বিশ বছর হয়ে গেল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছেড়ে দিয়ে একদিন বইয়ের আশ্রমে ঢুকে পড়েছিলাম, সেই থেকে আজো, এই বিশ বছর, বইয়ের আশ্রমে আমার আশ্রয়, আমার বইপ্রস্থ। আর মুক্তাঙ্গনে বইপ্রস্থ শিরোনামের পোস্টে আমার পড়া, কেনা বা শোনা বইয়ের বিজ্ঞাপন লিখব। কোনো ধারাবাহিক পোস্ট নয়, একই নামে বিভিন্ন সময়ে লিখব একই পোস্ট। এই প্রথম পোস্টে থাকছে আমার পড়া তিনটি বইয়ের বিজ্ঞাপন [...]

বিশ বছর হয়ে গেল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছেড়ে দিয়ে একদিন বইয়ের আশ্রমে ঢুকে পড়েছিলাম, সেই থেকে আজো, এই বিশ বছর, বইয়ের আশ্রমে আমার আশ্রয়, আমার বইপ্রস্থ। আর মুক্তাঙ্গনে বইপ্রস্থ শিরোনামের পোস্টে আমার পড়া, কেনা বা শোনা বইয়ের বিজ্ঞাপন লিখব। কোনো ধারাবাহিক পোস্ট নয়, একই নামে বিভিন্ন সময়ে লিখব একই পোস্ট। এই প্রথম পোস্টে থাকছে আমার পড়া তিনটি বইয়ের বিজ্ঞাপন। পাকিস্তানের আগের বাংলাদেশ পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন ।।যতীন সরকার।।জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ।।মূল্য ৩৮০ টাকা।।প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৫।। ১৯৩৬-এর ১৮ অগাস্ট থেকে ১৯৪৭-এর ১৩ আগস্ট এই এগারো বছর এগারো মাস ২৫দিন যতীন সরকারের জীবনে পাকিস্তানের আগের বাংলাদেশে বসবাস। ময়মনসিংহের নেত্রকোনায় তার বসবাসের স্মৃতিচারণায়—বড়দের মুখে শোনা, শৈশবের চোখে দেখা—এই দার্শনিক সবচেয়ে যত্নে লিখেছেন পাকিস্তানের আগের বাংলাদেশের স্মৃতি।তারপর বইটিতে পাওয়া যায় পরবর্তী দুই যুগের পাকিস্তানি বাংলাদেশের দার্শনিক সময়কাল। বইটি শেষ হয় বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে যতীন সরকারের ত্রিকালদর্শী দার্শনিক হয়ে ওঠার ভাবনাবেদনায়।পাকিস্তানের আগের বাংলাদেশই পাকিস্তানি ২৪ বছরের বিধ্বস্ত বিকলাঙ্গ বাংলাদেশকে শক্তি যুগিয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের। বইটি ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সালে লেখা হয়েছিল, প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৫ সালে, লেখক আমাদের ইঙ্গিত দিয়েছেন পঁচাত্তর পরবর্তী এই তিরিশ বছরের পাকিস্তানি ভূততাড়িত এক অন্য বাংলাদেশের। ত্রিকালদর্শনের উপন্যাস পাঠের মোহনীয় বই। সংগ্রাম ইতিহাসের নয় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস।।ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ।।ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড।।প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭।।