দীর্ঘায়ুর সেই দুর্দৈবের ক্রমিক পুনরাবৃত্তি — কনিষ্ঠজন ও বন্ধুদের মৃত্যুশোক ভোগ। তারা ঝরে যায় গাছের পাতার মতো, ফুলের মতো নিঃশব্দে, প্রায়শ কোনো সংকেত ছাড়াই। গাছে আবার পাতা গজায়, ফুল ফোটে, কিন্তু মৃতেরা আর ফেরে না কোনো দিন। আনোয়ার চলে গেল ‘ফাল্গুনের অঙ্গন শূন্য করি’ ৩ মার্চ (২০১৪) বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায়। অথচ আমরা তার ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। [...]

দীর্ঘায়ুর সেই দুর্দৈবের ক্রমিক পুনরাবৃত্তি — কনিষ্ঠজন ও বন্ধুদের মৃত্যুশোক ভোগ। তারা ঝরে যায় গাছের পাতার মতো, ফুলের মতো নিঃশব্দে, প্রায়শ কোনো সংকেত ছাড়াই। গাছে আবার পাতা গজায়, ফুল ফোটে, কিন্তু মৃতেরা আর ফেরে না কোনো দিন। আনোয়ার চলে গেল ‘ফাল্গুনের অঙ্গন শূন্য করি’ ৩ মার্চ (২০১৪) বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায়। অথচ আমরা তার ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। ভাবি, আনন্দহীন এই শূন্য ভুবনে এখন আমার দিন কাটবে কীভাবে! আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী ছিলাম, থাকতাম ঢাকা হলে (১৯৫৬-৫৮)। করিডর দিয়ে তাকে হেঁটে যেতে দেখতাম, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গম্ভীর মুখ, কোনো কথা হতো না। আমার বন্ধুরা তাকে আড়ালে ‘মনীষী’ বলত; উপাধিটি সে জুটিয়েছিল কলকাতার এক বামপন্থী মাসিকপত্রে দর্শনবিষয়ক একটি প্রবন্ধ লেখার সুবাদে। ছাত্র ইউনিয়নের সভা-সমিতিতে তাকে কোনো দিন দেখিনি, বরং সে আমাদের এড়িয়েই চলত। তাই বরিশালের বিএম কলেজে তাকে দেখে এবং স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতা অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের জন্যই সে বরিশাল এসেছে শুনে অবাকই হয়েছি। যা হোক বরিশালেই তার সঙ্গে আলাপ ও বন্ধুত্ব! ওখানে সে বেশিদিন থাকেনি, চলে যায় ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজে, সম্ভবত ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের অসুবিধায়। কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক বছরের বৃত্তি নিয়ে সে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমায় এবং রিডিং ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা শুরু করে। ভেবেছি অন্যদের মতো সেও পিএইচডি ডিগ্রি না নিয়ে ফিরবে না। কিন্তু বৃথা। এক বছরের মাথায় সে ফিরে এল। খবর শুনে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় দেখা করতে গেলাম এবং ফিরে আসার কারণ শুনলাম। বলল, ও দেশে লেখকদের খুব সমাদর, তাই একটি বই লিখে আবার ফিরবে। সে বই আর কোনো দিন লেখা হয়নি, বিদেশে শিক্ষালাভও নয়। কিছুদিন কবি ইয়েটস ছিলেন তার প্রধান আলোচ্য, যেন তাঁকে নিয়েই বইটি লিখবে। একসময় স্থলবর্তী হলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে নিয়ে যা-কিছু লিখেছিল তার প্রায় সবই পড়ে আছে দুষ্পাঠ্য পাণ্ডুলিপির খসড়ায়। আমি ১৯৬২ সালে বরিশাল ছেড়ে নটের ডেম কলেজে চলে আসি, আনোয়ার তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকতাম তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ায়। ঢাকা এলে বাড়িতে ব্যাগ ফেলে সে ছুটে আসত এখানে, তারপর আমাকে টেনে নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী ফেরা। আমিও থেকে যেতাম কয়েক দিন। সেসব দিনে আমরা প্রায় প্রতিদিন রমনা পার্কে কিছুক্ষণ কাটিয়ে এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে পৌঁছতাম নিউমার্কেটে, ঢুঁ মারতাম বইয়ের দোকানগুলোতে। শেষে নীলক্ষেত ও মতিঝিল হয়ে…

পৃথিবীতে শনাক্তকৃত জীব প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। অচেনা-অজানা আছে আরও ৫০ লাখ, হতে পারে ৫ কোটি। ক্রান্তীয় বৃষ্টিবনে আরও ৩ কোটি পতঙ্গ ও ১৫-২০ হাজার নলবাহী (ভ্যাসকুলার) উদ্ভিদ প্রজাতি থাকা সম্ভব। [...]

