সদ্যপ্রয়াত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ বই থেকে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশটি এখানে তুলে দিলাম। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও ভারতে মওলানা ভাসানীর অঘোষিত গৃহবন্দিত্ব নিয়ে ফয়েজ আহমদের এই অনবদ্য রচনাটি আমার খুবই প্রিয় — অসাধারণ গদ্য এবং রাজনৈতিক কাহিনী ও মুহূর্তের প্রকাশের এক অনন্য দলিল এই লেখাটি।
মওলানা ভাসানীর ভারত আবিষ্কার
ফয়েজ আহমদ
মওলানা ভাসানী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার প্রাক্কালেই সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে লন্ডনে বিপ্লবী অস্থায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরিকল্পিত এই বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই তিনি একাত্তর সালের আটই এপ্রিল লন্ডনের পথে আত্মগোপন করে ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন। ভারত থেকে লন্ডন পৌঁছানোর সহজ পথ বেছে নেবার সিদ্ধান্তটি ছিল ভ্রান্ত। এই রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের ফলেই তিনি ভারত সরকার কর্তৃক অঘোষিত গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। এবং তাঁর বিপ্লবী সরকার গঠনের পরিকল্পনাটি স্বাভাবিকভাবেই বানচাল হয়ে যায়। জীবনে তাঁর সবচাইতে বেদনাদায়ক ঘটনা ছিল এই ব্যর্থতা।
দেশ স্বাধীন হবার পর তিয়াত্তর সালে সন্তোষে সগৃহে অঘোষিত অবস্থায় বন্দী থাকার পরবর্তীকালে মওলানা ভাসানী একটি দৈনিকের সাক্ষাৎকালে এই বেদনার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন : তেসরা ডিসেম্বর (১৯৭০) পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা আমিই প্রথম দিয়েছিলাম। সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের বাস্তব কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে!
আর একবার তিনি মর্মাহতই শুধু হননি, ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি দেরাদুনে আদর আপ্যায়নের মধ্যে আটকাবস্থায় আগস্ট মাসেই জানতেন যে, ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। ভারত সরকারের বৈদেশিক দফতরের উচ্চপদস্থ অফিসার মিঃ নাগ্রানী একবার মওলানা সায়েবের সঙ্গে দেরাদুনে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সে সাক্ষাতের সময় মওলানা ভাসানী তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপনার সরকারের সুস্পষ্ট ভূমিকা কি? মিঃ নাগ্রানী ইঙ্গিতবহ উত্তর দিয়ে বলেন : ডিসেম্বরের দিকে।
মওলানা সায়েব পরবর্তীকালে নানা ঘটনার সূত্র ধরে ভারতে আটক অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করতেন। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনটাই ছিল বিদ্রোহ ও অভিযানের। ঐতিহাসিকভাবে এ কথা সত্য যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক ও শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তিনি প্রথম ছাপ্পান্ন সালে কাগমারী সম্মেলনে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকাশ্য হুমকী দিয়ে বলেছিলেন : শাসন-শোষণের বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে আমরা তোমাদের আচ্ছালামো আলাইকুম বলতে বাধ্য হব। অর্থাৎ পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানীর এই ‘‘দেশদ্রোহমূলক’’ বক্তব্য প্রকাশের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় উঠে এবং এমন কি তখন আওয়ামী লীগের গোঁড়া সমর্থক পত্রিকাও মওলানা ভাসানীকে ‘‘লুঙ্গিসর্বস্ব’’ মওলানা বলে ব্যঙ্গ করতে দ্বিধা বোধ করেনি। পনের বছর পর সেই মওলানা সায়েবই একাত্তর সালের মার্চ মাসে পল্টন ময়দানে পুনরায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি সেই ঘোষণার সূত্র ধরেই লন্ডন থেকে স্বাধীন বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বিশ্বের কাছে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন।
মওলানা ভাসানীর মত একজন বিচক্ষণ রাজনীতিক মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা নিয়ে ভারত হয়ে লন্ডনে যাবার কথা ভেবেছিলেন কেন? আশঙ্কিত ভারতীয় আগ্রাসন ও সম্প্রসারণের নীতি সম্পর্কে যিনি তীব্র সমালোচনামূলক বক্তব্য রেখেছিলেন, তাঁর পক্ষে সে সময়ে ভারতকে মিত্র বলে গণ্য করা সম্ভব ছিল কি করে? ভারত ছাড়া, যেমন চীন বা অন্য কোনো রাষ্ট্রে তিনি যেতে চেয়েছিলেন কি? মওলানা সায়েবের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত গমন সম্পর্কে এ সমস্ত প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া স্বাভাবিক।
ভারতের মাধ্যম ছাড়া অন্য কোনো দেশের পথ ধরে তাঁর পক্ষে সেই বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থায় লন্ডন পৌঁছানো সম্ভব ছিল না বলেই তিনি বিশ্বাস করতেন কি?
