পহেলা বৈশাখ, রাষ্ট্র, ইন্ডিয়া, লোকসমাজ…

আজ অনেকটা ধুমধামেই আমাদের রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রপালিত বান্দাদের সহযোগে পহেলা বৈশাখ পালন করাতে পারল। আমরাও অনেকটা গৃহপালিত বান্দার মতোই তা স্মরণীয় বরণীয়ও করলাম। তাতে নাগরিক মধ্যবিত্তের তেমন সমস্যা হয়েছে বলে দৃশ্যত মনে হয় নি। তবে ঘটনার আড়ালেও ঘটনা থাকে, কষ্টের আড়ালেও কষ্ট থাকে।

আজ অনেকটা ধুমধামেই আমাদের রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রপালিত বান্দাদের সহযোগে পহেলা বৈশাখ পালন করাতে পারল। আমরাও অনেকটা গৃহপালিত বান্দার মতোই তা স্মরণীয় বরণীয়ও করলাম। তাতে নাগরিক মধ্যবিত্তের তেমন সমস্যা হয়েছে বলে দৃশ্যত মনে হয় নি। তবে ঘটনার আড়ালেও ঘটনা থাকে, কষ্টের আড়ালেও কষ্ট থাকে।
নাগরিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, প্রিন্টিং ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া হুলস্থূল সহকারে বাংলা নববর্ষ পালন করলেও সনাতন হিন্দু সমাজ আজ পালন করেছে চৈত্র সংক্রান্তি। আমাদের পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেই আগামীকাল পহেলা বৈশাখ পালন করা হবে।
এরই মধ্যে দুই-একটা অদ্ভুত ঘটনার মুখোমুখি হলাম আমি। আমার অতি পরিচিত একজন সরকারি কর্মজীবী আমায় জানাচ্ছেন, একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন… এই বলেই লোকটা আমার দিকে এভাবে তাকালেন যেন আমার দায়িত্ব হচ্ছে এইটুকুতেই সবটুকু বুঝে নেয়া। আমার না-বুঝাকে তাচ্ছিল্যের ভিতর ফেলে তিনি বলছেন, এই দেশের হিন্দুরা তো সরকারের আইন মানে না! আমার অতি আশ্চর্য অবয়বকে পুঁজি করে আমায় জানাচ্ছেন, সরকারের ঘোষণা আছে বুধবার ১৪ই এপ্রিল পয়লা বৈশাখ, কিন্তু এরা ভিতরে ভিতরে বিষুদবার দিন পহেলা বৈশাখ করবে, পূজা-উজা করবে আর-কি। আমি বুঝাতে চাইলাম, এরা তো পঞ্জিকা মেনে তাদের ধর্মমতে…; _আরে রাখেন আপনার পঞ্জিকা, এইসব সরকারের সাথে গাদ্দারি, এরা ইন্ডিয়ার বুদ্ধিতে নাচে, আপনারা এইসব বুঝবেন না।
আমি তাকে কিছুতেই বুঝাতে পারলাম না। আমি বাধ্য হয়ে একজন সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোককে তাদের এই ধরনের অবাধ্যতা বিষয়ে তাদের মতামতটা জানতে চাইলাম। তার কথা বেশ সরল-মীমাংসামুখি। তার বাপ-দাদারা গ্রামের নিয়মে যেভাবে চৈত্র-সংক্রান্তি বা পয়লা বৈশাখ যেভাবে পালন করেছেন, এরাও তা-ই করছেন। তারা তো মুরুব্বিগণের সাথে বেয়াদবি করতে পারেন না।
আসলে মহাত্মা (!) এরশাদ অনেকভাবে জাতিকে লণ্ডভণ্ড করার মানসে অনেককিছুর মতো এই কাজটিও করে গেছেন। অর্থাৎ রাষ্ট্র কর্তৃক মুসলিম আধিপত্যকে একচেটিয়া করার মানসেই এ কাজটি করা হয়েছে। ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদীরা (এই যুগল দৃশ্যত, কার্যত, প্রবহমানত অনেকটাই একই নবীর উম্মত।) না হয় একই ধারায় তা বহাল রেখেছিল, এখন ভাষাপন্থি জাতীয়তাবাদীরাও একই কাজ কেন করছেন? কারণ এখন যেভাবে পহেলা বৈশাখ পালন করা হচ্ছে, এতে সনাতন হিন্দু সমাজকে শুধু নয়, লোকজ সমাজকেও বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে। মুক্তচিন্তার কথিত সওদাগরগণও দেখছি এ ব্যাপারে অনেকটাই চুপচাপ আছেন!

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর

কথাসাহিত্য চর্চার সঙ্গে যুক্ত। পেশায় চিকিৎসক। মানুষকে পাঠ করতে পছন্দ করি। আমি মানুষ এবং মানব-সমাজের যাবতীয় অনুষঙ্গে লিপ্ত থাকার বাসনা রাখি।

৭ comments

  1. মোহাম্মদ মুনিম - ১৫ এপ্রিল ২০১০ (৪:৩২ পূর্বাহ্ণ)

