ত্রিশ-দশকে আবির্ভূত একদল শিক্ষিত মেধাবী কবির হাতে ‘স্থূলতা, মেকিত্ব ও প্রাকৃত আবেগ ছেড়ে বাঙলা কবিতা আলিঙ্গন করলো সূক্ষ্মতা, স্বাভাবিকতা ও রুচিশীলতাকে’ ((প্রসঙ্গ বাংলাদেশের সমালোচনা সাহিত্য, আবিদ আনোয়ার, বাংলা কবিতার আধুনিকায়ন, ১৯৯৭, ঢাকা)) ; মহাপরাক্রমশালী রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয়ের বাইরে প্রবাহিত হতে শুরু করলো বাংলা কাব্য-নন্দনের এক নবস্বাদধারা। যেখান থেকে বাংলা কবিতায় ‘আধুনিক’ যুগের ব্যাপকায়তন যাত্রাপাত। ক্ষুদ্রায়তনে ‘আধুনিক’ শব্দটির প্রয়োগ এর আগে মাত্র একজন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়েছিল। সে ‘আধুনিকতা’ এবং ত্রিশের সূক্ষ্মতা, স্বাভাবিকতা আর রুচিশীলতাসূচক ‘আধুনিকতা’ এক নয়। চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-আশি বাহিত হয়ে এখনো অবধি প্রবহমান যে ‘আধুনিকতা (উত্তর-আধুনিকতার কথা মনে রেখেই), তা মধুসূদনের নয়, ত্রিশের। ত্রিশের পাণ্ডবগণের জীবনবাদিতা ছিল ভিন্নরকম। ‘তাঁরা রাজনীতিনিরপেক্ষ, সমাজবিমুখ, ব্যক্তিবাদী কিন্তু জীবনবাদীও এ-অর্থে যে তাঁদের হাতেই বাঙলা কবিতা এই প্রথম স্বপ্নীল ভাবলোকের নিকুঞ্জ ছেড়ে হৈ হৈ করে ঢুকে পড়ল জনজীবনের আনাচে-কানাচে, গৃহিণীর হেঁসেলে, গেঁদু মোড়লের সালিশী বৈঠক থেকে নগরীর ফুটপাত, অলিগলি এমনকি পতিতালয়ের নিষিদ্ধ প্রকোষ্ঠে। কিন্তু এত জীবনলগ্ন হয়েও এসব কবিতার অধিকাংশ নির্গত হয়েছে ব্যক্তিমানসের নিঃসঙ্গ অন্তর্লোক থেকে। এই নিঃসঙ্গতা আধুনিক বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে জাত; এই চেতনা যত না কবির স্বসৃষ্ট তারও চেয়ে বেশি বিনষ্ট সময় ও সমাজের দান।’ ((মধ্যদিনের জানালা, আবিদ আনোয়ার, বাংলা কবিতার আধুনিকায়ন, ১৯৯৭, ঢাকা)) –এই যে অস্থিরতার সাথে কবিতাকর্মীদের আত্যন্তিক সাক্ষাৎ ত্রিশ-দশকীয় গবাক্ষপথে; একটিমাত্র দশকান্তরে সেই অস্থির পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে অস্থিরতর। বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের পাশাপাশি ভারতভূমিতেও এ সময়ে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এমনসব ঘটনাবলি সমুপস্থিত হয়েছে যে চল্লিশদশক আধুনিক ভারতবর্ষের সবচেয়ে কম্পমান, অনিশ্চয়তামণ্ডিত দুর্দশক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এর প্রতিক্রিয়া স্পর্শ করেছে লেখককুলকেও। নির্মাণ প্রক্রিয়ায় নিঃসঙ্গ হয়েও বাইরে তাঁরা হয়ে উঠেছেন সঙ্গপরিবেষ্টিত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক কবিই যুক্ত হয়ে পড়েছেন বঞ্চিত মানুষের আন্দোলনে। কবিতার বিষয় হিসেবে সময়, সমাজ, মানুষ, মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস হয়ে উঠেছে ব্যক্তিক নৈসঃঙ্গ্যের চেয়েও বড়ো। লিখিত হয়েছে প্রচুর উচ্চকণ্ঠ স্লোগানও। আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫) এই উত্তুঙ্গ আন্দোলনমুখর বিনষ্ট সময়েই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’ (১৯৪৭)-এর প্রকাশের মধ্য দিয়ে কবি আহসান হাবীব হিসেবে স্বয়ম্প্রকাশিত।