সে সময়ে এবং বর্তমানেও একজন বিশিষ্ট কম্যুনিস্ট নেতা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে তাঁর সাথে দেখা করে তাঁকে চীনে বা বার্মায় নিয়ে যাবার প্রস্তাব করেছিলেন। মওলানা সায়েব সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, লন্ডন থেকেই বিশ্বের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা কোন প্রকার বাধ্যবাধকতা ছাড়া ব্যাপকভাবে প্রচার করা সম্ভব। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর পিতার সঙ্গে মওলানা সায়েবের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল এবং ভারতে তাঁর এক সময়ের অনুসারী অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ক্ষমতা ও শাসনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন; তাই তিনি ভারতে গিয়ে কোন বিপদে পড়বেন বলে আশঙ্কা করেননি। সবচাইতে তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন চীনের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্কের ওপর। তিনি ভেবেছিলেন, এই সম্পর্কের কারণেই ইন্দিরা ও তাঁর সরকার অবশ্যই তাঁকে চীনা সমর্থনের প্রশ্নে ব্যবহার করবেন। কিন্তু তাঁর সেই রাজনৈতিক হিসাব ছিল একান্তই ভ্রান্তিপূর্ণ। ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ছিল বৈরিতাপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে ভারত চীনের বন্ধু একজন বিশিষ্ট নেতাকে ভারতের বাইরে থেকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক করতে দিতে রাজী ছিলেন না। অন্যদিকে ভারত নিজস্ব চিন্তা অনুযায়ী চীন বিরোধী প্রচারের সুযোগ নিচ্ছিলেন – ‘চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানকে সমর্থন করছে’ – যদিও ভারত জানত যে এশিয়ার বন্ধু সংগ্রহের প্রয়োজনে এবং ভারতের বৈরিতার জন্যেই চীন সে সময় পাকিস্তানকে প্রধান বন্ধু বলে মনে করত; যার সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করা না করার কোনো সম্পর্ক ছিল না। মওলানা সায়েব মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন এবং বাংলাদেশের প্রতি চীনের সমর্থন চেয়ে বিবৃতি দেয়া সত্ত্বেও ভারত সরকার তাঁর ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছিলেন এবং ভারতেও যাতে পত্রপত্রিকায় তিনি কোন বক্তব্য না রাখতে পারেন তার ব্যবস্থা ছিল সরকারীভাবে। কিন্তু তাজউদ্দিন সরকারের প্রতি যখন তাঁর সমর্থন ছিল অত্যন্ত মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ, সে সময় বিশেষ প্রয়োজনে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দেরাদুনে রক্ষিত মওলানা সায়েবকে কোলকাতায় এনে উপদেষ্টা পরিষদে যোগদানের সুযোগ করে দেন।
তিনি যদি ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত না নিতেন, তবে হয়তো তাঁর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত। ভারত যাওয়ার সিদ্ধান্ত এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহেই নেন। সে সময় মওলানা সায়েব নিজের বাড়ি হারিয়ে (পাকিস্তানি বাহিনী তাঁর সন্তোষের বাড়ি ইতিমধ্যেই পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল।) ব্রহ্মপুত্র নদে নৌকার মধ্যে বাস