    Wikipedia তে দেখা গেল প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ পালিত হচ্ছে ১৪ই এপ্রিল, বাংলা একাডেমীর ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। ডঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এই ক্যালেন্ডারটি চালু করেন, ইংরেজী ক্যালেন্ডারের সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্য। ক্যালেন্ডারটি চালু হয় ১৯৬৬ সালে, এরশাদের আমলের বহু আগে। হিন্দু পঞ্জিকা চলে সনাতন নিয়মে (চন্দ্র সুর্য্যের অবস্থান অনুযায়ী)। আবার হিন্দু পঞ্জিকারও রকমফের আছে। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। তবে পহেলা বৈশাখ এলেই একদিনের জন্য হলেও আমাদের মেয়েরা লাল পাড়ের শাড়ী পড়ে, হাতে মেহেদী মাখে, সেটা দেখে একদিনের জন্য হলেও মোল্লারা মন খারাপ করে থাকে, একদিনের জন্য হলেও আমরা আবার আশায় বুক বাঁধি, যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আমরা হারিয়ে ফেলেছি বহূকাল আগে, তা আবার ফিরে আসবে, বছরে শুধু একদিনের জন্য নয়, প্রতিদিনের জন্য।

  2. kamruzzaman Jahangir - ১৫ এপ্রিল ২০১০ (৭:১৫ পূর্বাহ্ণ)

    মোহাম্মদ মুনিম, আপনাকে ধন্যবাদ।
    একাডেমীর ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। ডঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এই ক্যালেন্ডারটি চালু করেন, ইংরেজী ক্যালেন্ডারের সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্য। ক্যালেন্ডারটি চালু হয় ১৯৬৬ সালে, এরশাদের আমলের বহু আগে।
    আপনার উপরোক্ত তথ্যটি বাস্তবত সঠিক বলে ধরতে পারছি না। উইকিপিডিয়ারও উচিত ছিল, যাচাই-বাছাই করে তথ্য দেয়া। আসল ইতিহাস হচ্ছে, ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ড. মুহ্ম্মাদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে অফিসিয়াল সুবিধার কারণে, খ্রীষ্টাব্দের আবহ আনার তাড়নায়, বিজ্ঞানভিত্তিক করার মানসে(!) ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার’ নামে কতিপয় সুপারিশ করেন, যেখানে ১৪ এপ্রিলকে বাংলা নববর্ষ হিসাবে গণনার কথা বলা হয়। আরও বলা হয় বৈশাখ-ভাদ্র হবে ৩১ দিনে, আশ্বিন-চৈত্র হবে ৩০ দিনে। তবে ফাল্গুন মাস অধিবৎসরের সাথে মিলিয়ে প্রতি চার বছর পরপর ৩১ দিনে হবে। স্বাধীনতার পর বাংলায় সবকিছু লেখার হুকুম জারি করলেও তা কার্যকর করা হয় নি। কিন্তু গত শতাব্দীর ৮০ দশক (১৯৮৭ সালে) অনেক চেনাজানা, প্রয়োজনীয়, লোকজ মূল্যবোধ উলটপালট হতে থাকল। ১৯৬৩ সালের কমিটির রায় তখন কার্যকর করার আদেশ জারি হল। সামরিক সমনের জীবনে বহুবিধ নিয়ম-শৃঙ্খলা যে নাড়িয়ে দিচ্ছিল, এ তারই আরেক নজির। চাঁদের হিসাব দেখে, তিথির উপর ভর করে, পঞ্জিকা দেখে স্থির হয়ে চলা বাংলা সনে একটা পরিবর্তন কার্যকর করা হল। তখন থেকেই ১৪ এপ্রিলকে বাধ্যতামূলকভাবে ‘পহেলা বৈশাখ’ বলে ফর্মান জারি করা হয়।
    আবার হিন্দু পঞ্জিকারও রকমফের আছে। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা একটু গোলমেলে।
    আমার জানামতে সনাতন হিন্দু সম্প্রদায় লোকনাথের পঞ্জিকাকেই সঠিক বলে ধরে নেয়। আরেকটা কথা হচ্ছে, পঞ্জিকা নিয়েও তো বাণিজ্য হয়, তবে চন্দ্র-তিথির হিসাব আর লোকবিজ্ঞানকে খাটো করে দেখার কোনো স্কোপ নেই। আমরা ‘গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’ জাতীয় বড়ো বড়ো আওয়াজ তুলি, কিন্তু নিজেদের সুবিধার বেলায় নাগরিক আধিপত্য ঠিকই বজায় রাখি।

  3. মাসুদ করিম - ১৫ এপ্রিল ২০১০ (৯:৪৩ পূর্বাহ্ণ)

    হিন্দু সমাজের একজন ‘জ্যোর্তিবিজ্ঞানী বিদ্যাসাগর’ দরকার। শহীদুল্লাহর পঞ্জিকা সংস্কারের ভিত্তি ছিল বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার পঞ্জিকা সংস্কার বিষয়ক গবেষণা। এদেশে শহীদুল্লাহর মতো ভারতে এস.পি. পান্ডে কমিটি মেঘনাদ সাহার পঞ্জিকা গবেষণাকে ভিত্তি করে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু সেখানে সরকারিভাবে এটা চালু হয়নি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার তামিল ও সিংহলিরা বাংলাদেশের মতো ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করে, সেটাও সম্ভব হয়েছে প্রচলিত পঞ্জিকা সংস্কার করে তাকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে ঐক্যসূত্রে চলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায়। এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার এস.পি. পান্ডে কমিটির সুপারিশ মেনে নিয়ে আদেশ দিলেই ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন শুরু হয়ে যাবে। তাই বলছিলাম তাদের একজন সমাজসংস্কারক দরকার যিনি ‘জ্যোর্তিবিজ্ঞানী’ হলে ভাল হয়। তার আগ পর্যন্ত পঞ্জিকা দিয়েই চলুক না। এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠ ও কালের কণ্ঠে প্রকাশিত অজয় রায়ের ‘চৈত্র সংক্রান্তি’ বিষয়ক লেখাটা পড়ুন এখানে</a।

    বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী বর্ষান্তের চৈত্র মাসের শেষ দিনকে অভিহিত করা হয় চৈত্র সংক্রান্তি নামে। সাধারণভাবে শেষ দিনটি হয়ে থাকে ৩০ চৈত্র। বাংলা একাডেমী সংস্কারায়িত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বছরের প্রথম পাঁচ মাস (বৈশাখ-ভাদ্র) গণনা করা হবে ৩১ দিনে। বাকি ৭ মাস হবে ৩০ দিনের। সে হিসেবে ৩০ চৈত্রকে ধরা হবে চৈত্র সংক্রান্তি। অন্যদিকে ভারতীয় বাংলা পঞ্জিকাকারগণের পুরনো হিসেবমতে দিনটির তারতম্য হতে পারে, আবার মিলেও যেতে পারে। যেমন ১৪১৪ সালের লোকনাথ ডাইরেক্টরি মতে চৈত্র মাস ত্রিশ দিনের। বাংলা একাডেমীর সাথে একই দিনে পড়েছে (১৩ এপ্রিল ২০০৮ রবিবার) এবার। অর্থাৎ ১৪১৬ সালের ৩০ চৈত্র পড়েছে ১৩ এপ্রিলে। তবে বারটি হচ্ছে মঙ্গল। আমাদের সংস্কারায়িত বর্ষপঞ্জির বিশেষত্ব হচ্ছে অধিকাংশ গুরম্নত্বপূর্ণ দিবসের সাথে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের সাথে প্রাতিষঙ্গিকতা বজায় থাকে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত অনেক বাংলা ক্যালেন্ডারের সাথে আমাদের দিনের কোন কোন সময় ব্যত্যয় ঘটে। তবে সংস্কারায়িত শকাব্দের সাথে খুব একটা বিরোধ ঘটে না। কারণ এটি সংস্কারায়িত হয়েছে ড. মেঘনাদ সাহার বৈজ্ঞানিক সুপারিশক্রমে যা বাংলা একাডেমীও গ্রহণ করেছিল আমাদের বর্ষপঞ্জি সংস্কারকালে। আমাদের সাথে পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা পঞ্জিকার বড় অনৈক্য ঘটেছে ১ বৈশাখের প্রাতিষঙ্গিকতাকে কেন্দ্র করে। ওরা ১ বৈশাখ করে অধিকাংশ সময় ১৫ এপ্রিলে, আর আমরা করে থাকি ১৪ এপ্রিলে প্রতিবছর। বৃহত্তর স্বার্থে এটুকু অসামঞ্জস্য আমাদের মেনে নিতে হয়েছে। তারতম্যের আরও কয়েকটি নমুনা দিই :
    হিন্দুরা এ দিনটিকে অত্যন্ত একটি পুণ্য দিন বলে মনে করে। এছাড়া সাধারণত এই বসনত্মকালে বাসন্তী দেবী ও অন্নপূর্ণা দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। হিন্দু পঞ্জিকামতে, দিনটিকে গণ্য করা হয় মহাবিষুব সংক্রান্তি নামে। হিন্দুরা পিতৃপুরম্নষের তর্পণ করে থাকে, নদীতে বা দীঘিতে পুণ্য স্নান করে থাকে।
    ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের পরিবারে মহাধুমধামের সাথে চৈত্র সংক্রানত্মি পালিত হতো। ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে পিতৃদেব নদীতে পুণ্য স্নান সেরে সূর্য উপাসনা করতেন, পিতৃপুরম্নষের উদ্দেশে স্মৃতি তর্পণ করতেন অনেকণ ধরে। অনেক হিন্দুকে দেখেছি পিতৃপুরম্নষের উদ্দেশে পিণ্ডিদান করতেও। মা সকাল থেকেই স্নান সেরে সুন্দর শাড়ি পরে নানা সুন্দর সুন্দর রান্নার আয়োজনে ব্যসত্ম হয়ে পড়তেন। সংক্রানত্মির আগের দিন রাতভর নানা মিষ্টি, বিশেষ ধরনের পিঠা, খৈ, মুড়ি আর চিড়ের লাড়ু তৈরি করতেন। সংক্রানত্মির সকালে চমৎকার শাড়ি পরা মাকে অপূর্ব সুন্দরী মনে হতো। আমরা মার আশপাশে ঘুরঘুর করতাম মিষ্টি আর মিষ্টান্নের লোভে। প্রসন্নময়ী মা আমাদের নিরাশ করতেন না। বিতরণ করতেন দরাজ হাতে। আমার দাদা বলে উঠতেন, ‘মা, প্রতিদিন তুমি এত সুন্দর হতে পার না, হতে পার না দয়াময়ী? মা কৃত্রিম রাগে দাদাকে বকতেন, আর পরণেই চুমুতে ভরিয়ে দিতেন দাদার মুখ। আমরাও বঞ্চিত হতাম না মায়ের সুখস্পর্শ থেকে। আমাদের বাসায় থাকা বাবার পিতৃব্য সংক্রানত্মির সকালে স্নান সেরে মাকে প্রথমেই কাছে ডেকে এনে মাথায় হাত রেখে অনেকণ ধরে কী সব মন্ত্র আউড়িয়ে মাকে আশীর্বাদ করতেন। প্রতিবছরই এই ছবির পুনরাবৃত্তি ঘটত। মা তাঁকে ভক্তিভরে প্রণাম সারলে ঠাকুর্দা বলতেন, ‘মা, তোমাকে আজ দেবী অন্নপূর্ণার মতো সুন্দরী লাগছে। তারপর চিবুক ছুঁয়ে আশীর্বাদ করতেন, ‘চিরআয়ুস্মতী ভব।’ গৌরবর্ণা মা লাজে আরও রক্তিম হতেন। মা-ই ছিলেন আমাদের কাছে সকল আনন্দের, সকল সুখের কেন্দ্রবিন্দু। বাবা অনেকটাই দূরের মানুষ ছিলেন, স্নেহপরায়ণ হলেও।
