স্যার আমি গল্পটা শুরু করি। আপনে শুনতে শুনতে ঘুমায় পড়েন।
চক্রবর্তীর এমন বলার কারণ আছে। বেশ ক’রাত ধরে সে দেখেছে আমার ঘুমের জন্য তার গল্প টনিকের মত কাজ করে।
চক্রবর্তীর বয়স বিশের মত হবে। দিন পনের আগে ডি জি এফ আইর নিরাপদ গর্ত যেখানটায় আমাকে রাখা হয়েছে, সেখানে লাগোয়া খাটিয়াতে তাকে ফেলে দিয়ে যায়। তখন শেষ রাত। নিঃসাড় হয়ে সে পড়েছিল। সেলের বাইরের করিডোরে প্রহরীর পদশব্দ মৃদু হয়ে আসছিল, সেও হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বিরক্তিকর পায়চারিতে ঝিমুনিও হয়তো এসেছে তার। সেই ফাঁকে আমি ঐ যুবকের কপালে হাত রাখি। মে মাসের এই সময়টায় বেশ গরম পড়েছে। কিন্তু ছেলেটির শরীরতো ঠাণ্ডা। নাকের সামনে হাত রেখে বোঝার চেষ্টা করি ও বেঁচে আছে কিনা। শ্বাস-প্রশ্বাস বোঝা যায় কি যায়না। পাটের ছালায় জড়ানো তার শরীর। বুকের বাম দিকে কান পাতি। দূর থেকে ভেসে আসা ঘড়ীর কাটার মৃদু শব্দের মত বুকের শব্দ শুনে বুঝতে পারি জীবন প্রদীপ এখনও নিভে যায়নি। কিন্তু তার উত্তাপ বড় কম। গোটা শরীরকে উষ্ণ রাখতে তা বড় অপ্রতুল। ওর হাতের তালু, কপাল ও বুকে দ্রুত লয়ে হাত দিয়ে ঘষতে থাকি। এ সেলের অনেক উঁচু সিলিংএ ঝোলানো কম পাওয়ারের বাল্ব থেকে ধূষর আলো ওর মুখের উপর পড়েছে। পাণ্ডুর সে মুখে মৃত্যুর ছায়া। আমার হাতের, শরীরের সবটুকু উত্তাপ দিয়ে তাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করি।
অতি ধীরে সে চোখ মেলে।
কি নাম তোমার?
শুধোই তাকে। জবাব দেয় না। বোঝার চেষ্টা করে হয়তো।
সময় নিয়ে বলি, কোন ভয় নেই। এই সেলে আমি ছাড়া আর কেউ নেই।
আতঙ্ক হয়তো একটু কমে।
ওর কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে আবারও জিজ্ঞাসা করি, কি নাম তোমার? কি কর তুমি? আমাকে বলতে পার। আমিও তোমার মত বন্দী এখানে। আমি একজন শিক্ষক।
এবারে তার মুখাবয়বে পরিবর্তন দেখি। আরও একটু বড় করে চোখ মেলে তাকায়। খুব মৃদু শব্দে নামটি বলে।
অরুণ চক্রবর্তী।
পুরনো এলিফেন্ট রোডে এক ফার্মেসীতে কাজ করতো। রামপুরা ব্রিজের ওপারের বস্তিতে ভাড়া ঘরে থাকত। গত সন্ধ্যায় ফার্মেসী থেকে তাকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। সারা রাত ধরে বেদম পিটিয়েছে।
বলে, আমি বোধ হয় আর বাঁচুম না স্যার।
কি জানতে চায় তোমার কাছে?
এবারে সে দ্বিধান্বিত। কতক্ষণ কথা বলে না।
সময় নিয়ে আবারও শুধাই। কি ভেবে এবারে উত্তর দেয়।
আমি নাকি স্যার ইন্ডিয়ার চর। কার কার সাথে যোগাযোগ আছে জানতে চায়।
তুমি কি বলেছ?
স্যার, বিশ্বাস করেন, এসবের আমি কিছু জানিনা। যতই কই, আমি চর না। ফার্মেসীতে কাম করি। খুব গরীব। বস্তিতে মা আর ছোড বইনরে নিয়া থাকি। হেরা বিশ্বাস করে না। কয়, আমাদের খবর আছে। স্বীকার কর। তুই হইলি ইন্ডিয়ার গুপ্তচর। যাগো খবরা-খবর দেছ, তাগো নাম ঠিকানা ক।
তুমি কি স্বীকার গেছ?
