প্রাণবিজ্ঞানকে বর্তমান শতাব্দীর বিজ্ঞান বলে অভিহিত করা হয়েছে। তা বিনা কারণে নয়। প্রাণজগত বিস্ময়কর, গভীর রহস্যপূর্ণ ও জটিল। ডি এন এ-র পেঁচানো সিঁড়িতে থরে থরে সাজানো আছে জীবনের মৌলরহস্য। একথা জানবার পর থেকে গত অর্ধ শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানের যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি তা মূলত প্রাণবিজ্ঞানের পরিমণ্ডলে ঘটেছে। প্রাণবিজ্ঞানের জটিল বিষয়াদি নিয়ে বাংলায় লেখা সহজ কাজ নয়। কিন্তু সে কঠিন কাজটি সরস বাংলায় উপস্থিত করবার দক্ষতা দেখিয়েছেন আশরাফ আহমেদ তাঁর ‘জলপরি ও প্রাণপ্রভা’ গ্রন্থে। রম্য রচনায় লেখক যে হাত পাঁকিয়েছেন তার পরিচয় মেলে ‘কলাচ্ছলে বলা’ নামের তাঁর প্রথম পুস্তকটিতে। গল্পের মত করে পুরনো স্মৃতি বর্ণনা – যাতে জড়িয়ে থাকে হাস্য-কৌতুকের অনুষঙ্গ, তেমন হাল্কা মেজাজের রসোত্তীর্ণ রচনা সৃষ্টিতে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন আশরাফ আহমেদ। ‘জলপরি ও প্রাণপ্রভা’ গ্রন্থের ১৩টি কাহিনী বর্ণনায় সে ছাপের পরিচয় মেলে।
একটি বড় সুবিধে তাঁর আছে। নিজেই তিনি প্রাণবিজ্ঞানী। চার দশকের বেশী সময় ধরে প্রাণবিজ্ঞান গবেষণায় শুধু নিমগ্ন থাকা নয়, খ্যাতিও অর্জন করেছেন আশরাফ আহমেদ। শিক্ষকেরা কথা বলেন। সেসব কথা শুনে ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা মুগ্ধ হলে শিক্ষকেরা নিজেদের ধন্য জ্ঞান করেন। শিক্ষকতার সে সৌভাগ্যও হয়েছে আশরাফ আহমেদের। পল্পেও কথা বলে যেতে হয়। এছাড়া সৃষ্টিশীল লেখার জন্য পরিমণ্ডলের সাহায্য লাগে। স্ত্রী-পরিবার-পরিজন-বন্ধু-স্বজন সে পরিমণ্ডল গড়ে তোলে। তা যদি হয় সহায়ক তবে তা অণুঘটকের কাজ করে। আশরাফ আহমেদ সে সাহায্যও পেয়েছেন।
এবারে ‘জলপরি ও প্রাণপ্রভা’ পুস্তকের লেখাগুলো নিয়ে কথা বলব। জলপরি ও প্রানপ্রভার ইংরেজি প্রতিশব্দ Mermaid and Bioluminisense । ১৩টি গল্পের বেশ কয়েকটিতে পুস্তকের নামকরণের কার্যকারণ বোঝা যায়। জলপরি ও প্রাণপ্রভার নানা বৃত্তান্ত পাব আমরা ক্রমশ।
জ্ঞান অর্জনে গুরুর প্রয়োজন হয়। বইয়ের প্রথম রচনা ‘গুরু বিন কেয়সে গানা গা-আ-ও’ তে তার পরিচয় পাই। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা কিভাবে আশরাফ আহমেদের মধ্যে বিজ্ঞান মনস্কতার আধুনিক ভুবনটি খুলে দিলেন তার নিবিড় বর্ণনা পাই এ রচনায়। লেখাটি শেষ করেছেন তিনি এমন একটি সহায়কপঞ্জি যুক্ত করে যাতে পরবর্তী লেখাগুলো পাঠে সুবিধে হয়। শিক্ষাগুরুদের কাছ থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে কি শিক্ষা পেলেন তিনি তারও সারাংশ টেনেছেন ঐ পঞ্জিতে। অনুঘটকের কথা শুরুতে বলেছি। তার কথা আছে সেখানে।
