সোদরপ্রতিম আলী আনোয়ার

দীর্ঘায়ুর সেই দুর্দৈবের ক্রমিক পুনরাবৃত্তি — কনিষ্ঠজন ও বন্ধুদের মৃত্যুশোক ভোগ। তারা ঝরে যায় গাছের পাতার মতো, ফুলের মতো নিঃশব্দে, প্রায়শ কোনো সংকেত ছাড়াই। গাছে আবার পাতা গজায়, ফুল ফোটে, কিন্তু মৃতেরা আর ফেরে না কোনো দিন। আনোয়ার চলে গেল ‘ফাল্গুনের অঙ্গন শূন্য করি’ ৩ মার্চ (২০১৪) বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায়। অথচ আমরা তার ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। [...]

দীর্ঘায়ুর সেই দুর্দৈবের ক্রমিক পুনরাবৃত্তি — কনিষ্ঠজন ও বন্ধুদের মৃত্যুশোক ভোগ। তারা ঝরে যায় গাছের পাতার মতো, ফুলের মতো নিঃশব্দে, প্রায়শ কোনো সংকেত ছাড়াই। গাছে আবার পাতা গজায়, ফুল ফোটে, কিন্তু মৃতেরা আর ফেরে না কোনো দিন।

আনোয়ার চলে গেল ‘ফাল্গুনের অঙ্গন শূন্য করি’ ৩ মার্চ (২০১৪) বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায়। অথচ আমরা তার ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। ভাবি, আনন্দহীন এই শূন্য ভুবনে এখন আমার দিন কাটবে কীভাবে! আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী ছিলাম, থাকতাম ঢাকা হলে (১৯৫৬-৫৮)। করিডর দিয়ে তাকে হেঁটে যেতে দেখতাম, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গম্ভীর মুখ, কোনো কথা হতো না। আমার বন্ধুরা তাকে আড়ালে ‘মনীষী’ বলত; উপাধিটি সে জুটিয়েছিল কলকাতার এক বামপন্থী মাসিকপত্রে দর্শনবিষয়ক একটি প্রবন্ধ লেখার সুবাদে। ছাত্র ইউনিয়নের সভা-সমিতিতে তাকে কোনো দিন দেখিনি, বরং সে আমাদের এড়িয়েই চলত। তাই বরিশালের বিএম কলেজে তাকে দেখে এবং স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতা অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের জন্যই সে বরিশাল এসেছে শুনে অবাকই হয়েছি। যা হোক বরিশালেই তার সঙ্গে আলাপ ও বন্ধুত্ব! ওখানে সে বেশিদিন থাকেনি, চলে যায় ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজে, সম্ভবত ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের অসুবিধায়।

কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক বছরের বৃত্তি নিয়ে সে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমায় এবং রিডিং ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা শুরু করে। ভেবেছি অন্যদের মতো সেও পিএইচডি ডিগ্রি না নিয়ে ফিরবে না। কিন্তু বৃথা। এক বছরের মাথায় সে ফিরে এল। খবর শুনে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় দেখা করতে গেলাম এবং ফিরে আসার কারণ শুনলাম। বলল, ও দেশে লেখকদের খুব সমাদর, তাই একটি বই লিখে আবার ফিরবে। সে বই আর কোনো দিন লেখা হয়নি, বিদেশে শিক্ষালাভও নয়। কিছুদিন কবি ইয়েটস ছিলেন তার প্রধান আলোচ্য, যেন তাঁকে নিয়েই বইটি লিখবে। একসময় স্থলবর্তী হলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে নিয়ে যা-কিছু লিখেছিল তার প্রায় সবই পড়ে আছে দুষ্পাঠ্য পাণ্ডুলিপির খসড়ায়।

আমি ১৯৬২ সালে বরিশাল ছেড়ে নটের ডেম কলেজে চলে আসি, আনোয়ার তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকতাম তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ায়। ঢাকা এলে বাড়িতে ব্যাগ ফেলে সে ছুটে আসত এখানে, তারপর আমাকে টেনে নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী ফেরা। আমিও থেকে যেতাম কয়েক দিন। সেসব দিনে আমরা প্রায় প্রতিদিন রমনা পার্কে কিছুক্ষণ কাটিয়ে এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে পৌঁছতাম নিউমার্কেটে, ঢুঁ মারতাম বইয়ের দোকানগুলোতে। শেষে নীলক্ষেত ও মতিঝিল হয়ে বাড়ি ফেরা, আর সবই পদব্রজে। কোনো কোনো দিন আড্ডা দিতাম বর্তমানে অফিসার্স ক্লাবের সামনের এক পুরোনো কালভার্টের কিনারে বসে। প্রবল হাস্যরোল শোনার মতো কেউ কোথাও নেই। রাত গভীর হতো, তেজগাঁও ফিরতাম শেষ বাস ধরে। একসময় তারই জবরদস্তিতে বাসা বদলে এলাম সিদ্ধেশ্বরীর খোন্দকার মঞ্জিলে। দুপক্ষেরই সুবিধা হলো। কাছেই রমনা পার্ক, সকাল-সন্ধ্যা পার্কের রেস্তোরাঁর আমতলায় চা-পান, হেয়ার রোডের বৃক্ষছায়ায় হাঁটাহাঁটি এবং বাতাসে স্বপ্ন বপন। বলতে গেলে গোটা যৌবনটাই আমরা কাটিয়েছি রমনার শ্যামল ছায়ায় ঘুরে ঘুরে। কী কথা বলতাম আমরা জানেন কেবল স্বয়ং ঈশ্বর। তবে স্বীকার্য, তাতে আমিই লাভবান হয়েছি বেশি, অনেক বেশি। বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের সেতুবন্ধ ঘটানোর কৌশলটি সে ভালোই জানত।

