...[একুশের সেই ভোরের কথা চিন্তা করুন। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে চলে আসছে সেই মেয়েটি, যার অন্তর্গত কণ্ঠে তখন ধ্বনিত হচ্ছে ভাইকে ভুলে না যাওয়ার নিভৃত প্রতিজ্ঞা। সঙ্গে তার ভাই ছিল অথবা ছিল বাবাও। কিংবা তারা কেউ না থাকলেই বা কি? একুশ তো নির্ভয়ে পথচলারই দিন।]...

একুশের সেই ভোরের কথা চিন্তা করুন। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে চলে আসছে সেই মেয়েটি, যার অন্তর্গত কণ্ঠে তখন ধ্বনিত হচ্ছে ভাইকে ভুলে না যাওয়ার নিভৃত প্রতিজ্ঞা। সঙ্গে তার ভাই ছিল অথবা ছিল বাবাও। কিংবা তারা কেউ না থাকলেই বা কি? একুশ তো নির্ভয়ে পথচলারই দিন। আর চিরদিন যেন এভাবে পথচলা যায়, সে আকাঙ্ক্ষাই তো খেলা করে এদিনের আগেপরে। বাবা নয়, ভাই নয়, কেউই নয় মেয়েটি তো ফিরছিলো সেই আকাঙ্ক্ষাকে সঙ্গী করে। কিন্তু তাকে উত্যক্ত করতে শুরু করল কয়েক ছেলে। প্রতিবাদ করায় ক্ষতবিক্ষত হতে হলো ভাইকে। একুশ মানে তো মাথা নত না করা- যে একুশের প্রতি পরম মমত্বে সে একটু আগে মিনারের পাদদেশে শুইয়ে রেখে এসেছে কয়েকটি ফুল- মেয়েটিও তাই প্রতিবাদে জ্বলে উঠল। এবার তাকেও পিটাতে পিটাতে ফুটপাতে ফেলে দিলো বখাটেরা। শহীদ মিনার থেকে অনেকেই ফিরছিল, শহীদ মিনারে অনেকেই যাচ্ছিল। তাদের সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে এই দৃশ্য। কেউই এগিয়ে যায়নি এই বখাটেদের পাল্টা উত্তর দিতে। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো যত সহজ, চেতনা নিয়ে রুখে দাঁড়ানো তত সহজ নয়। মেয়েটিকে তাই একুশের দিন এইভাবে রক্তাক্ত হতে হয়েছে, যে-রক্তের দাগ হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই মুছে যাবে- কিন্তু কিছুতেই সে ভুলতে পারবে না এদিনটিকে। আরও ভুলতে পারবে না একটি সংগঠনকে। সে সংগঠনটির নাম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ - যে সংগঠনটি দাবি করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লালন করার। জগন্নাথগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে এক ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করেছে এক ছাত্র। ছাত্রীটির অপরাধ, ওই ছাত্রের অনৈতিক প্রস্তাবে সে রাজি হয়নি। প্রতিদিনই ছাত্রীটিকে ওই ছাত্র উত্যক্ত করত। কিন্তু একদিন সে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, বাসার দিকে রওনা হওয়া ছাত্রীটির পিছু নেয় সে। ছাত্রীটি তার স্বামীর কাছে টেলিফোন করে। তার স্বামী এসে ছাত্রটিকে অনুরোধ করে তাকে উত্যক্ত না করতে। পরদিন ওই ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মেয়েটিকে তার বিভাগের সামনে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। মেয়েটি টিকতে না পেরে বাসার দিকে রওনা হলে বিশ্ববিদ্যালয় গেটে শ শ মানুষের সামনে তার ওড়না কেড়ে নেয় ছেলেটি, চুলের মুঠি ধরে চড়থাপ্পর মারে। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। গত বছরের শেষ দিকে বাংলা বিভাগের এক ছাত্রীকে কলাভবনে সবার সামনে মারধর করে এক ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে হুশিয়ার করলেও গ্রাহ্য করেনি সে।…

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে (আমি যদ্দুর জানি) আসামীদের সবাই রাজনৈতিকভাবে মৃত ছিলেন। নাৎসীরা থেকে শুরু করে বর্তমানে বিচারাধীন রোদোভান কারাচদিচ [....]

