সেই কোন্ ছেলেবেলায় সকাল হতো ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’ শুনতে শুনতে। একই গানের ভিতর রোজ সকাল গড়িয়ে ইস্কুলের মাঠে। সেখানেও আসতেন তিনি — ‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি’। রোজ সকাল থেকে রাত অবধি মাকে নানা ভাবে জ্বালিয়ে, কাঁদিয়ে, নির্বিঘ্নে যখন ঘুমিয়েছি, জানিনি মলিন মুখের মায়ের জন্যে ব্যথা হয়। জানিনি আমার চেনা মায়ের বাইরে আর যাকে মাতৃ রূপেন সংস্থিতা জেনে ভালবাসতে গিয়ে এই দূরের দেশে চোখ ভেসে যাবে জলে। রোজ এমন করেই জীবনের নানান অনুভবকে রাঙিয়ে দিয়ে, বাজিয়ে দিয়ে তিনি যখন আমার নিত্যদিনের ভিতর জুড়ে বসেন তখন বুঝি আর কেউ নয়, গানের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আর কেউ নন, তিনি নিজেই।
সমস্ত দিন বৃষ্টিতে ভিজে এই শহরটা যখন একটা মনখারাপের চাদর জড়িয়ে ঘুরছে, তখন সন্ধ্যা নামার মুখে দূরের আকাশে মেঘ সরে গিয়ে একটুকরো সাদা মেঘে জড়িয়ে সূর্যটা উঁকি দিলে, আমি তাঁকেই যেন হাসতে দেখলাম আমার এই মেঘলা দিনের ভিতর। আর মনের ভিতর থেকে তিনিই গাইলেন ‘নূতন আলোয় নূতন অন্ধকারে/ লও যদি বা নূতন সিন্ধুপারে/ তবু তুমি সেই তো আমার তুমি,/ আবার তোমায় চিনব নূতন করে।’ এমন নিত্যজানার ভিতর দিয়ে আমার চিরকালের ভিতর যখন তিনি সত্যি হয়ে ওঠেন, আর সব কিছুকে ছাপিয়ে তাঁর উপস্থিতিই জীবন উপভোগের ইচ্ছেকে জাগায়। মনের ভিতর যে অসম্পূর্ণতা সারাক্ষণ অস্থির তাকে স্থিতি দিতেই গীতবিতানের পাতা উল্টে দেন।
স্বরবিতানের সাথে পরিচয় ঘটেনি তখনও, গীতবিতানই কেবল উল্টেপাল্টে দেখতাম। সেইসব দিনগুলোতে মা কেমন উদাস গলায় গাইত ‘ভালোবেসে যদি সুখ নাহি’। কিসের অসুখ মায়ের সেটা জানবার অবকাশ ছিল না ওই বয়েসে। কেবল মায়ের রিনরিনে গলার ভিতর গানটাকে পেতে চাইতাম সে সময়ে। আরো কত পরে নিজের উপলব্ধিকে শাণিয়ে নিয়ে বুঝেছি ভালবেসেও অসুখী হবার ব্যথার ভিতর আমার মা আর রবি ঠাকুর মিলতেন। কিংবা তিনি হয়তো এমনি করেই নানান বয়েসের ভিতর নানান জনের নানান রূপের ঈশ্বর হয়ে ওঠেন। কোনো কোনো রুক্ষ রোদের দিনে উঠোনে কাপড় নাড়তে গিয়ে মায়ের সাথে গলা মিলিয়ে গেয়েছি ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে’। সমস্ত সংসারের চারদিকে রুক্ষ তাপ দুঃখ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যখন, সেই রকমের একটা সময়ে এই গান গাইবার মন মাকে রবি ঠাকুর পাইয়ে দিয়েছিলেন। আর আমার ছোট্ট বুকের ভিতর মায়ের সেই প্রাণ ঢেলে গাইবার ছবিটি চিরকালের জন্যে আঁকা হয়ে গেল। মুগ্ধতায় চোখের পাতা নেমে এলে মা আর রবি ঠাকুর পাশাপাশি; এ যেন ‘আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি’।
