নভেরা আহমেদ : ধূমকেতু নয়, ধ্রুবতারা

অথচ একসময়ে রটে গিয়েছিল যে, নভেরা আহমেদ বোধহয় বেঁচে নেই। বেঁচে যদি-বা থাকেনও, সক্রিয় নেই — সৃষ্টিশীলতার বাইরে ছিটকে পড়েছেন, হারিয়ে গিয়েছেন অপরিচয়ের অন্ধকারে। [. . .]

এই এক সত্তা যে নিঃশর্তে এবং সম্পূর্ণভাবে তার শিল্পে নিবেদিত। শিল্প তাঁকে আবিষ্ট করে রেখেছে এবং এই সর্বগ্রাসী আবেগে সদা উত্তেজিত তাঁর অন্তর। তাঁর জীবন তিনি একাকী যাপন করছেন শিল্পের ভেতর এবং শিল্পের জন্যে।

CCF11112012_00010

এই কথা ক’টি ১৯৬০ সালের। এর পরেও আরো পঞ্চান্ন বছর শিল্পের প্রতিই তিনি নিবেদিত থেকেছেন। একেবারে নিজের মতো করেই বাঁচতে চেয়েছেন; যাপন করেছেন তাঁর নিভৃত জীবন। সম্প্রতি অগ্রগণ্য এই শিল্পীর জীবনাবসান হলো পঁচাশি-উত্তীর্ণ বয়সে, দূর প্রবাসে।

তাঁর সমসাময়িক শিল্পীদের মতো তিনি চিত্রকর নয়, হতে চেয়েছিলেন ভাস্কর। এই নির্বাচন তাঁর নিজের। দেশবিভাগোত্তর ঢাকার নতুন শিল্পবিদ্যালয়ে তখনও মেয়েদের শিল্পশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়নি, ভাস্কর্যও অন্তর্ভুক্ত হয়নি পাঠ্যক্রমে। তিনি পড়তে গিয়েছেন লন্ডনে, ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস-এ, নিজেরই আগ্রহে। ইয়োরোপীয় আধুনিক ভাস্কর্যের পরম্পরা প্রত্যক্ষ করেছেন, একেবারে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত। গিয়েছেন ফ্লোরেন্সে, ভেন্তুরিনো ভেন্তুরির স্টুডিওতে। ইউরোপের শিল্পতীর্থগুলিতে — দোনাতেল্লো, মিকেলাঞ্জেলো, রোদ্যাঁর ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষার্থীর একাগ্রতায়। এই সবই যেন তাঁর সুবিস্তৃত পাঠ্যক্রমের অংশ, তাঁর প্রস্তুতিপর্ব। দেশবিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গে, বাংলাদেশে, আধুনিক ভাস্কর্যচর্চা সূচনা করবার দায়িত্ব তাঁর ওপরেই অর্পিত হয়েছিল। অন্য কেউ তাঁকে দেয়নি এই দায়িত্ব, দিয়েছিলেন তিনি নিজেই।

