তিনি শুধু প্রগতিশীল সমাজের সেনাপতিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশি চিন্তার একজন অভিভাবকও। এটা বুঝতেও আমাদের সময়ের দরকার হতে পারে। একটা ধাবমান অন্ধকার ছিল তাঁর আক্রমণের লক্ষ্যস্থল। [...]

'সৃষ্টি করো সেই সব যা দেখে জনগণ বিদ্ধ করবে বিদ্রূপে। আর সেটুকুই হলে তুমি।' -- জাঁ ককতো আমরা কেউই আশা করিনি হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭-২০০৪) এত অচিরাৎ মৃত্যুকে গ্রহণ করবেন। আমরা বলতে যারা তাঁকে সেনাপতি জ্ঞান করতাম। বস্তুত পক্ষে তিনি শুধু প্রগতিশীল সমাজের সেনাপতিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশি চিন্তার একজন অভিভাবকও। এটা বুঝতেও আমাদের সময়ের দরকার হতে পারে। একটা ধাবমান অন্ধকার ছিল তাঁর আক্রমণের লক্ষ্যস্থল। সাহিত্যের ইতিহাস মূলত অজ্ঞানতা আর অন্ধকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ইতিহাস। আর সমস্ত আবিষ্কার ভয় থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য। আগুন জ্বালানোর পর মানুষের ভয় অনেকখানি কেটে যায়। আলো সবসময় অন্ধকারের শত্রু। তবে আজাদের সময়ের সব চাইতে বড় অন্ধকার হচ্ছে অজ্ঞানের অন্ধকার। এটা প্রতিক্রিয়াশীল এবং সংক্রামক। উগ্র এবং আদেশপ্রবণ। অনেকটা দানবীয় তার স্বভাব। যার বিরুদ্ধে তিনি লড়েছিলেন। ভাবি যে হুমায়ুন আজাদ কি জানতেন না তাঁর শত্রুর অপশক্তি ও দেহকাঠামো সম্পর্কে? যদি তিনি তা জানার পরও সম্মুখসমরে লড়াই করতে মনস্থির করে থাকেন এবং লড়াই চালিয়ে যান আমৃত্যু, তাহলে তাঁকে অসম্ভব সাহসী, সৎ আলোকপ্রাপ্ত শহিদ সেনাপতি হিসেবে তকমা মারা যায়। হুমায়ুন আজাদের আঘাতের প্রক্রিয়া এত সরাসরি এবং এত সঠিক ছিল যে তাঁকে একমাত্র ফরাসি চিরবিদ্রোহী দার্শনিক মহাত্মা ভলতেয়ারের সাথেই তুলনা করা চলে। আর আমার বিশ্বাস, এই যুদ্ধে নামার আগেই তিনি মৃত্যুকে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সক্রাতেসকে জানতেন, জানতেন ভলতেয়ারকে, জানতেন গ্যালিলিওকে, জানতেন হাইপেশিয়াকে। তাঁর স্থান অন্ধকারের বিরুদ্ধে এই সব সৈনিকদের কাতারে খোদাই হয়ে গেছে। যদিও তাঁর প্রায় উপন্যাসে তিনি যৌনতাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন আধুনিকতার নাম করে, তবুও মনে হয় তিনি মেজাজে মার্ক্সীয় ছিলেন। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে যেখানে লেখক-সাহিত্যিকরা নব্য সিনিসিজমে মেতে উঠেছেন, যখন তাঁরা পৃথিবীব্যাপী বোমার শব্দে জেগে উঠে বলেছেন, 'অনেক ঘুমাতে চেয়েছি আমি' এবং তারপর পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছেন, সেখানে তিনি জেগে ছিলেন এবং নির্ভয়ে বিহার করে চলেছেন এই পোড়োজমিতে এবং হাঁকিয়ে চলেছেন সম্মুখ-রণাঙ্গনে। তিনিও তো পারতেন প্রথম দুনিয়ার কোনো দেশের পুঁজির গোলামি করতে বা পালিয়ে যেতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে। কিন্তু তিনি তা করেননি। এ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে তিনি নিজেকে একা মনে করতেন না, তিনি নিজেকে সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার অংশ মনে করতেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, 'অন্ধ হলেই প্রলয়…

সম্ভবত নয়-দশ বছর আগের কথা। কোন সাল এখন আর নিশ্চিত করে মনে নেই; তবে দিনটা ছিল অক্টোবর মাসের তেইশ তারিখ। [...] ... শেষ যে-বার সে-বাড়িতে যাই, ড্রইংরুম অব্দি আর যেতে হয়নি। বারান্দাতেই দুটো চেয়ার পাতা ছিল, সেখানে বসেই কথা চলল খানিকক্ষণ। [...] ... অধুনালুপ্ত 'নতুন সাহিত্য' পত্রিকার একেবারে প্রথম দিকের কয়েকটি সংখ্যার পাতা উল্টাতে গিয়ে একবার চোখ আটকে গিয়েছিল একটি কবিতায় [...]

