অনেক বছর আগের কথা। কলকাতার সিটি কলেজে পড়ার সময় থাকতাম ব্যারাকপুর, ফিরতে প্রায়ই সন্ধে হয়ে যেত। দেখতাম, স্টেশনের লাগোয়া বস্তির শ্রমিকেরা ধুনি জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে পোহাতে গলা ছেড়ে গাইছেন ‘আয়েগা মার্কস বাবাকো জমানা’। [...]

অনেক বছর আগের কথা। কলকাতার সিটি কলেজে পড়ার সময় থাকতাম ব্যারাকপুর, ফিরতে প্রায়ই সন্ধে হয়ে যেত। দেখতাম, স্টেশনের লাগোয়া বস্তির শ্রমিকেরা ধুনি জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে পোহাতে গলা ছেড়ে গাইছেন ‘আয়েগা মার্কস বাবাকো জমানা’। সবে মার্ক্সবাদে দীক্ষা নিয়েছি। বসে পড়তাম তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা জানেন না, মার্ক্স কোথাকার মানুষ, কী কী বই লিখেছেন তিনি। তবে ভালোই জানেন, মার্ক্স বাবার জমানায় গরিবের রাজত্ব কায়েম হবে, ধনীর ঠাঁই হবে না সেখানে, আর সেই রাজত্ব শুরু হয়ে গেছে রাশিয়ায়, হবে এখানেও। স্বপ্নেও ভাবিনি, আমিও একদিন যাব রাশিয়ায়, থাকব অনেক দিন, দেখব সেই জমানার সুদিন ও করুণ পতন। ১৯৭৪ সালে মস্কোয় অনুবাদকের একটি চাকরি জুটে যায়, থাকি ২০০০ সাল পর্যন্ত। মার্ক্সের কিছু লেখাও অনুবাদ করি এবং বিস্ময়ে ভেবেছি, একজন মানুষের লেখা কীভাবে শত শত বছরের একটা টেকসই সমাজকে টলিয়ে দিতে পারে। ব্যারাকপুরের শ্রমিকদের কথাও মনে পড়ত। হ্যাঁ, মার্ক্সস বাবার জমানা ঠিকই কায়েম হয়েছে রাশিয়ায়। ধনিক শ্রেণী নেই, উচ্চপদাসীন ও হাতুড়িপেটা মজুর নির্বিশেষে সবারই সাজপোশাক, বাড়িঘর, চলাচল অভিন্ন। বরং বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় শ্রমিকদের উপার্জন কিছুটা বেশি এবং অন্যান্য কিছু বিষয়ে তাঁরা অধিক সুবিধাভোগী। পরে অবশ্য বুঝেছি, এ ব্যবস্থাও অসংগতিমুক্ত নয়, ধনী না থাকলেও ধনী-হতে-ইচ্ছুক মানুষের সংখ্যা অনেক, আর বিত্ত সঞ্চয়ের আকাঙ্ক্ষা কতটা দুর্মর। রাশিয়ায় ১৯৯১ সালে সমাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটলে লোকে যখন মার্ক্সের রচনাগুলো আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করছিল, তখন একদিন আমার কর্মস্থল প্রগতি প্রকাশনে গিয়ে দেখি, বিগত অর্ধশতক কালে অনূদিত বইপত্র নিয়ে বড় বড় গাঁট বাঁধা চলছে, গন্তব্য কাগজকল। বড়ই হতাশ হই। কয়েক দিন পর আমেরিকা থেকে জনৈক বন্ধুর পাঠানো সেখানকার নামী পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের একটি কাটিং পাই, তাতে ছিল রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের জন্য মার্ক্সকে দোষী সাব্যস্ত করা এবং তাঁর শিক্ষার অবমূল্যায়ন অযৌক্তিক; মার্ক্স একজন মনীষী, তাঁর আবিষ্কারগুলো চিরায়ত মূল্যধর এবং গোটা মানবজাতির সম্পদ। তারপর দুই দশক অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই দেখা দেয় আরেকটি বিশ্বমন্দা এবং সেই সঙ্গে আসন্ন পরিবেশবিপর্যয় নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ। লোকে আবার মার্ক্সকে খুঁজতে শুরু করে, এমনকি পরিবেশবাদীরাও, কেননা তিনি মানুষ কর্তৃক মানুষ শোষণ এবং মানুষ কর্তৃক প্রকৃতি শোষণের সমাধান পেয়েছিলেন কমিউনিজমে। আমি ২০০০ সালে দেশে ফিরি, নানা কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, কিন্তু রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের ভাবনা থেকে…

