তাঁর আর কোনো ভাস্কর্যের জন্য না হোক, অন্য কোনো কৃতির জন্য না হোক, ‘অপরাজেয় বাংলা’ নামের মুক্তিযুদ্ধের এই স্মারক-ভাস্কর্যটির জন্য সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদকে বাংলাদেশ মনে রাখবে। [ . . .]

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে (অধুনা চারুকলা ইনস্টিটিউট) ভাস্কর্যকলার অধ্যাপক ছিলেন সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। এছাড়াও ছিলেন – এখনো আছেন – অধ্যাপক অলক রায়। এই দুজন স্বনামধন্য ভাস্করের কাছেই আমাদের ভাস্কর্য শিক্ষার হাতেখড়ি। প্রথম বর্ষের একেবারে প্রথমদিকের এক ক্লাসে খালিদ স্যার আমাদের মাটি দিয়ে গোলক তৈরি করতে দিয়েছিলেন, মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, সম্ভবত সে-বছরই, ১৯৯৩-এর কোনো একদিন, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের চলচ্চিত্র প্রদর্শনী শেষে মেডিকেল কলেজের পূর্ব গেইটের বাইরের এক সাধারণ রেস্তোরাঁয় চলচ্চিত্র কেন্দ্রের উপস্থিত সবাইকে নিয়ে আড্ডা আর মধ্যাহ্নভোজে শামিল হয়েছিলেন, তিনিই বিল মিটিয়ে দিয়েছিলেন। সে-সময়ে খালিদ স্যার চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের উপদেষ্টা। আরো পিছিয়ে গিয়ে আমাদের কলেজের সাইক্লোস্টাইল-পদ্ধতিতে-ছাপা হাতে-লেখা পত্রিকা ‘প্রবাহ’র কথাও মনে পড়ে যাচ্ছে, যেটির একটি সংখ্যার শেষ প্রচ্ছদে একবার তাঁর ‘অঙ্কুর’ ভাস্কর্যটির ছবি আমরা ব্যবহার করেছিলাম। আর লজ্জার সঙ্গে এও মনে পড়ছে যে, ভাস্করের নামটি সেদিন সঠিক বানানে আমি লিখতে পারিনি! তাঁর ভাস্কর্য প্রদর্শনীর একটি ক্যাটালগ তখন কারো মাধ্যমে আমাদের হাতে এসে পড়েছিল, দারুণভাবে আলোড়িতও করেছিল। সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের সঙ্গে শেষ দেখা ও কথা গত বছরের (২০১৬) ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে। ‘অপরাজেয় বাংলা’র নির্মাণপর্বকে দীর্ঘ সময় জুড়ে ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন মিশুক মুনীর; সেইসব স্মরণীয় মুহূর্তের সংকলন ‘মন জানালা’র সেদিন ছিল প্রকাশনা অনুষ্ঠান, সিনেট ভবনের সেমিনার কক্ষে। খালিদ স্যার, কুলসুম ভাবী ও তাঁদের এক পুত্র এবং প্রয়াত মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলি কাজী ও একমাত্র পুত্রও সেদিন উপস্থিত ছিলেন। পরে স্যার ও ভাবীকে ঘিরে আমাদের দ্বিতীয় দফা আড্ডা জমেছিল মধুর ক্যান্টিনে। কারো কারো নিশ্চয়ই মনে পড়বে, নব্বইয়ের দশকের এক পহেলা বৈশাখে চট্টগ্রামের ডি.সি. পাহাড়ে তিনি ডাব বিক্রির ব্যবস্থা করেছিলেন! অস্বাস্থ্যকর-অথচ-বিজ্ঞাপিত পানীয় কোক-পেপসি বিপণনের বিরুদ্ধে সেটা ছিল ‘শিল্পীর প্রতিবাদ’। নিছক খ্যাপামোর বশেই তিনি এ কাজ করেছিলেন – এমনটা ধরে নিলে বোধহয় ভুল করা হবে। যদিও তাঁর স্বভাবে খ্যাপামো ছিল, সহজে রেগে যেতেন কখনো কখনো; নিজের নানা কাজে, আচরণে ও অবস্থানের কারণে নানা সময়ে তিনি বিতর্কের জন্মও দিয়েছেন। সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদকে ঘিরে একটি ঘটনা-পরম্পরার কথা শুনেছিলাম নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা ও দেবী শর্মার কাছ থেকে। একবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সোভিয়েত দেশীয় স্মারক-ভাস্কর্যের একটি সচিত্র বই মস্কো থেকে কিনে এনে দ্বিজেন শর্মা একজনের মাধ্যমে উপহার পাঠিয়েছিলেন…