দাম ২০০ ভারতীয় টাকা।। এটি ইতিহাসের বই নয়। সেই সুযোগও নেই। কারণ এটি সংগ্রামের বই। আর সংগ্রাম ইতিহাসের নয়। চলমান ভবিষ্যতের। নাম্বুদিরিপাদ এক বড় মাপের ভারতীয় রাজনীতিক। স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরো সময়টা জুড়ে ভারতের সবচেয়ে সক্রিয় নেতাদের একজন। তার লেখা এই বইটি এতই প্রাণবন্ত, ইতিহাস লেখার মানের দিক থেকে তৃতীয় শ্রেণীর হয়েও, রাজনৈতিক গুরুত্বে এক অসাধারণ বই। ভারতের স্বাধীনতা যে শুধু অন্তহীন আলোচনা, সাম্প্রদায়িক বিভেদ, নিষ্ঠুর দাঙ্গার মধ্য দিয়ে মধ্যরাতে অর্জিত স্বাধীনতা নয়; ভারতের স্বাধীনতা এক জটিল বাস্তবতার ভেতর বহুতর মানুষের অবিস্মরণীয় জীবনীশক্তির আন্দোলন সংগ্রামের জয় না পরাজয় এই দ্বিধার মধ্যে দাঁড়িয়ে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় খামখেয়ালি। রায়তের স্বাধীনতা এমন-ই হয়। ভারতের রায়তের স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাসের নয়, ভবিষ্যতের, প্রজা থেকে প্রজাতন্ত্রে উত্তরণের, সে সংগ্রাম এখনও চলছে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসই প্রেরণা জোগাচ্ছে। অধিকার পারিবারিক নয় মা।।ম্যাক্সিম গর্কি।।অনুবাদ পুষ্পময়ী বসু।।ন্যাশনাল বুক এজেন্সি…

এই বইটা আমি পাঠ করি অসম্ভব দ্বিধা নিয়ে। তবে লেখকের দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা খুবই তেরছা। অবশ্যই যথেষ্ট প্রমাণপত্র তিনি বইটাতে তুলে ধরেছেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সমকালীন নেতৃবৃন্দকে তিনি চুলচেরা বিচার করে ছেড়েছেন। বইটির মোটকথা হচ্ছে বৃটিশদের সাথে বিড়লাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। আর বিড়লা ছিল গান্ধীর মানসপুত্র। বৃটিশ এবং বিড়লারা গান্ধীকে আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে যা যা করা দরকার সবই করত। এর জন্য তাদের ছিল বিশাল বাজেট। গান্ধী অহিংস থাকতেন তখন যখন ইংরেজদের ওপর আক্রমণ করার প্রয়োজন হতো আর যখন ভারতীয়দের ওপর আক্রমণ হত তখন তিনি অহিংস থাকতেন না। কংগ্রেসের ভিতর থেকে মুসলিম লীগ বলে যে শুয়াপোকাটি বের হল তার মূলে আছে গান্ধীর স্বেচ্ছাচারিতা। তিনি কারও মন্তব্য সহ্য করতেন না। বাংলা বিভাজনেও বিড়লাদের ভূমিকা ছিল খুব বেশী । বৃটিশরা উভয় বাংলাকে একটি রাষ্ট্র হিসাবে ভাগ করে দেয়ার পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু বিড়লাদের বেশীর ভাগ ব্যবসা বাণিজ্য ছিল পশ্চিম বাংলায়, তাই গান্ধীকে দিয়ে বিড়লা পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের অংশ করে নেন আর পূর্ববাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করে দিয়ে ভারতকে দাঙ্গা অধ্যুষিত উপমহাদেশে পরিণত করেন। এরকম আরো বহু তথ্যে বইটি ভাস্বর। বইটি পড়ে আমি রীতিমত রোমাঞ্চিত হয়েছি। দেশভাগ বিষয়টা অসম্ভব স্পর্শকাতর একটা বিষয়, এবং এখনো অব্দি  অমীমাংসিত; তাই আলোচনার অবকাশ এখনো যথেষ্ট।

