যুক্তিবাদী বিশ্বদৃষ্টির সাথে অন্ধ বিশ্বাসপ্রবণদের দ্বন্দ্বের সর্বশেষ শহিদ অভিজিৎ রায়। অভিজিৎদের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর হয়ে চলেছে কয়েক দশক ধরে। অথচ বাংলাদেশের কথা ছিল তার সবটুকু শক্তি দিয়ে সেক্যুলার মুক্তচিন্তার পরিবেশ গড়ে তোলার [. . .]

এক.

আমেরিকা-প্রবাসী ড. অভিজিৎ রায় (জন্ম ১৯৭১) এবার বাংলাদেশে এসেছিলেন অমর একুশের বইমেলায় যোগ দিতে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামপন্থী আততায়ীরা তাঁকে বইমেলা সংলগ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। আততায়ীদের আক্রমণে অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন, যিনি নিজেও একজন ব্লগার এবং লেখিকা; ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ (২০০৭) গ্রন্থটি তাঁরই। কাছাকাছি স্থানেই এই ফেব্রুয়ারি মাসেই এক দশক আগে (২০০৪) মুক্তচিন্তার আরেক পথিকৃৎ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের উপরও ঠিক এভাবেই আক্রমণ করেছিল ইসলামপন্থী জঙ্গিরা।

ছোটবেলা থেকে অভিজিতের বেড়ে ওঠা এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই। বিদেশে ডক্টরেট করতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এ তাঁর পড়াশোনা। সে বুয়েট ক্যাম্পাসও অদূরেই। আমেরিকায় একটি কোম্পানিতে কর্মরত প্রকৌশলী অভিজিৎ। পেশাগত জীবনের পাশাপাশি অভিজিৎ শুধু লিখেছেন। প্রচুর লিখেছেন। ব্লগ থেকে শুরু করে গবেষণা নিবন্ধ, মতামত কলাম থেকে শুরু করে বই। একক এবং দ্বৈত প্রকাশনা মিলিয়ে ড. অভিজিৎ রায়ের প্রকাশিত বইগুলো হলো: ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৫), ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ (২০০৭), ‘স্বতন্ত্র ভাবনা: মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি’ (২০০৮), ‘সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ (২০১০), ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (২০১১), ‘ভালোবাসা কারে কয়’ (২০১২), ‘বিশ্বাস ও দর্শন’ (২০১২), ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ (২০১৪) এবং ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে’(২০১৫)।

অভিজিৎ রায়ের পিতা পদার্থবিজ্ঞানের পণ্ডিত অধ্যাপক অজয় রায়, বর্তমানে অবসরে। তরুণ বয়সে অজয় রায় নিজে সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এর পর সারা জীবন জ্ঞান সাধনা, এবং শিক্ষকতার মহান ব্রত নিয়ে মানুষ গড়ার পাশাপাশি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত করেছেন প্রগতিশীল-সেক্যুলার-বৈষম্যহীন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার কাজে।

তাই, সন্তানহারা পিতার কাছেও এই দেশটির জবাবদিহিতার মুহূর্ত এটা।

দুই.

অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডে পুরো দেশ এখনও স্তম্ভিত। সামাজিক মিডিয়াসহ পুরো বাংলা ব্লগমণ্ডল প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে, অভিজিৎ রায়ের লেখাগুলো সর্বশক্তিতে পুনঃপ্রচারে নেমেছে অনেকগুলো প্ল্যাটফর্ম। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে, আর দেশের বাইরে লন্ডন, টরন্টো, নিউইয়র্ক, বার্লিন, সিডনি-তে মানব-বন্ধন থেকে শুরু করে অসংখ্য প্রতিবাদ সমাবেশ হয়ে গেছে গত কয়েক দিনে। অনলাইন আর অফলাইন এর প্রতিবাদে বারবার হ্যাশট্যাগে উঠে এসেছে: ‘JeSuisAvijit’, ‘আমিই অভিজিৎ’, ‘আমরা অভিজিৎ’। সুষ্ঠু তদন্ত আর বিচারের পাশাপশি মুক্তচিন্তার অনুসারীদের নিরাপত্তার দাবিই এ মুহূর্তে মুখ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই অভিজিৎ রায়ের স্মৃতিস্তম্ভ দাবি নিয়েও এগিয়ে এসেছে সেক্টর কমান্ডার’স ফোরাম। ইতিমধ্যে হত্যার উস্কানিদাতা এক জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছে। তদন্ত চলছে। আমেরিকা থেকে এফবিআই-এর একটি তদন্ত দলও সংশ্লিষ্ট হয়েছে তদন্তে সাহায্যের জন্য।

‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্যের পাদদেশে শেষ শ্রদ্ধা ও বিদায় জানানোর পর অভিজিৎ রায়ের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিক্ষা ও গবেষণার উদ্দেশ্যে সম্প্রদান করা হয়েছে। অভিজিতের বরাবরই সেটাই ইচ্ছা ছিল, বেঁচে থাকতেও এ নিয়ে গণসচেতনতা তৈরির জন্য কাজ করেছেন তিনি। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকেও সেই অন্তিম ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।

তিন.

মুক্তচিন্তার গতিকে স্তব্ধ করতে লাগাতার আক্রমণের ফলে দীর্ঘ মৃত্যুমিছিলে সাম্প্রতিকতম সংযোজন অভিজিৎ।। কিন্তু এ কি শুধু মৃত্যুরই মিছিল? মুক্তচিন্তার বিপরীতে, লেখনীর জবাব পাল্টা লেখনী দিয়ে দিতে ব্যর্থ পশ্চাৎপদ চিন্তার নৈতিক পরাজয়কেও চিহ্নিত করে এই হত্যাকাণ্ড। যে চিন্তা, ভাবমূর্তি, বা ‘অনুভূতি’-র নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সহিংসতার আশ্রয় নিতে হয়, শান্তিপ্রিয়-যুক্তিবাদী লেখক আর চিন্তাবিদদের কলম চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার পথ বেছে নিতে হয় — সে চিন্তা বা ভাবধারা যে কার্যত অচল এবং বাতিল তাও প্রমাণ করে এই হত্যাকাণ্ড। এ প্রসঙ্গে অভিজিতের নিজেরই একটি অমোঘ উক্তি আজ স্মরণীয়: ‘ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মতো জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি করছি।’ তিনি আরও লিখেছিলেন, পরাজয় নিশ্চিত জানলে মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধ শক্তি ‘সব সময়ই … শেষ কামড় দিতে চেষ্টা করে… এগুলো আলামত… তাদের অন্তিম সময় সমাগত।… বিজয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী।’

অভিজিৎদের কেন মরতে হয়, সেটা বোঝা কঠিন নয়। অভিজিৎ লিখতেন বিজ্ঞানের প্রান্তিক বিষয়গুলো নিয়ে, মহাবিশ্ব আর সেখানে আমাদের অস্তিত্বের বাস্তবতা নিয়ে, ধর্ম ও কুসংস্কার নিয়ে, বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে। সেখানে শুধু একটি ধর্ম নয়, সকল ধর্মের গোঁড়ামি অসঙ্গতি আর অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে তাঁর কলম ছিল সোচ্চার। তিনি লিখতেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর এর ওপর বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী নিয়ত যে আঘাতগুলো আসছে তা নিয়ে। শুধু নিজে ভেবে, এবং নিজে লিখেই তিনি দায় সারেননি, যদিও শুধু অতটুকু করলেও তা কোনো অর্থেই কম করা হতো না। তিনি জানতেন — সাংগঠনিক উদ্যোগ, সংঘবদ্ধ আন্দোলন, আর সমমনা মানুষদের মধ্যে যোগাযোগের গুরুত্ব কতখানি। এবং সেই সঙ্গে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের সাথে আলোচনার পরিসর তৈরির গুরুত্বও। বিভিন্ন সংঘবদ্ধ উদ্যোগেরও অংশ ছিলেন তিনি।