অথচ একসময়ে রটে গিয়েছিল যে, নভেরা আহমেদ বোধহয় বেঁচে নেই। বেঁচে যদি-বা থাকেনও, সক্রিয় নেই — সৃষ্টিশীলতার বাইরে ছিটকে পড়েছেন, হারিয়ে গিয়েছেন অপরিচয়ের অন্ধকারে। [. . .]

এই এক সত্তা যে নিঃশর্তে এবং সম্পূর্ণভাবে তার শিল্পে নিবেদিত। শিল্প তাঁকে আবিষ্ট করে রেখেছে এবং এই সর্বগ্রাসী আবেগে সদা উত্তেজিত তাঁর অন্তর। তাঁর জীবন তিনি একাকী যাপন করছেন শিল্পের ভেতর এবং শিল্পের জন্যে। এই কথা ক’টি ১৯৬০ সালের। এর পরেও আরো পঞ্চান্ন বছর শিল্পের প্রতিই তিনি নিবেদিত থেকেছেন। একেবারে নিজের মতো করেই বাঁচতে চেয়েছেন; যাপন করেছেন তাঁর নিভৃত জীবন। সম্প্রতি অগ্রগণ্য এই শিল্পীর জীবনাবসান হলো পঁচাশি-উত্তীর্ণ বয়সে, দূর প্রবাসে। তাঁর সমসাময়িক শিল্পীদের মতো তিনি চিত্রকর নয়, হতে চেয়েছিলেন ভাস্কর। এই নির্বাচন তাঁর নিজের। দেশবিভাগোত্তর ঢাকার নতুন শিল্পবিদ্যালয়ে তখনও মেয়েদের শিল্পশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়নি, ভাস্কর্যও অন্তর্ভুক্ত হয়নি পাঠ্যক্রমে। তিনি পড়তে গিয়েছেন লন্ডনে, ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস-এ, নিজেরই আগ্রহে। ইয়োরোপীয় আধুনিক ভাস্কর্যের পরম্পরা প্রত্যক্ষ করেছেন, একেবারে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত। গিয়েছেন ফ্লোরেন্সে, ভেন্তুরিনো ভেন্তুরির স্টুডিওতে। ইউরোপের শিল্পতীর্থগুলিতে — দোনাতেল্লো, মিকেলাঞ্জেলো, রোদ্যাঁর ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষার্থীর একাগ্রতায়। এই সবই যেন তাঁর সুবিস্তৃত পাঠ্যক্রমের অংশ, তাঁর প্রস্তুতিপর্ব। দেশবিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গে, বাংলাদেশে, আধুনিক ভাস্কর্যচর্চা সূচনা করবার দায়িত্ব তাঁর ওপরেই অর্পিত হয়েছিল। অন্য কেউ তাঁকে দেয়নি এই দায়িত্ব, দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। আবগারি বিভাগের কর্মকর্তা, পিতা সৈয়দ আহমেদের কর্মসূত্রে তাঁর বেড়ে ওঠা শহর কলকাতায়; পড়েছেন কনভেন্টে — লরেটোয়। বোন আর ভাইদের সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন বাড়ির উদার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। দেশবিভাগের পর পিতার বদলির কারণে থেকেছেন কুমিল্লায়, তারপর কিছুকাল বাবা-মায়ের শহর চট্টগ্রামে। পরে, ইয়োরোপ থেকে ভাস্কর্যের পাঠ নিয়ে দেশে ফিরে, তাঁর কাজের ক্ষেত্র হলো ঢাকা — পাকিস্তানের পুব অংশের রাজধানী, শিল্পচর্চারও প্রাণকেন্দ্র। তিনি ভেবেছিলেন, এখানে নগর পরিকল্পনায় স্থাপত্য আর ভাস্কর্য একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠবে। ভেবেছিলেন, নগর-জীবনের দিগন্তসীমায় অধিষ্ঠান হবে শিল্পের। এই স্বপ্ন নিয়েই এ ভূখণ্ডের প্রথম আধুনিক ভাস্কর হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। ১৯৬০ সালের আগস্টে কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে প্রায় পঁচাত্তরটি ভাস্কর্য নিয়ে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনীর আগেই, ১৯৫৭ আর ’৫৮ সালে দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন তিনি। প্রথমটি পাবলিক কমিশনের কাজ: মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্য-নকশায় নির্মিত গণগ্রন্থাগারের নীচতলার দেয়ালে গ্রাম-বাংলার দৃশ্য নিয়ে একটি আধুনিক ফ্রিজ — দেয়াল-লগ্ন নতোন্নত ভাস্কর্য। আর দ্বিতীয়টি প্রাইভেট কমিশন: মণিপুরিপাড়ায় শিল্পপতি এম. আর. খানের নির্মীয়মাণ বাসভবনের উদ্যানে ফোয়ারা সমেত একটি পূর্ণায়তন মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য,…

