১৯৮৩ থেকে ২০১৪ — মাত্র তিনটি দশক। কথিত ভ্যালেন্টাইনের আগ্রাসনে বিভ্রান্ত, বিস্মৃত নিজের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস! ক্ষমা করো শহীদেরা। ১৯৮৩ থেকে ২০১৪ — মাত্র তিনটি দশক। এরই মধ্যে আমরা বেমালুম ভুলে গেলাম গণতন্ত্র-স্বৈরাচার! সামরিক স্বৈরাচার অনেক আগে থেকেই আবার গণতন্ত্রের ভোটবন্ধু হয়ে বসে আছে। এ থেকে মুক্তি নেই আমাদের?
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল আমাদের ভাই-সহযোদ্ধা জাফর-জয়নাল-দীপালী-কাঞ্চন। আমার স্মৃতি যদি আমাকে বিভ্রান্ত না করে থাকে তাহলে বলতে পারি এর পরদিন তারই প্রতিবাদে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাছে কে.সি. দে রোডে সেই স্বৈরাচারীর নির্দেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে কথিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছোঁড়া বুলেটে মোজাম্মেলের বুকের তাজা রক্তে চট্টগ্রামের রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। আরো অনেক সহযোদ্ধা আহত হয়েছিলেন সেদিন। (যদি আমার তথ্যে ঘাটতি বা অসংগতি থাকে কেউ শুধরে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।) তারপর থেকেই এদেশের তরুণ ছাত্র-জনতা এই ১৪ ফেব্রুয়ারিকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবেই পালন করেছে, যতটুকু জানি।
কিন্তু দ্রোহ-প্রতিরোধ-আন্দোলন-বিপ্লব এসবকে সবসময়েই কায়েমি স্বার্থবাদী চক্র ভয় পেয়েছে, এখনো পায়। আর তাই সেই প্রতিরোধের ১৪ ফেব্রুয়ারিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য অত্যন্ত সুচতুরভাবে অনুপ্রবেশ ঘটালো ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবসের। আর এতে যোগ দিল কর্পোরেট বাণিজ্যের মেধা-কূটকৌশল। সুতরাং কেল্লা ফতে। নো চিন্তা, ডু ফুর্তি। যার যা উদ্দেশ্য ছিল তা সফল হলো, কিন্তু আমরা যেন ভুলে যেতে বসেছি আমাদের গৌরবোজ্জ্বল আত্মত্যাগের ইতিহাস। এ লজ্জা কার? তারুণ্যের দোষ কী? স্বাভাবিকভাবেই ওরা ভালোবাসবে। এটাই তো নিয়ম। জাফর-জয়নাল-দীপালী-কাঞ্চন-মোজাম্মেল নিজেদের রক্ত দিয়ে গণতন্ত্র আর আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ভালোবেসেছিল। ছাত্রসমাজের প্রাণের দাবি আদায়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমরা যারা তাদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আজ গণতন্ত্রের ঢোল বাজাচ্ছি, কর্পোরেট বাণিজ্যের আগ্রাসনের কথিত ভালোবাসা দিবসের গোলকধাঁধায় আটকা পড়েছি, আমাদের বিবেক এতটাই প্রতিবন্ধী হয়ে গেল? ভাবতেই অবাক লাগে।
নারী-পুরুষের ভালোবাসা, বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ভালোবাসা — এ সবকিছুই চিরন্তন। কিন্তু আমাদের গৌরবোজ্জ্বল গণতান্ত্রিক ইতিহাসকে ভুলবো কেমন করে? মিডিয়াগুলো নেমেছে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় — কে কত বেশি করে এই ভ্যালেন্টাইন দিবসকে প্রচার করবে। ভালোবাসা যে শুধু নারী-পুরুয়ের ভালোবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর সাথে যে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, মায়ের নাড়ি-ছেঁড়া ধনের আত্মত্যাগ, রক্তে-ভেজা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তীব্র ভালোবাসা রয়েছে তা কি একটি বার আমরা স্মরণ করেছি বা করছি? এ কোন সমাজে বাস আমাদের? এতটাই অকৃতজ্ঞ আমরা!?
কর্পোরেট বাণিজ্য আর অর্থ-বিত্তের পেছনে দৌড়ালে যা হয়, তাই হচ্ছে এখন। আমি খুব বেশি অবাক হচ্ছি না এসব দেখে। কারণ যাঁরা সেদিন রাজপথে ছিলেন তাঁরাই (সবাই না, অনেকে) আজকের দিনে খুব বেশি করে কথিত ভালবাসার জোয়ারে ভাসছে! হায় রে আমার রাজপথ-কাঁপানো স্লোগান! হায় রে আমার ভাইয়ের বুকের তাজা রক্ত! শুধু নিজেদেরকেই ধিক্কার দিতে পারি এজন্য, অন্য কাউকে দোষ দেব না। ক্ষমা করো শহীদেরা।
সমরেশ বৈদ্য
আত্মগ্লানিতে দগ্ধ এক মফস্বল সংবাদকর্মী
১৪.০২.২০১৪
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
অদিতি কবির - ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ (৮:৩০ পূর্বাহ্ণ)
আমার বয়স তখন খুবই কম। আম্মার চাকরীসূত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকতাম। সেই ভয়াবহ দিনের কথা আজও মনে পড়ে! আমি কাউকেই ভুলি নি। তবে দুঃখজনক হল শহীদ মোজাম্মেলের কথা জানতাম না। লেখাটির জন্য ধন্যবাদ। শেয়ার দিলাম।