আজ থেকে এক যুগেরও বেশি আগে (২০০১) ইন্টারনেটে ‘মুক্তমনা’ নামে একটা ইয়াহু গ্রুপের মাধ্যমে সে সময়ের সর্ববৃহৎ আলোচনার প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছিলেন অভিজিৎ। বাংলাদেশ বা ভারতবর্ষের সাথে নাড়ির টান আছে এমন হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ ছিল সেটি। সব ধরনের চিন্তার এবং ধ্যান-ধারণার মানুষের উপস্থিতিতে সে ফোরামে আলোচনার ঝড় বয়ে যেত দিনরাত। মত-বিনিময় এবং পরমত-সহিষ্ণুতা চর্চার এক কেন্দ্র ছিল সেটি। এর পাশাপাশি বাংলা ব্লগ আন্দোলন যখন পূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে ওঠে, তখন আত্মপ্রকাশ করে ‘মুক্তমনা’ কমিউনিটি ব্লগ। অভিজিৎ নিজের কমিউনিটি ব্লগ মুক্তমনার পাশাপাশি অন্যান্য কমিউনিটি ব্লগ ‘সচলায়তন’, ‘মুক্তাঙ্গন: নির্মাণ ব্লগ’-এও নিয়মিত লিখতেন। ২০০৯ সালে যখন বাংলাদেশের মাটিতে ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধের বিচারের আয়োজন শুরু হল, তখন বিশ্বব্যাপী গড়ে তোলা সহায়ক নাগরিক নেটওয়ার্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ)’-এ বিচারপ্রার্থী আর সব ব্লগ এবং সংগঠনের পাশাপাশি সক্রিয় অংশীদার হয়ে উঠেছিলেন অভিজিৎ এবং তাঁর ব্লগ প্ল্যাটফর্ম ‘মুক্তমনা’। স্বাধীনতার সপক্ষের  প্রগতিশীল বাংলা ব্লগগুলোর সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলা কমিউনিটি ব্লগ এলায়েন্স (বিসিবিএ)’-এরও সক্রিয় অংশীদার ছিলেন অভিজিৎ এবং তাঁর ‘মুক্তমনা’ ব্লগ। ব্লগার রাজীব হত্যার পর, নাস্তিকতার অপরাধে চার ব্লগার গ্রেফতারের পর — সম্মিলিতভাবে এই বাংলা ব্লগগুলো তখন দ্বিধাহীন স্পষ্ট নির্ভীক অবস্থান নিয়েছিল মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে, অবস্থান নিয়েছিল সরকারের ইসলামপন্থী তোষণ-নীতির বিরুদ্ধে। সেটা এমনই এক সময় ছিল, যখন এমনকি প্রগতিশীল সেক্যুলার অনেক মানুষও ইসলামপন্থীদের ভয়ে মুখ খোলেননি।

অভিজিৎ রায়কে জানতে এবং তাঁর হত্যার কারণটি বুঝতে তাঁর সাংগঠনিক সত্তাটিকেও তাই মনে রাখা দরকার।

চার.

রাষ্ট্রের রাজনীতিতে আমরা বিভিন্ন দল ও আদর্শের সার্বক্ষণিক প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্ব দেখতে পাই। কেউ একে ব্যাখ্যা করেন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হিসেবে, কেউ করেন পুঁজির আধিপত্যের দ্বন্দ্ব হিসেবে, কেউ করেন ‘সব-আছে’ আর ‘সব-হারা’-র দ্বন্দ্ব হিসেবে। সময়কে বোঝার এই প্রতিটি ব্যাখ্যারই নিশ্চয়ই নিজ নিজ তাত্ত্বিক বলিষ্ঠতার (এবং সীমাবদ্ধতার) দিক রয়েছে। এগুলোর পাশাপাশি আরও এক ধরনের দ্বন্দ্বও রয়েছে, যুক্তিবাদী বিশ্বদৃষ্টির সাথে অন্ধ বিশ্বাসপ্রবণদের দ্বন্দ্ব। তাত্ত্বিকরা বলবেন, এই শেষোক্ত দ্বন্দ্বটিও আসলে পূর্বোক্ত দ্বন্দ্বগুলোরই ফল বা লক্ষণ মাত্র। হতেই পারে। কিন্তু এও মনে হয় যে এই শেষোক্ত দ্বন্দ্বটিও অতি বিশিষ্ট, প্রবলভাবে বিরোধাত্মক, যা বারবার মুক্তচিন্তার পক্ষের সব মানুষের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রীতিমতো অস্তিত্ব-সংকটের দ্যোতক হয়ে।

এই বিরোধাত্মক দ্বন্দ্ব যে যুদ্ধের জন্ম দেয়, সে যুদ্ধেও আর সব যুদ্ধের মতোই শহিদ আছে, আততায়ীও আছে। এবং পক্ষগুলোর মৌলিক ধরনটাই এমন যে, সেখানে শহিদদের সবাই শুধু প্রথম দলেই, আর আততায়ীরা সব অন্য দলে। যেখানে প্রথম দল বিশ্বাস করে তাদের পেনসিল, কলম, ক্যামেরা এবং বাকশক্তির ব্যবহারে, আর দ্বিতীয় দল তাদের আধিপত্য বিস্তারে বেছে নেয় মারণাস্ত্র — সেখানে মৃতদের সবাই যে প্রথম দলেই থাকবে, এ আর বিচিত্র কী!

আমরা জানি, বদ্ধ চিন্তার হাতে নিপীড়িতদের মিছিলে ইতিহাস জুড়ে ছড়িয়ে আছেন ব্রুনো, কোপার্নিকাস, হাইপেশিয়া, গ্যালিলিও, সক্রেটিসরা। কিন্তু অনেকেই মনে রাখি না, বাংলাদেশেও সেই তালিকা কিন্তু কম দীর্ঘ নয়। জন্মসময় জুড়ে মুক্তচিন্তার জন্য প্রাণ দিয়েছেন ১৯৭১-এর শহিদ বুদ্ধিজীবীরা। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাণ দিয়েছেন অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস, অধ্যাপক এম তাহের, অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলাম, প্রভাষক জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া, ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, আশরাফুল আলম, আরিফ রায়হান দ্বীপ, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুক, জগৎজ্যোতি তালুকদার, জাফর মুন্সী। অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ব্যক্তিরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছেন জীবননাশের হুমকি। জঙ্গি মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন কবি শামসুর রাহমান। আক্রান্ত হয়েছেন ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন। হুমকির শিকার হয়েছেন ড. আহমদ শরীফ। দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিন।

তালিকাটি দেখলে বুঝতে অসুবিধে হয় না অভিজিৎ রায় একক নন, তাঁরা প্রত্যেকেই মুক্তচিন্তা আর স্বাধীনতার বিরুদ্ধবাদীদের কাছে কত বড় ভয়ের কারণ। ভয় জাগান বলেই তাঁদের প্রাণ দিতে হয়।

পাঁচ.