গীতবিতান খুঁজে স্বরবিতান সাথে নিয়ে রত্না পিসির হাত ধরে প্রথমবার শেখা রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘তাই তোমার আনন্দ আমার ’পর’। গানটা বাণী না বুঝেই সেদিন শিখেছি; আর একটু সময় গড়ালে বাণীটা আবিষ্কার করলাম কোনো এক প্রার্থনার মুহূর্তে। গীতবিতানের সমস্ত পূজা পর্যায়ের গানের ভিতর যে-ঈশ্বরকে কুড়িয়ে পেলাম সে যেন দীর্ঘদিনের জানাকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিল। ছেলেবেলায় বড়োদের মুখে শোনা, ধর্ম-শিক্ষকের বয়ানের ভিতর যে জুজুর-ভয়-দেখানো ঈশ্বর তাঁকে আর কোথাও খুঁজে পেলাম না। ঈশ্বর যে বন্ধু, প্রিয়, জীবনস্বামী, বঁধুর মতো এত প্রিয় এত কাছের হয়ে ধরা দিতে পারেন রবি ঠাকুর না থাকলে তা জানতাম কী করে? কেমন করে এমন অধিকার নিয়ে তাকে মিলতে ডাকতাম ‘হাতখানি ওই বাড়িয়ে আনো, দাও গো আমার হাতে —/ ধরব তারে ভরব তারে, রাখব তারে সাথে’? কী করে তিনি লিখলেন ‘আরো প্রেমে আরো প্রেমে/ মোর আমি ডুবে যাক নেমে’। আরো অনেক পরে রবীন্দ্রনাথের (লেডি রানু মুখোপাধ্যায়কে) লেখা চিঠিতে মিলেছে উত্তর। তিনি লিখছেন, ‘আমাদের যে ঠাকুরকে আমরা প্রণাম করি, তিনি যত বড়ো তার সমস্তটা যদি সম্পূর্ণ আমাদের সামনে আসত, তা হলে সে আমরা সইতে পারতুম না। কিন্তু হিমালয় পাহাড়ের মত আমরা তাঁর বুকের উপর দিয়ে ক্রমে ক্রমে উঠি। যতই উঠি না কেন, তিনি আমাদের একেবারে ছাড়িয়ে যান না — বরাবর আমাদের সঙ্গী হয়ে তিনি আমাদের আপনি উঠিয়ে নিতে থাকেন। বুদ্ধিতে বুঝতে পারি তিনি আমাদের ছাড়িয়ে আছেন। কিন্তু ব্যবহারে বরাবর তাঁর সঙ্গে আমাদের সহজ আনাগোনা চলতে থাকে। তাই তো তাঁকে বন্ধু বলতে আমাদের কিছু ঠেকে না— তিনি তাঁর উপর থেকে হেসে আমাদের বন্ধু বলেন।’ আমাদের নিত্যদিনের ছোট গণ্ডির ভিতর ঈশ্বরকে কেমন খাপে মিলিয়ে বসিয়ে দিলেন রবি ঠাকুর! যে-ঈশ্বর ঠুনকো চাওয়া-পাওয়ার ভিতর থেকে বাইরে এসে অসীম অনুভবের ভিতর দাঁড়ালেন।
এমন কত কিছু পাইয়ে দিতে গানগুলোর ভিতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আসেন আমাদের ঘরে, মনে, আমাদের খোলা প্রান্তরে। আর আমি এই প্রাপ্তির ভিতর হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। সকালবেলায় জানালার ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ড্ টেনে আলো ডাকতে গিয়ে তাকে নিয়ে ফিরি। দুপুরের রোদে পুড়তে পুড়তে যখন সব কিছুকে কেমন হেলায় তাকিয়ে ফেলে আসতে চাই, সেই সব উদাস সময়ে প্রিয় সব মুখের ছবি হয়ে তিনি আসেন বুকের ভিতর। আমার সমস্ত উদাসীনতাকে বাজিয়ে দিয়ে আমাকে দিয়েই গাইয়ে নেন — ‘এ মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে/ তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে’। চরাচর ছাপিয়ে যখন