পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে (আমি যদ্দুর জানি) আসামীদের সবাই রাজনৈতিকভাবে মৃত ছিলেন। নাৎসীরা থেকে শুরু করে বর্তমানে বিচারাধীন রোদোভান কারাচদিচ, এরা সকলেই বিচারাধীন সময়ে রাজনৈতিক ভাবে দুর্বল বা মৃত ছিলেন। অল্প কিছু শুভানুধ্যায়ী ছাড়া এদের পক্ষে কেউ ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আসামীরাও রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। সম্ভবত এই প্রথমবারের মত কোন সক্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতারা (প্রকৃতপক্ষে সব শীর্ষ নেতারাই) যুদ্ধাপরাধের মত গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আদালতে যাচ্ছেন। সে হিসাবে এটা সরকারের একটা সাহসী পদক্ষেপ।
জামাতের জনসমর্থন সেভাবে কোন কালেও ছিল না, একাত্তরপূর্ব বাংলাদেশেও না, আজকের বাংলাদেশও না। কিন্তু একদল সক্রিয় কর্মীর সুবাদে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা চিরকাল pivotal অবস্থানে থেকেছে। ১৯৯৩ সালে শেখ হাসিনা নিজামীকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ‘তাদের ডানে রাজাকার, বামে স্বৈরাচার, সামনে অন্ধকার” এই কাব্যিক উক্তিটি করলেন। খালেদা জিয়া সেই রাজাকারকেই ২০০১ সালে মন্ত্রী করলেন। সেই সময়ে বিএনপির এক মন্ত্রী ‘আমরা জামাতকে স্মৃতিসৌধে নিতে পেরেছি’ এই জাতীয় একটা হাস্যকর উক্তি করেছিলেন বলে মনে পড়ে। এই দুঃখজনক ব্যাপারগুলোর মাঝেও একটা আশার ব্যাপার হচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি দু’দলই রাজাকার ফ্যাক্টরটি ব্যবহার করেছে। জামাত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে গেলেই তারা রাজাকার ফ্যাক্টরটি ব্যবহার করেছে। এমনকি সামরিক বাহিনীর অফিসাররাও রাজাকার ফ্যাক্টরটি ব্যবহার করেছেন। বিএনপি ‘৯১ এ রাজাকার আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত করেছিল। ‘৯৬ এ জেনারেল নাসিমের পদ্যচ্যুতির ক্ষুদ্র নাটিকাটি যখন ঘটে, তখন তাঁর পক্ষের অফিসারদের রেকর্ডকৃত কথোপকথনে রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে ‘রাজাকার বিশ্বাস’ নামে অভিহিত করা হয়েছে শোনা যায়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলিয়া কিছুই নাই’ এই জাতীয় কিছু আপ্তবাক্য ব্যবহার করে সকল রাজনৈতিক দলই জামাতকে ব্যবহার করেছে (এবং ব্যবহৃত হয়েছে), আবার বাংলাদেশের মানুষের মনে জামাতীদের ব্যাপারে যে তীব্র ঘৃণা আছে সে আবেগটিরও ব্যবহার করেছে। ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়ে গেলে জামাত শেষ, জামাত শেষ মানে বিএনপি শেষ, আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র শাসন, ফিরে আসবে ‘৭২-‘৭৫-এর দুঃশাসন’ এই জাতীয় কিছু অতি সরলীকৃত রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আছে। ‘৭২-‘৭৫-এর আমল ভালো না খারাপ এটা নিয়ে শুধু অর্থহীন বিতর্কই করা চলে, সেই আমল কখনোই ফিরে আসবে না, ইতিহাস কখনোই পিছনের দিকে যায় না। ২০০১ সালে বঙ্গবন্ধুর নামে আকাশ বাতাস নদী ও সাগরের নামকরণ করেও আওয়ামী লীগ গোত্তা খেয়েছিল। ২০০৯ সালের খালের ধারের জিয়াউর রহমানও বিএনপিকে রক্ষা করতে পারেননি। আবার অন্যদিকে আশঙ্কা হচ্ছে জামাতের বিদেশে অনেক ‘বন্ধু’ আছে, বাংলাদেশের মানবধিকার লংঘন হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে রাজনৈতিক হয়রানি হচ্ছে, এই জাতীয় কিছু কথাবার্তা জামাতীরা লন্ডনে আর ওয়াশিংটনে বলছে। এই শুনে হিলারী ভাবি (গ্রামীণ ব্যাঙ্কের মহিলারা যেমন বলেন) শেখ হাসিনাকে ফোন করে ধমক দিয়ে বিচার থামিয়ে দিতে পারেন। জামাতের আল-কায়েদা কানেকশনও নিশ্চয় আছে, আল-কায়েদা তাদের এই মুসিবত থেকে রক্ষার জন্য শেখ হাসিনাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করতে পারে।
