আতোয়াঁ দ্য সা-এক্সুপেরির দ্য লিটল প্রিন্স বইয়ের গল্পে আছে — ভিন গ্রহের বাসিন্দা ছোট রাজকুমার নিজ গ্রহে চলে যাওয়ার সময় পৃথিবীবাসী বন্ধুকে এই বলে আশ্বস্ত করে গিয়েছিলেন যে, রাতেরবেলায় আকাশের দিকে তাকিয়ে সে যখন রাজকুমারের তারাটি খুঁজবে, তখন তিনি নিজ তারায় বসে হাসবেন। তার মনে হবে যেন, সব তারাই হাসছে। সব দুঃখ তখন সে ভুলে যাবে (সময় সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়)। আর সুখী হবে এই ভেবে যে, সে একদিন রাজকুমারকে ভালোবেসেছিল। রাজকুমার আরও বলেছিলেন, সবারই একটি করে তারা আছে।
আমিও তা বিশ্বাস করতে চাই; এবং এই ভেবে সুখী হতে চাই যে, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ আকাশের তারা হয়ে আছেন। তাতে আছেন জগৎজ্যোতিও।
জগৎজ্যোতি দাস মুক্তিযুদ্ধের শহীদ। সব শহীদই বীর, বীরশ্রেষ্ঠ। জন্ম হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে। ১৯৭১ সালে বয়স হয়েছিল ২২। তার হয়ে ওঠার বয়ান নিষ্প্রয়োজন। কেননা, মুক্তিযোদ্ধাদের সিংহভাগই দরিদ্রজনের সন্তান। আর জগৎজ্যোতিও এর ব্যতিক্রম নন। সুনামগঞ্জ কলেজে ছাত্র থাকাকালে গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য শিলংয়ে প্রেরিত ১১৪ জনের প্রথম দলটিতে মনোনয়ন পান জগৎজ্যোতি। ৩২ দিনের কোর্স সাফল্যের সঙ্গে সমাপ্ত করেন। শেখেন যুদ্ধ ও অন্তর্ঘাতের নানা কৌশল। প্রশিক্ষণ শেষে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের হেড কোয়ার্টারে এলে ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত একটি দলের নেতৃত্ব তিনি পান, যে দলটি পরে ‘দাস-পার্টি’ নামে পরিচিত হয়েছিল।
সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা এবং নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের কিছু এলাকা ছিল টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীন। এসব এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে সড়কপথে চলাচল বিপজ্জনক হয়ে উঠলে পাকিস্তানিরা জলপথ ব্যবহার শুরু করে। এ পরিস্থিতিতে শত্রুদের জলযান ধ্বংসের দায়িত্ব পায় ‘দাস-পার্টি’; এবং কুশিয়ারা নদীতে তারা কার্গো-নৌযানের একটি বহর অ্যামবুশ করে ডুবিয়ে দেয়। জগৎজ্যোতি পানিতে ডোবানো খুঁটিতে বাঁধা দড়িতে মাইন ঝুলিয়ে নৌযান ধ্বংসের একটি নিজস্ব পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন এবং ক্রমাগত গানবোট ও কার্গো-ভেসেল ডোবাতে থাকেন। দাস-পার্টির অসংখ্য সফল অপারেশনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য — বানিয়াচং থানা দখল, পাহাড়পুরে হানাদার অ্যামবুশ, বদরপুরে ব্রিজ ধ্বংস, জামালগঞ্জ থেকে পাক সৈন্য ও রাজাকার বিতাড়ন এবং গোটা এলাকা মুক্তকরণ, তাহিরপুর আক্রমণ, খালিয়াজুড়ি থানায় হামলা, রানীগঞ্জ ও কাদিরপুর অভিযান, দিরাই ও শালল্গা বিনাযুদ্ধে দখল ইত্যাদি। বিপজ্জনক ও রক্তক্ষয়ী এসব অভিযানে সাফল্য ছিল উদ্ভাবন দক্ষতানির্ভর। এভাবেই জগৎজ্যোতি নিজেকে পুনর্নির্মাণ করেছেন, দক্ষ যোদ্ধা হয়ে উঠেছেন, শত্রুর ত্রাস ও জনগণের বল্পুব্দ হয়ে উঠতে পেরেছেন। অনেক ক্ষেত্রে একরোখা ও বদমেজাজি মনে হবে, সহযোদ্ধাদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করতে দেখা যাবে, কিন্তু যুদ্ধপরিস্থিতিতে এগুলো স্বাভাবিক ঘটনা। যুদ্ধ মাত্রেই হিংস্রতাশ্রয়ী; দয়া-মায়ার অবকাশ সেখানে নেই। তবু জগৎজ্যোতি মানবিকতা সম্পূর্ণ বর্জন করেননি; এবং তার প্রমাণ রেখেছেন শেষ যুদ্ধেও।
