প্রাণবিজ্ঞানকে বর্তমান শতাব্দীর বিজ্ঞান বলে অভিহিত করা হয়েছে। তা বিনা কারণে নয়। প্রাণজগত বিস্ময়কর, গভীর রহস্যপূর্ণ ও জটিল। ডি এন এ-র পেঁচানো সিঁড়িতে থরে থরে সাজানো আছে জীবনের মৌলরহস্য। একথা জানবার পর থেকে গত অর্ধ শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানের যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি তা মূলত প্রাণবিজ্ঞানের পরিমণ্ডলে ঘটেছে। প্রাণবিজ্ঞানের জটিল বিষয়াদি নিয়ে বাংলায় লেখা সহজ কাজ নয়। কিন্তু সে কঠিন কাজটি সরস বাংলায় উপস্থিত করবার দক্ষতা দেখিয়েছেন আশরাফ আহমেদ তাঁর ‘জলপরি ও প্রাণপ্রভা’ গ্রন্থে। রম্য রচনায় লেখক যে হাত পাঁকিয়েছেন তার পরিচয় মেলে ‘কলাচ্ছলে বলা’ নামের তাঁর প্রথম পুস্তকটিতে। গল্পের মত করে পুরনো স্মৃতি বর্ণনা – যাতে জড়িয়ে থাকে হাস্য-কৌতুকের অনুষঙ্গ, তেমন হাল্কা মেজাজের রসোত্তীর্ণ রচনা সৃষ্টিতে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন আশরাফ আহমেদ। ‘জলপরি ও প্রাণপ্রভা’ গ্রন্থের ১৩টি কাহিনী বর্ণনায় সে ছাপের পরিচয় মেলে। একটি বড় সুবিধে তাঁর আছে। নিজেই তিনি প্রাণবিজ্ঞানী। চার দশকের বেশী সময় ধরে প্রাণবিজ্ঞান গবেষণায় শুধু নিমগ্ন থাকা নয়, খ্যাতিও অর্জন করেছেন আশরাফ আহমেদ। শিক্ষকেরা কথা বলেন। সেসব কথা শুনে ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা মুগ্ধ হলে শিক্ষকেরা নিজেদের ধন্য জ্ঞান করেন। শিক্ষকতার সে সৌভাগ্যও হয়েছে আশরাফ আহমেদের। পল্পেও কথা বলে যেতে হয়। এছাড়া সৃষ্টিশীল লেখার জন্য পরিমণ্ডলের সাহায্য লাগে। স্ত্রী-পরিবার-পরিজন-বন্ধু-স্বজন সে পরিমণ্ডল গড়ে তোলে। তা যদি হয় সহায়ক তবে তা অণুঘটকের কাজ করে। আশরাফ আহমেদ সে সাহায্যও পেয়েছেন। এবারে ‘জলপরি ও প্রাণপ্রভা’ পুস্তকের লেখাগুলো নিয়ে কথা বলব। জলপরি ও প্রানপ্রভার ইংরেজি প্রতিশব্দ Mermaid and Bioluminisense । ১৩টি গল্পের বেশ কয়েকটিতে পুস্তকের নামকরণের কার্যকারণ বোঝা যায়। জলপরি ও প্রাণপ্রভার নানা বৃত্তান্ত পাব আমরা ক্রমশ। জ্ঞান অর্জনে গুরুর প্রয়োজন হয়। বইয়ের প্রথম রচনা ‘গুরু বিন কেয়সে গানা গা-আ-ও’ তে তার পরিচয় পাই। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা কিভাবে আশরাফ আহমেদের মধ্যে বিজ্ঞান মনস্কতার আধুনিক ভুবনটি খুলে দিলেন তার নিবিড় বর্ণনা পাই এ রচনায়। লেখাটি শেষ করেছেন তিনি এমন একটি সহায়কপঞ্জি যুক্ত করে যাতে পরবর্তী লেখাগুলো পাঠে সুবিধে হয়। শিক্ষাগুরুদের কাছ থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে কি শিক্ষা পেলেন তিনি তারও সারাংশ টেনেছেন ঐ পঞ্জিতে। অনুঘটকের কথা শুরুতে বলেছি। তার কথা আছে সেখানে। এ গল্প পড়ে ভিন্ন একটি কথা ভাবছিলাম। ইদানিং আমাদের স্কুল-কলেজে বিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি কমে যাচ্ছে আশংকাজনক হারে।…
পৃথিবীতে শনাক্তকৃত জীব প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। অচেনা-অজানা আছে আরও ৫০ লাখ, হতে পারে ৫ কোটি। ক্রান্তীয় বৃষ্টিবনে আরও ৩ কোটি পতঙ্গ ও ১৫-২০ হাজার নলবাহী (ভ্যাসকুলার) উদ্ভিদ প্রজাতি থাকা সম্ভব। [...]