অভিজিৎদের মৃত্যু পরোয়ানা আসলে ঠিক কোন্ মুহূর্তে জারি হয়েছিল? হত্যার ধারালো অস্ত্র হয়তো শেষ পর্যন্ত এক দল প্রতিহিংসাপরায়ণ জঙ্গিই হাতে তুলে নিয়েছে, কিন্তু এই মৃত্যু পরোয়ানায় আসলে বহু মানুষের স্বাক্ষর, যা স্বাক্ষরিত হয়েছে কয়েক দশক ধরে। ইসলামি পাকিস্তানের বিপরীতে সেক্যুলার স্বশাসিত বাংলাদেশ গড়তে গিয়ে যখন মুক্তিযুদ্ধ হলো, সে যুদ্ধে পরাজয়ের ঠিক আগে পাক-বাহিনী আর তাদের তাঁবেদার ইসলামপন্থীরা এক মরণ কামড় দিয়েছিল। যে দেশটি স্বাধীন হতে যাচ্ছে সে দেশটিতে সেক্যুলার মুক্তচিন্তার নেতৃত্ব যাঁরা দিতে পারবেন, সেই সব লেখক-কবি-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে আর ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেয়া হয়েছিল, কিন্তু সে অবস্থান স্বাধীনতার চার বছর যেতে না যেতেই পাকিস্তানপন্থী পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের পর সংবিধান সংশোধন করে পরিবর্তন করা হল। এর পর সামরিক সরকারের আমলে আরেক দফা সংবিধান সংশোধন, ঘোষিত হল ইসলামই ‘রাষ্ট্রধর্ম’। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকে না, তবুও বাংলাদেশ নামের সেক্যুলার রাষ্ট্রটির উপর একটা নির্দিষ্ট ধর্মকেই আরোপ করা হয়েছিল হীন রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য। আর এই গোটা সময়টায় রাজনীতির নামে দেশব্যাপী লক্ষাধিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে সরকারি এবং বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতায়, ধর্ম-ভিত্তিক এক অসম শিক্ষাব্যবস্থার ডালপালাও বিস্তারের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে সারা দেশব্যাপী।

স্বাধীনতার মূল্য দিতে গিয়ে যে দেশটি এত বড়ো ত্যাগ স্বীকার করেছে, সে বাংলাদেশের তো কথা ছিল তার সবটুকু শক্তি দিয়ে সেক্যুলার মুক্তচিন্তার পরিবেশ গড়ে তোলার। সেটা হল না। প্রতিটি সরকারের আমলে রাষ্ট্র ও প্রচলিত রাজনীতির বিনিয়োগ হয়েছে ইতিহাসের উল্টো পথটিতেই।

২০১১ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এক রায় (পঞ্চম সংশোধনী মামলায়) কিন্তু সুযোগ তৈরি করেছিল সংবিধানকে সেই ১৯৭২-এর ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়ার। একদিন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল যে দলটি, সেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারই এই সুযোগটুকু গ্রহণ করলো না। বরং উল্টো এই আমলেই দেখেছি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে অসহনশীল একটি ধারাকে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সমমর্যাদা দেয়া হল। অন্যদিকে, সংবিধানে ব্লাসফেমির কোনো বিধান না থাকলেও তথ্য প্রযুক্তি আইন (২০০৬)-এ ৫৭ ধারার মতো এক ভয়ংকর বিধানে যা বলা হল, তা কার্যত ব্লাসফেমি বা ধর্মবিরুদ্ধতার শাস্তিমূলক আইন। এই বিধান বলে ধর্মীয় ‘অনুভূতিতে’ আঘাত দেয়া হলে তার শাস্তি ১৪ বছরের কারাদণ্ড কিংবা এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা, কিংবা দুই-ই। এই আইনের অপপ্রয়োগ আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যখন চার ব্লগারকে হয়রানিমূলকভাবে গ্রেফতার করা হল ২০১৩ সালে। নিতান্তই ব্যক্তির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, সংস্কৃতি আর চিন্তাপদ্ধতি নির্ভর এই ‘ধর্মানুভূতি’-র প্রয়োগ-মানদণ্ড নিয়েই ক্রিস্টোফার হিচেন্স একসময় সংশয় জানিয়েছিলেন — ‘ধর্মানুভূতিতে আঘাতের এই সীমারেখা আসলে কে নির্ধারণ করবে?’ নিকটবর্তী দেশ পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের মধ্যযুগীয় প্রয়োগ দেখার পর হিচেন্সের সে প্রশ্নের তাৎপর্য বুঝতে দূরে কোথাও যাওয়ার দরকার পড়ে না।

অভিজিৎরা মুক্তচিন্তার চর্চা করেছেন। তাঁদের মৃত্যু পরোয়ানাও এই ভাবেই জারি হয়ে চলেছে, ধাপে ধাপে। এই ধারার সামনে দাঁড়িয়েই আমাদের ভাবতে হবে — কেমন বাংলাদেশ আমরা চাই। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ সেই ভবিষ্যৎ স্থির করে দেবে। তবে আমরা যারা অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে একসময় একসাথে হেঁটেছি, তারা একটা কথা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই: এই হত্যাকাণ্ড মুক্তচিন্তার বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনটিকে সাময়িকভাবে স্তম্ভিত করলেও স্থবির করতে পারবে না। বরং তা সমমনা মানুষদের সংকল্পকেই আরো দৃঢ় করবে। ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হব’ — ঠিক যেমন লিখে গিয়েছিলেন লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা, মুক্তিযুদ্ধের আরেক মুক্তমনা শহিদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান।

(‘মুক্তমনা ব্লগ‘-এর পাশাপাশি ‘মুক্তাঙ্গন: নির্মাণ ব্লগ’-এ যুগপৎভাবে প্রকাশিত। লেখাটি ঈষৎ পরিমার্জিত আকারে ১২ মার্চ ২০১৫ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ‘অথচ সবটুকু শক্তি দিয়ে মুক্তি তৈরির কথা ছিল’ শিরোনামে)

Je Suis Avijit | আমিই অভিজিৎ | আমরা অভিজিৎ

Je Suis Avijit | আমিই অভিজিৎ | আমরা অভিজিৎ

বিচারের দাবীতে সকল প্রগতিশীল সংগঠনের সমাবেশ | ৯ মার্চ ২০১৫, লন্ডন

বিচারের দাবিতে সকল প্রগতিশীল সংগঠনের সমাবেশ | ৯ মার্চ ২০১৫, লন্ডন

ঢাকায় প্রতিবাদী মশাল মিছিল। ২৭ ফেব্রুয়ারী - এএফপি

অভিজিৎ রায়কে হত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় মশাল মিছিল। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। এএফপি

রায়হান রশিদ

জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।

১২ comments

  1. মাসুদ করিম - ১৬ মার্চ ২০১৫ (১২:৩০ পূর্বাহ্ণ)

