পৃথিবীর সব কালিকাগজ খরচ করেও কি বোঝানো যাবে?

...[একুশের সেই ভোরের কথা চিন্তা করুন। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে চলে আসছে সেই মেয়েটি, যার অন্তর্গত কণ্ঠে তখন ধ্বনিত হচ্ছে ভাইকে ভুলে না যাওয়ার নিভৃত প্রতিজ্ঞা। সঙ্গে তার ভাই ছিল অথবা ছিল বাবাও। কিংবা তারা কেউ না থাকলেই বা কি? একুশ তো নির্ভয়ে পথচলারই দিন।]...

একুশের সেই ভোরের কথা চিন্তা করুন। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে চলে আসছে সেই মেয়েটি, যার অন্তর্গত কণ্ঠে তখন ধ্বনিত হচ্ছে ভাইকে ভুলে না যাওয়ার নিভৃত প্রতিজ্ঞা। সঙ্গে তার ভাই ছিল অথবা ছিল বাবাও। কিংবা তারা কেউ না থাকলেই বা কি? একুশ তো নির্ভয়ে পথচলারই দিন। আর চিরদিন যেন এভাবে পথচলা যায়, সে আকাঙ্ক্ষাই তো খেলা করে এদিনের আগেপরে। বাবা নয়, ভাই নয়, কেউই নয় মেয়েটি তো ফিরছিলো সেই আকাঙ্ক্ষাকে সঙ্গী করে। কিন্তু তাকে উত্যক্ত করতে শুরু করল কয়েক ছেলে। প্রতিবাদ করায় ক্ষতবিক্ষত হতে হলো ভাইকে। একুশ মানে তো মাথা নত না করা- যে একুশের প্রতি পরম মমত্বে সে একটু আগে মিনারের পাদদেশে শুইয়ে রেখে এসেছে কয়েকটি ফুল- মেয়েটিও তাই প্রতিবাদে জ্বলে উঠল। এবার তাকেও পিটাতে পিটাতে ফুটপাতে ফেলে দিলো বখাটেরা।
শহীদ মিনার থেকে অনেকেই ফিরছিল, শহীদ মিনারে অনেকেই যাচ্ছিল। তাদের সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে এই দৃশ্য। কেউই এগিয়ে যায়নি এই বখাটেদের পাল্টা উত্তর দিতে। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো যত সহজ, চেতনা নিয়ে রুখে দাঁড়ানো তত সহজ নয়। মেয়েটিকে তাই একুশের দিন এইভাবে রক্তাক্ত হতে হয়েছে, যে-রক্তের দাগ হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই মুছে যাবে- কিন্তু কিছুতেই সে ভুলতে পারবে না এদিনটিকে।
আরও ভুলতে পারবে না একটি সংগঠনকে। সে সংগঠনটির নাম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ – যে সংগঠনটি দাবি করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লালন করার।

জগন্নাথগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে এক ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করেছে এক ছাত্র। ছাত্রীটির অপরাধ, ওই ছাত্রের অনৈতিক প্রস্তাবে সে রাজি হয়নি। প্রতিদিনই ছাত্রীটিকে ওই ছাত্র উত্যক্ত করত। কিন্তু একদিন সে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, বাসার দিকে রওনা হওয়া ছাত্রীটির পিছু নেয় সে। ছাত্রীটি তার স্বামীর কাছে টেলিফোন করে। তার স্বামী এসে ছাত্রটিকে অনুরোধ করে তাকে উত্যক্ত না করতে। পরদিন ওই ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মেয়েটিকে তার বিভাগের সামনে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। মেয়েটি টিকতে না পেরে বাসার দিকে রওনা হলে বিশ্ববিদ্যালয় গেটে শ শ মানুষের সামনে তার ওড়না কেড়ে নেয় ছেলেটি, চুলের মুঠি ধরে চড়থাপ্পর মারে।
একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। গত বছরের শেষ দিকে বাংলা বিভাগের এক ছাত্রীকে কলাভবনে সবার সামনে মারধর করে এক ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে হুশিয়ার করলেও গ্রাহ্য করেনি সে। গত এক এপ্রিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে মেয়েটি যখন রিকশায় তার এক বান্ধবীর সঙ্গে হলে ফিরছিল, তখন ওই ছাত্র অতর্কিতে হলের সামনের রাস্তায় রিকশা থামিয়ে ছাত্রীটিকে টেনে নামিয়ে এলোপাথাড়ি কিল-ঘুষি ও লাথি মারতে মারতে বলতে থাকে, এর আগে তোকে খালি চড়থাপ্পর মারায় খবরের কাগজে নাম এসেছিল, এরপর তোকে খুন করে নাম তুলব। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের তীব্র ক্ষোভের মুখে তিন এপ্রিল শনিবার ওই ছাত্রটিকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও মাত্র ১০ মিনিট পরেই সে ছাড়া পেয়ে যায় বিশেষ কারও নির্দেশে। থানা থেকে বেরিয়ে সঙ্গীদের সঙ্গে হাসতে হাসতে মোটর সাইকেল চড়ে রওনা হয় সে তার আস্তানার দিকে।

এরকম উদাহরণ আরও দেয়া যাবে, এইসব ঘটনা কে বা কারা কারা ঘটিয়েছে তাদের নামও বলা যাবে। কিন্তু ব্যক্তিগত নাম তাদের বড় পরিচয় নয়, তাদের শক্তির উৎসও নয়- তাদের শক্তির উৎস আর বড় পরিচয় হলো তারা সবাই ছাত্রলীগের নেতা আর কর্মী। যে-সব ঘটনা তারা ঘটিয়ে চলেছে, ওপরের ঘটনাগুলি সেসবের তুলনায় নস্যি মাত্র। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর আমরা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের টেন্ডারবাজির ধাক্কা খেতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু এখন আর কেবল টেন্ডারবাজি কিংবা দখলবাজি নয়, নারী নির্যাতনই হয়ে উঠেছে এইসব সন্ত্রাসীদের মূল ধ্যানজ্ঞান। ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেত্রী নিজেদেরই কেবল পণ্য ও ভোগবাদিতার সামগ্রীতে পরিণত করেননি, নিজেদের পণ্যবাজার শেষ হয়ে যাওয়ায় সংগঠনের পরবর্তী স্তরের কর্মীদেরও ‘উদ্বুদ্ধ’ করেছেন ‌’জীবনে সাফল্য অর্জনের প্রক্রিয়া’ হিসেবে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের কাছে যেতে। ইডেন কলেজের হাজার হাজার ছাত্রীদের মধ্যে এরকম ছাত্রী কয়েকজন মাত্র- অথচ এই হাতে গোণা কয়েক ছাত্রীর জন্যে ইডেনের সব ছাত্রীর দিকে সন্দেহের দিকে তাকাচ্ছে বাংলাদেশের সংশয় ও সন্দেহের ঘোরে আবদ্ধ মধ্যবিত্ত শ্রেণি। জনসভায় বলে বেড়ানোর মতো একটি ‘লাগসই’ উদাহরণ খুঁজে পেয়েছেন বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। কিন্তু খালেদা জিয়া না বললেই কি আর মুছে যাবে দুঃসহ এসব ঘটনা ইডেনের ছাত্রীদের স্মৃতি থেকে! মুছে যাবে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের অনুষ্ঠানে লাঞ্ছিত ছাত্রীদের জীবন থেকে! ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে যে-ছাত্রলীগের বীরপুঙ্গব নেতাকর্মীরা জাতীয় সংসদের নির্বাচনের ফল পুরোপুরি প্রকাশের আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ভার্সিটি ও কলেজের ছাত্রাবাস থেকে ভোরের আলো ফোটার আগেই এক পোশাকে বিদায় নিয়েছিল, কে বলবে সেই ছাত্রলীগ ভেতরে ভেতরে এত ‘পুরুষ’ যে নতুন সরকারের মধুচন্দ্রিমা শেষ হওয়ার আগেই ঝাপিয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে টেন্ডারবাজিতে, নারী নির্যাতনে!
