সোনা, অহিফেন আর যৌনসঙ্গী এই তিনের প্রতি ছিল চীনাদের আকর্ষণ – প্রবীণ চীনের সেই আকর্ষণের বস্তুতান্ত্রিকতা ও গণমানুষের উপর অনিঃশেষ শোষণের বিরুদ্ধে নবীন চীন রুখে দাঁড়িয়েছিল – তাদের সাম্যবাদী বস্তুতান্ত্রিকতার পরিকল্পনায় প্রধান বাহন ছিল শিল্পমুখী যন্ত্রশক্তি – এদুয়ের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের আদর্শবাদ বা আধ্যাত্মবাদ মোটেই সুবিধা করতে পারেনি – তাই ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথের চীন ভ্রমণ ব্যর্থ না হলেও নবীন চীনের কাছে অপমানিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পিকিং-এ যেখানেই বক্তৃতা দিতে গেছেন তিনি, তার বিরুদ্ধে চীনের নতুন যুগের ছোকরারা চীনা ভাষায় মুদ্রিত প্রচারপত্র বিলি করেছিল। রবীন্দ্রনাথ যাদেরকে চীনের ছোকরা বলেছিলেন তারা কারা – অবশ্যই ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থকেরা – যাদের মধ্যে তখন চল্লিশোর্ধ বিখ্যাত চীনা সাহিত্যিক লু স্যুনও ছিলেন। এই বস্তুবাদীদের কার্যকলাপে রবীন্দ্রনাথ এতই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন যে শেষ পর্যন্ত সফর অসমাপ্ত রেখেই তিনি পিকিং ত্যাগ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ ছিল তাদের – রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন চীনের সভ্যতার গুণকীর্তন করেছিলেন, আধ্যাত্মবাদী ব্রহ্মধর্ম ও উপনিষদের বাণী প্রচার করেছিলেন, বৌদ্ধধর্মের সূত্রে ভারত-চীন সেতুবন্ধের কথা বলেছিলেন, চীনের প্রগতিশীল সহিংসতাকে গান্ধীর অহিংস নীতি অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছিলেন আর বস্তুবাদী বিপ্লবের যন্ত্রনির্ভর শিল্পের দৈত্যের বিপরীতে মানুষের মধ্যে দেবতার আকাঙ্ক্ষায় উচ্চতর স্বর্গ লাভের চূড়ান্ত মানবিক উৎকর্ষের কথা বলেছিলেন। তিনি চীনের তরুণদের উদ্দেশ্যে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন
যারা বস্তুগত শক্তির সাহায্যে ক্ষমতাশালী জাতি গড়তে চায় তারা ইতিহাস জানে না ও সভ্যতাকেও বুঝতে পারেনি। নিছক শক্তির উপর নির্ভরতা বর্বরতার লক্ষণ, যারা তার উপর নির্ভর করেছিল তারা হয় ধ্বংস হয়েছে অথবা বর্বরই থেকে গিয়েছে।
এরকমের উচ্চারণের বিরুদ্ধে চীনের যুবকেরা চীনা ভাষায় চিৎকার করে বলেছিল, পরাধীন দেশের দাস ফিরে যাও – আমরা দর্শন চাই না, বস্তুবাদ চাই।
কেন তার বিরুদ্ধে এইসব বিরোধিতামূলক প্রচারপত্র, প্ল্যাকার্ড, চিৎকার? রবীন্দ্রনাথ জানার চেষ্টা করেছিলেন এবং জেনেও ছিলেন। কিন্তু তিনি তার উপলব্ধিতে স্থিতধী ছিলেন – আত্মিক শক্তির উচ্চতায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন – তিনি বারবার আধ্যাত্মিক সভ্যতা ও বিজ্ঞানের পথে পার্থিব উন্নতির সমন্বয় ঘটানোর পথেই মানুষের মুক্তির আদর্শবাদে নিমগ্ন ছিলেন। এই সীমাহীন দূরত্ব চীনের বিপ্লবী যুবশক্তির কাছে রবীন্দ্রনাথকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ পরিচয়ে পর্যবসিত করেছিল। এ তো গেল আধ্যাত্মবাদ ও বস্তবাদে অটল বিশ্বাসের কারণে দুপক্ষের সংঘাতের জ্বলন্ত দিক। কিন্তু এটাও তো জানতে ইচ্ছে হয়, কেউ কেউ কি জানত না এই ঠাকুর ওই ভারতীয় অহিফেন সরবরাহকারী ঠাকুর-এর বংশজাত – এবং এটা জেনে কি রবীন্দ্র বিরোধিতার তীব্রতা মুক্তিকামী তরুণদের মধ্যে আরো প্রজ্জ্বলিত হয়নি?