আশা করি এই আশঙ্কাগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হবে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের সময়ও আশঙ্কা ছিল হত্যাকারীদের ফাঁসি হয়ে গেলে তাদের ছেলেমেয়েরা বিএনপি ক্ষমতায় আসলে টিভিতে কান্নাকাটি করে আওয়ামী লীগের ইমেজের বারোটা বাজিয়ে ফেলবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফাঁসি হয়ে গেছে, বাংলাদেশের গোটা দশেক টিভি চ্যানেলে প্রতিদিন এত সংখ্যক কান্নাকাটি আর হাসাহাসি হয় যে কান্নাকাটির গুরুত্বটাই কমে গেছে। বিএনপিও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ইমেজ নিয়ে খুব চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে না।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারটি যদি হয়েই যায়, তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারোত্তর বাংলাদেশের চেহারা কেমন হবে। সে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ থাকবে, বি এন পিও থাকবে, আমরা অনেকে ব্যক্তিগতভাবে না চাইলেও জামাতও সম্ভবত থাকবে। যানজট, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি এইসব থেকেই যাবে। তবে বাংলাদেশের মানুষ ঢাকা আর চট্টগ্রামের ভয়ংকর দুষিত বাতাসেও বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবেন। যেমন নিয়েছিলেন ১৯৭১ এর ১৭ই ডিসেম্বরে, এক সাগর রক্তের মাঝে দাঁড়িয়েও।
মোহাম্মদ মুনিম
পেশায় প্রকৌশলী, মাঝে মাঝে নির্মাণ ব্লগে বা ফেসবুকে লেখার অভ্যাস আছে, কেউ পড়েটড়ে না, তারপরও লিখতে ভাল লাগে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৪ comments
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ৩০ মার্চ ২০১০ (৬:৪৯ অপরাহ্ণ)
মোহাম্মদ মুনিমের পোস্ট ক্রমশ আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে। তার পোস্ট ভালো লাগার প্রধান কারণ, তিনি যা বলেন, নিজের ধ্যান থেকে বলেন, সামনে-পিছনে-ডানে-বায়ে-পাতালে-জমিনে খেয়াল না রেখেই বলেন। তিনি তার মতো করেই সত্যকে লালন করছেন। এধরনের লেখালেখির বড়ো পাওয়া হচ্ছে, ক্রমশ একা হয়ে যেতে হয়। যারা একেবারে নিঃশ্বাসের কাছাকাছি থাকে, তারাও ক্রমশ দূরে চলে যেতে থাকে। তবে আমার মনে হয়, ব্যক্তি-সত্যই অনেক বড়ো ব্যাপার। তিনি তা-ই অর্জনের সাধনায় আছেন। তাকে আমার ভালোবাসা।
নিরাভরণ - ৩০ মার্চ ২০১০ (৮:০০ অপরাহ্ণ)
আপনার এই মন্তব্যটি ভাল লাগল। সামষ্টিক গড়পরতার মধ্যে ব্যক্তি হারিয়ে না যাক। ভিন্নমতকে যুক্তি দিয়ে মোকাবেলা করা হোক, গোত্তা দিয়ে জর্জরিত করা না হোক।
সিসিপাস - ৩ এপ্রিল ২০১০ (৮:৫৫ পূর্বাহ্ণ)
সুন্দর লিখেছেন। বিচারটা হওয়া উচিত এবং তা যত দ্রুত সম্ভব।
নওশের - ১৭ এপ্রিল ২০১০ (১০:০৩ অপরাহ্ণ)
বেশ গোছানো লেখা। বিচার হওয়া জরুরী। তবে মৃত্যুদন্ডে বিশ্বাসী নই ।