আবগারি বিভাগের কর্মকর্তা, পিতা সৈয়দ আহমেদের কর্মসূত্রে তাঁর বেড়ে ওঠা শহর কলকাতায়; পড়েছেন কনভেন্টে — লরেটোয়। বোন আর ভাইদের সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন বাড়ির উদার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। দেশবিভাগের পর পিতার বদলির কারণে থেকেছেন কুমিল্লায়, তারপর কিছুকাল বাবা-মায়ের শহর চট্টগ্রামে। পরে, ইয়োরোপ থেকে ভাস্কর্যের পাঠ নিয়ে দেশে ফিরে, তাঁর কাজের ক্ষেত্র হলো ঢাকা — পাকিস্তানের পুব অংশের রাজধানী, শিল্পচর্চারও প্রাণকেন্দ্র। তিনি ভেবেছিলেন, এখানে নগর পরিকল্পনায় স্থাপত্য আর ভাস্কর্য একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠবে। ভেবেছিলেন, নগর-জীবনের দিগন্তসীমায় অধিষ্ঠান হবে শিল্পের। এই স্বপ্ন নিয়েই এ ভূখণ্ডের প্রথম আধুনিক ভাস্কর হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। ১৯৬০ সালের আগস্টে কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে প্রায় পঁচাত্তরটি ভাস্কর্য নিয়ে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনীর আগেই, ১৯৫৭ আর ’৫৮ সালে দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন তিনি। প্রথমটি পাবলিক কমিশনের কাজ: মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্য-নকশায় নির্মিত গণগ্রন্থাগারের নীচতলার দেয়ালে গ্রাম-বাংলার দৃশ্য নিয়ে একটি আধুনিক ফ্রিজ — দেয়াল-লগ্ন নতোন্নত ভাস্কর্য। আর দ্বিতীয়টি প্রাইভেট কমিশন: মণিপুরিপাড়ায় শিল্পপতি এম. আর. খানের নির্মীয়মাণ বাসভবনের উদ্যানে ফোয়ারা সমেত একটি পূর্ণায়তন মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য, যার বিষয়বস্তু কৃষক-পরিবার। এই দুটি ভাস্কর্য সম্পর্কে পরে, তাঁর প্রথম প্রদর্শনী উপলক্ষে, জয়নুল আবেদিন লিখেছিলেন,

আমরা ঢাকাবাসীরা গত কয়েক বছর যাবৎ এই দুটি অপূর্ব কাজের সঙ্গে বসবাস করছি। তারপরও আমার মনে হয়, আমাদের শিল্পজগতের ওপর তাঁর এ দুটি শিল্পকর্মের প্রভাব নির্ণয় করতে আগামী কয়েক প্রজন্ম লেগে যাবে।

২০১৪-র জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে একশো দিন ব্যাপী তাঁর যে পূর্বাপর প্রদর্শনী হয়ে গেল প্যারিসে, তাঁর জীবনসঙ্গী গ্রেগরি দ্য ব্রুনস-এর উদ্যোগে ‘লাইব্রেরি দ্য সিয়ালস্কি’-তে, নয়টি ভাস্কর্য আর বেয়াল্লিশটি চিত্রকর্ম নিয়ে, তার সবই ১৯৬৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যবর্তী সময়ের কাজ। অথচ একসময়ে রটে গিয়েছিল যে, নভেরা আহমেদ বোধহয় বেঁচে নেই। বেঁচে যদি-বা থাকেনও, সক্রিয় নেই — সৃষ্টিশীলতার বাইরে ছিটকে পড়েছেন, হারিয়ে গিয়েছেন অপরিচয়ের অন্ধকারে।

শহিদ মিনারের অন্যতর রূপকার তিনি। এই ভূখণ্ডের তিনি পথিকৃৎ আধুনিক ভাস্কর। কিন্তু তাঁর ভাস্কর্যসৃষ্টি তো কেবল ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সালের কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এরপরেও নানা পর্বে-পর্বান্তরে ভাস্কর হিসেবে তাঁকে বিবর্তিত হতে দেখি আমরা, পরিণত হতে দেখি। আমরা দেখি; কিন্তু অনেকেই দীর্ঘদিন তা দেখেননি — বিশেষ করে তাঁর সমসাময়িক শিল্পীরা। আর দেখেননি বলেই হেনরি মুর এবং বারবারা হেপওয়ার্থের অনুকরণ বলে কেউ কেউ উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন তাঁর কাজকে, প্রথম পর্বের কাজকে। কেবল অনুকরণ বা অনুসরণই তাঁদের চোখে পড়েছে; চোখে পড়েনি যে, প্রতীচ্যের সমকালীন আঙ্গিকের সঙ্গে প্রাচ্যের সংবেদনকেও তিনি মেলাতে চেয়েছেন, তাঁর সমান আগ্রহ প্রাচীন শিল্পের প্রতিও, তিনি দেশীয় পারিপার্শ্বিক থেকে আহরণ করেছেন শিল্পের বিষয়বস্তু, আবিষ্কার করতে চেয়েছেন লোকজীবনের শেকড়কে। মাধ্যমগত সীমাবদ্ধতার সঙ্গে তাঁকে যুঝতে হয়েছে। খুঁজতে হয়েছে পুরুষপ্রধান সমাজে প্রথম পেশাদার নারীশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার পথ। আর, সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির মাপে নিজেকে ছোট করে নেয়ার কথা কখনো তিনি ভাবেননি।