পৃথিবীতে শনাক্তকৃত জীব প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। অচেনা-অজানা আছে আরও ৫০ লাখ, হতে পারে ৫ কোটি। ক্রান্তীয় বৃষ্টিবনে আরও ৩ কোটি পতঙ্গ ও ১৫-২০ হাজার নলবাহী (ভ্যাসকুলার) উদ্ভিদ প্রজাতি থাকা সম্ভব। ছত্রাক ও মাকড়সার অনেক প্রজাতি শনাক্তকরণ এখনও বাকি। বিগত ৫ বছরে আমাজান বনাঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে ৩০০ নতুন প্রজাতির মাছ এবং ৪ প্রজাতির নতুন বানর জাতীয় প্রাণী। সবকিছু শনাক্ত করতে প্রয়োজন ২৫ হাজার বিজ্ঞানীর বহু বছরের শ্রম আর তাতেও জানা যাবে না ওইসব জীবের জীবনচক্র ও বাস্তু পরিবেশ। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত জ্ঞাত উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা যথাক্রমে ৬৬৩৪ ও ৫৩৫১। সীমিত আয়তনের এ ভূখণ্ডে বিগত কয়েক বছরে পাওয়া গেছে সপুষ্পক উদ্ভিদের ১২টি নতুন প্রজাতি। এখানকার নলবাহী উদ্ভিদের ১০৬ ও প্রাণীর ১৩৭ প্রজাতি নানা পর্যায়ে বিপন্ন, বিলুপ্ত হয়ে গেছে মেরুদণ্ডী প্রাণীর ১৩ প্রজাতি। বাংলাদেশের নিজস্ব বা একান্ত সপুষ্পক উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা ৬। এ হিসাব থেকে বাদ গেছে অণুজীব, ছত্রাক, শৈবাল এবং নিম্নবর্গীয় উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতিগুলো। বলা বাহুল্য, খতিয়ান ক্রমেই দীর্ঘতর হবে এবং বিলুপ্ত, বিপন্ন ও নতুন প্রজাতির সংখ্যা বাড়বে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রজাতির বিপন্নতা ও বিলুপ্তির কারণ প্রাকৃতিক নয়, মানুষী কর্মকাণ্ডের ফল। তবে আশার কথা, হিসাবটি নির্বিশেষ নয়। জীব প্রজাতির ভূগোল রাজনৈতিক ভূগোল থেকে পৃথক। বাংলাদেশের জীবকুল ইন্দো-মালয়ীয় জীবাঞ্চলের অন্তর্গত, এখানে না থাকলেও আশপাশের দেশে কোনো কোনোটি টিকে থাকা সম্ভব। সমস্যাটি কোনো একক দেশের নয়, গোটা বিশ্বের। জীববৈচিত্র্য একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিপর্যস্ত হলে জীববৈচিত্র্যেরও অবক্ষয় ঘটে। জীবজগৎ বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে বসবাস করে। প্রাকৃতিক নিয়মে এ বাস্তুতন্ত্রে পরিবর্তন ঘটলে বিবর্তনক্রিয়া সক্রিয় হয়ে ওঠে, ধ্বংস ও সৃষ্টির মধ্যে জীবকুলের পুনর্জনন ঘটে, উৎপন্ন হয় নতুন নতুন প্রজাতি। অক্সিজেনহীন পৃথিবীতে এক সময় অবায়ুজীবী জীবকুলের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছিল, বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন আসার পর এসব জীবের গণবিলুপ্তি ঘটে, কিন্তু উৎপন্ন হয় বায়ুজীবী জীবকুল এবং আজকের সব উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি। এটাই বিবর্তন। কিন্তু মানুষ বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন ঘটালে প্রকৃতি পশ্চাদপসরণ করে, প্রহত হয় বিবর্তনক্রিয়া, লোপ পায় জীববৈচিত্র্য। প্রকৃতি ও মানুষের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মধ্যে গুণগত পার্থক্য দুস্তর। মানুষ যখন থেকে জেনেছে, সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জীব, গোটা প্রকৃতি তার ভোগ্যবস্তু তখন থেকেই প্রকৃতির ওপর মানুষের অমিত…

অনেক বছর আগের কথা। কলকাতার সিটি কলেজে পড়ার সময় থাকতাম ব্যারাকপুর, ফিরতে প্রায়ই সন্ধে হয়ে যেত। দেখতাম, স্টেশনের লাগোয়া বস্তির শ্রমিকেরা ধুনি জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে পোহাতে গলা ছেড়ে গাইছেন ‘আয়েগা মার্কস বাবাকো জমানা’। [...]

অনেক বছর আগের কথা। কলকাতার সিটি কলেজে পড়ার সময় থাকতাম ব্যারাকপুর, ফিরতে প্রায়ই সন্ধে হয়ে যেত। দেখতাম, স্টেশনের লাগোয়া বস্তির শ্রমিকেরা ধুনি জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে পোহাতে গলা ছেড়ে গাইছেন ‘আয়েগা মার্কস বাবাকো জমানা’। সবে মার্ক্সবাদে দীক্ষা নিয়েছি। বসে পড়তাম তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা জানেন না, মার্ক্স কোথাকার মানুষ, কী কী বই লিখেছেন তিনি। তবে ভালোই জানেন, মার্ক্স বাবার জমানায় গরিবের রাজত্ব কায়েম হবে, ধনীর ঠাঁই হবে না সেখানে, আর সেই রাজত্ব শুরু হয়ে গেছে রাশিয়ায়, হবে এখানেও। স্বপ্নেও ভাবিনি, আমিও একদিন যাব রাশিয়ায়, থাকব অনেক দিন, দেখব সেই জমানার সুদিন ও করুণ পতন। ১৯৭৪ সালে মস্কোয় অনুবাদকের একটি চাকরি জুটে যায়, থাকি ২০০০ সাল পর্যন্ত। মার্ক্সের কিছু লেখাও অনুবাদ করি এবং বিস্ময়ে ভেবেছি, একজন মানুষের লেখা কীভাবে শত শত বছরের একটা টেকসই সমাজকে টলিয়ে দিতে পারে। ব্যারাকপুরের শ্রমিকদের কথাও মনে পড়ত। হ্যাঁ, মার্ক্সস বাবার জমানা ঠিকই কায়েম হয়েছে রাশিয়ায়। ধনিক শ্রেণী নেই, উচ্চপদাসীন ও হাতুড়িপেটা মজুর নির্বিশেষে সবারই সাজপোশাক, বাড়িঘর, চলাচল অভিন্ন। বরং বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় শ্রমিকদের উপার্জন কিছুটা বেশি এবং অন্যান্য কিছু বিষয়ে তাঁরা অধিক সুবিধাভোগী। পরে অবশ্য বুঝেছি, এ ব্যবস্থাও