পঞ্চমীর চাঁদ তখনো ডুবে যায়নি। তার আলোয় প্রথম যা নজরে পড়লো তা একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেলের নল। শীতের ঠাণ্ডা এখন স্বস্তিদায়ী। তারপরও নদীর খোলা হাওয়ায় একটু শীত অনুভব করি আমরা। আমরা যে নৌকাটিতে উঠেছি তা ঠিক সাম্পান নয়। যদিও নাফ নদীতে প্রায় সব নৌকাই ছই তোলা সাম্পান। এ নৌকাটি ছিপ নৌকার মত। লম্বা ও খোলা। তার দু’পাশে দু’জন করে চারজন যুবক বৈঠা নিয়ে বসেছিল। নৌকার পাটাতনে বিছানো ছিল রাইফেলটি। মোক্তারের নির্দেশে ঐ যুবকেরা আমাদের ব্যাকপ্যাকগুলো এমনভাবে গুছিয়ে রাখছিল যাতে নৌকার ভারসাম্য ঠিক থাকে। আমরা পনের জন যুত হয়ে বসেছি। নৌকা চলতে শুরু করেছে। সঁপাসপ বৈঠা পড়ছে। নাফ নদীর নোনা পানি কেটে নৌকা চলছে তীরবেগে।

জামার সাইড পকেটে হাত ঢোকাল মোক্তার। তারপর বের করা হাত যখন মেলে ধরল, তখন চাঁদের আলোয় পাঁচটি বুলেট চকচক করে উঠল। আমরা চলেছি অজানা গন্তব্যে। মোক্তার আমাদের গাইড। সুঠাম চার যুবকের আটটি হাতের ছন্দময় আন্দোলনে নৌকা এগিয়ে চলেছে। সাম্পানের গতি মন্থর। আমাদের এপারে যেমন আছে ই পি আর ঠিক তেমনি ওপর পারে সীমান্তরক্ষী নাসাকা বাহিনী। দ্রুত গতির গানবোট আছে তাদের। ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে ওপারে পৌঁছাতে হবে। এই নিশুথি রাতে লম্বা ছিপ নৌকা বেছে নেয়ার কারণটি বোঝা গেল। খোলা রাইফেল ও তাজা বুলেট কেন দেখালো মোক্তার? তা কি একথা বোঝাতে যে আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অস্ত্র আছে আমাদের সাথে। না কি আমাদের মনে ভয় সঞ্চার করা তার উদ্দেশ্য? টেকনাফ বাজারের পশ্চিমে পাহাড় পেরিয়ে মোক্তারের বাড়ি। আমাদের নিয়ে যাচ্ছে আরাকানে। চার যুবকের সাথে তার কথোপকথন আমরা সামান্যই বুঝতে পারি। তবে আমাদের সাথে যখন সে কথা বলে, তখন তা ভিন্ন। ঠিক চট্টগ্রামেরও নয়। পনের জনের এই দলে সাঈদ ভাই ও আমি চট্টগ্রামের ভাষা বেশ বুঝতে পারি। আমাদের স্কুল জীবনের একটা সময় কেটেছে মিরেশ্বরাই স্টেশনে। তবে মোক্তারের কথা অন্যেরাও বুঝতে পারে। মোক্তার বহু জায়গা ঘুরেছে। শুনেছে নানা ভাষা। সবার বোধগম্য করে কথা বলার কায়দাটি সে ভালই রপ্ত করেছে।

আমরা যখন ওপারে পৌঁছেছি, তখন চাঁদ প্রায় ডুবে গেছে। আরও যুবকদের আমরা অপেক্ষমাণ দেখি। মোক্তারের নির্দেশে ওরা টপাটপ ব্যাকপ্যাকগুলো মাথায় উঠিয়ে নেয়। ওদের সাথে মোক্তারের স্বল্প বাক্যবিনিময় আমরা ধরতে পারি না। দ্রুত চলতে শুরু করে ওরা। ব্যাপারটা কি হচ্ছে, জানতে চায় সাঈদ ভাই চট্টগ্রামের ভাষায়।

চিন্তা ন গইয্যুন। অ-না-রা-ততে এক্কানা কষ্ট হইবু। ইতারা আঁরার মানুষ। আঁর ঘাডিত লই যাইবু।

মোক্তারের এ কথার পরও সাঈদ ভাই বলে,

থাইমত খন টাঙও, অ্যাঁরার জিনিষ অ্যাঁরা টাইন্নুম, কনও অসুবিদা নাই।

মোক্তার কথা বলে না। হাতের ইশারায় আমাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে। সন্দেহটি দানা বাঁধতে থাকে তখন থেকে। কোথায় আমাদের নিয়ে চলেছে মোক্তার? এর আগে একবার ওর সাথে দেখা হয়েছে। আমাদের দলপতি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। মধ্য বয়সী মোক্তারের মুখে হাল্কা হাসিটি লেগেই থাকে। কথা বলে কম, শোনেই বেশী। বার্মার কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যোগাযোগ আছে তার। মোক্তারের সাথে সে সাক্ষাতের সময়ই ঠিক হয়েছিল, আরাকানে কমিউনিস্ট পার্টির ঘাঁটি এলাকায় সে আমাদের নিয়ে যাবে।

সারিবদ্ধ আমাদের জোর কদম যাত্রা শেষ হয় প্রায় দু’ঘণ্টা পর। ভোর হতে তখন আর খুব বেশী বাকি নেই। সমতল শেষ হয়ে পাহাড়ের শ্রেণী শুরু হয়েছে। আমাদের পথ চলা শেষ হয় যেখানটায়, তা একটি বড় গুহার মত। পায়ে চলার সরু পথ ছেড়ে এলোমেলো বন-বাদাড় পেরিয়ে গহীন এই জায়গায় আমাদের আনা হয়েছে। পাঁচ ব্যাটারির আলো ফেললো মোক্তার। তাতে ভেতরটা দৃশ্যমান হোল। মাটিতে খড় বেছানো দেখে বোঝা গেল মানুষজনের পা এ গুহায় আগেও পড়েছে।

ইবা জাগা নিরাপদ, আজিয়া দিনর বেলাত অনারা বেয়াজ্ঞুন এডে থাইবান যে। বাইরে ন যাইবান। আঁই তরাতরি চলি আইস্যুম।

দ্রুত মোক্তার আরও যা জানিয়ে যায়, তা হোল নাসাকা বাহিনীর ঘাঁটি খুব দূরে নয়। মোক্তার অপেক্ষা করে না, সঙ্গী দু’জনকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় ভোরের আলো ফুটবার আগের অন্ধকারে।