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে, সত্তরের নির্বাচনে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে, এমনকি স্বাধীন দেশে সামরিক শাসন ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রলীগের যে-ভূমিকা মানুষ দেখেছে, তার সঙ্গে সংগঠনটির নতুন এ ভূমিকা বিসদৃশই বটে। ১৯৮৯-এর ডাকসু নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী মিছিলের ওপর হামলা চালানোর মধ্যে দিয়ে যে-কদর্যতার প্রকাশ ঘটিয়েছিল, সেই কদর্যতার চেয়েও নিকৃষ্ট কদর্যতা ধারণ করেছে এ ছাত্রলীগ। আর সন্দেহ নেই, এমন কদর্যতা প্রকাশের ঔদ্ধত্য তারা দেখাতে পারছে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে বলে, আওয়ামী লীগেরই কোনো কোনো নেতা তাদের মাথার ওপর আশীর্বাদের হাত মেলে ধরে রেখেছেন বলে। তা হলে কি আমরা ধরে নেব যে সংগঠনগতভাবেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নারী নির্যাতকে পরিণত হয়েছে? টেন্ডারবাজে পরিণত হয়েছে? আমরা কি ধরে নেব ১৯৯৬ সালের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের শতসংখ্যা উদযাপনকারী এক মানিকই ২০০৮ সালের পর ফিরে এসেছে শত শত মানিক হয়ে? ইতালিতে পালিয়ে গেলেও মানিক তার শত শত উত্তরাধিকার রেখে গেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগে? মানিকের সেইসব প্রেতাত্মারা এখন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে ফেরা নিষ্পাপ স্বপ্নমাখা তরুণীকে পর্যন্ত উত্যক্ত করছে, রাস্তায় পেটাতে পেটাতে শুইয়ে ফেলছে?
আমরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতে চাই, আওয়ামী লীগ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সব সদস্যই এরকম নয়। কিন্তু আমাদের বিশ্বাসে কী আসে যায়, যখন চোখের সামনে এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকে এবং সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত দিশেহারা আচরণ করে, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে এবং এমন কোনও পদক্ষেপ নিতে পারে ব্যর্থ হয়, যা জনমনে একটু হলেও স্বস্তির জন্ম দিতে পারে। আদর্শের নামে কত সংগঠন খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়, কিন্তু পঙ্কিল আদর্শহীনতা একটি সংগঠনকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেও সংগঠনটিতে এমন কাউকে খুজেঁ পাওয়া যায় না, যে বলে উঠবে – এসো, আমরা এদের হাত ভেঙে দেই। কীটনাশক পান করে সপ্তাহ কয়েক আগে প্রাণ দিতে হয়েছে ইলোরাকে বখাটেদের হাত থেকে বাঁচতে- সেই ঘটনার সঙ্গে নিশ্চয়ই তফাৎ রয়েছে এইসব ঘটনার, যেমন তফাৎ রয়েছে সেইসব বখাটেদের সঙ্গে এইসব বখাটেদের। এক ধরণের ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছে বিচ্ছিন্ন সামাজিক ক্ষতদুষ্ট বখাটেরা, আরেক ধরণের ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছে এমন একটি সংগঠনের নেতা অথবা কর্মীরা, যাদের দিকে সাধারণ মানুষ ও ছাত্রছাত্রীরা তাকিয়ে থাকে প্রত্যাশা নিয়ে। সংগঠন মানুষ কেন করে? সংগঠনের নেতা-কর্মী কিংবা সদস্য না হওয়ার পরও কেন মানুষ সংগঠনকে মর্যাদা দেয়? তা তো এ কারণেই যে, সংগঠন হলো সমাজের সেই সব মানুষের সমাবেশকেন্দ্র, যারা আর দশজন মানুষের তুলনায় অগ্রগামী চিন্তার অধিকারী, যারা অগ্রগামী চিন্তা করতে চায়। কোনও নির্দিষ্ট আদর্শে সমবেত মানুষের কাছে থেকে সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে এমন বুদ্ধিমত্তা ও আচরণের প্রকাশ, যা তাদের কাছে সব সময় গ্রহণযোগ্য না হলেও দৃষ্টান্তস্বরূপ।
