১
সম্ভবত নয়-দশ বছর আগের কথা। কোন সাল এখন আর নিশ্চিত করে মনে নেই; তবে দিনটা ছিল অক্টোবর মাসের তেইশ তারিখ। বাসা থেকে বেরিয়ে ফোনের দোকানে পৌঁছতে প্রায় পৌনে ন’টা। ও-পাশ থেকে নারীকণ্ঠ শুনে বুঝে নিই, দেরি করে ফেলেছি। ‘একটু লাইনে থাকুন।’ খানিকক্ষণ পর পরিচিত সেই চপ্পলের আওয়াজ। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে নিজের রুমে পৌঁছলেন তিনি। তিন-চার মিনিট কথা হলো। জানালেন খুব খুশি হয়েছেন ফোন পেয়ে। আমারও খুব খুশি লাগছিল সকালেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পেরে। আর বিব্রতও লাগছিল। আধঘণ্টা আগে ফোন করলেই তাঁকে কষ্ট করে সিঁড়ি ভাঙতে হতো না। কথা শেষে আবার নিশ্চয়ই ফিরে গেলেন নীচে, চপ্পলে ফট্ফট্ আওয়াজ তুলে। বই-দিয়ে-ঘেরা সুপরিসর ড্রইংরুমে এরই মধ্যে জড়ো হয়েছেন অনেকে। তাঁরা এসেছেন তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে। আজ তাঁর জন্মদিন।
২
শেষ যে-বার সে-বাড়িতে যাই, ড্রইংরুম অব্দি আর যেতে হয়নি। বারান্দাতেই দুটো চেয়ার পাতা ছিল, সেখানে বসেই কথা চলল খানিকক্ষণ। চা-ও চলে এল অল্পক্ষণের মধ্যে। আগে বাইরে থেকেই চোখে পড়ত দেয়ালে ঝোলানো মুর্তজা বশীরের ‘এপিটাফ’ সিরিজের একটা ছবি, কয়েক বছর আগে সেটাকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়া হয়েছে। জানা ছিল না যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে অল্পকাল আগে তাঁর একটা বই বেরিয়েছে — পাণ্ডুলিপি সংস্করণ। দেখলাম। আর জানলাম ছায়ানট ভবনে তাঁর নামে একটা কক্ষ করা হয়েছে। তাঁর সংগ্রহের সবগুলো বই সে-কক্ষে সংরক্ষণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ছায়ানট। তাহলে কি সব বই দিয়ে দেয়া হবে? না, এখনো মত দেয়া হয়নি তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে। দেখা যাক। আগের মতোই কি আছে তাঁর বইগুলো, বিছানা-ঘেরা শেল্ফে পরিপাটি সাজানো আর লেখার টেবিলের উপর এলামেলো হয়ে? কিছুই পালটায়নি। যেভাবে রেখে গেছেন ঠিক সেভাবেই রাখা আছে সবকিছু তাঁর ঘরে। ‘দোতলায় গিয়ে দেখে আসবে নিজের চোখে?’ না, থাক। আবার আসব, হ্যাঁ, ফোন করেই আসব। বিদায় নিই তাঁর পুত্রবধূর কাছ থেকে।
৩
অধুনালুপ্ত নতুন সাহিত্য পত্রিকার একেবারে প্রথম দিকের কয়েকটি সংখ্যার পাতা উলটাতে গিয়ে একবার চোখ আটকে গিয়েছিল একটি কবিতায় — ‘কয়েকটি দিন : ওয়াগনে’। কবিতাটির নীচে সম্পাদক অনিলকুমার সিংহ একটি টীকা জুড়ে দিয়েছিলেন :
বহু মুসলমান শরণার্থী আজ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের দাক্ষিণ্যে পরিত্যক্ত ও অকেজো রেলওয়ে ওয়াগনে দিন যাপন করছে। উপরোক্ত কবিতাটি বিহারের তেমনি একটি হতভাগ্য বাস্তুহারা পরিবারকে কেন্দ্র করে লেখা।
প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে-তে তো নয়ই, এমনকী কবির পরবর্তী কোনো কাব্যগ্রন্থেও এ কবিতাটি দেখিনি! পরে তাঁকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম কবিতাটি তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন, সে-কারণেই কখনো আর গ্রন্থভুক্ত হয়নি।
সেই কবিতা রচনার পটভূমি সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীতে (কালের ধুলোয় লেখা, ২০০৪) :
