স্যার আমি গল্পটা শুরু করি। আপনে শুনতে শুনতে ঘুমায় পড়েন। চক্রবর্তীর এমন বলার কারণ আছে। বেশ ক’রাত ধরে সে দেখেছে আমার ঘুমের জন্য তার গল্প টনিকের মত কাজ করে। চক্রবর্তীর বয়স বিশের মত হবে। দিন পনের আগে ডি জি এফ আইর নিরাপদ গর্ত যেখানটায় আমাকে রাখা হয়েছে, সেখানে লাগোয়া খাটিয়াতে তাকে ফেলে দিয়ে যায়। তখন শেষ রাত। নিঃসাড় হয়ে সে পড়েছিল। সেলের বাইরের করিডোরে প্রহরীর পদশব্দ মৃদু হয়ে আসছিল, সেও হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বিরক্তিকর পায়চারিতে ঝিমুনিও হয়তো এসেছে তার। সেই ফাঁকে আমি ঐ যুবকের কপালে হাত রাখি। মে মাসের এই সময়টায় বেশ গরম পড়েছে। কিন্তু ছেলেটির শরীরতো ঠাণ্ডা। নাকের সামনে হাত রেখে বোঝার চেষ্টা করি ও বেঁচে আছে কিনা। শ্বাস-প্রশ্বাস বোঝা যায় কি যায়না। পাটের ছালায় জড়ানো তার শরীর। বুকের বাম দিকে কান পাতি। দূর থেকে ভেসে আসা ঘড়ীর কাটার মৃদু শব্দের মত বুকের শব্দ শুনে বুঝতে পারি জীবন প্রদীপ এখনও নিভে যায়নি। কিন্তু তার উত্তাপ বড় কম। গোটা শরীরকে উষ্ণ রাখতে তা বড় অপ্রতুল। ওর হাতের তালু, কপাল ও বুকে দ্রুত লয়ে হাত দিয়ে ঘষতে থাকি। এ সেলের অনেক উঁচু সিলিংএ ঝোলানো কম পাওয়ারের বাল্ব থেকে ধূষর আলো ওর মুখের উপর পড়েছে। পাণ্ডুর সে মুখে মৃত্যুর ছায়া। আমার হাতের, শরীরের সবটুকু উত্তাপ দিয়ে তাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করি। অতি ধীরে সে চোখ মেলে। কি নাম তোমার? শুধোই তাকে। জবাব দেয় না। বোঝার চেষ্টা করে হয়তো। সময় নিয়ে বলি, কোন ভয় নেই। এই সেলে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আতঙ্ক হয়তো একটু কমে। ওর কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে আবারও জিজ্ঞাসা করি, কি নাম তোমার? কি কর তুমি? আমাকে বলতে পার। আমিও তোমার মত বন্দী এখানে। আমি একজন শিক্ষক। এবারে তার মুখাবয়বে পরিবর্তন দেখি। আরও একটু বড় করে চোখ মেলে তাকায়। খুব মৃদু শব্দে নামটি বলে। অরুণ চক্রবর্তী। পুরনো এলিফেন্ট রোডে এক ফার্মেসীতে কাজ করতো। রামপুরা ব্রিজের ওপারের বস্তিতে ভাড়া ঘরে থাকত। গত সন্ধ্যায় ফার্মেসী থেকে তাকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। সারা রাত ধরে বেদম পিটিয়েছে। বলে, আমি বোধ হয় আর বাঁচুম না স্যার। কি জানতে চায় তোমার কাছে? এবারে…