 

দেশে ফেরার পর প্লাস্টার আর সিমেন্টে ভাস্কর্য গড়তে বাধ্য হয়েছিলেন নভেরা; কেননা এখানে এগুলিই ছিল সুলভ উপকরণ। আর ছিল কাঠ। পাথর এখানে মেলে না, ছিল না ব্রোঞ্জে ঢালাইয়ের ব্যবস্থা। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রবাসে, ১৯৬০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে, তিনি নির্মাণ করেছেন মূলত ধাতব ভাস্কর্য। আর সেগুলিতে বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে মাধ্যমগত সম্ভাবনার আবিষ্কার ও উন্মোচন। আদিম থেকে আধুনিক — বিশ্ব-ভাস্কর্যের বিস্তৃত পরিসর জুড়ে ব্যাপ্ত তাঁর সংলাপ। এ পর্যায়ে শিট মেটালে, ব্রোঞ্জে পূর্ণাবয়ব ভাস্কর্য গড়েছেন তিনি; রূপবন্ধের সরলীকরণ আর আধ্যাত্মিকতার স্পর্শে একেবারেই ভিন্ন মাত্রার সব সৃষ্টি, যার প্রদর্শনী করেছেন ব্যাংককে, ১৯৭০-এ। সেইসঙ্গে ছিল কয়েকটি নতোন্নত ভাস্কর্য এবং ভিয়েতনাম-যুদ্ধে বিধ্বস্ত মার্কিন যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষ জুড়ে নিয়ে তৈরি এগারোটি ‘অ্যাসেমব্লেজ’। থাইল্যান্ডের শিল্পজগতে একেবারেই নতুন এক অভিজ্ঞতা। উপমহাদেশের শিল্পীদের শিল্পসৃষ্টির মধ্যে তো বটেই, এমনকী সমগ্র এশিয়ার মধ্যেও তাঁর এই পর্বের ভাস্কর্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

নভেরার তৃতীয় প্রদর্শনী প্যারিসে — ১৯৭৩-এর জুলাইয়ে। বারোটি নতুন আঙ্গিকের ধাতব ভাস্কর্যের সঙ্গে দেখালেন সমান সংখ্যক চিত্রকর্মও। এর পরের এক দশকের একটা বড়ো অংশ জুড়ে তাঁর সক্রিয়তা হয়তো কম; আর তার একটা বড়ো কারণ নিশ্চয়ই সড়ক দুর্ঘটনার অভিঘাত। কিন্তু তিনি সরে যাননি তাঁর সৃজনের ভূমি থেকে; নতুন স্টুডিয়ো করে আবার পূর্ণ উদ্যমে ফিরে এসেছেন। সংখ্যায় কম হলেও ভাস্কর্য গড়েছেন ২০০৯ পর্যন্ত, আর এঁকে গেছেন একের পর এক ছবি। সেখানে ভিড় জমিয়েছে হরেক রকম পাখি; রঙে-রেখায় মূর্ত হয়ে উঠেছে নিসর্গ, প্রকৃতিলগ্ন মানবীর অবয়ব। শেষ প্রদর্শনীর শেষ ছবি ২০১২ সালে আঁকা — কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত।