হাত-পা ঝাড়া আমরা। আমাদের সব জিনিষপত্র তো নিয়ে গেছে মোক্তারের লোকজন। শুকনো খাবার ও ফ্লাস্কে পানি ছিল ব্যাকপ্যাকে। সারা রাতের রোমাঞ্চকর যাত্রায় তৃষ্ণা ও ক্ষুধা পেয়েছে আমাদের। তারপরও খড় বেছানো গুহাটি দেখে আমরা আরাম বোধ করি। ঘুমও পায় আমাদের। গা এলিয়ে দিয়েছে অনেকে। ভোরের আলো দৃশ্যমান হচ্ছে। ঘন অরণ্যের ফাঁক গলে সূর্য রশ্মি পৌঁছে গেছে গুহা মুখে। প্রকৃতির ডাক শব্দটি কে কখন আবিষ্কার করেছে? সে ডাকে নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে অনেকের। কিন্তু মোক্তারের নির্দেশের কথা মনে হতেই গভীর ভাবনা আচ্ছন্ন করে আমাদের। এক শব্দহীন ভয় আছর করে গুহায়। সাঈদ ভাই কথা বলে প্রথম।
নাহ্ এভাবে থাকা যায় না। আমি যাচ্ছি বাইরে।

সানিউল্লাহর স্থান আমাদের দলপতির পরেই। আমরা বাচ্চু ভাই বলে ডাকি। বাচ্চু ভাই ভাল ইংরেজি লেখেন, ভাল বলতেও পারেন। তার বুক পকেটে একটা চিঠি আছে। দলপতির লেখা বাংলা চিঠিটির পরিমার্জন করেছেন বাচ্চু ভাই। ইংরেজিতে তরজমাও করেছেন। আমাদের এই অভিযাত্রা শুরুর আগে দলপতি সবাইকে শুনিয়েছেন সে চিঠি। মতামতও নিয়েছেন। বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টি প্রধানকে সম্বোধন করে লেখা সে চিঠিতে তাদের সাহায্য চাওয়া হয়েছে। পূর্ববাংলাকে আমরা স্বাধীন করতে চাই। আরাকানকে ব্যবহার করতে চাই পশ্চাদভূমি হিসেবে। পেগু পাহাড় পেরিয়ে শান প্রদেশ হয়ে আমরা চীন দেশেও যেতে চাই।যোগাযোগ করতে চাই কমরেড মাওসেতুংএর সাথে। চিঠিতে স্বাক্ষর আছে দলপতির। আমাদের সংগঠনের নাম আছে শেষে।

বাচ্চু ভাইয়ের চশমাটি ভারি। একটু বেঁটে, নাদুস-নুদুস বাচচু ভাই। ভারতের উত্তর প্রদেশে তার জন্ম। পার্টিশনের পর মোহাজের হিসেবে তার পরিবার এসেছে পূর্ব বাংলায়। তার ছোট ভাই রাজিউল্লাহ কলেজে আমার সহপাঠী ছিল। বাচ্চু ভাইও পড়তেন সে কলেজে। হাসি মুখের কিছু মানুষ আছেন, যাদের দেখলেই মনে হবে ভাল মানুষটি। বাচ্চু ভাই তেমন। দলপতির অবর্তমানে বাচ্চু ভাইই আমাদের নেতা। সাঈদ ভাই গুহার বাইরে গেলেন বাচ্চু ভাইয়ের কোন অনুমতি না নিয়েই।

আমার অগ্রজ সাঈদ ভাই দলে যুক্ত হয়েছেন দিন পনের আগে। তিনি ঠিক করেছিলেন ব্যবসা করবেন। সাঈদ ট্রেডার্স নাম দিয়ে একটি প্যাডও ছাপিয়েছেন। হলে আমার রুমে অনেকের ব্যাকপ্যাকগুলো সারিবদ্ধ আছে। আগামীকাল রাতের ট্রেনে আমাদের যাত্রা। দলপতি আগে থেকেই টেকনাফের হ্নলাতে আছেন। বাচ্চু ভাই আমার রুমে এসেছেন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি দেখতে। আমাকে যেতে হবে চকবাজারে পশারির দোকানে। সাঈদ ভাই এলেন তখন। ব্যবসার নানা পরিকল্পনা তার মাথায়। সে নিয়েই কথা বলতে এসেছেন।

তুমি বাচ্চু ভাইয়ের সাথে কথা বল। আমাকে বেরুতে হবে একটু।
ঘরে এত ব্যাকপ্যাক দেখে নানা প্রশ্ন না করে সাঈদ ভাই। তাই কথা বাড়াতে চাচ্ছি না।
আমার ফিরতে একটু দেরী হবে। পরে কথা হবে।
আমার এ কথায় সাঈদ ভাইকে বিশেষ চিন্তিত মনে হয় না।
অসুবিধা নাই, আমি একটু থাকব।

সাঈদ ভাই আলাপী মানুষ। আমি জানি বাচ্চু ভাইয়ের সাথে সে জমিয়ে আলাপ করবে তার ব্যবসা নিয়ে। কেনা-কাটা সেরে রুমে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কিন্তু একি, সাঈদ ভাই তো এখনো যাননি! রহস্যময় হাসি তার মুখে।

তুমি এখনো যাওনি।
আমার এ কথার জবাব দেয়না সাঈদ ভাই। তারপর যা বলে তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।
আমিও যাচ্ছি তোদের সাথে।
বাচ্চু ভাইয়ের দিকে তাকাই। হাসিমুখে তিনিও বলেন
সাঈদও যাবে টেকনাফে।
বয়সে বাচ্চু ভাইয়ের থেকে সাঈদ ভাই দু’বছরের বড় হবেন। তবে গত কয়েক ঘণ্টায় তারা বেশ বন্ধু হয়ে গেছেন। সরাসরি নাম ধরে ডাকা থেকে তা বুঝতে পারি।
তোমার ব্যবসা?
গোল্লায় যাক বিজনেস।

সাঈদ ভাইয়ের জীবন বর্ণময়। কলেজ জীবনে ছাত্র ইউনিয়ন করেছেন। এর আগেও ব্যবসার চেষ্টা করেছেন কয়েকবার। সফল হননি।

আরাকানের গোপন গুহা থেকে সাঈদ ভাই বের হয়েছেন অনেকক্ষণ। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আ কা ফজলুল হক কথাটি বলল।
লিডার এ কেমন কথা, আপনার পারমিশন না নিয়ে সাঈদ ভাই বাইরে গেল, এখনোতো ফিরছে না। কেউ যদি তাকে দেখে ফেলে? কি হবে আমাদের?