করতেন। নৌকায় আত্মগোপন কালে নিজ পার্টি ন্যাপ-এর সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ ছিল না। আটই এপ্রিল তারিখে তিনি গোপনে নৌকা যোগে সিরাজগঞ্জ ঘাটে এসে মুজাফফর ন্যাপ-এর স্থানীয় সেক্রেটারী জনাব সাইফুল ইসলামকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর নিজের দলের কর্মীদের লোক মারফত সন্ধান করেন। জনাব সাইফুল রাজনৈতিক জীবনের গোড়া থেকেই মওলানা ভাসানীর একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। এই বিশ্বস্ত ও সৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিটির ওপর মওলানার সর্বদাই আস্থা ছিল। পরবর্তীকালে ন্যাপ দ্বিধাবিভক্ত হবার সময় সাইফুল সায়েব মুজাফফর ন্যাপ-এ যোগদান করেন এবং মওলানার সঙ্গে সমস্ত রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। বর্তমানে জনাব সাইফুল একতা পার্টির একজন নেতা। এই সাইফুল সায়েবই মওলানার সঙ্গে ভারতে যেতে সম্মত হন। ন্যাপ কর্মী মুরাদুজ্জামানও সিরাজগঞ্জ থেকে মাওলানার সঙ্গী ছিলেন। মওলানা সায়েব তখন বলেছিলেন : বর্তমান অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া বাঞ্চনীয়। সে ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে বিভেদের সুযোগ কোথায়?
নৌকার মধ্যে এই আলোচনার সময় জনাব সাইফুল নিজ পার্টির মতামত না নিয়েই মওলানা সায়েবের যুক্তি মেনে নেন। একটি কাঁথা ও টিনের একটি ছোট স্যুটকেস নিয়ে দু’সঙ্গীসহ নদীপথে মওলানা ভাসানী ভারতের আসাম অভিমুখে যাত্রা করলেন। চারদিন পর তার তিস্তা নদীর নামাজের চরে সীমান্তের নিকট এসে পৌঁছান। তাদের মুখোমুখি আসামের শিশুমারী এলাকা। গোয়ালপাড়া জেলার শিশুমারী বর্ডারে সামাদ নামে মওলানা ভাসানীর এক শিষ্যের নাম জানা গেল। এ সময়ই রেডিওতে তাঁরা জানতে পারেন যে দশ তারিখে মুজিব নগরে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে। পাকিস্তান অঞ্চলে নামাজের চরে মওলানা সায়েবকে রেখে তাঁর চিঠি সাইফুল রাতের অন্ধকারে শিশুমারীতে সামাদের বাসায় নিয়ে যান। শিশুমারী গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান মওলানাকে আশ্রয় দিতে ভয় পেলেন। তিনি জানালেন যে, আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কাউকে এই এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া কর্তৃপক্ষের নিষেধ।
কিন্তু সেখানেই জানা গেল যে, পরদিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনাব মঈনুল হক শিশুমারী হাই স্কুল পরিদর্শন করবেন। জনাব হক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে এক সময় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত আসাম মুসলিম লীগের সম্পাদক ছিলেন। মওলানা সায়েব এই সংবাদ পেয়ে সাইফুলের মাধ্যমে পরদিন উক্ত সভা চলাকালেই মঈনুল হক সায়েবের কাছে তাঁর সীমান্ত পারে অবস্থানের কথা জানান। সভা শেষে হক সায়েব স্থানীয় ফুলবাড়িয়া রেস্ট হাউসে সাইফুলকে নিয়ে যান এবং দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এই ফোনে আলোচনার পরেই মওলানাকে ভারতে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়। রাত একটায় একটি জীপে করে মওলানা ভাসানীকে পাকিস্তান সীমান্ত থেকে ভারতের ফুলবাড়িয়া রেস্ট হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