১ সম্ভবত নয়-দশ বছর আগের কথা। কোন সাল এখন আর নিশ্চিত করে মনে নেই; তবে দিনটা ছিল অক্টোবর মাসের তেইশ তারিখ। বাসা থেকে বেরিয়ে ফোনের দোকানে পৌঁছতে প্রায় পৌনে ন'টা। ও-পাশ থেকে নারীকণ্ঠ শুনে বুঝে নিই, দেরি করে ফেলেছি। 'একটু লাইনে থাকুন।' খানিকক্ষণ পর পরিচিত সেই চপ্পলের আওয়াজ। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে নিজের রুমে পৌঁছলেন তিনি। তিন-চার মিনিট কথা হলো। জানালেন খুব খুশি হয়েছেন ফোন পেয়ে। আমারও খুব খুশি লাগছিল সকালেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পেরে। আর বিব্রতও লাগছিল। আধঘণ্টা আগে ফোন করলেই তাঁকে কষ্ট করে সিঁড়ি ভাঙতে হতো না। কথা শেষে আবার নিশ্চয়ই ফিরে গেলেন নীচে, চপ্পলে ফট্‌ফট্‌ আওয়াজ তুলে। বই-দিয়ে-ঘেরা সুপরিসর ড্রইংরুমে এরই মধ্যে জড়ো হয়েছেন অনেকে। তাঁরা এসেছেন তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে। আজ তাঁর জন্মদিন। ২ শেষ যে-বার সে-বাড়িতে যাই, ড্রইংরুম অব্দি আর যেতে হয়নি। বারান্দাতেই দুটো চেয়ার পাতা ছিল, সেখানে বসেই কথা চলল খানিকক্ষণ। চা-ও চলে এল অল্পক্ষণের মধ্যে। আগে বাইরে থেকেই চোখে পড়ত দেয়ালে ঝোলানো মুর্তজা বশীরের 'এপিটাফ' সিরিজের একটা ছবি, কয়েক বছর আগে সেটাকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়া হয়েছে। জানা ছিল না যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে অল্পকাল আগে তাঁর একটা বই বেরিয়েছে -- পাণ্ডুলিপি সংস্করণ। দেখলাম। আর জানলাম ছায়ানট ভবনে তাঁর নামে একটা কক্ষ করা হয়েছে। তাঁর সংগ্রহের সবগুলো বই সে-কক্ষে সংরক্ষণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ছায়ানট। তাহলে কি সব বই দিয়ে দেয়া হবে? না, এখনো মত দেয়া হয়নি তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে। দেখা যাক। আগের মতোই কি আছে তাঁর বইগুলো, বিছানা-ঘেরা শেল্‌ফে পরিপাটি সাজানো আর লেখার টেবিলের উপর এলামেলো হয়ে? কিছুই পালটায়নি। যেভাবে রেখে গেছেন ঠিক সেভাবেই রাখা আছে সবকিছু তাঁর ঘরে। 