দৃশ্যত আলী আনোয়ার-এর মৃত্যু ঘটেছে। ৩ মার্চ বাংলাদেশ সময় রাত দশটায় তিনি তার পৃথিবীকে আলাদা করে নিয়েছেন আমাদের থেকে। কিন্তু ১৯৭০ সালে বিদ্যাসাগরের সার্ধশতবার্ষিকীর সময় থেকে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে তিনি যে নিভৃত অথচ গভীর ভূমিকা রাখতে শুরু করেন, যার প্রকাশ ঘটে 'বিদ্যাসাগর' সংকলনটির মধ্যে দিয়ে, অথবা যে একাগ্র ভূমিকা তিনি রাখেন ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' বিষয়ক সিম্পোজিয়ামে যুক্ত থেকে এবং ১৯৭৩ সালে সংশ্লিষ্ট সংকলন প্রকাশের মধ্যে দিয়ে, সামরিক শাসনবিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে, সেসব অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে আমাদের সংস্কৃতিচর্চার ইতিহাসে। 'ধর্মনিরপেক্ষতার জন্যও সাহসের প্রয়োজন।' — বলেছিলেন তিনি। আমরা তাঁর এ কথার সত্য উপলব্ধি করছি এখন মৌলবাদীদের হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন-নিপীড়ন ও বোমাবাজির শিকার হয়ে।

বিদ্যাসাগরের গভীর কোনো ইচ্ছা বা অবকাশ ছিল না সমাজ প্রক্রিয়াকে সামগ্রিকভাবে বুঝে নেওয়ার, এরকমই মনে করেন আলী আনোয়ার; মনে করেন তিনি, বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিত্বও ছিল এর প্রতিবন্ধক। বিদ্যাসাগরের সাহস ছিল, ছিল আত্মবিশ্বাস, বিবেকবুদ্ধি, সহানুভূতি আর চিন্তার ক্ষমতাও; আরো ছিল রাজনৈতিক আত্ম-অপসারণ বা সমষ্টির রাজনৈতিক ভূমিকার উপলব্ধির সংকট। সব মিলিয়ে আত্মনির্ভরতা ও নেতৃত্বের ক্ষমতায় আস্থা হয়ে উঠেছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের উপকরণ মাত্র। এভাবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মধ্যে দিয়ে আসলে ব্যক্তির সীমানা উপলব্ধির প্রয়াস চালান আলী আনোয়ার। সে-প্রয়াসের কারণে আমরা পৌঁছাই এই সত্যে যে, ‘তাঁর আন্দোলনের সাফল্য যেমন শুধুমাত্র ব্যক্তি নেতৃত্বের ফলাফল নয়, তাঁর ব্যর্থতাও শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা দিয়ে বিচার্য নয়...।’ ধর্মাশ্রয়ী আন্দোলনে সামাজিক মুক্তি আসবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় ছিল তাঁর, শিক্ষাকে তিনি করে তুলতে চেয়েছিলেন ‘যুক্তি-আশ্রয়ী, বিজ্ঞানমুখিন ও ধর্মনিরপেক্ষ’। রক্ষণশীল বিপ্লবাতঙ্ক থেকে তিনি সংস্কার আন্দোলন শুরু করেননি, যদিও বাঙালি সমাজে তাঁর প্রতীকী উদাহরণ হয়ে ওঠার কারণ ছিল তাঁর চরিত্রশক্তি। ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর শানানো রাজনৈতিক চিন্তার তুলনায় পিছিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত তিনি এগিয়ে থাকেন ওই কারণেই। আলী আনোয়ার তাঁর সদ্যপ্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ সাহিত্য-সংস্কৃতি নানা ভাবনা অবশ্য এই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরবিষয়ক প্রবন্ধ দিয়ে শুরু করেননি। শুরু করেছেন শিল্পের সংজ্ঞা নির্ণয়-সংক্রান্ত সমস্যা নামের প্রবন্ধটি দিয়ে। কিন্তু শিল্পের সংজ্ঞা নির্ণয় থেকে শুরু করে সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান যেটির কথাই বলা হোক না কেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, পাবলো নেরুদা, ওয়াহিদুল হক, ওরখান পামুক কিংবা শিরিন এবাদি যাঁর কথাই বলা হোক না কেন, সমাজ-প্রক্রিয়াকে বোঝার বিষয়টি কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে থাকেই। আর সমাজটি যদি হয় বাঙালি সমাজ, তাহলে অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে এ-সমাজে পরিবর্তনের প্রেরণা নিয়ে সংঘটিত সামাজিক সংস্কারের প্রসঙ্গ, আসে তেমন সংস্কারের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই পথিকৃৎকে বিংশ শতাব্দীর অনেক চিন্তক-শিক্ষাবিদই নানাভাবে উদ্ঘাটন করেছেন; আলী আনোয়ার করেছেন বিষাদে ছোঁয়া নিঃসঙ্গ বিদ্যাসাগরকে, ব্যক্তির সীমানা উদ্ঘাটন করতে থাকা বিদ্যাসাগরকে। আলী আনোয়ারের দুটি লেখা আছে এ-গ্রন্থে বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে (বিক্ষত বিদ্যাসাগরের নির্বেদ ও নৈরাশ্য, বিদ্যাসাগর ও ব্যক্তির সীমানা)। নানা প্রশ্ন জাগান তিনি, চেষ্টা করেন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার এবং এরকম প্রশ্ন ও প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে দিয়ে স্থাপিত হয় আরো প্রশ্নের। ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক এই তিন আপাতবিচ্ছিন্ন ক্ষেত্রকে স্পর্শ করে বিস্তৃত…