অধিক রাত্রি পর্যন্ত রেস্ট হাউসে মওলানা সায়েবের সঙ্গে তাঁর এককালের সহকর্মী ও ভারতীয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনাব হকের দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। পরদিন মন্ত্রী মঈনুল সায়েব দিল্লী চলে যান। এক দিন পর ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী বিএসএফ-এর হিল্লায় পাহাড়ের ওপর অবস্থিত হেলেডিগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পে মওলানা সায়েবকে দু’জন সঙ্গীসহ নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি জনসংযোগশূন্য এবং যোগাযোগবিহীন হয়ে পড়েন। তাঁকে জানানো হয় যে, খবর এলেই তাঁকে তুরা বা কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে। নিরাপদ ও বৈচিত্রপূর্ণ প্রাকৃতিক দৃশ্যের পরিবেশে আশ্রিত মওলানা সায়েব সেদিনই প্রথম উপলব্ধি করতে পারলেন যে, এই আশ্রয় বন্দীর আশ্রয়।
ক’দিন পর বিমানে মওলানা সায়েবকে কোলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। বিমান বন্দরে জনৈক ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ব্যানার্জী তাঁকে স্বাগত জানান। পার্ক স্ট্রীট এলাকার সুপরিচিত কোহিনুর ম্যানশনে নিরাপত্তা সহকারে মওলানা সায়েবের থাকার (পাঁচ তলায়) ব্যবস্থা করা হয়। গুরুসদয় দত্ত রোডস্থ গোয়েন্দা পুলিশের অফিসে দু’দিন পরে মওলানা সায়েবের দু’ঘন্টাব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছিল গৃহবন্দী হিসেবেই।
এপ্রিলের শেষে জনাব তাজউদ্দিন, খোন্দকার মোস্তাক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও জনাব আব্দুল মান্নান উক্ত ফ্ল্যাটে মওলানা সায়েবের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এরই মধ্যে বেগম তাজউদ্দিন একই ম্যানসনে এসে উঠেন। তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। সে সময় মওলানার সঙ্গী দু’জন সাইফুল ও মুরাদ মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারতেন। কিন্তু মওলানার গতিবিধি ছিল নিয়ন্ত্রিত এবং কেবলমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারের সঙ্গেই তিনি গাড়িতে করে গঙ্গার ধারে ঘুরে আসতে পারতেন। মে মাস পর্যন্ত এই ফ্ল্যাটে অবস্থানকালে দু’টো ঘটনা ঘটে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচেষ্টায় তখন কোলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমন্বয় কমিটি গঠিত হচ্ছিল। তারা মওলানা সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতে সমর্থ হন। (সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মওলানা ভাসানীর নাম ঘোষণা করা হয়েছিল) ন্যাপ-এর সাধারণ সম্পাদক জনাব মশিউর রহমান ( যাদু মিয়া।) সেই সমন্বয় কমিটি গঠনের সময় মওলানা সায়েবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্ট করেন। তিনি জানতেন মওলানা সায়েবের আশ্রয়স্থল। কিন্তু কোন এক রহস্যজনক কারণে মওলানা তারই প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদকের মশিউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেন! ( এ ব্যাপারে মওলানা সায়েবের বক্তব্য উদ্ধৃত করা গেল না। কারণ দু’জনেই প্রয়াত) এ ঘটনার ক’দিন পরেই মে মাসের শেষের দিকে জনাব যাদু মিয়া কোলকাতা ত্যাগ করে বাংলাদেশে ফিরে যান।
