ভ্রমণ ছিল কঠিন নেশা জীবদ্দশায়। বিশ্বজুড়ে ঘুরবো এবার, উল্টেপাল্টে দেখবো এবার জগতটাকে - 'কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্নিপাকে'। এলেবেলে পথের বাঁকে অনেকটা পথ হাঁটা হলেও, দীর্ঘ জীবন ৬০টি বছর বেঁচে থেকেও, বিশ্বজুড়ে হয়নি আমার দাপিয়ে বেড়ানো। সাধ-সাধ্যের দেখাদেখি হয়েছে কখনো, দীর্ঘ মোলাকাতের সুযোগ হয়নি একটি বারও। যখন আমি সদ্য তরুণ…... তখন আমর অঢেল সময়, অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্য। সমস্যাটা টাকা-কড়ির, নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা বহুদুরের স্বপ্ন তখন, দেশ ভ্রমণে যাই কি করে। আরো একটু বড় হও, অপেক্ষাতে রইলাম আমি। যখন আমি মধ্যযুবা…... শক্তি তখন অফুরন্ত, অর্থেরও নেই সমস্যা। কিন্তু আমি ভীষণ ব্যস্ত প্রচুর প্রাচুর্যে। সময় কোথায় বিশ্ব ঘোরার? ওইবেলাতেও হয়নি যাওয়া। সময় যখন প্রৌঢ়ত্বে ...... তখন আমার প্রচুর সময়, ছিল অঢেল অর্থও। কিন্তু আমি ততদিনে বিত্ত দৌড়ে রিক্ত মানুষ, রোগ-ব্যাধিতে বিধ্বস্ত। দেশ-বিদেশে ভ্রমণ হলো হাসপাতাল টু হাসপাতালে। বিশ্ব দেখা দুরেই থাক, এমনকি সেই হাসপাতালের বারান্দাতে, খেয়াল করে হয়নি দেখা, ম্যাগনোলিয়ার কুঁড়িটিও। বিশ্ব আমার শেষবেলাতেও থেকেই যে যায় অদেখাতেই। এই পারেতে আসার পরে শখটা যেন পুরন হলো। আত্মা আমার হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় সারা পৃথিবীতে। নাই টিকেটে- নাই ভিসাতে- নাই পাসপোর্টে। বিশ্বজুড়ে অবারিত সীমান্ত তার, অবাধ যাতায়াত । তবু যেন আত্মা আমার অতৃপ্ত যে বড়ো। অসময়ে ভ্রমণ করার বিড়ম্বনা যার, মানব জনম কেটে গেছে দ্বিধায় দ্বিধায় দ্বিধায়.....। [কপচিত দর্শন - প্রত্যেক মানুষের শখ-সাধ-আহ্লাদ তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল -- সময়, অর্থ, শক্তি। মানুষের জীবনে এই তিনটি জিনিস একই সময়ে এক সাথে থাকা ঘটনা অতি বিরল। দৈবাৎ যাদের একসাথে তিনটাই থাকে তারা অতি অসাধারণ অদ্ভুত ভাগ্যবান মানুষ]
লোকটা ডাকাত সর্দার, ময়মনসিংহ অঞ্চলের একদার যাত্রার হিরো। শেষ তাকে দেখি ঢাকা জেলখানার হাজতিদের ওয়ার্ডের পাহারার দায়িত্বে। আমরা তার অধীন ছিলাম। তার প্রাণে গান ছিল এবং তার যাবজ্জীবন হয়েছিল। ডাকু রমজানের জন্যই রাতটা মাঝেমধ্যে রঙ্গিন হয়। অ্যালুমিনিয়ামের থালায় আঙুল ঠুকে গান গাওয়া ছিল তার রাতের মেরাজ। চোখ বন্ধ করে গাইতে গাইতে সে লুপ্ত হতো নিজের মধ্যে। কোনোদিন সে গাইতো মৈমনসিংহ গীতিকার 'আলোমতি ফুলকুমার' থেকে, 'রাজার ফুল বাগানে যাই, একটু হাঁটিয়া বেড়াই....আমার মনে শান্তি নাই।' গাইতো, 'বন্ধু থাকো, বন্ধু থাকো, বন্ধু থাকো আমার সনে বন্ধু থাকো ও বন্ধু থাকো বন্ধু থাকো তোমার ঢংয়ে।' আবার কোনোদিন গাইতো এই বিষন্ন ব্যালাড, 'যে আমারে আদর করে রে, নাম রাইখ্যাছে আদরিণী আমি কী তার আদর জানি-ই-ই-ই...' যার অর্থ আমার নাম, তার নাম কী তা আমি জানি? আত্মপ্রেমে 'আমি' মাত হয়ে থাকি, কিন্তু আমার 'আত্ম' কী তা কি আমি জানি? তাহলে কার জন্য 'আমি' প্রাণপাত করি? একদা ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ৩২ নং খাতা ওয়ার্ডের সর্দার রমজান ডাকাত এই সমস্যায় জাগ্রত হতো; আমি আজ সেই সমস্যায় লুপ্ত।