না স্যার, আমি মিছাকথা কেন কমু? আমিতো এইসবের কিছু জানিনা। হেরার কথামত স্বীকার যাই না বইলা অনেক অত্যাচার করছে। এই দেহেন স্যার।
হাতের তালু উলটো করে আঙ্গুলের নখগুলো দেখায় চক্রবর্তী। সুঁই ফুটিয়ে ছিল তাতে। ফুলে ঢোল হয়ে আছে। তালু ঘষবার সময় আধো আলোতে খেয়াল করিনি।
আরও কত মাইরযে দিছে। এক সময় আর কিছু জানিনা।
গত রাতে টর্চার সেল থেকে ভেসে আসা আর্তনাদ তাহলে এই চক্রবর্তীরই ছিল। ধীরে ধীরে চক্রবর্তীর শরীর তার তাপ ফিরে পাচ্ছিল।
বললাম, ঘুমিয়ে পড়।
তার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। যখন ফজরের আযান পড়ছিল, তখন চক্রবর্তী ঘুমিয়ে পড়েছে।
দুই সেল পরেরটিতে ছিপছিপে লম্বা মানুষটির কালো দাঁড়ি আছে। মাথায় টুপি। সারাদিনে একবার প্রাতঃকৃত্য ও গোসলের জন্য সেলের বাইরে আনা হয় আমাদের। তখন তার সাথে অল্প দু’এক কথা হয়েছে। হালুয়াঘাটে বাড়ি। স্থানীয় কলেজের প্রিন্সিপাল। বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত। তাঁর হত্যার প্রতিবাদে যুদ্ধ করতে ভারতে গিয়েছিলেন অস্ত্রের জন্য, যেমনটা গিয়েছিলেন একাত্তরে। তার সাথে গিয়েছিল গারো সম্প্রদায়ের যুবকেরা। পরে বাংলাদেশে ঢুকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা। কিছুদিন আগে পুরো গ্রুপটি ধরা পড়ে যায়। নানা জায়গা ঘুরে শেষে ঠাই হয়েছে ডি জি এফ আই’র নিরাপদ এই গর্তে। ফজরের নামাজের আযান এই ভদ্রলোকই দেন। তাঁর গলা ভরাট ও সুমিষ্ট। নামাজের পর তিনি শব্দ করে সুরা পড়েন।
‘তাজ কুরুনি তাজ কুরুন …’ কিম্বা ‘ফাবি আইইয়া আলা ইয়া রাব্বিকুমা তু কাজ্জিবান – তার কণ্ঠে এসব সুরা বহু দুর থেকে ভেসে আসা গানের মত মনে হয়। এ সবই হয়ত রিমান্ডে অত্যাচার থেকে বাঁচবার জন্য। অথবা হয়ত এমনিতেও তিনি ধার্মিক।
ভোর হয়ে গেছে। আমার সেলের দরজা খুলল প্রহরী।
প্রফেসর সাব মালাউন কি বাইচ্চা আছে?
প্রহরীর এই কথার কোন জবাব দেই না। এক সাথে পাঁচ জন করে সেল থেকে বের করে, কারণ বাথরুম পাঁচটি। চারজন গারো যুবক বের হয়েছে দুটো সেল থেকে। আজ ওদের মুখে হাঁসি। বলল, টেলিভিশনে নিয়ে যাবে। তারপর বাড়ি। গোসল হয়ে গেছে। চার গারো যুবককে লাইন করে দাঁড় করান হয়েছে।
ডাইন হাত মেল। সরিষার তেলের বোতল হাতে এক সান্ত্রী আদেশ করলো।
প্রসারিত চারটি হাতের তালুতে তেল ঢালল সান্ত্রী।
ভাল কইরা মাখ, টেলিভিশনে দেখাইব তোগো। আইজ তো তরার ঈদ। নতুন জামা পাইবি একটা কইরা। যেমুন কইরা শিখাইছে, ঠিক কইরা কইবি। নাইলে আইজ রাইতে খবর আছে।
চার যুবক সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। কথা বলে না। তাদের দৃষ্টি তখন হয়ত সেনানিবাসের এই নিরাপদ গর্তের অন্ধকার পেরিয়ে হালুয়াঘাটের নদী, মাঠ, পাহাড়, অরণ্যে নিবিষ্ট হয়েছে। মুক্তির আশ্বাসে তাদের রক্তে কিসের যেন দোলা। মাদল বাঁজার শব্দ হয়তো শোনে।
সেলে ফিরে এসেছি। ঘন ডাল এবং দু’টো রুটি দেয়া হয়েছে। আজ প্লেট দু’টি। চক্রবর্তী এখনো গভীর ঘুমে। আমি জানি ৯ টার দিকে ওরা আসবে। চোখ বেঁধে, হ্যান্ডকাফ পরিয়ে চক্রবর্তীকে নিয়ে যাবে ইন্টারোগেশন রুমে। তার আগেই জরুরী কথাগুলো তাকে বলা প্রয়োজন। নাড়া দিয়ে তাকে জাগালাম। গভীর আতঙ্ক নিয়ে চক্রবর্তী চোখ মেললো। সেলে দিন-রাত নেই। বাল্বের আধো আলোতে আমাকে দেখল। হয়ত স্মরণ করলো গত রাতের কথা। ভাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মনের ভাষা পড়তে চাইলো।
বললাম, চক্রবর্তী শোন, একটু পর তোমাকে নিতে আসবে। কঠিন জিজ্ঞাসাবাদ করবে। ভয়ানক অত্যাচার সব করবে। সব সময় একটি কথাই বলবে – আমি এসব কিছু জানিনা। জীবন গেলেও আর কিছু বলবে না। যদি তা পার, তাহলে একদিন তারা তোমাকে ছেড়ে দেবে। তোমাকে নানা লোভ দেখাবে। বলবে, আমাদের কথা স্বীকার যাও। তাহলে বাড়িতে রেখে আসবো। কিন্তু সাবধান, ঐ ভুল করবে না। তুমিতো বলেছ, ইন্ডিয়ার গুপ্তচর তুমি নও। তাই মারের ভয়ে মিথ্যা বলবে কেন? আর তাতে লাভও হবে না। স্বীকারোক্তি দিলে তোমাকে মামলা দিয়ে পাঠিয়ে দেবে জেলে। আমার কথা কি তুমি বুঝতে পেরেছো?
চক্রবর্তীর চোখে পানি। দু’হাত দিয়ে আমার হাত জড়িয়ে ধরলো।
বলল, আমার বাবা নাই। আপনে আমার বাবা। জীবন থাকতে আপনের কথার বাইরে আর কিছু কমু না।
ফার্স্ট ডিগ্রি, সেকেন্ড ডিগ্রি, থার্ড ডিগ্রি। এ সব ধরণের ইন্টারোগেশন চললো চক্রবর্তীর উপর। দিন-রাত্রি চারদিন ধরে। ছালায় জড়ানো চক্রবর্তীর হিমশীতল নিঃসাড় দেহটি খাটিয়ায় ফেলে যেতো দু’জন সান্ত্রী।
মালাউন শক্ত মাল, তয় যাইব কই। মাইরের উপরে ওষুধ নাই। আরও শক্ত ওষুধ দিমু সামনে।
ছালা দিয়ে জড়ানোর কারণটি বুঝে গেছি। চেতনাহীন শীতল হয়ে পড়া দেহযন্ত্রে তাপ ফেরাবার ব্যবস্থা। সেলের দরজা বন্ধ হবার সাথে সাথে আমার শুশ্রূষা শুরু হয়। চক্রবর্তী চোখ মেলে।
প্রতিবারই বলে, স্যার কিছু বলি নাই।
তার মাথায় হাত বুলাই।
আজ কি করেছে?
