‘সৃষ্টি করো সেই সব যা দেখে জনগণ বিদ্ধ করবে বিদ্রূপে। আর সেটুকুই হলে তুমি।’ — জাঁ ককতো
আমরা কেউই আশা করিনি হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭-২০০৪) এত অচিরাৎ মৃত্যুকে গ্রহণ করবেন। আমরা বলতে যারা তাঁকে সেনাপতি জ্ঞান করতাম। বস্তুত পক্ষে তিনি শুধু প্রগতিশীল সমাজের সেনাপতিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশি চিন্তার একজন অভিভাবকও। এটা বুঝতেও আমাদের সময়ের দরকার হতে পারে। একটা ধাবমান অন্ধকার ছিল তাঁর আক্রমণের লক্ষ্যস্থল।
সাহিত্যের ইতিহাস মূলত অজ্ঞানতা আর অন্ধকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ইতিহাস। আর সমস্ত আবিষ্কার ভয় থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য। আগুন জ্বালানোর পর মানুষের ভয় অনেকখানি কেটে যায়। আলো সবসময় অন্ধকারের শত্রু। তবে আজাদের সময়ের সব চাইতে বড় অন্ধকার হচ্ছে অজ্ঞানের অন্ধকার। এটা প্রতিক্রিয়াশীল এবং সংক্রামক। উগ্র এবং আদেশপ্রবণ। অনেকটা দানবীয় তার স্বভাব। যার বিরুদ্ধে তিনি লড়েছিলেন। ভাবি যে হুমায়ুন আজাদ কি জানতেন না তাঁর শত্রুর অপশক্তি ও দেহকাঠামো সম্পর্কে? যদি তিনি তা জানার পরও সম্মুখসমরে লড়াই করতে মনস্থির করে থাকেন এবং লড়াই চালিয়ে যান আমৃত্যু, তাহলে তাঁকে অসম্ভব সাহসী, সৎ আলোকপ্রাপ্ত শহিদ সেনাপতি হিসেবে তকমা মারা যায়। হুমায়ুন আজাদের আঘাতের প্রক্রিয়া এত সরাসরি এবং এত সঠিক ছিল যে তাঁকে একমাত্র ফরাসি চিরবিদ্রোহী দার্শনিক মহাত্মা ভলতেয়ারের সাথেই তুলনা করা চলে। আর আমার বিশ্বাস, এই যুদ্ধে নামার আগেই তিনি মৃত্যুকে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সক্রাতেসকে জানতেন, জানতেন ভলতেয়ারকে, জানতেন গ্যালিলিওকে, জানতেন হাইপেশিয়াকে। তাঁর স্থান অন্ধকারের বিরুদ্ধে এই সব সৈনিকদের কাতারে খোদাই হয়ে গেছে।
যদিও তাঁর প্রায় উপন্যাসে তিনি যৌনতাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন আধুনিকতার নাম করে, তবুও মনে হয় তিনি মেজাজে মার্ক্সীয় ছিলেন। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে যেখানে লেখক-সাহিত্যিকরা নব্য সিনিসিজমে মেতে উঠেছেন, যখন তাঁরা পৃথিবীব্যাপী বোমার শব্দে জেগে উঠে বলেছেন, ‘অনেক ঘুমাতে চেয়েছি আমি’ এবং তারপর পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছেন, সেখানে তিনি জেগে ছিলেন এবং নির্ভয়ে বিহার করে চলেছেন এই পোড়োজমিতে এবং হাঁকিয়ে চলেছেন সম্মুখ-রণাঙ্গনে।
তিনিও তো পারতেন প্রথম দুনিয়ার কোনো দেশের পুঁজির গোলামি করতে বা পালিয়ে যেতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে। কিন্তু তিনি তা করেননি। এ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে তিনি নিজেকে একা মনে করতেন না, তিনি নিজেকে সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার অংশ মনে করতেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ‘অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না’। তাঁর কবিতাগুলোকে দেখি বক্তব্যে ভরা আর প্রেমে মহীয়ান। যদিও মহাকালের চেয়ে কবিতায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমকালের দিকে। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী দিলেন : ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’। আমাদের জন্য কত সত্য তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী! কবিতাকে তিনি ব্যবহার করেছেন অন্ধকার আর অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে। এক হিসেবে সমস্ত কবিতাই তা-ই। জীবনানন্দ যখন অবিরাম মহাকালিক বেদনার দিকে তাকিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন, ‘তিমির হননে তবু অগ্রসর হয়ে’ — আমরা কি তিমিরবিলাসী? বস্তুত তাও অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে যুদ্ধেরই মহামন্ত্র। তাঁর কবিতায় এক দিকে প্রেম অন্যদিকে চূড়ান্ত বিদ্রোহ। শান্তি এবং যুদ্ধ, প্রেম ও বিচ্ছেদ, জরা ও যৌবন এভাবেই এগিয়ে চলেছে পৃথিবী।
