সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ : ‘অপরাজেয় বাংলা’র ভাস্কর

তাঁর আর কোনো ভাস্কর্যের জন্য না হোক, অন্য কোনো কৃতির জন্য না হোক, ‘অপরাজেয় বাংলা’ নামের মুক্তিযুদ্ধের এই স্মারক-ভাস্কর্যটির জন্য সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদকে বাংলাদেশ মনে রাখবে। [ . . .]

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে (অধুনা চারুকলা ইনস্টিটিউট) ভাস্কর্যকলার অধ্যাপক ছিলেন সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। এছাড়াও ছিলেন – এখনো আছেন – অধ্যাপক অলক রায়। এই দুজন স্বনামধন্য ভাস্করের কাছেই আমাদের ভাস্কর্য শিক্ষার হাতেখড়ি। প্রথম বর্ষের একেবারে প্রথমদিকের এক ক্লাসে খালিদ স্যার আমাদের মাটি দিয়ে গোলক তৈরি করতে দিয়েছিলেন, মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, সম্ভবত সে-বছরই, ১৯৯৩-এর কোনো একদিন, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের চলচ্চিত্র প্রদর্শনী শেষে মেডিকেল কলেজের পূর্ব গেইটের বাইরের এক সাধারণ রেস্তোরাঁয় চলচ্চিত্র কেন্দ্রের উপস্থিত সবাইকে নিয়ে আড্ডা আর মধ্যাহ্নভোজে শামিল হয়েছিলেন, তিনিই বিল মিটিয়ে দিয়েছিলেন। সে-সময়ে খালিদ স্যার চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের উপদেষ্টা।

আরো পিছিয়ে গিয়ে আমাদের কলেজের সাইক্লোস্টাইল-পদ্ধতিতে-ছাপা হাতে-লেখা পত্রিকা ‘প্রবাহ’র কথাও মনে পড়ে যাচ্ছে, যেটির একটি সংখ্যার শেষ প্রচ্ছদে একবার তাঁর ‘অঙ্কুর’ ভাস্কর্যটির ছবি আমরা ব্যবহার করেছিলাম। আর লজ্জার সঙ্গে এও মনে পড়ছে যে, ভাস্করের নামটি সেদিন সঠিক বানানে আমি লিখতে পারিনি! তাঁর ভাস্কর্য প্রদর্শনীর একটি ক্যাটালগ তখন কারো মাধ্যমে আমাদের হাতে এসে পড়েছিল, দারুণভাবে আলোড়িতও করেছিল।

ছবি : মিশুক মুনীর

ছবি : মিশুক মুনীর

সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের সঙ্গে শেষ দেখা ও কথা গত বছরের (২০১৬) ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে। ‘অপরাজেয় বাংলা’র নির্মাণপর্বকে দীর্ঘ সময় জুড়ে ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন মিশুক মুনীর; সেইসব স্মরণীয় মুহূর্তের সংকলন ‘মন জানালা’র সেদিন ছিল প্রকাশনা অনুষ্ঠান, সিনেট ভবনের সেমিনার কক্ষে। খালিদ স্যার, কুলসুম ভাবী ও তাঁদের এক পুত্র এবং প্রয়াত মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলি কাজী ও একমাত্র পুত্রও সেদিন উপস্থিত ছিলেন। পরে স্যার ও ভাবীকে ঘিরে আমাদের দ্বিতীয় দফা আড্ডা জমেছিল মধুর ক্যান্টিনে।

কারো কারো নিশ্চয়ই মনে পড়বে, নব্বইয়ের দশকের এক পহেলা বৈশাখে চট্টগ্রামের ডি.সি. পাহাড়ে তিনি ডাব বিক্রির ব্যবস্থা করেছিলেন! অস্বাস্থ্যকর-অথচ-বিজ্ঞাপিত পানীয় কোক-পেপসি বিপণনের বিরুদ্ধে সেটা ছিল ‘শিল্পীর প্রতিবাদ’। নিছক খ্যাপামোর বশেই তিনি এ কাজ করেছিলেন – এমনটা ধরে নিলে বোধহয় ভুল করা হবে। যদিও তাঁর স্বভাবে খ্যাপামো ছিল, সহজে রেগে যেতেন কখনো কখনো; নিজের নানা কাজে, আচরণে ও অবস্থানের কারণে নানা সময়ে তিনি বিতর্কের জন্মও দিয়েছেন।

সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদকে ঘিরে একটি ঘটনা-পরম্পরার কথা শুনেছিলাম নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা ও দেবী শর্মার কাছ থেকে। একবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সোভিয়েত দেশীয় স্মারক-ভাস্কর্যের একটি সচিত্র বই মস্কো থেকে কিনে এনে দ্বিজেন শর্মা একজনের মাধ্যমে উপহার পাঠিয়েছিলেন ‘অপরাজেয় বাংলা’র ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদকে। দুজনই বৃহত্তর সিলেটের মানুষ, যদিও তাঁদের সামনাসামনি পরিচয় ছিল না। আশ্চর্যের বিষয় হলো বছরের পর বছরের পেরিয়ে যাবার পরেও প্রাপকের কাছ থেকে কোনো উত্তর মেলেনি! এর প্রায় এক দশক পর – ততদিনে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত, প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদ-বিভাগগুলো উঠে গেছে, শর্মা-দম্পতি শেষমেশ মস্কো থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছেন – ১৯৯৬-এর জানুয়ারির এক শীত-রাতে, রাত তখন এগারোটা,পরদিন কন্যার গায়েহলুদ, তাঁদের সিদ্ধেশ্বীর বাড়ির দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুলতে যাঁকে দেখা গেল, তাঁর পরনে বেশ ক’টা পকেটওয়ালা এক কোট, আর সে-সব পকেট থেকে একে-একে বেরিয়ে এল পাথর সহ নানা টুকিটাকি জিনিস – তারই মধ্যে ছিল দেবী শর্মার জন্য আনা উপহারও! ততক্ষণে জানা হয়ে গেছে – তাঁর নাম ‘খালিদ’, তিনি ‘ঋণ স্বীকার করতে’ এসেছেন! তিনি মিরপুর ফিরবেন, তাঁকে বেইলি রোড পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন দ্বিজেন শর্মা; রাত বারোটা পেরিয়েছে, কোনোক্রমে পাওয়া গেল একটা স্কুটার (বেবি ট্যাক্সি)। বাড়ি ফিরতে আগ্রহী আরোহী স্কুটারের চালককে জানালেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কিন্তু মুশকিল হলো এ মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে আছে মাত্র বিশ টাকা। সদাশয় চালক সৌজন্যবশত তাতেই রাজি হয়ে তাঁকে তুলে নিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার ফিরে এল স্কুটার, নেমে এলেন সেই আরোহী, পকেট থেকে বার করলেন একটি কমলালেবু, এগিয়ে দিলেন দ্বিজেন শর্মার হাতে – ‘এটা আপনার জন্য’!

পরদিন সকালে আবার সিদ্ধেশ্বরীতে এলেন সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ – সঙ্গে তিন-চারজন শিল্পীবন্ধু আর গায়েহলুদের সাজসজ্জার জন্য কুলা-ডালা সহ নানান সরঞ্জাম। ঘোষণা করলেন, তাঁরা কিছুই খাবেন না; ফ্লাস্কভর্তি চা আর মিষ্টি দেয়া হলো তাঁদের জন্য। সারাদিন সাজসজ্জার কাজ সেরে তাঁরা বিদায় নেবার আগে দেবী শর্মা উপহার পেলেন একটি শাড়ি – ‘মেয়ের বিয়ের দিন এ শাড়িটা আপনাকে পরতে হবে’। জানা গেল, এই একই শাড়ি আরো একটা কেনা হয়েছে স্ত্রী কুলসুমের জন্য, বিয়ের দিন তিনি সেই শাড়িটা পরেই আসবেন খালিদের সঙ্গে। এসেওছিলেন। পরে বিয়ের অনুষ্ঠানে তোলা ছবিও শর্মা-দম্পতিকে পাঠিয়েছিলেন খালিদ। কিন্তু এর পর যথারীতি আবার উধাও!

এরও দুই দশক পেরিয়ে, গতকাল (২০ মে ২০১৭) রাত পৌনে বারোটায়, প্রায় পঁচাত্তর বছর বয়সে, চিরবিদায় নিলেন একুশে পদকে সম্মানিত ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট আর ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি, চিকিৎসাধীন ছিলেন ঢাকার বারডেম হাসপাতালে।

Aparajeo-Bangla-1

‘অপরাজেয় বাংলা’, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, কলা ভবন প্রাঙ্গণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

তাঁর আর কোনো ভাস্কর্যের জন্য না হোক, অন্য কোনো কৃতির জন্য না হোক, ‘অপরাজেয় বাংলা’ নামের মুক্তিযুদ্ধের এই স্মারক-ভাস্কর্যটির জন্য সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদকে বাংলাদেশ মনে রাখবে। অবশ্য ভবিষ্যতে এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি নিছকই একটা মুখস্থ বুলি না হয়ে ওঠে, শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতির অঙ্গনে শুভবুদ্ধি আর অসাম্প্রদায়িকতাকে হটিয়ে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার ক্রমবর্ধমান পশ্চাৎযাত্রাকে যদি রুখে দেয়া যায়, চিত্রকলা আর মূর্তিকলা বা ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে [রাষ্ট্র]ধর্মানুভূতিকে আঘাত করার অগ্রহণযোগ্য অভিযোগকে যদি আর কল্কে দেয়া না হয়, কেবল তাহলেই ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভবিষ্যতের আরো অনেক প্রজন্মের প্রগতিশীল আন্দোলনকেও অনুপ্রেরণা জোগানোর জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে।

 

রেজাউল করিম সুমন

একজন সামান্য পাঠক।

১ comment

  1. SY Global ltd - ১ জুলাই ২০১৭ (১:১৮ অপরাহ্ণ)

    রেজাউল করিম সুমন স্যার আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.