আমাদের সাধারণ বুদ্ধির মধ্যবিত্ত নিরাপত্তা-বোধের মুখে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো (অথবা অভয় দেখানো) একটি কৃশকায়, খর্বকায় মানুষের বেশ একটা জম্পেশ বড় মাপের দীঘল জীবন চোখের সামনে খাপ খোলে, বিশ্বাস হয় না সব কথা -- কখনো কষ্ট হয়, কখনো ঈর্ষা হয়, কখনো বাকরুদ্ধ ভালবাসায় ভরে যায় মন। লিখেছেন কোনো এক কাবুলিওয়ালার কাছে বেশ কিছু টাকা ঋণ নিয়ে ঋণের সুদের মাসিক বকেয়া মেটানোর তাগিদে । লিখতে কি ভালো লাগে মশাই? আমি তো লিখে খাই, খেয়ে লিখি -- ইত্যাকার হাস্য-উর্দ্রেককারী টিপ্পনি, অথচ হেসে উড়িয়ে দেবার জো নেই এই সব আপাত বুদবুদের মত নিঃসংকোচ কথাকে । [...]

শিবরাম বা শিব্রাম চক্রবর্তীর বেজায় মিষ্টির আসক্তি । বিশেষ করে রাবড়ি বা রসগোল্লা জাতীয় রসের মিষ্টি । এর সঙ্গে তার একান্ত উপাদেয় রসে টইটম্বুর লেখার কোনো যোগাযোগ বোধহয় --- টক ঝাল মিষ্টি তেতো কষায়, যেকোনো অভিজ্ঞতাকে মধুর প্রলেপ দিয়ে, আগাগোড়া সুমিষ্ট লেখনীর রসে জারিয়ে রসনা ও মনের খোরাক করে তোলা কম কথা নয় । বইখানা পড়ে একটু প্রসন্ন আশ্চর্য-ভাবাপন্ন মুগ্ধতায় আপ্লুত আছি । এবার বিদিত থেকে আনা, শিব্রামের ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা, তাঁর অদ্বিতীয় আত্মজীবনীর প্রথম ভাগ । কথার পিঠে কথার খেলা, শব্দের লোফালুফি, বিনা লাফালাফিতেই তিনি যেভাবে ব্যবহার করে থাকেন, তাতে তাঁকে king অফ puns বলাই যায় অনায়াসে -- সেই পানাভ্যাসে আমরাও আসক্ত, আরক্ত না হয়ে পারছি না দেখা যায়! তাঁর এই অনুপ্রাসিক শব্দের অক্লেশ, অহর্নিশ জাগলিং, জিমন্যাস্টিকস-এর জেল্লায় আমাদের কিশোর-পাঠে হর্ষবর্ধন গোবর্ধনের পার্টনারশিপ আমাদের রাম-হাসি বা শিবরাম-হাসি সাপ্লাই করেছিল নিশ্চয়ই । কিন্তু তাঁর জীবনকাহিনী আমার পড়া অন্য জীবনকাহিনী থেকে বিসদৃশ ভাবে আলাদা । কেন? তাই ব্যক্ত করার দুর্বল চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছি। শুরুতেই শিবরাম বলে নিয়েছেন তাঁর শৈশব ছিল ঈশ্বর-পীড়িত । মা বাবা দুজনই অসাধারণ দুটি মানুষ কিন্তু