পঞ্চমীর চাঁদ তখনো ডুবে যায়নি। তার আলোয় প্রথম যা নজরে পড়লো তা একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেলের নল। শীতের ঠাণ্ডা এখন স্বস্তিদায়ী। তারপরও নদীর খোলা হাওয়ায় একটু শীত অনুভব করি আমরা। আমরা যে নৌকাটিতে উঠেছি তা ঠিক সাম্পান নয়। যদিও নাফ নদীতে প্রায় সব নৌকাই ছই তোলা সাম্পান। এ নৌকাটি ছিপ নৌকার মত। লম্বা ও খোলা। তার দু’পাশে দু’জন করে চারজন যুবক বৈঠা নিয়ে বসেছিল। নৌকার পাটাতনে বিছানো ছিল রাইফেলটি। মোক্তারের নির্দেশে ঐ যুবকেরা আমাদের ব্যাকপ্যাকগুলো এমনভাবে গুছিয়ে রাখছিল যাতে নৌকার ভারসাম্য ঠিক থাকে। আমরা পনের জন যুত হয়ে বসেছি। নৌকা চলতে শুরু করেছে। সঁপাসপ বৈঠা পড়ছে। নাফ নদীর নোনা পানি কেটে নৌকা চলছে তীরবেগে। জামার সাইড পকেটে হাত ঢোকাল মোক্তার। তারপর বের করা হাত যখন মেলে ধরল, তখন চাঁদের আলোয় পাঁচটি বুলেট চকচক করে উঠল। আমরা চলেছি অজানা গন্তব্যে। মোক্তার আমাদের গাইড। সুঠাম চার যুবকের আটটি হাতের ছন্দময় আন্দোলনে নৌকা এগিয়ে চলেছে। সাম্পানের গতি মন্থর। আমাদের এপারে যেমন আছে ই পি আর ঠিক তেমনি ওপর পারে সীমান্তরক্ষী নাসাকা বাহিনী। দ্রুত গতির গানবোট আছে তাদের। ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে ওপারে পৌঁছাতে হবে। এই নিশুথি রাতে লম্বা ছিপ নৌকা বেছে নেয়ার কারণটি বোঝা গেল। খোলা রাইফেল ও তাজা বুলেট কেন দেখালো মোক্তার? তা কি একথা বোঝাতে যে আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অস্ত্র আছে আমাদের সাথে। না কি আমাদের মনে ভয় সঞ্চার করা তার উদ্দেশ্য? টেকনাফ বাজারের পশ্চিমে পাহাড় পেরিয়ে মোক্তারের বাড়ি। আমাদের নিয়ে যাচ্ছে আরাকানে। চার যুবকের সাথে তার কথোপকথন আমরা সামান্যই বুঝতে পারি। তবে আমাদের সাথে যখন সে কথা বলে, তখন তা ভিন্ন। ঠিক চট্টগ্রামেরও নয়। পনের জনের এই দলে সাঈদ ভাই ও আমি চট্টগ্রামের ভাষা বেশ বুঝতে পারি। আমাদের স্কুল জীবনের একটা সময় কেটেছে মিরেশ্বরাই স্টেশনে। তবে মোক্তারের কথা অন্যেরাও বুঝতে পারে। মোক্তার বহু জায়গা ঘুরেছে। শুনেছে নানা ভাষা। সবার বোধগম্য করে কথা বলার কায়দাটি সে ভালই রপ্ত করেছে। আমরা যখন ওপারে পৌঁছেছি, তখন চাঁদ প্রায় ডুবে গেছে। আরও যুবকদের আমরা অপেক্ষমাণ দেখি। মোক্তারের নির্দেশে ওরা টপাটপ ব্যাকপ্যাকগুলো মাথায় উঠিয়ে নেয়। ওদের সাথে মোক্তারের স্বল্প বাক্যবিনিময় আমরা ধরতে পারি…

“আমরা একে-অন্যের শক্তিকে হয় অবমূল্যায়ন করি নয়তো অতিমূল্যায়ন করি। খুব কম মানুষ আছে যারা অন্যের সম্পর্কে যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারে। এটা একটা বিশেষ গুণ। উঁচু মাপের মহৎ মানুষেরাই তা পারে। ”--আন্দ্রেই তারকোভস্কি https://www.flickr.com/photos/27671489@N04/14881613396/ সময়টা ২০০৪ সালের জানুয়ারী মাসের ১৬ই জানুয়ারী। ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদে’র উদ্যোগে নয়দিন ব্যাপী তারেক মাসুদ পরিচালিত "মাটির ময়না" প্রদর্শনের আয়োজন করা হয় চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমীতে। শেষ দিন তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরীন মাসুদ দুজনেই উপস্থিত হলেন চট্টগ্রামে। প্রদর্শনী শেষে তারেক ভাই ও ক্যাথেরীন ফিরে যাবেন। আমাদের বলা হলো, ট্রেনের টিকেট জোগাড় করতে। ট্রেনের টিকেট, তাও আবার স্লীপার। রীতিমতো দুঃসাধ্য ব্যাপার। আমরা বললাম, “এ.সি বাসে টিকেট করে দিই, খুব ভালো হয়।” তারেক ভাই রাজী হলেন না। কোনভাবে বোঝানো সম্ভব না। তারেক ভাই এর ছোট ভাই নাহিদ (যিনি পুরো প্রদশর্নীর আয়োজনে আমাদের সাথে কাটিয়েছেন) আমাকে বললেন, তারেক ভাই বাসে যাবেন না। বেপোরোয়া বাস চালালে উনি অসম্ভব ভয় পান। আমরা হেসে উঠি। তার কাছে জানলাম, একবার নাকি ঢাকা থেকে আসতে গিয়ে বাসের গতিবেগ বেপেরোয়া দেখে যাত্রাবাড়ীতে মাঝ পথে নেমে গিয়েছিলেন তারেক ভাই ও ক্যাথরীন। এই ঘটনা নিয়ে আমি পরবর্র্তীতে তারেক ভাইকে অনেক খেপাতাম। তার এ্যক্সিডেন্ট নিয়ে খুব ভয় ছিল। আর এমনি এক এক্সিডেন্টই তারেক মাসুদ কে আামাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। তারেক মাসুদের সাথে আমাদের পরিচয় হয় ১৯৯৯ সালে। তখন ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদে’র এর দায়িত্বে আছি আমরা অনেকে। আমাদের তারুন্যময় কর্মকান্ড আর চলচ্চিত্রের প্রতি উৎসাহ দেখে সংগঠনের অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা বিভাগে তৎকালীন সহযোগী অধ্যাপক ঢালী আল মামুন। আমাদের প্রিয় ‘মামুন স্যার’, যিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একজন বরেন্য চিত্রশিল্পী। স্যার আমাদের কাছে শুধুমাত্র উপদেষ্টা হিসেবে কখনও ছিলেন না । তার সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে CUFS বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের সহযোগিতায় ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদশর্নী’র আয়োজন করে। আমরা পরিচিত হই বাংলাদেশের বিকল্পধারা চলচ্চিত্রের সাহসী মানুষ তারেক শাহরিয়ার, আমিনুল ইসলাম খোকন, তানভীর মোকাম্মেল, প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মসিহউদ্দিন শাকের, শারমিন আখতারসহ আরো অনেকের সাথে। ঢালী আল মামুন ছিলেন সার্বজনীন একজন মানুষ। তাঁর সুবাদে সবার সাথে কাজ করার সুযোগ ঘটেছিল আমাদের । https://www.flickr.com/photos/27671489@N04/9514877970/ "চ. বি. ক্যাম্পাসে ‘মুক্তির…

মেইল বক্স থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ছেলেবেলার ভেতর হামাগুঁড়ি দিয়ে সোজা খাটের নীচে। অন্ধকার হাতড়ে টেনে বের করি টিনের বাক্সে রাখা পুতুলের সংসার, এলোমেলো করে দিতে দিতে ভাবি বাবা বুঝি 'ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী' হাতে নিয়ে পড়তে ডাকবে। বাবার দিকে ছুটে যেতে যেতে দেখি বুড়ো জেলের মুখটা বাবার। [. . .]