'দোতলায় গিয়ে দেখে আসবে নিজের চোখে?' না, থাক। আবার আসব, হ্যাঁ, ফোন করেই আসব। বিদায় নিই তাঁর পুত্রবধূর কাছ থেকে। ৩ অধুনালুপ্ত নতুন সাহিত্য পত্রিকার একেবারে প্রথম দিকের কয়েকটি সংখ্যার পাতা উলটাতে গিয়ে একবার চোখ আটকে গিয়েছিল একটি কবিতায় -- 'কয়েকটি দিন : ওয়াগনে'। কবিতাটির নীচে সম্পাদক অনিলকুমার সিংহ একটি টীকা জুড়ে দিয়েছিলেন : বহু মুসলমান শরণার্থী আজ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের দাক্ষিণ্যে পরিত্যক্ত ও অকেজো রেলওয়ে ওয়াগনে দিন যাপন করছে। উপরোক্ত কবিতাটি…

ত্রিশ-দশকে আবির্ভূত একদল শিক্ষিত মেধাবী কবির হাতে ‘স্থূলতা, মেকিত্ব ও প্রাকৃত আবেগ ছেড়ে বাঙলা কবিতা আলিঙ্গন করলো সূক্ষ্মতা, স্বাভাবিকতা ও রুচিশীলতাকে’; মহাপরাক্রমশালী রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয়ের বাইরে প্রবাহিত হতে শুরু করলো বাংলা কাব্য-নন্দনের এক নবস্বাদধারা। যেখান থেকে বাংলা কবিতায় ‘আধুনিক যুগের ব্যাপকায়তন যাত্রাপাত [...]

ত্রিশ-দশকে আবির্ভূত একদল শিক্ষিত মেধাবী কবির হাতে ‘স্থূলতা, মেকিত্ব ও প্রাকৃত আবেগ ছেড়ে বাঙলা কবিতা আলিঙ্গন করলো সূক্ষ্মতা, স্বাভাবিকতা ও রুচিশীলতাকে’ ((প্রসঙ্গ বাংলাদেশের সমালোচনা সাহিত্য, আবিদ আনোয়ার, বাংলা কবিতার আধুনিকায়ন, ১৯৯৭, ঢাকা)) ; মহাপরাক্রমশালী রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয়ের বাইরে প্রবাহিত হতে শুরু করলো বাংলা কাব্য-নন্দনের এক নবস্বাদধারা। যেখান থেকে বাংলা কবিতায় ‘আধুনিক’ যুগের ব্যাপকায়তন যাত্রাপাত। ক্ষুদ্রায়তনে ‘আধুনিক’ শব্দটির প্রয়োগ এর আগে মাত্র একজন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়েছিল। সে ‘আধুনিকতা’ এবং ত্রিশের সূক্ষ্মতা, স্বাভাবিকতা আর রুচিশীলতাসূচক ‘আধুনিকতা’ এক নয়। চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-আশি বাহিত হয়ে এখনো অবধি প্রবহমান যে ‘আধুনিকতা (উত্তর-আধুনিকতার কথা মনে রেখেই), তা মধুসূদনের নয়, ত্রিশের। ত্রিশের পাণ্ডবগণের জীবনবাদিতা ছিল ভিন্নরকম। ‘তাঁরা রাজনীতিনিরপেক্ষ, সমাজবিমুখ, ব্যক্তিবাদী কিন্তু জীবনবাদীও এ-অর্থে যে তাঁদের হাতেই বাঙলা কবিতা এই প্রথম স্বপ্নীল ভাবলোকের নিকুঞ্জ ছেড়ে হৈ হৈ করে ঢুকে পড়ল জনজীবনের আনাচে-কানাচে, গৃহিণীর হেঁসেলে, গেঁদু মোড়লের সালিশী বৈঠক থেকে নগরীর ফুটপাত, অলিগলি এমনকি পতিতালয়ের নিষিদ্ধ প্রকোষ্ঠে। কিন্তু এত জীবনলগ্ন হয়েও এসব কবিতার অধিকাংশ নির্গত হয়েছে ব্যক্তিমানসের নিঃসঙ্গ অন্তর্লোক থেকে। এই নিঃসঙ্গতা আধুনিক বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে জাত; এই চেতনা যত না কবির স্বসৃষ্ট তারও চেয়ে বেশি বিনষ্ট সময় ও সমাজের দান।’ ((মধ্যদিনের জানালা, আবিদ আনোয়ার, বাংলা কবিতার আধুনিকায়ন, ১৯৯৭, ঢাকা)) --এই যে অস্থিরতার সাথে কবিতাকর্মীদের আত্যন্তিক সাক্ষাৎ ত্রিশ-দশকীয় গবাক্ষপথে; একটিমাত্র দশকান্তরে সেই অস্থির পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে অস্থিরতর। বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের পাশাপাশি ভারতভূমিতেও এ সময়ে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এমনসব ঘটনাবলি সমুপস্থিত হয়েছে যে চল্লিশদশক আধুনিক ভারতবর্ষের সবচেয়ে কম্পমান, অনিশ্চয়তামণ্ডিত দুর্দশক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এর প্রতিক্রিয়া স্পর্শ করেছে লেখককুলকেও। নির্মাণ প্রক্রিয়ায় নিঃসঙ্গ হয়েও বাইরে তাঁরা হয়ে উঠেছেন সঙ্গপরিবেষ্টিত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক কবিই যুক্ত হয়ে পড়েছেন বঞ্চিত মানুষের আন্দোলনে। কবিতার বিষয় হিসেবে সময়, সমাজ, মানুষ, মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস হয়ে উঠেছে ব্যক্তিক নৈসঃঙ্গ্যের চেয়েও বড়ো। লিখিত হয়েছে প্রচুর উচ্চকণ্ঠ স্লোগানও। আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫) এই উত্তুঙ্গ আন্দোলনমুখর বিনষ্ট সময়েই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’ (১৯৪৭)-এর প্রকাশের মধ্য দিয়ে কবি আহসান হাবীব হিসেবে স্বয়ম্প্রকাশিত। সুতরাং ‘রাত্রিশেষ’-এর মূল্যায়নপ্রয়াস পুরোটাই অর্থহীনতায় পর্যবসিত হবে, যদি না তৎকালীন ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটি সামনে নিয়ে আসা হয়। সেটা হবে অসঙ্গত এবং অযৌক্তিকও। এখানে কাজেই রাত্রিশেষের গান…

কবিবন্ধু ফুয়াদ হাসানের ফোন পেলাম রবিবার (৫ জুলাই ২০০৯) দুপুরে, যদিও আগের দিনই খবরটা পেয়েছিলাম সুমন ভাইয়ের (রেজাউল করিম সুমন) কাছে। পত্রিকায় জানলাম, আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯) মারা গেলেন শুক্রবার রাতে। কিন্তু দেরিতে হলেও ফুয়াদের ফোনালাপে প্রচ্ছন্ন ছিল এক স্মৃতিপ্রাসঙ্গিকতা। [...]

