আমাদের পুরোনো বাড়ির উঠোনের লম্বা ঢ্যাঙা একমাথা ঝাঁকড়া সবুজ চুলের কামিনী গাছটা, আমার প্রথম প্রেমিক। প্রতিবারের বর্ষায় মাথায় সাদা টুপি পরে সে যখন প্রলুব্ধ করতে আসত, চারপাশে তখন সুগন্ধে ম’ম’। রানী সমেত মৌমাছির দল সারাদিন গুনগুন গানে ওর চারপাশটা ভরে তুলতো। একটু জোরে হাওয়া দিলে পালকের মতো ঝরে পড়ত সাদা পাপড়ি। পড়ার টেবিল থেকে মুখ তুলে ওর হাতছানির ভেতর হেঁটে হেঁটে কলঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতাম আর একটা ঝড়ো হাওয়ার, অথবা ঝুমবৃষ্টির। স্কুলের জন্যে তাড়া দিতে থাকা বন্ধুদের শত্রু মনে হত। ‘আসছি… যাই’ করে করে আরও খানিকটা সময় গাছটার নীচের ছাদখোলা কলঘরে দাঁড়িয়ে থাকতো বালিকা। বর্ষাশেষে নরম সবুজ নতুন পাতার ভেতর থেকে কয়েকটা সাদা পাপড়ি কুড়িয়ে বইয়ের ভাঁজে গুঁজে দিতে দিতে ভাবত, বারোমাস — সে কত দীর্ঘ! আঙুলের করে গুনে শেষ হয় না।
অপেক্ষা মৃত মীনের চোখ, উল্টে পড়ে থাকে পড়ার টেবিলে কিছুদিন। তারপর বাসার সামনের ছাতিম গাছটা বুনো গন্ধের ফুল ফোটাতে শুরু করলে ছাতিম গাছটাকে মনে হত সবচাইতে প্রিয়। জানালার বাইরে মুগ্ধ চোখজোড়া ফেলে এসে অঙ্কের খাতা ভরে যেত ভুলে। আর সন্ধ্যায় স্যারের কাছে শাস্তি নিতে নিতে মনে হত আমি অবুঝের মতো এ কী করেছি। এই এই করে কখনো দোলনচাঁপা কখনো শিউলি কখনো চন্দ্রমল্লিকার চারপাশে ঘুরঘুর। ভূগোল বইয়ের পাতা থেকে উঠে গিয়ে, পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ফিরে আসতে আসতে আমার কামিনী গাছে বর্ষা নামে।
‘বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান’ শুনতে শুনতে বালিকা তার কলঘরের সময়কে প্রলম্বিত করে। কামিনীর সেই সুগন্ধি সাদা টুপির জন্যে, ঝড়-জল-কাদায় মোড়া বর্ষাকে মনে হত প্রিয় ঋতু। তারও অনেক পরে কোনো এক এপ্রিলের রাতে পৃথিবী কেমন বন্ বন্ করে ঘুরতে থাকে, বাতাসের গায়ে চাবুক পেটাতে থাকে নারকেলের পাতা। রাতভর শিব তার প্রলয়নাচন নেচে সব কেমন গুঁড়িয়ে দিতে থাকে! একসময় সব চুপকথা হয়ে গেলে ঘষা কাচের ভেতর দিয়ে আলো আসার মতো করেই ভোর আসে। ঘর থেকে বাইরে আসে কেবল বড়রা। ছোটদের কাজ কেবল জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা। একটু পর বাসার বারান্দায় আসার অনুমতি পেলে ছোটরা সব অবাক চোখে দেখতে এল বাসার উঠোনে মস্ত একটা আকাশ! এতকাল আকাশটা কেবল গাছেদের ছিল; আজ সকাল থেকে সেটা বাসার সবার হয়ে গেল। বড়দের চোখ বাঁচিয়ে একছুটে চলে এসছিলাম কামিনী গাছটার কাছে। মাটিতে নুয়ে পড়া মাথাটায় হাত বুলিয়ে জেনেছি শত চেষ্টায়ও সে আর ফিরবে না। অভিমানের করুণ বৃষ্টি চোখ ছাপিয়ে বুক ছাপিয়ে, চুপিচুপি ওর ঝাঁকড়া চুলের কাছে মুখ গুঁজে বলেছি — ভালো থেকো, ফুল। সেই প্রথম প্রেম ভেঙে যাবার যন্ত্রণায় মনের মধ্যে ঝুমবৃষ্টি, বুকের নীচে দমকা হাওয়া আর পাশের ঘরে বড়পা’র নতুন শেখা ‘ওগো নিঠুর দরদী’।
দু-চারটা হাত-পা ভেঙে কী করে যেন টিকে গেল ছাতিম গাছটা। আর কামিনী গাছটার জায়গায় একটা ল্যাংড়া আমের গাছ আদরে ডালপালা মেলতে শুরু করল। তারপর থেকে ঝুমবৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়া কাউকেই ডাকেনি বালিকা। কেবল টিনের বাক্সের ভেতর পুতুলের সংসার নেড়েচেড়ে রেখে কৈশোরকে বলেছে — আয়। এইভাবে আয় আয় করে বয়েস বাড়িয়ে নিয়ে জেনেছে শোকের আয়ু কম বলেই মানুষ বাঁচে। কোনো এক বর্ষণমন্দ্রিত সন্ধ্যায় পাশের বাসা থেকে চেয়ে এনেছে দোলনচাঁপা আর বেলি ফুলের গাছ। সমান প্রেমে ওদের গোড়ায় জল ঢালতে ঢালতে বুঝেছে মানুষ মূলত বহুগামী।
