপক অজয় রায়, বর্তমানে অবসরে। তরুণ বয়সে অজয় রায় নিজে সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এর পর সারা জীবন জ্ঞান সাধনা, এবং শিক্ষকতার মহান ব্রত নিয়ে মানুষ গড়ার পাশাপাশি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত করেছেন প্রগতিশীল-সেক্যুলার-বৈষম্যহীন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার কাজে।
তাই, সন্তানহারা পিতার কাছেও এই দেশটির জবাবদিহিতার মুহূর্ত এটা।
দুই.
অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডে পুরো দেশ এখনও স্তম্ভিত। সামাজিক মিডিয়াসহ পুরো বাংলা ব্লগমণ্ডল প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে, অভিজিৎ রায়ের লেখাগুলো সর্বশক্তিতে পুনঃপ্রচারে নেমেছে অনেকগুলো প্ল্যাটফর্ম। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে, আর দেশের বাইরে লন্ডন, টরন্টো, নিউইয়র্ক, বার্লিন, সিডনি-তে মানব-বন্ধন থেকে শুরু করে অসংখ্য প্রতিবাদ সমাবেশ হয়ে গেছে গত কয়েক দিনে। অনলাইন আর অফলাইন এর প্রতিবাদে বারবার হ্যাশট্যাগে উঠে এসেছে: ‘JeSuisAvijit’, ‘আমিই অভিজিৎ’, ‘আমরা অভিজিৎ’। সুষ্ঠু তদন্ত আর বিচারের পাশাপশি মুক্তচিন্তার অনুসারীদের নিরাপত্তার দাবিই এ মুহূর্তে মুখ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই অভিজিৎ রায়ের স্মৃতিস্তম্ভ দাবি নিয়েও এগিয়ে এসেছে সেক্টর কমান্ডার’স ফোরাম। ইতিমধ্যে হত্যার উস্কানিদাতা এক জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছে। তদন্ত চলছে। আমেরিকা থেকে এফবিআই-এর একটি তদন্ত দলও সংশ্লিষ্ট হয়েছে তদন্তে সাহায্যের জন্য।
‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্যের পাদদেশে শেষ শ্রদ্ধা ও বিদায় জানানোর পর অভিজিৎ রায়ের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিক্ষা ও গবেষণার উদ্দেশ্যে সম্প্রদান করা হয়েছে। অভিজিতের বরাবরই সেটাই ইচ্ছা ছিল, বেঁচে থাকতেও এ নিয়ে গণসচেতনতা তৈরির জন্য কাজ করেছেন তিনি। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকেও সেই অন্তিম ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
তিন.
মুক্তচিন্তার গতিকে স্তব্ধ করতে লাগাতার আক্রমণের ফলে দীর্ঘ মৃত্যুমিছিলে সাম্প্রতিকতম সংযোজন অভিজিৎ।। কিন্তু এ কি শুধু মৃত্যুরই মিছিল? মুক্তচিন্তার বিপরীতে, লেখনীর জবাব পাল্টা লেখনী দিয়ে দিতে ব্যর্থ পশ্চাৎপদ চিন্তার নৈতিক পরাজয়কেও চিহ্নিত করে এই হত্যাকাণ্ড। যে চিন্তা, ভাবমূর্তি, বা ‘অনুভূতি’-র নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সহিংসতার আশ্রয় নিতে হয়, শান্তিপ্রিয়-যুক্তিবাদী লেখক আর চিন্তাবিদদের কলম চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার পথ বেছে নিতে হয় — সে চিন্তা বা ভাবধারা যে কার্যত অচল এবং বাতিল তাও প্রমাণ করে এই হত্যাকাণ্ড। এ প্রসঙ্গে অভিজিতের নিজেরই একটি অমোঘ উক্তি আজ স্মরণীয়: ‘ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মতো জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি করছি।’ তিনি আরও লিখেছিলেন, পরাজয় নিশ্চিত জানলে মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধ শক্তি ‘সব সময়ই … শেষ কামড় দিতে চেষ্টা করে… এগুলো আলামত… তাদের অন্তিম সময় সমাগত।… বিজয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী।’