আমার এ সব প্রশ্নের উত্তরে চক্রবর্তী জানাতো নানা কঠিন নির্যাতনের কথা। গামছা দিয়ে নাক মুখ বেঁধে উপর থেকে পানি ঢালতো। একটু শ্বাসের জন্য কি প্রাণান্তকর চেষ্টা। এক এক সময় মনে হয়েছে দম বন্ধ হয়ে সে মারা যাবে।
কিছু বলি নাই স্যার।
এক ম্লান পরিতৃপ্তি তার চোখের তারায় দেখতাম।
স্যার, একটা চরকির মতো যন্ত্রের উপরে খার করাইয়া দুই হাত, দুই পা টানা দিছে। পরে ঘুরাইছে। নাড়ী-ভূরি এমুন মুচড় দেয়। ঘাড় কাইত হইলে থামায়।
বুঝতে পারি প্রবল ঘূর্ণনে চেতনা থাকেনা। ঘাড় কাত হয়ে পড়ে তখন।
খুঁটির লগে টাইট কইরা বান্দে। পরে মাথার তালুর উপরে টিপ টিপ কইরা পানি ফালায়। পইলা চোডে খারাপ লাগে না। পরে টাইম যত যায়, মন হয় টিপ টিপানি পানি তাল্লুর ভিতরে গিয়া বাড়ি মারতাছে। মাথা লারান যায়না। খুব কষ্টের স্যার। তার বান্ধে হাতে পায়ে। যন্ত্রে যহন টিপ দেয়, তহন কি কমু স্যার। সারা শইল্লে এমুন ঝাকনি মারে।
ইলেকট্রিক শকের কথা বলছে চক্রবর্তী। সামনের ওষুধ কি হবে তা আমি জানি। চক্রবর্তীকে বলি না। শুধু ভাবি সে ধাক্কা ও সামলাতে পারবে তো।
ডি জি এফ আই’র এই সেইফ হাউসটি নতুন। যেসব বন্দীদের দিয়ে এ’টি উদ্বোধন করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। আমাকে প্রথম যখন ধরে নিয়ে এসেছিল, তখন যেখানে ছিলাম, তা ছিল টিনের ছাউনির বারান্দা ঘেরা একতলা পুরনো বাড়ি। ‘৭৬-এর ১৫ই মার্চ। বিকেলে ওরা আমাকে ধরে। আমার সার্ট খুলে তা দিয়ে চোখ বাঁধে। দু’হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরায়। একটি স্টেশন ওয়াগনের পেছনের সিটে দু’জনের মাঝখানে আমাকে বসিয়েছিল। ওদের রিভলভারের নল আমার দেহ স্পর্শ করছিল। প্রায় আধ ঘণ্টা চলার পর গাড়ি থামে। আমাকে একটি ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে চোখের বাঁধন খুলেছিল।
ডাইনে, বাঁয়ে চাইবেন না, সোজা সামনে তাকান।
আমার পেছনে থাকা অস্ত্রধারী হুকুম করলো।
চোখ মেলে তাকিয়ে কালো পর্দায় ঢাকা একটি বাক্স নজরে পড়লো। তার পেছনের মানুষটির চেহারা দেখা গেল না। ফ্লাশ জ্বলে উঠলে বুঝতে পারলাম আমার ছবি তোলা হোল। এরপর পেছন থেকে একজন কালো কাপড়ের পট্টি দিয়ে শক্ত করে চোখ বাঁধল।
কানের কাছে ফিস ফিস করে বলল, স্যার ভয় পাবেন না, আমি সৈনিক সংস্থার লোক।
ছবি তোলার পর চোখ বেঁধে একটি ঘরের মেঝেতে আমাকে বসানো হয়। পেছনে দেয়াল। পিছমোড়া হ্যান্ডকাফ লাগানো হাতের স্পর্শে তা বুঝতে পারি। এখন সন্ধ্যা হয়ে যাবার কথা। কিন্তু চোখ বাঁধা থাকলে দিন-রাত সমান। সবই অন্ধকার। এই ঘরে যে আরও মানুষ আছে, তা বুঝলাম দরূদ পড়ার শব্দ শুনে।
‘আল্লাহ হুম্মা সল্লে আলা ছাইয়েদেনা মোহাম্মদ, ওয়ালা আলে ছাইয়েদেনা …’ সুর করে পড়া দরূদ শুনছি।
কিন্তু একি, দরূদের মধ্য দিয়ে আমাকে বার্তা দেয়া হচ্ছে!
নতুন ভাই যে আসছেন, একটু ডান দিকে সরিয়া বসেন, আল্লাহ হুম্মা … আপনের বাম দিকে পেশাবের টিন আছে, আল্লাহ হুম্মা … ।
এই ঘরের বন্দীদের জন্য রাখা প্রস্রাবের টিনের পাশে আমাকে বসানো হয়েছে। তাই দরূদের সুরে আমাকে সরে বসার পরামর্শ। বাইরের বারান্দায় সেন্ট্রির প্রহরা। তারা দরূদ শুনে অভ্যস্থ।
পুরনো সেই সেইফ হাউসে আসবার পরদিন সকালে ঘরের বারান্দায় আমাকে একটি চেয়ারে বসানো হোল। চোখ যথারীতি বাঁধা। হাত পেছনে মোড়ানো। তিনজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা এসেছেন। চেয়ার টেনে বসবার শব্দ থেকে তা বুঝতে পারি।
কেমন আছেন প্রফেসর সাহেব?