এ গল্প পড়ে ভিন্ন একটি কথা ভাবছিলাম। ইদানিং আমাদের স্কুল-কলেজে বিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি কমে যাচ্ছে আশংকাজনক হারে। ব্যবসা-বিষয়ক ডিগ্রি অর্জনে ঝোঁক এখন বেশী। ভোগবাদী সমাজের এ এক অনুসঙ্গ। এ সময়ের এমন গড্ডালিকা প্রবাহের বিপরীতে প্রথম গল্পটি প্রাণবিজ্ঞানের মোহন জগতে প্রবেশের হাতছানি হয়ে এসেছে। তা পড়ে ক্ষণস্থায়ী কুহকের মোহকে এক পাশে রেখে কিশোর-কিশোরী-তরুণ-তরুণীরা ভাবতেও পারে বিজ্ঞানের রোমাঞ্চকর ভুবনে প্রবেশ করতে।
বিজ্ঞানের জগতের নানা রহস্য উন্মোচিত হয়েছে পরবর্তী গল্পগুলোতে। পুরুষের অংশগ্রহণ ছাড়াই সন্তানের জন্ম যে আর কোন কল্পকাহিনী নয়, তা নিয়ে ‘আমি কার বাবা রে, আমি কার খালু রে’ গল্পটি। নামটি আরও চিত্তাকর্ষক হতে পারত। তবে বিষয়বস্তু বর্ণনায় লেখক কল্পনাশক্তি ও সমাজ সচেতনতা বিবেচনায় রেখেছেন। আধুনিক সভ্যতার এ সময়েও পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য, নারীর অবমাননা এবং তার অবসানে বিজ্ঞান কিভাবে পথ দেখাবে তা বর্ণনা করেছেন হাস্য-কৌতুক ও যুক্তির মিশেল দিয়ে। শুধু নারীরা নয়, পুরুষকুলও আলোকিত হবেন এ লেখা পড়ে। প্রকৃতি-বিরুদ্ধ কত নিয়মের বেড়াজালেই না বেধে রাখা হয়েছে নারীদের। আর তা কি না করেছে হোমোসেপিয়ান বা প্রবুদ্ধ মানুষেরা! একশ বছরেরও আগে মহীয়সী বেগম রোকেয়ার ভাবনাগুলো এই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে কেমন অর্থবহ হয়ে উঠেছে, তার এক যুক্তিনিষ্ঠ বর্ণনা পাই এ রচনায়। ‘নারীস্থান’ এবং ‘মাইটোকনড্রিয়াল ইভ’ সমসূত্রে গাঁথা – এ বিবেচনা সহজেই মাথায় আসে।
‘ভালবাসার গন্ধ কত’ লেখকের তৃতীয় রচনা। নানা বয়সী বাঙ্গালি বিজ্ঞানীদের মজার সব গবেষণায় শরীরের গন্ধ শুধু মশা তাড়ানো নয়, ইভ-টিজিং-এর প্রতিষেধক হয়ে কি ভাবে আমাদের অসহায় কিশোরী-তরুণীদের রক্ষা করবে তার সম্ভাবনার কথা শুনি আমরা। মস্তিষ্কের বিশেষ কোষ ‘অলফ্যাক্টরি নার্ভ’ যা গন্ধকে সনাক্ত করে, তাতে পরিবর্তন ঘটিয়ে তেমন কিছু করা যে সম্ভব, তার বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা আছে এ লেখাটিতে। যে ক’জন বিজ্ঞানীর নাম এসেছে, সেগুলো কল্প নাম নয়। প্রাণবিজ্ঞানের গবেষণায় বাস্তবেও তাঁরা নিবিষ্ট আছেন। তাই এ গল্পের শিরোনামের নিচে ‘একটি বৈজ্ঞানিক কল্পবিলাস’ লেখা ঠিক যথার্থ হল না।
লেখায় বিশ্বাসযোগ্যতা বিষয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শ প্রণিধানযোগ্য। বাংলা ১৩৩৮ সালে ‘পরিচয়’ কার্ত্তিক সংখ্যায় জগদীশচন্দ্র গুপ্তের ‘লঘু গুরু’ উপন্যাসের পর্যালোচনায় তিনি লিখেন,
“লেখকের ক্ষমতা আছে বললে বোঝায়, লেখক যেটাকে লেখেন, সেটাকে পাঠ্য করে তুলতে পারেন, সেটা পথ্য না হলেও। সাহিত্য সর্ম্পকে পথ্য কথাটা বলতে এ বোঝায় না যে, জ্ঞানের দিক থেকে সেটা পুষ্টিকর, বা নীতির দিক থেকে সেটা স্বাস্থ্যজনক। যেটাকে মন সম্পূর্ণ সায় দিয়ে গ্রহণ করতে পারে, সেটাই পথ্য। মন যেটাকে বিশ্বাস করতে পারে, সেটাকেই গ্রহণ করে। এস্থানে নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিললে তো কোন কথাই নেই, নইলে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের দরকার। সে-প্রমাণ মিথ্যে সাক্ষ্যের মতো বানিয়ে তোলা হলেও চলে, কিন্তু, তাতে সত্যের স্বাদ থাকা চাই। সাহিত্যিক এই বলে হলফ করে, আমার কথা যতই মিথ্যে হোক, তবু সেটা সত্য।”