    অভিজিৎ রায়ের বাবা অজয় রায় কিন্তু বলছেন অভিজিৎ রায়ের জন্ম ১৯৭১ সালে।

    কুমিল্লা সোনামুড়ায়। আমরা প্রায় ২৫/৩০ জন পাকিস্তানিকে মেরে ফেলেছি। এটা তখনকার সময় বাংলাদেশ যে আমাদের বেতার ছিল, সেখানে প্রচারিত হয়েছিল। তো রণাঙ্গনে সরে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে তো স্ত্রী ছিলেন আর মা ছিলেন। তো ওদেরকে তখন আপার আসামে আমার বড়ভাই ছিলেন, তিনি ওয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কমিশনে একজন বড় অধিকর্তা এবং বড় প্রকৌশলী। তো আমরা ওর ওখানে গেলাম। ওর ওখানে গিয়ে, জায়গাটার নাম হচ্ছে আপার আসামের শিব সাগর জেলার নাজিরা, তো নাজিরাতে গেলাম। তখন মাই ওয়াইফ ওয়াজ ক্যারিয়িং অ্যাট দ্যাট টাইম (উনি তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন)। চলে গেলাম। তারপরে রণাঙ্গনে একজন স্বেচ্ছাসেবক আমাকে বলল, ‘স্যার একটা খবর আছে, শুভ খবর আছে, আমরা খবর পেয়েছি নাজিরায় আপনার যে স্ত্রী এবং মাকে রেখে এসছিলেন, আপনার একটি পুত্র সন্তান হয়েছে’। তো সেইটা হচ্ছে তোমার ১৯৭১ সনের ১২ই সেপ্টেম্বর, রোববার সকাল বেলা ১২টা ৪২ মিনিটে। আমার এই ছেলের জন্ম। এখানে একটা নাজিরা ম্যাটারনিটি হোমের বার্থ সার্টিফিকেট আছে।

    ১৯৭২ সার্টিফিকেটের ব্যাপার হবে, আমার যেমন সার্টিফিকেটে ১৯৭৩ – আমারও জন্ম ১৯৭১এ। আমার মনে হয় ড. অভিজিৎ রায় (জন্ম ১৯৭১) লেখাই উচিত হবে, প্রয়োজনে অজয় রায়কে জিজ্ঞেস করে আমরা আরো একবার নিশ্চিত হয়ে নিতে পারি।

    • রায়হান রশিদ - ১৬ মার্চ ২০১৫ (২:২৯ পূর্বাহ্ণ)

      একমত মাসুদ ভাই। জন্ম-তারিখটা নিশ্চিত হতে পারলে ভাল হয়।

    • রায়হান রশিদ - ১৬ মার্চ ২০১৫ (২:৩১ পূর্বাহ্ণ)

      মূল পোস্টে পাল্টে নিয়েছি: “জন্ম ১৯৭১”

  2. অদিতি কবির - ১৬ মার্চ ২০১৫ (৪:৪৭ পূর্বাহ্ণ)

    উনিশটা দিন পার হয়ে গেল! কোন সুরাহা নেই।

    • রায়হান রশিদ - ১৭ মার্চ ২০১৫ (৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ)

      খুব দ্রুত সুরাহা হয়ে যাবে সেটা অবশ্য আশা করিনি, কিন্তু তদন্তের শেষ যতটা সম্ভব দ্রুত হয়ে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়াটা জরুরী।

  3. গোলাম রব্বানী - ১৭ মার্চ ২০১৫ (২:৫৬ পূর্বাহ্ণ)

    চারদিকে প্রতিদিন কেমন গরম হয়ে উঠছে। ঘটনাগুলো সব দ্রুত ঘটে যাচ্ছে। সারা পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের ভেতরেও মেরুকরণ শুরু হয়ে গেছে। সমস্যা যেদিকে গড়াচ্ছে মনে হচ্ছে: মানুষ নতুন কিছুর খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। মুক্তির পথযাত্রায় অভিজিতকে মাড়িয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের। এ ভার অসহ্য।

  4. অবিশ্রুত - ২০ মার্চ ২০১৫ (৫:৫৪ অপরাহ্ণ)

    ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’- এভাবেই বলে যাচ্ছি আমরা ক্রমাগত। কিন্তু যাদের পা চালিয়ে আশান্বিত করার কথা, তারা যেন গোঁ ধরে আছেন। কিছুতেই পা চালাবেন না। এই তো আজও তাই হতাশা প্রকাশ করেছেন অজয় রায়, বলেছেন, ”অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে শিবিরের কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতাসহ কয়েকটি বিষয়ে নিজের অনুসন্ধানের তথ্য তিনি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তুলে ধরেছেন। কিন্তু প্রায় এক মাস হতে চললেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি।” পুরো সংবাদটি এমন :

