নভেরা আহমেদের ভাস্কর্যচর্চার স্বল্পালোচিত অধ্যায়: ১৯৬০–১৯৭০

বাংলাদেশের পথিকৃৎ ভাস্কর নভেরা আহমেদের মূল্যায়ন করা হয় মূলত তাঁর ১৯৫৭–১৯৬০ সালের ভাস্কর্য দিয়ে। এই লেখায় তুলে ধরা হয়েছে তাঁর ১৯৬০–১৯৭০ কালপর্বের ভাস্কর্যসৃষ্টির পরিচয়। [...]

[প্যারিসে নভেরা আহমেদের প্রায় একশো দিন ব্যাপী (১৬ জানুয়ারি—২৬ এপ্রিল ২০১৪) পূর্বাপর প্রদর্শনীর আজ শেষদিন। এতে প্রদর্শিত হয়েছে তাঁর ১৯৬৯–২০১৪ কালপর্বের ৫১টি শিল্পকর্ম (৯টি ভাস্কর্য ও ৪২টি চিত্রকর্ম)। নীচের প্রবন্ধটির উপজীব্য নভেরার এই কালপর্বের অব্যবহিত আগের এক দশক অর্থাৎ ১৯৬০–১৯৭০ সালের ভাস্কর্যসৃষ্টির পটভূমি ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এই লেখার আদিপাঠ মুদ্রিত হয়েছিল ঢাকা থেকে প্রকাশিত শিল্প ও শিল্পী  ত্রৈমাসিকের তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যায় (কার্তিক ১৪২০, নভেম্বর ২০১৩)। মুক্তাঙ্গনে প্রকাশের সময়ে দু-এক জায়গায় সামান্য পরিমার্জনা করা হয়েছে।]

.

১৯৬০ সালে ঢাকায় নভেরা আহমেদের প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনীর দীর্ঘ প্রায় তিন যুগ পরে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে সে-প্রদর্শনীর প্রায় চল্লিশটি ভাস্কর্য সংগৃহীত হয় এবং ১৯৯৮ সালে একত্রে মাসাধিককালব্যাপী প্রদর্শিত হয়। পরে শিল্পপতি এম আর খানের বাড়ির উদ্যানে নির্মিত মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য ‘পরিবার’ও (১৯৫৮) ফোয়ারা-সহ জাতীয় জাদুঘরের সামনে পুনঃস্থাপিত হয়। বাংলাদেশে ভাস্কর হিসেবে নভেরার মূল্যায়ন মূলত তাঁর ১৯৫৭–৬০ কালপর্বের শিল্পকর্মগুলির আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ।

পরবর্তীকালে যথাক্রমে ব্যাংককে ও প্যারিসে আয়োজিত শিল্পীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় একক প্রদর্শনী সম্পর্কে তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে তাঁর পরিণত পর্যায়ের শিল্পকৃতি নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয়নি।

ভাস্কর নভেরা আহমেদ

পথিকৃৎ ভাস্কর নভেরা আহমেদ

বিগত প্রায় পাঁচ দশক তাঁর নিভৃত প্রবাস-যাপনের ফলে এই দীর্ঘ সময়জুড়ে বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই, তাঁর শিল্পচর্চার ধারাবাহিকতা সম্পর্কেও আমরা অনবহিত। শিল্পীজীবনের উন্মেষপর্বে, ১৯৬১ সালে, ভাস্কর হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি; পরে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে জীবনী উপন্যাস রচিত হয়েছে (নভেরা, হাসনাত আবদুল হাই, ১৯৯৪, গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৯৫), নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র (নহন্যতে, এন রাশেদ চৌধুরী, ১৯৯৯)। বাংলাদেশের শিল্পকলার ইতিহাসে ভাস্কর ও নারীশিল্পীদের পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি, কিন্তু তা সত্ত্বেও নভেরা আহমেদের যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন এখনো পর্যন্ত হয়নি।

১৯৫০ দশকের প্রথমার্ধে লন্ডনের ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে চেক ভাস্কর কারেল ফোগেলের (১৮৯৭–১৯৬১) তত্ত্বাবধানে নভেরার শিল্পশিক্ষা-পর্ব মেহবুব আহমেদের একাধিক প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে। আমিনুল ইসলামের স্মৃতিকথার (বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর : প্রথম পর্ব ১৯৪৭–১৯৫৬, ২০০৩) কল্যাণে বিখ্যাত ইতালীয় ভাস্কর ভেন্তুরিনো ভেন্তুরির (১৯১৮–২০০২) ফ্লোরেন্সের স্টুডিওতে নভেরার প্রশিক্ষণ গ্রহণের কথাও আমাদের অবিদিত নয়। তাঁর ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে নির্মিত ভাস্কর্যের আঙ্গিক, করণকৌশল ইত্যাদি নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন লালা রুখ সেলিম। বর্তমান নিবন্ধের স্বল্প পরিসরে কিছু সম্পূরক তথ্য সংযোজনের পাশাপাশি শিল্পীর ১৯৬০–৭০ কালপর্বে নির্মিত ভাস্কর্যের স্বল্পালোচিত প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে।

 