অসংগতিমুক্ত নয়, ধনী না থাকলেও ধনী-হতে-ইচ্ছুক মানুষের সংখ্যা অনেক, আর বিত্ত সঞ্চয়ের আকাঙ্ক্ষা কতটা দুর্মর। রাশিয়ায় ১৯৯১ সালে সমাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটলে লোকে যখন মার্ক্সের রচনাগুলো আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করছিল, তখন একদিন আমার কর্মস্থল প্রগতি প্রকাশনে গিয়ে দেখি, বিগত অর্ধশতক কালে অনূদিত বইপত্র নিয়ে বড় বড় গাঁট বাঁধা চলছে, গন্তব্য কাগজকল। বড়ই হতাশ হই। কয়েক দিন পর আমেরিকা থেকে জনৈক বন্ধুর পাঠানো সেখানকার নামী পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের একটি কাটিং পাই, তাতে ছিল রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের জন্য মার্ক্সকে দোষী সাব্যস্ত করা এবং তাঁর শিক্ষার অবমূল্যায়ন অযৌক্তিক; মার্ক্স একজন মনীষী, তাঁর আবিষ্কারগুলো চিরায়ত মূল্যধর এবং গোটা মানবজাতির সম্পদ। তারপর দুই দশক অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই দেখা দেয় আরেকটি বিশ্বমন্দা এবং সেই সঙ্গে আসন্ন পরিবেশবিপর্যয় নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ। লোকে আবার মার্ক্সকে খুঁজতে শুরু করে, এমনকি পরিবেশবাদীরাও, কেননা তিনি মানুষ কর্তৃক মানুষ শোষণ এবং মানুষ কর্তৃক প্রকৃতি শোষণের সমাধান পেয়েছিলেন কমিউনিজমে। আমি ২০০০ সালে দেশে ফিরি, নানা কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, কিন্তু রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের ভাবনা থেকে…

সত্তর বছর আগের পাঠশালার স্মৃতিচারণা, দীর্ঘবিস্মৃতির আবরণ উন্মোচন, কঠিন হলেও দুঃসাধ্য নয়, কেননা কিছু কিছু কৈশোরস্মৃতি মস্তিষ্কে আমৃত্যু ধৃত থাকে এবং হৃদয়েও। আমাদের গ্রামটি সিলেটের প্রত্যন্ত এলাকায়, পাহাড়ঘেঁষা অন্য দশটি গ্রামের মতোই, আকারে ছোট, টিলাটালা ও গাছগাছালিতে ভরা, ছোট একটি স্রোতস্বিনী, সচ্ছল-অসচ্ছল জনগোষ্ঠী, সমসংখ্যক হিন্দু-মুসলমান, আমার ছেলেবেলার স্বপ্নরাজ্য। [...]

সত্তর বছর আগের পাঠশালার স্মৃতিচারণা, দীর্ঘবিস্মৃতির আবরণ উন্মোচন, কঠিন হলেও দুঃসাধ্য নয়, কেননা কিছু কিছু কৈশোরস্মৃতি মস্তিষ্কে আমৃত্যু ধৃত থাকে এবং হৃদয়েও। আমাদের গ্রামটি সিলেটের প্রত্যন্ত এলাকায়, পাহাড়ঘেঁষা অন্য দশটি গ্রামের মতোই, আকারে ছোট, টিলাটালা ও গাছগাছালিতে ভরা, ছোট একটি স্রোতস্বিনী, সচ্ছল-অসচ্ছল জনগোষ্ঠী, সমসংখ্যক হিন্দু-মুসলমান, আমার ছেলেবেলার