বাচ্চু ভাই হাত উঁচিয়ে তাকে থামান।

সাঈদকে আমি চিনি। ভয় পেয়ো না। আর সে চট্টগ্রামের ভাষা জানে। মোক্তারের সাথে তার কথাবার্তা শোননি? সে ঠিকই কিছু খবর নিয়ে আসবে। আর এভাবে এই গুহায় থাকাটাও তো নিরাপদ মনে হচ্ছে না।
বাচ্চু ভাই কথা শেষ করেন। এক অজানা আশংকা নিয়ে আমাদের অপেক্ষার পালা চলতে থাকে।

সাঈদ ভাই ফেরেন। তবে একাকি নয়। সাথে বুড়ো বয়সী একজন।

গুহা থেকে বেরিয়ে পানি খুঁজছিলাম। একটা ছড়াও পেয়ে যাই। মহিষ নিয়ে ইনি যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে ভয় পেয়ে চলে যেতে চান। বুঝিয়ে নিয়ে এসেছি। কিছু কথাও হয়েছে। চাঁটগায়ের ভাষা বোঝেন।

সাঈদ ভাইয়ের কথা শুনে সবাই তাকাই বুড়োর দিকে। আতঙ্ক ও অবিশ্বাসের ছায়া বুড়োর চেহারায় এখনো বেশ আছে। সাঈদ ভাই যে কাহিনী এই বুড়োর সাথে ফেঁদেছে, তার একটা সারসংক্ষেপ এখন বলব।

অ্যাঁরা মুসলমান। টেকনাফত্থুন অ্যাঁয়যযি। আরাকানের মুসলমান ভাইঅগগলর আজাদী অ্যাঁরা চাই। নাফ নদীর হেই পারত অ্যাঁরার বড় দল আছে।

আমাদের প্রত্যেককে ভালো করে দেখে বৃদ্ধ। বোঝার চেষ্টা করে। ছেলেগুলোকে দেখেতো খারাপ মনে হয় না। কথাও যা বলছে তাওতো সত্যি। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে বৃদ্ধের মন পাক খায়। সাঈদ ভাই তার কথা চালিয়ে যায়।

অ্যাঁরা ঢাকাত থাকি। ইনভারসিঠিত হরি।

চাঁটগাঁয়ের এমন নানা কথা বলা হয়ে গেছে বুড়োকে।

ওঁনেরা হজ্বও যাইত ন পারেন।

এ প্রসঙ্গও সাঈদ ভাই তোলে। আরাকানবাসী মুসলমানদের হজ্বে যেতে না পারার বেদনার কথা সাঈদ ভাই জানে। বুড়ো ভাবে। বার্মা সরকার, সীমান্ত রক্ষী বাহিনী, বৌদ্ধ সম্প্রদায় – এদের নিপীড়নের কথা হয়তো স্মরণ করে। এক ফাঁকে তার হজ্বে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানায়। আমরা সে ব্যবস্থা করতে পারবো কিনা জানতে চায়।

হেত কিছু ন, সামনের হজ্বে অনে অ্যাঁর আনারার গ্রামত্তুন যারা যাইতো চায়, হিতারার জওনের হক্কল ব্যবস্থা অ্যাঁই গইযযুম।

সাঈদ ভাইয়ের এ প্রত্যয় শুনে বৃদ্ধের চোখ উজ্জ্বল হয়। একটু সহজ হয়েছে সে।

অ্যাঁই মনে গইযযিদি ওঁনেরা হেইপারের ডাকাইত।

বুড়োর সরল স্বীকারোক্তি। তবে সাঈদ ভাই যখন বলে টেকনাফের মোক্তার আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে, তখনই আতঙ্ক দেখা যায় বুড়োর অবয়বে।

মোক্তার – হিতি তো বড় ডাকাইত। অ্যাঁরা খুব ডরাই। হিতার বড় ডাকাইত দল আছে। হিতারার ডেরা হেই ঘন জঙ্গলও। কেয় ন যায় হেডে। এই পাড়র জওয়ান পোয়া হগগল হিতার দলত্ আছে।

চকিতে গত রাতে আলো-আঁধারিতে নৌকায় এবং নাফ নদীর এপারে সুঠামদেহী নিঃশব্দ যুবকদের অবয়ব আমাদের চোখে ভেসে উঠে।

অ্যাঁই অহন বাড়িত যাইর। অনেরার খানার জোগাড়-যন্ত্র করি। তরা করি আইস্যুম অ্যাঁর পোলারে লই।

বুড়ো চলে যায়। মিশ্র এক অনুভূতি। কিন্তু প্রকৃতির ডাক অন্য কিছু ভাবতে দেয় না। গুহার বাইরে যাওয়া এবং সাঈদ ভাইয়ের বলা ঝরণার কথাই সবার মনে হয়। দ্রুতই প্রাতঃকৃত্য সেরে গুহায় ঘন হয়ে বসেছি আমরা। বুড়ো কি ফিরে আসবে? না খবর দেবে নাসাকা বাহিনীকে? পাড়ার লোকেরা কি ভাবে নেবে তার কথা? মোক্তার ডাকাত আমাদের এই গুহায় এনে রেখেছে। সে যখন জানতে পারবে স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে, তখন কি হবে গ্রামবাসীর? ভয় ব্যাপারটি এমন যে তা দ্রুতই সংক্রামিত হয়। তেমনটাই ঘটছে এই গুহায়। নাফ নদী তো বহুদূর। পথও আমরা চিনিনা। পারই বা হব কি করে? নাসাকা বাহিনীর ঘাঁটি দূরে নয়। তাদের টহল আছে। এখানকার মানুষ-জনদের আই ডি কার্ড আছে। বার্মিজ বাহিনীর হাতে পড়লে হয় মৃত্যু না হয় ১৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। এসব ভাবনা সবার মনে। তার ছাপ পড়েছে চেহারায়। সবার দৃষ্টি গুহার প্রবেশমুখে। কাদের দেখা পাওয়া যাবে সেখানে? খাবার নিয়ে বৃদ্ধ ও তাঁর পুত্র, নাকি উদ্যত অস্ত্র উঁচিয়ে বার্মিজ সীমান্তরক্ষী বাহিনী? অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়। নীরবতাও নেমে আসে।