আমাদের পুরোনো বাড়ির উঠোনের লম্বা ঢ্যাঙা একমাথা ঝাঁকড়া সবুজ চুলের কামিনী গাছটা, আমার প্রথম প্রেমিক। প্রতিবারের বর্ষায় মাথায় সাদা টুপি পরে সে যখন প্রলুব্ধ করতে আসত, চারপাশে তখন সুগন্ধে ম'ম'। রানী সমেত মৌমাছির দল সারাদিন গুনগুন গানে ওর চারপাশটা ভরে তুলতো। একটু জোরে হাওয়া দিলে পালকের মতো ঝরে পড়ত সাদা পাপড়ি। পড়ার টেবিল থেকে মুখ তুলে ওর হাতছানির ভেতর হেঁটে হেঁটে কলঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতাম আর একটা ঝড়ো হাওয়ার, অথবা ঝুমবৃষ্টির। স্কুলের জন্যে তাড়া দিতে থাকা বন্ধুদের শত্রু মনে হত। ‘আসছি... যাই’ করে করে আরও খানিকটা সময় গাছটার নীচের ছাদখোলা কলঘরে দাঁড়িয়ে থাকতো বালিকা। বর্ষাশেষে নরম সবুজ নতুন পাতার ভেতর থেকে কয়েকটা সাদা পাপড়ি কুড়িয়ে বইয়ের ভাঁজে গুঁজে দিতে দিতে ভাবত, বারোমাস — সে কত দীর্ঘ! আঙুলের করে গুনে শেষ হয় না। অপেক্ষা মৃত মীনের চোখ, উল্টে পড়ে থাকে পড়ার টেবিলে কিছুদিন। তারপর বাসার সামনের ছাতিম গাছটা বুনো গন্ধের ফুল ফোটাতে শুরু করলে ছাতিম গাছটাকে মনে হত সবচাইতে প্রিয়। জানালার বাইরে মুগ্ধ চোখজোড়া ফেলে এসে অঙ্কের খাতা ভরে যেত ভুলে। আর সন্ধ্যায় স্যারের কাছে শাস্তি নিতে নিতে মনে হত আমি অবুঝের মতো এ কী করেছি। এই এই করে কখনো দোলনচাঁপা কখনো শিউলি কখনো চন্দ্রমল্লিকার চারপাশে ঘুরঘুর। ভূগোল বইয়ের পাতা থেকে উঠে গিয়ে, পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ফিরে আসতে আসতে আমার কামিনী গাছে বর্ষা নামে। ‘বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান’ শুনতে শুনতে বালিকা তার কলঘরের সময়কে প্রলম্বিত করে। কামিনীর সেই সুগন্ধি সাদা টুপির জন্যে, ঝড়-জল-কাদায় মোড়া বর্ষাকে মনে হত প্রিয় ঋতু। তারও অনেক পরে কোনো এক এপ্রিলের রাতে পৃথিবী কেমন বন্ বন্ করে ঘুরতে থাকে, বাতাসের গায়ে চাবুক পেটাতে থাকে নারকেলের পাতা। রাতভর শিব তার প্রলয়নাচন নেচে সব কেমন গুঁড়িয়ে দিতে থাকে! একসময় সব চুপকথা হয়ে গেলে ঘষা কাচের ভেতর দিয়ে আলো আসার মতো করেই ভোর আসে। ঘর থেকে বাইরে আসে কেবল বড়রা। ছোটদের কাজ কেবল জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা। একটু পর বাসার বারান্দায় আসার অনুমতি পেলে ছোটরা সব অবাক চোখে দেখতে এল বাসার উঠোনে মস্ত একটা আকাশ! এতকাল আকাশটা কেবল গাছেদের ছিল; আজ সকাল থেকে সেটা বাসার সবার হয়ে গেল।…

সেই কোন্ ছেলেবেলায় সকাল হতো ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’ শুনতে শুনতে। একই গানের ভিতর রোজ সকাল গড়িয়ে ইস্কুলের মাঠে। সেখানেও আসতেন তিনি [. . .]