আমি সামান্য লেকচারার। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেই হয়তো এই সম্বোধন। বিদ্রূপও হতে পারে।
বলি, এই যেমন রেখেছেন। জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, আমার চোখ খুলে দিন। একজন শিক্ষকের হাতে হ্যান্ডকাফ কেন লাগিয়েছেন?
একটু নিশ্চুপ থাকেন তারা। একজন কথা বলেন। হয়তো ইনি দলপতি। গলা ভরাট। কণ্ঠে সমবেদনার ছোঁয়া।
প্রফেসর সাহেব, অনেক উঁচু পর্যায়ের নির্দেশে আপনাকে এভাবে রাখা হয়েছে। আমাদের কিছু করার নেই। আমরা সত্যিই দুঃখিত। আপনিতো সিগারেট খান?
সম্মতিসূচক মাথা নাড়ি।
ওনার হ্যান্ডকাফ খুলে দাও।
নিন সিগারেট খান। হাতে ধরিয়ে দেন।
সিগারেট ঠোঁটে পুরি। একজন মুখ থেকে টেনে নিয়ে আবার তা পুরে দেন।
বলেন, এবার ঠিক হয়েছে।
লাইটার জ্বালানোর শব্দ হয়। আমি লম্বা টান দেই ফিলটার টিপ সিগারেটে।
কি ব্রান্ড আপনার?
ব্রিস্টল।
আজ থেকে প্রফেসর সাহেবকে এক প্যাকেট ব্রিস্টল সিগারেট দেবে প্রতিদিন, দলপতি বলেন। দু’ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ চলে।
প্রফেসর সাহেব, আপনার প্যান্টের পকেটের নোট বইটি আমরা পেয়েছি। বিভিন্ন জনের সাথে আগামী পনেরো দিনের সাক্ষাতসূচি নোট বইতে আছে। তবে বুঝতে পারছি সব সাংকেতিক ভাষায় লেখা। তাদের নাম, ঠিকানাগুলো বলুন।
কেন তা জানতে চান?
আমার এ জবাবে দলপতি বলেন, এই একটু পরিচিত হবো, কথা বলবো। তাদের কোন ঝামেলা হবে না।
এসব কথার সাথে আমি খুবই পরিচিত।
বলি, দেখুন এঁরাই বিপদে আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন, নিজেদের বিপন্ন করেছেন। আর আমি তাদের নাম ঠিকানা আপনাদের বলে দেব? আমার জায়গায় আপনারা হলে কি করতেন? জীবন থাকতে তাঁদের নাম বলবো না। আমাকে দ্বিতীয়বার এমন প্রশ্ন করবেন না।
তারা করেন নি।
প্রথম দিন কানের কাছে ফিস ফিস স্বর, ‘স্যার ভয় পাবেন না, আমি সৈনিক সংস্থার লোক।’ খোদ বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা – এমন সংবাদ হয়তো সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের এই উচ্চপদস্থ তিনজন অফিসারেরও জানা। আমাকে এ সময়ে টর্চার করার পরিণতির কথাও হয়তো তারা ভেবেছেন। আবার এমনও হতে পারে এই অফিসাররা আসলেও চাননি একজন শিক্ষকের উপর নির্যাতন হোক।
কুসুমেও কীট থাকে। এ কথা যেমন সত্য, তেমনি অশুভের মধ্যে শুভ শক্তিও নিশ্চয়ই আছে।
পুরনো ঐ সেইফ হাউসে আমাকে প্রায় এক মাস রাখা হয়। এ সময়ে নির্যাতনের সব কৌশলের সাথে পরিচিত হয়ে যাই। চক্রবর্তীর উপর সর্বশেষ যে ঔষুধটি প্রয়োগ হবে, তার কথাও জেনেছি এখানে।
হাবিলদার মেজর গফুরের কথা একটু বলে নেই। সর্বক্ষণ তিরিক্ষি মেজাজের এই লোকটি পুরনো সেইফ হাউসের ইনচার্জ। সব সময় সুযোগ খোঁজে কখন কোন বন্দীর উপর ঔষূধ প্রয়োগ করবে। তার মনে বড় খেদ, আমার উপর শারীরিক নির্যাতনের অনুমতি নেই। মনের কথা গফুর প্রকাশও করে।
এই ঘরে কত জনরে যে পিডাইছি, ঝুলাইছি তার হিসাব নাই। পিশাব-পাইখানা কইরা দেয়। আপনে আওনের আগে এক সচিবরে আনছিল। সাইকেলের চেইনের পিডায় হের পিঠ, কপাল থিক্কা যে রক্ত বারাইছে, তার দাগ এই ঘরের দেওয়ালে অহনও আছে।
এমনও হতে পারে, গফুর এসব বলে আমাকে কাবু করতে চায়। আরও কায়দা-কানুন আছে গফুরের। সে কথা একটু পরে বলবো।
আমার চোখে কালো কাপড়ের পট্টিতো সেই শুরু থেকেই আছে। হ্যান্ডকাফ পেছন থেকে সামনে আনা হয়েছে। তিন বেলা খাবার ও সিগারেট খাওয়ার সময় ডাকলে সেন্ট্রি এসে হ্যান্ডকাফ খুলে দেয়। শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। তবে কায়দা আমিও শিখেছি। অনেক চেষ্টায় হ্যান্ডকাফ থেকে একটি হাত গলিয়ে বের করতে পারি। ভেবেছি, মেয়েরা তো চুড়ি পরে ও খোলে। আমার হাত বলতে কি বেশ সরু। এখন আরও শীর্ণ। কয়েক দিনের চেষ্টায় হঠাৎ করেই হাত খুলে যায়। কত বড় আনন্দ। আমার একটি হাত মুক্ত। আমি জানি কখন প্রহরী দরজা খুলবে। তালা খোলার শব্দ হতেই নিমিষে হ্যান্ডকাফে হাত গলিয়ে দিতে পারি।
তো গফুরের কথা বলছিলাম। আমাকে কষ্ট দেয়ার নানা ফন্দি-ফিকির খোঁজে গফুর।
চলেন, হেই ঘরে যাই। চুপচাপ বইয়া থাকবেন টুলে। কোন শব্দ করবেন না।
চোখ বাঁধা, হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় আমাকে ধরে ধরে সেই ঘরে নিয়ে টুলে বসায় ও দরজা বন্ধ করে। অনেকক্ষণ বসে আছি। হঠাৎ বুটের আওয়াজ, দরজা খোলার শব্দ। চড়, থাপ্পড়, গালির শব্দ শুনি। লাথির আঘাতে হাউ-মাউ শব্দ করে যে মেঝেতে আছড়ে পরে, তার গলার আওয়াজে বুঝতে পারি কৈশোর শেষ হয়নি তার।
শুয়োরের বাচ্চা, তোগর বাড়িত থাকতে দেছ নাই তারে – একজন নেতার নাম বলে।
হুজুর বিশ্বাস করেন, আমাদের বাড়িতে কোন দিন তিনি আসেননি।
কথা শুনে বুঝি শিক্ষিত পরিবারের ছেলে।
কুত্তার বাচ্চা, তার নাম জানছ না?