মারিও রেনাতো কাপোচ্চি। ছোটবেলায় টোকাই থেকে ২০০৭ সালে তাঁর নোবেল বিজয়ী প্রাণবিজ্ঞানী হয়ে ওঠার রোমাঞ্চকর গল্প শুনি আমরা। ইঁদুরের সাথে মানুষের ডি এন এ-র পার্থক্য সামান্য। কাপোচ্চি দেখালেন জিন প্রকৌশল কাজে লাগিয়ে ইঁদুরের দেহে মানুষের নানা রোগ সৃষ্টি করে তার নিরাময়ের উপায়। জাপানে ৮০-এর দশকে ধানে গরুর দুধের প্রোটিন স্থানান্তর ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯০-এর দশকে ধান থেকে খুঁজে পাওয়া জিনের পরিচালক প্রমোটারকে মানবদেহের ক্যান্সার সনাক্তকরণে ব্যবহারের চিন্তা এবং সে সংক্রান্ত আমার নিজের গবেষণার কথা মনে পড়লো। আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতার কয়েকটি চরণও স্মরণে এল।
“হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হ’ব- কিশোরীর- ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,”
কবির সেসব কল্পনা ও স্বপ্নকে অর্ধশতাব্দী পর বাস্তবে রুপ দিচ্ছেন কাপোচ্চি ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরা। আশরাফ আহমেদের কলমে টোকাই বিজ্ঞানীর কীর্তিগাঁথা পড়তে গিয়ে মন চলে গিয়েছিল তেপান্তরে।
এরপর আরও নয়টি গল্প আছে। ‘পাগলের মন পেয়ালায়’ গল্পে আদি কোষ (stem cell) গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে সামনের দিনগুলোতে অটিজম বা মনোবৈকল্য নিরাময়ও অসম্ভব হবেনা। এ গল্পের নাম আরও চিত্তাকর্ষক হতে পারতো।
‘আমার ভালবাসা’ একটি নিটোল গল্প। নানা প্রাণকণার মধ্যে প্রোটিন সবচেয়ে বর্ণিল, রহস্যময় ও জটিল। এ ধরিত্রীতে প্রাণের উদ্ভবে প্রোটিনের ভূমিকাই মুখ্য। প্রোটিনের গঠন কাঠামো জানতে এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফি কৌশল ব্যাবহার করতে হয়। তারজন্য প্রয়োজন পড়ে প্রোটিনের নিখুত ক্রিস্টাল তৈরির। পূর্বে বলেছি আশরাফ আহমেদ নিজেই খ্যাতিমান প্রাণবিজ্ঞানী। ট্রিপ্টোফ্যান সিন্থেস নামের অনুঘটক প্রোটিনের ক্রিস্টাল তৈরিতে তাঁর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে এ গল্পে। বিজ্ঞানীরাও অস্থি-মজ্জার মানুষ। প্রেম ভালবাসা তাঁদেরও আছে। তা যেমন প্রিয়জনের প্রতি তেমনি তাঁদের অপূর্ব সৃষ্টির প্রতিও। সেসব ভাললাগা কথা আছে এই গল্পে।
সুস্থ দেহ নিয়ে অমর হয়ে থাকবার চিরন্তন ইচ্ছা মানুষের সহজাত হলেও প্রকৃতির নিয়ম হচ্ছে জন্ম হলে মৃত্যু হবে; তার অন্যথা হবেনা। জীবনানন্দ দাশের চার লাইনের অগ্রন্থিত কবিতা মনে পড়লো আবারঃ
“ঘড়ির দুইটি ছোট কাল হাত ধীরে