নভেরার প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার) পাকিস্তান জাতিসংঘ সমিতির উদ্যোগে এবং এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায়। ১৯৬০ সালের ৭ আগস্ট রবিবার বিকেলে অন্তর্দৃষ্টি বা Inner Gaze শীর্ষক এই প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ আজম খান। দৈনিক আজাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ‘গবর্ণর পাকিস্তানে ভাস্কর্য্য শিল্পের আলোকবর্ত্তিকা বহনকারিনী নভেরার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করেন এবং তাহার শিল্প সৃষ্টির সহায়তাকল্পে দশ হাজার টাকা সাহায্য ঘোষণা করেন।’ পরের দিন সোমবার থেকে পরবর্তী দশদিন এই প্রদর্শনী সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। কেবলমাত্র ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে কিছু ভাস্কর্য গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণেও প্রদর্শিত হয়েছিল। প্রদর্শনীতে ভাস্কর্য ছিল সর্বসাকল্যে প্রায় পঁচাত্তরটি।

প্রথম একক প্রদর্শনীর ক্যাটালগ, ১৯৬০

প্রথম একক প্রদর্শনীর ক্যাটালগ, ১৯৬০

অন্তর্দৃষ্টি কেবল নভেরা আহমেদেরই নয়, সমগ্র পাকিস্তানের ক্ষেত্রেই সেটা ছিল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কোনো ভাস্করের প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী। প্রদর্শনীটি পাকিস্তানের দুই অংশের শিল্পরসিকদেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তৎকালীন পত্রিকার সাক্ষ্যে জানা যাচ্ছে, উদ্বোধনের তিনদিন পর ১০ আগস্ট বুধবার গভর্নর-পত্নী মিসেস আজম খান নভেরার ভাস্কর্য প্রদর্শনী পরিদর্শন করেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানান প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা পাকিস্তান জাতিসংঘ সমিতির পূর্বাঞ্চল শাখার সদস্যা ডা. ফাতিমা সাদেক, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ এবং শিল্পী স্বয়ং। সেদিনের অন্যান্য দর্শনার্থীর মধ্যে ছিলেন লাহোরের পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের সেক্রেটারি কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, লাহোর আর্ট কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল শিল্পী শাকির আলী, শিল্পী জয়নুল আবেদিনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

চাইল্ড ফিলোসফার

চাইল্ড ফিলোসফার

পরের বছর, ১৯৬১-র ডিসেম্বর থেকে ১৯৬২-র জানুয়ারির মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে আয়োজিত জাতীয় চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও ছাপচিত্র প্রদর্শনীতে নভেরা আহমেদ ভাস্কর্য মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার (রাষ্ট্রপতির পুরস্কার) লাভ করেন। তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্ত ভাস্কর্যটি ছিল প্লাস্টার (মতান্তরে সিমেন্ট/কংক্রিট) মাধ্যমে একটি বালকের আবক্ষ প্রতিকৃতি — ‘Child Philosopher’। মুদ্রিত প্রতিরূপের কল্যাণে এই ভাস্কর্যটি আমাদের পরিচিত। Contemporary Arts in Pakistan পত্রিকায় প্রকাশিত ডি এস ওয়াটসনের পর্যালোচনা থেকে জানা যায়, তাঁর অন্য যে-দুটি কাজ প্রদর্শনীতে ছিল সেগুলির একটি ‘কোয়ার্টার রিলিফে অ্যাবস্ট্রাক্ট প্যানেল’, অন্যটি অবয়বধর্মী ভাস্কর্য ‘Exterminating Angel’। ছয় ফুটের অধিক উচ্চতাবিশিষ্ট শেষোক্ত স্টাইলাইজড ভাস্কর্যটিতে বিধৃত হয়েছে শকুনের শ্বাসরোধকারী একজন নারীর অবয়ব — নারীর হাতে অশুভ শক্তি ও মৃত্যুর পরাভবের প্রতীক।

এক্সটারমিনেটিং অ্যাঞ্জেল, সিমেন্ট, ১৯৬০

এক্সটারমিনেটিং অ্যাঞ্জেল, সিমেন্ট, ১৯৬০

পাকিস্তানের অগ্রগণ্য শিল্প-ইতিহাসবেত্তা সালিমা হাশমি তাঁর Unveiling the Visible : Lives and Works of Women Artists in Pakistan (2002) বইয়ের ‘নভেরা আহমেদ’ শীর্ষক ভুক্তি-নিবন্ধে ‘Child Philosopher’-কে ব্রোঞ্জ-নির্মিত ভাস্কর্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এমন কি হতে পারে যে, প্লাস্টার বা কংক্রিট থেকে পরে সেটা ব্রোঞ্জে ঢালাই করেছিলেন শিল্পী? এ নিবন্ধে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ‘Exterminating Angel’ শীর্ষক ভাস্কর্যটির নির্মাণকাল ১৯৬০। আমাদের ইতিপূর্বে-অদেখা আরো একটি ভাস্কর্যের ছবিও সালিমার লেখায় সন্নিবেশিত হয়েছে – ‘Female Form’ (ছবির ক্যাপশনে অবশ্য আছে ‘Standing Figure’); ছয় ফুটের অধিক উচ্চতাবিশিষ্ট এ ভাস্কর্যও ১৯৬০ সালে নির্মিত। ঢাকায় ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে আয়োজিত শিল্পীর প্রথম একক প্রদর্শনীর যেসব ভাস্কর্য আমরা ক্যাটালগে বা বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে দেখি, সেগুলির সঙ্গে লাহোর-পর্বের ভাস্কর্যের কোনো শৈলীগত সামীপ্য নেই।