কনকনে ঠাণ্ডা বৃষ্টি আর দমকা বাতাস থেকে বাঁচতে ছুটে এসে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে দেখি বাসটা এগিয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার ‘অপেক্ষা’ শব্দটা বানান করতে করতে দেখি পকেটের ফোনটা নড়েচড়ে জানান দিচ্ছে, ম্যাসেজ ফর ইউ। সাত সাগর পাড়ি দিয়ে আসা আষাঢ়ের প্রথম দিনের বার্তা। মাথার উপর টুপ করে পড়া ম্যাপেলের মরা ফলটাকে কদম বলে ভুল হয়ে যায়। স্পর্শকাতর ফোনটার শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফিরতি জানিয়ে দেই এখানে শীত ঋতু, বরফ গলা জল, ঝড়ো হাওয়ার দিন। দশই জুলাই কত দূর, বেয়াল্লিশ মাসে কত দিন হয়? ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরি।
রুম হিটারটা চালিয়ে দিয়ে মেইল বক্সে হানা দিই। পৃথিবীর আরেক প্রান্ত থেকে লিখতে না-পারার যন্ত্রণা জানায় রুদ্র বাউল। জগৎ-সংসার সামলাতে সামলাতে অস্থির হয়ে পুরোনো লেখা শেয়ার করে জানান দেয়, লিখেছিলাম। আমি ওর ব্যথা জানলার বাইরের আকাশ চুঁইয়ে নামতে দেখি। গীতবিতান থেকে নেমে এসে ভেজা ভেজা গানগুলো মাথার ভেতর কানের ভেতর বৃষ্টি নামায়। মেইল বক্স থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ছেলেবেলার ভেতর হামাগুঁড়ি দিয়ে সোজা খাটের নীচে। অন্ধকার হাতড়ে টেনে বের করি টিনের বাক্সে রাখা পুতুলের সংসার, এলোমেলো করে দিতে দিতে ভাবি বাবা বুঝি ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ হাতে নিয়ে পড়তে ডাকবে। বাবার দিকে ছুটে যেতে যেতে দেখি বুড়ো জেলের মুখটা বাবার। চোখটা কেমন ঝাপসা ঠেকে, মনে হয় চোখের জলে নামল জোয়ার। ফিশ অয়েল, গরম জামা, ব্যথার ওষুধ গুছিয়ে নিতে নিতে শুনতে পাই ঝুমবৃষ্টির ধুন। দমকা বাতাসে উল্টে যায় ভূগোল বইয়ের পাতা। দেখি মাথা নিচু করে বালিকা পড়ে চলেছে ‘দক্ষিণ গোলার্ধে যখন গ্রীষ্মকাল উত্তর গোলার্ধে তখন…’। উত্তর গোলার্ধে বসে জানছি দক্ষিণ গোলার্ধে খুব গুছিয়ে আঙুলের করে দিন গুনছে কেউ — এক দুই তিন করে। দূরে এই ঝাপসা মেঘের দিন। এই ভারী ঠাণ্ডা আর বাউল বাতাসের ভেতর বৃষ্টির ছাঁট কেটে কেটে আমিও এক দুই করে কদম গুনে গুনে ভাবছি কতোটা পথ পেরুলে বাড়ির মাথার নারকেল গাছটা মাথা দুলিয়ে বলবে, ‘এসে গেছে’! বয়সের ভারে ন্যুব্জ আমাদের বাড়িটার পেটের ভেতর ঢুকে গেলে কী দারুণ উষ্ণ বুক আমার বাবার। কী অবিশ্রাম কান্না আমার ভীষণ সাহসী মায়ের। ঠিক তখন আমার বয়েস কমে যাবার কথা, কিন্তু বয়েস না কমে বেড়ে গেলে আমার গলার স্বর খানিকটা ভেজা আর ভারী হয়ে যাবে। ‘এই যে আমি, এই যে আমি’ বলে সান্ত্বনা দিতে দিতে, আঙুলের করে নতুন করে গুনতে শেখা আমার মা-কে খুকি মনে হবে যখন, জানি বৃষ্টি নামবে টিনের চালে। বুকের ভেতর বৃষ্টি পড়ে বলে সুমনের সেই দীর্ঘ গান বৃষ্টির ভেতর রঙ মিশিয়ে সব ভিজিয়ে দেবে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৩ comments
mahtab - ২ জুলাই ২০১৪ (১১:৪৭ পূর্বাহ্ণ)
অসাধারন।খুবই ভাল।
লুসিফার লায়লা - ৩ জুলাই ২০১৪ (২:১৭ অপরাহ্ণ)
মাহতাব
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শাহ আলম বাদশা - ১৯ আগস্ট ২০১৪ (১০:১১ অপরাহ্ণ)
ভাল্লাগলো। তবে শিরোনাম ভুলবানানে লিখেছেন-হবে স্মৃতি সত্তা=স্মৃতিসত্তা