আ কা ফজলুল হকের কথা আগে একটু বলেছি। সেই নীরবতা ভাঙ্গে। এমন এক মিটারের কথা সে বলে, যার নাম আগে কেউ শোনেনি।
ভাইসব, আমি এক মিটার আবিষ্কার করেছি। ভয় মাপা যায় তা দিয়ে। আমার এই ভয়োমিটার দিয়ে এখন আমি মেপে দেখবো আপনারা কে কতটুকু ভয় পেয়েছেন। যন্ত্রটি পরীক্ষামূলক, তাই আপনাদের পয়সা দিতে হবে না। তবে একটা কথা, আমার এই মিটারে যারা বেশি ভয় পেয়েছেন বলে জানা যাবে, তাদের কিন্তু খবর আছে। আপনারা তো আমাদের মহান নেতার শিক্ষা ভুলে যান নাই। বিপ্লবীরা হবেন ভয়শুন্য। আমরা যেখানে মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে এই পথে নেমেছি, সেখানে আরাকানের এই গুহায় ডাকাত কিম্বা বর্মী বাহিনীর ভয়ে কেন আমরা ইঁদুরের মত আচরণ করবো। তাই ভাইসব, আপনাদের প্রতি আকুল আবেদন, আমার এই মিটারে ভয় মাপার আগে নিজ নিজ ভয় ঝেড়ে ফেলুন।
হাস্যরস পরিবেশনায় ফজলুল হকের প্রসিদ্ধি পুরনো। তাই তার ঘোষণামতো ভয়োমিটারের কথা শুনে মনের ভয় তেমন না কাটলেও গুহাবদ্ধ আমাদের উপর চেপে বসা গুমোট কিছুটা হাল্কা হয়।

গুহামুখে বৃদ্ধকে আমাদের দেবদূতের মতোই মনে হয়। একটি ভারে করে দু’টো বাঁশের টুকরি বহন করে নিয়ে এসেছে যে যুবক, সে বৃদ্ধের পুত্র। এক টুকরিতে কলাপাতা মোড়া গরম ভাত। তার উপর বড় একটি ডেকচিতে ঝোলে ডোবানো মুরগির মাংস। অন্য টুকরিতে এক কলস পানি, এনামেলের গ্লাস, কাটা কলাপাতার বান্ডিল ও মাটির সানকীতে লবণ। নিমিষে আশার, আনন্দের এবং স্বস্থির হর্ষধ্বনি ওঠে গুহাটিতে। জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভোজটি সাঙ্গ হয় দ্রুত।

সন্ধ্যায় মোক্তার আসে। ইতোমধ্যেই ঘটে যাওয়া নাটকীয় সব ঘটনার কথা তার কানে এখনো যায়নি। সে কথা বোঝা যায় নিরীহ চেহারা করে তার দুঃখ প্রকাশ দেখে।

ওঁনেরা কষ্ট কইযঝুন হারাদিন। খুদার কষ্ট বর কষ্ট। দিনের বেলা আইত ন পারি। আইজ রাইত ডেরাত লই যাইয়ুম। চিন্তা ন গইয্যুন।

সাথের লোকটি সহ মোক্তারকে আমাদের মাঝখানে বসাই। এলাকাবাসীর সাথে সংযোগ এবং দুপুরের ভোজ আমাদের শক্তি দিয়েছে। সাথে সাহসও দিয়েছে। আমাদের দেখে মোক্তার একটু বিস্মিত। গহীন বনে অজানা এই গুহায় ভয় ও ক্ষুধা আমাদের তেমন কাবু করেনি, তা দেখে। তার ডাকাত পরিচয় যে আমরা জেনে ফেলেছি, তা বলি না। তবে স্পষ্ট করে তাকে জানিয়ে দেই আমাদের ব্যাকপ্যাকগুলো এই গুহায় না আনা পর্যন্ত আমরা কোথাও যাবনা। রমজান নামের সাথের বলবান লোকটিকে আমাদের সাথে রেখে মোক্তারকে বিদায় দেই আমরা। রমজানের শরীর পেশীবহুল। চেহারায় এক বন্য ভাব আছে।

রাতের প্রথম প্রহরেই ভার কাঁধে বৃদ্ধের পুত্র আসে। এবার একটি লন্ঠনও নিয়ে এসেছে সে। তার মৃদু আলোয় আমাদের খাওয়ার কাজটি সেরে নেই আমরা। সাঈদ ভাই মোক্তারের বিষয়ে আদ্দ্যপান্ত জানিয়েছে রমজানকে। গ্রামবাসী আমাদের খাবার পাঠাচ্ছে, তা তো সে নিজ চোখেই দেখল। এর মধ্যে একজন পেছন থেকে তার গলা পেঁচিয়ে দেখায়, কিভাবে খালি হাতে শত্রুকে হত্যা করা যায়। রমজান বুঝে নিয়েছে আমাদের হাতে সে কার্যত জিম্মি। ইতোমধ্যে রমজানের সাথে ভালোই ভাব জমিয়ে ফেলেছে সাঈদ ভাই। হয়তো রমজান সাঈদ ভাইকে আপনও ভাবতে শুরু করেছে। আরাকান ও বান্দরবানের বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতির নানা গল্প সে করে। তবে মোক্তারের এক ভিন্ন রূপ আমরা পাই তার কাছ থেকে। শুধু এক ডাকাত সর্দার নয়, আধুনিক কালের এক রবিনহুড হয়েই মোক্তার আমাদের চোখে ধরা পড়ে। টেকনাফ ও আরাকানের মংডু এলাকার বড় চোরাচালানীদের উপর চাঁদা ধার্য করে রমজান। ধনী লোক ছাড়া অন্যদের বাড়িতে ডাকাতি করে না। আরাকানের গরীব মুসলমানেরা তাই মোক্তারকে ভয় পেলেও তার বিরুদ্ধে যায় না। রমজান জানায় মোক্তারের পরিকল্পনা ছিল তার ডেরায় নিয়ে গিয়ে আমাদের দিয়ে বোমা তৈরি করাবে। নাফ নদীর উপর একচ্ছত্র আধিপত্যের জন্য তার শক্তি বৃদ্ধি প্রয়োজন। আমাদের দলপতির কাছ থেকে নানা গল্প শুনেছে সে আমাদের সম্পর্কে। চন্দ্রঘোনার কাগজ কলের বাঁশ সংগ্রহের জন্য সমতলের মানুষদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে গহীন অরণ্যে নিয়ে দাসের মত ব্যবহার করবার বিষয়টিও হয়তো সে জেনেছে। আমাদের তেমন দাস বানাবার পরিকল্পনা হয়তো তার ছিল। অথবা কে বলতে পারে হয়তো আমরা যা ভাবছি, তা ঠিক নয় একেবারে। সে সম্ভাবনার কথা একটু হলেও উঁকি দেয় আমাদের মনে। রমজানের পরবর্তী বয়ান সে দিকে ইংগিত করে। মোক্তারের বড় স্বপ্ন আছে। স্বাধীনতার স্বপ্ন। যেমনটা আছে আমাদের। স্বাধীন আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠা তার মূল লক্ষ্য। বার্মার কমিউনিস্টদের মত সেও যুদ্ধ করতে চায় বর্মী সরকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে। আরাকানের স্বঘোষিত কর্নেল কাসেম রাজার স্বপ্নও তো তাই ছিল। তার কথা মোক্তারের কাছেই শুনেছি।