মাত্র ৫ জন আগ্রহী পাঠকও কি নেই বাংলাদেশের এক-একটি জেলায়? তাঁদের কাছে পৌঁছানোর কথা আমরা ভাবছি কি? প্রতি জেলায় গড়ে যদি ৫ কপি করেও বিক্রি হয়, ৩২০ কপি বই বিক্রি হতে ৩ বছরের বদলে বড়োজোর ৩ সপ্তাহ, মানসাঙ্কের হিসাবে এমনকী ৩ মিনিট লাগার কথা! [. . .]

কোনো একটা বই বা লিটল ম্যাগাজিন বের করার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-কুমিল্লার দু-চারটা চেনা দোকানে ৫/১০ কপি দিয়ে আসা, এখন ফেসবুকেও একটু শেয়ার-টেয়ার করা এবং ফেব্রুয়ারি মাসে একুশে বইমেলার লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে জড়ো হওয়া — অনিয়মিত লিটল ম্যাগাজিনকর্মী হিসেবে আমাদের অপেশাদার বিপণনের দৌড় এই পর্যন্তই। (অবশ্য কেউ কেউ নিশ্চয়ই আরো গুছিয়েই করেন কাজটা।) বগুড়ার বা রাজশাহীর বা বরিশালের বা নোয়াখালির পাঠক-পাঠিকাদের হাতের নাগালে আমাদের প্রকাশনাগুলি পৌঁছে দিতে পারলেই কি ভালো হয় না? দেশের ৬৪ জেলায় না হোক, অন্তত বেশ কিছু জেলা শহরেই নিশ্চয়ই এমন একাধিক  সুপরিচিত বইবিপণি আছে যেখান থেকে বই বা লিটল ম্যাগাজিন সচরাচর বিক্রি হয়, এবং আর্থিক লেনদেনের বিষয়েও যাঁরা আন্তরিক। মাত্র ৫ জন আগ্রহী পাঠকও কি নেই বাংলাদেশের এক-একটি জেলায়? তাঁদের কাছে পৌঁছানোর কথা আমরা ভাবছি কি? প্রতি জেলায় গড়ে যদি ৫ কপি করেও বিক্রি হয়, ৩২০ কপি বই বিক্রি হতে ৩ বছরের বদলে বড়োজোর ৩ সপ্তাহ, মানসাঙ্কের হিসাবে এমনকী ৩ মিনিট লাগার কথা! পাঠকের কাছে পৌঁছানো না গেলে ‘লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন’, ‘মুদ্রণশিল্পের বিপ্লব’ ইত্যাদি গালভরা কথারও তো কোনো মানে থাকে না। নিজস্ব বিপণন-ব্যবস্থা আর বিজ্ঞাপনের জোরে কেবল  বড়ো প্রকাশকরাই তাহলে টিকে থাকবে? আমাদেরও কি কিছুই করণীয় নেই? জনপ্রিয় লেখকদের বই বাদ দিলে অধিকাংশ বইয়েরই মুদ্রণ সংখ্যা কমতে কমতে এখন ৩০০-তে এসে দাঁড়িয়েছে। বই বিক্রি হয় না বলে কম ছাপা হয়, আর কম ছাপা হলে বইপিছু খরচ বেড়ে যাওয়ায় বইয়ের দামও যায় বেড়ে। এই দুষ্টচক্রেই আমরা ঘুরপাক খেয়ে মরব? সেজন্যই প্রত্যেক জেলার চিহ্নিত বইবিপণিগুলোর একটা তালিকার দরকার এখন। আর সে-তালিকা ধরে সমন্বিত উদ্যোগে বিকল্প বিপণনের একটা দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলাও সম্ভব। লেখক-পাঠক-প্রকাশক সবারই এই ‘সামাজিক নেটওয়ার্ক’ কাজে লাগবে।