স্বপ্নরাজ্য। পূর্ব কিনারে আসাম-বেঙ্গল রেলপথ, একটি স্টেশন ও সামান্য দূরে ঘাটাঘর আর ওখানেই আমাদের পাঠশালা—আবদুল লতিফ সিদ্দিকী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিখ্যাত মৌলানা, হায়দ্রাবাদ রাজ্যের নিজামের সভাসদ, তাঁর মুরিদবর্গ ছিল সারা ভারতে। প্রথম পাঠশালা-যাত্রা, মনে আছে, ইনাই চাচার কোলে চড়ে। তিনি ছিলেন আমাদের সংসারেরই একজন। ছোটদের অভিভাবকের মতো, আমাদের সম্ভব-অসম্ভব আবদার মেটাতে কসুর করতেন না। মোটাসোটা গড়ন, হাতে লাঠি ইনাই চাচাকে গ্রামের লোকজন কেন জানি সমীহ করত, এমনকি পাঠশালার মাস্টারমশাইও। মাঝেমধ্যে স্কুলেও হানা দিতেন এবং মাস্টারমশাইকে শাসাতেন যেন আমাকে বকাঝকা না করেন। কিশোরকালের স্মৃতিভুবনে তিনি আছেন অনেকটা জায়গাজুড়ে, তাঁকে নিয়ে বড় একটা গল্প লেখাও যায়। স্কুল বলতে একটিই টিনের ঘর, লম্বা বারান্দা, সামনে রাস্তা, তারপর একসার আমগাছ, পেছনে উঠোন, এক পাশে একটি কাঁঠালগাছ, অন্য পাশে নাগেশ্বর, শেষ মাথায় বাঁশ ও গাছগাছালির জঙ্গল। পুরো ঘরে একটিই শ্রেণীকক্ষ, প্রধান শিক্ষক নীরদচন্দ্র শর্মা, সর্বদাই অগ্নিশর্মা, সহকারী আছদ্দর আলী একেবারেই উল্টো, সর্বদাই স্নেহসিক্ত। ‘বেত নেই তো ছেলে নষ্ট’—আদর্শনির্ভর সেকালের পাঠশালাগুলো ছিল কিশোরদের জন্য আনন্দহীন অকুস্থল। স্কুলে যেতাম শেক্সপিয়রের মতো ‘শম্বুকগতিতে পা দুটি টেনে টেনে’ একান্ত অনিচ্ছায়। বেঞ্চিতে বই-শ্লেট রেখেই রেললাইনে ছোটা, উত্তরমুখে একদৃষ্টিতে দাঁড়ানো, মনে দুরাশা—যদি তিনি না আসেন। কিন্তু বৃথা, অনিবার্য ছিল সেই আগমন। ক্ষণিক পরেই চোখে পড়ত পতপত উড়ছে সাদা ধুতির খুঁট, আখেরি নিশান। ছুটে গিয়ে বেঞ্চিতে বসতাম পাথরখণ্ডের মতো। কেন তাঁকে এত ভয় পেতাম? খুব যে মারধর করতেন তাও না। তবে? সেকালে গুরুজনদের ভয় পাওয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল সম্ভবত সে জন্য। তবে এমন শিক্ষক সেকালেও ছিলেন, আজও আছেন, যাঁরা স্বভাবগুণেই নিষ্ঠুর। আজকাল অনেক ছেলেমেয়েরই বাড়ির চেয়ে স্কুলের প্রতি অধিক পক্ষপাত দেখি। আমাদের সময় কিন্তু এমনটি একেবারেই ছিল না। অভিভাবকেরা ছেলেদের শিক্ষকের হাতে সঁপে দিয়ে বলতেন—প্রাণটা আমার, শরীরটা আপনার। এমন বন্দোবস্ত যেখানে, সেখানে কার যেতে ইচ্ছে হবে! তাই স্কুল ফাঁকি দেওয়ার নানা…

জগৎজ্যোতি দাস মুক্তিযুদ্ধের শহীদ। সব শহীদই বীর, বীরশ্রেষ্ঠ। জন্ম হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে। ১৯৭১ সালে বয়স হয়েছিল ২২। [...]