হুজুর নাম শুনেছি, কিন্তু কখনো তাকে দেখিনি।
আবারও চর, থাপ্পড়, লাথি।
বান্ধ হারামজাদারে, লেংডা কর।
কিশোরের আর্ত চিৎকার। কব্জিতে কাপড় বেঁধে তাকে ঝুলানো হয়। কিশোরের তারুণ্যময় অনাবৃত শরীরে চাবুকের বাড়ি পড়ে। চোখ বাঁধা কিশোর জানতে পারে না আরও একজন বন্দীকে চোখ বেঁধে এখানে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ফাঁকে ফাঁকে আবারও জিজ্ঞাসা। কিশোরের আর্ত আবেদন, সে কিছু জানেনা। এবার হুকুম হয় শিশ্মে পাথর ঝোলানোর। এর কথা গফুর একবার বলেছিল।
আমার হাতে সূতলিতে ঝোলানো পাথর দিয়ে বলেছিল, প্রফেসর সাহেব যত বড় ঘাগুই হোউক, এই ঔষূধে কাম হয়। হাতে দড়ি বাইন্দা ঝুলাইয়া যহন যন্তরে এই পাত্থর বান্ধি, আর দুই চাইরডা বাড়ি দেই, তহন বাপ বাপ কইরা সব স্বীকার যায়।
সে ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে এখন। কি বলবে এই কিশোর? ঝুলন্ত অনাবৃত কিশোরের শিশ্মে পাথর ঝোলানোর কাজটি নির্বিঘ্নেই সাঙ্গ হয়। কিশোর তা বুঝতেও পারে না। শুধু হয়তো মাধ্যাকর্ষণজনিত এক টান অনুভব করে নিম্নাজ্ঞে। এরপর চাবুকের প্রথম বাড়িটি পড়তেই বুকফাটা চিৎকার বেরিয়ে আসে কিশোরের কণ্ঠ থেকে। আবারও চাবুক, আবারও আর্তনাদ। বলছি, বলছি, আমাকে নামান।
ওরা হাসে। ঔষূধে কাম হইছে।
হাত ফসকে যাওয়া ভারি ঝোলার মতো কিশোর মেঝেতে আছড়ে পড়ে।
এইবার ক।
হুজুর, তিনি কোন দিন আমাদের বাসায় আসেননি। তবে আমার বড় বোনের কাছে শুনেছি, তিনি আমাদের চাচার বাসায় কিছুদিন ছিলেন।
জিজ্ঞাসায় কিশোর চাচার নাম, ঠিকানা বলে দেয়।
আমাকে ছেড়ে দেন, বাসায় রেখে আসেন। আমার মা খুব অসুস্থ, আমাকে না দেখলে তিনি মরে যাবেন।
বাসাত রাইখ্যা আসুম, তয় আরও কয়টা দিন পর। তর বইন, চাচা – তাগো আগে আইন্না লই। তারপরে তোরে ছারুম।
আমাকে একজন ধরে ধরে আমার ঘরে নিয়ে যায়। ঐ কিশোর, তার বোন, চাচা – এদের কথা আর জানা হয়নি। পরদিন রাতেই আমাদের চোখ বেঁধে লাইনে ফাইল করে নিয়ে আসে নতুন সেইফ হাউসে। চক্রবর্তীর উপর এই শেষ ট্রিটমেন্ট হবে শুনে এত কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।
আজ পাঁচ দিন হোল। আশ্চর্যের কথা। চক্রবর্তীকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়নি টর্চার সেলে। এর মধ্যে একদিন গোসলও করতে দিয়েছে তাকে। চক্রবর্তী তার গল্প বলেছে। সেসব গল্পের পরিধি খুবই ছোট। বাবা যে বছর মারা যান, তখন তার বয়স দশ। ছোট বোন সন্ধ্যা ৫ বছরের। বাসায় বাসায় কাজ করে মা চক্রবর্তীকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়িয়েছেন। তারপর থেকেই ও কাজে ঢুকেছে। মাকে এখন আর কাজ করতে হয় না।
স্যার, সন্ধ্যা পড়াশুনায় খুব ভালো। গত বছর মা আর আমি ওর স্কুলের ফাংশনে গেছিলাম। কি কমু স্যার, এমুন সুন্দর কইরা গান গাইল। খুব হাততালি পড়লো। আমি মায়েরে জরাইয়া ধইরা খুব কানছিলাম।
মা, সন্ধ্যা কুন সময় গান শিখলো? কুনো সময়তো গান গাইতে দেহি নাই।
স্কুলেই শিখছে। মা বলেন। জানোস, ছোট বেলায় আমিও গান গাইতাম। তোর ঠাকুরমারও আছিল ভাল গলা।
মা’র মন চলে গেছে সুদূর অতীতে। ‘রেবা নদীর ওপারে কোন শৈল শির’ থেকে ভেসে আসা এক সুর তিনি যেন শুনতে পাচ্ছেন। চক্রবর্তীর চোখে পানি।
স্যার, মা আর সন্ধ্যারে কি আর দেখতে পামু?
আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। কিছু বলি না। টিম টিম আলোতে সে খুব ভাল করে আমার মনের ভাষা পড়তে চায়। আশ্বাস খোঁজে। হয়তো তা পায়ও। আরও কিছু কথা বলে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
এই সেলে দিনমান কাটে চেতনায়-অবচেতনায়। অনেক ওপরে সিলিঙের নিচের দেয়ালে এগজস্ট ফ্যানটি শব্দ করে সারাক্ষণ ঘোরে। তার প্রয়োজনও আছে। লোহার গ্রিলের পর মোটা কাঠের দরজা দিয়ে এই সেল বন্ধ। সে দরজায় পিপিং হোল। তার উপর ঝোলানো টিনের ঢাকনা সরিয়ে বাইরে থেকে ভেতরে দেখে প্রহরী। এগজস্ট ফ্যান চললে বদ্ধ সেলের বাতাস বাইরে যায়। দরজার নিচে সামান্য যে ফাঁক আছে, তা দিয়ে বাইরের বাতাস ভেতরে আসে। অক্সিজেন সঞ্চালনের এই ব্যবস্থা না থাকলে আবদ্ধ এই সেলে দম আটকে মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু এগজস্ট ফ্যানের ধাতব শব্দ? দিনের বেলাটা কোন রকমে কাটে। আশ পাশের বন্দীদের দরূদ পড়া, অল্প সময়ের জন্য সেলের বাইরে আসতে পারা, প্রহরীদের আনাগোনা – এসবে ঐ শব্দকে ভুলে থাকা যায়। কিন্তু রাতে? একেবারে মাথার ভেতরে আঘাত করতে থাকে। এক এক সময় মনে হয় চুল ছিঁড়ে ফেলি। নানা কথা স্মরণ করে মনকে অন্যমনস্ক করতে চাই। ফ্যানের শব্দ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে বাজে। ঘুম আসে না। চক্রবর্তী তখন গল্প শুরু করে। ঘুরে ফিরে একই গল্প তার মা ও সন্ধ্যাকে নিয়েই। কিন্তু কি আশ্চর্য! ধীরে ধীরে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
গোসলের জন্য সেলের বাইরে আনা হয়েছে। বাথরুমের কাছে বিমান বাহিনীর কর্পোরাল আমিরের সাথে দেখা।
কেমন আছেন স্যার? আমিরের বাড়ি যশোর। পরিষ্কার শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। চক্রবর্তী তো সুস্থ হয়ে উঠেছে। তবে আজ রাতে টিকলে হয়।
আমিরের এই কথায় বুকটা ধক করে উঠে।
জানেন স্যার, অদ্ভুত ছেলে। থার্ড ডিগ্রিতেও কাজ হয়নি। তার এক কথা। কিছু জানিনা। কত দেখলাম, মারের হাত থেকে বাঁচতে মিথ্যাকে সত্য বলে। আমাদের কথায় সায় দেয়। কিন্তু এই ছেলের কোন ঔষূধে কাজ হচ্ছে না।
মনে মনে ভাবি, সে তো আমার কথায় বিশ্বাস করে সব কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছে। বাড়িতে ফিরবে। মা ও সন্ধ্যার কাছে। আমির ফাঁক পেলেই কথা বলে। কে জানে সেও সৈনিক সংস্থার সদস্য কিনা।
অজানা শঙ্কা নিয়ে সেলে ফিরি।
চক্রবর্তী শোন। আজ রাতে তোমাকে আবার নিয়ে যাবে। এটাই হয়তো শেষ। আজকের পরীক্ষায়ও পাশ করতে হবে তোমাকে। পারবে না।
চক্রবর্তীর চোখে অন্য আলো দেখি।
পারুম স্যার। বাবার আদেশ জীবন থাকতে ভুলুম না।
রাতের খাবার হয়ে গেছে। রাত গভীর হচ্ছে। আজ আর চক্রবর্তীকে গল্প শোনাতে বলিনা। নিশ্চুপ থাকি।
স্যার, আইজ তো শেষ রাইত। আপনে তো কইছেন, স্বীকার না গেলে আমারে বাড়িত রাইখ্যা আসবো। তাইনা স্যার। আমি ঠিক পারুম।
বাইরে বুটের আওয়াজ। কাঠের দরজা খোলার শব্দ, তারপর লোহার গ্রিল।
উঠ, মালাউন। আইজ তর শেষ দিন।
চক্রবর্তী খাটিয়া থেকে নামে। একজন এসে দু’পরত কালো কাপড়ের পট্টি দিয়ে শক্ত করে চোখ বাঁধে। হ্যান্ডকাফ লাগায় আরেক জন। আমার সেলের দরজা বন্ধ হয়। বুটের শব্দ ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ হয়। টর্চার সেলটি দূরে, একেবারে শেষ প্রান্তে।
আজ এগজস্ট ফ্যানের শব্দ কোন সমস্যা করে না। মনের পর্দায় নানা দৃশ্য দেখি। হাবিলদার মেজর গফুরের কথা মনে হয়। একহারা লম্বা মানুষটির চেহারায় মায়া-মমতার লেশমাত্র ছিল না। বন্দীদের অত্যাচার করার নানা ফন্দি আঁটত সারাক্ষণ। নাজি কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে এমন চরিত্রের দেখা পেয়েছি সিনেমায়। মানুষকে কষ্ট দিয়ে এরা আনন্দ পায়। তারপরও মানুষের মন।
একদিন গফুর বলে, স্যার সব সময় পেট খারাপ থাকে। খাবার হজম হয় না। সি এম এইচে গেছি কয়বার। ডাক্তার সাব ঔষূধও দিছে। কাম হয় না।
মনে মনে ভাবি তা বিচিত্র কি!