সমন্বয় কমিটির সঙ্গে মওলানার যোগাযোগ ভারত সরকার পছন্দ করেননি এবং রাজনৈতিক কারণেই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে মওলানা ভাসানীকে মে-র শেষের দিকে কুচবিহারের পুন্ডিবাড়ি পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তার পূর্বে কোলকাতা প্রেস ক্লাবে সরকারী উদ্যোগে একটি সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করা হয়। মওলানা সায়েব সে সম্মেলনে যেতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করায় জনাব সাইফুল উপস্থিত হয়ে মওলানার পক্ষে বিবৃতি পাঠ করেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে ছিল সেই বিবৃতি। পুন্ডিবাড়িতে একটি পরিত্যক্ত গৃহে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তাঁকে দিল্লীতে চিকিৎসার জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুটা সুস্থ হবার পর তিনি হাসপাতাল থেকেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর বাসায় দেখা করতে যান। এই সাক্ষাৎকারের সময় নাকি দেড় ঘন্টাকাল কেবল মওলানা সায়েবই কথা বলেছেন। কন্যাতুল্য ইন্দিরা তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করার পর বিশেষ কোন কথা বলার সুযোগই পাননি! এই গোপনীয় সাক্ষাতের কয়েক দিন পর জুন মাসে মওলানা সায়েবকে সুদূর দেরাদুনে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
দেরাদুনে সার্কিট হাইসে তাঁর দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার লবরাজ। পনের দিন পরই কোলকাতায় প্রত্যাবর্তনের খবর এল। পঞ্চদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের প্রয়োজনে তাঁকে কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। এবার মওলানা সায়েব কোলকাতায় ছিলেন হাজরা স্ট্রীটের একটি বাড়িতে। বৈঠকে উপদেষ্টা কমিটিতে বামপন্থীদের সমন্বয় কমিটির প্রতিনিধি গ্রহণের জন্য মওলানা সায়েব প্রস্তাব করেন। কিন্তু সমন্বয় কমিটিকে গ্রহণের প্রশ্নে সবাই প্রবল বাধা দিলেন। এ সময় তাজউদ্দিন সায়েবের সঙ্গে এক দিকে খোন্দকার মোশতাক, আরেক দিকে সৈয়দ নজরুল এবং অপর দিকে শেখ ফজলুল হক মনির তুমুল কলহ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছিল। এমনকি এক পর্যায়ে তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের আয়োজন চলে। সেই পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে একদিন তাজউদ্দিন সায়েব এলেন মওলানা সায়েবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এবং সাইফুলকে বলে গেলেন : আমার পায়ের নীচে মাটি সরে যাচ্ছে। অনাস্থা আসছে। মওলানা সায়েবকে যেন কেউ এখান থেকে নিয়ে না যায়। তিনি এসেছিলেন মওলানা সায়েবের সমর্থন পেতে।
জুলাই মাসে তিনি গেলেন আসামের ভাসানীর চরে, গৌরীপুর ইস্টেটে। এখান থেকে মওলানাকে পুনরায় দেরাদুনে নিয়ে যাওয়া হয়। একদিন সরকারী এক অফিসার মওলানাকে বিশ্ব মানবিক অধিকার কমিটির একটি প্রচারপত্র দিয়ে গেলেন – ‘মওলানা ভাসানী কোথায়?’
