খানিক আগে আমাদের হাতে হাউজ অব লর্ডস-এর প্যাডে লর্ড অ্যাভবেরির একটি বিবৃতি এসে পৌঁছেছে (এখানে দেখুন), যেটি গত ২৩ জুন বুধবার যুক্তরাজ্যের অল পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের আয়োজিত সেমিনার সংক্রান্ত।
বিবৃতিটির উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হলো, লর্ড অ্যাভবেরির পক্ষ থেকে সেখানে বলা হয়েছে :
১. অল পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপ-এর অনুরোধে ওয়ার ক্রাইমস কমিটি অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশন সংক্ষেপে আই বি এ বাংলাদেশে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধসমূহ বিচারের জন্যে যে আইন অনুসরণ করছে তার উপযোগিতা মূল্যায়ন করে দেখেছে।
২. এর উদ্দেশ্য এই নয় যে, বাংলাদেশে সংগঠিত যুদ্ধাপরাধকে খাটো করে দেখা হচ্ছে- বরং ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশের আওতায় বিচার সংগঠিত হলে তার আইনী যৌক্তিকতা যেন গত ৩৭ বছরে উন্নীত আইনি স্ট্যান্ডার্ডের বিচারে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেটি নিশ্চিত করা।
৩. গত ২০০৯-এর শেষের দিকে পার্লামেন্টারী হিউম্যান রাইটস গ্রুপ (পিএইচআরজি)-এর কাছে ওয়ার ক্রাইমস কমিটি তাদের প্রাপ্তি বা ফাইন্ডিংগুলি পাঠায়। প্রাপ্তিসমূহ নিজেদের মধ্যে মূল্যায়নের পর পিএইচআরজি-এর চেয়ার মিস অ্যান ক্লুয়েড বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলির মন্তব্যের জন্যে যুক্তরাজ্যের দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশ হাই কমিশনারের কাছে হস্তান্তর করেন।
৪. আইবিএ-র এ রিপোর্ট পর্যালোচনার জন্যে ২৪ জুন হাউজ অব লর্ডস-এ সেমিনারের আয়োজন করা হয় এবং ২১ জুন যুক্তরাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ হাই কমিশনার তাদের মন্তব্য পাঠান। তবে তিনি বা তাঁর কোনও প্রতিনিধি সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন না।
৫. সেমিনারের প্রধান বক্তা হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশের- সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট খন্দকার মাহবুব হোসেন।
৬. আইবিএ-র প্রতিনিধিরা তাদের বক্তব্যে বার বার বলেছেন যে বাংলাদেশের আইনটির উন্নতিসাধনে বা সংশোধনের ক্ষেত্রে পরামর্শ দিতে তারা প্রস্তুত রয়েছেন, যাতে এ আইনটি আন-র্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধি, অধুনালুপ্ত যুগোশ্লাভিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, রুয়ান্ডাসংক্রান- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ পূর্ব তিমুর ও সিয়েরা লিয়েনের জাতীয় ট্রাইব্যুনালগুলির মতোই আন্তর্জাতিক মানসম্মত হয়ে ওঠে।
৭. বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এ সংক্রান্ত সংলাপ অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে বাহকের দায়িত্ব পালন করছেন লর্ড অ্যাভবেরি।
এবার লর্ড অ্যাভবেরি, আপনি আমাদের এই কথাগুলি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন, শুনুন :
১. বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পরপরই যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সালে, দালাল আইনের আওতায়। এর মান নিয়ে কোনও আপত্তিই ওঠেনি তখন, বরং সেটি ছিল আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে সংগঠিত সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে নতুন সরকার আসার পর পর্যায়ক্রমে এ বিচারের কাজ বাতিল করে দেয়া হয়। দালাল আইন এবং এর আওতায় বিচার কার্য বাতিল করে দেয়া হলেও ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল এ্যাক্টটি তখনো বলবত ছিল। স্বাধীনতার ইতিহাসকে উল্টে দেয়ার এজেন্ডা নিয়ে যারা তখন ক্ষমতায় এসেছিল, এবং তাদের যে সব অনুসারীরা পরে ক্ষমতায় এসেছে, তারাও কেউই এই আইনটিকে কখনোই সংশোধন করেননি, এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনও প্রশ্নও তোলেননি, বাতিল তো করেইনি। যদিও, তারা বিচারের আইনগত এবং নৈতিক দায়িত্বে অবহেলার মধ্য দিয়ে অপরাধের শিকার অসংখ্য মানুষকে আশাহত করেছেন। আপনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে সামান্য একটু দৃষ্টি দিলেই বুঝতে পারবেন, আজ যারা এ আইনটিকে পুঁজি করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে লবিং করছে, আইনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে, তারাই তখন বিচারের কাজ বাতিল করেছিল। তারা কখনোই চিন্তা করেনি, বাংলাদেশের মানুষ একদিন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠবে- যদি চিন্তা করত, তা হলে নিশ্চয়ই তারা এ আইনটিও বাতিল করে দিতো। আপনাদের আজ কষ্ট করে এই সেমিনার করতে হতো না।