    মা সেদিন অনেক ধরনের ব্যঞ্জনের সাথে অনেক পদের শাক রান্না করতেন। অনেক শাকই থাকত ওষুধি গুণযুক্ত। মা এসব কোত্থেকে শিখেছিলেন জানি না। অথচ তাঁর শাশুড়ি, মা এই পরিবারে পুত্রবধূ হয়ে আসার ২-৩ বছরের মধ্যে মারা যান। প্রশিণ পাওয়ার খুব সুযোগ পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। মার মুখেই শুনেছি, মা যখন এ সংসারে এলেন তখন ছিলেন অষ্টাদশী। মা একদিন গল্পচ্ছলে আমাদের ভাইবোনদের বলেছিলেন, “জানিস, আমি যখন এ সংসারে এলাম কালাজ্বর থেকে সদ্য সেরে ওঠা। আমার গাত্রবর্ণ দেখে শাশুড়ি-ননদদের মুখ আমার আপাত কালো বর্ণের চেয়েও কালো হয়ে উঠেছিল।” এই বলে মা হাসিতে লুটিয়ে পড়তেন। তারপর প্রসাধন চর্চায় কালাজ্বরের প্রভাবে ‘কালাভাব’ ২-১ মাসের মধ্যে সরে গিয়ে মা তাঁর আদি গৌরবর্ণ ফিরে পেলে তখন পরিবারের মেয়ে সদস্যদের হাসি দেখে কে! এই বলে মা আবার হাসিতে গড়িয়ে পড়তেন। আমরা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠতাম।
    চৈত্র সংক্রানত্মির দিনে আমাদের বাসায় একটি রীতি ছিল। সেদিন সকালে আমরা সবাই প্রাতঃরাশ শুরম্ন করতাম নানা ধরনের ছাতু খেয়ে। ছাতুর গোলস্না তৈরি হতো গুড়, দৈ বা দুধের মিশ্রণে। অনেক সময় কলাও মেশানো হতো। দাদা ও আমার ঠাকুর্দার চাহিদা ছিল এর সাথে অতি অবশ্য গুড়ের সন্দেশ। আমরা তৃপ্তির সাথে খেতাম। ছাতুর প্রকার ছিল বুট, পয়রা বা যব, মাকই বা ভুট্টা। মা এত সব কখন বানাতেন আমরা বুঝতে পারতাম না। মার অবশ্য একজন সর্বণিক বালবিধবা সহায়িকা ছিলেন, যাঁকে আমরা ডাকতাম ‘তনু দি।’ আর একজন পুরম্নষ সহায়ক ছিলেন_ মার সাথে পিত্রালয় থেকে আসা নেপালী সহচর ‘বুনিয়াদ সিং।’ আমরা সিং কাকু ডাকতাম। তাঁর কাছে আমাদের সবচাইতে আকর্ষণীয় একটি দ্রব্য ছিল তী্ন্নধার ‘ভোজালী।’
    আমাদের বাসায় সংক্রানত্মির দিন আর একটি রীতি পালন করা হতো বেশ নিষ্ঠার সাথে। তাহলো, নানা প্রকারের ওষুধি গাছের পাতা ও শিকড় একত্রে বেঁধে সুতো দিয়ে প্রতিটি ঘরের দরজার মাথায় ঝুলিয়ে দেয়া হতো এক বছরের জন্য। এ সব সংগ্রহে মাকে সহায়তা করতেন সিং কাকু। বনজঙ্গল ঘেঁটে তিনি সেসব সংগ্রহ করতেন। অবশ্য বাবারও এ ব্যাপারে খুব উৎসাহ ছিল। আমরাও প্রবল উৎসাহে গাছগাছালি সংগ্রহে লেগে যেতাম। এক ধরনের ছোট গাছের কথা আমার এখনও মনে আছে। তাকে আমাদের অঞ্চলে বলা হতো ‘বিষ কুটুলি।’ তা ছাড়া থাকত নিমের পাতা, হলুদ গাছের চারা, রসুনের গাছ বা পাতা। যত্নের সাথে ঝোলানোর পর মা দরোজার উপরের আনুভূমিক কাঠটির মাঝখানে, পাঁচটি করে সিন্দুর আর চন্দনের ফোঁটা লাগিয়ে দিতেন সুন্দর করে। তাছাড়া বাড়ির মেঝেতে অাঁকা হতো জল মিশ্রিত চালের গুঁড়ো দিয়ে শ্বেতশুভ্র ‘আলপনা।’ সেদিন দুপুরে নানা পদের নিরামিষ দিয়ে আমাদের চমৎকার দ্বিপ্রাহরিক ভোজন সমাপ্ত হতো। কিছু অতিথি সব সময় থাকতেন। এ সবের পেছনেই থাকত মার ভূমিকা। মাকে কেন জানি আমার মনে হতো দশভুজা দুর্গা। সব দিক থেকেই আমাদের পরিবারটিকে মনে হতো যেন একাই রা করে চলেছেন। মা যেদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, শয্যাপাশে আমি ছাড়া কেউ ছিলেন না। পিতৃদেব কয়েক বছর আগেই চলে গেছেন। যখন বললাম, ‘মা, আমাদের কে দেখবে?’ বাকরম্নদ্ধ মা কেবল মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। সেই জগজ্জননী মাকে আমার বার বার মনে পড়ে চৈত্র সংক্রানত্মি এলে। পরিবর্তিত পরিবেশে, নাগরিকতার চাপে আমরা আর কেউ সেদিনের মতো চৈত্রের শেষ দিনে মহাবিষুব সংক্রানত্মি উৎসব পালন করতে পারি না।
    চৈত্রের শেষ দিনে আমাদের আর একটি আকর্ষণীয় দর্শনী ছিল একটি খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত চড়ক পূজা। একটি সুউচ্চ বাঁশের পোলের উপরে স্থাপিত একটি আনুভূমিক বাঁশের লিভারের এক প্রানত্মে একটি জলজ্যানত্ম মানুষের পিঠে বড়শির হুক দিয়ে আটকিয়ে তাকে ঝুলিয়ে দেয়া হতো। আর আনুভূমিক বাঁশটির অন্য প্রানত্মটি দিয়ে ঝুলনত্ম মানুষটিকে বন বন করে ঘোরানো হতো। আমরা বিস্ফারিত লোচনে অবাক হয়ে দেখতাম আর ভয়ে শিহরিত হতাম। সে এক ভয়ানক রোমাঞ্চকর অনুভূতি।
    চৈত্র সংক্রানত্মির একটি জ্যোতির্বৈদ্যিক দিক আছে। সেটির সামান্য প্রসঙ্গ টেনে প্রবন্ধের সমাপ্তি টানব। সংক্রানত্মি কথাটির অর্থ হলো অতিক্রম করা বা অতিক্রমণ। বিশেষ অর্থ হলো, সূর্য এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বলা হয় সংক্রানত্মি। চলতি কথায়, মাসের শেষ দিবসকেই বলা হয় সংক্রানত্মি। পৌষ মাসের শেষ দিনটিকে বলা হয় ‘পৌষ সংক্রানত্মি’, আর চৈত্রের শেষ দিবস অভিহিত হয় ‘চৈত্র সংক্রানত্মি’ নামে। চৈত্রের শেষ দিবসকে পঞ্জিকাকাররা বলে থাকেন ‘মহাবিষুব’ সংক্রানত্মি। আর আশ্বিনের শেষ দিন হলো ‘জলবিষুব’ সংক্রানত্মি।
    মহাকাশে (ঈবষবংঃরধষ ংঢ়যবৎব) পৃথিবীর অরেখার উপর লম্বভাবে অঙ্কিত মহাবৃত্তের নাম বিষুব বৃত্ত (ঊয়ঁধঃড়ৎ) । আর মহাকাশে পৃথিবীর চার পাশে সূর্যের আপাত বার্ষিক গতিপথকে বলা হয় ‘রবি মার্গ’ বা রাশিচক্র (ঊপষরঢ়ঃরপ)। এই দু’টি মহাবৃত্ত একই সমতলে অবস্থান করে না। তারা পরস্পরকে দু’টি বিন্দুতে ছেদ করে এবং উভয়ের মধ্যে ২৩০২৭’ কোণ রচিত হয়। এই ছেদ বিন্দু দু’টির নাম যথাক্রমে মহাবিষুব বিন্দু (াবৎহধষ বয়ঁরহড়ী ড়ৎ ভরৎংঃ ঢ়ড়রহঃ ড়ভ অৎরবং,) এবং জলবিষুব বিন্দু (ধঁঃঁসহধষ বয়ঁরহড়ী ড়ৎ ভরৎংঃ ঢ়ড়রহঃ ড়ভ খরনৎধ, )। পৃথিবীর মেরম্নুঅ ক্রানত্মিতলের অরে সাথে ২৩০২৭’ হেলে থাকে বলেই বিষুব বৃত্ত ও ক্রানত্মি বৃত্ত পরস্পরকে ছেদ করে, আর এ কারণেই পৃথিবীতে ঋতুর পরিবর্তন হয়। সাধারণভাবে ২১ মার্চ তারিখে সূর্য ক্রানত্মি বৃত্ত ও বিষুব বৃত্তের মধ্যে ছেদ বিন্দু ‘কে অতিক্রম করে যায়। আর তাই ২২ মার্চ তারিখে পৃথিবীর সর্বত্র দিন-রাত্রি সমান হয়। কারণ এ সময় সূর্য বিষুব বৃত্তে অবস্থান করে। এর পর থেকেই উত্তর গোলার্ধে দিন বাড়তে থাকে আর রাত ছোট হতে থাকে, এবং ২১ জুন তারিখে উত্তর গোলার্ধে আমরা পাই দীর্ঘতম দিন আর হ্রস্বতম রজনী। সূর্য এ সময় কর্কট ক্রানত্মি বৃত্তে অবস্থান করে। ক্রানত্মি বৃত্তে সূর্যের এই প্রানত্মিক অবস্থান বিন্দুকে বলা হয় উত্তর অয়নানত্ম (ংঁসসবৎ ংড়ষংঃরপব)। দণি গোলার্ধে অবশ্য এর বিপরীত। এর পর থেকে দিন ছোট হতে থাকে আর রাত বড় হতে থাকে। অবশেষে ২৩ সেপ্টেম্বর তারিখে সূর্য