কবিবন্ধু ফুয়াদ হাসানের ফোন পেলাম রবিবার (৫ জুলাই ২০০৯) দুপুরে, যদিও আগের দিনই খবরটা পেয়েছিলাম সুমন ভাইয়ের (রেজাউল করিম সুমন) কাছে। পত্রিকায় জানলাম, আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২–২০০৯) মারা গেলেন শুক্রবার রাতে। কিন্তু দেরিতে হলেও ফুয়াদের ফোনালাপে প্রচ্ছন্ন ছিল এক স্মৃতিপ্রাসঙ্গিকতা। বহুদিন আগে, যখন আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্র, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে একসঙ্গে পড়েছিলাম ভোরের নদীর মোহনায় জাগরণ। এ-বইয়ের 'দুই আফসোস' কবিতাটি আমাদের দুজনকেই আক্রান্ত করেছিল শরব্যঞ্জনায়। পরে অনেকবার চিরকুট দিয়েও বইটির খোঁজ পাওয়া যায়নি। আজাদের লেখার সঙ্গে আমি আকৈশোর পরিচিত, বলা যায়, তিনি ছিলেন আমার প্রথম সাহিত্যনায়ক। নবম শ্রেণিতে, ১৯৯২-এ, পাঠ্যবাংলার কবিতাসঙ্কলনে 'আমার মা'কে যখন' নামের একটি সম্মোহক দীর্ঘকবিতা ছিল তাঁর। দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য এই : কবিতাটি পরীক্ষার পাঠ্যসূচির বাইরেই পড়ে ছিল সারাবছর। আমার এতই প্রিয় ছিল যে পাঠোচ্ছ্বাসে মুখস্থ হতে দেরি হয়নি। প্রথম স্তবক মনে আছে এখনও : আমার মা'কে যখন মনে পড়ে চলতি বাসের ভিড়ে জানালায় তাকাই করুণ আমি, রডধরা সহযাত্রীর হাতের যত ঘাম লাগে গালে ঝাঁকুনির তালে তালে এবং যদিও খুব নিরুপায় গরম নিঃশ্বাসে চাপে দেখি দূরে হলুদ-সবুজ বন, কালোজাম থোকা থোকা ধরে আছে আলগোছে ঠোকর মারে কাকেরা, উড়ে যায় ডাল থেকে ডালে, বসে কি যে খুশি দুপুররোদেও ডাকে অবিশ্রাম। আমি মুগ্ধ শিশু, চোখে এক হ্রদ বিস্ময়ের ঝিকিমিকি, মহাকায় বটগাছ খেলা করে বাতাসের স্রোতে―হাতে পাখি নীলকণ্ঠ নাম তখন ছন্দের কোনও ধারণাই ছিল না; পরে বুঝলাম, কবিতাটির গায়ে বোলানো হয়েছে অক্ষরবৃত্তের সোনারুপোর কাঠি, যা উতল গাঙের বুকেও এনে দিতে পারে নিঝুম অরণ্যের ঘুম। এ-ও দেখলাম, অষ্টাক্ষর পর্বকে মাঝেমধ্যেই ৩+২+৩ মাত্রার বিরলকর্ষিত বিলে চালিয়ে নিয়েছেন কবি অবলীলায়। অন্তর্মিলে ও অন্ত্যমিলে বহমান এক স্মৃতিকাতরতা মুগ্ধ করে রেখেছিল আমার কিশোরহৃদয় এবং এখনও ভিড়েলা বাসে কোথাও যেতে যেতে যেন 'গালে লাগে' 'রডধরা সহযাত্রীর হাতের যত ঘাম'। ২ কিন্তু কবিতা নয়, উপন্যাসের সূত্রেই আজাদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়, আমার এক খালাতো ভাই দুটি বই নিয়ে এসেছিলেন বাসায়। একটি পারস্য উপন্যাস, অন্যটি আজাদের শীতের শেষ রাত বসন্তের প্রথম দিন। বইদুটি ছিল মায়ের দখলে―দূর থেকে দেখতাম বিড়ালের কারুণ্য নিয়ে। আমার অভিশাপে মায়ের চোখে ঘুম নেমে আসত দুপুরে, তখন একটু-একটু পড়ার সুযোগ…