কালি ও কলম-এর দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় (এপ্রিল ২০০৫) প্রকাশিত মেহবুব আহমেদের লেখা ‘ভাস্কর নভেরা আহমেদ’ থেকে আমরা জেনেছি (তিনি জেনেছেন সম্ভবত শিল্পীর ঘনিষ্ঠ সুহৃদ সাংবাদিক এস এম আলীর কাছ থেকে) — প্রথম প্রদর্শনীর ‘কিছুদিন পর লাহোর আর্টস কাউন্সিলের সেক্রেটারি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের আমন্ত্রণে নভেরা লাহোরে চলে গেলেন, ঢাকার চেয়ে সেখানে কমিশন পাওয়ার সুযোগ বেশি হবে — এরকম একটা ধারণা তিনি পেয়েছিলেন।’ অনুমান করা যেতে পারে, ১৯৬০ সালের শেষদিকে কোনো একসময়ে নভেরা লাহোরে গিয়েছিলেন এবং বছরখানেক সেখানে অবস্থান করেছিলেন। ১৯৬১ সালের শেষদিকে নৃত্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য তাঁর ভারতে অবস্থান এবং ১৯৬২ সালের শেষদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভ্রমণ বাদ দিলে ১৯৬৩-র প্রায় শেষ পর্যন্ত মূলত লাহোরেই থেকেছেন তিনি। এস এম আলী সে-সময়ে প্রায় দুই বছর সেখানকার The Pakistan Times পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

বস্তুতপক্ষে ঢাকায় প্রথম প্রদর্শনীর পর নভেরা আহমেদের ভাস্কযচর্চার প্রধান কেন্দ্র ছিল লাহোর। তাঁর লাহোর-পর্বের ভাস্কর্য নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কন্যা সালিমা হাশমির পূর্বোক্ত নিবন্ধে :

Novera came to Lahore for the National Exhibition in 1961, and stayed for almost a year. Her works were exhibitied at the Alhamra Art Centre — then known as the Pakistan Arts Council — and bought by important private collectors. The ‘Child Philosopher’ was in the private collection of Mian Mumtaz Daultana; the ‘Exterminating Angel’ in the collection of the late Dr. Riaz Ali Shah; the ‘Female Form’ in that of Alys Faiz. Two works were gifted to Faiz Ahmed Faiz, to be placed at the Arts Council where they still remain.

বর্তমানে আল হামরা আর্টস কাউন্সিলের গ্যালারিতে সংরক্ষিত শেষোক্ত অবয়বধর্মী ভাস্কর্য দুটির বিষয়বস্তু মা ও শিশু এবং নারী। ওপরের উদ্ধৃতি থেকে জানা যাচ্ছে, লাহোরের জাতীয় প্রদর্শনীর তিনটি ভাস্কর্যের মধ্যে ‘Child Philosopher’ ও ‘Exterminating Angel’ সংগ্রহ করেছিলেন যথাক্রমে মিয়া মমতাজ দৌলতানা ও ড. রিয়াজ আলী শাহ্। মেহবুব আহমেদের লেখায় জাতীয় প্রদর্শনীতে স্থানপ্রাপ্ত নভেরার একটি ভাস্কর্য পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস বা পিআইএ কর্তৃক সংগ্রহের উল্লেখ আছে। তাহলে তৃতীয় ভাস্কর্যটি অর্থাৎ ওয়াটসন-বর্ণিত অজ্ঞাত-শিরোনাম ‘কোয়ার্টার রিলিফে অ্যাকস্ট্রাক্ট প্যানেলটি’ই কি পিআইএ সংগ্রহ করেছিল? এ কাজটির কোনো ছবি যেমন আমরা দেখিনি, তেমনি এটির বর্তমান অবস্থানও আমাদের অজানা।

আল হামরা আর্টস কাউন্সিলে সংরক্ষিত দুটি ভাস্কর্যের একটি। ছবি: তৈয়বা বেগম লিপি

আল হামরা আর্টস কাউন্সিলে সংরক্ষিত নভেরার ভাস্কর্য। ছবি: তৈয়বা বেগম লিপি

ওয়াটসনের একই লেখায় (১৯৬২) পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানকালে নভেরা আহমেদের একটি কমিশন লাভের উল্লেখ আছে। জাতীয় প্রদর্শনীর ভাস্কর্য তিনটি সম্পর্কে নিজস্ব মতামত জানানোর পর ওয়াটসন লিখেছিলেন :

The medium used in all three of her exhibits is concrete, which suits the panel perfectly, but imparts a deadness to the other two, which one wished had been done in either stone or bronze. She herself undoubtedly wishes the same, but the problems of casting large metal figures must be almost insuperable in Lahore, and the cost of marble puts it out of the range of an artist who is not working on an advance from a patron. Sculpture has always had to be commissioned; the artist working independently has never been able to cope with the expense of it unaided. Miss Novera has now one commission that I know of; let us hope that the patron will finance marble. The value of the finished work will be infinitely higher.