    বুয়েটের শিক্ষক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীর বিষয়ে আবারও নিজের সন্দেহের কথা প্রকাশ করে অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের তদন্তে অগ্রগতি না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন যুক্তিবাদি এই লেখকের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়।
    তিনি বলেছেন, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে শিবিরের কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতাসহ কয়েকটি বিষয়ে নিজের অনুসন্ধানের তথ্য তিনি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তুলে ধরেছেন। কিন্তু প্রায় এক মাস হতে চললেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
    শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার মিলনায়তনে এক নাগরিক সমাবেশে নিজের হতাশার কথা তুলে ধরেন পদার্থবিদ অজয় রায়, যার দুটি গবেষণা নোবেল কমিটিতে আলোচিত হয়।
    গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে হামলায় নিহত হন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী প্রকৌলশী অভিজিৎ রায়, যিনি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ব্লগ মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা। এবারের মেলায় তার দুটি বই প্রকাশিত হয়।
    অভিজিতের স্ত্রী ব্লগার রাফিদা আহমেদ বন্যাও ওই হামলায় আহত হন। এরইমধ্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেছেন।
    সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলা প্রাঙ্গণে একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অভিজিৎ ও তার স্ত্রীর অবস্থান এবং পরে বিজ্ঞান লেখকদের এক আড্ডায় তাদের যোগ দেওয়া নিয়ে নিজের অনুসন্ধানের তথ্য নাগরিক সমাবেশে তুলে ধরেন অধ্যাপক অজয় রায়।
    বুয়েটের শিক্ষক ফারসীম মান্নানই সেদিন অভিজিত-বন্যাকে ওই আড্ডায় ডেকে নিয়েছিলেন বলে তিনি জানান।
    “ফারসীম মান্নানের গতিবিধি ও তার চরিত্র আমার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ মনে হচ্ছে। যিনি ফেইসবুকের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আলোচনার ব্যবস্থা করেন। যাতে ১১ জন আমন্ত্রিত অতিথির মধ্যে অনাহুত ৪/৫ জনের উপস্থিতি ছিল।”
    ‘অনাহুত’ সেই ব্যক্তিরা শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উল্লেখ করে অভিজিতের বাবা বলেন, “তাদেরকে বুয়েটের ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ওই শিক্ষকই ডেকে আলোচনাস্থলে এনেছে বলে তারা বলেছে।”
    অজয় রায় বলেন, অভিজিতের বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের অনুষ্ঠানে সাড়ে ৬টা থেকে ৭টা পর্যন্ত অবস্থান করেন তার ছেলে ও পুত্রবধূ। পরে ছায়াবিথী ও অবসর প্রকাশনীর স্টলের মাঝে ত্রিপল বিছানো উন্মুক্ত স্থানে সেই আড্ডায় বসেন তারা।
    “ওখানে রাত ৮টা পর্যন্ত আলোচনা হয়, যেটা ফেইসবুকের মাধ্যমে ফারসীম মান্নান আয়োজন করে। জিরো টু ইনফিনিটি ও পাই নামে দুটো সংগঠনের লোকজনও উপস্থিত ছিল সেখানে। তাদের সঙ্গে শিবিরের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।”
    জিরো টু ইনফিটির সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন সেই ‘অনাহুত’ লোকদের গালাগাল করেন বলেও উল্লেখ করেন অজয় রায়।
    “কারা আমন্ত্রণ করেছে জানতে চাইলে অনাহুতরা দাবি করে, স্যার [ফারসীম মান্নান] তাদের ডেকেছেন। এগুলো অভিজিত জানত না। অভিজিতকে দেখে তারা সেখান থেকে উঠে চলে যায়।”
    ওই আলোচনার পর রাত সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরে অভিজিতকে হত্যা করা হয়।
    অজয় রায় বলেন, ‘বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে’ অনুসন্ধান চালিয়ে পাওয়া এসব তথ্য তিনি গোয়েন্দা সংস্থাকেও জানিয়েছেন।
    “সিইডি, গোয়েন্দা বিভাগ ও ডিবিকে সবার নামসহ সার্বিক বিষয়টি জানানো হয়েছে। এরপর অনেকদিন, এক মাসের মতো সময় পার হতে যাচ্ছে; দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয় না।”
    এ অনুসন্ধানে যুক্ত এফবিআই সদস্যদের সব বিষয় জানিয়ে সহযোগিতা করতেও গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
    “উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে এফবিআই এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বের করতে পারবে আশা করি। সেই সঙ্গে তাদের মদদদাতা মৌলবাদী গোষ্ঠীর মুখোশও উন্মোচিত হবে।”
    এর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীকে নিয়ে সন্দেহ আর তদন্ত নিয়ে অসন্তোষের কথা বলেছিলেন অজয় রায়।
    ওই সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর তার প্রতিক্রিয়ায় ফারসীম মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে দাবি করেন, ওই আড্ডার ‘অপরিচিত’ কেউ ছিলেন না।
    অভিজিতের এমন মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নাগরিক সমাবেশে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন তার বাবা, যিনি ছেলেকে ডাকতেন ‘গুল্লু’ নামে।
    তিনি বলেন, “আমি ও আমার পরিবার মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। পিতার আগে পুত্রের মৃত্যু ঘটেছে। তার লাশ বহন করা আমার কাছে অত্যন্ত কঠিন। তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।”
    অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে এই নাগরিক সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, শিক্ষক সমিতির সভাপতি ফরিদউদ্দিন আহমেদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নূহ উল আলম লেনিন, খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ, ডা. সারোয়ার আলী ও পঙ্কজ ভট্টচারর্যসহ শুভাকাঙ্ক্ষীরা উপস্থিত ছিলেন।

    এর আগে অজয় রায় বলেছিলেন, “আমার মনে হয়, মান্নান খুব ইনোসেন্টলি কাজটা করেছে। ও যে এটার মধ্যে ইনভলবড, তা না। কিন্তু সে অনেক লোকজন ডেকেছে, অনেকে এসেছে শুনে। এই যে আননোন কতগুলো ছেলে বসে আছে ওখানে।” কিন্তু তদন্তের ধীরগতি অনেক কিছুতেই সংশয় সৃষ্টি করছে। মুক্তচিন্তা দূরে থাক, অজস্র মুক্ত সন্দেহের জন্ম দিয়ে চলেছে, নানাভাবে তা আমাদের আক্রান্ত করছে সবাইকে। কুরুক্ষেত্রে দাঁড়ানো অর্জুন হয়ে উঠছি আমরা সবাই। এ থেকে মুক্তি পেতে চাই আমরা।
    মুক্তাঙ্গন কি পারে না, অভিজিতের প্রতিটি বই নিয়ে একেকটি আলাদা পোস্টের ব্যবস্থা করতে?

  5. মাসুদ করিম - ৩০ মার্চ ২০১৫ (১:৫২ অপরাহ্ণ)

    তেজগাঁওয়েব্লগারওয়াশিকুরবাবু(https://t.co/BY4GngL2QT)-কেকুপিয়েহত্যাhttp://t.co/5ZT3p6P8As #Bangladesh pic.twitter.com/Am1WbwZvEf

    — ICSF (@icsforum) March 30, 2015

  6. Pingback: অভিজিৎ রায় : মুক্তির পথযাত্রা » বাংলাদেশী শীর্ষ কমিউনিটি নিউজ পোর্টাল

  7. মাসুদ করিম - ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ (১২:০৭ পূর্বাহ্ণ)

    ‘আমার বাবা অভিজিৎ রায়’

    আমেরিকায় বেড়ে ওঠা তৃষা আহমেদ যখন ষষ্ঠ গ্রেডের ছাত্রী, তখন অভিজিৎ রায় তার জীবনে আসেন ‘বাবা’ হয়ে।

    যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী কম্পিউটার প্রকৌশলী অভিজিৎ গতবছর স্ত্রী বন্যা আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। ফেব্রুয়ারির এই দিনটিতেই বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঘাতকের হামলায় খুন হন মুক্তমনা এই লেখক।

    তৃষার মা বন্যা আহমেদও ওই হামলায় আহত হন। মায়ের মতো তৃষাকেও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ২৬ ফেব্রুয়ারির স্মৃতি।

    অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর বছরপূর্তিতে সিএনএন-এ প্রকাশিত এক বিশেষ নিবন্ধে তৃষা সামনে নিয়ে এসেছেন অন্য এক অভিজিৎ রায়কে।

    ডায়েরির ঢঙে লেখা এই নিবন্ধে জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তৃষা লিখেছেন, বাবা তাকে নির্ভীক চিত্তে সত্যের পথে হাঁটতে শিখিয়ে গেছেন।

    সিএনএনএর ইংরেজি নিবন্ধ থেকে তৃষার জবানীর বাংলা তর্জমা, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য।

    ২০০৮
    উনাকে বাবা ডাকতে কেমন যেন লাগলো কয়েক দিন। উনার রসবোধ আর ভাবভঙ্গি বাবার চেয়ে আঙ্কেলদের সঙ্গেই বেশি মেলে।

    সিক্সথ গ্রেড শেষ হওয়ার পরের গ্রীষ্মে আমরা নতুন বাড়িতে উঠলাম। উনি লম্বা দুটো লাঠি নিয়ে উঠানে এলেন। একটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন- ‘আয় তলোয়ার ফাইট!’

    আমিও সানন্দে রাজি। বললাম, “তোমাকে আমি হারাবোই।”

    সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত সেদিন আমাদের লড়াই চললো। প্রতিবারই আমি হারলাম।

    প্রতিবার হারার পর আবার খেলার জন্য জেদ ধরছিলাম আমি। তারপরও প্রতিবারই হারছিলাম।

    উনাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম- কেন সেদিন আমাকে একবারও জিততে দেননি।

    উত্তরে বলেছিলেন, “আমি তোকে আমার সমান মনে করি- তুই কি তা চাস না?”