পঞ্চমীর চাঁদ তখনো ডুবে যায়নি। তার আলোয় প্রথম যা নজরে পড়লো তা একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেলের নল। শীতের ঠাণ্ডা এখন স্বস্তিদায়ী। তারপরও নদীর খোলা হাওয়ায় একটু শীত অনুভব করি আমরা। আমরা যে নৌকাটিতে উঠেছি তা ঠিক সাম্পান নয়। যদিও নাফ নদীতে প্রায় সব নৌকাই ছই তোলা সাম্পান। এ নৌকাটি ছিপ নৌকার মত। লম্বা ও খোলা। তার দু’পাশে দু’জন করে চারজন যুবক বৈঠা নিয়ে বসেছিল। নৌকার পাটাতনে বিছানো ছিল রাইফেলটি। মোক্তারের নির্দেশে ঐ যুবকেরা আমাদের ব্যাকপ্যাকগুলো এমনভাবে গুছিয়ে রাখছিল যাতে নৌকার ভারসাম্য ঠিক থাকে। আমরা পনের জন যুত হয়ে বসেছি। নৌকা চলতে শুরু করেছে। সঁপাসপ বৈঠা পড়ছে। নাফ নদীর নোনা পানি কেটে নৌকা চলছে তীরবেগে। জামার সাইড পকেটে হাত ঢোকাল মোক্তার। তারপর বের করা হাত যখন মেলে ধরল, তখন চাঁদের আলোয় পাঁচটি বুলেট চকচক করে উঠল। আমরা চলেছি অজানা গন্তব্যে। মোক্তার আমাদের গাইড। সুঠাম চার যুবকের আটটি হাতের ছন্দময় আন্দোলনে নৌকা এগিয়ে চলেছে। সাম্পানের গতি মন্থর। আমাদের এপারে যেমন আছে ই পি আর ঠিক তেমনি ওপর পারে সীমান্তরক্ষী নাসাকা বাহিনী। দ্রুত গতির গানবোট আছে তাদের। ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে ওপারে পৌঁছাতে হবে। এই নিশুথি রাতে লম্বা ছিপ নৌকা বেছে নেয়ার কারণটি বোঝা গেল। খোলা রাইফেল ও তাজা বুলেট কেন দেখালো মোক্তার? তা কি একথা বোঝাতে যে আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অস্ত্র আছে আমাদের সাথে। না কি আমাদের মনে ভয় সঞ্চার করা তার উদ্দেশ্য? টেকনাফ বাজারের পশ্চিমে পাহাড় পেরিয়ে মোক্তারের বাড়ি। আমাদের নিয়ে যাচ্ছে আরাকানে। চার যুবকের সাথে তার কথোপকথন আমরা সামান্যই বুঝতে পারি। তবে আমাদের সাথে যখন সে কথা বলে, তখন তা ভিন্ন। ঠিক চট্টগ্রামেরও নয়। পনের জনের এই দলে সাঈদ ভাই ও আমি চট্টগ্রামের ভাষা বেশ বুঝতে পারি। আমাদের স্কুল জীবনের একটা সময় কেটেছে মিরেশ্বরাই স্টেশনে। তবে মোক্তারের কথা অন্যেরাও বুঝতে পারে। মোক্তার বহু জায়গা ঘুরেছে। শুনেছে নানা ভাষা। সবার বোধগম্য করে কথা বলার কায়দাটি সে ভালই রপ্ত করেছে। আমরা যখন ওপারে পৌঁছেছি, তখন চাঁদ প্রায় ডুবে গেছে। আরও যুবকদের আমরা অপেক্ষমাণ দেখি। মোক্তারের নির্দেশে ওরা টপাটপ ব্যাকপ্যাকগুলো মাথায় উঠিয়ে নেয়। ওদের সাথে মোক্তারের স্বল্প বাক্যবিনিময় আমরা ধরতে পারি…

ঘুরে দাঁড়াতে কি লাগে? সম্মেলনের তৃতীয় দিন, ১২ জুন ২০১৪। সময় বিকেল ৫টা। ডেলিগেটদের সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসবার মুহূর্ত। আজকে ছিল শতাধিক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের আলোচনায় বসবার দিন। তাই এই মুহূর্তটাকেই যৌথভাবে আইসিএসএফ (International Crimes Strategy Forum) এবং Komola Collective-এর পক্ষ থেকে আমরা নির্ধারণ করেছিলাম প্রতিবাদ সমাবেশের 'জিরো আওয়ার' হিসেবে [. . .]