সুতরাং ‘রাত্রিশেষ’-এর মূল্যায়নপ্রয়াস পুরোটাই অর্থহীনতায় পর্যবসিত হবে, যদি না তৎকালীন ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটি সামনে নিয়ে আসা হয়। সেটা হবে অসঙ্গত এবং অযৌক্তিকও। এখানে কাজেই রাত্রিশেষের গান শোনাবার আগে খতিয়ে দেখা দরকার আঁধারাধার সেই রাত্রির চারিত্র্যপট, যেখানে ঘাপটি মেরে ছিল নবপ্রভাতের রক্তিম সম্ভাবনা।
ছুঁয়ে দেখি সময়ের ত্বক
হিটলারের অট্টহাসি তখন কাঁপাচ্ছিল পৃথিবী। সে কম্পনের দোলা এসে লাগছিল ভারতবর্ষেও। ততদিনে নানাভাবে বিব্রত ব্রিটিশ ক্ষত্রিয়কুল যুগপৎ হতবিহ্বল ও মরিয়া। রাজনৈতিক আকাশে অশনি, ঘনঘটা। ১৯৪০-এ ফরোয়ার্ড ব্লকের আন্দোলনে ভারতীয় রাজনীতিতে জাগল অভূতপূর্ব এক চাঞ্চল্য। ব্রিটিশের রক্তচক্ষু নেতাজীর প্রতি কুপিত। কিন্তু চৌকষ ও লোকপ্রিয় নেতা সুভাষ বোস ব্রিটিশের আণুবীক্ষণিক-চোখকে ফাঁকি দিয়ে আফগানিস্তান হয়ে জার্মানিতে অন্তর্ধান করলেন। লাগল বাঙালি তারুণ্যে এক অসামান্য নাড়া।
‘৪১-এ ঘটল বাংলার সাহিত্যাকাশের অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ। চারদিক থেকে ধেয়ে আসা দুঃসময়ে এ বটবৃক্ষ নানাভাবে ছায়া বিস্তার করে ছিলেন ভারতবাসীর ওপর। তিনি নতুন করে প্রস্তুতও হচ্ছিলেন মানুষের পাশে দাঁড়াবার জন্যে। ফলে এ সময়ে এই ছায়াদায়ী বৃক্ষের বিলয় ব্যথিত করে তুলল বাঙালিমাত্রকেই।
‘৪১-‘৪২ জুড়ে জার্মান ও জাপানের হাতে দুর্দান্ত মার খাচ্ছিল ব্রিটিশ। কলকাতায় আমেরিকান সৈন্যের পদপাত, জাপানের বোমা। বোমাতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ। ক্রিপস মিশনে কংগ্রেসের সাথে ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের আলোচনা এবং তার ফলাফল ব্যর্থতায় পর্যবসিত। স্বদেশী খ্যাত মহাত্মাজীর অহিংস আন্দোলন রূপলাভ করল সহিংস ‘ভারত ছাড়ো’তে। মাতঙ্গিনী হাজরার বীরত্বপূর্ণ মৃত্যু। গান্ধীজীসহ ওয়ার্কিং কমিটির সকল সদস্য গ্রেফতার। ডাক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা, সরকারি অফিস ও থানা ব্যাপকভাবে আক্রমণের শিকার। বিহার, উত্তর প্রদেশ ও মেদিনীপুরের কোনো কোনো অংশে ইংরেজ শাসনের অস্তিত্ব বিলোপ। বামপন্থার সমর্থকদের নেতৃত্বে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গঠন ও ব্রিটিশবিরোধী ব্যাপক তৎপরতা।