জাপান জাভা পারস্য রাশিয়া ইউরোপ ভ্রমণ নিয়ে চিঠি ডায়েরি সংকলিত বই আছে রবীন্দ্রনাথের, চীন ভ্রমণ নিয়ে কিন্তু এরকম কিছুই নেই। ফ্যাসিস্ট মুসোলিনিকে রবীন্দ্রনাথ তো সমর্থন দিয়েই ফেলেছিলেন, রমাঁ রলাঁ থাকায় সেই আগ্রাসী শক্তির রূপ রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন এবং ইউরোপের সেদিনের গণচেতনার সহিংস দিককে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু চীনের মুক্তিকামী গণচেতনায় উদ্বুদ্ধ তারুণ্যের শক্তিকে বুঝতে সেদিন রমাঁ রলাঁর মতো চীনের কোনো ব্যক্তিত্বের সাথে রবীন্দ্রনাথের কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ফলে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মবাদী আত্মিক মহত্ব ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ পরিচয়ের অপমান যেমন বহন করেছিল তেমনি চীনের মুক্তিকামী যুবসমাজও এক অনন্য শান্তিকামী মানুষের অন্তরের উপলব্ধি থেকে বঞ্চিত হয়েছিল।
আমার আরো রবীন্দ্রনাথ : অহিফেন ঠাকুর, মুখের কথা লেখা, উপন্যাস : যোগাযোগ, রবীন্দ্রনাথ।
মাসুদ করিম
লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১৯ comments
সাইদুল ইসলাম - ৭ এপ্রিল ২০১১ (১:২৩ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ মাসুদ করিমকে, রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণইতিহাসের এ অনালোকিত দিকটি আলোকিত করার জন্য। এ-বিষয়ে আরো বিশদভাবে পড়তে চাই। মাসুদ ভাই আশা করি লিখবেন।
প্রণব আচার্য্য - ৭ এপ্রিল ২০১১ (৫:৫৬ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ মাসুদ করিম।। অজানা ছিল– এ সম্পর্কিত আরো বিস্তারিত জানার আগ্রহে রইলাম।।
নাসরীন - ১০ এপ্রিল ২০১১ (৩:১৭ অপরাহ্ণ)
আপনার লেখাটি খুব ভাল লেগেছে।আপনার আরো লেখা পড়তে চাই।
মাসুদ করিম - ১০ এপ্রিল ২০১১ (৫:২৯ অপরাহ্ণ)
অনেক ধন্যবাদ, আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন এখানে।
5th in the alfabet - ১৭ এপ্রিল ২০১১ (৭:৩৫ পূর্বাহ্ণ)
জানার দরকার ছিলো ।
Pingback: মুক্তাঙ্গন | সীমানা ছাড়ায়ে | মাসুদ করিম
অজানা - ৫ জুন ২০১১ (২:১৬ অপরাহ্ণ)
চীন খারাপ ভারত ভাল,কারন রবীন্দ্রনাথের মত জমিদারের পুএ চীনে শ্রমিক শ্রেনীর শাসন ভাল লাগেনি! যাই হোক উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সংঘাত ভালো কিন্তু শ্রমিকের অধিকার আদায়ের লড়াই ভালো না। জমিদারিটা ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ কথা বলেননি,শ্রেনির বাইরে তিনি কতটুকু নিম্নবর্গের স্বার্থের পক্ষের হয়ে কথা বলেন?মালিকেরা সহিংস কিন্তু শ্রমিককে অহিংস হওয়ার মালিক পক্ষের চালাকি আর ধুর্তামি উপদেশ দেওয়া শঠতা।
সরব দর্শক - ৫ জুন ২০১১ (৮:৫৯ অপরাহ্ণ)
@ অজানা
আপনি লিখেছেন,
কোন্ সালে চীনে ‘শ্রমিক শ্রেণীর শাসন’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? লালফৌজের বিখ্যাত লং মার্চই-বা হয়েছিল কোন্ সালে?
মাসুদ করিম - ২৪ মার্চ ২০১২ (২:০৮ অপরাহ্ণ)
৮৮ বছর পর চীনে আবার রবীন্দ্রনাথ, অনান্থ কৃষ্ণান ‘দি হিন্দু’তে লিখছেন
বিস্তারিত পড়ুন : 88 years later, Tagore comes to China again।
Pingback: মুক্তাঙ্গন | রবীন্দ্রনাথ | মাসুদ করিম
মাসুদ করিম - ২০ মে ২০১৩ (১:১৪ অপরাহ্ণ)
Pingback: হন্যতে : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোপন ডায়েরি | মাসুদ করিম
মাসুদ করিম - ৮ এপ্রিল ২০১৪ (৩:৩২ অপরাহ্ণ)
আরো অপমান এবার মেক্সিকোয়, দিয়েগো রিবেরার মুরালে।
মাসুদ করিম - ১৪ জুলাই ২০১৪ (২:০১ অপরাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ২৯ আগস্ট ২০১৪ (৯:৫৯ অপরাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ২২ ডিসেম্বর ২০১৫ (১০:০৫ পূর্বাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ২৭ মে ২০১৬ (১২:১১ পূর্বাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ৫ ডিসেম্বর ২০১৬ (৮:৩৩ পূর্বাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ৯ মে ২০২২ (৪:৩৯ পূর্বাহ্ণ)
রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে পাঁচদফা অভিযোগ
https://mknewsmedia.tumblr.com/post/683650038218506240/%E0%A6%AC-%E0%A6%A4%E0%A6%B0-%E0%A6%95-%E0%A6%A4-%E0%A6%85%E0%A6%A4-%E0%A6%A5-%E0%A6%B0%E0%A6%AC-%E0%A6%A8-%E0%A6%A6-%E0%A6%B0%E0%A6%A8-%E0%A6%A5-%E0%A6%93-%E0%A6%9A-%E0%A6%A8-%E0%A6%B0%E0%A6%AC-%E0%A6%A8-%E0%A6%A6-%E0%A6%B0%E0%A6%A8-%E0%A6%A5-%E0%A6%B0