ঘুরে দাঁড়াতে কি লাগে? সম্মেলনের তৃতীয় দিন, ১২ জুন ২০১৪। সময় বিকেল ৫টা। ডেলিগেটদের সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসবার মুহূর্ত। আজকে ছিল শতাধিক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের আলোচনায় বসবার দিন। তাই এই মুহূর্তটাকেই যৌথভাবে আইসিএসএফ (International Crimes Strategy Forum) এবং Komola Collective-এর পক্ষ থেকে আমরা নির্ধারণ করেছিলাম প্রতিবাদ সমাবেশের 'জিরো আওয়ার' হিসেবে (বিস্তারিত ইভেন্ট: http://bit.ly/1oRjCD3)। যাতে করে ডেলিগেটরা বেরিয়ে যাওয়ার সময় একাংশের হলেও নজরে আসে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের এই নাগরিক প্রতিবাদটুকু। কারণ, এরই মধ্যে আমরা জেনে গেছি সম্মেলনের ক্লোজড সেশনগুলোতেও বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হালে এতোটুকু পানি পায়নি গত দুই দিন। প্রচণ্ড ট্রাফিকের সাথে ধস্তাধস্তি করে অক্সফোর্ড থেকে লন্ডন পর্যন্ত ড্রাইভে আজকেও প্রায় তিন ঘণ্টা লেগে গেল। কাছাকাছি এসে লক্ষ করলাম সম্মেলনের কেন্দ্রস্থল আজকে অনেকটাই যেন আলাদা। গত দু'দিনও নিরাপত্তা ব্যবস্থার বেশ কড়াকড়ি ছিল, কিন্তু আজকের সমাপনী মুহূর্তের নিরাপত্তা বেষ্টনী গত দু'দিনকেও ছাড়িয়ে গেছে। রীতিমতো এয়ারপোর্টের মতো নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দুই দফার মেটাল ডিটেক্টর আর বডি সার্চ। ট্রে-র ওপর ব্যাগ মোবাইল ঘড়ি ওয়ালেট রাখো রে, বেল্ট খোলো রে, জুতোর সোল পরীক্ষা করো রে ইত্যাদি ইত্যাদি। চারপাশে দুটি ভিন্ন সংস্থার কঠোর-দর্শন সিকিউরিটির লোকজন, তার উপর যেদিকেই তাকাই দেখি শুধু পুলিশ আর পুলিশ! মন্ত্রী-ডেলিগেটদের ঘরে ফেরার মুহূর্তটাকে নির্বিঘ্ন করার কতোই না আয়োজন! সত্যিই চিন্তায় পড়ার মতো সমস্যা আমাদের সামনে। সমাবেশ করবো কিভাবে তাহলে? কিন্তু এর মধ্যেই দেখি সাহসী মুখে একে একে জড়ো হচ্ছেন সবাই। একদিন আগেই ফোন করেছিল হৈমন্তী। নিজের পরিচয়টুকু দিয়ে জানতে চেয়েছিল কিভাবে যুক্ত হতে পারে? আমি দিনক্ষণ জানিয়েছিলাম। সবার আগে কালো শাড়ি পরে নির্ধারিত সমাবেশস্থলে ও হাজির। ওকে দেশ থেকে এই সমাবেশের কথা জানিয়েছেন মেঘনাদি (মেঘনা গুহঠাকুরতা); আর মেঘনাদিকে জরুরি আবেদন পাঠিয়েছিলেন শিপ্রাদি (শিপ্রা বসু)। উল্লেখ না করলেই নয় -- গত চার দিন ধরে শিপ্রাদির সাথে প্রায় সার্বক্ষণিকভাবেই ফেসবুকে যোগাযোগ হচ্ছিল। পরিচিত সব মানবাধিকার কর্মী আর নারীবাদী সহযোদ্ধাদের কারও সাথে যোগাযোগ করতে বাকি রাখেননি তিনি এই বৈশ্বিক সম্মেলনের হালচাল শুনে। (শিপ্রাদির মতো আরও একজন হাজির না থেকেও হাজির ছিলেন আমাদের সাথে, সেটা না উল্লেখ করলেই নয়। গত কয়েক দিন বেলজিয়াম থেকে জিয়া ভাই সকাল-বিকাল উৎকণ্ঠিতভাবে স্ট্যাটাস রিপোর্ট গ্রহণ করে গেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন।)…

১৯৮৩ থেকে ২০১৪ -- মাত্র তিনটি দশক। কথিত ভ্যালেন্টাইনের আগ্রাসনে বিভ্রান্ত, বিস্মৃত নিজের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস! ক্ষমা করো শহীদেরা। ১৯৮৩ থেকে ২০১৪ -- মাত্র তিনটি দশক। এরই মধ্যে আমরা বেমালুম ভুলে গেলাম গণতন্ত্র-স্বৈরাচার! সামরিক স্বৈরাচার অনেক আগে থেকেই আবার গণতন্ত্রের ভোটবন্ধু হয়ে বসে আছে। এ থেকে মুক্তি নেই আমাদের? [...]