মোক্তার সম্পর্কে এতসব জেনে আমাদের মনের গ্লানি অনেকটা দূর হয়েছে। ডাকাতের পাল্লায় পড়ে এই গুহায় আমাদের নিরাপত্তাহীন, নিঃস্বহায় অবস্থা সে গ্লানির জন্ম দিয়েছিল। রাত গভীর হয়। পালা করে আমরা জেগে থাকি। রমজানের শোয়ার জায়গাটি ঠিক করা হয়েছে গুহার মুখের অপর পাশে দেয়াল ঘেঁষে। নাক ডাকা থেকে বুঝতে পারি সে গভীর নিদ্রায় ডুবে গেছে। আমরাও তাই চাই। তার উপর তীক্ষ্ণ নজরে অবশ্য কোন গাফিলতি হয় না। আরাকানের গুহায় আরেকটি ভোর আসে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। আজও দু’বেলার খাবার এসেছে। রাইফেল হাতে মোক্তার ও তার স্যাঙ্গাৎদের দেখা গেছে গুহা থেকে অল্প দূরে। রাতের খাবার দিতে আসা যুবকের কাছ থেকে পাওয়া এ সংবাদে নতুন শঙ্কা জেঁকে বসতে শুরু করেছে সবার মনে।

রমজানকে ঘিরে আমরা বসেছি। আহার ও নিদ্রা তাকে উজ্জীবিত করেছে। নিজের থেকেই নানা গল্প সে করে। হয়তো আমাদের সঙ্গ তাকে আনন্দই দিচ্ছে। চাঁটগার আঞ্চলিক ভাষায় তার কথা মোটামুটি সবাই ধরতে পারছি। বান্দরবানের থাঞ্চি বাজারের সবচে বড় সওদাগরের বাড়িতে ডাকাতির গল্প সে বলে। সে রাতে শুক্লপক্ষ। আকাশে নবীন চাঁদের ডোবার অপেক্ষায় আছে তারা। শীতের নিশুতি রাতে ঘুমে কাত হয়েছে অরণ্যবাসী। কুকুরগুলোও গরম জায়গা বেছে নিয়ে কুন্ডুলি পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। অন্ধকার গাঢ় হতেই বাঁশ ঝাড়ের আড়াল থেকে ছায়ার মত বেরিয়ে আসে ওরা। এখন তারা উঠানে। খড়ের গাঁদার পাশে অবস্থান নিয়েছে রমজান। থ্রি নট থ্রি রাইফেল তার হাতে। ঘরের পেছন দরজা দিয়ে যেন কেউ পালাতে না পারে। গাঁদা বন্দুক আছে আরও পাঁচ জনের হাতে। মোক্তারের নির্দেশে তারা অবস্থান নিয়েছে নির্ধারিত জায়গায়। ডাকাতি শুরু হলে গ্রামবাসী যাতে এগিয়ে আসতে না পারে, তার জন্য কাট অফ পার্টি রাখা হয়েছে। মোক্তারের গুপ্তচর শরাফত নিশ্চিত খবর এনেছে আজ সন্ধ্যায় বিক্রির মোটা টাকা পেয়েছে সওদাগর তমিজ মিয়াঁ। কয়েক দিন পরেই তার ছোট মেয়ে জমিলার বিয়ে।

শরাফত এ বাড়ির কামলা। সে নজর রাখছে গত এক মাস ধরে। রাত দিন কাজ করে তমিজ মিয়াঁর মন কেড়েছে শরাফত। তবে এখানে আজই তার শেষ রাত। ডাকাতির পর থাঞ্ছি থেকে পাততাড়ি গুটাবে সে। চলে যাবে মোক্তারের সাথে অন্য কোনখানে। গুপ্তচরের নতুন কাজে। উঠানের খোলা রান্না ঘর থেকে ভারী ঢেঁকীটি বের করেছে চারজন। আরও দু’জন লম্বালম্বি ঢেঁকীটি ধরেছে বাড়ির বড় দরজার দিকে তাক করে। সবার অপেক্ষা মোক্তারের নির্দেশের জন্য। মোক্তারের রিভলভারের নল থেকে আলোর ঝলকানি দেখা যায় প্রথম। তারপর ধাতব শব্দ। প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে যায় বারোটি শক্ত হাতে ধরা ভারী ঢেঁকী। আঘাত করে সদর দরজা। দু’ইঞ্চি পুরু পুরনো গর্জন কাঠের দরজা। শক্ত চৌকাঠ। তারপরও তৃতীয় ধাক্কায় দড়াম করে খুলে যায় দরজা। মোক্তার ছয় সঙ্গীকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। তমিজের ঘুম পাতলা। তবে বধির না হলে গুলির শব্দ এবং দরজায় প্রচণ্ড আঘাতের শব্দে সবার ঘুম ভেঙ্গে যাবার কথা। তাই হয়েছে। ডাকাত, ডাকাত রব উঠে সবার কণ্ঠে। পূর্ব নির্দেশ মত পাঁচটি গাদা বন্দুক গর্জে উঠে।

তমিজ মিয়াঁ ঘুমাচ্ছিল বড় সিন্দুকের উপর। বিশাল বপুর এক স্যাঙ্গাৎ হেঁচকা টানে তাকে নিচে ফেলে তার বুকের উপর বসে। মোক্তারের রিভলভারের নল ঢোকে তার মুখে। তাড়াহুড়া করেনা মোক্তার। শান্তভাবে টাকা এবং মেয়ের বিয়ের সোনাদানা বের করে দিতে বলে। তমিজ থর থর করে কাঁপে। কোরবানির গলাকাটা পশুর মত শুধু গোঙ্গানি বের হয় তার কণ্ঠ থেকে। মোক্তার নির্বিকার। মুখ থেকে রিভলভারের নল বের করে আঘাত করে কপালে। শীতের রাতে মোক্তারের মুখে ছিটকে পড়া উষ্ণ রক্ত একটু শিহরণ জাগায়। মোক্তার আবারো শান্তভাবে জানতে চায় টাকা, সোনা-দানার খবর। এবার তমিজ সিন্ধুকের দিকে ইশারা করে। তড়িৎ ঢাকনা খুলে ভেতরে আলো ফেলে কয়েকজন। টিনের বাক্স, কাপড় চোপর, বিয়ের পোশাক – সবকিছু সিন্দুকের বাইরে ফেলে। মোক্তার বাক্সটি খোলে। টিনের কৌটায় কিছু টাকা এবং ভাংতি পয়সা পাওয়া যায়। কিন্তু সোনা-দানা, টাকা? কোথাও তো নেই। বুকের উপর চেপে বসা ডাকাতের ঘুষির আঘাতে তমিজ তখন জ্ঞানশূন্য।