আনোয়ার বিয়ে করল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম অনুষদের অধ্যাপক হোসনে আরা লাবুকে। ভাবলাম এবার হয়তো সটকে পড়বে, ভাঙবে আমাদের মিলনমেলা। অচিরেই এই শঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হলো। লাবু সংসারের হাল ধরার পরিবর্তে জুটে গেলেন আমাদের দলে, স্বামীর চেয়ে এক কদম বাড়া। অসামান্যা এক নারী। তাঁকে বোঝার জন্য একটি ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি তাদের সঙ্গে থাকতাম কলকাতার বেলেঘাটায়। বিস্তর লোকজন আসত। সব ঝক্কি পোহাতে হতো লাবুকে। একদিন খুব সকালে সবার অজান্তে এঁটো বাসনপত্র ধুতে বসেছি কলতলায়। হঠাৎ লাবু ছুটে এসে আমার হাত ধরলেন, বাসন আর আমার ধোয়া হলো না।

ওই সময় গৌরী আইয়ুবসহ কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে আনোয়ারের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। তাঁরা অশেষ ভালোবাসায় তাঁদের সংসারে আমাদের ঠাঁই দিয়েছিলেন। আনোয়ার ও লাবু তাঁদের কোনো দিন ভোলেননি। স্বাধীনতার পরও এই বন্ধন ছিন্ন হয়নি। তাঁরা কেউই আর বেঁচে নেই। দেখলাম আনোয়ার তার সাহিত্য-সংস্কৃতি: নানা ভাবনা বইটি উৎসর্গ করেছে তাঁদেরই স্মৃতির উদ্দেশে।

আমি অনেকবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি। সেখানকার অনেকেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জ্ঞানচর্চার এ এক আদর্শ সংশ্লেষ। সেখানকার অনেকে গবেষণা ও সাহিত্য রচনায় খ্যাতিমান হয়েছেন, কিন্তু আনোয়ার লিখল না প্রায় কিছুই, অথচ তার জ্ঞানগম্যির কোনো ঘাটতি ছিল না, পড়াশোনার পরিসর ছিল ঈর্ষণীয়। সামান্য যা-কিছু লিখেছে প্রায় সবই দৈনিক সংবাদ ও বর্তমান কালি কলম পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাসনাতের অদম্য জবরদস্তিতে। সে কি পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের তুলনায় নিজের অবমূল্যায়ন করত? বোঝা দুষ্কর। অসুস্থ হওয়ার পর দেখলাম হঠাৎ করেই সে লেখালেখিতে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। গোছাতে শুরু করেছে পুরানো লেখাগুলো, ভাবছে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ বই লেখার কথা। কিন্তু তত দিনে খুব দেরি হয়ে গেছে। যা হোক, হাসনাতের অক্লান্ত চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তার প্রবন্ধ-সংকলন সাহিত্য-সংস্কৃতি: নানা ভাবনা (জুলাই, ২০১৩)। পুরোনো ও নতুন লেখা মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ক বইটির একটি পাণ্ডুলিপি মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে আছে। ইয়েটস-সম্পর্কিত স্বপ্নগ্রন্থ লেখা না হলেও লিখেছে ইবসেন ও নেরুদাবিষয়ক দুটি বৃহদায়তন গবেষণাগ্রন্থ। বাংলা একাডেমি তাকে সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত করেছে। তার একটি দুঃখের কথা প্রায়ই বলত, ছাত্রজীবন ও যৌবনে জ্ঞানচর্চার জন্য কোনো যোগ্য ‘গুরু’ খুঁজে পায়নি। এটা তার একার দুঃখ নয়, আমাদেরও। সেকালে দেশে তেমন মানুষের অভাব ছিল। ভবিষ্যতে তার কাজ নিয়ে কোনো গবেষণা পরিচালিত হলে এ-বিষয়টি, আমাদের সীমাবদ্ধতার সামাজিক দিকটি, আশা করি, গবেষকদের নজর এড়াবে না।

আমাদের সিদ্ধেশ্বরী আমূল পালটে গেছে। নেই সেই ছোট ছোট বাড়ি, সামনের বাগান, অঢেল গাছগাছালি ও নির্জনতা—স্বস্তিকর মানবিক পরিবেশ। নির্মুখ নগর সবকিছু গ্রাস করেছে, লোপাট হয়ে গেছে আমাদের যৌবনের স্মৃতির সব আশ্রয়। সামান্য যেটুকু আজও টিকে আছে তা রমনার কয়েকটি বৃদ্ধ বৃক্ষে। আনোয়ার নেই, আমি আছি, আরও কিছুদিন যাতায়াত থাকবে পার্কে, গাছগুলো দেখলে তার কথা মনে পড়বে এবং হয়তো তাদের পাতার মর্মরে শুনতে পাব সেই না-বলা বাণী — ‘ভালবেসেছিল কবি বেঁচেছিল যবে’।

দ্বিজেন শর্মা

জন্ম ১৯২৯, সিলেট। উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক (ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল ও নটর ডেম কলেজ, ঢাকা); অনুবাদক, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক। বসবাস ঢাকায়। শখ : উদ্যান পরিকল্পনা।

১ comment

  1. অদিতি কবির - ৮ মার্চ ২০১৪ (১০:১০ পূর্বাহ্ণ)

    বরিশালের ‘ধানসিড়ি’ নামের যে বাড়িটি সবাই দেখতে যায় জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি হিসেবে, সেটির নাম ছিল ‘সর্বানন্দ ভবন’। মালিকানা বদল হয়ে আমার নানার হাতে এলে নতুন নামকরণ হয় ‘ধানসিড়ি’। এই নামটি দিয়েছিলেন আলী আনোয়ার মামা।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.