১৯৮৩ থেকে ২০১৪ -- মাত্র তিনটি দশক। কথিত ভ্যালেন্টাইনের আগ্রাসনে বিভ্রান্ত, বিস্মৃত নিজের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস! ক্ষমা করো শহীদেরা। ১৯৮৩ থেকে ২০১৪ -- মাত্র তিনটি দশক। এরই মধ্যে আমরা বেমালুম ভুলে গেলাম গণতন্ত্র-স্বৈরাচার! সামরিক স্বৈরাচার অনেক আগে থেকেই আবার গণতন্ত্রের ভোটবন্ধু হয়ে বসে আছে। এ থেকে মুক্তি নেই আমাদের? ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল আমাদের ভাই-সহযোদ্ধা জাফর-জয়নাল-দীপালী-কাঞ্চন। আমার স্মৃতি যদি আমাকে বিভ্রান্ত না করে থাকে তাহলে বলতে পারি এর পরদিন তারই প্রতিবাদে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাছে কে.সি. দে রোডে সেই স্বৈরাচারীর নির্দেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে কথিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছোঁড়া বুলেটে মোজাম্মেলের বুকের তাজা রক্তে চট্টগ্রামের রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। আরো অনেক সহযোদ্ধা আহত হয়েছিলেন সেদিন। (যদি আমার তথ্যে ঘাটতি বা অসংগতি থাকে কেউ শুধরে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।) তারপর থেকেই এদেশের তরুণ ছাত্র-জনতা এই ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‌স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবেই পালন করেছে, যতটুকু জানি। কিন্তু দ্রোহ-প্রতিরোধ-আন্দোলন-বিপ্লব এসবকে সবসময়েই কায়েমি স্বার্থবাদী চক্র ভয় পেয়েছে, এখনো পায়। আর তাই সেই প্রতিরোধের ১৪ ফেব্রুয়ারিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য অত্যন্ত সুচতুরভাবে অনুপ্রবেশ ঘটালো ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবসের। আর এতে যোগ দিল কর্পোরেট বাণিজ্যের মেধা-কূটকৌশল। সুতরাং কেল্লা ফতে। নো চিন্তা, ডু ফুর্তি। যার যা উদ্দেশ্য ছিল তা সফল হলো, কিন্তু আমরা যেন ভুলে যেতে বসেছি আমাদের গৌরবোজ্জ্বল আত্মত্যাগের ইতিহাস। এ লজ্জা কার? তারুণ্যের দোষ কী? স্বাভাবিকভাবেই ওরা ভালোবাসবে। এটাই তো নিয়ম। জাফর-জয়নাল-দীপালী-কাঞ্চন-মোজাম্মেল নিজেদের রক্ত দিয়ে গণতন্ত্র আর আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ভালোবেসেছিল। ছাত্রসমাজের প্রাণের দাবি আদায়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমরা যারা তাদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আজ গণতন্ত্রের ঢোল বাজাচ্ছি, কর্পোরেট বাণিজ্যের আগ্রাসনের কথিত ভালোবাসা দিবসের গোলকধাঁধায় আটকা পড়েছি, আমাদের বিবেক এতটাই প্রতিবন্ধী হয়ে গেল? ভাবতেই অবাক লাগে। নারী-পুরুষের ভালোবাসা, বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ভালোবাসা -- এ সবকিছুই চিরন্তন। কিন্তু আমাদের গৌরবোজ্জ্বল গণতান্ত্রিক ইতিহাসকে ভুলবো কেমন করে? মিডিয়াগুলো নেমেছে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় -- কে কত বেশি করে এই ভ্যালেন্টাইন দিবসকে প্রচার করবে। ভালোবাসা যে শুধু নারী-পুরুয়ের ভালোবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর সাথে যে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, মায়ের নাড়ি-ছেঁড়া ধনের আত্মত্যাগ, রক্তে-ভেজা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তীব্র ভালোবাসা রয়েছে তা কি…

চেনা মানুষ অচেনা হয়ে উঠলে যে দুঃসহ কষ্ট আমরা পাই, চেনা মানুষের মুখোশ চিরে আরেক মানুষ বেরিয়ে পড়লে আমরা যেমন যন্ত্রণায় ছটফট করি — সেইরকম একটা অনুভূতি নিয়ে আমি নিশ্চিত পৃথিবীর সকল প্রান্তের বাঙালীরা আজকে রাতে এবং এরপর আরো অনেক রাতে ঘুমোতে যাবে। [...]