অভিজিৎদের কেন মরতে হয়, সেটা বোঝা কঠিন নয়। অভিজিৎ লিখতেন বিজ্ঞানের প্রান্তিক বিষয়গুলো নিয়ে, মহাবিশ্ব আর সেখানে আমাদের অস্তিত্বের বাস্তবতা নিয়ে, ধর্ম ও কুসংস্কার নিয়ে, বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে। সেখানে শুধু একটি ধর্ম নয়, সকল ধর্মের গোঁড়ামি অসঙ্গতি আর অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে তাঁর কলম ছিল সোচ্চার। তিনি লিখতেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর এর ওপর বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী নিয়ত যে আঘাতগুলো আসছে তা নিয়ে। শুধু নিজে ভেবে, এবং নিজে লিখেই তিনি দায় সারেননি, যদিও শুধু অতটুকু করলেও তা কোনো অর্থেই কম করা হতো না। তিনি জানতেন — সাংগঠনিক উদ্যোগ, সংঘবদ্ধ আন্দোলন, আর সমমনা মানুষদের মধ্যে যোগাযোগের গুরুত্ব কতখানি। এবং সেই সঙ্গে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের সাথে আলোচনার পরিসর তৈরির গুরুত্বও। বিভিন্ন সংঘবদ্ধ উদ্যোগেরও অংশ ছিলেন তিনি।
আজ থেকে এক যুগেরও বেশি আগে (২০০১) ইন্টারনেটে ‘মুক্তমনা’ নামে একটা ইয়াহু গ্রুপের মাধ্যমে সে সময়ের সর্ববৃহৎ আলোচনার প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছিলেন অভিজিৎ। বাংলাদেশ বা ভারতবর্ষের সাথে নাড়ির টান আছে এমন হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ ছিল সেটি। সব ধরনের চিন্তার এবং ধ্যান-ধারণার মানুষের উপস্থিতিতে সে ফোরামে আলোচনার ঝড় বয়ে যেত দিনরাত। মত-বিনিময় এবং পরমত-সহিষ্ণুতা চর্চার এক কেন্দ্র ছিল সেটি। এর পাশাপাশি বাংলা ব্লগ আন্দোলন যখন পূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে ওঠে, তখন আত্মপ্রকাশ করে ‘মুক্তমনা’ কমিউনিটি ব্লগ। অভিজিৎ নিজের কমিউনিটি ব্লগ মুক্তমনার পাশাপাশি অন্যান্য কমিউনিটি ব্লগ ‘সচলায়তন’, ‘মুক্তাঙ্গন: নির্মাণ ব্লগ’-এও নিয়মিত লিখতেন। ২০০৯ সালে যখন বাংলাদেশের মাটিতে ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধের বিচারের আয়োজন শুরু হল, তখন বিশ্বব্যাপী গড়ে তোলা সহায়ক নাগরিক নেটওয়ার্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ)’-এ বিচারপ্রার্থী আর সব ব্লগ এবং সংগঠনের পাশাপাশি সক্রিয় অংশীদার হয়ে উঠেছিলেন অভিজিৎ এবং তাঁর ব্লগ প্ল্যাটফর্ম ‘মুক্তমনা’। স্বাধীনতার সপক্ষের প্রগতিশীল বাংলা ব্লগগুলোর সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলা কমিউনিটি ব্লগ এলায়েন্স (বিসিবিএ)’-এরও সক্রিয় অংশীদার ছিলেন অভিজিৎ এবং তাঁর ‘মুক্তমনা’ ব্লগ। ব্লগার রাজীব হত্যার পর, নাস্তিকতার অপরাধে চার ব্লগার গ্রেফতারের পর — সম্মিলিতভাবে এই বাংলা ব্লগগুলো তখন দ্বিধাহীন স্পষ্ট নির্ভীক অবস্থান নিয়েছিল মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে, অবস্থান নিয়েছিল সরকারের ইসলামপন্থী তোষণ-নীতির বিরুদ্ধে। সেটা এমনই এক সময় ছিল, যখন এমনকি প্রগতিশীল সেক্যুলার অনেক মানুষও ইসলামপন্থীদের ভয়ে মুখ খোলেননি।
অভিজিৎ রায়কে জানতে এবং তাঁর হত্যার কারণটি বুঝতে তাঁর সাংগঠনিক সত্তাটিকেও তাই মনে রাখা দরকার।
চার.