আজ অনেকটা ধুমধামেই আমাদের রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রপালিত বান্দাদের সহযোগে পহেলা বৈশাখ পালন করাতে পারল। আমরাও অনেকটা গৃহপালিত বান্দার মতোই তা স্মরণীয় বরণীয়ও করলাম। তাতে নাগরিক মধ্যবিত্তের তেমন সমস্যা হয়েছে বলে দৃশ্যত মনে হয় নি। তবে ঘটনার আড়ালেও ঘটনা থাকে, কষ্টের আড়ালেও কষ্ট থাকে।

আজ অনেকটা ধুমধামেই আমাদের রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রপালিত বান্দাদের সহযোগে পহেলা বৈশাখ পালন করাতে পারল। আমরাও অনেকটা গৃহপালিত বান্দার মতোই তা স্মরণীয় বরণীয়ও করলাম। তাতে নাগরিক মধ্যবিত্তের তেমন সমস্যা হয়েছে বলে দৃশ্যত মনে হয় নি। তবে ঘটনার আড়ালেও ঘটনা থাকে, কষ্টের আড়ালেও কষ্ট থাকে। নাগরিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, প্রিন্টিং ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া হুলস্থূল সহকারে বাংলা নববর্ষ পালন করলেও সনাতন হিন্দু সমাজ আজ পালন করেছে চৈত্র সংক্রান্তি। আমাদের পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেই আগামীকাল পহেলা বৈশাখ পালন করা হবে। এরই মধ্যে দুই-একটা অদ্ভুত ঘটনার মুখোমুখি হলাম আমি। আমার অতি পরিচিত একজন সরকারি কর্মজীবী আমায় জানাচ্ছেন, একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন... এই বলেই লোকটা আমার দিকে এভাবে তাকালেন যেন আমার দায়িত্ব হচ্ছে এইটুকুতেই সবটুকু বুঝে নেয়া। আমার না-বুঝাকে তাচ্ছিল্যের ভিতর ফেলে তিনি বলছেন, এই দেশের হিন্দুরা তো সরকারের আইন মানে না! আমার অতি আশ্চর্য অবয়বকে পুঁজি করে আমায় জানাচ্ছেন, সরকারের ঘোষণা আছে বুধবার ১৪ই এপ্রিল পয়লা বৈশাখ, কিন্তু এরা ভিতরে ভিতরে বিষুদবার দিন পহেলা বৈশাখ করবে, পূজা-উজা করবে আর-কি। আমি বুঝাতে চাইলাম, এরা তো পঞ্জিকা মেনে তাদের ধর্মমতে...; _আরে রাখেন আপনার পঞ্জিকা, এইসব সরকারের সাথে গাদ্দারি, এরা ইন্ডিয়ার বুদ্ধিতে নাচে, আপনারা এইসব বুঝবেন না। আমি তাকে কিছুতেই বুঝাতে পারলাম না। আমি বাধ্য হয়ে একজন সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোককে তাদের এই ধরনের অবাধ্যতা বিষয়ে তাদের মতামতটা জানতে চাইলাম। তার কথা বেশ সরল-মীমাংসামুখি। তার বাপ-দাদারা গ্রামের নিয়মে যেভাবে চৈত্র-সংক্রান্তি বা পয়লা বৈশাখ যেভাবে পালন করেছেন, এরাও তা-ই করছেন। তারা তো মুরুব্বিগণের সাথে বেয়াদবি করতে পারেন না। আসলে মহাত্মা (!) এরশাদ অনেকভাবে জাতিকে লণ্ডভণ্ড করার মানসে অনেককিছুর মতো এই কাজটিও করে গেছেন। অর্থাৎ রাষ্ট্র কর্তৃক মুসলিম আধিপত্যকে একচেটিয়া করার মানসেই এ কাজটি করা হয়েছে। ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদীরা (এই যুগল দৃশ্যত, কার্যত, প্রবহমানত অনেকটাই একই নবীর উম্মত।) না হয় একই ধারায় তা বহাল রেখেছিল, এখন ভাষাপন্থি জাতীয়তাবাদীরাও একই কাজ কেন করছেন? কারণ এখন যেভাবে পহেলা বৈশাখ পালন করা হচ্ছে, এতে সনাতন হিন্দু সমাজকে শুধু নয়, লোকজ সমাজকেও বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে। মুক্তচিন্তার কথিত সওদাগরগণও দেখছি এ ব্যাপারে অনেকটাই চুপচাপ আছেন!