সেই কোন্ ছেলেবেলায় সকাল হতো ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’ শুনতে শুনতে। একই গানের ভিতর রোজ সকাল গড়িয়ে ইস্কুলের মাঠে। সেখানেও আসতেন তিনি — ‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি’। রোজ সকাল থেকে রাত অবধি মাকে নানা ভাবে জ্বালিয়ে, কাঁদিয়ে, নির্বিঘ্নে যখন ঘুমিয়েছি, জানিনি মলিন মুখের মায়ের জন্যে ব্যথা হয়। জানিনি আমার চেনা মায়ের বাইরে আর যাকে মাতৃ রূপেন সংস্থিতা জেনে ভালবাসতে গিয়ে এই দূরের দেশে চোখ ভেসে যাবে জলে। রোজ এমন করেই জীবনের নানান অনুভবকে রাঙিয়ে দিয়ে, বাজিয়ে দিয়ে তিনি যখন আমার নিত্যদিনের ভিতর জুড়ে বসেন তখন বুঝি আর কেউ নয়, গানের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আর কেউ নন, তিনি নিজেই। সমস্ত দিন বৃষ্টিতে ভিজে এই শহরটা যখন একটা মনখারাপের চাদর জড়িয়ে ঘুরছে, তখন সন্ধ্যা নামার মুখে দূরের আকাশে মেঘ সরে গিয়ে একটুকরো সাদা মেঘে জড়িয়ে সূর্যটা উঁকি দিলে, আমি তাঁকেই যেন হাসতে দেখলাম আমার এই মেঘলা দিনের ভিতর। আর মনের ভিতর থেকে তিনিই গাইলেন ‘নূতন আলোয় নূতন অন্ধকারে/ লও যদি বা নূতন সিন্ধুপারে/ তবু তুমি সেই তো আমার তুমি,/ আবার তোমায় চিনব নূতন করে।’ এমন নিত্যজানার ভিতর দিয়ে আমার চিরকালের ভিতর যখন তিনি সত্যি হয়ে ওঠেন, আর সব কিছুকে ছাপিয়ে তাঁর উপস্থিতিই জীবন উপভোগের ইচ্ছেকে জাগায়। মনের ভিতর যে অসম্পূর্ণতা সারাক্ষণ অস্থির তাকে স্থিতি দিতেই গীতবিতানের পাতা উল্টে দেন। স্বরবিতানের সাথে পরিচয় ঘটেনি তখনও, গীতবিতানই কেবল উল্টেপাল্টে দেখতাম। সেইসব দিনগুলোতে মা কেমন উদাস গলায় গাইত ‘ভালোবেসে যদি সুখ নাহি’। কিসের অসুখ মায়ের সেটা জানবার অবকাশ ছিল না ওই বয়েসে। কেবল মায়ের রিনরিনে গলার ভিতর গানটাকে পেতে চাইতাম সে সময়ে। আরো কত পরে নিজের উপলব্ধিকে শাণিয়ে নিয়ে বুঝেছি ভালবেসেও অসুখী হবার ব্যথার ভিতর আমার মা আর রবি ঠাকুর মিলতেন। কিংবা তিনি হয়তো এমনি করেই নানান বয়েসের ভিতর নানান জনের নানান রূপের ঈশ্বর হয়ে ওঠেন। কোনো কোনো রুক্ষ রোদের দিনে উঠোনে কাপড় নাড়তে গিয়ে মায়ের সাথে গলা মিলিয়ে গেয়েছি ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে’। সমস্ত সংসারের চারদিকে রুক্ষ তাপ দুঃখ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যখন, সেই রকমের একটা সময়ে এই গান গাইবার মন মাকে রবি ঠাকুর পাইয়ে দিয়েছিলেন।…

দীর্ঘায়ুর সেই দুর্দৈবের ক্রমিক পুনরাবৃত্তি — কনিষ্ঠজন ও বন্ধুদের মৃত্যুশোক ভোগ। তারা ঝরে যায় গাছের পাতার মতো, ফুলের মতো নিঃশব্দে, প্রায়শ কোনো সংকেত ছাড়াই। গাছে আবার পাতা গজায়, ফুল ফোটে, কিন্তু মৃতেরা আর ফেরে না কোনো দিন। আনোয়ার চলে গেল ‘ফাল্গুনের অঙ্গন শূন্য করি’ ৩ মার্চ (২০১৪) বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায়। অথচ আমরা তার ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। [...]