সেই কমিশনের কাজটি শিল্প-সমালোচকের প্রত্যাশা অনুযায়ী শিল্পী মার্বেলে বা ব্রোঞ্জে করতে পেরেছিলেন কি না, আদৌ সেটি কোথায় সংরক্ষিত আছে — সে-বিষয়ে অন্য কোনো সূত্র থেকেও কিছু জানা যায়নি।

একথা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে ভাস্কর হিসেবে নিজের একটা দৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন নভেরা। Pakistan Quarterly পত্রিকার সম্পাদক জালালউদ্দিন আহমেদের Art in Pakistan (করাচি, ১৯৫৪) গ্রন্থের পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণে (১৯৬২) তাঁর ওপর একটি স্বতন্ত্র ভুক্তি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। Contemporary Arts in Pakistan পত্রিকায় প্রকাশিত ইতিমধ্যে-উল্লিখিত লেখায় জাতীয় প্রদর্শনীর পুরস্কারবিজয়ী শিল্পী প্রসঙ্গে ওয়াটসন মন্তব্য করেছিলেন, ‘[…] no discussion of Pakistani art would be complete without reference to her [Novera Ahmed].’

এদিকে এর দীর্ঘ চার দশক পর সালিমা হাশমি নভেরা আহমেদের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘Perhaps the first sculptor in Pakistan to adopt a thoroughly contemporary idiom’। তাঁর এই মন্তব্যের যাথার্থ্য অনুধাবনের জন্য নভেরার সমসাময়িক পশ্চিম পাকিস্তানি ভাস্করদের প্রসঙ্গ উত্থাপন জরুরি।

 

ঢাকায় ১৯৬০ সালে নভেরার একক প্রদর্শনীর প্রায় বছর তিনেক পরে, ১৯৬৩ সালে, করাচির পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল-এর উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল সৈয়দ আফসার মাদাদ নাকভি-র প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী। সেটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের প্রথম ও সমগ্র পাকিস্তানের দ্বিতীয় একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী।

আফসার মাদাদ নাকভি (১৯৩৩–১৯৯৭) ভাস্কর্য বিষয়ে ডিপ্লোমা ও পোস্ট-ডিপ্লোমা (১৯৬০) করেছিলেন লখনৌ স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস থেকে। ১৯৬২ সালে দেশান্তরী হয়ে করাচিতে আসার পর তিনি সেখানকার সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস-এ ভাস্কর্য বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেন। আর সে-সময়ে লাহোরের ন্যাশনাল কলেজ অব আর্টস-এর ভাস্কর্য বিভাগের প্রধান ছিলেন হায়দরাবাদ ডেক্কান-এর গভর্নমেন্ট কলেজ অব ফাইন আর্টস থেকে ভাস্কর্য বিষয়ে ডিপ্লোমাধারী (১৯৫৫) তৌফিক আইজাজ।

ভারতের একাধিক শিল্পবিদ্যালয়ের পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানেও দেশবিভাগ-পূর্ব কালেই ভাস্কর্য বিষয়ে বিদ্যায়তনিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিল। পাকিস্তানের অগ্রণী ভাস্কর ওজির জুবি (১৯২২–২০০১) লাহোরের মেয়ো স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস (অধুনা ন্যাশনাল কলেজ অব দি আর্টস) থেকে মডেলিং-এ ডিপ্লোমা অর্জন করেছিলেন ১৯৪৪ সালে, পরে এক বছর উচ্চশিক্ষা নিয়েছিলেন রোমের আকাদেমিয়া দি বেল্লে আর্তি থেকে।

নভেরা আহমেদের সমসাময়িককালে পশ্চিম পাকিস্তানে আরো যে-ক’জন ভাস্কর সক্রিয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এম. আমিন (জন্ম ১৯২৪), বাবর হামিদ ও নাসির শামসি (মৃত্যু ২০০২)। তাঁরাও ছিলেন ওজির জুবির মতো একাধারে চিত্রকর ও ভাস্কর। এই তিন শিল্পী শিল্পশিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন যথাক্রমে লাহোরের মেয়ো স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস, রোমের আকাদেমিয়া দি বেল্লে আর্তি এবং  প্রথমে বোম্বের জে জে স্কুল অব আর্ট ও পরে লন্ডনের সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্ট থেকে।

ওজির জুবি ও আফসার মাদাদ নাকভির মতো বাবর হামিদের ভাস্কর্যও ছিল মূলত বাস্তবানুগ ও অবয়বধর্মী। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে ভাস্কর্যচর্চার ক্ষেত্রে সাদৃশ্যনিষ্ঠাকে অতিক্রমণের প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় এম. আমিনের কয়েকটি কাঠের ভাস্কর্যে এবং নাসির শামসির হেনরি মুর-প্রভাবিত কয়েকটি প্লাস্টারের ভাস্কর্যে|