রমজানের বিড়ালের চোখ তীক্ষ্ণ নজর রাখে কেউ পালায় কিনা। ঘটনাটি ঘটে তখন। বড় ঘরের লাগোয়া ছোট ঘরটির পেছন দরজা দিয়ে ছায়ামূর্তিকে বেরিয়ে পড়তে দেখে রমজান। টর্চের আলো এবং রাইফেলের নল একসাথেই তাক করে। থামতে বললেও নারীমূর্তি থামেনা। একটু দ্বিধা হয় রমজানের। তারপরই থ্রি নট থ্রি রাইফেলের গুলির শব্দ প্রকম্পিত করে নিশীথের চরাচর। গভীর নিস্তব্ধতা নামে হাত ধরেই। একহাতে রাইফেল অন্য হাতে টর্চের আলো ফেলে এগোয় রমজান। কাছের গাছ-গাছালির ঝোপ পর্যন্ত যেতে পারেনি ত্রস্থ হরিণী। যে দেহটি কাত হয়ে পড়ে আছে, তার উপর আলো ফেললে মুখটি দৃশ্যমান হয়। পরীর মত মেয়েটি। হাঁটু গেঁড়ে বসে রমজান। যা ভেবেছিলো তাই। পুটলিটি মেয়েটির হাতে ধরা। শরাফত যে মেয়েটির বিয়ের কথা বলেছিল, সে তো এই মেয়েটি! টর্চের আলোয় মেহেদী মাখা হাত দেখে রমজান প্রায় নিশ্চিত হয়। নিশ্চল হয়ে থাকে। পুটলিটি নিতে হাত উঠে না। মোক্তার ও অন্য ডাকাতেরা এখন মেয়েটিকে ঘিরে আছে। গুলি লেগেছে সরাসরি মাথায়। তাজা রক্তের একটি গন্ধ আছে। মাথার নিচে জমে থাকা উষ্ণ রক্ত থেকে তা পাওয়া যায়। পুটলিটি খুলে নেয় মোক্তার। গুপ্তচর শরাফতের সংবাদ ঠিকই আছে। পুরো টাকা এবং বিয়ের গহনা অক্ষত আছে পুটলিতে।

রমজানের গল্প যখন শেষ হয়, তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। লন্ঠনের মৃদু আলোতে ঠিক বোঝা যায় না তার বন্য দু’টো চোখ আদ্র হয়ে উঠেছে কিনা। গুহার নিস্তব্ধতা ভাঙ্গে একটু পর, রমজানের কথায়ই।

ভাইজানেরা, অ্যাঁরও উগগাঁ মাইয়া পোয়া আছে। হেই জমিলার মতন।

তারপর ডুকরে কেঁদে উঠে।

আরাকানে তৃতীয় ভোর। পাহাড়ে ভোরের নিজস্ব রূপ আছে। সুবেহ সাদেকের সময় ক্ষণস্থায়ী স্বর্গীয় আলোতে কিছু পাখী ডেকে উঠে। তারপর আবার নরম অন্ধকার। আবার নিস্তব্ধতা। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করে এর পর থেকে। তার আগে আগে পাখীর কল-কাকলি জানান দেয়, সূর্য দেবের আবির্ভাবের। বনমোরগের ডাক পাহাড় থেকে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরে। ভোরের আলো স্নিগ্ধ। গাছের পাতা, পোকা-মাকড়, পাখী ও প্রাণীকুল সে আলোয় জেগে উঠে। লক্ষ কোটি বছরের মুগ্ধতা নিয়ে প্রকৃতি তাকায় সূর্যের রশ্মির দিকে। প্রায় পনের কোটি কিলোমিটার দূর থেকে আট মিনিট আগে সূর্যদেব যে আলো পাঠিয়েছে তার জন্য সারারাত অপেক্ষা করেছে সে। এই মহাবিশ্বের আর কোথাও ধরিত্রীর মত প্রাণময় জগত আছে কিনা তা এখনও জানা যায়নি। কারণ এখন পর্যন্ত জানামতে সূর্যের যে আলো হারিয়ে যেত শুন্যতায়, বাড়াত এনট্রপি বা বিশৃঙ্খলা, তার এক অতি ক্ষুদ্র অংশকে অনর্থ সৃষ্টির হাত থেকে বাঁচিয়ে জীবন সৃষ্টির কাজে লাগান সম্ভব হয়েছে এই পৃথিবীতে। সালোক সংশ্লেষণের এ কাজটি প্রায় তিনশো কোটি বছর আগে শুরু করেছিল এক কোষী ব্যাকটেরিয়া। পঁচাত্তর কোটি বছর আগে সবুজ শৈবাল। এরা সবাই ছিল পানিতে। প্রায় পঞ্চাশ কোটি বছর আগে মখমলের মত সবুজ মস সালোক সংশ্লেষণের কাজটি শুরু করল কঠিন মাটিতে। আর পঁয়তাল্লিশ কোটি বছর আগে সবুজ পত্রাবলির উদ্ভিদরাজি ছেয়ে ফেললো স্থলভূমি। পোকা-মাকড়, স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখী, বানরকুল হয়ে সোজা হয়ে হাঁটা মানুষ এল গত চল্লিশ কোটি থেকে আড়াই লক্ষ বছরের মধ্যে। আজ ভোরে আলোর প্রত্যাশায় তিনশো কোটি বছর আগের আদি ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে সবাই আছে। রাতজাগা নিশাচরেরা এবার ঘুমুতে যাবে। তার আগে শেষবারের মত তারা আসে প্রবহমান ঝরণাধারার কাছে। প্রাণীকুল এক অলিখিত নিয়মে একই উৎস থেকে জলপান সারে চকিত চাউনি নিয়ে। কেউ কাউকে আক্রমণ করে না। প্রত্যুষের আলো শেষ বারের মত দেখে নিজ নিজ আস্তানায় ফেরে। প্রকৃতির এসব নিয়ম কি সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজাতি মানুষ মেনে চলে? এই গুঢ় প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ যে নয়, তা বোঝা যায় গুহায় আটকে পড়া পনের যুবক, ডাকাত মোক্তার ও রমজান, গ্রামবাসী ও বর্মী বাহিনীর সম্পর্কের জটাজালে।