পরীক্ষায় কৃতিত্বের ঝলক দেখাতে না পারলেও কবিতা রচনার ক্ষেত্রে আমার কিছু সাফল্য ধরা পড়েছিল সে-সময়ে কারও কারও কাছে। আমার শিক্ষক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী আমার লেখায় একজন ভালো কবির আভাস পেয়েছিলেন — এ কথা আমি বুঝতে পারি তাঁর উদার আচরণে। মনে পড়ে, একদিন দুপুরে তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে তাঁর বাসার দিকে রওয়ানা হন। তাঁর বাসা ছিল ওয়ারিতে। তিনি সাইকেল চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করতেন। তিনি সেদিন সাইকেলে সওয়ার না হয়ে পুরো রাস্তাই সাইকেল হাতে করে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাসায় পৌঁছেন। চলার পথে তিনি ফুলবাড়িয়া স্টেশনের রেললাইনে রাখা কিছু বাতিল রেলওয়ের ওয়াগনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আমাকে বলেন, ‘দেখ মানুষের কী দুর্ভোগ।’ আমি ওয়াগনের দিকে তাকিয়ে দেখি ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে ক’জন নারী, পুরুষ এবং শিশু ওয়াগনের ভিতর বসে আছে। এরা সবাই রিফিউজি, যারা বিহার থেকে ঢাকায় আশ্রয় নিয়েছে। এসব ওয়াগনের ভিতরেই এরা দিনরাত কাটাচ্ছে। আমার শিক্ষক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী বললেন, ‘এসো আমরা দু’জনই এদের নিয়ে কবিতা লিখি।’
পরবর্তী ঘটনাও এ কালের পাঠকের পক্ষে কৌতূহল-উদ্দীপক :
… অধ্যাপক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর ড্রইংরুমে একদিন স্বয়ং গৃহকর্তা এবং আমি ওয়াগন বিষয়ে কবিতা পড়লাম। আমার কবিতাটির নাম ছিল ‘কয়েকটি দিন, ওয়াগনে’। সৈয়দ নূরুদ্দিন সে-কালে একটি উঁচুদরের সাহিত্যপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই সম্ভাব্য পত্রিকার জন্যে তিনি লেখা সংগ্রহ করছিলেন। সম্পাদক সৈয়দ নূরুদ্দিন স্যারের কবিতাটি চাইলেন। কিন্তু স্যার কবিতা দিলেন না। তিনি সম্পাদককে আমার উপস্থিতিতেই বললেন, ‘শামসুর রাহমানের কবিতাটি আপনার পত্রিকার জন্যে নিন। ওর কবিতা আমার কবিতার চেয়ে অনেক বেশি ভালো হয়েছে।’ স্যারের এই বিরল ঔদার্যে আমি স্তম্ভিত তো হলামই, আমার চোখও ছলছলিয়ে উঠল। সৈয়দ নূরুদ্দিন আমার কাছ থেকে তৎক্ষণাৎ কবিতাটি চেয়ে নিলেন এবং মানিব্যাগ থেকে পঁচিশ টাকা বের করে আনাড়ি, তরুণ কবিকে দিলেন। সেকালে একটি কবিতার জন্যে পঁচিশ টাকা পাওয়া ছিল মস্ত ব্যাপার। দুঃখের বিষয়, সেই পত্রিকা কখনও দিনের আলো দেখে নি। পরে আমি পঁচিশ টাকা ফেরত দিতে চাইলেও সৈয়দ নূরুদ্দিন সেই টাকা কিছুতেই নিতে চান নি। তারুণ্যের ভোরবেলায় লেখা সেই কবিতা অনিল সিংহ সম্পাদিত এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত উন্নতমানের প্রগতিশীল পত্রিকা ‘নতুন সাহিত্যে’ প্রকাশিত হয়েছিল। আমার এই কবিতায় সোৎসাহে সুর সংযোজন করেছিলেন বন্ধু হামিদুর রহমান। পরে হামিদের ভাই সাঈদ আহমদ সেই সুরটি সেতারে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের একটি অনুষ্ঠানে বাজান।
সেই কবিতা আখেরে কোথায় হারিয়ে যায়, আমার কোনও কাব্যগ্রন্থেই ওর ঠাঁই হয় নি।
নতুন সাহিত্য-র দ্বিতীয় বর্ষ অষ্টম সংখ্যায় (অগ্রহায়ণ ১৩৫৮) প্রকাশিত সেই কবিতাটি আজ তাঁর জন্মদিনে পড়া যাক আবার। দু-একটি শব্দের বানান আমাদের পালটে নিতে হবে এখন। কিন্তু সেই সঙ্গে লক্ষ করব, এক তরুণ কবির একুশ-বাইশ বছর বয়সে লেখা কবিতাটির গায়ে, অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পরেও, এতটুকু মরচে পড়েনি!