তাঁর । পরে বুঝতে পারি তাঁর Bohemian জীবনের বীজ ওই বাবার বৈরাগী পদ্ব্রাজক ভাব, আর মার নিরাসক্ত আত্মশক্তির মধ্যেই বোধ হয় । চাঁচোলের এক রাজ-পরিবারেই তাঁর জন্ম -- সম্পর্কের কাকা ছিলেন রাজা, কিন্তু রাজ-জোটক ছিল না তাঁর কপালে । বাবা ছোট বেলায় সংসার-ত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে ছিলেন, পরে এসে বিয়ে করেন তাঁর মা-কে । দুজনই সাদাসিধে মানুষ, গন্য মান্য ছিলেন, কিন্তু মনে হয় কোনো উন্নাসিকতার মধ্যে ছিলেন না । মা-ই ছিলেন শিব্রামের গুরু, বন্ধু, সবই । তাঁর কাছেই তিনি যা কিছু সার শিখেছেন । তার পর তার সঙ্গে জারিয়ে নিয়েছেন জীবনের অভিজ্ঞতা । ওই বাড়ির পাশেই প্রতিবেশীর কন্যা রিনির সঙ্গে শিব্রামের বন্ধুত্ব এবং বাল্যপ্রেম । একেবারেই মধুর, বাল্যকাল থেকে বয়ঃসন্ধির টলটলে আবেগে ভরা । সবচেয়ে সুন্দর হলো, এই প্রেমে আপাত ভাবে কোনো অপরিচয়ের আড়াল, কোনো রহস্য ছিল না । পুরোটা স্বচ্ছ ও অবারিত । রিনিকে নিয়েই সেসময় শিব্রামের জগত আবর্তিত । কিন্তু রিনিরা সপরিবারে কলকাতায় চলে যায়। রিনির মা ভেবেছিলেন সেখানে রিনিদের বিয়ের…

এইখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সাদত হাসান মান্টো। তাঁর সঙ্গে মাটি-চাপা পড়ে আছে ছোটগল্প রচনার যাবতীয় কারুকৃতি আর প্রহেলিকা [...]

লাহোরে তাঁর সমাধিতে এই এপিটাফের দেখা মিলবে না। কট্টরপন্থী আর মৌলবিদের ভয়ে তাঁর আত্মীয়রা এই স্মৃতিলিপি উৎকীর্ণ করাননি। তবু আজ জন্মশতবর্ষে তাঁর গল্প-রেখাচিত্র-স্মৃতিকথার নিবিড় পাঠের মধ্য দিয়ে না-দেখা সেই কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আমরা নির্ভুল পড়ে নিতে পারি লেখকের স্বরচিত এই এপিটাফ : এইখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সাদত হাসান মান্টো। তাঁর সঙ্গে মাটি-চাপা পড়ে আছে ছোটগল্প রচনার যাবতীয় কারুকৃতি আর প্রহেলিকা... তাল তাল মাটির নীচে শুয়ে তিনি আপনমনে ভাবছেন, তাঁদের দু’জনের মধ্যে মহত্তর ছোটগল্পলেখক কে : ঈশ্বর না কি তিনি। মৃত্যু : ১৮ জানুয়ারি ১৯৫৫। জন্ম : ১১ মে ১৯১২।