এক কাজ করতে পারেন। আগামী দুই সপ্তাহ কাউকে টর্চার করবেন না। বাড়িতে আপনার ছোট মেয়েটির জন্য একটা পুতুল কিনে নিয়ে যাবেন। মনটাকে আনন্দে রাখবেন।
আমার এসব কথায় গফুর হাসে।
কি যে কন প্রফেসর সাব। ঔষূধ দিয়া কথা বাইর করা হইল আমার ডিউটি।
বলি, অনেক ডিউটি করেছেন, এবার একটু বিরাম দিন। দেখবেন আপনি ভাল হয়ে গেছেন।
পুরনো সেইফ হাউসে আরেক দিনের কথা। কালো চশমার জেনারেলের শাসন চলছে। মার্চের শেষ। বিকেলে গফুর শহরে গেছে। নেভির পেটি অফিসার সিরাজ চার্জে আছেন। মানুষটি ভাল। সন্ধ্যা হয়ে আসতেই জোর হাওয়া বইতে শুরু করলো। কাল বৈশাখীর প্রবল ঝড়। হঠাৎ করেই আমাদের ঘরের জানালাটি সশব্দে খুলে গেল। খবরের কাগজ দিয়ে ঢাকা জানালার কাঁচ ভেঙ্গে পড়ল। এই প্রথম খোলা গ্রিল দিয়ে বাইরেটা দেখতে পেলাম। একেবারে রাস্তার পাশে এই বাড়ি! রাস্তাটিও তো চেনা। এ বাড়ির বাইরের পাঁচিল খুব উঁচু নয়। বারান্দা থেকে দৌড়ে গেলে এক লাফে পাঁচিলের উপরটা ধরে টপকে যাওয়া যাবে। আমি জানি বাড়ির বাইরের ব্যারাকে এক প্লাটুন সৈন্য আছে। কিন্তু কাল বৈশাখীর ঝড়ে বাইরে কেউ নেই নিশ্চয়ই। তার উপর বিদ্যুৎ চলে গেছে।
বারান্দায় পায়চারিরত সিরাজ জানালা খুলে যাওয়ার শব্দ পেয়েছে।
চিৎকার করে বলল, সে ভেতরে ঢুকে জানালা বন্ধ করতে আসছে।
মুহূর্তে চিন্তাটি মাথায় এল। আমি পালিয়ে যাব। হ্যান্ডকাফ তো আমি খুলতে পারি। দরজা খুলে সিরাজ ঘরে ঢোকামাত্র তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে বারান্দা থেকে এক দৌড়ে আমি পাঁচিল টপকে যাব। ঝড়ে ঘন অন্ধকারে পালিয়েও যেতে পারব। বাইরের রাস্তা, আশপাশ সবই তো আমার চেনা। পরিচিত বাড়িও আছে কয়েকটি। এ ঘরে আরও দু’জন বন্দী আছেন। একজন বয়স্ক। অপরজন জাহাঙ্গীর আমার বয়সী। আগে থেকে চেনা। দরজা খোলার শব্দ হচ্ছে। আমি হ্যান্ডকাফ খুলে ফেলেছি।
বড় একটি ভুল করে ফেললাম।
জাহাঙ্গীরকে বললাম, আমি চলে যাচ্ছি।
মুহূর্তে সে আমাকে জাপটে ধরল।
বলল, সিরাজকে এখনই বলে দেব।
জাহাঙ্গীর দীর্ঘদেহী। শক্তিমান। মনে তার ভয় ডুকেছে। আমি পালালে তাকে ছাড়বে না। তার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলাম না। সিরাজ ঘরে ডুকেছে। চাইনিজ সাবমেশিনগানটি পিঠে ঝোলানো। জানালার কপাট লাগাচ্ছে। অন্ধকার ঘরে জাহাঙ্গীর আমাকে ধরেই থাকলো। সিরাজ দু’একটা কথা বলল। তারপর দরজায় তালা দিল। জাহাঙ্গীরের শক্ত বেষ্টনী থেকে আমি ছাড়া পেলাম। মুক্তির এমন সুযোগ হয়তো একবারই আসে। অথবা কে জানে, সে সন্ধ্যায় সাবমেশিনগানের বার্স্ট ফায়ারে হয়তো আমার মৃত্যুই হতো।
কি হবে আজ রাতে? চক্রবর্তী কি মুক্তি পাবে?
মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। থেকে থেকে চক্রবর্তীর করুণ আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি। আজকের রাতটিকে বড় দীর্ঘ মনে হচ্ছে। সেলের দরজা খোলার শব্দ হতেই বুকটা ধড়াস করে ওঠে। দু’জন সেন্ট্রি ছালায় জড়ানো চক্রবর্তীকে খাটিয়ায় শুইয়ে দেয়।
স্বগোক্তি করে একজন। পোলাডা বাঁচবো তো?
দরজা বন্ধ হতেই আমি উঠে বসি। ছালা সরিয়ে চক্রবর্তীর মুখটি দেখি। হিম শীতল দেহ। চক্রবর্তী সাড়া দেয়না। কেমন যেন মনে হয়। ওকি আর চোখ খুলবে না। পালা করে হাত ও পায়ের তালু ঘষি। শেষ পর্যন্ত চক্রবর্তী চোখ মেলে।
“তুমি শুধু দু’বার বেঁচে থাক। একবার, যখন তুমি জন্ম নিয়েছো, আর একবার, যখন তুমি চোখের সামনে মৃত্যুকে দেখ।”
চক্রবর্তী কি তেমন কিছু দেখেছে?