আতোয়াঁ দ্য সা-এক্সুপেরির দ্য লিটল প্রিন্স বইয়ের গল্পে আছে -- ভিন গ্রহের বাসিন্দা ছোট রাজকুমার নিজ গ্রহে চলে যাওয়ার সময় পৃথিবীবাসী বন্ধুকে এই বলে আশ্বস্ত করে গিয়েছিলেন যে, রাতেরবেলায় আকাশের দিকে তাকিয়ে সে যখন রাজকুমারের তারাটি খুঁজবে, তখন তিনি নিজ তারায় বসে হাসবেন। তার মনে হবে যেন, সব তারাই হাসছে। সব দুঃখ তখন সে ভুলে যাবে (সময় সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়)। আর সুখী হবে এই ভেবে যে, সে একদিন রাজকুমারকে ভালোবেসেছিল। রাজকুমার আরও বলেছিলেন, সবারই একটি করে তারা আছে। আমিও তা বিশ্বাস করতে চাই; এবং এই ভেবে সুখী হতে চাই যে, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ আকাশের তারা হয়ে আছেন। তাতে আছেন জগৎজ্যোতিও। জগৎজ্যোতি দাস মুক্তিযুদ্ধের শহীদ। সব শহীদই বীর, বীরশ্রেষ্ঠ। জন্ম হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে। ১৯৭১ সালে বয়স হয়েছিল ২২। তার হয়ে ওঠার বয়ান নিষ্প্রয়োজন। কেননা, মুক্তিযোদ্ধাদের সিংহভাগই দরিদ্রজনের সন্তান। আর জগৎজ্যোতিও এর ব্যতিক্রম নন। সুনামগঞ্জ কলেজে ছাত্র থাকাকালে গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য শিলংয়ে প্রেরিত ১১৪ জনের প্রথম দলটিতে মনোনয়ন পান জগৎজ্যোতি। ৩২ দিনের কোর্স সাফল্যের সঙ্গে সমাপ্ত করেন। শেখেন যুদ্ধ ও অন্তর্ঘাতের নানা কৌশল। প্রশিক্ষণ শেষে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের হেড কোয়ার্টারে এলে ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত একটি দলের নেতৃত্ব তিনি পান, যে দলটি পরে 'দাস-পার্টি' নামে পরিচিত হয়েছিল। সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা এবং নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের কিছু এলাকা ছিল টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীন। এসব এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে সড়কপথে চলাচল বিপজ্জনক হয়ে উঠলে পাকিস্তানিরা জলপথ ব্যবহার শুরু করে। এ পরিস্থিতিতে শত্রুদের জলযান ধ্বংসের দায়িত্ব পায় 'দাস-পার্টি'; এবং কুশিয়ারা নদীতে তারা কার্গো-নৌযানের একটি বহর অ্যামবুশ করে ডুবিয়ে দেয়। জগৎজ্যোতি পানিতে ডোবানো খুঁটিতে বাঁধা দড়িতে মাইন ঝুলিয়ে নৌযান ধ্বংসের একটি নিজস্ব পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন এবং ক্রমাগত গানবোট ও কার্গো-ভেসেল ডোবাতে থাকেন। দাস-পার্টির অসংখ্য সফল অপারেশনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য -- বানিয়াচং থানা দখল, পাহাড়পুরে হানাদার অ্যামবুশ, বদরপুরে ব্রিজ ধ্বংস, জামালগঞ্জ থেকে পাক সৈন্য ও রাজাকার বিতাড়ন এবং গোটা এলাকা মুক্তকরণ, তাহিরপুর আক্রমণ, খালিয়াজুড়ি থানায় হামলা, রানীগঞ্জ ও কাদিরপুর অভিযান, দিরাই ও শালল্গা বিনাযুদ্ধে দখল ইত্যাদি। বিপজ্জনক ও রক্তক্ষয়ী এসব অভিযানে সাফল্য ছিল উদ্ভাবন দক্ষতানির্ভর। এভাবেই জগৎজ্যোতি নিজেকে পুনর্নির্মাণ করেছেন, দক্ষ যোদ্ধা হয়ে উঠেছেন, শত্রুর…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.