প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক দিয়গনেস তাঁর দর্শন ও দর্শন-সম্বলিত জীবন যাপন নিয়ে সৎ ছিলেন। তিনি সিনিকদের পতি মহাত্মা এন্থিস্থিনিসকেও অতিক্রম করেছিলেন বলে জানা যায়। দিয়গনেস নির্লোভ নির্মোহ জীবন যাপন করতেন। তিনি থাকতেন একটা জালার ভেতর মতান্তরে পিপার ভেতর যেখানে অনেক কুকুরও থাকত তাঁর প্রতিবেশী হিসাবে। কুকুরদের সাথে রুটি ভাগাভাগি করে খেতেন তিনি। একটা রুটি রাখার থলে থাকত আর পানি রাখার জন্য একটা বোতল। এই হচ্ছে তাঁর জীবন যাপন। তিনি সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিকতাকে ত্যাগ করেছিলেন। মানুষের বানানো সব কিছুকে তছনছ করতে বলতেন। তাঁর জ্ঞানের পরিধি এবং সুনাম এত দূর গিয়েছিল যে স্বয়ং সম্রাট আলেকজান্দার একদিন খায়েস করলেন তাঁকে দেখতে যাবেন। যেই কথা সেই কাজ। ভোরে দিয়গনেস পিপার মুখে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন। সম্রাট এসে দাড়ালেন পিপার মুখে । সম্রাট নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলেন তিনি তাঁর জন্য কিছু করতে পারেন কিনা। আর দিয়গনেস তারদিকে তাকিয়ে সুর্যের দিকে ইশারা করে বললেন - রোদ পোহাতে দাও (সরে দাড়াও, তোমাকে আমার দরকার নাই)। পরবর্তীতে সিনিকাল দর্শনটা খুব জনপ্রিয় হয়ে যায়। নতুন নতুন ধরনের সিনিক্যাল মতবাদের উদ্ভব হয়। শেষে এটা বুর্জোয়া অসুখে পরিণত হয়। অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক কোন ব্যাপার সম্পর্কে মাথা না ঘামানো। তবে দিয়গনেসের মতটা ছিল অনেকটা বৌদ্ধিক। নিজেকে সবকিছু থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া। পরে অসত্দিত্ববাদিদের দর্শনেও সিনিক প্রভাব দেখা যায়। আলবেয়ার কামুর আউড সাইডার উপন্যাসের নায়ক যে তার মায়ের মৃত্যুতে নির্বিকার থাকে। ধর্ম আইন সবকিছু সম্পর্কে যে প্রশ্ন তোলে। এখনো আধুনিক মানুষদের একটা বড় অংশ সিনিক্যাল জীবন যাপন করে। তবে আমার মনে হয় এখানেও একটা যৌক্তিকতা আছে। দেশের সবচাইতে মেধাহীন গবেটরাই রাষ্টের নায়ক হয়, যেখানে আইন নাই, জ্ঞানীদের শাসন কার্যে অংশগ্রহণ নাই। সক্রাতেসের বিক্রিত মতেই যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র চলে সেখানে সিনিক্যাল কমপ্লেক্স থাকবেই। সিনিক্যাল কমপ্লেক্স একধরণের হতাশা। একজন চৈতন্য সমৃদ্ধ মানুষই কেবল সিনিক হতে পারে। তবে একটা সিনিকাল জীবন গবেট রাষ্ট্রও চাপিয়ে দিতে পারে মানুষের ওপর। প্রথম বিশ্বে মানুষ পুজিবাদের পূর্ণ বিকাশ এবং ভোগবাদী জীবনের কারণেই সিনিক হতে পারে। যেটাকে আমি ইতিমধ্যে বুর্জোয়াদের অসুখ বলে আখ্যায়িত করেছি। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকেনা। যদিও রাষ্ট্রীয় ভাবেই অধিকসংখ্যক মানুষকে কর্মহীন করে রাখা হয় এখানে।…
দার্শনিক, না শিশু? শুক্লা চতুর্দশীর চাঁদটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে ছোট্ট শিশুটি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো- চাঁদটা গোল কেন? আমরা যারা ইতোমধ্যে বড় হয়ে গেছি, প্রশ্ন শুনেই নড়েচড়ে ওঠি। তখন আর ঠিক মনে করতে পারি না - আমরাও কি এমন প্রশ্ন করেছিলাম শৈশবে? সৃষ্টির শুরুতে একান্ত তরল প্রকৃতির মহাজাগতিক একটা বস্তুপিণ্ডের তীব্রগতির ঘুর্ণায়মান অবস্থায় মহাকর্ষের কেন্দ্রাভিগ আর কেন্দ্রাতিগ বলের সম্মিলিত প্রভাবের সাথে অন্যান্য অনুঘটক মিশে বস্তুর আকৃতি প্রকৃতই গোল হয়ে যাবার ধারণাটা যারা প্রশ্ন খুঁজে খুঁজে পেয়ে গেছেন তাদের কথা আলাদা। (more…)
কবিতা নিয়ে, তা যে বা যার কবিতাই হোক না কেন, কিছু লিখা বেশ বিপজ্জনক। আমার সবসময় মনে হয়েছে কবিতার গঠন এবং প্রকৃতিতে এত বেশি সম্ভাবনা, প্রতি-সম্ভাবনা এবং বিমূর্ততা রয়ে যায় যে কবিতাকে সুনির্দিষ্টায়িত এলাকাভিত্তিক করার চেষ্টা পন্ডশ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু সময়ে সময়ে এ-বোধটুকু থাকা সত্ত্বেও কবিতার মানে বের করে ফেলার একটা চেষ্টা থেকেই যায়। . . . (more…)