বাংলাদেশের পথিকৃৎ ভাস্কর নভেরা আহমেদের মূল্যায়ন করা হয় মূলত তাঁর ১৯৫৭–১৯৬০ সালের ভাস্কর্য দিয়ে। এই লেখায় তুলে ধরা হয়েছে তাঁর ১৯৬০–১৯৭০ কালপর্বের ভাস্কর্যসৃষ্টির পরিচয়। [...]

[প্যারিসে নভেরা আহমেদের প্রায় একশো দিন ব্যাপী (১৬ জানুয়ারি—২৬ এপ্রিল ২০১৪) পূর্বাপর প্রদর্শনীর আজ শেষদিন। এতে প্রদর্শিত হয়েছে তাঁর ১৯৬৯–২০১৪ কালপর্বের ৫১টি শিল্পকর্ম (৯টি ভাস্কর্য ও ৪২টি চিত্রকর্ম)। নীচের প্রবন্ধটির উপজীব্য নভেরার এই কালপর্বের অব্যবহিত আগের এক দশক অর্থাৎ ১৯৬০–১৯৭০ সালের ভাস্কর্যসৃষ্টির পটভূমি ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এই লেখার আদিপাঠ মুদ্রিত হয়েছিল ঢাকা থেকে প্রকাশিত শিল্প ও শিল্পী  ত্রৈমাসিকের তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যায় (কার্তিক ১৪২০, নভেম্বর ২০১৩)। মুক্তাঙ্গনে প্রকাশের সময়ে দু-এক জায়গায় সামান্য পরিমার্জনা করা হয়েছে।] . ১৯৬০ সালে ঢাকায় নভেরা আহমেদের প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনীর দীর্ঘ প্রায় তিন যুগ পরে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে সে-প্রদর্শনীর প্রায় চল্লিশটি ভাস্কর্য সংগৃহীত হয় এবং ১৯৯৮ সালে একত্রে মাসাধিককালব্যাপী প্রদর্শিত হয়। পরে শিল্পপতি এম আর খানের বাড়ির উদ্যানে নির্মিত মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য ‘পরিবার’ও (১৯৫৮) ফোয়ারা-সহ জাতীয় জাদুঘরের সামনে পুনঃস্থাপিত হয়। বাংলাদেশে ভাস্কর হিসেবে নভেরার মূল্যায়ন মূলত তাঁর ১৯৫৭–৬০ কালপর্বের শিল্পকর্মগুলির আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। পরবর্তীকালে যথাক্রমে ব্যাংককে ও প্যারিসে আয়োজিত শিল্পীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় একক প্রদর্শনী সম্পর্কে তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে তাঁর পরিণত পর্যায়ের শিল্পকৃতি নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয়নি। বিগত প্রায় পাঁচ দশক তাঁর নিভৃত প্রবাস-যাপনের ফলে এই দীর্ঘ সময়জুড়ে বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই, তাঁর শিল্পচর্চার ধারাবাহিকতা সম্পর্কেও আমরা অনবহিত। শিল্পীজীবনের উন্মেষপর্বে, ১৯৬১ সালে, ভাস্কর হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি; পরে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে জীবনী উপন্যাস রচিত হয়েছে (নভেরা, হাসনাত আবদুল হাই, ১৯৯৪, গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৯৫), নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র (নহন্যতে, এন রাশেদ চৌধুরী, ১৯৯৯)। বাংলাদেশের শিল্পকলার ইতিহাসে ভাস্কর ও নারীশিল্পীদের পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি, কিন্তু তা সত্ত্বেও নভেরা আহমেদের যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন এখনো পর্যন্ত হয়নি। ১৯৫০ দশকের প্রথমার্ধে লন্ডনের ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে চেক ভাস্কর কারেল ফোগেলের (১৮৯৭–১৯৬১) তত্ত্বাবধানে নভেরার শিল্পশিক্ষা-পর্ব মেহবুব আহমেদের একাধিক প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে। আমিনুল ইসলামের স্মৃতিকথার (বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর : প্রথম পর্ব ১৯৪৭–১৯৫৬, ২০০৩) কল্যাণে বিখ্যাত ইতালীয় ভাস্কর ভেন্তুরিনো ভেন্তুরির (১৯১৮–২০০২) ফ্লোরেন্সের স্টুডিওতে নভেরার প্রশিক্ষণ গ্রহণের কথাও আমাদের অবিদিত নয়। তাঁর ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে নির্মিত ভাস্কর্যের আঙ্গিক, করণকৌশল ইত্যাদি নিয়ে…

'ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন' মনোরঞ্জন ব্যাপারীর প্রবন্ধ-সংকলন বা গবেষণা-অভিসন্দর্ভ নয়, আত্মজৈবনিক উপন্যাসের প্রথম খণ্ড — এবং সেইসঙ্গে সম্ভবত কোনো বাঙালি দলিত লেখকেরও প্রথম আত্মজৈবনিক উপন্যাস। [...]

ছবির এই মানুষটি — মনোরঞ্জন ব্যাপারী — নিজের জন্মতারিখ জানেন না। তাঁর গর্ভধারিণীও ছেলের জন্মের দিনটির কথা ঠিকঠাক বলতে পারেননি। আনুমানিক ১৯৫০ সালের দিকে তাঁর জন্ম — বরিশালে। দেশভাগের ধাক্কায় তাঁদের ছিন্নমূল পরিবার যখন পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমায় সে-সময়ে মনোরঞ্জনের বয়স তিন বছর। বারে বারে ঠাঁইনাড়া হতে হয়েছে — উদ্বাস্তু শিবিরের মানবেতর পরিবেশে তিনি বড়ো হয়েছেন আরো অসংখ্য দেশহারা মানুষজনের সঙ্গে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর পরিবারকে যেতে হয়েছে দণ্ডকারণ্যে। অল্পবয়স থেকেই মনোরঞ্জনকে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে কঠিন জীবনসংগ্রামে। আর বর্ণমালায় তাঁর হাতেখড়ি হয়েছে শৈশবে নয়, চব্বিশ বছর বয়সে — কয়েদখানায়! এমন একজন মানুষের লেখা ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’ (২০১২) বইটি এখনো পড়ার সুযোগ পাইনি। কিছুদিন আগে কলকাতা থেকে এ বইয়ের একটা কপি নিয়ে এসেছেন একজন; আর সেটা পড়ার জন্য পড়ে গেছে লম্বা লাইন। এক সন্ধ্যায় বইটা হাতে নিয়ে উলটেপালটে দেখার সুযোগ হয়েছিল। ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’ প্রবন্ধ-সংকলন বা গবেষণা-অভিসন্দর্ভ নয়, মনোরঞ্জন ব্যাপারীর আত্মজৈবনিক উপন্যাসের প্রথম খণ্ড — এবং সম্ভবত কোনো বাঙালি দলিত লেখকেরও প্রথম আত্মজৈবনিক উপন্যাস। কিন্তু মরাঠী, কন্নড় ও গুজরাতির মতো বাংলা ভাষায়ও কি দলিত সাহিত্যের একটি ধারা আছে, যা এখনো সবার গোচরে আসেনি? দেবেশ রায় সম্পাদিত ও সংকলিত ‘দলিত’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৭, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০০৪) নামের সংকলনটিতে কিন্তু তার আভাস মাত্রও ছিল না। এখন থেকে বছর পাঁচেক আগে, ২০০৭ সালে, মনোরঞ্জন ব্যাপারীরই একটি প্রবন্ধ এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সর্বভারতীয় পাঠক-সমালোচকদের। ভারতের ‘ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি’-র একটি সংখ্যায় (বর্ষ ৪২ সংখ্যা ৪১, ১৩ অক্টোবর ২০০৭) তাঁর হইচই-ফেলে-দেয়া প্রবন্ধ ‘Is there Dalit Writing in Bangla?’ প্রকাশিত হয়েছিল মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে। বাংলাদেশে তাঁকে নিয়ে এখনো আলোচনার সূত্রপাত না হলেও মনোরঞ্জন ব্যাপারী ইতিমধ্যেই তাঁর লেখনীর জোরে অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ৯, গল্প শতাধিক।

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.