১৯৪৯ সালে নাসির শামসির প্রথম একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল করাচির ফাইন আর্টস সোসাইটির উদ্যোগে। অবশ্য তখনও পর্যন্ত তাঁর আগ্রহ সীমবদ্ধ ছিল চিত্রকলায়। সে-বছরের মে মাসে তিনি ভর্তি হন লন্ডনের সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্টের তিন বছর মেয়াদি ডিজাইন কোর্সে। উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে তিনি কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। নাসির শামসি ভাস্কর্য নির্মাণে মনোযোগী হন আরো পরে — ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে।  নগ্ন অবয়ব বিষয়ে সামাজিক স্বীকৃতির অভাব ও নিজের নানামুখী পেশাগত ব্যস্ততার কারণে তাঁর ভাস্কর্যচর্চা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

১৯৬০ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় চিত্রকলা ও ভাস্কর্য প্রদর্শনীর পর্যালোচনা করতে গিয়ে সে-সময়ে পাকিস্তানে অবস্থানকারী মার্কিন শিল্পী এলেইন হ্যামিলটন নাসির শামসির ভাস্কর্য সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন :

Shamsie’s ‘Standing Figure’ most definitely stands out, though the obvious echos of Henry Moore resounds and makes this, as two other pieces by him, more a matter of exercise than a genuine creative effort.

নভেরার সমসাময়িক পাকিস্তানি ভাস্করদের মধ্যে দুজন দীর্ঘদিন ভাস্কর্যচর্চায় স্থিত থেকেছেন — ওজির জুবি ও আফসার মাদাদ নাকভি। নাকভি ছিলেন ঘোষিতভাবেই ‘ঐতিহ্যপন্থী’ — তিনি প্রাচীন ভারতীয় ভাস্কর্যের অনুপ্রেরণায় প্রাচ্যরীতির অবয়বধর্মী ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন। দুজনেরই কমিশনের ভিত্তিতে করা কাজের বড় অংশ ছিল প্রতিকৃতি ভাস্কর্য। তাঁদের সম্পর্কে পাকিস্তানের শিল্প-বিষয়ক সাময়িকপত্র Nukta-য় প্রকাশিত ‘The Dissident Dialogue’ শীর্ষক এক লেখায় মন্তব্য করা হয়েছে :

Both these artists, for different reasons, leave behind no articulation of a personal grammar, and stayed well within the established framework. For Zuby, sculpture took a backseat as he established and ran the School of Decor in Karachi. Naqvi, with his full time responsibility as the head of the modest Sculpture Department of the Central Institute of Arts and Crafts (CIAC), and later as head of the school, had few opportunities to exhibit his work and was happy to hone his skills on private commissions.

এই দুজন শিল্পীর সঙ্গে নভেরার বড় পার্থক্য তাঁর ভাস্কর্যচর্চার ধারাবাহিকতায় এবং স্বাতন্ত্র্যের অন্বেষণে।

 

নভেরা আহমেদের দ্বিতীয় একক প্রদর্শনীর সময়কাল নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য প্রচলিত আছে। মেহবুব আহমেদের মতে, ‘১৯৬৮ সালের শেষদিকে ব্যাংককে নভেরা আহমেদের একক প্রদর্শনী হয়।’ শিল্প ও শিল্পী-র দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যায় (সেপ্টেম্বর ২০১২) প্রকাশিত ‘নভেরা — নতুন পথের দিশারী’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি আক্ষেপ করেছেন, ‘অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, নভেরার প্যারিসে করা যে-কাজগুলো ব্যাংককে প্রদর্শিত হয়েছিল তার কোনো নিদর্শন পাইনি, এমনকি ব্রোশারও নয়।’

অন্যদিকে সেলিনা হোসেন জেন্ডার বিশ্বকোষ-এর (২০০৬) প্রথম খণ্ডের ‘নভেরা আহমেদ’ শীর্ষক ভুক্তিতে লিখেছেন, ‘১৯৮৮ সালে প্যারিসে অবস্থানকালে ব্যাংককের আলিয়ঁস ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস যৌথভাবে তাঁর একক প্রদর্শনীর আয়োজন করে।’

বাংলাদেশের নারী চরিতাভিধান-এ (১৯৯৮) সাঈদা জামানও প্রদর্শনীর সাল হিসেবে ১৯৮৮-র কথাই উল্লেখ করেছেন, এবং সেইসঙ্গে যুক্ত করেছেন নভেরার মৃত্যুসংবাদও : ‘১৯৮৯ সালে নভেরা আহমেদ মারা যান।’

ব্যাংককের প্রদর্শনী সম্পর্কে সঠিক তথ্য রয়েছে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত  ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষা’  গ্রন্থমালার  চারু ও কারু কলা  (২০০৭) সংকলনভুক্ত লালা রুখ সেলিমের লেখায় : ‘১৯৭০ সালে তিনি [নভেরা আহমেদ] ব্যাঙ্ককে যান এবং প্রাঙ্গণ ভাস্কর্যের প্রদর্শনী করেন।’