দীর্ঘায়ুর সেই দুর্দৈবের ক্রমিক পুনরাবৃত্তি — কনিষ্ঠজন ও বন্ধুদের মৃত্যুশোক ভোগ। তারা ঝরে যায় গাছের পাতার মতো, ফুলের মতো নিঃশব্দে, প্রায়শ কোনো সংকেত ছাড়াই। গাছে আবার পাতা গজায়, ফুল ফোটে, কিন্তু মৃতেরা আর ফেরে না কোনো দিন। আনোয়ার চলে গেল ‘ফাল্গুনের অঙ্গন শূন্য করি’ ৩ মার্চ (২০১৪) বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায়। অথচ আমরা তার ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। ভাবি, আনন্দহীন এই শূন্য ভুবনে এখন আমার দিন কাটবে কীভাবে! আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী ছিলাম, থাকতাম ঢাকা হলে (১৯৫৬-৫৮)। করিডর দিয়ে তাকে হেঁটে যেতে দেখতাম, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গম্ভীর মুখ, কোনো কথা হতো না। আমার বন্ধুরা তাকে আড়ালে ‘মনীষী’ বলত; উপাধিটি সে জুটিয়েছিল কলকাতার এক বামপন্থী মাসিকপত্রে দর্শনবিষয়ক একটি প্রবন্ধ লেখার সুবাদে। ছাত্র ইউনিয়নের সভা-সমিতিতে তাকে কোনো দিন দেখিনি, বরং সে আমাদের এড়িয়েই চলত। তাই বরিশালের বিএম কলেজে তাকে দেখে এবং স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতা অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের জন্যই সে বরিশাল এসেছে শুনে অবাকই হয়েছি। যা হোক বরিশালেই তার সঙ্গে আলাপ ও বন্ধুত্ব! ওখানে সে বেশিদিন থাকেনি, চলে যায় ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজে, সম্ভবত ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের অসুবিধায়। কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক বছরের বৃত্তি নিয়ে সে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমায় এবং রিডিং ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা শুরু করে। ভেবেছি অন্যদের মতো সেও পিএইচডি ডিগ্রি না নিয়ে ফিরবে না। কিন্তু বৃথা। এক বছরের মাথায় সে ফিরে এল। খবর শুনে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় দেখা করতে গেলাম এবং ফিরে আসার কারণ শুনলাম। বলল, ও দেশে লেখকদের খুব সমাদর, তাই একটি বই লিখে আবার ফিরবে। সে বই আর কোনো দিন লেখা হয়নি, বিদেশে শিক্ষালাভও নয়। কিছুদিন কবি ইয়েটস ছিলেন তার প্রধান আলোচ্য, যেন তাঁকে নিয়েই বইটি লিখবে। একসময় স্থলবর্তী হলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে নিয়ে যা-কিছু লিখেছিল তার প্রায় সবই পড়ে আছে দুষ্পাঠ্য পাণ্ডুলিপির খসড়ায়। আমি ১৯৬২ সালে বরিশাল ছেড়ে নটের ডেম কলেজে চলে আসি, আনোয়ার তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকতাম তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ায়। ঢাকা এলে বাড়িতে ব্যাগ ফেলে সে ছুটে আসত এখানে, তারপর আমাকে টেনে নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী ফেরা। আমিও থেকে যেতাম কয়েক দিন। সেসব দিনে আমরা প্রায় প্রতিদিন রমনা পার্কে কিছুক্ষণ কাটিয়ে এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে পৌঁছতাম নিউমার্কেটে, ঢুঁ মারতাম বইয়ের দোকানগুলোতে। শেষে নীলক্ষেত ও মতিঝিল হয়ে…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.