রাষ্ট্রের রাজনীতিতে আমরা বিভিন্ন দল ও আদর্শের সার্বক্ষণিক প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্ব দেখতে পাই। কেউ একে ব্যাখ্যা করেন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হিসেবে, কেউ করেন পুঁজির আধিপত্যের দ্বন্দ্ব হিসেবে, কেউ করেন ‘সব-আছে’ আর ‘সব-হারা’-র দ্বন্দ্ব হিসেবে। সময়কে বোঝার এই প্রতিটি ব্যাখ্যারই নিশ্চয়ই নিজ নিজ তাত্ত্বিক বলিষ্ঠতার (এবং সীমাবদ্ধতার) দিক রয়েছে। এগুলোর পাশাপাশি আরও এক ধরনের দ্বন্দ্বও রয়েছে, যুক্তিবাদী বিশ্বদৃষ্টির সাথে অন্ধ বিশ্বাসপ্রবণদের দ্বন্দ্ব। তাত্ত্বিকরা বলবেন, এই শেষোক্ত দ্বন্দ্বটিও আসলে পূর্বোক্ত দ্বন্দ্বগুলোরই ফল বা লক্ষণ মাত্র। হতেই পারে। কিন্তু এও মনে হয় যে এই শেষোক্ত দ্বন্দ্বটিও অতি বিশিষ্ট, প্রবলভাবে বিরোধাত্মক, যা বারবার মুক্তচিন্তার পক্ষের সব মানুষের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রীতিমতো অস্তিত্ব-সংকটের দ্যোতক হয়ে।
এই বিরোধাত্মক দ্বন্দ্ব যে যুদ্ধের জন্ম দেয়, সে যুদ্ধেও আর সব যুদ্ধের মতোই শহিদ আছে, আততায়ীও আছে। এবং পক্ষগুলোর মৌলিক ধরনটাই এমন যে, সেখানে শহিদদের সবাই শুধু প্রথম দলেই, আর আততায়ীরা সব অন্য দলে। যেখানে প্রথম দল বিশ্বাস করে তাদের পেনসিল, কলম, ক্যামেরা এবং বাকশক্তির ব্যবহারে, আর দ্বিতীয় দল তাদের আধিপত্য বিস্তারে বেছে নেয় মারণাস্ত্র — সেখানে মৃতদের সবাই যে প্রথম দলেই থাকবে, এ আর বিচিত্র কী!
আমরা জানি, বদ্ধ চিন্তার হাতে নিপীড়িতদের মিছিলে ইতিহাস জুড়ে ছড়িয়ে আছেন ব্রুনো, কোপার্নিকাস, হাইপেশিয়া, গ্যালিলিও, সক্রেটিসরা। কিন্তু অনেকেই মনে রাখি না, বাংলাদেশেও সেই তালিকা কিন্তু কম দীর্ঘ নয়। জন্মসময় জুড়ে মুক্তচিন্তার জন্য প্রাণ দিয়েছেন ১৯৭১-এর শহিদ বুদ্ধিজীবীরা। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাণ দিয়েছেন অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস, অধ্যাপক এম তাহের, অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলাম, প্রভাষক জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া, ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, আশরাফুল আলম, আরিফ রায়হান দ্বীপ, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুক, জগৎজ্যোতি তালুকদার, জাফর মুন্সী। অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ব্যক্তিরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছেন জীবননাশের হুমকি। জঙ্গি মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন কবি শামসুর রাহমান। আক্রান্ত হয়েছেন ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন। হুমকির শিকার হয়েছেন ড. আহমদ শরীফ। দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিন।
তালিকাটি দেখলে বুঝতে অসুবিধে হয় না অভিজিৎ রায় একক নন, তাঁরা প্রত্যেকেই মুক্তচিন্তা আর স্বাধীনতার বিরুদ্ধবাদীদের কাছে কত বড় ভয়ের কারণ। ভয় জাগান বলেই তাঁদের প্রাণ দিতে হয়।
পাঁচ.
অভিজিৎদের মৃত্যু পরোয়ানা আসলে ঠিক কোন্ মুহূর্তে জারি হয়েছিল? হত্যার ধারালো অস্ত্র হয়তো শেষ পর্যন্ত এক দল প্রতিহিংসাপরায়ণ জঙ্গিই হাতে তুলে নিয়েছে, কিন্তু এই মৃত্যু পরোয়ানায় আসলে বহু মানুষের স্বাক্ষর, যা স্বাক্ষরিত হয়েছে কয়েক দশক ধরে। ইসলামি পাকিস্তানের বিপরীতে সেক্যুলার স্বশাসিত বাংলাদেশ গড়তে গিয়ে যখন মুক্তিযুদ্ধ হলো, সে যুদ্ধে পরাজয়ের ঠিক আগে পাক-বাহিনী আর তাদের তাঁবেদার ইসলামপন্থীরা এক মরণ কামড় দিয়েছিল। যে দেশটি স্বাধীন হতে যাচ্ছে সে দেশটিতে সেক্যুলার মুক্তচিন্তার নেতৃত্ব যাঁরা দিতে পারবেন, সেই সব লেখক-কবি-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে আর ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেয়া হয়েছিল, কিন্তু সে অবস্থান স্বাধীনতার চার বছর যেতে না যেতেই পাকিস্তানপন্থী পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের পর সংবিধান সংশোধন করে পরিবর্তন করা হল। এর পর সামরিক সরকারের আমলে আরেক দফা সংবিধান সংশোধন, ঘোষিত হল ইসলামই ‘রাষ্ট্রধর্ম’। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকে না, তবুও বাংলাদেশ নামের সেক্যুলার রাষ্ট্রটির উপর একটা নির্দিষ্ট ধর্মকেই আরোপ করা হয়েছিল হীন রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য। আর এই গোটা সময়টায় রাজনীতির নামে দেশব্যাপী লক্ষাধিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে সরকারি এবং বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতায়, ধর্ম-ভিত্তিক এক অসম শিক্ষাব্যবস্থার ডালপালাও বিস্তারের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে সারা দেশব্যাপী।
স্বাধীনতার মূল্য দিতে গিয়ে যে দেশটি এত বড়ো ত্যাগ স্বীকার করেছে, সে বাংলাদেশের তো কথা ছিল তার সবটুকু শক্তি দিয়ে সেক্যুলার মুক্তচিন্তার পরিবেশ গড়ে তোলার। সেটা হল না। প্রতিটি সরকারের আমলে রাষ্ট্র ও প্রচলিত রাজনীতির বিনিয়োগ হয়েছে ইতিহাসের উল্টো পথটিতেই।
২০১১ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এক রায় (পঞ্চম সংশোধনী মামলায়) কিন্তু সুযোগ তৈরি করেছিল সংবিধানকে সেই ১৯৭২-এর ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়ার। একদিন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল যে দলটি, সেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারই এই সুযোগটুকু গ্রহণ করলো না। বরং উল্টো এই আমলেই দেখেছি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে অসহনশীল একটি ধারাকে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সমমর্যাদা দেয়া হল। অন্যদিকে, সংবিধানে ব্লাসফেমির কোনো বিধান না থাকলেও তথ্য প্রযুক্তি আইন (২০০৬)-এ ৫৭ ধারার মতো এক ভয়ংকর বিধানে যা বলা হল, তা কার্যত ব্লাসফেমি বা ধর্মবিরুদ্ধতার শাস্তিমূলক আইন। এই বিধান বলে ধর্মীয় ‘অনুভূতিতে’ আঘাত দেয়া হলে তার শাস্তি ১৪ বছরের কারাদণ্ড কিংবা এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা, কিংবা দুই-ই। এই আইনের অপপ্রয়োগ আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যখন চার ব্লগারকে হয়রানিমূলকভাবে গ্রেফতার করা হল ২০১৩ সালে। নিতান্তই ব্যক্তির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, সংস্কৃতি আর চিন্তাপদ্ধতি নির্ভর এই ‘ধর্মানুভূতি’-র প্রয়োগ-মানদণ্ড নিয়েই ক্রিস্টোফার হিচেন্স একসময় সংশয় জানিয়েছিলেন — ‘ধর্মানুভূতিতে আঘাতের এই সীমারেখা আসলে কে নির্ধারণ করবে?’ নিকটবর্তী দেশ পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের মধ্যযুগীয় প্রয়োগ দেখার পর হিচেন্সের সে প্রশ্নের তাৎপর্য বুঝতে দূরে কোথাও যাওয়ার দরকার পড়ে না।
অভিজিৎরা মুক্তচিন্তার চর্চা করেছেন। তাঁদের মৃত্যু পরোয়ানাও এই ভাবেই জারি হয়ে চলেছে, ধাপে ধাপে। এই ধারার সামনে দাঁড়িয়েই আমাদের ভাবতে হবে — কেমন বাংলাদেশ আমরা চাই। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ সেই ভবিষ্যৎ স্থির করে দেবে। তবে আমরা যারা অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে একসময় একসাথে হেঁটেছি, তারা একটা কথা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই: এই হত্যাকাণ্ড মুক্তচিন্তার বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনটিকে সাময়িকভাবে স্তম্ভিত করলেও স্থবির করতে পারবে না। বরং তা সমমনা মানুষদের সংকল্পকেই আরো দৃঢ় করবে। ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হব’ — ঠিক যেমন লিখে গিয়েছিলেন লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা, মুক্তিযুদ্ধের আরেক মুক্তমনা শহিদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান।
(‘মুক্তমনা ব্লগ‘-এর পাশাপাশি ‘মুক্তাঙ্গন: নির্মাণ ব্লগ’-এ যুগপৎভাবে প্রকাশিত। লেখাটি ঈষৎ পরিমার্জিত আকারে ১২ মার্চ ২০১৫ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ‘অথচ সবটুকু শক্তি দিয়ে মুক্তি তৈরির কথা ছিল’ শিরোনামে)

জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক ‘ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম’ (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।