আমাদের দু’জনকে নিতে চায় যেই শব্দহীন মাঠে ঘাসে
সাহস সঙ্কল্প প্রেম আমাদের কোনদিন সেদিকে নেবে না
তবুও পায়ের চিহ্ন সেদিকেই চলে যায় কি গভীর সহজ অভ্যাসে।”
মনেই থাকে না আমরা সবাই প্রকৃতির সহজ নিয়মে এগিয়ে চলেছি মৃত্যু অভিমুখে। প্রকৃতির সে অমোঘ নিয়ম ‘পরিকল্পিত কোষ মৃত্যুর’ মধ্য দিয়ে আমাদের শরীরে কিভাবে ক্রিয়া করে তার সাবলীল আলোচনা পাই ‘পুরনো সেই বাতিঘরটি’ গল্পে। বাতিঘরের আলোর সংকেত দেখে অকুল সাগরে দিশাহীন নাবিক আশার আলো দেখতে পায়। আমাদের কোষের শক্তিকেন্দ্র মাইটোকনড্রিয়া পরিকল্পিত কোষ মৃত্যুর সংকেত পাঠায়। এ বিচারে মাইটোকনড্রিয়াকে বাতিঘর বলা যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সে সংকেত তো মৃত্যুর। এ কথা সত্য যে জন্ম-মৃত্যু হাত ধরাধরি করে চলে প্রাকৃতিক নিয়মে। তারপরও এ গল্পের নাম ভিন্ন হলেই ভাল হত বলে মনে হয়।
জি এফ পি। গ্রিন ফ্লোরেসেন্ট প্রোটিন। জিন প্রকৌশলে একটি অতি পরিচিত নাম। সবুজ আলো বিচ্ছুরণকারী এই প্রোটিনের জন্য ২০০৮ সালের নোবেল পুরস্কার পান তিনজন প্রাণবিজ্ঞানী। জেলি ফিশের নীল বর্ণের প্রোটিনের উপর অতি বেগুনি রশ্মি ফেললে তা থেকে বেরিয়ে আসে গাঢ় সবুজের বর্ণচ্ছটা। জি এফ পির গঠন কাঠামোয় পরিবর্তন এনে বিচিত্র বর্ণের আলো তৈরি সম্ভব হল। আর আলো-প্রদায়ি এসব প্রোটিনকে সংকেত হিসেবে ব্যবহার করে জানা সম্ভব হচ্ছে নানা কঠিন রোগের কার্যকারণ। ‘জলপরি ও প্রাণপ্রভা’ গ্রন্থের ‘প্রভামিষ ও প্রভামাছ’ গল্পে সেসব বর্ণনা আছে। নানা রঙের আলো বিচ্ছুরণকারী প্রোটিনের কারণে প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীব তাদের দেহ থেকে বর্ণীল আলো ছড়াচ্ছে – এ দৃশ্য কল্পনা করেই জেমস ক্যামেরনের ‘এভাটার’ (অবতার) সিনেমার এক অপূর্ব দৃশ্যপট মনে পড়ে। প্যানডোরা গ্রহের নাভি নামের মানুষ ও অন্যান্য প্রজাতির প্রাণভোমরা যুক্ত আছে বোধিবৃক্ষে। মানুষের অনাচারে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীর অধিপতিদের নজর পড়েছে সেখানে। হানাদার বাহিনী প্রধান কর্নেল কুইরিচ বোধিবৃক্ষকে বিনাশ করতে চায়। প্রকৃতির সকল প্রজাতির মিলিত প্রতিরোধে পরাজিত হয় মনুষ্য নামের দস্যুরা। সে প্রতিরোধে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরাও যোগ দিয়েছিল। প্যানডোরা রক্ষা পায়। রক্ষা পায় তার প্রকৃতি। পৃথিবীর প্রাণপ্রভা বিচ্ছুরণকারী প্রজাতির মত অপূর্ব সুন্দর আলো দানকারী প্রজাতিরা প্যানডোরা গ্রহে ভেসে বেড়ায়।
এরপর আরও পাঁচটি গল্প আছে। ‘মল চিকিৎসা’ এখন আর চীন দেশে হাজার বছর আগে প্রচলিত কল্পকাহিনী নয়। আমাদের অন্ত্রের ঘাতক অণুজীব Clostridium difficile-কে ভাল অণুজীব দিয়ে হটিয়ে দুরারোগ্য ডায়রিয়া নিরাময়ে ‘স্টুল থেরাপি’ হাল আমলে দারুণ আলোচিত। সে কাহিনী আছে লেখকের ‘গুগুলের পাতায় গুওেলফ এর’ গল্পে। নামটিকে সম্পূর্ণ মনে হইনি। রম্যরস যুক্ত করার মোহে নামকরণ হয়ে থাকলেও তার যথার্থতা তেমন পাওয়া গেল না।