সন্ধ্যা নামে এখানে, তখন কি এক অদ্ভুত বিষাদের ভিতর সব কেমন হারিয়ে যেতে শুরু করে। স্বস্তির আশায় মন অস্থির হতে চায়। তেমনি এক সন্ধ্যায় প্রথমবার শুনি ‘এ পরবাসে রবে কে হায়’। সন্ধ্যা যেন একটু বেশি তাড়াতাড়ি নেমে এসেছিল সেদিন। চোখ ঝাপসা হয়ে বাইরের সব ছবি কেমন জলে ধুয়ে যেতে শুরু করলে বুকের কাছে ক্রমাগত বেজেছে ‘হেথা কে রাখিবে দুখভয়সঙ্কটে—/ তেমন আপন কেহ নাহি এ প্রান্তরে হায় রে’।
এই যে এমন করে দাগ কেটে দিয়ে বাজে এই গানগুলো নানান মুহূর্তে, তখন বুঝি সুরের নয় বাণীর ভার গানগুলোকে কাঠামোগত ভাবে সুসংহত করেছে। ফলে বাণীটা ঠিক বোধগম্য না হলে এই গানগুলো কেবল গাওয়া হয়, সঙ্গীত ঠিক হয়ে ওঠে না। তবু আজকাল এই গানগুলোকে গায়ের জোরে ‘আধুনিক’ করে তুলবার একটা চেষ্টা চোখে পড়ে। আমার মতো অনাধুনিক আটপৌরে মনের শ্রোতা এতে অস্বস্তিতে পড়ে, কেননা এর গায়কীও এই গানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভারী ভারী যন্ত্রের সাথে মাথা দুলিয়ে লাফঝাঁপ দিয়ে চিৎকার করে গাইলে ‘দূর হতে আমি তারে সাধিব, গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব’র যে-ব্যথা যে-আবেদন সেটা আর মুখ্য থাকে না। কেবল গানগুলো ক্রমশ দূরে আরো দূরে সরে যেতে থাকে।
রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতা ভালবাসতেন, নতুন কিছুর সাথে যুক্ত হতে চাইতেন সবসময়ই। সরলা দেবী পিয়ানোতে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গানের নোট তৈরি করে দিয়েছিলেন; এতে তিনি এতটাই আনন্দিত হয়েছিলেন যে পরে সে-কথা ইন্দিরা দেবীকে লিখে জানিয়েছিলেন। বিদেশি গানের সুরে নিজের কথা বসিয়ে নিয়ে গান তৈরির কাজটি তাঁর আগে কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই। প্রাণ ভরে সমস্ত জগৎ থেকে গ্রহণ করতে পারতেন বলেই অমন অকাতরে উজাড় করতে পেরেছেন নিজের সৃষ্টিশীলতাকে। এমন যাঁর আধুনিকতার বোধ তাঁর গানগুলোর নতুন করে কোনো আধুনিক আচ্ছাদনের দরকার আছে বলে মনে হয় না। বলছি না আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করা যাবে না; বলছি — বাণীপ্রধান গানগুলো যদি অযাচিত যন্ত্রসঙ্গীতের সুরের ভিতর কেবল গাইবার জন্যে গাওয়া হয় তাহলে গানগুলোর আবেদন নষ্ট হয়। যন্ত্রের বহুল ব্যবহার সুরকে মুখ্য করে দিতে চাইলে বাণীগুলো ভাবনা তৈরির সুযোগ পায় না। আমাদের মতো অনাধুনিক শ্রোতার জীবনে এই বাণীগুলো আপনা থেকেই ঝড় তৈরি করে বলেই সুরগুলোও তেমন করে বাজে। যেমন করে বাজলে গানের ভিতর দিয়ে ভুবন দেখার অনুভব হয়। মনে হয় — ‘তখন তারি আলোর ভাষায় আকাশ ভরে ভালবাসায়,/ তখন তারি ধুলায় ধুলায় জাগে পরম বাণী’।
শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ ?