আজ ২৭ মার্চ ৯২২ এর এই দিনে মনসুর আল-হাল্লাজ (৮৫৭/৫৮—৯২২ খ্রিষ্টাব্দ) ওরফে আনাল হক্ককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যিনি আনা আল-হক্ক নামেই সর্বাধিক পরিচিত [..]

আজ ২৭ মার্চ ৯২২ এর এই দিনে মনসুর আল-হাল্লাজ (৮৫৭/৫৮—৯২২ খ্রিষ্টাব্দ) ওরফে আনাল হক্ককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যিনি আনা আল-হক্ক নামেই সর্বাধিক পরিচিত, তিনি জন্মগ্রহণ করেন পারস্যের আল বাইজা নগরীর তূর এলাকায়। আল বাইজা তখন আরব-শাসনের এক নগরী। তিনি আরবেরই ওয়াসিত স্কুলে মাত্র বারো বছর বয়সে কোরানের হাফেজ হয়ে যান। এবং কথিত আছে, তিনি তা করেন মরমি উপলব্ধি থেকেই। পরবর্তী কালে তিনি তোস্তারের শাহল বিন আবদুল্লা এবং তারও পরে বসরার সূফীর খিরকা গ্রহণ করেন উমর বিন উসমান মক্কীর কাছে। তিনি সূফীত্বের যাবতীয় আচারনিষ্ঠার সাথে সন্নিহিত থাকেন দীর্ঘ বিশ বছর। বিয়ে করেন সূফীসাধক ইয়াকুব আল-আক্তা কারনাবাইয়ের কন্যা উম্মুল হুসাইনকে। বিবাহসূত্রেই বিপ্লবী শিয়াদের সাথে তার সংযোগ ঘটে। তখন আলিদ (জাঈদী) ছিলেন তাদের নেতা। তবে একথা বলা যায় যে তিনি সুন্নী মতাদর্শের প্রতিই অনুগত ছিলেন। একসময় তিনি বাগদাদে যান বিখ্যাত সূফী জুনায়েদের কাছে। তিনি নিঃসঙ্গতার সাধনালব্ধ হন এবং তারও পরে মক্কায় যান হজ্ব করতে। সেখানে তিনি পরমাত্তায় লীন হবার কঠোর সাধনা শুরু করেন। তিনি যখন জুনায়েদের দরজায় গভীর রাতে ঘা মারেন, তখন জুনায়েদ কর্তৃক ‘কে’ বলার জবাব হিসাবে তিনি বলেন, ‘আনা আল-হক্ক’। ঈশ্বরত্ব নির্মাণবিষয়ক পরম জ্ঞানের বিষয়ে জুনায়েদের সাথে তার তর্ক-বিতর্ক হয়। ফলশ্র“তিতে তিনি খিরকা ছেড়ে পারস্য ও খোরাসানে যান। অনেক সুন্নী মুসলমান আর খ্রিষ্টান ধর্মানুসারী তার কাছে শিষ্যত্ব বরণ করেন। খোরাসানে তিনি শিয়া আর মুতাযালীদের কবলে পড়েন; এমনকি তাকে জাদুকর বলেও অভিহিত করা হয়। এ ঘটনারও পর তিনি দ্বিতীয়বার হজ্বব্রত পালন করেন চারশ’ অনুসারীসহ। সেখানে তিনি প্রচলিত ধর্ম-অনুরাগীদের তোপের মুখে পড়েন। প্রথমে তুর্কেস্তান এবং পরে ভারত চলে আসেন। তখন বৌদ্ধ, মানী ও সনাতন হিন্দু ধর্মের অনেকেই তাঁর সংস্পর্শে আসেন। ৯০২ সালে তৃতীয় অর্থাৎ শেষবারের মতো হজ্ব পালন করেন তিনি। আরাফাতের ময়দানে তিনি দোয়া করেন এই বলে, আল্লা যেন তাকে অনস্তিত্বে পর্যবসিত করেন। তিনি মানুষের জন্য রক্তাক্ত হতে চান। সাধারণ মানুষের ভিতর তাঁর ঐকান্তিকতা ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। উঁচু শ্রেণীর মানুষজন তার উপর ক্ষেপে যেতে থাকেন। জাহিরী আইনজীবী হাল্লাজের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ-অভিযোগ আনেন এবং তার মৃত্যুদণ্ড প্রার্থনা করেন। তাঁর অপরাধ তিনি প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিপরীতে মুক্তঅস্তিত্বের সাধনা করেছেন। নিজের ক্বলবে ঈশ্বরত্ব প্রাপ্ত হচ্ছেন। প্রচলিত…