২. তারপরও বাংলাদেশে আমরা যারা যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবিতে আন্দোলন করে চলেছি, তারা আইনটিকে নানাভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে রাজি আছি। আমাদের মনে হয়, বাংলাদেশ সরকারও এ ব্যাপারে সদিচ্ছা দেখিয়েছেন এবং আইনটিকে ২০০৯ সালে সংশোধন করেছেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সরকার রোম সংবিধিতেও স্বাক্ষর করেছেন- যে-উদাহরণ পৃথিবীতে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে পরিচিত অনেক দেশও করেনি। যদি আইন নিয়ে সত্যিই কোনও যথোপযুক্ত আপত্তি থাকে তা নিয়ে পর্যালোচনার মতো গণতান্ত্রিক পরিবেশও রয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, বাংলাদেশ থেকে যারা আপনার কাছে ১৯৭৩-এর ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট নিয়ে ধর্ণা দিচ্ছেন, তারা চিহ্নিত কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, যাদের সংসদেও প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। তারপরও এ আইনটি সম্পর্কে তাদের সংসদীয় প্রতিনিধিরা এখনো সংসদে গিয়ে কোনও আপত্তি তোলেনি। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত যারা এ ব্যাপারে এ দলগুলিকে সাহায্য করছেন, তারাও অতীতে দেশে প্রশ্নবিদ্ধ রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন আপনার কাছে আমাদের সবিনয় প্রশ্ন, রুয়ান্ডার গণহত্যা বিচারের আইন মূল্যায়ন কিংবা পূর্নমূল্যায়নের দাবি ও লবিং করার ক্ষমতা কিংবা অধিকার ভিলেইনদের প্রতিনিধিদের হাতে ছিল, না কি ভিকটিমদের প্রতিনিধিদের হাতে ছিল? নব্য নাৎসিরা যদি নাৎসিদের বিচারের প্রক্রিয়া পূর্নমূল্যায়নের দাবি জানায়, তা হলে আমরা কি তা আদৌ আমলে নেবো? না কি মানবাধিকার বিকাশের সামগ্রিক ঐতিহাসিক পটভূমির আলোকেই বিষয়টি বিবেচনা করা হবে?
৩. আমাদের জানা আছে, এবং আপনি নিজেও এ-বিবৃতিতে জানিয়েছেন, আইবিএ-র প্রাপ্তি ও মূল্যায়ন সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বক্তব্য যুক্তরাজ্যে নিয়োজিত বাংলাদেশ হাই কমিশনার আপনাদের কাছে হস্তান্তর করেছেন। কিন্তু এই বক্তব্য সম্পর্কে আপনারা কী অবস্থান নিয়েছেন, সেটি আমাদের কাছে একটুও পরিষ্কার নয়। সরকারের ওই বক্তব্য সম্পর্কে ঝেড়ে না কাঁশা পর্যন্ত আপনারা নিশ্চয়ই ‘আইন সংশোধনে সর্বতোভাবে সাহায্য করার’ আগ্রহ প্রকাশ করতে পারেন না।
৪. আপনি আপনার বিবৃতিতে যে-ভাবে তথ্য উপস্থাপন করেছেন, তাতে মনে হয়েছে যে আইবিএ-র রিপোর্ট পর্যালোচনার জন্যে পিএইচআরজি, অর্থাৎ আপনারা এ সেমিনারের আয়োজন করেছেন। কিন্তু এর মধ্যেই প্রমাণিত – বিষয়টি সেরকম ছিল না (এখানে অথবা এখানে দেখুন) । ‘জাস্টিস কনসার্ন’ নামের একটি সংগঠন এ সেমিনারের আয়োজনে প্রথমাবস্থায় যুক্ত ছিল এবং পরে ওয়ার ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজী ফোরাম, লন্ডন লইয়ারস ফোরামসহ বিভিন্ন মহল থেকে সেমিনারটি প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু হওয়ায় তারা নিজেদের ‘নাম সরিয়ে নিয়েছে’ বলে দাবী করা করা হয়। প্রসঙ্গত, আপনার বক্তব্য কিংবা চিঠিগুলোতে একবারের জন্যও বিষয়টি আপনি উল্লেখ করেননি। আপনার আয়োজিত এই সেমিনারে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং বক্তব্যপ্রদানকারীদের অনেকেই যে বিভিন্নভাবে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত এরও প্রচুর তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, এবং সে সব আপনাকেও যথাসময়েই অবগত করা হয়েছে। যে-দলটি এক সময় আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে তাদের নেতাকর্মীদের বিভিন্নভাবে যুদ্ধাপরাধে নিয়োজিত করেছে, সেই দলটি এবং তাদের সমমনারাই এখন বিচারের আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে চলেছে- যাতে আইনটিকে এমন একটি তথাকথিত মানবিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় যাতে আইনের ফাঁক গলে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়। আমরা এ-ও জেনেছি, এ বিষয়টি নিয়ে সেমিনার চলার সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের একজন প্রশ্ন করেছিলেন, কিন্তু আপনি জাস্টিস কনসার্ন-এর সম্পৃক্তির বিষয়টিকে খুব হালকাভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন- যা আমাদের বিস্মিত করেছে।
৫. আপনি উল্লেখযোগ্য বক্তাদের যে-তালিকা দিয়েছেন, তার মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি সেমিনারে কী বক্তব্য দিয়েছেন, আপনি তা উল্লেখ করেননি, কিন্তু বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় এ ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে এবং সেখানে আমরা দেখছি, তিনি খুব কায়দা করে বলেছেন যে, তারা না কি যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিরোধী নন এবং তারা চান আইনটি আন্তর্জাতিক মানসম্মত হোক। এখানে প্রসঙ্গত বলি এই খন্দকার মাহবুব হোসেনই কিছুদিন আগে নিউইয়র্কে গিয়ে যুদ্ধাপরাধ বিচারবিরোধী জনমত গড়ার চেষ্টা চালিয়েছেন এবং সেখানে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে কোনও যুদ্ধাপরাধী নেই। যিনি মনে করেন যে, বাংলাদেশে কোনও যুদ্ধাপরাধীই নেই, তিনি যখন আপনাদের সেমিনারে যুদ্ধাপরাধী বিচারের আইনের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করেন এবং আপনারাও তা বসে বসে শোনেন, তখন লর্ড অ্যাভবেরি- আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের মনে হয় যে, আপনারা আসলে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী বিচার নিয়ে মশকরা করতে বসেছেন। এই ধরণের মশকরা দয়া করে আমাদের সঙ্গে ভবিষ্যতে আর কখনোই করবেন না। আপনাদেরও সময়ের মূল্য আছে, আমাদেরও সময়ের মূল্য আছে।
৬. সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন সম্পর্কে আপনার আরও একটি তথ্য জানা দরকার- তিনি বিএনপির সদস্য; এবং এই বিএনপি গত ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে দলটির সর্বশেষ কাউন্সিলে গঠনতন্ত্রে সংশোধনী এনে একটি ধারা বাদ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠালগ্নে বিএনপির গঠনতন্ত্রের ওই ধারাটিতে বলা হয়েছিল যে, কোনও যুদ্ধাপরাধীকে বিএনপির সদস্যপদ দেয়া হবে না। এ ধারাটি বাদ দেয়ার মাধ্যমে বিএনপি প্রকারান্তরে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের দলটির পতাকাতলে সমবেত করার উদ্যোগ নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয় দিতে যে দলটি তাদের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনেছে সেই দলের একজন নীতিনির্ধারক হিসেবে খন্দকার মাহবুব হোসেনও যে বিশেষ মিশন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে বর্তমানে যুক্তরাজ্যে এসেছেন, এ ব্যাপারে আমাদের কোনও সংশয় নেই।
৭. আপনি বাহকের দায়িত্ব পালন করছেন; কিন্তু জাস্টিস কনসার্নকে আপনি এখনো যে-ভাবে আড়াল করতে চাইছেন, রক্ষা করতে চাইছেন এবং বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠার পরও এ ব্যাপারে আপনার বিবৃতিতে কোনও ব্যাখ্যা না দিয়ে বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন, তাতে বলতে বাধ্য হচ্ছি, অনেক বাংলাদেশিই এখন আর আপনার ভূমিকাকে যথেষ্ট স্বচ্ছ মনে করেন না।
আপনি এবং আপনারা যেখানে আপনাদের বক্তব্যে স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে পারছেন না, সেখানে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের প্রণীত একটি আইনকে ‘যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য নয়’ বলাটাও কি সন্দেহজনক না?
(ওয়ার ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম এর সদস্য-সংগঠন মুক্তাঙ্গন ব্লগ ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তায় অঙ্গীকারাবদ্ধ)