আধুনিক জগত থেকে ক্লেশকর এক যাত্রার শেষে, আলেহো কার্পেন্তিয়েরের লোস পাসোস পারদিদোস_ দ্য লস্ট স্টেপস_(১৯৫৩) উপন্যাসের নায়ক সান্তা মনিকা ডে লা ভেনাদোস এ পৌঁছে। আদেলান্তাদো সেখানে জঙ্গল কেটে কয়েকটি কুড়েঘরের একটি শহর পত্তন করেছে। নামহীন সেই নায়ক মনে করে, কিংবা মনে করতে ভালবাসে যে, এটাই সেই উপত্যকা যেখানে সময় থিতু হয়েছে, সময় আর এগয় না যেখানে। কারণ, জায়গাটি ইতিহাসের খাতের বাইরে। তার ধারণা এখানেই সে নিজেকে ফিরে পাবে। তার ইচ্ছা হয় অডেসিকে ভিত্তি করে এক সাংগীতিক সৃষ্টি করে। তাই নগরপত্তনিদারের কাছে কিছু কাগজ চায়। কিন্তু আদেলান্তাদোর কাছে যা আছে তা তো নতুন শহরের আইন লিখতেই লেগে যাবে। তবুও আরও একটি নোটবই তাকে দেয়া হয়। দ্রুতই তা ভরে যায়। বিরক্ত আদেলান্তো তাকে শেষ নোটখাতাটি দেয়। তখন চরিত্রটি বাধ্য হয় গুটিগুটি অক্ষরে লিখতে, প্রতিটি শূন্যস্থান কাজে লাগাতে, এমনকি নিজের জন্য একধরনের সাঁটলিপিও সে আবিষ্কার করে। কিন্তু তাতেও না কুলালে সে কেবলই লেখে আর মোছে। কেননা তার সামনে যাওয়ার কোনো স্পেস নাই। তাই লেখা, মোছা আর পুনর্লিখন প্রক্রিয়ায় তার পাণ্ডুলিপি আর্কাইভের রাখা ও ফেলার (The economy of Loss and Gain) কসরতে ঢুকে যায়। রবার্টো গঞ্জালেস এচেভারিয়া তাঁর মিথ এন্ড আর্কাইভ অভিসন্দর্ভে দেখান যে, কার্পেন্তিয়েরের হাতেই হালের লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের আদল কীভাবে দাঁড়িয়ে যায়। পরে, আমরা দেখব যে, মার্কেজ, ফুয়েন্তেস, য়োসার উপন্যাসে এরকমই কিছু অসাধিত পাণ্ডুলিপি ফিরে ফিরে আসছে। তা-ই যেন হয়ে ওঠে লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের আদি টেক্সট। পাশাপাশি, আদি পাণ্ডুলিপির সমান্তরালে পাচ্ছি একটা যাত্রার বিবরণ: নদীর বন, পাহাড়ের ওপর দিয়ে। এবং আখ্যানগুলো যেন অসম্পূর্ণ। যেন পরের কেউ এসে তাকে এগিয়ে নেবে। এই মর্ত্যরে রাজত্বে, পেদ্রো পারামো, শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা যেন একই আখ্যানের লিখন, লেপন ও পুনর্লিখনের সাঁটলিপি। একেকটি নতুন শুরু, ভিন্ন ভিন্ন দেশ ও কালের মধ্যে। এশেভারিয়ার ভাষায় লোস পাসোস পারডিদোস হলো সেই মহাআখ্যানের মহাফেজখানা। এ প্রক্রিয়ায় যা ঘটছে, এশেভারিয়া বলছেন, If Carpentier’s novel is the founding archival fiction, Garcia Marquez’ is the architypical one. পাওয়া ও হারানো, আত্ম-আবিষ্কারের সফর, নতুন আরম্ভের মিথ আর সেই আদি অভিজ্ঞতানিচয় মিলে গঠন করে লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের মণিমুকুর বা পড়ৎব। কার্লোস ফুয়েন্তেসের টেরা নোস্ত্রা (১৯৭৬), কার্পেন্তিয়েরের এল রেইনো…