আওয়ামী লীগের গা-লাগোয়া বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যে তাদের ঐতিহ্য হারাচ্ছে সেটি মানুষ বুঝতে শুরু করেছিল সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের সময় থেকেই। আন্দোলন গড়ে তোলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল এ ছাত্রলীগ – অভ্যুত্থানের পর থেকেই বিভিন্ন ছাত্রনেতাদের নামে শোনা যাচ্ছিল চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির বদনাম। এরশাদের সহযোগী সব আমলা-বিত্তবান-ব্যবসায়ী-রাজনীতিক মানুষগুলিকে গণরোষের হাত থেকে রক্ষার নামে এক শ্রেণির ছাত্রনেতা তখন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান, কেউ কেউ নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যান এবং বিভিন্ন ব্যবসাপাতিও শুরু করেন। ঘুণ ধরে এস্টাবলিশমেন্টবিরোধী ছাত্ররাজনীতিতেও। খালেদা জিয়া সরকারের প্রথম পর্বে আওয়ামী লীগ যে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামে, তাতে ছাত্রলীগ তেমন কোনও ভূমিকাই রাখতে পারেনি, বরং এক সরকারি কর্মকর্তার বস্ত্র হরণ করে আন্দোলন সম্পর্কেই বিরুপ ধারণা তৈরি করেছিল জনমনে। ১৯৯৫-এর সরকারবিরোধী আন্দোলন পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বুঝতে পারেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিধি ও শক্তি এখন এতটাই প্রসারিত হয়েছে যে, ভবিষ্যতে এ ধরণের সরকার পতনের আন্দোলনে ছাত্র সংগঠনগুলি আর গুরুত্ব বহন করবে না।
কিন্তু তারপরও ছাত্রলীগকে আওয়ামী লীগ বহন করে চলেছে। মাঝেমধ্যে অবশ্য খবর পাওয়া যায় যে, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা ছাত্রলীগের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে – কিন্তু পরক্ষণেই ছাত্রলীগ কর্মীদের নিত্য নতুন সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি ও অনিয়ম ইত্যাদির খবর এসে আমাদের জানিয়ে যায় যে, ওইসব ক্ষোভ কথার কথা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে-ছাত্রলীগ কর্ম এক ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করেছিল, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন-চিরদিনের জন্যে বহিষ্কার করেছেন তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (ধন্যবাদ রাবির কর্তৃপক্ষকে)। কিন্তু এ ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই এক প্রাধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগ কর্মীরা বুঝিয়ে দিয়েছে আমাদের, ওরকম শাস্তিতে তাদের কিছু আসে যায় না। ওই প্রভোস্টের দোষ, ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে পরিচয় দেয়ার পরও প্রাধ্যক্ষ তাকে নেতা হিসেবে নয়, ছাত্র হিসেবে ধর্তব্যে নিয়েছিলেন।

ছাত্রলীগের এইসব অপকর্ম আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে জামায়াতে ইসলামী দলভুক্ত বিভিন্ন বক্তার ওই অভিযোগের পর- ‘ছাত্রলীগের এইসব অপকর্ম আপনাদের চোখে পড়ে না? খালি খালি একাত্তরের নারী ধর্ষণ আপনাদের চোখে পড়ে?’
অবশ্যই ছাত্রলীগের এইসব অপকর্ম আমাদের ও সাংবাদিকদের চোখে পড়ে- চোখে পড়ে বলেই সংবাদপত্রের পাতায় সেসবের রিপোর্ট ছাপা হয় এবং তাই মানুষও জানতে পারে। নইলে যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষক সংবাদপত্রগুলির সার্কুলেশন কী আর এমন যে, সর্বস্তরের মানুষ এসব ঘটনা জানতে পারবে?