পৃথিবীতে শনাক্তকৃত জীব প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। অচেনা-অজানা আছে আরও ৫০ লাখ, হতে পারে ৫ কোটি। ক্রান্তীয় বৃষ্টিবনে আরও ৩ কোটি পতঙ্গ ও ১৫-২০ হাজার নলবাহী (ভ্যাসকুলার) উদ্ভিদ প্রজাতি থাকা সম্ভব। ছত্রাক ও মাকড়সার অনেক প্রজাতি শনাক্তকরণ এখনও বাকি। বিগত ৫ বছরে আমাজান বনাঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে ৩০০ নতুন প্রজাতির মাছ এবং ৪ প্রজাতির নতুন বানর জাতীয় প্রাণী। সবকিছু শনাক্ত করতে প্রয়োজন ২৫ হাজার বিজ্ঞানীর বহু বছরের শ্রম আর তাতেও জানা যাবে না ওইসব জীবের জীবনচক্র ও বাস্তু পরিবেশ। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত জ্ঞাত উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা যথাক্রমে ৬৬৩৪ ও ৫৩৫১। সীমিত আয়তনের এ ভূখণ্ডে বিগত কয়েক বছরে পাওয়া গেছে সপুষ্পক উদ্ভিদের ১২টি নতুন প্রজাতি। এখানকার নলবাহী উদ্ভিদের ১০৬ ও প্রাণীর ১৩৭ প্রজাতি নানা পর্যায়ে বিপন্ন, বিলুপ্ত হয়ে গেছে মেরুদণ্ডী প্রাণীর ১৩ প্রজাতি। বাংলাদেশের নিজস্ব বা একান্ত সপুষ্পক উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা ৬। এ হিসাব থেকে বাদ গেছে অণুজীব, ছত্রাক, শৈবাল এবং নিম্নবর্গীয় উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতিগুলো। বলা বাহুল্য, খতিয়ান ক্রমেই দীর্ঘতর হবে এবং বিলুপ্ত, বিপন্ন ও নতুন প্রজাতির সংখ্যা বাড়বে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রজাতির বিপন্নতা ও বিলুপ্তির কারণ প্রাকৃতিক নয়, মানুষী কর্মকাণ্ডের ফল। তবে আশার কথা, হিসাবটি নির্বিশেষ নয়। জীব প্রজাতির ভূগোল রাজনৈতিক ভূগোল থেকে পৃথক। বাংলাদেশের জীবকুল ইন্দো-মালয়ীয় জীবাঞ্চলের অন্তর্গত, এখানে না থাকলেও আশপাশের দেশে কোনো কোনোটি টিকে থাকা সম্ভব। সমস্যাটি কোনো একক দেশের নয়, গোটা বিশ্বের। জীববৈচিত্র্য একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিপর্যস্ত হলে জীববৈচিত্র্যেরও অবক্ষয় ঘটে। জীবজগৎ বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে বসবাস করে। প্রাকৃতিক নিয়মে এ বাস্তুতন্ত্রে পরিবর্তন ঘটলে বিবর্তনক্রিয়া সক্রিয় হয়ে ওঠে, ধ্বংস ও সৃষ্টির মধ্যে জীবকুলের পুনর্জনন ঘটে, উৎপন্ন হয় নতুন নতুন প্রজাতি। অক্সিজেনহীন পৃথিবীতে এক সময় অবায়ুজীবী জীবকুলের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছিল, বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন আসার পর এসব জীবের গণবিলুপ্তি ঘটে, কিন্তু উৎপন্ন হয় বায়ুজীবী জীবকুল এবং আজকের সব উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি। এটাই বিবর্তন। কিন্তু মানুষ বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন ঘটালে প্রকৃতি পশ্চাদপসরণ করে, প্রহত হয় বিবর্তনক্রিয়া, লোপ পায় জীববৈচিত্র্য। প্রকৃতি ও মানুষের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মধ্যে গুণগত পার্থক্য দুস্তর। মানুষ যখন থেকে জেনেছে, সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জীব, গোটা প্রকৃতি তার ভোগ্যবস্তু তখন থেকেই প্রকৃতির ওপর মানুষের অমিত…