তিনি যদি ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত না নিতেন, তবে হয়তো তাঁর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত। ভারত যাওয়ার সিদ্ধান্ত এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহেই নেন। সে সময় মওলানা সায়েব নিজের বাড়ি হারিয়ে (পাকিস্তানি বাহিনী তাঁর সন্তোষের বাড়ি ইতিমধ্যেই পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল।) ব্রহ্মপুত্র নদে নৌকার মধ্যে বাস করতেন। নৌকায় আত্মগোপন কালে নিজ পার্টি ন্যাপ-এর সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ ছিল না।[...]

সদ্যপ্রয়াত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের 'মধ্যরাতের অশ্বারোহী' বই থেকে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশটি এখানে তুলে দিলাম। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও ভারতে মওলানা ভাসানীর অঘোষিত গৃহবন্দিত্ব নিয়ে ফয়েজ আহমদের এই অনবদ্য রচনাটি আমার খুবই প্রিয় -- অসাধারণ গদ্য এবং রাজনৈতিক কাহিনী ও মুহূর্তের প্রকাশের এক অনন্য দলিল এই লেখাটি। মওলানা ভাসানীর ভারত আবিষ্কার ফয়েজ আহমদ মওলানা ভাসানী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার প্রাক্কালেই সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে লন্ডনে বিপ্লবী অস্থায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরিকল্পিত এই বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই তিনি একাত্তর সালের আটই এপ্রিল লন্ডনের পথে আত্মগোপন করে ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন। ভারত থেকে লন্ডন পৌঁছানোর সহজ পথ বেছে নেবার সিদ্ধান্তটি ছিল ভ্রান্ত। এই রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের ফলেই তিনি ভারত সরকার কর্তৃক অঘোষিত গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। এবং তাঁর বিপ্লবী সরকার গঠনের পরিকল্পনাটি স্বাভাবিকভাবেই বানচাল হয়ে যায়। জীবনে তাঁর সবচাইতে বেদনাদায়ক ঘটনা ছিল এই ব্যর্থতা। দেশ স্বাধীন হবার পর তিয়াত্তর সালে সন্তোষে সগৃহে অঘোষিত অবস্থায় বন্দী থাকার পরবর্তীকালে মওলানা ভাসানী একটি দৈনিকের সাক্ষাৎকালে এই বেদনার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন

: তেসরা ডিসেম্বর (১৯৭০) পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা আমিই প্রথম দিয়েছিলাম। সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের বাস্তব কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে! আর একবার তিনি মর্মাহতই শুধু হননি, ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি দেরাদুনে আদর আপ্যায়নের মধ্যে আটকাবস্থায় আগস্ট মাসেই জানতেন যে, ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। ভারত সরকারের বৈদেশিক দফতরের উচ্চপদস্থ অফিসার মিঃ নাগ্রানী একবার মওলানা সায়েবের সঙ্গে দেরাদুনে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সে সাক্ষাতের সময় মওলানা ভাসানী তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপনার সরকারের সুস্পষ্ট ভূমিকা কি? মিঃ নাগ্রানী ইঙ্গিতবহ উত্তর দিয়ে বলেন : ডিসেম্বরের দিকে। মওলানা সায়েব পরবর্তীকালে নানা ঘটনার সূত্র ধরে ভারতে আটক অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করতেন। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনটাই ছিল বিদ্রোহ ও অভিযানের। ঐতিহাসিকভাবে এ কথা সত্য যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক ও শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তিনি প্রথম ছাপ্পান্ন সালে কাগমারী সম্মেলনে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকাশ্য হুমকী দিয়ে বলেছিলেন : শাসন-শোষণের বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে আমরা তোমাদের আচ্ছালামো আলাইকুম বলতে বাধ্য হব। অর্থাৎ পূর্ব…

...কফিনের মধ্যে কাফনে ঢাকা তাঁর ছায়া-ছায়া মুখ -- কিন্তু কোনও মুখরতা নেই আগের মতো, আমাদের সেই শিল্পাঙ্গনের সন্ধ্যার আড্ডাগুলির মতো। তবে, কফিনের ওপর রয়েছে মার্কস ও এঙ্গেলস-এর লেখা বই ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ম্যানিফেস্টো’। এটাও তার একটি অন্যতম শেষ ইচ্ছে।...