খুবই ধীরে কিন্তু স্পষ্ট স্বরে চক্রবর্তী বলে, স্যার স্বীকার যাই নাই।
তারপর চোখ বন্ধ করে। আমি লাফ দিয়ে খাটিয়া থেকে নামি। লোহার গ্রিলের ওপাশে কাঠের দরজায় আঘাত করতে থাকি। চিৎকার করে প্রহরীকে ডাকি।
দরজা খুললে ওদের বলি, ছেলেটি বোধহয় আর বাঁচবে না। ওকে ডাক্তারের কাছে নেন। দু’জন ভেতরে ঢোকে। ধরাধরি করে চক্রবর্তীকে বাইরে নেয়। সেলের দরজা বন্ধ হয়।
ডি জি এফ আই’র নিরাপদ গর্তে চক্রবর্তীকে আর দেখিনি। কেউ তার কথা বলেনি। মা আর ছোট বোন সন্ধ্যার কাছে সে কি ফিরে যেতে পেরেছিল? আমার কথায় বিশ্বাস করে তার কি ঘরে ফেরা হয়েছিল? না কি বেওয়ারিশ লাশ হয়ে ভেসে উঠেছিল ওদের ঘরের খুব কাছে রামপুরা ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নোংরা পানিতে?
মো. আনোয়ার হোসেন
অধ্যাপক, প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অনুজ, শহীদ কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম)।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৩ comments
তানভীর - ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ (৬:১২ পূর্বাহ্ণ)
ভালো লেগেছে…এইসব ইতিহাসআশ্রয়ী ট্রুথ-ফিকশন নিয়ে উপন্যাসও হতে পারে…
আমাদের এখানে ঐ সময়ের অবিশ্বাস্য সব বাঁক আর বাঁক-বদল; আর তার ফাঁকে ফাঁকে জমে থাকা সাহস আর দেশপ্রেম নিয়ে কোনো বড় কাজ সেইভাবে হয়নি (সুশান্ত মজুমদার ‘গরম হাত’ বলে একটা উপন্যাস লিখেছেন, সেটা ভালো)…ফলে; লেখক, মো. আনোয়ার হোসেন, উপন্যাস এ হাত দিলে, সেটা আমাদের জন্য একটা প্রাপ্তি হবে, নিশ্চিতভাবেই…
রিয়াজুল হোসেন - ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ (২:২২ অপরাহ্ণ)
আমি জানি এটা গল্প নয়, পুরোটাই সত্যি ঘটনার বর্ণনা। এটি পড়ে কিছু জায়গায় যেমন হাসি পেয়েছে, কিছু জায়গায় প্রচন্ড আবেগাপ্লুত হয়েছি, ঘটনার নায়কদের কষ্টে কষ্ট অনুভব করেছি আমিও। থেকে থেকে দুঃশাসন আর অনাচারের একটা চিত্র ফুটে উঠেছে। শেষে চক্রবর্তীর কি হল সেটা জানা না গেলেও আমি মনে প্রাণে ভেবে নিয়েছি সে যেন সত্যি সত্যিই তার ঘরে ফিরে যেতে পারে। তাহলেই না তার ঘরে ফেরা হল। বর্ণনা খুবই প্রাঞ্জল এবং গল্পটি সুলিখিত হয়েছে।
S. Ashraf Ahmed - ২১ জানুয়ারি ২০১৫ (১:২৬ পূর্বাহ্ণ)
আগে একবার মন্তব্যের ঘরে লিখেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে তাড়াতাড়িতে আমার নাম ও ইমেইল ঠিকানা না লিখেই পেশ করেছিলাম। ফলে তা এখন আর দেখতে পাচ্ছি না!
যাই হোক লেখাটি আমার পড়া হয়েছে দুইবার, প্রতিবারই এক নিঃশ্বাসে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা অনেক সহজ কারণ কাল্পনিক ভাল কিছু নিয়ে লিখতে গেলে মাথার কিছু ঘাম ঝরাতে হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত ঘটনা যখন সামষ্টিক রূপ নেয় এবং তা লেখকের কল্যানে পাঠককে চুম্বকের মত শক্ত করে ধরে রাখে তখন তা সাহিত্যে উত্তীর্ণ হয়। ‘চক্রবর্তীর ঘরে ফেরা’কে আমার তাই মনে হয়েছে।
আমাদের দেশে রিমান্ডের নামে যে অমানুষিক একটি ব্যপার চালু আছে তাকে সম্বল করে লেখক আনোয়ার হোসেন তাঁর সহবন্দী চক্রবর্তীর নির্মম নির্যাতনের বর্ণনায় নিজের অভিজ্ঞতাই যেন তুলে ধরেছেন। কিন্তু একই সাথে এই নিরীহ কিশোর চক্রবর্তীর মা এবং ছোটবোনের প্রতি ওর স্নেহভালবাসার ছিটেফোঁটা উল্লেখ করাতে শেষ পর্যন্ত ওর বেঁচে থাকা বা না থাকার ব্যপারটি পাঠকের মনে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে গেছে। চক্রবর্তীর জন্য আমাদের মন কাঁদে। মন কাঁদে চক্রবর্তীর মত আরো শতশত মানুষের ওপর একই শারিরীক নির্যাতনের কথা ভেবে।
একই সাথে আমাদের বিচার বিভাগ সাথে এই অমানুষিক ও বরবরোচিত নির্যাতনের কথা জেনেও কিভাবে কিভাবে রিমান্ডের অনুমোদন দেয় তা ভেবে শঙ্কিত হই! এই প্রিথার বিলুপ্তি কামনা করি।
লেখক তাঁর সমৃদ্ধ ও ঘটনাবহুল জীবন অভিজ্ঞতা নিয়ে আরো অনেক লেখা উপহার দেবেন তেমন প্রত্যাশা করি।