    ২০১২
    দিনের বেলায় বাবা থাকতেন একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামার। আর বাসায় ফিরে হয়ে যেতেন লেখক।

    সমকামিতা নিয়ে বিজ্ঞান কী বলে, ধর্মীয় উগ্রবাদের ভাইরাস কতোটা ভয়ঙ্কর- সে কথা তিনি বইয়ে লিখেছেন।

    তিনি চাইতেন, বাংলাদেশের মূলধারায় ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে আরও বেশি আলোচনা হোক। এ কারণে অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে দিন দিন আরও বেশি পরিচিত হয়ে উঠছিলেন।

    আমার ইলেভেন্থ গ্রেডের পরীক্ষার মাত্র এক মাস আগে আমাদের ক্যালকুলাস শিক্ষক চাকরি ছেড়ে দিলেন। বললেন, স্কুলের বেতনে তার আর চলছে না।

    বাবার সাথে আমি একটা চুক্তিতে আসলাম। উনি আমাকে ক্যালকুলাস আর ফিজিক্স পড়াবেন, বিনিময়ে আমি উনার লেখা অনুবাদে সাহায্য করব।

    আমি মাঝে মধ্যে বলতাম, “বাবা, এরকম জঘন্য বাক্য তুমি কীভাবে লেখ! গ্রামারের এ কী অবস্থা!”

    “তৃষা, দয়া করে ঠিক করে দে। অনুবাদ যেমনই হোক, বিষয়টা ভালো,” বলতেন বাবা।

    বাবার লেখাগুলো সত্যিই ভালো ছিল। খুব ভালো কাজ করছিলাম আমরা।

    ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
    প্রতি ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় জাতীয়ভাবে একটা বইমেলা হয়। বাংলাদেশে ওটাই আমার বাবা-মায়ের শহর।

    ঢাকার পথে রওনা হওয়ার আগে ওরা বাল্টিমোরে জনস হপকিনসে এলেন আমাকে দেখতে। এ বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন আমি পড়ছি।

    আমার জন্য বাক্স ভর্তি উপহার এনেছিল ওরা। ক্যান্ডি, জামা, নোটবুক, কলম…। ওদের কিছু দিতে পারিনি বলে আমার খারাপ লাগছিল। ব্যাগপ্যাকে দুটো স্কার্ফ ছিল, বের করে দুজনকে তাই দিলাম।

    বাবা সারা রাত ওই স্কার্ফ পরে ছিলেন।

    ২৬ ফেব্রুয়ারি (সকাল)

    তখন সাড়ে ১০টা। কগনিটিভ নিউরোসায়েন্সের ক্লাস। ৩০০ জনের লেকচার থিয়েটারের শেষ সারিতে বসেছি। দুপুরে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনটা মেসেজ, ঢাকা থেকে কাজিনরা পাঠিয়েছে।

    মেসেজ পড়ে আমার গাল বেয়ে চোখের পানি নামতে লাগলো। আমি কাঁপছিলাম। কী করব… রুমমেটকে ফোন করলাম।

    ও জানতে চাইল, “কী হয়েছে? ঠিক আছিস তুই?”

    “আমার বাবা মারা গেছে। আর মা আইসিইউতে,” আমি বললাম।

    ২৬ ফেব্রুয়ারি (বিকাল)
    আমার চোখগুলো ততোক্ষণে ফুলে লাল হয়ে গেছে। ফেইসবুকে একটা পোস্ট দিলাম।

    “আমার বাবা ছিলেন একজন বাঙালি লেখক, বিজ্ঞান আর নাস্তিক্যবাদ নিয়ে লেখার জন্য তিনি পরিচিত ছিলেন। বইমেলায় বইয়ের প্রচারের জন্য গত সপ্তাহে বাংলাদেশে যান আমার বাবা আর মা। ১৫ ঘণ্টা আগে ইসলামী উগ্রবাদীরা আমার বাবাকে কুপিয়ে মেরেছে। আমার মাও আহত, উনি এখনো হাসপাতালে। আমার বাবার মৃত্যুর খবর এখন বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর শিরোনাম।

    “আমার জন্য না, এই কথাগুলো আমি বাবার জন্য লিখছি। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর ভালোর জন্যই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রয়োজন।

    “আমার মায়ের সঙ্গে উনার প্রথম ডেটের সময় আমার বয়স ছয় বছর। পরের ১২টি বছরে উনি হয়ে উঠেছিলেন আমার বন্ধু, আমার হিরো, আমার সবচেয়ে ভরসার জায়গা, আমার নাচের সঙ্গী এবং আমার বাবা।

    “উনি কখনো আমাকে শাসন করেননি; উনি আমাকে শিখিয়েছেন- জানতে হবে, হতে হবে সাহসী, নির্ভীক।

    “আমি ক্ষোভ থেকে এসব বলছি ভাবলে ভুল হবে। পৃথিবীর ভালোর জন্য লড়াই থামানোর মতো কিছু এখনো ঘটেনি। গভীর মামতায় বাবা আমাকে যা শিখিয়ে গেছেন, তা আমি ধারণ করে যাব।

    “তোমাকে ভালোবাসি বাবা; যা কিছু আমাকে দিয়েছ, তার সবকিছুর জন্য ভালোবাসি।”

    # শব্দকে খুন করা যায় না

    সেদিন এই শব্দগুলো মানুষ ফেইসবুকে দেখেছিল। কিন্তু তারা দেখেনি যে আমাকে ঘুমানোর জন্য প্রতি রাতে ওষুধ খেতে হয়েছে, যাতে রক্তের মধ্যে পড়ে থাকা বাবার সেই ছবি আমাকে স্বপ্নে দেখতে না হয়।

    কেউ দেখেনি কতোটা উদ্বিগ্ন ছিলাম মাকে নিয়ে। ভয় হচ্ছিল, হয়তো তাকে আর দেখতে পাব না। যদি পাইও, মা হয়তো আর আগের মানুষটা থাকবে না। আমি হয়তো তার যত্নও ঠিকমতো নিতে পারব না।

    মানুষ জানে না, আমি তখন সারাক্ষণ বাংলাদেশের টেলিভিশনের খবর দেখছিলাম; দিনের প্রতিটা ঘণ্টা। আমি দেখছিলাম, বাবার ছবির পোস্টার নিয়ে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করছে, হত্যার বিচার চাইছে।

    কেউ দেখেনি, একটা মেয়ে কেমন করে নির্বাক হয়ে গেল।

    ৩ মার্চ
    মা যেদিন আমেরিকায় ফিরলেন, আমি তাকে চিনতে পারিনি। তার কামানো মাথা দেখে আমার মনে সেইসব দিনের কথা মনে পড়ল, যখন তার থাইরয়েড ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছিল। সেইসব দিনের মতোই আমার বুক খালি হয়ে গেল।

    রাত ১০টায় আমি বিমানবন্দরে মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একদল ডাক্তার, এফবিআই এজেন্ট আর নিরাপত্তাকর্মী তাকে ঘিরে ছিল। যে লোকটা হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে আসছিল, মা রসিকতা করে তাকে কী যেন বললেন! আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল।

    আমার নানা কাঁদছিলেন। মায়ের কামানো মাথায় ব্যান্ডেজের আশপাশে বার বার হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন।