অনেকেই সমকামিতা নিয়ে বেজায় বিব্রত থাকেন। নাম শুনলেই আঁতকে উঠেন। কাঠমোল্লারা তো গালি দিয়ে খালাস- সমকামীরা হচ্ছে খচ্চর স্বভাবের, কুৎসিৎ রুচিপূর্ন, মানসিক বিকারগ্রস্ত। এমনকি প্রগতিশীলদের মধ্যেও রয়েছে নানা রকম ওজর আপত্তি [...]

সমকামিতা কি প্রকৃতিবিরুদ্ধ? অনেকেই সমকামিতা নিয়ে বেজায় বিব্রত থাকেন। নাম শুনলেই আঁতকে উঠেন। কাঠমোল্লারা তো গালি দিয়ে খালাস- সমকামীরা হচ্ছে খচ্চর স্বভাবের, কুৎসিৎ রুচিপূর্ন, মানসিক বিকারগ্রস্ত। এমনকি প্রগতিশীলদের মধ্যেও রয়েছে নানা রকম ওজর আপত্তি। যারা শিক্ষিত, ‘আধুনিক’ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন, গে লেজবিয়ন ইত্যকার তথাকথিত ‘পশ্চিমা’ শব্দের সাথে কমবেশি পরিচিত হয়েছেন, তারাও খুব কমই ব্যাপারটিকে মন থেকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নিতে পারেন। তাদের অনেকেই এখনো ব্যাপারটিকে ‘প্রকৃতি বিরুদ্ধ’ মনে করেন, আর নয়ত ভাবেন – পুরো ব্যাপারটি উৎকট ধরনের ব্যাতিক্রমধর্মী কিছু, এ নিয়ে ‘ভদ্র সমাজে’ যত কম আলোচনা করা যায় ততই মঙ্গল। উপরে উপরে না বললেও ভিতরে ভিতরে ঠিকই মনে করেন সমকামীরা তো হচ্ছে গা ঘিন ঘিনে বিষ্ঠাকৃমি জাতীয় এঁদো জীব। মরে যাওয়াই মনে হয় এদের জন্য ভাল। সমাজ সভ্যতা রক্ষা পায় তাহলে। আমি এই বছর বৈজ্ঞানিক দিক (মুলত জীববিজ্ঞান ও জেনেটিক্সের দৃষ্টিভঙ্গি) থেকে নির্মোহভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে একটি বই লিখেছি; নাম - 'সমকামিতা : একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান' (২০০৯)। বইটি প্রকাশ করেছে 'শুদ্ধস্বর'। বইটির বেশ কিছু অংশ ইন্টারনেটের ব্লগসাইটগুলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের সময় প্রকাশের সময় সুধীজনের আগ্রহ তৈরি করে। মুক্তাঙ্গন ব্লগের জন্য এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে আমার এবারকার বইয়ের উপর ভিত্তি করেই। আমি নিজে সমকামী নই, কিন্তু সমকামী বন্ধু-বান্ধবদের জীবন প্রত্যক্ষ করার এবং এ নিয়ে কিছু পড়াশুনা করার ও লেখালেখি করার সুবাদে কিছুটা ধারনা অর্জন করেছি। আমার এ প্রবন্ধটি সে চিন্তাভাবনারই ফসল বলা যেতে পারে। মুক্তাঙ্গন ব্লগের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে এ প্রবন্ধ ভিন্নমাত্রার আবেদন তৈরি করবে বলে মনে করি। তবে, এ নিয়ে পাঠকদের ভিন্নমত থাকলে আমি তা সদরে পর্যালোচনা করতে, এবং যুক্তিনিষ্ঠ হলে তা গ্রহণ করতেও আমি রাজী। আমি প্রবন্ধটি শুরু করছি ভুল ভাবে ব্যবহৃত কিছু মন্তব্য দিয়ে, যা সমকামিতার বিরুদ্ধে প্রায়শই ব্যবহার করা হয় : “সমকামিতা প্রাকৃতিক কোনোভাবেই হতে পারে না মূলত (নারী-পুরুষে) কামটাই প্রাকৃতিক” কিংবা অনেকে এভাবেও বলেন - “নারী আর পুরুষের কামই একমাত্র প্রাকৃতিক যা পৃথিবীর সকল পশু করে। যার মূল লক্ষ্য হলো বংশ বৃদ্ধি” উক্তিগুলো স্রেফ উদাহরণ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। অনেকেই সমকামিতাকে ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ বা ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য উপরোক্ত ধরণের যুক্তির আশ্রয় নেন। আমি এই…