কয়েকটি দিন : ওয়াগনে
ধূসর বাতাস। ঝাঁঝালো রৌদ্র। ক্ষীণ আকাশ।
সকাল সন্ধ্যা লোহার খাঁচায় দিন কাটাই।
অচিন শহর। ভিন্ন জীবন। নতুন মুখ।
ধোঁয়াটে মনের স্যাঁৎসেঁতে কোণে নড়ছে মাছি,
বোনের কান্না! বৃদ্ধ পিতার ভীষণ কাশি!
বিষণ্ণ দিনে সহসা তাকাই : কোথায় আছি?ধূসর বাতাস। ঝাঁঝালো রৌদ্র। ক্ষীণ আকাশ।
সকাল সন্ধ্যা লোহার খাঁচায় দিন কাটাই।বাড়িঘর সব পুড়ে হল ছাই : আমার বাড়ি!
দস্যুর হাতে প্রাণ দিল ভাই : আমার ভাই!
চোখের সামনে মরেছে অনেক আপনজন।
তারপর বহু মৃত্যু এড়িয়ে, ‘বিহার’ ছেড়ে
রোদে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে গাছতলাতে
কাটিয়েছি দিন, এমনি করেই দিন কেটেছে!আহা সে কত না ভুট্টার ক্ষেত ভালোবেসেছি,
আহা সেই কত নীল শালবন আমার চোখে
ছায়া ফেলে আজও! বান্ধবী কত যত্ন করে
চুল দিত বেঁধে : সেই কথা আজ পড়ছে মনে।
কোনো কোনো দিন কালো সন্ধ্যায় মা-র কবরে
দাঁড়াতাম গিয়ে : সেই কথা আজ পড়ছে মনে।
আহা সেই পথ! ধু ধু শাদা পথ! গ্রামের পথ!
আহা সেই মাঠ! ফসলের মাঠ! গমের শিষ!এখানে এখন নিঃসাড় চাঁদ। মৃত আকাশ।
বহু রাত ধরে ঘুম হয়নিকো, হয়নি ঘুম।
বোনের কান্না! বৃদ্ধ পিতার ভীষণ কাশি!
ক্লান্ত রাত্রে ট্রেনের শব্দে ঘুম আসে না!
কয়লার গুঁড়ো আকাশে ছড়ায়। ক্ষীণ আকাশ।
অনেক স্বপ্ন ঢাকা পড়ে গেছে ধুলার চাপে।ধূসর বাতাস। ঝাঁঝালো রৌদ্র। ক্ষীণ আকাশ।
সকাল সন্ধ্যা লোহার খাঁচায় দিন কাটাই।এই নিয়ে আমি অনাহার আর ব্যাধির সাথে
লড়েছি অনেক; তপ্ত দুপুরে লোহার মেঝে
আমার বোনের কচি দুটি পা পুড়ে গেছে!
বোনের কান্না! বৃদ্ধ পিতার ভীষণ কাশি!
ঝাঁঝালো রৌদ্রে সহসা তাকাই : কোথায় আছি?শুনেছি এখানে মদের পাত্রে খুনের স্বাদ!
শুনেছি এখানে পরীর মতো মেয়েরা সব
আমি তো অবাক : নৈশ আসরে ঘুরে বেড়ায়!
পরীদের মতো মেয়েদের সব মদির চোখ!
এই তো এখন রুগ্ণ বোনটি জ্বরের ঘোরে
তপ্ত দুপুরে ছট্ফট্ করে লোহার মেঝে!
চটের পর্দা সরিয়ে তাকাই : কোথায় আছি?সকাল সন্ধ্যা লোহার খাঁচায় দিন কাটাই।
প্রতিদিনকার দুঃসহ ব্যথা বেড়েই চলে।
বোনের কান্না! বৃদ্ধ পিতার ভীষণ কাশি!
ক্লান্ত রাত্রে ট্রেনের শব্দে ঘুম আসে না।
স্বপ্ন মলিন, তবুও আকাশে হাত বাড়াই!
সোনালি বিকেলে হঠাৎ সেদিন পথ-চলতি
একটি ছেলের উজ্জ্বল চোখে দেখেছি যেন
ঘৃণ্য দিনের মৃত্যুর কথা রয়েছে লেখা।