    ক্লিনিকের ডাক্তাররা ব্যান্ডেজ খোলার পর আমি মায়ের মাথার সেলাইগুলে দেখলাম। মাথায় চারবার কোপ দিয়েছিল ওরা। কিন্তু কোনোটাই গভীরে যেতে পরেনি। তবে এক হাতের বুড়ো আঙুল কাটা পড়েছিল।

    ক্ষতগুলো দেখতে দেখতে আমার চোখ আঁধার হয়ে এলো। একটা চেয়ারে বসে পড়লাম; রাতটা সেখানেই কাটলো।

    আমি ঘুমিয়ে পড়েছি মনে হওয়ার পর একসময় মা ফোঁপাতে শুরু করল। আমি পেছন থেকে জড়িয়ে মায়ের হাত ধরে থাকলাম, যতক্ষণ না শান্ত হয়। এই কৌশলটা আমার নানী তার মায়ের কাছে শিখেছিলেন। নানী শিখিয়েছিলেন আমার মাকে, আর মা আমাকে।

    ২২ মার্চ
    আমি আবার ক্যাম্পাসে ফিরলাম, একা। আমাকে বলা হলো, যারা আমার বাবাকে মেরেছে, তারা আমার মাকে, আমাকেও টার্গেট করতে পারে। মা বলে দিল, কোথাও একা যাওয়া চলবে না, রাতে বের হওয়া বন্ধ। এফবিআইয়ের একজন এজেন্টের সঙ্গে আমার কথা হলো। সে জানালো, আমার ভয়ের খুব বেশি কারণ সম্ভবত নেই। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি খুব বেশি বদলালো না।

    ৩ মে

    আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা একটা ভিডিও প্রকাশ করেছে। ইসলামের নামে অভিজিৎ রায়কে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়েছে সেখানে।

    ২৬ মে

    দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর একটা সেমিস্টার শেষ করে আমি জর্জিয়ায়, বাড়িতে এলাম। অদ্ভুত লাগছিল আমার। বাড়ির যে দিকে তাকাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল বাবাকে দেখতে পাব। মনে হচ্ছিল বাবা হয়তো স্টাডিতে বসে টাইপ করছে, হয়তো শোবার ঘরে কাত হয়ে কিছু পড়ছে।

    ওই হামলার পর তিন মাস কেটে গেছে। মেঝেতে শুয়ে শুয়ে কাঁদছিলাম আমি। কিছুই আমার কাছে বাস্তব মনে হচ্ছিল না। ব্যালকনিতে গিয়ে মনে হলো ঝাঁপ দিই। আমার বন্ধু বুঝিয়ে আমাকে ফিরিয়ে আনলো।

    সেপ্টেম্বর
    আমার বাবা যেখানে জীবনের বেশিরভাগ সময় বিজ্ঞান আর ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে লেখাপড়া করে কাটিয়েছেন, আমার মায়ের মূল আগ্রহের বিষয় ছিল রাজনীতি আর ইতিহাস, নারীবাদ আর বিশ্ব সংস্কৃতি। একটি ক্রেডিট ব্যুরোর সিনিয়র ডিরেক্টরের পদে ছিলেন মা। চাকরি ছেড়ে কিছুদিনের জন্য ছুটিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

    আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি শিওর?”

    মা হাসতে হাসতে বললেন, “কি জানি…

    “আজ আমার মনে হয়, তোর বাবা নিজের আদর্শের জন্য জীবন দিতে পেরেছেন, আমি নিজের আদর্শের জন্য অন্তত বাঁচার চেষ্টা করতে পারি।”

    সপ্তাহখানেক পর মা আমেরিকার বাইরে গেলেন। ইউরোপ ঘুরে ঘুরে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করলেন। বাংলাদেশে আর যে অ্যাক্টিভিস্টরা আছে, তাদের বের করে আনতে কাজ শুরু করলেন তিনি; যাতে বাবার মতো একই ভাগ্য তাদের না হয়।

    তখনো নিজের বিষয়গুলো গুছিয়ে উঠতে পারেননি, অথচ অন্যদের সাহায্য করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন মা।

    আজ
    মৃত্যু যতো নির্মমই হোক, আমার ধারণা, অন্য কোনোভাবে বেঁচে থাকতে চাইতেন না আমার বাবা।

    নিজের বিশ্বাসের জন্য প্রাণ দিয়ে তিনি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গেছেন। বিশ্ব সেই বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকে খুন হতে দেখেছে, যে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে পরিচালিত হয় বলে দাবি করা হয়।

    আমি জানি, আল কায়েদা, আইএস এবং আর যারা ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রচার করে, তারা এখনো তৎপর। তারপরও নিজের গল্প লিখে, তা শেয়ার করে আমি আমার ভূমিকা রাখলাম।

    আমি এবং আমার মতো অনেকে মিলে, ধীরে ধীরে, ভেবে চিন্তে এবং নিশ্চিতভাবে- সেইসব আদর্শকে দুর্বল করে তুলব, যারা আমাদের ধ্বংস করতে চায়।

    Murdered blogger’s stepdaughter: Dad taught me to be informed, bold, unafraid

    Exactly a year ago today, Avijit Roy was hacked to death in the most public of places: Coming out of a crowded book fair in Dhaka, Bangladesh. His crime? He was an American blogger who wrote prominently about secular issues — works that his misguided attackers viewed as blasphemous. In the months that followed, fundamentalists carried out several other attacks on secular writers.

    In the piece below, Roy’s stepdaughter Trisha Ahmed, a second-year student at Johns Hopkins University, recounts the father she remembers and the attack she’s trying to forget.

    2008

    For a while, it felt strange to call him “Dad” because he had the aura and wit of a fun uncle. When we moved into a new house in the summer after my sixth grade, he picked up two long sticks in the backyard, and passed one to me.

    “Sword fight?” he challenged.

    “It’ll be my pleasure to beat you,” I snarked back.

    We waved our wooden swords at each other until it got dark outside. Every time I lost, I wanted a rematch. And I lost every time.

    I asked him one day why he never let me win.

    “Don’t you want me to treat you as my equal?” he asked.

    2012

    Though my dad worked as a computer programmer during the day, he was a writer when he came home. His books were about the science behind homosexuality and the “virus” of religious extremism. With the goal of incorporating more secular discussion into mainstream Bangladesh, he was also becoming a well-known activist.

    One month before the national AP exam during my 11th grade, my calculus teacher quit. He told us he was sorry to leave, but that he had to because he wasn’t making enough money as a high school teacher.

    My dad and I struck a deal. He would help me with calculus and physics, if I would help him transition into writing in English.

    “Dad, these sentences are horrible. How have you been getting by with this kind of grammar?”

    “Trisha, please just make the edits. The content is good.”

    And it always was. We had a good thing going.

    February 13, 2015

    Every February, a national book fair is held in Dhaka, my parents’ hometown in Bangladesh. Before flying there, my parents decided to visit me at Johns Hopkins University in Baltimore, where I was now a student.

    They brought me a box full of presents: Candy, clothes, notebooks, pens. I felt guilty for not getting them anything, so I quickly pulled two scarves out of my backpack.

    My dad wore the scarf all night long.

    “You give him a new thing, and he’ll wear the hell out of it with pride,” my mom joked.

    February 26 (morning)

    At 10:30 a.m., I took a seat in the back of my 300-person lecture class in cognitive neuroscience. At noon, I checked my phone and saw three unread messages from my cousins in Bangladesh.