কয়েক ধরণের ব্যাকটেরিয়া নীল প্রাণপ্রভা সৃষ্টি করে। দিনের বেলা দৃশ্যমান না হলেও রাতে আমাদের চোখের রডপ্সিন নামের প্রোটিনের কারণে সেই নীল আলো সাদা হিসেবে আমরা দেখি। সমুদ্রের বিশাল জায়গা জুড়ে এমন প্রাণপ্রভা দেখে দুধ সাগর বলে ভ্রম হয়। এমন সব বৃত্তান্তের সহজ বয়ান আমরা পাই ‘দুধ সাগর’ গল্পে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর উপাদান আছে এ রচনায় দেশের মেয়ে শাহানার কারণে। মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ে পড়া শাহানার দুধ সাগরে স্নান করার স্বপ্ন, অসম বয়সী স্বামীর ঘর করতে এসে স্বপ্ন ভঙ্গ এবং তার করুণ মৃত্যু অন্য এক মাত্রা দেয় এ গল্পে। আকারের দিক থেকেও গল্পটি বড়।
‘অপারেশান ক্লিন হার্ট’ গল্পটির নামে বাহার থাকলেও সবগুলো গল্পের মধ্যে এ’টিকে দুর্বল মনে হয়েছে। বাংলাদেশে র্যাব ‘অপারেশান ক্লিন হার্ট’-এর নামে যে হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে তার সূত্র ধরে লেখক হৃদযন্ত্রের শল্য চিকিৎসার নানা অনুষঙ্গ তুলে ধরেন এই রম্যরচনায়। প্রাণবিজ্ঞানের নানা চিত্তাকর্ষক আবিষ্কার নিয়ে লেখার পর ভিন্ন স্বাদের এই গল্প ‘জলপরি ও প্রাণপ্রভা’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত না হলেই ভালো হত।
আরব্য উপন্যাসের হাজার রজনীর গল্পের নায়িকা শাহরজাদ নিজেকে ও সন্তানদায়িনী নারীকুলকে স্বামী সুলতান শাহরিয়ারের হাত থেকে রক্ষা করেন প্রতি রাতে একটি গল্প শুনিয়ে। মানবজাতি চিরতরে বিলিন হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়। ‘পেঁয়াজ ও রসুন এর গল্প’ উপাখ্যানে পেঁয়াজ, রসুনের ভেষজ গুন, পেঁয়াজের ঝাঁজ – এসবের রহস্য নিয়ে শাহরজাদ গল্প শোনান বাদশাহকে। সে গল্প আমাদের শুনতেও ভাল লাগে পরিবেশনার গুনে। আরও একজন নারী মানবজাতির ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
‘জলপরি’ গল্পটি আকারের দিক থেকে সবচেয়ে বড়। গ্রন্থের নামের সাথে মিল আছে বলে বাড়তি আকর্ষণ বোধ করবেন পাঠক। স্বপ্ন ও বাস্তবতার এক আখ্যান এই গল্প। কটকা সৈকতে রুশো মরে যেতে পারতো তার বারোজন সহপাঠীর মত। সেই মৃত্যুর দশ বছর পর রুশো এসেছে দুবলার চরে। সুন্দরবনের এক চমৎকার বর্ণনা পড়ি। তার সাথে আমরা শিক্ষিতজনেরা কি ক্ষতি করছি বনের ও তার পশুদের তারও করুণ ইতোবৃত্ত শুনি বন বিভাগের কর্মচারী কমরুদ্দিনের মুখে। বাঘের সংখ্যা কমে এখন যে মাত্র ৪৫টিতে ঠেকেছে, তা গভীর দুঃসংবাদ হয়ে আসে আমাদের কাছে। আর আছে বনবিবি। সুন্দরবনকে বাঁচাবার দেবী। দশ বছর আগে রুশোর বারো বন্ধু যে সমুদ্রে তলিয়ে গেল, তাদের বন ও বনবিবি নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখেনি। তাই হয়তো এমন নির্মম প্রতিশোধ। এসব ভূমিকার পর মূল গল্প শুরু হয়।