“‌‌‌ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে এথেন্সবাসী করেছেন, বর্বর করেননি, তাঁকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে মুক্তপুরুষ তৈরি করেছেন, স্ত্রীলোক বা ক্রীতদাস করে তৈরি করেন নি।” [...]

“‌‌‌ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে এথেন্সবাসী করেছেন, বর্বর করেননি, তাঁকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে মুক্তপুরুষ তৈরি করেছেন, স্ত্রীলোক বা ক্রীতদাস করে তৈরি করেন নি।”' উক্তিটি যেন-তেন কারো নয়; বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো-র। কারো কারো মতে যিনি নারীমুক্তি আন্দোলনের পথপ্রদর্শক এবং বিশ্বাসী। তৎকালীন সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নাকি ব্যক্তিগত মানসিকতা, মনস্তাত্ত্বিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী প্লেটো উক্তিটি করেছেন তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। সে বিতর্কে যাবার জায়গা এটা নয়। তবে উক্তিটিতে স্পষ্টভাবেই তিনি নারীকে ক্রীতদাসদের সমতূল্য বিবেচনা করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে করা প্লেটোর এ উক্তির বাস্তবতা যে আজও বহাল তবিয়তে রয়েছে তা জানতে আমাদের বেশি দূর যেতে হয় না। এর জন্য পাবলিক বাসগুলোর দিকে তাকানোই যথেষ্ট; যেখানে কিছু আসন সংরক্ষিতকরণের চিহ্নস্বরূপ লেখা থাকে- মহিলা/শিশু/প্রতিবন্ধি। ইঙ্গিতটি স্পষ্ট। নারীকে বিবেচনা করা হচ্ছে শিশু ও প্রতিবন্ধিদের মতো দুর্বল হিসেবে; যাদের বাড়তি সুবিধার প্রয়োজন। বাসওয়ালারা যে অবচেতন মনেই এ কাজটি করেছেন তা ধরে নেয়া যায়। আমাদের শক্তিশালী সামজিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিলিকৃত মতাদর্শ আমাদের এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে শুধু এই অর্ধশিক্ষিত কিংবা নিরক্ষর বাসওয়ালারাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীরাও নারীকে এরকম দুর্বল, অধস্তন, পুরুষের প্রতি নির্ভরশীল, সৌন্দর্য ও যৌনপ্রতীক হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রচলিত গালি, প্রবাদ, সঙ্গীত কিংবা কৌতুকেও এর প্রকাশ ঘটে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় আমাদের প্রচলিত গালিগুলো যাকে উদ্দেশ্য করেই নিক্ষিপ্ত হোক না কেন, গালির মাধ্যমে যাকে আক্রমণ করা হয় সে হলো কোন নারী, মা বা বোন বা স্ত্রী। কোন পুরুষকে অপদস্ত করবার সবচেয়ে কার্যকর পথ হচ্ছে তার মা, বোন, কন্যা বা স্ত্রীর ‘সতীত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন বা তাদের কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ইঙ্গিত। এছাড়া প্রতিটি ভাষায় বিশেষ্য-বিশেষণ পদগুলো খেয়াল করলে দেখা যায় তার অধিকাংশই পুরুষবাচক; আকার-ইকারযোগে শব্দের রূপান্তর ঘটিয়ে নারীবাচক শব্দ তৈরি করা হয়েছে। এতেই বোঝা যায় আমাদের সংস্কৃতি-সভ্যতা নির্মাণ ও টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে পুরুষ কতটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই শক্তিশালী যে খোদ নারীরাও নিজেদেরকে এরকম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হিসেবে বিশ্বাস করে। সিমঁ দ্য ব্যুভুয়া যেমনটা বলেছেন, “নারীর কোনো পৃথক জগৎ নেই। জগতের তাবৎ বিষয় সে বিচার করে পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে। নারীর বাস্তবতা আসলে পুরুষেরই বাস্তবতা।” এ বাস্তবতা তৈরিকরণ ও শক্তিশালীকরণে যেসব…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.