ব্যাংকক প্রদর্শনীর ক্যাটালগের পৃষ্ঠা

ব্যাংকক প্রদর্শনীর ক্যাটালগের পৃষ্ঠা

ব্যাংকক পোস্ট পত্রিকার তৎকালীন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এস  এম আলীই যে এই প্রদর্শনীর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর সম্প্রতি-প্রাপ্ত  ‘ব্রোশার’ বা ক্যাটালগের সাক্ষ্য নিয়ে এখন নিশ্চিত করেই বলা সম্ভব, ব্যাংকক আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের আয়োজনে নভেরার প্রদর্শনী চলেছিল ১৯৭০ সালের ১৪ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত, আয়োজক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ভবনে (২৯ থানন সাথর্ন তাই)। প্রদর্শনী আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন থাইল্যান্ডে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মি. রব, শিল্পাকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আলঙ্কারিক শিল্পকলা অনুষদের ডিন প্রিন্স ইয়াৎচাই চিত্রাবংস, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস-এর ডিরেক্টর মাহমুদ-আল-হক। এবং এর উদ্বোধন করেছিলেন প্রিন্স কারাবিক চক্রবন্ধু, যিনি নিজেও ছিলেন শৌখিন চিত্রকর ও ভাস্কর।

ক্যাটালগে মুদ্রিত ভাষ্য অনুযায়ী:

This is a unique kind of art exhibition. Novera Ahmed, the most famous sculptress of Pakistan and well known among art circles in London and Paris, presents her recent works in an exposition that provides a welcome break to her self-imposed detachment from public attention. What makes this exhibition all the more unique is that it is also Bangkok’s first open air show of sculptures in direct metal, a medium that poses almost formidable challenges to contemporary artists. In more ways than one, this exhibition should make a vital contribution to the modern art movement in Asia.

থাইল্যান্ডের তৎকালীন ভাস্কর্যচর্চার প্রেক্ষাপটে নভেরার এই একক প্রদর্শনীকে একটা বৈপ্লবিক পদক্ষেপ বললে অত্যুক্তি হবে না। সে-দেশে আধুনিক ভাস্কর্য তথা শিল্পচর্চার সূত্রপাত করেছিলেন ইতালীয় ভাস্কর কোরাদো ফেরোচি (১৮৯২–১৯৬২), যিনি মিনিস্ট্রি অব প্যালেস এফেয়ার্স-এর চারুকলা বিভাগের আমন্ত্রণে পাশ্চাত্য রীতির ভাস্কর্য বিষয়ে হাতে-কলমে পাঠ দানের জন্য থাইল্যান্ডে এসেছিলেন ১৯২৩ সালে। ১৯৪৩ সালে তিনি যে-শিল্পবিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটিই পরবর্তীকালে শিল্পাকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির পরাভবের ফলে ১৯৪৪ সালে আত্মরক্ষার তাগিদে তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে ‘শিল্পা বিরাশ্রী’ রাখেন এবং থাই নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪০ ও ‌’৫০-এর দশকে থাইল্যান্ডে শিল্পা বিরাশ্রীর নেতৃত্বে বাস্তবধর্মী প্রতিকৃতি ও অবয়বপ্রধান ভাস্কর্যের চর্চাই হয়েছে বেশি। ১৯৬২ সালে তাঁর মৃত্যুর সেখানে বিমূর্ত ভাস্কর্য ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। ১৯৬৫ সালের ষোড়শ জাতীয় প্রদর্শনীতে চাম্‌রুয়াং ভিচিয়েন্‌কেত্-এর একটি বিমূর্ত ভাস্কর্যের স্বর্ণপদক লাভের ঘটনাকে থাইল্যান্ডের আধুনিক ভাস্কর্যচর্চার ক্ষেত্রে একটি নতুন পর্বের সূচনা হিসেবে গণ্য করা হয়। বিমূর্ত রূপকল্পনার পাশাপাশি এ-সময় থেকেই ভাস্কর্য নির্মাণে প্রচলিত উপকরণের বাইরে কাঠ, পাথর ইত্যাদির ব্যবহার শুরু হয়। বিমূর্ত ও অর্ধবিমূর্ত ধারার কয়েকজন প্রতিভাবান ভাস্করের সক্রিয়তার কারণে ১৯৬৭–৭৬ কালপর্ব  সে-দেশে বিমূর্ত ভাস্কর্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত।

নভেরা আহমেদ, আনুমানিক ১৯৭০

নভেরা আহমেদ, আনুমানিক ১৯৭০

আর এ সময়েই, ১৯৭০ সালের অক্টোবরে, নভেরা আহমেদের ধাতব মাধ্যমে তৈরি ভাস্কর্যের প্রদর্শনীটি ছিল ব্যাংককে ধাতব ভাস্কর্যের প্রথম মুক্তাঙ্গন প্রদর্শনী। ব্রোঞ্জ ছাড়াও এ পর্বে নভেরা তাঁর ভাস্কর্যের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন শিট মেটাল এবং ঝালাইকৃত বা ওয়েলডেড ও স্টেইনলেস স্টিল।