পুনরায় অবস্থান নেয় বিষুব বৃত্তের বিন্দুতে, যেখানে ক্রানত্মি বৃত্ত ও বিষুব বৃত্ত পরস্পরকে ছেদ করেছে। একে বলা হয় ‘জলবিষুব বিন্দু’ (ধঁঃঁসহধষ বয়ঁরহড়ী)। এই দিন পুনরায় পৃথিবীর সর্বত্র দিন-রাত সমান হয়ে থাকে। অতঃপর উত্তর গোলার্ধে ক্রমশ রাত বড় হতে হতে সূর্য পেঁৗছে যায় ক্রানত্মি বৃত্তের দণি অয়নানত্ম বিন্দুতে (রিহঃবৎ ংড়ষংঃরপব ) ২২ ডিসেম্বর তারিখে যখন উত্তর গোলার্ধে হয় দীর্ঘতম রজনী আর ুদ্রতম দিবস। এ সময় সূর্য মকর বৃত্তে অবস্থান করে থাকে। এখানে লণীয় যে, ২১ জুনের পর থেকে সূর্য রাশিচক্রে ক্রমশ দণি দিকে সরে আসতে আসতে ডিসেম্বর মাসে দণিতম বিন্দুতে (মকর ক্রানত্মি বিন্দু) উপনীত হয়। সূর্যের এই ছয় মাসব্যাপী দণি অভিমুখী অভিযাত্রাকে বলা হয়ে থাকে দণিায়ন। অন্য দিকে ২২ ডিসেম্বরের পর থেকে সূর্য পুনরায় রাশিচক্রে ক্রমশ উত্তর দিকে সরতে সরতে জুন মাসে উত্তরতম বিন্দুতে উপনীত হয় (কর্কট ক্রানত্মি বিন্দু)- সূর্যের এই ছয় মাসব্যাপী উত্তরাভিযানকে বলা হয় উত্তরায়ন।
    এখানে একটি বিষয় লণীয় যে, যদিও জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুযায়ী সূর্য রাশিচক্রে চারটি কার্ডিনাল বিন্দুতে_ মহাবিষুব সংক্রানত্মি (াবৎহধষ বয়ঁরহড়ী), জলবিষুব সংক্রানত্মি (ধঁঃঁসহধষ বয়ঁরহড়ী), উত্তর অয়নানত্ম (ংঁসসবৎ ংড়ষংঃরপব) বিন্দু এবং দণি অয়নানত্ম বিন্দুতে (রিহঃবৎ ংড়ষংঃরপব ) উপনীত হয় যথাক্রমে ২২ মার্চ, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২১ জুন ও ২২ ডিসেম্বর তারিখে। কিন্তু বাংলা পঞ্জিকাকারগণ যে তারিখগুলোকে এই দিবসগুলোকে চিহ্নিত করে তার সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানসম্মত উক্ত তারিখগুলোর একদম মিল নেই। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আমার হাতের কাছে লোকনাথের ১৪১৪ সালের পঞ্জিকাটি রয়েছে। ওদের মতে, এই সনে মহাবিষুব সংক্রানত্মি হবে ৩০ চৈত্র (১৩ এপ্রিল), ৮ চৈত্রের (২২ মার্চ) পরিবর্তে,_ ২২ দিনের ব্যবধান। এর কারণ পঞ্জিকাকারগণ তাঁদের গণনায় নত্র বছর (ংরফবৎবধষ ুবধৎ ) ব্যবহার করে থাকে (যেখানে অয়ন বিন্দুদ্বয়ের গতিকে হিসাবে আনা হয় না) ক্রানত্মি বৎসরের (ঃৎড়ঢ়রপধষ ুবধৎ) পরিবর্তে। বর্তমান হিসেব মতে বিন্দুটি (ভরৎংঃ ঢ়ড়রহঃ ড়ভ অৎরবং,) কোন স্থির নত্রের সাপে েসূর্যের গতির উল্টো দিকে সরে আসছে। ফলে বিন্দুটির সাপে েসূর্যের আপাত অবস্থানের মধ্যে ও পঞ্জিকার হিসাবের সূর্যের অবস্থানের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে চলেছে। যদি ধরা হয় যে, ৫৭০ অব্দে সিদ্ধানত্মিক গণনা চালু কালে মহাবিষুব সংক্রানত্মি হয়ত ৩০ বা ৩১ চৈত্র হতো। অয়ন বিন্দুর এই পশ্চাৎগামিতার ফলে এখন প্রকৃত মহাবিষুব সংক্রানত্মি ঘটে থাকে ৭ বা ৮ চৈত্র (২ শে মার্চ)। হিসাব করে দেখা গেছে যে, পঞ্জিকার এই গণনা পদ্ধতি অব্যাহত থাকলে আগামী ২০০০ বছরের মধ্যে আমরা যথাযথ ঋতু থেকে এক মাস এগিয়ে যাব। অর্থাৎ যেসব অনুষ্ঠান হওয়ার কথা বসনত্মকালে তা পড়বে মধ্য-শীতে। সূর্য সিদ্ধানত্মভিত্তিক পণ্ডিত পঞ্জিকাবিশারদগণ কি আধুনিক বিজ্ঞানের অবদানকে অস্বীকার করেই যাবেন, আর তাঁদের অনুসারী সাধারণ মানুষদের মধ্যে বিভ্রানত্মি বাড়াতেই থাকবেন। আমাদের কি আর একজন প্রগতিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক বিদ্যাসাগরের জন্য অপো করতে হবে?