চৈতন্যে গ্রন্থিত হয়েছিলেন তিনি। এড়িয়ে যাননি কোনো দুঃসময়-দুঃশাসনকে। সামরিক একনায়কদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি লিখেছেন জলপাই রঙের অন্ধকার-এর মতো বই, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল-এর মতো বক্তব্যপ্রধান উপন্যাস। লিখেছেন প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে, সীমাবদ্ধতার সূত্র। মূলত তাঁর কবিতা এবং প্রবন্ধ (ভাষা সংক্রান্ত সম্পাদনা, প্রবন্ধাবলি বাদে) ও উপন্যাসে উঠে এসেছে তাঁর স্ব-সংস্কৃতি-প্রগতির পথে প্রধান অন্তরায়সমূহের সমালোচনা। আর তিনি শুধু বিষয়কে উপস্থাপন করেননি, সাথে সাথে বিষয়সমূহকে রক্তাক্ত করেছেন। ধারালো তলোয়ার দিয়ে সেসবকে তিনি চেঁছে ফেলে দিতে চেয়েছেন। নতুন করে তিনি সম্পাদনা করেছিলেন আধুনিক বাঙলা কবিতা, নতুন করে সম্পাদনা করেছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। মূলত তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিটাই ছিল অভিভাবক সুলভ। কিন্তু তিনি চপল বা চঞ্চল ছিলেন না। তাঁর বক্তব্যে আপাতগভীরতাও কম নয়। সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক প্রথায় সিদ্ধ হয়েও তিনি ছিলেন চূড়ান্ত প্রথাবিরোধী। কিন্তু তাঁকে কখনও রাগী তরুণ সম্প্রদায়ের লোক বলে মনে হয় না। চৈতন্যের দায় তাঁকে নাড়া দিয়েছিল।
জ্ঞান যাঁরা আহরণ করেন, মনে করি, তাঁরা সাথে সাথে আরও দুটি বস্তু আহরণ করেন : একটা হচ্ছে মারাত্মক কাণ্ডজ্ঞান, অন্যটা অসার কাণ্ডজ্ঞানহীনতা। কাণ্ডজ্ঞান একজন মানুষকে দায়বদ্ধ করে আর কাণ্ডজ্ঞানহীনতা তাঁকে করে তোলে আত্মপ্রেমে মাতোয়ারা। হুমায়ুন আজাদ প্রচণ্ড কাণ্ডজ্ঞানসম্বলিত ছিলেন। তিনি সবকিছুকে ঘেন্না করতে চেয়েছিলেন সবকিছুকে ভালোবেসে। তিনি কখনওই গ্রহণ করতে পারেননি এমন সাহিত্যকে যা সমাজকে স্থূলভাবে প্রকাশ করে। তিনি গ্রহণ করতে পারেননি মাথামোটা নেতাদের। তিনি বরদাস্ত করেননি চরিত্রহীন সাহিত্যিকদের। তিনি সহ্য করেননি সামরিক একনায়কদের। তিনি ছেড়ে দেননি সুবিধাবাদী আগাছা বুদ্ধিজীবীদের। সমস্ত অসাহিত্য, অপন্যাস, অকবিতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। মনঃতুষ্টির জন্য তিনি ছুটির দিনের অপন্যাস লেখেননি। লেখেননি কোনো দায়িত্বজ্ঞানহীন কাহিনি। তবে আক্রমণের পাশাপাশি তিনি অপেক্ষাকৃত বেশি মাত্রায় ব্যবহার করেছেন যৌনতাকে। মাঝে মাঝে তাঁর চরিত্রদের প্রতি সহানুভূতি রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তাদেরকে মনে হয় যৌনদানব। তবু তাদের প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্যাটায়ার। অতিমাত্রায় যৌনতার ব্যবহারও আসে এক ধরনের হতাশা থেকে, যেমন হতাশায় থাকলে মানুষ অতিমাত্রায় যৌনপ্রবণ হয়। তিনি নির্দিষ্ট কোনো মতবাদে বিশ্বাস করতেন না আগেই বলেছি, যদিও তিনি মেজাজে মার্ক্সীয় ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ পাশ্চাত্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মতো নয়। কেননা তিনি দায় এড়াতে পারেননি। এড়াতে পারেননি যে-সমাজে তিনি বাস করেন সেই সমাজকে। তাঁর উদ্ধত তলোয়ার ছিন্নভিন্ন করেছে বাঙালি মুসলমানকে। সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যান্টদের মতো। হুমায়ুন আজাদ জন্ম দিয়েছেন অপক্ষাকৃত ধর্মীয় উদার মনোভাবের। ধর্ম সম্পর্কে বাঙালি মুসলমানের যে-অন্ধ রক্ষণশীল মনোভাব, সেটা থেকে তিনি বাঙালি মুসলমানদের পরিত্রাণ দিতে চাইলেন। যেখানে তাঁর মৃত্যু, সেখানেই অন্যার্থে তাঁর যাত্রা শুরু। তাঁর মৃত্যুর পর এখন অনেকেই তাঁকে নিরপেক্ষভাবে বুঝতে চাইবে।