পরিবার, ধাতব ভাস্কর্য, ১৯৬৯

পরিবার, ১৯৬৯, ধাতব ভাস্কর্য

১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে নির্মিত ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে অধিকাংশই বেশ বড়ো আকারের — ৫ ফুট থেকে শুরু করে এমনকী ৭ ফুট ১১ ইঞ্চি পর্যন্ত উচ্চতা বিশিষ্ট। একই বিষয়বস্তু নিয়ে নির্মিত একাধিক ভাস্কর্যের মধ্যে ‘পরিবার’ (১৯৬৯), ‘যুগল’ (১৯৬৯), ‘ইকারুস’ (১৯৬৯) ইত্যাদি কাজে মাধ্যমগত চাহিদার কারণেই অবয়বগুলি সরলীকৃত। ওয়েলডেড স্টিলের ‘জেব্রা ক্রসিং’ (১৯৬৮), দুটি ‘লুনাটিক টোটেম’ ইত্যাদির পাশাপাশি রয়েছে ব্রোঞ্জে তৈরি দণ্ডায়মান অবয়ব। এছাড়া কয়েকটি রিলিফ ভাস্কর্য ও স্ক্রল।

অবয়ব, ১৯৬৮, ব্রোঞ্জ, উচ্চতা ৫ ফুট

অবয়ব, ১৯৬৮, ব্রোঞ্জ, উচ্চতা ৫ ফুট

‘লুনাটিক টোটেম’ বা ‘মেডিটেশন’ (১৯৬৮)-এর মতো ভাস্কর্যে শিল্পীর মরমি অনুভবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কোথাও-বা রয়েছে আদিম ভাস্কর্যরীতি থেকে পরিগ্রহণ। তবে একেবারে ভিন্ন রীতির কাজও ছিল এই প্রদর্শনীতে। বস্তুতপক্ষে ৩৩টি শিল্পকর্মের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ১১টিই ছিল junk sculpture — ইন্দোচীনে ভূপাতিত মার্কিন যুদ্ধবিমানের ভগ্নাবশেষ থেকে তৈরি। শিল্পভাষার বিচারে এ কাজগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বিধ্বস্ত যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষ থেকে তৈরি ভাস্কর্য

বিধ্বস্ত যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষ থেকে তৈরি ভাস্কর্য

দ্বিতীয় প্রদর্শনীর সবগুলি ভাস্কর্যই কি ব্যাংককে রয়ে গিয়েছিল? না কি কোনো কোনোটা নিজের সঙ্গে প্যারিসে নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পী? এস. এম. আলী মেহবুব আহমেদকে বলেছিলেন ‘ব্যাংককে নভেরার কোনো কাজ এখনো আছে কি না তাও দেখে আসবেন।’ তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর কারণে তা আর আমাদের জানা হলো না। শিল্পাকর্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যাংককের আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেও এ-সংক্রান্ত কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।

নভেরা আহমেদের তৃতীয় একক প্রদর্শনীটি হয়েছিল প্যারিসে, ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে। এ প্রদর্শনীর ১২টি ভাস্কর্যের সব কটিই ছিল ব্রোঞ্জ-নির্মিত — আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে ব্যাংককের প্রদর্শনীর কাজের চাইতে অনেকটাই আলাদা। ১৯৬৬ সালের দুটি কাজ বাদে বাকি দশটি ভাস্কর্যই ছিল ১৯৭১–৭৩ কালপর্বের। প্যারিসের প্রদর্শনীতে প্রথমবারের মতো ভাস্কর্যের পাশাপাশি স্থান পেয়েছিল ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে আঁকা ১২টি ছবি। কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য হলো প্রদর্শিত ছবিগুলির অন্যতম ছবি ‘বাংলাদেশ’  আঁকা হয়েছিল ১৯৭১ সালে।

নভেরার তৃতীয় প্রদর্শনীর উল্লেখ আছে লালা রুখ সেলিমের লেখায়, তবে মেহবুব আহমেদের লেখায় এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। বরং তিনি লিখেছেন, ‌‌’এই শিল্পী আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেলেন। […] তিনি continue করলেন না — শিল্পকর্ম থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে নিলেন।’ সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংককের প্রদর্শনীর পর থেকে তো নয়ই, এমনকী প্যারিসের প্রদর্শনীর পরেও নভেরা শিল্পচর্চা থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে নেননি। তবে এ লেখার উপজীব্য যেহেতু ১৯৬০–৭০ কালপর্বের ভাস্কর্য, শিল্পীর পরবর্তী পর্যায়ের ভাস্কর্য ও চিত্রকলার প্রসঙ্গ পরবর্তী কোনো প্রবন্ধে আলোচিত হবে।

প্যারিসের গ্যালারিতে নভেরার ছবি ও ভাস্কর্য। ছবি : সজীব আহমেদ

প্যারিসের গ্যালারিতে নভেরার ছবি ও ভাস্কর্য। ছবি : সজীব আহমেদ

বর্তমান আলোচনার উপসংহারে বলা চলে, নভেরা আহমেদ কেবল বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যচর্চার পথিকৃৎ-শিল্পী নন, পাকিস্তানের শিল্প-ইতিহাসেও তিনি একজন অগ্রগণ্য ভাস্কর। উপরন্তু থাইল্যান্ডের আধুনিক শিল্পচর্চার ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যাংককের প্রদর্শনী একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবার যোগ্য।

 