মাছের শরীর থেকে বিচিত্র বর্ণের প্রাণপ্রভা রুশো দেখে স্বপ্নের ভেতর জেগে থেকে। দশ বছর আগে তার সহপাঠী বন্ধু মিলি সাগরে হারিয়ে গিয়েছিল। দেহটি মেলেনি। এখন জলপরি হয়ে দেখা দিয়েছে রাতের শেষ প্রহরে। ১৫ হাজার বছর আগে বাংলাদেশ ভূখণ্ড এমন ছিলনা। সমুদ্র ছিল আরও এগিয়ে। নানা বিস্ময়ের কথা শোনায় মিলি নামের জলপরি। মানুষের সভ্যতার চেয়েও আরও উন্নত এক সভ্যতা ছিল সমুদ্রের নিচে। মনুষ্য-সৃষ্ট পরিবেশ দূষণের ফলে সে সভ্যতা কবে শেষ হয়ে গেছে। সুন্দরবন বাঁচাবার আকুতি জানায় মিলি। এ পৃথিবী যে শুধু মানুষের নয়, সকল প্রজাতির; সবার একযোগে বাঁচা ছাড়া যে তা ধ্বংস হয়ে যাবে এবং অনেকটা হয়ে গেছে সে মহাবিপদের বার্তা দেয় জলপরি। তার রেখে যাওয়া নানা বর্ণের দুটো ওড়নার কথা আছে গল্পে। আর আছে বনবিবির কাছে সব ধর্মের পীড়িত মানুষের প্রার্থনা – মঙ্গল হোক সবার। পরিবেশ সচেতনতা বিষয়ে বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজনা নেই। আশরাফ আহমেদ চেষ্টা করেছেন। মনে পড়লো ১৯৭৩ সালে জার্মান লেখক মাইকেল এন্ডি লিখেছিলেন ‘মোমো’। ছোট্ট মেয়ে মোমো থাকে বিরান এক শহরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এমফিথিয়েটারের পাশে। মিলি নামের জলপরির মত সেও ত্রাতার ভূমিকা নিয়ে উদয় হয় ধূসর পোশাকের মানুষরুপী সময়চোরদের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে। সফলও হয়। কারণ বনবিবির মত হোরা তাকে সাহায্য করে। আরব্য রজনীর শাহরজাদ, জোয়ান অব আর্ক, মিলি, মোমো এবং প্যানডোরা গ্রহের নেইতিরি সমার্থক হয়ে ওঠে। বনবিবি ও হোরার মত ওরা যেন প্রকৃতিরই প্রতিচ্ছবি।
বহুদূর অতীতে আফ্রিকায় ‘মাইটোকনড্রিয়াল ইভ’ থেকে মানব প্রজাতির সৃষ্টি। ডি এন এ ফিঙ্গার প্রিন্টিং কৌশল কাজে লাগিয়ে প্রাণবিজ্ঞানীরা এমন আভাষই দিয়েছেন। মানুষের কারণে যে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে তার হাত থেকে রক্ষায় আশার বার্তা নিয়ে আসবে নারীরা। এখনও পুরুষ শাসিত মানব সমাজে এ সত্য উচ্চারণ সাহসী বটে। আশরাফ আহমেদ সে সাহস দেখিয়েছেন। একজন স্বপ্নচারী হিসেবে শুধু নয়, মানবতাবাদি ও যুক্তিনিষ্ঠ একজন প্রাণবিজ্ঞানী হিসেবেও।
কবি জীবনানন্দ দাশের ‘স্বপ্ন’ কবিতার কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করে এ লেখার ইতি টানছিঃ
“তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,
পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,
মানুষ রবে না আর, রবে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখনঃ
সেই মুখ আর আমি রবো সেই স্বপ্নের ভিতরে।”
——————-
জলপরি ও প্রাণপ্রভা
লেখকঃ আশরাফ আহমেদ
প্রকাশকঃ আগামী প্রকাশনী
প্রচ্ছদঃ শিবু কুমার শীল
প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
মূল্যঃ ৩০০.০০ টাকা