মধ্যরাতে, মানুষের ক্রান্তিকালে, বিপন্ন সময়ে কিংবা মুখর শুক্ল অথবা কৃষ্ণপক্ষের আড্ডাতে নিশ্চয়ই তিনি আমাদের মধ্যে ফিরে-ফিরে আসবেন -- যদিও তিনি আর নেই। তিনি, ফয়েজ আহ্‌মদ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে শারীরিকভাবে বিদায় নিয়েছেন এই পৃথিবী থেকে। বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। কিন্তু বয়স দিয়ে ফয়েজ আহ্‌মদের বিস্তার অনুমান করা সম্ভব নয়। আসলে তিনি ত্রিকালজ্ঞ। জন্ম নিয়েছিলেন পরাধীনকালে, উপনিবেশে ১৯২৮ সালের ২ মেতে। তাঁর জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জ তখনও পরিচিত বিক্রমপুর হিসেবে। বালককাল থেকেই বার বার অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়িয়েছেন -- কখনো কাউকে না বলে চলে গেছেন ভাইয়ের চাকরিস্থলে, কখনও আবার প্রিয় পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলার জন্যে চেপে বসেছেন কলকাতার রেলে। আর মধ্যরাতের অশ্বারোহী হওয়ার গল্প -- সেও তো সবার জানা। সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন আমাদের মাঝে জীবন্ত কিংবদন্তি। আর এই কিংবদন্তি হয়ে ওঠার পথে কত না দীর্ঘ সময় হেঁটেছেন তিনি -- রাজনীতি করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, মানুষের সঙ্গে থেকেছেন, মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন, কথা শুনেছেন। তার মতো কথক আর কেই-বা ছিল? কখনও নিচু লয়ে, কখনও দ্রুত লয়ে খানিকটা ফিসফিসানো আচ্ছন্নতা মেশানো কণ্ঠে তিনি আড্ডায় শোনাতেন পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী মুক্তিআন্দোলনসমূহের কথা, ডা. নন্দীর চলে যাওয়ার বর্ণনা, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব নির্মাণের আর ব্যক্তিত্বের তুচ্ছ দীনতার ঘটনা। সাহিত্যচর্চার শুরু করেছিলেন শিশুসাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে -- অন্যদিকে ১৯৪৭ সালের পর থেকেই যুক্ত হয়েছিলেন কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে। পৃথিবীকে শিশুর বসবাসযোগ্য করে তোলার সুকান্তীয় ছাড়পত্র হাতে তারপর ফয়েজ আহ্‌মদ ছুটে বেরিয়েছেন বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে -- পৃথিবীর একদিক থেকে আরেকদিকে। কত কমিটমেন্ট ছিল তাঁর! আর ছিল সেসব কমিটমেন্ট পূরণের জন্যে কত উদ্যোগ! সেসব আমরা লিখে, বলে কখনও শেষ করতে পারব না। সাম্প্রদায়িকতা ঠেকাতে রক্তাক্ত হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছেন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটকে গড়ে তুলেছেন নিজের সন্তানের মতো করে, শিল্পকে এ সমাজে মর্যাদাপূর্ণ করে তোলার প্রয়াসে নব্বইয়ের দশকে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সমস্ত প্রয়াস একীভূত করেছেন ‘শিল্পাঙ্গন’ গড়ে তোলার কাজে। আমরা কি কখনও ভুলতে পারব, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি কী করে এরশাদ পতনের আন্দোলনের শেষ সময় দু নেত্রীকে ঐক্যবদ্ধ করার, এক মঞ্চে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং সে উদ্যোগে সফলও হয়েছিলেন? এবং সেই উদ্যোগের অনিবার্য উপসংহার ছিল…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.