নভেরা আহমেদ তাঁর ভাস্কর্যচর্চার প্রারম্ভিক পর্বেই জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। ১৯৬০-এ তাঁর প্রথম প্রদর্শনী ছিল কেবল পূর্ব পাকিস্তানে নয়, তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কোনো ভাস্করের প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী। পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পী আর কলারসিকরাও ঢাকায় এসেছিলেন তাঁর প্রদর্শনী দেখতে।

১৯৬১-র ডিসেম্বর থেকে ১৯৬২-র জানুয়ারির মধ্যে লাহোরে অনুষ্ঠিত জাতীয় চিত্রকলা, ভাস্কর্য আর ছাপচিত্র প্রদর্শনীতে শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যের জন্য নভেরা পেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতির পদক। তাঁর কয়েকটি ভাস্কর্য এখনও সযত্নে সংরক্ষিত আছে পাকিস্তানে, ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংগ্রহে। কেবল তাই নয়, এখনো তিনি সে-দেশে স্বীকৃত একজন পথিকৃৎ আধুনিক ভাস্কর হিসেবে। সেলিমা হাশমির মতে, ‘নভেরাই সম্ভবত পাকিস্তানের প্রথম ভাস্কর, যিনি সর্বতোভাবে সমকালীন একটি প্রকাশরীতি পরিগ্রহণ করলেন’।

আর বাংলাদেশে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, নভেরার হাতেই আধুনিক ভাস্কর্যের সূচনা। না, তাঁর কোনো পূর্বসূরি নেই। ঢাকায় প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষায় ভাস্কর্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে, স্বতন্ত্র বিভাগের মর্যাদায় এবং ক্লাস শুরু হয়েছিল ১৯৬৫ সালে — ততদিনে নভেরা পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে।

একসময়ে তাঁকে মনে করা হয়েছিল ধূমকেতু, ক্ষণস্থায়ী যার উদ্ভাসন। কিন্তু গত দুই দশকব্যাপরী অনুসন্ধান ও গবেষণার পরিণামে বাংলাদেশের শিল্পচর্চার ইতিহাসে নতুন করে আবিষ্কৃত হচ্ছেন নভেরা আহমেদ। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননার (একুশে পদক, ১৯৯৭) মধ্য দিয়ে, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলায়-পড়ে-থাকা ভাস্কর্যগুলির আংশিক পুনরুদ্ধার আর প্রদর্শনীর (এপ্রিল-মে, ১৯৯৮) মধ্য দিয়ে, জাতীয় জীবনে তাঁর পুনরাবির্ভাব ঘটেছে পথিকৃৎ ভাস্করের মর্যাদায়। যদিও তাঁর শিল্পসৃষ্টির সামগ্রিক পরিচয় পেতে আমাদের হয়তো আরো বেশ কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।

নভেরা আহমেদ এখন আর ক্ষণিকের ধূমকেতু নন। আমৃত্যু সৃজনমগ্ন এই শিল্পী আমাদের কাছে ধ্রুবতারা হয়ে থাকবেন — দ্রষ্টা হিসেবে, তাঁর জীবনব্যাপী ‘অন্তর্দৃষ্টি’র জন্য। আমাদের ভাবিত করবে তাঁর জীবনদর্শন — ব্যতিক্রমী, দুর্জ্ঞেয়, অননুকরণীয়।

১৬ মে ২০১৫

চিত্রকলা ও সংস্কৃতি বিষয়ক ষাণ্মাষিক  শিল্প ও শিল্পী-তে (চতুর্থ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, আষাঢ় ১৪২২, জুন ২০১৫) প্রকাশিত রচনা ‘ধূমকেতু নয়, ধ্রুবতারা’র ঈষৎ পরিমার্জিত পাঠ

রেজাউল করিম সুমন

একজন সামান্য পাঠক।

২ comments

  1. মাসুদ করিম - ২৯ মার্চ ২০১৯ (৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ)

    গুগল ডুডলে নভেরা আহমেদ

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.