হা হন্ত তথাপি জন্ম-বিটপী ক্রোড়ে মনো ধাবতি... ১. চেনা মানুষ অচেনা হয়ে উঠলে যে দুঃসহ কষ্ট আমরা পাই, চেনা মানুষের মুখোশ চিরে আরেক মানুষ বেরিয়ে পড়লে আমরা যেমন যন্ত্রণায় ছটফট করি -- সেইরকম একটা অনুভূতি নিয়ে আমি নিশ্চিত পৃথিবীর সকল প্রান্তের বাঙালীরা আজকে রাতে এবং এরপর আরো অনেক রাতে ঘুমোতে যাবে। আমরা বাংলাদেশকে আর চিনতে পারছি না। অথচ, এই মৃতমানুষের কনভয়, এই জীবিতমানুষের শোকমিছিল এই মৃ্ত্যু উপত্যকাই আমার দেশ। দীর্ঘদিন তাই ছিল -- কেন ভুলে ছিলাম? কেন ভ্রমে ছিলাম? আমাদের চোখের সামনেই কি আমাদের ভাগ্যান্বেষণরত পরিচিত মানুষরা পত্রিকায় মৃতমানুষের সংখ্যা বাড়ায়নি? লঞ্চডুবি হয়ে, গুলি খেয়ে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মরে ফুলে পড়ে থেকেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসার অভাবে সাহায্যের অভাবে কাতরে কাতরে মরে গেছে। আর একদল বোকা মানুষ একদল পাগল তাদের খালিহাতে এই মানুষগুলিকে বাঁচাবার চেষ্টায় নিজেদের প্রাণ দিয়েছে। কখনো আমরা তাদের নাম ভুলে গেছি। কখনো তাদের বীরশ্রেষ্ঠ ডেকেছি। দেয়ালে টাঙানো বীরশ্রেষ্ঠদের ছবি প্রণিধানযোগে দেখলেই আপনি বাংলাদেশের স্বরূপ দেখতে পাবেন -- এই মানুষগুলির কারো চেহারা/প্রফাইল ‘সিগনিফিক্যান্ট’ না, ঝাপসা মুখ, ভিড়ের একজনের মতো অভিব্যক্তি -- আমাদের ছোট্ট দেশটার ইনসিগনিফিক্যান্ট মানুষগুলিই আমাদের বীর। আমাদের নেতারা কোনোদিন বীর ছিল না, যোদ্ধা ছিল না, স্বার্থত্যাগী ছিল না। মানুষের মৃত্যু তাদের বিচলিত করেনি, মৃত্যু মানে হয় জয়ের তুরুপের তাস, অথবা পরাজয়ের ধ্বনি। আমাদের নেতারা কোনোদিন সামাজিক মানুষ যেমন করে কাছের মানুষের মৃত্যুকে গ্রহণ করে, যে বেদনায়, তা ধারণ করেনি। ফলে বাংলাদেশের শ্রমজীবি মানুষ অকাতরে মরবার খবরে কেবল সাধারণ মানুষই ছুটে যাবে -- নেতারা নানাভাবে নিজের পাপক্ষালনের চেষ্টা করবে (আগের দল ক্ষমতায় থাকতেও এমন ঘটেছে, যারা করেছে তারা আমাদের কেউ না) এবং রাষ্ট্রনায়ক/নায়িকা ভান করবেন তাঁরা এখনো তাঁদের দলের নেতা, দেশের দায় তাঁদের নেই -- এতে অবাক হবার কিছু নেই। তাহলে এমন যাতনা কেন? সাভারের গার্মেন্টসে যে মানুষগুলি এমন করে মরে গেল, তাদের নিরন্তর সংগ্রাম ছিল বেঁচে থাকার, জীবনের দিনগুলিকে অল্প দামে বেচে দিয়ে জীবনযাপনের জন্যে অসামান্য সেই সংগ্রাম।আমি জেনেছি, অনেক শ্রমিক উদ্ধার পেয়ে বিকলাঙ্গ-জীবন যাপনের চেয়ে সেই জগদ্দলের তলায় সমাধিস্থ হতে চেয়েছেন -- যেন কোনোভাবে তাঁদের মৃত্যু অন্ততঃ একটা আর্থিক মূল্য পায়। এই তো বাংলাদেশ। নেতানেত্রীরা…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.