১৬ নভেম্বরের শেষ যুদ্ধের বর্ণনা অনেকটা এরূপ :
যুদ্ধ চলতে থাকে। এক পর্যায়ে ১০০ গজের মধ্যে চলে আসে হানাদাররা। হতবিহ্বল হয়ে পড়েন জ্যোতি। সহযোদ্ধা ইলিয়াস তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী করব দাদা?’ ‘তোর যা ইচ্ছা, তা-ই কর’ — জবাব দেন। পরক্ষণেই আবার পেছনের ব্যাকআপ পার্টিকে বাঁচানোর জন্য ইলিয়াসকে সঙ্গে থাকতে বলেন। ৫ জনের কোটায় এসে পৌঁছে দলের সংখ্যা। সাড়ে ৩টার দিকে ইলিয়াসের বাঁ পাঁজরে গুলি লাগে। জ্যোতি তাকে জড়িয়ে ধরেন, নিজের মাথার গামছা খুলে ক্ষতস্থান শক্ত করে বাঁধেন। সেখানে তখন কেবল ইলিয়াস আর জ্যোতি। নিচু স্বরে ইলিয়াস বলেন, ‘চল, আমরা আত্মরক্ষা করি।’ তেজী বীরকণ্ঠে জ্যোতি জবাব দেন, ‘পালাব না, সবটাকে শেষ করে তবেই যাব।’ বিকেল পৌনে ৫টা নাগাদ জ্যোতি গুলিবিদ্ধ হন। সুঠামদেহের প্রাণবন্ত যোদ্ধা শেষবারের মতো চিৎকার করে ওঠেন, ‘আমি যাইগ্যা!’ ইলিয়াস পেছনে ফিরে দেখেন, জ্যোতির তেজময় দেহ পানিতে ডুবে যাচ্ছে। দ্রুত এগিয়ে যান তিনি। বীরের ডুবন্ত দেহকে ইলিয়াস যখন সূর্যাস্তের শেষ রক্তিম আভায় তুলে ধরেন, ততক্ষণে জ্যোতি প্রাণহীন। সহযোদ্ধা কমান্ডারকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে কোমর পানিতে কাদার মধ্যে তার লাশ ডুবিয়ে দেন।
জগৎজ্যোতিকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হয়নি — এ অভিযোগ অনেকের। মানুষের বিচার প্রায়ই ত্রুটিপূর্ণ হলেও ইতিহাসের বিচার সর্বদাই অভ্রান্ত। সন্দেহ নেই, জগৎজ্যোতি জনস্মৃতিতে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবেন। তাকে নিয়ে ইতিমধ্যেই লেখা হয়েছে দুটি বই এবং অনেক প্রবন্ধ। আলোচ্য বইয়ের প্রকাশকের অনবদ্য অনুসন্ধানী বক্তব্যের খানিকটা উদ্ধৃত করে লেখাটা শেষ করতে চাই :
জগৎজ্যোতি দাস এক অনন্য মুক্তিযোদ্ধার নাম। বিস্ময় জাগানিয়া এই তরুণ অসীম সাহসিকতা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে পাক বাহিনীর ত্রাসে পরিণত হয়েছিলেন।… তিনি হয়ে উঠেছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি। ১৬ নভেম্বর ১৯৭১ এক অসম অথচ অসীম সাহসী যুদ্ধে জীবন বিসর্জন দিলেন জগৎজ্যোতি। পরম যত্ন ও নিষ্ঠার সঙ্গে জগৎজ্যোতির সংগ্রামী জীবন ও সাহসিক যুদ্ধাভিযানের সবিস্তার বিবরণ সংগ্রহ করেছেন অপূর্ব শর্মা। দেশের জন্য মেলে ধরে এক অগ্নিসন্তানের বীরগাথা, যে বই নতুন প্রজন্মকে পরিচিত করবে অনন্য এক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে।
(সমকাল-এর সাময়িকী ‘কালের খেয়া’য় ১৮ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে প্রকাশিত।)
উৎসনির্দেশ :
অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি, অপূর্ব শর্মা, সাহিত্য প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৯।