    • kamruzzaman Jahangir - ১৫ এপ্রিল ২০১০ (১০:২৪ অপরাহ্ণ)

      আপনার প্রস্তাবনা এবং যথোচিত উদ্ধৃতির জন্য ধন্যবাদ।

  4. Pingback: মুক্তাঙ্গন | সীমানা ছাড়ায়ে | মাসুদ করিম

  5. উত্তম সিংহ - ৬ ডিসেম্বর ২০১২ (১২:২৭ অপরাহ্ণ)

    মাননীয় কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, আপনার সুন্দর একটি লিখার জন্য ধন্যবাদ। অনেকেই আপনার লিখার প্রতি উত্তরে নানান যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তাদের উত্তরে আমার কিছু বলা জরুরি মনে করছি। বিষয়টি অত্যন্ত জটিল ও দীর্ঘ তাই সল্প পরিসরে লিখে বুঝানো আমার পক্ষে আরো জটিল। তবুও আমি চেষ্ঠা করছি।
    ১। বলা হয়ে থাকে বাংলা পঞ্জিকার দিন-তারিখ গননা পঞ্জিকারেরা একটি দৈবিক ধারনা থেকে করে থাকেন তাই এর হিসাব সরকারি ভাবে রাখা যায়না বলেই বাংলা একাডেমীর সংস্কার দরকারী।
    – বাংলা পঞ্জিকা শুধুই তারিখ নির্ভর নয় বলে ইংরেজী তারিখের সাথে তাল মিলালেই এর প্রকৃত সংস্কার সম্ভব নয়, চন্দ্র ও সুর্য্যের অবস্থানেরও সংস্কার আনতে হবে। আমি আমার অনেক লেখায় প্রমান দিয়েছি যে পুরাতন শাস্ত্র নির্ভর না হয়েও জুলিয়ান তারিখ দিয়ে কিভাবে বাংলা তারিখ বের করা যায়, যা আমাদের প্রচলিত পঞ্জিকার সাথে হুবহু মিলবে। যদি কেউ চর্বিত চর্বন না মনে করেন তা হলে বলছি।
    উদাহরন: বাংলা পঞ্জিকা গননার ০ পয়েন্ট (সূর্য্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করেছিল তার জুলিয়ান ডে) JD = 1938094.483733333 (594 March 19 23:36:34.3 BDT Friday), যেহেতু ২০শে মার্চ ৫৯৪ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা ১লা বৈশাখ ১ বঙ্গাব্দ ছিল।

    ক) ১৪২১ বঙ্গাব্দর শুরুর ঠিক আগের দিন ছিল ১৪২০ বঙ্গাব্দ তাকে বাংলা ১ বৎসরের মান: 365.258756481482 (সুর্য্য সিদ্ধান্ত মতে) দ্বারা গুন করুন
    1420 X 365.258756481482 = 518667.4342

    খ) উক্ত গুণফলকে বাংলা পঞ্জিকা গননার ০ পয়েন্ট মানের সাথে যোগ করুন
    1938094.483733333 + 518667.4342 = 2456761.918 (জুলিয়ান ডে)

    গ) উক্ত জুলিয়ান ডে-কে গ্রেগরিয়ান তারিখে রুপান্তর করলে দাঁড়ায় 2014 April 14 10:01:55.2 BDT Monday
    যা সূর্য্যের মেষ রাশিতে প্রবেশ কালের সমান সময় হবে, তা হলে ১৫ এপ্রিল ২০১৪ খ্রীষ্টাব্দ তারিখে, ১ বৈশাখ ১৪২১ বঙ্গাব্দ মঙ্গলবার হবে।