চিন্তার জয় সেখানেই — তাঁর মৃত্যু নেই। তাঁর বই অন্য অনেক জনপ্রিয় অপন্যাসিকের চাইতেও কম বিকোয় না। কারা পড়ে তাঁর বই? বিশেষ করে পড়ে তরুণরা, পিছিয়ে পড়া নারীগোষ্ঠী। তিনি চেয়েছিলেনও তা-ই। তরুণদের ভেতর তিনি তাঁর চিন্তাসূত্র ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন, সেটাই তাঁর সফলতা। হুমায়ুন আজাদ যতটুকু কর্ষণ করেছেন, অন্য যে-কেউ সেখান থেকেই শুরু করতে পারে। তিনি তরুণদের জন্য পথটি অপেক্ষাকৃত সহজ করে দিয়ে গেছেন। এমন এক সমাজের কথা ভেবে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন যে-সমাজে চিন্তার স্বাধীনতা নেই। যেন আমরা বাস করছি কতিপয় অন্ধ মানুষের ভিড়ে। প্লাতোনের সেই গল্পটার মতো। আমরা যেন সেই সব লোক যাদের দু’হাত পিছন দিকে বাঁধা। আমরা কেবল সম্মুখ দেখতে পারি। আমরা কেবল ছায়া দেখে দেখে ভাবি এটাই জগৎ, এটাই পৃথিবী। হুমায়ুন আজাদ সেই লোক যিনি বন্দিত্ব থেকে মু্ক্তি পেয়েছিলেন আর তিনি আমাদের মাঝে এসে বললেন, ‘দেখো, আমরা কেবল ছায়াকেই জগৎ ভেবেছি। আসল জগৎ অন্য রকম।’ আর আমরা দুর্ভাগারা তাঁকে সবাই মিলে হত্যা করেছি। হুমায়ুন আজাদ নিহত হননি। অনেকে বলতে পারেন, কিন্তু হুমায়ুন আজাদের সাথে যে-রকম ব্যবহার আমরা করেছি — বইমেলা প্রাঙ্গণেই মূলত তিনি মরে গেছেন চাপাতির কোপে। বাকি অর্ধেক মরেছে ধিক্কারে, ঘৃণায়; তাঁকে খুন করার প্রচেষ্টার পরও তাঁর পরিবারকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি অন্ধকারের কৃমিরা। সরকার চিহ্নিত করতে পারেনি তাঁর আপাত-আততায়ীদের। সরকার দিতে পারেনি তাঁর পারিবারিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। শত্রুরা ফের তাঁর সন্তানকে ধরে নিয়ে যায় এবং হত্যার হুমকি দেয় । শত্রুদের ভয় কেবল তাঁর কলম আর দেখার চোখ। কিন্তু যা তিনি লিখে ফেলেছেন তা কী করে রুখবে তারা? যে-চিন্তার স্রোত তিনি প্রবাহিত করেছেন, কী করে বন্ধ করবে তারা তার প্রস্রবণ? তাঁর মৃত্যুর পর তিনি তলে তলে দ্বিগুণ শক্তিশালী। তাঁর লেখা নিয়ে নতুন করে ভাবছে মানুষ। তাঁর বই নতুন করে কেনার হিড়িক পড়েছে — কী লিখেছেন এই লোক যার জন্য হঠাৎ করে মরে যেতে হয়েছে!
কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ সব মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। শুধু হুমায়ুন আজাদ কেন, কোনো চৈতন্যসমৃদ্ধ মানুষই নিরাপদ নয়, ভিনদেশি অন্ধকারের কৃমিদের কাছে। আহত হওয়ার পর বিষক্রিয়ায় কোন পর্যায়ে তিনি ছিলেন তা আমাদের দ্বারা অনুমান করাও দুঃসাধ্য। তিনি ছিলেন মূলত হেমলক পান করার পর সক্রাতেস যে-অবস্থায় ধীরে ধীরে মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করে চলেছিলেন সেই অবস্থায়। তবু তাঁর জার্মানিতে যাওয়াটা বেঁচে থাকার এক ধরনের তৃষ্ণা বলা যায়। শেষপর্যন্ত পান করা হেমলকের অনন্ত বিষাদের আরকক্রিয়া থেকে নিস্তার মেলেনি তাঁর। তিনি ঢলে পড়লেন। তাঁকে আমরা নিহত হওয়া বলতে পারি। বলতে পারি আত্মহত্যাও। তাঁকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। এই দায়ভার আমাদের সবাইকে বহন করতে হবে। যারা তাঁকে খুন করতে চেয়েছিল আর আমরা যারা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি, তারা সমান অপরাধী।
হুমায়ুন আজাদ নেই; আমরা যারা আছি, এটুকু আশা নিয়ে আছি : তাঁর মৃত্যু এক ধরনের পুনর্জন্মের গান। তিনি উদাহরণ হয়ে আছেন নির্ভীক শহিদের, আত্মত্যাগকারী, মৃত্যুকে মহিমা দানকারী, প্রতিবাদী এক মহাপুরুষ হিসেবে।
writer