আর নিশ্চয়ই, অবশ্যই আমরা চাই এইসব ছাত্রলীগ কর্মী ও নেতাদের শাস্তি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। যদি এরকম নেতাকর্মীরাই সংগঠনের ধারক ও বাহক হয়, তা হলে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা হলেও আমাদের কোনও আক্ষেপ থাকবে না। আমাদের মনে হয়, এ ব্যাপারে সবারই স্পষ্টভাবে মুখ খোলার সময় এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, ছাত্রলীগের কারণে সরকারের সব সাফল্য নষ্ট হতে দেয়া যাবে না। আর আমরা বলি, এ কথার বাস্তব প্রতিফলন ঘটুক।
কিন্তু যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সমর্থকদের বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে যে-প্রশ্নটি না করলেই নয়, সেটি হলো : ছাত্রলীগ কি সাংগঠনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই এসব অপকর্ম করে চলেছে? ছাত্রলীগের নিচ থেকে শুরু করে ওপর পর্যন্ত বিস্তৃত বিভিন্ন দুষ্টচক্র এতে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকলেও নিশ্চয়ই ছাত্রলীগকে ওরকমভাবে অভিযুক্ত করা যাবে না। এরকম ন্যাক্কারজনক ঘটনা ছাত্র শিবির ও জামায়াতের নেতাকর্মীরাও মাঝেমধ্যেই ঘটাচ্ছেন। এই কয়েকদিন আগেও আমরা পত্রিকায় খবর পড়েছি, স্কুলছাত্রীকে অপহরণ করতে গিয়ে ইসলামী ছাত্র শিবিরের ক্যাডার হাটহাজারীর রাশেদ গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে।
কিন্তু একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ, মুসলিম লীগ ইত্যাদি দলগুলি যে রাজনৈতিক হত্যা ও ধর্ষণযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা ছিল তাদের দলীয় সম্মিলিত ও আদর্শিক সিদ্ধান্তের ফসল, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফসল। ‘মালে গণিমত’-এ পরিণত হয়েছিল পূর্ব বাংলার নারীরা তাদের কাছে, পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে। কোন দুঃসাহসে সেই সব ঘটনার সঙ্গে এসব অপকর্ম মেলাতে চান যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সঙ্গীচ্যালারা? কোন দুঃসাহসে একই পাল্লায় তুলে ওজন করতে চান ১৯৭১ সালের ভয়াবহ ধর্ষণযজ্ঞসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে এ সময়ের এইসব অপরাধকে? তারা কি সরকারের কাছে এই বার্তা পৌঁছাতে চান যে, আমরা যা করেছি, তোমরাও তাই করেছো- তুমিও যা, আমিও তাই, এসো আমরা একজন আরেকজনের পিঠ চুলকাই?
এই আবদার হালে পানি পাবে না। আওয়ামী লীগ সরকার এই আবদার মেনে নিলে ভবিষ্যতে তাদেরও প্রত্যাখ্যান করবে বাংলাদেশের মানুষ।
এর মধ্যেই সংবাদপত্রে খবর এসেছে, দীর্ঘদিন পর আবারও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের অন্যতম গোলাম আযম। তার সভাপতিত্বে বৈঠক হয়েছে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের, যেখানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির প্রতিনিধি ব্যারিস্টার মওদুদ। বিএনপি যে বাংলাদেশের জনমতের বিরুদ্ধে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে, তার আর একটি উদাহরণ এ ঘটনা। উদাহরণ আরও আছে- গত ডিসেম্বরে দলের কাউন্সিলে বিএনপির গঠনতন্ত্র থেকে বাদ দেয়া হয়েছে একটি বিধান- যে বিধান অনুযায়ী কোনও যুদ্ধাপরাধী বিএনপির সদস্য হতে পারতেন না। এই পরিবর্তনের সহজ মানে, বিএনপির দুয়ার যুদ্ধাপরাধীদের জন্যে খুলে দেয়া হয়েছে। এর আরও একটি উদাহরণ, বিএনপি এতদিন ট্রাইব্যুনালের বিরোধিতা না করলেও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনাল গঠনের সঙ্গে সঙ্গে তার বিরোধিতা করে দলের পক্ষ থেকে ঘোষণা দিয়েছে যে- যুদ্ধাপরাধী বিচরের জন্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের কোনও প্রয়োজন নেই। বিএনপির পক্ষ থেকে গত দুই এপ্রিল এমনকি সংবাদ সম্মেলনেও বলা হয়েছে যে- দেশে এখন আর কোনও যুদ্ধাপরাধী নেই। ওদিকে আবার গয়েশ্বর রায় হয়তো শেষবারের মতো জ্বলে উঠেছেন, ‘যারা জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক মানবে না, তারাই যুদ্ধাপরাধী।’