ভাসানীর সঙ্গে বিশ্বের কোন যোগাযোগ না থাকায় ইতিমধ্যে প্রচারিত হয়েছিল যে, ভারত সরকার মওলানাকে কোথাও গ্রেফতার করে রেখেছেন এবং সভ্য দুনিয়ার সঙ্গে তাঁকে কোন সংযোগ রক্ষা করতে দেয়া হচ্ছে না। সে কারণেই ভারত সরকার প্রচার পত্রটির উত্তরে মওলানার প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলেন। জনৈকা মিসেস মার্গারেটের নামে প্রচারিত প্রচারপত্রের উত্তর মওলানার জবানীতে সর্বত্র প্রকাশ করা হয়।
এরপরই মওলানা সায়েব মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করার জন্য চীনের চেয়ারম্যান মাও সে-তুং ও জাতিসংঘের মহাসচিবকে টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন। মিঃ ডি পি ধর ও মিঃ নাগ্রানী এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। ভারত সরকারের একটি সিনেমা ইউনিট এসে প্রামাণ্য চিত্র নিয়ে যায়। এ সমস্তই ছিল মওলানাকে নিয়ে রাজনীতি এবং বিশ্বের কাছে মওলানার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা প্রমাণ করা।
পুনরায় সেপ্টেম্বর মাসের দিকে মওলানাকে কোলকাতায় উঠানো হয় হাজরা স্ট্রীটের বাড়িতে। এবার তিনি আসেন উপদেষ্টা কমিটির যোগদান করার জন্যে। এই বৈঠকেই সেই বিখ্যাত আলোকচিত্র উঠিয়ে প্রচার* শুরু হয়।
বৈঠকের পর তৃতীয় বার তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় দেরাদুনে। এবার মওলানা কিছু দিনের মধ্যেই গুরুতর পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন। তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন ও অধ্যাপক মুজাফফর আহমদের নিকট দুটি তার পাঠিয়ে অসুস্থতার কথা জানান। এই অসুখের সময় ভারত সরকার ডাক্তারদের রিপোর্ট পেয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছিলেন। দিল্লী থেকে হেলিকপ্টারে বিশেষজ্ঞ-ডাক্তার আনা হয় চিকিৎসার জন্যে। তিনি যে ওষুধের পরামর্শ দেন, তা ভারতে কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। স্যুইজারল্যান্ড থেকে প্লেনে ওষুধ এনে মওলানাকে সুস্থ করে তোলা হয়। সেই থেকে মওলানা সায়েব দেরাদুনেই বাস করেছেন রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে অক্টোপাসের শিকার হয়ে।
একথা যেমন সত্য যে, শেখ মুজিব স্বাধীনতার প্রথম সূর্যোদয়ের প্রত্যুষে শত্রু পাকিস্তানের কারাগারে আবদ্ধ ছিলেন, ঠিক তেমনি মওলানা ভাসানী মিত্র ভারতের দূরবর্তী অঞ্চলে জনগণ থেকে সম্পর্কহীন দেরাদুনে অঘোষিত গৃহবন্দী অবস্থায় ষোলই ডিসেম্বরে সূর্যোদয় দেখেছিলেন অনেক জিজ্ঞাসা নিয়ে।
* আওয়ামী লীগ এককভাবে ভারতীয় সমর্থনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে যাচ্ছেন। পাকিস্তানী প্রতিনিধি আগাশাহীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সে সময় বিভিন্ন সদস্যদেশ জাতিসঙ্ঘে প্রশ্ন তোলেন – এই মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণের সমর্থন ও অংশগ্রহণ আছে কি না। এবং অস্থায়ী সরকার সর্বস্তরের জনগণ ও সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব দাবী করতে সমর্থ কি? এই সমস্ত মৌল প্রশ্নের প্রেক্ষিতে সরকার ন্যাপনেতা মওলানা ভাসানীর সহযোগিতা কামনা করতে বাধ্য হন। এতদিনে সকলের সহযোগিতার গুরুত্বের কথা তাদের উপলব্ধিতে না আসলেও তাঁরা তড়িৎগতিতে অদৃশ্য স্থান থেকে মওলানা ভাসানীকে একটি অকেজো পরামর্শদাতা কমিটির নাম করে বিশেষভাবে আহুত এক গোপন বৈঠকে উপস্থিত করেন। বৈঠকের সময় মন্ত্রীসভার সদস্যগণ পরিবেষ্টিত মওলানা ভাসানীর আলোকচিত্র গ্রহণ করা হয় – যেখানে তিনি অনর্গল প্রায় তিন ঘন্টাব্যাপী তাঁর বক্তব্য বলেছেন। এই আলোকচিত্রটিই ছিল অস্থায়ী সরকারের কাছে মহামূল্যবান দলিল। এই মূল্যবান আলোকচিত্রটি জাতিসঙ্ঘে ও অন্যান্য দেশের প্রতিনিধির কাছে উপস্থিত করে প্রমাণ করার চেষ্টা কার হয় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মওলানা ভাসানীর ন্যায় মহান ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় জননেতার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।
লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।