নিজের স্টুডিওতে নভেরা আহমেদ, ঢাকা, ১৯৬০

নিজের স্টুডিওতে নভেরা আহমেদ, ঢাকা, ১৯৬০

অস্বীকার করার উপায় নেই, নভেরার স্বাধীন ও স্বতন্ত্র শিল্পীসত্তাকে অভিবাদন জানানোর জন্য এখনো আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত হতে পারিনি। আমরা অনেকেই তাঁকে দেখেছি অন্যের স্মৃতিচারণ, জনশ্রুতি আর লেখকের কল্পনার মিশেলে গড়ে ওঠা একটি উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে। তাঁর ‘স্বেচ্ছানির্বাসন’-এর কারণ নিয়ে আমরা জল্পনাকল্পনা করেছি, কিন্তু তাঁর শিল্পসৃষ্টি নিয়ে তথ্যনিষ্ঠ গবেষণা করিনি।  বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ‘ভাস্কর নভেরা আহমেদ হল’-এর কার্যক্রম অজ্ঞাত কারণে বন্ধ হয়ে গেলে আমরা নির্বিকার থেকেছি। তাঁর ভগ্নপ্রায় শিল্পকর্মগুলির জীর্ণোদ্ধারের ব্যাপারে মনোযোগী হইনি। সংরক্ষিত ভাস্কর্যগুলিকে ব্রোঞ্জে ঢালাই করে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের দাবিও তুলিনি। এমনকী তাঁর মৃত্যু-সংবাদের রটনায়ও আমরা বিচলিত বোধ করিনি। আমাদের রাজধানীর উন্মুক্ত পরিসরে যত্রতত্র স্থাপিত শিল্প পদবাচ্য হওয়ার অযোগ্য বস্তুপিণ্ডকেও ভাস্কর্য হিসেবে স্বীকার করে নিতে নিতে আমরা সম্ভবত বিস্মৃত হয়েছি যে, এখন থেকে অর্ধশতাব্দী কালেরও বেশি সময় আগে, নগরজীবনের পরিসরে নান্দনিক অভিজ্ঞতার উৎস হিসেবে ভাস্কর্যকে অপরিহার্য বলে মনে করেছিলেন এ দেশেরই একজন শিল্পী :

We, the sculptors […] should play our part in the planning of the cities, in the building of hospitals, houses and factories — in fact in decorating every available space wherever people live and work.

[…] we must let the people grow up with work of art playing a direct positive part in their everyday life. We must return to the concept of city planning which had inspired the growth of great cities of the world, giving it a new interpretation. We must ignite among our people the spark of curiosity, about the inner visions, meanings and truths of life, which can come only by bringing art within the horizon of our city life.

রেজাউল করিম সুমন

একজন সামান্য পাঠক।

৪ comments

  1. লুসিফার লায়লা - ২৭ এপ্রিল ২০১৪ (১২:৩৯ অপরাহ্ণ)

    নভেরাকে নিয়ে চমৎকার তথ্যবহুল লেখার জন্যে ধন্যবাদ সুমন ভাই।

  2. ইশরাত - ৭ মে ২০১৫ (১:২৮ পূর্বাহ্ণ)

    অনেক কিছু জানা হল।ধন্যবাদ

  3. প্রদীপ ঘোষ - ৭ মে ২০১৫ (৯:৩২ পূর্বাহ্ণ)

    সুমন ভাই কে ধন্যবাদ ভালো একটি লেখার জন্য

  4. নাজিব তারেক - ২৩ মে ২০১৫ (১০:৩৫ অপরাহ্ণ)

    …বিগত প্রায় পাঁচ দশক তাঁর নিভৃত প্রবাস-যাপনের ফলে এই দীর্ঘ সময়জুড়ে বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই, তাঁর শিল্পচর্চার ধারাবাহিকতা সম্পর্কেও আমরা অনবহিত…
    রবীন্দ্রনাথ আমাদের অবহিত করতেন বা করেছিলেন বলে আমরা তার বিষয়ে আবগত। আসলেই কি আমরা অবগত?
    নভেরা কাজ করে গেছেন। যা যথাযথ মাধ্যমে প্রকাশীতও হয়েছে। আজ আমরা যখন অবগত হতে ইচ্ছা করছি তখন এ গুলোই আমাদের আমাদের তথ্য উৎস হয়ে উঠছে…
    আমরা অবগত হকে চাইনি, চাইনা।
    তার এ মূহুর্তের প্রমান ১৯৭৬ থেকে এ পর্যন্ত জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পীদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে আমাদের কাছে কোন তথ্যই নেই…
    পত্রিকা গুলি ছাপতে চায় না, ব্লগ নামক এ সুবিধাটাও আমরা ব্যবহার করছি না…
    আর নভেরা সম্পকিত সাম্প্রতিক আলোচনায় বলা হচ্ছে হাসনাত আবদুল হাই-এর নভেরা উপন্যাস নভেরাকে আলোচনায় এনেছে। আর্বিভাবের পর থেকে নভেরাকে নিয়ে কখোনই আলোচনা বন্ধ ছিলনা, নভেরা উপন্যাস সে আলোচনার সংকলন মাত্র… এবং এ উপন্যাস আমাদের আগ্রহ ও বুদ্ধিচর্চার মানের প্রমান।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.