মধ্যরাতে, মানুষের ক্রান্তিকালে, বিপন্ন সময়ে কিংবা মুখর শুক্ল অথবা কৃষ্ণপক্ষের আড্ডাতে নিশ্চয়ই তিনি আমাদের মধ্যে ফিরে-ফিরে আসবেন — যদিও তিনি আর নেই। তিনি, ফয়েজ আহ্মদ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে শারীরিকভাবে বিদায় নিয়েছেন এই পৃথিবী থেকে।
বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। কিন্তু বয়স দিয়ে ফয়েজ আহ্মদের বিস্তার অনুমান করা সম্ভব নয়। আসলে তিনি ত্রিকালজ্ঞ। জন্ম নিয়েছিলেন পরাধীনকালে, উপনিবেশে ১৯২৮ সালের ২ মেতে। তাঁর জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জ তখনও পরিচিত বিক্রমপুর হিসেবে। বালককাল থেকেই বার বার অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়িয়েছেন — কখনো কাউকে না বলে চলে গেছেন ভাইয়ের চাকরিস্থলে, কখনও আবার প্রিয় পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলার জন্যে চেপে বসেছেন কলকাতার রেলে। আর মধ্যরাতের অশ্বারোহী হওয়ার গল্প — সেও তো সবার জানা। সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন আমাদের মাঝে জীবন্ত কিংবদন্তি।
আর এই কিংবদন্তি হয়ে ওঠার পথে কত না দীর্ঘ সময় হেঁটেছেন তিনি — রাজনীতি করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, মানুষের সঙ্গে থেকেছেন, মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন, কথা শুনেছেন। তার মতো কথক আর কেই-বা ছিল? কখনও নিচু লয়ে, কখনও দ্রুত লয়ে খানিকটা ফিসফিসানো আচ্ছন্নতা মেশানো কণ্ঠে তিনি আড্ডায় শোনাতেন পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী মুক্তিআন্দোলনসমূহের কথা, ডা. নন্দীর চলে যাওয়ার বর্ণনা, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব নির্মাণের আর ব্যক্তিত্বের তুচ্ছ দীনতার ঘটনা। সাহিত্যচর্চার শুরু করেছিলেন শিশুসাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে — অন্যদিকে ১৯৪৭ সালের পর থেকেই যুক্ত হয়েছিলেন কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে। পৃথিবীকে শিশুর বসবাসযোগ্য করে তোলার সুকান্তীয় ছাড়পত্র হাতে তারপর ফয়েজ আহ্মদ ছুটে বেরিয়েছেন বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে — পৃথিবীর একদিক থেকে আরেকদিকে।
কত কমিটমেন্ট ছিল তাঁর! আর ছিল সেসব কমিটমেন্ট পূরণের জন্যে কত উদ্যোগ! সেসব আমরা লিখে, বলে কখনও শেষ করতে পারব না। সাম্প্রদায়িকতা ঠেকাতে রক্তাক্ত হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছেন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটকে গড়ে তুলেছেন নিজের সন্তানের মতো করে, শিল্পকে এ সমাজে মর্যাদাপূর্ণ করে তোলার প্রয়াসে নব্বইয়ের দশকে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সমস্ত প্রয়াস একীভূত করেছেন ‘শিল্পাঙ্গন’ গড়ে তোলার কাজে। আমরা কি কখনও ভুলতে পারব, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি কী করে এরশাদ পতনের আন্দোলনের শেষ সময় দু নেত্রীকে ঐক্যবদ্ধ করার, এক মঞ্চে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং সে উদ্যোগে সফলও হয়েছিলেন? এবং সেই উদ্যোগের অনিবার্য উপসংহার ছিল স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের পতন। বোধকরি সেই থেকেই এ দেশের মধ্যবিত্ত সমাজে একটি মিথ গড়ে উঠেছে : দুই নেত্রী একত্রিত হলেই এ দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইতে শুরু করবে। তাঁকে পুরস্কৃত করে একুশে পদক, বাংলা একাডেমী আর শিশু একাডেমীর মতো প্রতিষ্ঠানগুলি বলা চলে নিজেরাই সম্মানিত হয়েছেন। যদি জীবদ্দশায় তাঁরা ফয়েজ আহ্মদকে সম্মানিত না করতেন তা হলে তার গ্লানি এসব প্রতিষ্ঠানকে অনন্তকাল বইতে হতো। পাকিস্তানে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সেইসব ভয়াবহ দিনগুলিতে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে অসাম্প্রদায়িকতার পতাকা হাতে নিয়ে যেসব তরুণ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তিনি ছিলেন তাদের সামনের সারিতে। সাম্প্রদায়িকতা তাঁকে নিঃসঙ্গ করে দিয়েছিল, মনের ভেতর থেকে তিনি আসলে উদ্বাস্তু হয়ে গিয়েছিলেন, আবার একই সঙ্গে হয়েছিলেন অনমনীয় দৃঢ় সাহসী — চিরকুমার হয়ে বেঁচে ছিলেন, কিন্তু জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেছেন শৈল্পিক সামাজিকতা নির্মাণের কাজে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সংগঠক।
সাংবাদিকতাকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে, সত্যনিষ্ঠ পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে যে ক’জন মানুষ দৃঢ়প্রত্যয়ে কাজ করেছেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। তিনি সেই মধ্যরাতের অশ্বারোহী — যিনি বার বার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে সাংবাদিকতার বৃত্ত অতিক্রম করে গণমানুষের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক ফয়েজ আহ্মদের হাত ধরে পরে রেডিও পিকিং-এ (বর্তমানে বেইজিং রেডিও) বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান যাত্রা শুরু করে — কিন্তু এইসব প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় নয়, তিনি পরিচিতি পেয়েছেন মধ্যরাতের অশ্বারোহী হিসেবে।
প্রতিটি ব্যক্তির জীবনেই হয়তো এমন সময় আসে — এবং ফয়েজ আহ্মদের জীবনেও এসেছিল; নিজের মুখেই বিবৃত করেছেন তিনি : ‘…আমাকে তো কেউ চাকরি দেবে না এই বয়সে। প্রশ্নই ওঠে না। আমি কেমনে বলব যে এই বয়সে আমাকে একটা চাকরি দেও।’ অতএব তিনি লিখতেন। লেখাই ছিল তাঁর অবলম্বন। এখনও ছোটদের মুখে মুখে তাঁর ছড়া শুনি আমরা। তাঁর বই ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ কিংবা ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’ এদেশের সাংবাদিকদের শিল্পিত সত্য।
খুব ভোরে ফয়েজ আহ্মদের মৃত্যুর খবর এলো। খবর দিলেন শিল্পী সামছুল আলম আজাদ। কিছুক্ষণ পর শিল্পী রশীদ আমিন তা নিশ্চিত করলেন — বললেন, শিল্পাঙ্গনে যেতে। শুনলাম, তাঁর মৃত্যু আসে শেষ রাতের দিকে। তার আগে রাতে তাঁকে হাসপাতালে নেয়ার কথা বললে তিনি তা হেসে উড়িয়ে দেন। কিন্তু মৃত্যু ওৎ পেতে ছিল, ভোররাতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বারডেম হাসপাতালে নেয়ার পথে অনন্তের পথে পা বাড়ান।
শিল্পাঙ্গনে বিষণ্ণ মুখে পাশাপাশি বসেছিলেন রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো। বিষণ্ণ মুখে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। মুখ নিচু করে বেরিয়ে গেলেন শিল্পী শিশির। চুপচাপ বসে আছেন শিল্পী নিসার হোসেন, রফি হকরা। সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁর কফিনটি প্রেসক্লাব হয়ে অপরাজেয় বাংলায় নিয়ে যাওয়ার। সেখানে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হবে কম্যুনিস্ট পার্টির অফিসে, তার বিচ্ছিন্ন-অবিচ্ছিন্ন সহযোদ্ধা ও সহমর্মীদের কাছে। কেউ খুব নিভৃতে গেয়ে উঠবেন, ‘মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়…।’ দেখা হবে, প্রাণে প্রাণে আসাযাওয়া হবে, কিন্তু তবু তিনি রয়ে যাবেন কফিনেরই মধ্যে। তারপর ফয়েজ আহ্মদের শেষ ইচ্ছানুযায়ী মৃতদেহটি দেয়া হবে বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজে। ‘কেউ কি দেখবেন? আমরা এখন প্রেসক্লাবে যাব’ — একজনের ঊর্ধ্বচিৎকার শুনে আরও কয়েকজনের সঙ্গে এগিয়ে গেলাম। কফিনের মধ্যে কাফনে ঢাকা তাঁর ছায়া-ছায়া মুখ — কিন্তু কোনও মুখরতা নেই আগের মতো, আমাদের সেই শিল্পাঙ্গনের সন্ধ্যার আড্ডাগুলির মতো। তবে, কফিনের ওপর রয়েছে মার্কস ও এঙ্গেলস-এর লেখা বই ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ম্যানিফেস্টো’। এটাও তাঁর একটি অন্যতম শেষ ইচ্ছে।
নীরবতার মধ্যে থেকেও বইটি বার বার বলে উঠছিল — তিনি চেয়েছিলেন মানুষের মুক্তি, মৃত্যুর পরও তাই চান তিনি। আরও যাঁদের একই আকাঙ্ক্ষা আছে মধ্যরাতের এই নিঃসঙ্গ অশ্বারোহীর সঙ্গে তাঁদের নিশ্চয়ই দেখা হবে । বার বার দেখা হবে। দেখা হবে দেশের ক্রান্তিকালে, সমাজের ক্রান্তিকালে, মানুষ-ব্যক্তি-শিল্পীর ক্রান্তিকালে।