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে (আমি যদ্দুর জানি) আসামীদের সবাই রাজনৈতিকভাবে মৃত ছিলেন। নাৎসীরা থেকে শুরু করে বর্তমানে বিচারাধীন রোদোভান কারাচদিচ, এরা সকলেই বিচারাধীন সময়ে রাজনৈতিক ভাবে দুর্বল বা মৃত ছিলেন। অল্প কিছু শুভানুধ্যায়ী ছাড়া এদের পক্ষে কেউ ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আসামীরাও রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। সম্ভবত এই প্রথমবারের মত কোন সক্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতারা (প্রকৃতপক্ষে সব শীর্ষ নেতারাই) যুদ্ধাপরাধের মত গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আদালতে যাচ্ছেন। সে হিসাবে এটা সরকারের একটা সাহসী পদক্ষেপ। জামাতের জনসমর্থন সেভাবে কোন কালেও ছিল না, একাত্তরপূর্ব বাংলাদেশেও না, আজকের বাংলাদেশও না। কিন্তু একদল সক্রিয় কর্মীর সুবাদে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা চিরকাল pivotal অবস্থানে থেকেছে। ১৯৯৩ সালে শেখ হাসিনা নিজামীকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ‘তাদের ডানে রাজাকার, বামে স্বৈরাচার, সামনে অন্ধকার” এই কাব্যিক উক্তিটি করলেন। খালেদা জিয়া সেই রাজাকারকেই ২০০১ সালে মন্ত্রী করলেন। সেই সময়ে বিএনপির এক মন্ত্রী ‘আমরা জামাতকে স্মৃতিসৌধে নিতে পেরেছি’ এই জাতীয় একটা হাস্যকর উক্তি করেছিলেন বলে মনে পড়ে। এই দুঃখজনক ব্যাপারগুলোর মাঝেও একটা আশার ব্যাপার হচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি দু'দলই রাজাকার ফ্যাক্টরটি ব্যবহার করেছে। জামাত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে গেলেই তারা রাজাকার ফ্যাক্টরটি ব্যবহার করেছে। এমনকি সামরিক বাহিনীর অফিসাররাও রাজাকার ফ্যাক্টরটি ব্যবহার করেছেন। বিএনপি '৯১ এ রাজাকার আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত করেছিল। '৯৬ এ জেনারেল নাসিমের পদ্যচ্যুতির ক্ষুদ্র নাটিকাটি যখন ঘটে, তখন তাঁর পক্ষের অফিসারদের রেকর্ডকৃত কথোপকথনে রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে ‘রাজাকার বিশ্বাস’ নামে অভিহিত করা হয়েছে শোনা যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলিয়া কিছুই নাই’ এই জাতীয় কিছু আপ্তবাক্য ব্যবহার করে সকল রাজনৈতিক দলই জামাতকে ব্যবহার করেছে (এবং ব্যবহৃত হয়েছে), আবার বাংলাদেশের মানুষের মনে জামাতীদের ব্যাপারে যে তীব্র ঘৃণা আছে সে আবেগটিরও ব্যবহার করেছে। 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়ে গেলে জামাত শেষ, জামাত শেষ মানে বিএনপি শেষ, আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র শাসন, ফিরে আসবে '৭২-'৭৫-এর দুঃশাসন' এই জাতীয় কিছু অতি সরলীকৃত রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আছে। '৭২-'৭৫-এর আমল ভালো না খারাপ এটা নিয়ে শুধু অর্থহীন বিতর্কই করা চলে, সেই আমল কখনোই ফিরে আসবে না, ইতিহাস কখনোই পিছনের দিকে যায় না। ২০০১ সালে বঙ্গবন্ধুর নামে আকাশ বাতাস নদী ও সাগরের…

আদালতের রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হচ্ছে হচ্ছে ভাব, এটা হলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আবার নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। প্রত্যাশিতভাবেই জামাত হৈ-হুংকার শুরু করেছে, ছোটবড় কিছু দলকে সাথে নিয়ে এখানে ওখানে ও লন্ডনে বিদ্রোহী সমাবেশ করছে, উত্তেজক শ্লোগান দিচ্ছে। বানানো হয়েছে ‘‘ইসলাম ও ধর্মীয় রাজনীতি রক্ষা জাতীয় কমিটি’’, বক্তারা ‘‘কাফনের কাপড়’’ পরে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। এটা আরো বাড়বে, একটা মরণকামড় জামাত দেবেই [...]