    ২। অজয় রায় মহোদয় একজন ভাল পণ্ডিত ও লেখক। আমি উনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বিনয়ের সহিত কিছু (সংস্কার বিষয়ক) অংশে দ্বিমত পোষন করব।
    – আপনার পরিবারের যে বিশ্বাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন তা অত্যন্ত সুন্দর, অনুকরনীয় ও শ্রদ্ধার। যার কোন সংস্কার সম্ভব নয়।
    – আপনি বলেছেন “আগামী ২০০০ বছরের মধ্যে আমরা যথাযথ ঋতু থেকে এক মাস এগিয়ে যাব।” আগামী ২০০০ বছর পরে কি হবে তার চিন্তায় আমরা এখন থেকে অস্থির হচ্ছি আর বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যা লঘুদের অস্থির করে তুলছি ও ২টি পঞ্জিকা অনুসরনে বাধ্য করছি। বাংলা একাডেমীর পঞ্জিকা ১লা বৈশাখ পালন ব্যতিত আর কোথাও ব্যবহার হয় বলে আমার জানা নাই তবে প্রচলিত পঞ্জিকা হিন্দু সমাজে নিত্য দিন ব্যবহার করা হয়। শুধু এক দিনের জন্য এত বড় একটা ভার আমাদের বহন করতে দিলেন।
    – বর্তমানে চৈত্র সংক্রান্তি বা ১লা বৈশাখ গ্রীষ্ম কালে হলেও তা ঋতু নির্ভর কোন উৎসব নয় যে তা বসন্তে বা শরতে হলে আমাদের অসুবিধায় পরতে হবে। এখন বলি বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য গ্রীস্মকাল তখন হয়ত বলব জৈষ্ঠ্য-আষাঢ়। পবিত্র ঈদুল ফিতর এবার শরতে হলে তা আগামীতে শীতে হতে পারে যা সম্পূর্ন চন্দ্র ও হিজরী পঞ্জিকা নির্ভর। ঠিক তেমনি চৈত্র সংক্রান্তি রবি ও ভারতীয় (উপমহাদেশ) গননা পদ্ধতি (নিরয়ন) নির্ভর। আর বাংলার চৈত্র সংক্রান্তি দিন নির্নয়ের সিদ্ধান্ত ভারতের অন্য অঞ্চল থেকেও একটু আলাদা। আমাদের হচ্ছে, যে দিন রাত ১২টার মধ্যে রবি ০ডিগ্রিতে (মেষ রাষিতে) আসবে সে দিন চৈত্র সংক্রান্তি আর তার পর দিন ১লা বৈশাখ। উদাহরনঃ ১৩ এপ্রিল যদি রাত ১২টার মধ্যে রবি ০ডিগ্রিতে না আসে ১৫ই এপ্রিল ১লা বৈশাখ, আর যদি আসে তা হলে ১৪ই এপ্রিল ১লা বৈশাখ হবে।
    – পশ্চিমারা আয়ন সহ ব্যবহার করেন, আমরা করিনা তাই রবির ০ডিগ্রিতে আসার দিন গননায় পার্থক্য হয়ে থাকে। পশ্চিমা পদ্ধতি ব্যবহার করে আমাদের জ্যোতিষ গননা তথা কোষ্ঠী বিচার বা ভবিষ্যত গননা ইত্যাদি সঠিক হয়না। তারিখের জন্য পশ্চিমা পদ্ধতি আর জ্যোতিষ গননায় ভারতীয় পদ্ধতি এ রকম হতে পারেনা বলেই ভারত বা বাংলাদেশে সরকারী সংস্কার কোথাও গৃহিত হয়নি।
    ৩। জ্যোতিষ শাস্ত্র মানব কল্যানে ব্যবহার করা উচিত, ব্যবসা করে মানুষকে প্রতারিত করার জন্য নই। মানব কল্যান মুখী এই বিদ্যা কু সংস্কার নই যে তার সংস্কার প্রয়োজন।
    পরিশেষে, বিনামূল্যে পঞ্জিকা বইয়ের খবর দিয়ে শেষ করছি। আমি ১-১৪১৯ সন পর্যন্ত সকল বৎসরের পঞ্জিকা (বাংলা ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায়) মোট ২৮৩৮টি বই রচনা করেছি এবং বিনামূল্যে সবার জন্য উন্মুক্ত করেছি। যে কেউ আমার সাইট থেকে সেগুলো (http://ponjika.us/bangla) ডাউনলোড করতে পারেন। ধন্যবাদ।

  6. মাসুদ করিম - ৫ মে ২০২১ (২:২৮ পূর্বাহ্ণ)

    পূজা হল পঞ্জিকার প্রাণ, আবার পূজা এখানে ঐতিহ্যের অংশ, এটাই বাধা হয়ে গেছে পঞ্জিকা সংস্কারের। শহীদুল্লাহর পঞ্জিকা সংস্কারের ভিত্তি ছিল বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার পঞ্জিকা সংস্কার বিষয়ক গবেষণা। সেটা বাংলাদেশে কাজে লেগেছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে পূজার ঐতিহ্য বড় ঐতিহ্য তাই সেখানে মেঘনাদ সাহার গবেষণা এবং এই গবেষণার উপর ভিত্তি করে এস.পি. পান্ডে কমিটির সুপারিশ সুপারিশ হয়েই পড়ে আছে। তাই পশ্চিমবঙ্গের কেউ আমাকে এপ্রসঙ্গে কিছু বললে আমি তাদেরকে মেঘনাদ সাহা পড়তে বলি। বাংলাদেশে কেউ আমাকে এপ্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে পূজা পঞ্জিকা অনুযায়ী করতে বলি মাসের বছরের হিসেবটা আমাদের বাংলা ক্যালেন্ডার অনুয়ায়ী করতে অনুরোধ করি। এতে সব সমস্যা মিটে যায়, চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ ছাড়া। আমার কাছে চৈত্র সংক্রান্তি চৈত্রের শেষ দিন বছরের শেষ দিন, পহেলা বৈশাখ বৈশাখের প্রথম দিন বছরের প্রথম দিন। কিন্তু হিন্দুসমাজের কাছে এটা আবার পূজারও অংশ – আর যেহেতু পূজার অংশ তাই তাদেরকে পঞ্জিকার কথা শুনতে হয়।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.