    Tears streamed down my face. My body shook. I dialed my roommate.

    “What’s wrong?” she asked. “Are you okay?”

    “My dad’s dead and my mom’s in the ICU in Bangladesh.”

    February 26 (afternoon)

    With swollen, dead eyes, ringed in red, I posted on Facebook:

    My dad was a prominent Bengali writer, most famous for his books about science and atheism. He and my mom went to Bangladesh last week to publicize his books at Bangladesh’s national book fair. 15 hours ago, Islamic fundamentalists stabbed my dad to death. My mom was severely wounded from the attack and is still in the hospital. His death is headline news in Bangladesh.

    The reason I’m sharing this is less for me and more for my dad. He was a firm believer in voicing your opinion to better the world.

    The ‘sin’ that could get you killed in Bangladesh

    He and my mom started dating when I was six years old. In the twelve years that followed, he became my friend, my hero, my most trusted confidante, my dance partner (even though we’re both terrible dancers), and my father. Not once did he tell me to simmer down or be more polite; he taught me to be informed, bold, and unafraid.

    To say that I’m furious or heartbroken would be an understatement. But as [screwed] up as the world is, there’s never a reason to stop fighting to make it better. I’ll carry the lessons he taught me and the love he gave me forever. I love you so much, Dad. Thank you for every single thing <3

    #‎WordsCannotBeKilled

    Those are the words the public saw.

    But what they didn’t see was me downing sleep medicine every night, so I wouldn’t dream of my dad lying in a pool of his own blood. What they didn’t see was the worry that I wouldn’t see my mom again, and that if I did, she would never be the same, and I would be an incompetent caretaker. What they didn’t see was me watching Bangladeshi news networks at all hours of the day, watching footage of thousands of people marching in the streets with my dad’s face painted on banners, demanding justice for his murder.

    What they didn’t see was a girl who had gone mute.

    March 3

    I didn’t recognize my mom at first when she returned to the States. Her head was shaved. I thought of when she was diagnosed with thyroid cancer — how shrunken and slow she became during treatment, how my chest felt intensely hollow for days at a time.

    It was 10 p.m., and I stood in the airport to greet her. She was surrounded by a doctor, an FBI agent and a handful of security guards. We watched incredulously as she cracked a joke with the man who pushed her wheelchair.

    Roy’s death sparked a wave of mourning and widespread condemnation of the attack in Bangladesh.

    My grandfather sobbed at the sight of her. He stroked his fingers over her shaven head, over and over, around the bandages.

    The doctors at the Mayo Clinic, where she was taken, unraveled her bandages, and my eyes fell on her stitches. She’d been stabbed four times around the head, but none of them resulted in direct brain damage. Her thumb had been sliced off from the attack. Black spots dotted my vision, and I stumbled into a chair, which became my home for the night.

    She started to weep when she thought I was asleep. I slowly ran my fingers down her arms, down her back, until she was calm. It’s an old trick my grandma’s mom taught her, who taught my mom, who taught me.

    March 22

    I flew back to campus alone. I was told that the same group that killed my dad could still be targeting my mom and me. My mom instructed me not to go anywhere alone, no matter the time of day, and not to go anywhere at night, period. I met with an FBI representative. She assured me I was most likely safe. But that didn’t stop the paranoia from seeping in.

    May 3

    The leader of Al Qaeda’s branch in the Indian subcontinent published a video that claimed responsibility for murdering Avijit Roy in the name of Islam.

    May 26

    I was home in Georgia after a long and tired semester. It felt eerie. With every corner I turned, I expected to see my dad typing in his study or reading in my parents’ bedroom.

    It had been three months since the attack. I was on the floor, crying. Nothing seemed real. I got on the balcony, and readied myself to jump. My boyfriend found me before I did. He helped me back inside and put me to bed.

    September

    While my dad spent most of his life reading about science and secularism, my mom spent most of hers reading about politics and history and feminism and cultures of the world. After a few months at work, my mom decided to take a leave from her job as a senior director at a credit bureau.

    “Are you sure this is what you want to do?” I asked her.

    “Who knows?” she laughed. “I was thinking today that your dad died for his passion, so I should at least try living for mine.”

    Within a week, she was out of the country, meeting with humanist associations all over Europe. She began working to get other activists out of Bangladesh, before they could suffer the same fate as my dad. Although my mom hadn’t sorted through all of her own issues yet, she wanted desperately to help others get to safety.

    Today

    As brutal as his death was, I don’t think my dad would have wanted to live any differently. By dying for his cause, he gained worldwide attention to the oppression and murder of scientific thought in Bangladesh — a country that claims to be governed by secular principles.

    I know that Al Qaeda, ISIS, and other manifestations of religious extremism are alive and well. But by writing and sharing my story, I am making my impact. I — and so many others — am slowly, thoughtfully, and certainly chipping away at the ideologies that seek to destroy us.

    • রায়হান রশিদ - ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ (১০:৩০ অপরাহ্ণ)

      কৃতজ্ঞতা, মাসুদ ভাই, লেখাগুলো তুলে দেয়ার জন্য।

  8. অবিশ্রুত - ১১ মার্চ ২০১৬ (১:৪১ পূর্বাহ্ণ)

    বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ভাবে মানুষের জ্ঞানান্বেষণের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। কেননা জ্ঞানান্বেষণ মানুষকে স্বাভাবিকভাবেই টেনে নিয়ে যায় মুক্ত চিন্তার পথে। ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া মানুষকে অবশ্য তেমন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ফেলে না। এ কারণেই দেখা যায়, সফল অনেক বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশল, শিক্ষক প্রমুখকে সাক্ষী টানা হয়, অমুকের জ্ঞান কি কম, সে তো এমন আউলফাউল কথা (মানে যে কথার উত্তর যুক্তি দিয়ে তারা দিতে পারেন না) বলে না। হত্যার মতো ঘটনায় আমাদের চোখে খুব স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে পথের বাধাগুলো। কিন্তু এই বাধাগুলো কিন্তু সব সময়েই আছে, নিত্য নতুনভাবে সেগুলো ফিরে আসে, আসার চেষ্টা করে। এই প্রতিবন্ধকতাগুলোর ক্রনোলোজি করা দরকার। যেমন, এই মুহূর্তে শুধু একটি ঘটনার এটুকুই মনে পড়ছে, ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে কোনও এক সময় একজনকে পাঠাগার গড়ে বিভিন্ন দর্শনমুলক বই পড়ানোর অপরাধে সালিশ করে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। পত্রিকায় এ নিয়ে খবর বেরিয়েছিল। বেচারা নেহাৎই গ্রামের শিক্ষক-বিশ্ববিদ্যালয়ের অমুক তো নন, যে আমরা মনে রাখব!
    এ রোগ দীর্ঘ দিনের, যে রোগ পুষে রাখা হচ্ছে… শুধু হত্যার প্রতিবাদ করে, বিচার করে এ রোগ দূর করা যাবে না। তবে নিঃসন্দেহে বিচারও করতে হবে, দ্রুতই করতে হবে, রোগটা যে খারাপ, রোগটার পক্ষে যে শুভ শক্তি নেই, রোগটা পুষে রাখার মানে যে প্রতিনিয়ত শাস্তি পাওয়া, সেটি মনে করার ও করানোর জন্যই করতে হবে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.