শাস্ত্র মতে উপন্যাস মহাকাব্যের বংশধর। মহাকাব্যকে বলা যায় সাহিত্যের মাতৃক্রোড়। একদা মহাকাব্য চারণ কবিগণ মুখে মুখে আওড়াতেন। রাজা ও প্রজা যাকে নিয়েই রচিত হোক, মহাকাব্যগুলোতে একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়- মাত্রাঐক্য। একই আবহের মধ্যে দিয়ে যেন ঘটনাপ্রবাহ এগিয়ে যায়। কোথাও এতটুকু বেতাল হচ্ছে না। সন্দেহ নাই সুর কেটে গেলে সেটা মহাকাব্য হিসাবে অসফল। ধারাবাহিকতা, কাহিনীর সমন্বিত বিস্তার, সময়োপযোগী ডিটেল ও ভাষার ব্যবহারই মূলত একই লয়ে তাকে ধরে রাখে। শালোকভের বয়ানে-উপন্যাসিকদের সঙ্গীত জ্ঞান জরুরী। সব সফল মহৎ উপন্যাস গুলোতে এই মহাকাব্যের গভীরতা বিদ্যমান। মহাত্মা বালজাক এই কারণে তার উপন্যাসমালার নাম রাখেন হিউম্যান কমেদিয়া। এই উপন্যাসমালার প্রতিটি উপন্যাস মিলে যেন একটা মহাকাব্য। ফরাসী সমাজের সব ধরনের চরিত্র তাতে বিদ্যমান। শালোকভের বৃহৎ উপন্যাস প্রশান্ত দনে শত চরিত্রের ঘনঘঠা বহু ঘটনার বিস্তার। বলা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, রুশীয় গৃহযুদ্ধ থেকে অক্টোবর বিপ্লব পর্যন্ত, কিন্তু পুরা উপন্যাসের পরতে পরতে যেন একই ধারার সঙ্গীত বেজে চলেছে। কখনোই কেন্দ্রচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়তে হয়না পাঠককে। তলস্তয়ের মহাকাব্যিক উপন্যাসসমূহ আনা কারেনিনা, পুনরুজ্জীবন। দস্তয়েভস্কির কারামাজভ ভাইয়েরা, অপরাধ ও শাস্তি অথবা স্তাদালের লাল ও কালো। মহাকাব্যর একটা পর্যায় ছিল যখন তা লিখিত হতো  দেব দেবীদের নিয়ে। নিদেন পক্ষে রাজা বাদশা আমির ওমরাহদের নিয়ে। কেননা রাজাবাদাশাহরাই ছিলেন তৎকালে কবিদের  পৃষ্টপোষক। কিন্তু ইতোমধ্যে মানুষ যুদ্ধে, ভূমিকম্প,অগ্ন্যুৎপাত, রোগে, মহামারীতে নিজের অভিজ্ঞতাতো সম্মৃদ্ধ করলোই তদোপরি নিজের সীমাটাকে সে নির্ধারণ করতে পারলো। চিহ্নিত করতে পারলো তার অসহায়ত্বকে। এমনকি তলস্তয়ের চরিত্র সমূহ নেখলেয়ুদভ অথবা কনস্তানতিন লেভিন, ব্রনস্কি, কারেনিন অথবা পিটার, সুফিয়া প্রায় সব চরিত্র ধনতন্ত্রের প্রতিনিধি বইতো নয়! প্রলেতারিয়েত চেতনা থাকা সত্বেও লেভিনও তাই। যাইহোক আধুনিক কালের উপন্যাসই মহাকাব্যের বংশধর হিসাবে উত্তম। বিশ্বসাহিত্যে সম্ভবত দস্তয়েভস্কিই সেই মহৎ উপন্যাসিক যার শুরু থেকেই চরিত্ররা একেবারে সাধারণ মানুষ। দস্তয়েভস্কি গোগল সম্পর্কে বলেছিলেন গোগলের ওভারকোট এর পকেট থেকে আধুনিক রুশ সাহিত্যের জন্ম। দস্তয়েভস্তি সম্পর্কেও বলা যায় যে আধুনিক উপন্যাসেরও জন্ম তার রাসকলনিকভে। তার চরিত্র সমূহে। কার্যত দস্তয়েভস্কি ও বালজাকের পর উপন্যাস আর আগের মত থাকে নাই। ব্রাত্য অন্তর্মুখী অভাজনেরাই আধুনিক মহাকাব্য তথা উপন্যাসে প্রধান চরিত্র হয়ে আসতে লাগল। এবং উপন্যাসে সাধারণ মানুষের স্থান বলা যায় চিরস্থায়ী হয়ে গেল। যদিও এই সাধারনত্বের গোত্রভিত্তিক…

শ্রদ্ধেয় দ্বিজেন শর্মাকে নিয়ে এ লেখাটি লিখেছিলাম অনেক আগে, ১৯৯৮ সালে। কয়েকদিন হলো তাঁকে খুব মনে পড়ছে... আপনাদেরও মনে পড়ুক, এই প্রত্যাশায় লেখাটা তুলে দিচ্ছি। (more…)

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.