খুব ভালো একজন কবিও কবিতা সম্পর্কে লিখতে গেলে উল্টাপাল্টা লিখতে পারেন। তার লেখায় ফুটে উঠতে পারে বিব্রতবোধ, বিনয় কিংবা নিজেকে লুকানোর চাতুর্য। উপায় নাই, কবিতা কি? এটা খুব সহজ প্রশ্ন নয়। অন্তত একজন কবির পক্ষে। এই একটি মাত্র প্রশ্ন ব্যক্তিভেদে একেক রকম হয়ে যায়। কেননা সব ব্যক্তি যারা কবিতা লেখে সবার অনুভবের ঐক্য এক রকম নয়। পাবলো নেরুদা বলেছিলেন, কোনো কবিকে এ ধরনের প্রশ্ন করা অনেকটা কোনো মহিলাকে তার বয়স জিজ্ঞেস করার মত। কবিরাওতো সামাজিক জীব। সাধারণের সাথে তারাও একই সমাজে বাস করে। একই রাষ্ট্রের উৎপাদিত শষ্যাদি খেয়ে তারা জীবন বাচায়। সাধারণের সাথে একই স্কুলে কলেজে তারাও লেখাপড়া চালিয়ে যায়। কিন্তু এদের মধ্যে কারো ওপর ভর করে কবিতার আছর। যদিও রূপকার্থে অনেক সুন্দর সুন্দর বাক্য তৈরি করা যায়। কিন্তু এটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার দিকে নজর দেয়া যাক। জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগানের মতে মানব মস্তিষ্কের প্রধানতম কর্টেক্স সমূহ হচ্ছে সেরিব্রাল কর্টেক্স এবং আর কমপ্লেক্স। ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশনের পথে যে যোগ্যতার প্রশ্ন দেখা দেয় সেটা হচ্ছে টিকে থাকার যোগ্যতা। প্রাণী মাত্রের জন্যই পৃথিবী প্রতিকূল। সে সব প্রতিকূলতাকে সরাসরি অথবা কৌশলে বশ অথবা পরিহার করতে পারাকে যোগ্যতা বলে। টিকে থাকার প্রশ্নে প্রাণী চরিত্রে যে শিকার মনোবৃত্তির বিকাশ। এই শিকার সংক্রান্ত চিন্তা বলয়ের অধীনে মস্তিষ্কের যে প্রাকৃত অংশের বিকাশ তাকে বিজ্ঞান বলছে রয়্যাল কমপ্লেক্স। ইতোমধ্যে মানুষ তার খাদ্য বাসস্থান বন্যা দুর্ভিক্ষ ভূমিকম্প কিংবা অগ্নু্যৎপাতের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে। ইত্যাদি কারণে যাযাবর বৃত্তির যে প্রক্রিয়া তাকে গ্রহণ করতে হল। তার অবসর সময়চেতনা প্রকৃতির সাথে তার ভাব-অভাব অথবা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি দুর্বোধ্য টান ইত্যাদির চিন্তাসমগ্রের বিকাশের ক্রমপথে মস্তিষ্কের অন্য প্রধান যে কর্টেক্সের আবির্ভাব বিজ্ঞান তার নাম রাখেন সেরিব্রল কর্টেক্স। যে কারণে মানুষ গান শোনে কবিতা পড়ে অথবা লেখে প্রেম করে শ্রদ্ধাবোধে জড়িত হয়, তার চোখে সহমর্মিতার অশ্রু গড়ায়। পুরানা জমানায় কবিকুলের স্থান ছিল রাজসভা। তারা রচনা করতেন মহাকাব্য পুথি। এসব গীত হতো জনতার মাঝখানে, মুখে মুখে। বেশির ভাগ শাসকই ছিল দখলদার দস্যু অত্যাচারী প্রকৃতির। এদের মধ্যে ঘটেছে আর কমপ্লেক্সের চরমতম বিকাশ। ইতিহাসের কুখ্যাত শাসক চেঙ্গিজ খান। এই অশিক্ষিত পাশবিক শাসক যিনি সভ্যতার প্রভূত ক্ষতি করেছেন। তিনি শেষ…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.