ঘন গাছ-গাছালির পাতার ফাঁক গলে সোনালি রোদের রশ্মি এসে পড়েছে গুহামুখে। শেষ রাতের দু’জন যারা প্রহরায় ছিল তারা আর ঘুমুতে যায় না। আমাদের সবাই উঠে পড়েছে। শুধু ঘুমিয়ে থাকে রমজান। দিনের খাবার এসেছে যথারীতি। পনের জন মানুষের খাবার। আজ তিন দিন ধরে। যারা খাবার পাঠাচ্ছে, তারা দরিদ্র। অনেকাংশেই অসহায়। অচেনা যুবকদের প্রতি কেন এই মায়া? তখনই মনে হয় স্বাধীনতার স্পৃহাতো এক ঘোরের মত। আরাকানের ছোট এই জনপদের মুসলমান জনগোষ্ঠী সে ঘোরের মধ্যে পড়েছে। নাফ নদীর ওপার থেকে আসা পনের যুবক তাদের সে ঘোরে ফেলেছে। আজন্ম লালিত তাদের স্বপ্নে দোলা দিয়েছে অচেনা যুবকেরা। তাই ডাকাতের ভয়, খাওয়াবার কষ্ট – এসব আর তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেনা। খাবার নিয়ে আসা যুবক জানিয়ে গেল আজ রাতে নাফ নদী পাড়ি দেয়ার সম্ভাবনার কথা। শঙ্কার কথাও জানিয়েছে। মোক্তার ঘোষণা দিয়েছে, আমাদের নাফ নদী পার করিয়ে দিলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ।

রাত নেমেছে আরাকানে। খাবার সাঙ্গ হয়েছে। এবার অপেক্ষা নাফ নদী পেরিয়ে টেকনাফে ফিরে যাওয়ার। কিন্তু কেউতো আসছেনা আমাদের নিয়ে যেতে। কি হবে? আকাশে অষ্টমীর চাঁদ উজ্জ্বল। জ্যোৎস্না প্লাবিত করছে চারদিক। আর আমরা কিনা আটকে পড়া ইঁদুরের মত এই গুহায়?
এভাবে বসে থাকা যায় না।

সাঈদ ভাইয়ের এ কথায় নিজ নিজ ভাবনায় ছেদ পড়ে। রমজান অবাক হয়ে তাকায়। তার বোহেমিয়ান জীবনের সাথে এই যুবকের কোথায় যেন মিল পায়। কারো মতামতের অপেক্ষা না করে সাঈদ ভাই বেরিয়ে পড়ে।

কি খবর আনবে সে? আমাদের অপেক্ষা শুরু হয়। ভাল খবরই আনবে সাঈদ, বাচ্চু ভাইয়ের এ প্রত্যয়ে গুহায় স্বস্থির দোলা লাগে। এতক্ষণের স্তব্ধ নীরবতা চুরচুর করে ভেঙ্গে পড়ে। তার জায়গায় কেমন এক প্রগলভতা পেয়ে বসে সবাইকে। মুক্তির সুবাতাসের আগাম সংবাদ দেহের স্নায়ুকোষগুলো কি পেয়ে গেছে? যেমন পায় পিঁপড়া, পোকা-মাকড় ও নিম্ন বর্গের প্রাণীকুল? নানা গল্প চলে। আ কা ফজলুল হকের ভাণ্ডারে কত কৌতুক জমে আছে।

পাগলে পাগলামি করে কিন্তু মরিচ খায় না আর কারফিউর রাতে বাইরে যায়না।

আ কা’র এ মন্তব্যে প্রভূত আনন্দ পাই আমরা। রমজান বুদ্ধিমান। এ কৌতুকের গুঢ় অর্থটি সে ঠিকই ধরতে পারে। আমাদের ধরিয়ে দিলে তাদেরও খবর আছে। টেকনাফে তার ও মোক্তারের পরিবার আছে না। রমজানও অভয় দেয় আমাদের। তারপরও এক অজানা আশঙ্কা আমাদের হাড়ে, মাংসে, অস্থিমজ্জায় এবং স্নায়ুতন্ত্রে ঘোরে ফেরে। ঘাড় গুজু করে চলা দু’পেয়ে বানরকুলের সোজা প্রবুদ্ধ মানুষ হয়ে উঠা কত লক্ষ বছরে সম্পন্ন হয়েছে। গুহাবাসী মানুষ বাড়ি-ঘর বসতি করেছে, প্রথমে অরণ্যে-পাহাড়ে পরে সমতলে, নদীকূলে-সাগরপাড়ে। কিন্তু প্রতিনিয়ত মৃত্যুভয় তাকে তাড়া করেছে। সেই আদি যুগ থেকে ভয় তাড়ানিয়া ধ্বনি শুধু নয়, কত চেষ্টা ও উদ্যমে নানা কৌশল সে আয়ত্ত করেছে, নিজেকে সজ্জিত করেছে কত অস্ত্রে। কত অভিযান, জয়ী হওয়া। তারপরও ভয়শূন্য হয় না মানুষ। অসহায়ই সে থাকে। মানুষই মানুষের মনে ভয় জাগায়, তাকে অসহায় করে। আমাদের মস্তিষ্কে ধূসর কোষে তার একটা রিলে দৌড় হয়ে গেল আরাকানের এই গুহায়।