আদালতের রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হচ্ছে হচ্ছে ভাব, এটা হলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আবার নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। প্রত্যাশিতভাবেই জামাত হৈ-হুংকার শুরু করেছে, ছোটবড় কিছু দলকে সাথে নিয়ে এখানে ওখানে ও লন্ডনে বিদ্রোহী সমাবেশ করছে, উত্তেজক শ্লোগান দিচ্ছে। বানানো হয়েছে ‘‘ইসলাম ও ধর্মীয় রাজনীতি রক্ষা জাতীয় কমিটি’’, বক্তারা ‘‘কাফনের কাপড়’’ পরে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। এটা আরো বাড়বে, একটা মরণকামড় জামাত দেবেই। মুক্তিযুদ্ধে জাতি ইসলামে রাজনীতি মেশানোর আগুনে পুড়েছে। কিন্তু তারপরেও ইসলাম-ব্যবসায়ীদের হিংস্র চেহারা জাতির চোখে যতটা স্পষ্ট তাদের ধর্মতত্ত্বের ভয়াবহ দিকটা ততটা স্পষ্ট নয়। সেজন্যই জাতিকে জানানো বিশেষ জরুরী, নিজামুদ্দীন আওলিয়া-মঈনুদ্দীন চিশতি-হজরত শাহ জালাল-শাহ পরানের ইসলামের সাথে মওদুদী-নিজামী-সাঈদী-গোলাম আজমের ইসলামের সংঘর্ষ কেন ও কোথায়। জাতিকে জানানো দরকার মুক্তিযুদ্ধে জামাত যে হিংস্রতা করেছে তার শিকড় সেই মওদুদী-ব্যাখ্যার বিকৃত ও বিক্রীত অধর্মতত্ত্বের মধ্যেই নিহিত। যে-কোন প্রতিপক্ষকে যে-কোন উপায়ে নির্মূল করাই তাঁদের কাছে তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের দাবী। সেখানে হিংস্রতা বৈধ ও মিথ্যা বলা ‘‘বাধ্যতামূলক’’। মুখে, কাজে ও সংবাদপত্রে জামাতের সদাসর্বদা হিংস্রতা ও মিথ্যার যে বেসাতি আমরা দেখি ওটা তার ‘‘ধর্মীয় কর্তব্য’’। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তাদের খপ্পরে পড়া থেকে বাঁচানোর জন্য ইসলামের যে ভয়াবহ ব্যাখ্যা তারা জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চান সে দলিলগুলো দেখানো দরকার, এবং দেখানো দরকার তাদের কেতাব ও কর্মকাণ্ড থেকেই। সেটা সম্ভব, দরকার হলে আদালতে এসব দলিল দেখানো যাবে। ইতিহাসের শিক্ষা এই যে, গণসমর্থন ছাড়া শুধুমাত্র আইনের জোরে ধর্মীয় হিংস্রতা উচ্ছেদ করা যায়না। নিজেদের উদ্দেশ্য অর্জনে কখন সংবিধানকে ‘‘পবিত্র’’ বলে মাথায় তুলতে হয় ও কখন ‘‘ধর্ম-বিরোধী’’ বলে পায়ে দলতে হয় তা জামাত জানে। তাদের হুমকি-ধামকি ও হিংস্রতার কৌশল বেশ সফল, সেটা আইনের বিরুদ্ধে হলেও। মাত্র গত সপ্তাহে মালয়েশিয়াতে ক্যাথলিক পত্রিকা ‘‘হেরাল্ড’’-এর মালয় সংস্করণে স্রষ্টাকে বোঝাতে ‘‘আল্লাহ’’ শব্দটা ব্যবহার করলে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। শব্দের ওপরে কারো মালিকানার আইন নেই বলে আদালত হেরাল্ড-এর পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু আইনে হারলেও ওখানকার ইসলাম-ব্যবসায়ীরা জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলে খ্রিষ্টানদের ওপরে তুমুল হুমকি-ধামকি ছাড়াও এগারোটা গীর্জায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এই হিংস্রতার চাপে আদালত তার রায় স্থগিত রেখেছে, তাতে ইসলামি রাজনীতিকদের সাহস ও মনোবল দুটোই বেড়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে ইসলাম-ব্যবসায়ীরা দেশ ও জাতির কত ক্ষতি করেছে ও করছে সে দলিলগুলোও জাতিকে…

জামাতে ইসলামী ভূত দেখছে,- সত্তরের নির্বাচনের ভূত! তাদের কাছে মনে হচ্ছে এবারের নির্বাচন হবে সত্তরের নির্বাচনের মতো, তাদের ভাষায় যা ‘একতরফা’; তাদের ভাষায়, যে-নির্বাচনে ‘আওয়ামী লীগ জোর করে ভোট আদায় করেছিল।’ এবারের নির্বাচন কেমন হবে? সত্তরের নির্বাচনটি যদি বুঝতে পারি, তা হলে সেটি বোঝা বোধকরি আরও সহজ হবে। আর তা বুঝতে হলে খানিকক্ষণের জন্যে ইতিহাসের পাশে দাঁড়াতে হবে, বিশেষ করে তাদের যারা সত্তরের নির্বাচন চোখে দেখেননি। (more…)

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.