অবশ্য যুদ্ধাপরাধীরা যে-তত্ত্বের ভিত্তিতে যুদ্ধাপরাধ করেছে, সে-তত্ত্ব অনুযায়ী সত্যিই তারা যুদ্ধাপরাধী নয়! ইসলামী ফাউন্ডেশান থেকে প্রকাশিত ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে এই মুক্তাঙ্গন ব্লগেই হাসান মাহমুদ তাঁর ‘নিজামী, যুদ্ধাপরাধ ও প্রয়োজনমাফিক শরিয়া আইন’ নিবন্ধের মারফত পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন নিজামীদের অপব্যাখ্যায় আকীর্ণ শরিয়া আইন অনুযায়ী আসলেই তারা ‘একাত্তরে কোনও ভুল করেনি’ ‘কোনও যুদ্ধাপরাধ করেনি।’ তিন খণ্ডের ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ বইটি কারও কল্পিত লেখা নই, সেটি লিখিত হয়েছে ছয়জন ধর্মাভিজ্ঞ ব্যক্তির দ্বারা, আর সেটি সম্পাদনা করেছেন জামায়াতপন্থীদের তত্ত্বগুরু আবদুল হান্না। হাসান মাহমুদ জানাচ্ছেন, বইটির প্রথম খণ্ডের ২১৮ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে :”হিরাবা’র অপরাধ ব্যতীয়ত অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধী তওবা করিলেও শাস্তি হইতে রেহাই পাইবে না।” এরপর ২২২ পৃষ্ঠায় আবারও জানানো হয়েছে :”হিরাবা’র অপরাধে শাস্তি ব্যতীত তওবা অন্য কোনও শাস্তি বাতিল করে না।”
এবার আসুন, বোঝা যাক, হিরাব কী? ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ বইটিতেই আবদুল হান্নানের তত্ত্বাবধানে ছয় ধর্মাভিজ্ঞ ব্যক্তি এর ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। ”হিরাবাহ বলিতে সংঘবদ্ধ শক্তির জোরে আক্রমণ চালাইয়া আইনশৃঙ্ক্ষলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাইয়া জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করা বোঝায়। সম্পদ লুণ্ঠন, শ্লীনতাহানী, হত্যা ও রক্তপাত ইহাতে অন্তর্ভুক্ত।”
১৯৭১-এ জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সমমনা দলগুলি যা করেছে, তা ওই কথিত ব্যাখ্যার ভিত্তিতেই করেছে। ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে তারা তাদের হত্যা, ধর্ষণ, রক্তপাত ও সম্পদ লুণ্ঠনকে জায়েজ করেছে। এখন, যারা এ লেখা পড়ছেন, তারাই বলুন, ১৯৭১-এর পরিকল্পিত সেই ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ আর এখনকার এসব ধর্ষণ, হত্যা, চাঁদাবাজি কি সমান দৃষ্টিতে বিচার করার বিষয়? তারা তাদের ওইসব কর্মকাণ্ডকে অপরাধ মনে করছে না, মনে করে না, কেননা তাদের ব্যাখ্যায় সেগুলি ”হিরাবাহ”- এবং তাই মনে মনে ‘তওবা’ করেই তারা মাফ পেয়ে গেছে। এবং এখন জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিএনপিকেও কি না আমরা বলতে শুনছি, দেশে কোনও যুদ্ধাপরাধী নেই, জিয়াকে যারা ঘোষক বলে মানে না তারাই নাকি যুদ্ধাপরাধী।

যারা জেনেশুনেই মিথ্যা বলে, পৃথিবীর সমস্ত কালি ও কাগজ খরচ করেও কি তাদের বোঝানো যাবে যে, যুদ্ধাপরাধীরা কত বড় অপরাধ করেছে আর তাদের অপরাধকে চোখকান বুজে অস্বীকার করাটাও কত বড় অপরাধে শামিল? বলুন, বোঝানো যাবে?

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

8 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
8
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.