সাঈদ ভাইয়ের চোখ পায়ে চলা পথ খোঁজে। জ্যোৎস্নায় তা পেয়েও যায়। লোকালয়ের আলোর সন্ধান করে। এভাবে সরু পায়ে চলা পথ ও দূরের আলো তাকে যেখানে নিয়ে আসে, সেখানে মনুষ্য বসতি আছে। বড় উঠোন ঘিরে ঘরের সারি। আরাকানের এই অরণ্যে মানুষকে যূথবদ্ধ হয়ে থাকতে হয়। প্রতিকূল অবস্থায় নিজেদের রক্ষায় এমন সঙ্গবদ্ধতা। ঘরের ঠিক বাইরে খড়ের বড় পুইন। তার পেছনে বসেছে সাঈদ ভাই। একটি সভা চলছে উঠোনে। নারীরা বসেছে ঘরের দাওয়ায়। বিতর্ক চলছে। পনের অচেনা যুবককে নাফ নদীর ওপারে রেখে আসা হবে কি হবেনা। পক্ষে-বিপক্ষে মত আছে ঘোরতর। সাঈদ ভাই শুনতে পাচ্ছে সবই। এ বিতর্কের যেন শেষ নেই। কোন সময় এ পাল্লা ভারি তো পরক্ষনেই ও পাল্লা। তার সঙ্গত কারণ ও আছে। যুক্তির কথা মানলে আমাদের নিরাপদে পার করে দেয়াটা বড় ঝুঁকির বটে। শুধু তাই নয়। সমূহ বিপদ তাতে। মোক্তারের রোষানলে পড়া, বর্মী বাহিনীর কাছে এ খবর পৌঁছালে তার পরিণতি। সবচেয়ে বড় কথা এই যুবকদের তারা চেনেনা, জানে না। কি প্রয়োজন এদের সাহায্য করে নিজেদের বিপদে ফেলা। অপর দিকে আবেগ, ভালবাসা। অসহায় মানুষের প্রতি সাহায্যের হাতটি বাড়ানো। সর্বোপরি বহু বছর ধরে আরাকানের অরণ্যবাসীর মুক্তির প্রত্যাশা সমার্থক হয়ে ওঠে গুহায় আটকে পড়া যুবকদের মুক্তির সাথে। কোন দিকে যাবে অরণ্যের এই জনপদ? সাঈদ ভাইয়ের অপেক্ষার পালা দীর্ঘ হয়। কখনো মনে হয়, সোজা উঠানে গিয়ে দাঁড়ায়। কথা বলে। পরক্ষনেই দ্বিধা। সেই দোলাচলে সাঈদ ভাই অপেক্ষা করে।

তারপর এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে যায়। উচ্চ নারী কণ্ঠে উঠোনের বিতর্ক স্তব্ধ হয়। সে কথা সংক্ষিপ্ত ও নির্ধারক। তা এক নির্দেশের মত সবার কানে বাঁজে। নারী বৃদ্ধা। কিন্তু তার গলা স্পষ্ট।

এই পোয়া হক্কলর লাই ভাত রাইনদ্দিযি। অ্যাঁর পোয়া হেই ভাত লই গেইয়ি, খাবাইয়ি। ইতারা বেয়াগগুন অ্যাঁর পোয়া। আঁরার লাই মা-বাপ ছাড়ি হিতারা আইস্যিদে অ্যাঁরার দেশত। তোঁয়ারা কথা ন কইও। সড়কি, লাডি, বল্লম লই তৈরি হওঁ। অ্যাঁর পোয়া হগগলরে নদীর হেই পাড়ে রাখি আয়। যও, ত্বরাত্বরি গর। ইবা আঁর হুকুম।

মুহূর্তে সাঙ্গ হয় সভা। এই নিশুথি রাতে জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি শুনে সাঈদ ভাইয়ের চোখে পানি আসে। সাঈদ ভাই আড়াল থেকে দৃশ্যমান হয় এ সময়।

জীব কোষের মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ আসে শুধু মাতার কাছ থেকে। কোন সেই আদি মাতা যার কাছ থেকে প্রথম মাইটোকন্ড্রিয়া এসেছিল সন্তানের দেহে? পরে হোমিনিডের সৃষ্টি হলো? মাইটোকন্ড্রিয়ার ডি এন এ নিয়ে নানা পরীক্ষা থেকে এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে তা হল সেই আদি মাতা আড়াই লক্ষ বছর আগের আফ্রিকার এক কালো নারী। বিজ্ঞানীরা সে নারীর নামকরণ করেছেন আফ্রিকান ঈভ। আরাকানের নিভৃত এই জনপদে সেই ঈভ হয়ে বনবিবি রূপে আবির্ভূত হয়েছেন বৃদ্ধা। সাঈদ ভাই তাঁকে কদমবুচি করে।

ওঁনার হক্কল কথা হুইন্নি, অ্যাঁরার লাই দোয়া গরিবান অনে।

বৃদ্ধা এই অচেনা যুবকের মাথায়, গালে হাত বুলিয়ে দেন গভীর মমতায়। সুরা পড়েন, ফু দেন মাথায়।

মধ্যরাত পার হয়ে গেলে পরে দূর থেকে ভেসে আসা এক কোলাহল আমরা শুনি। ক্রমে তা স্পষ্ট হয়। এই নিশুথি রাতে কারা কোলাহল করে? মোক্তারের ডাকাত দল কি ধেয়ে আসছে? গুহার সামনে জড়ো হয়েছে বড় সড় একটি দল। সবার হাতে দেশীয় অস্ত্র। কিন্তু মোক্তার এগিয়ে আসে না। আসে সাঈদ ভাই। তার বিজয়ী হাসি মুহূর্তে সকল শঙ্কা দূর করে। এখন গুহার বাইরে আমরা। যদিও শত্রু বেষ্টিত আরাকানের প্রত্যন্ত গভীরে আমরা, তারপরও গুহার বাইরে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় আমরা মুক্তির সুবাতাস পেয়ে যাই। গ্রামবাসী দু’টো লাইনে দাঁড়িয়েছে। মাঝখানে ফাইল করে দাঁড়িয়েছি আমরা। প্রথম দিনে দেখা বৃদ্ধ এগিয়ে আসেন।

বাবারা ঘরত ফিরি যগুই। যত্ন গরিত ন পারি। কথ বড় ঘরের পোয়া তোঁয়ারা। অ্যাঁরার লাই দোয়া গইযযু।

তারপর রওয়ানা হতে বলে সবাইকে। নাফ নদী পার না হওয়া পর্যন্ত নদীর এপারে অপেক্ষার নির্দেশ দেন বৃদ্ধ।

খোদা হাফেজ।

বৃদ্ধের হাতের ইশারায় তিনটি সমান্তরাল লাইন চলতে শুরু করে। বৃদ্ধ তাকিয়ে থাকেন চন্দ্রালোকে অপসৃয়মান দলটির দিকে। তাঁর দৃষ্টি তখন হয়তো ঠিক সেখানেও নয়, তা নিবদ্ধ হয়েছে এক স্বপ্নময় স্বাধীন আবাসভূমির দিকে যার কথা বলেছিল অচেনা যুবকেরা। “মানুষ রবে না আর, রবে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখন।” চন্দ্রালোকে সেই স্বপ্নের ভুবনে প্রবেশ করেছেন বৃদ্ধ। স্বপ্ন যাত্রায় দু’পারের যুবকদের সাথে তিনিও সামিল হয়েছেন।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

9 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
9
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.