যুদ্ধের প্রয়োজনে খাদ্যশস্যের ব্যাপক পাচারের ফলে ‘৪৩-এ ভারতবর্ষে নজীরবিহীন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বেসরকারি মতে ৩৫ লক্ষ লোকের অনাহারে মৃত্যু। ((ডঃ মধুসূদন চক্রবর্ত্তী : বাঙলাদেশের (পূর্ববঙ্গের) আধুনিক কবিতার ধারা (১৯৪১-১৯৭১), ১৯৮২, কলকাতা)) মতান্তরে ৫০ লক্ষ। ((সন্দীপ দত্ত : বাংলা কবিতার কালপঞ্জি ১৯২৭-১৯৮৯, ১৯৯৩, কলকাতা)) প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে শতসহস্র ছিন্নমূল মানুষের শহরমুখীনতা। নারীসমাজের ওপর বেদনাকরভাবে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব-পতন। অল্পবয়সী নিঃস্ব নারীদের বেশিরভাগেরই ব্যতিক্রমহীনভাবে দেহব্যবসার শিকারে পরিণত হওয়া। ‘কলকাতার ১ লক্ষ ২৫ হাজার নিঃস্বের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজারের স্থান হয়েছিলো পতিতালয়ে। এদের মধ্যে প্রতি চার জনের একজন ছিলো নাবালিকা।’ ((দারিদ্র্য ও পতিতাবৃত্তি, পিটার কাস্টার্স : তেভাগা অভ্যুত্থানে নারী,)) এ পরিণতি শুধু কলকাতায় সীমাবদ্ধ না-থেকে মেদিনীপুর, রংপুর, চট্টগ্রামেও সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ‘ম্যালেরিয়ার পরে যৌনরোগ হয়ে ওঠে বৃহত্তম জনস্বাস্থ্য সমস্যা।’ ((দারিদ্র্য ও পতিতাবৃত্তি, পিটার কাস্টার্স : তেভাগা অভ্যুত্থানে নারী,)) পাশাপাশি ভারতবর্ষ জুড়ে ভয়াবহ বস্ত্র-সংকট। শতচ্ছিন্ন বস্ত্রাচ্ছাদিত পাঁচ হাজার নারীর এক ভুখামিছিলের আইনসভা ভবনের সামনে জমায়েত। ((জাগ্রত নারীসমাজ : এসেম্বলীর পথে ভুখা মিছিল, পিটার কাস্টার্স : তেভাগা অভ্যুত্থানে নারী,)) কলকাতায় জাপানি বোমারু বিমান থেকে মারণাঘাত।
‘৪৪-এ আবার বোমা।
‘৪৫-এ হিটলারের আত্মহত্যা। জাপানের হিরোশিমা, নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমার ধ্বংসযজ্ঞের পর যুদ্ধাবসান। আজাদ-হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবিতে উদ্বেল আন্দোলন। মিছিল। গুলি। রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক ছাত্রের মৃত্যু। ময়মনসিংহে হাজং বিদ্রোহ।
‘৪৬-এ নৌ-বিদ্রোহ। রক্তপাত। আন্দোলনকামীদের পরাজয়। ফসলের ন্যায্য ভাগ প্রাপ্তির দাবিতে খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে কৃষক আন্দোলনের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত। তেভাগা, নানকার, তেলেঙ্গানায় নিম্নবিত্তের অন্যরকম জেগে ওঠা। ‘১৯টি জেলার ৬০ লক্ষ মানুষের কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণ।’ ((আন্দোলনের সূত্রপাত, পিটার কাস্টার্স : তেভাগা অভ্যুত্থানে নারী,)) অজস্র শহীদ। ব্রিটিশদের ইন্ধনে ভারতে সম্প্রদায়গত বিভেদ। মানুষ কিংবা দেশের চেয়ে ধর্মের বড়ো হয়ে ওঠা। প্রধান শত্রু ইংরেজ রইল আড়ালে। হিন্দুর শত্রু প্রতিপন্ন হয়ে উঠল মুসলমান, মুসলমানের হিন্দু। ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-তে কলকাতায় সংঘটিত ভয়াবহ দাঙ্গায় মুসলমান পান করল হিন্দুর রক্ত, হিন্দু মুসলমানের। নিহত হলো ৫০০০, আহত ১০০০০। ((সন্দীপ দত্ত : বাংলা কবিতার কালপঞ্জি ১৯২৭-১৯৮৯, ১৯৯৩, কলকাতা)) কলকাতা ছাড়িয়ে তার জবাবে নোয়াখালী, বিহার, গড়মুক্তেশ্বরেও ঝরল উভয়পক্ষের রক্ত। শুভবুদ্ধি হলো অন্তর্হিত।
‘৪৭-এ ধর্মভিত্তিক এক বিভাজনে লর্ড মাউন্টব্যাটেন দু’খণ্ডে কর্তন করলেন ভারতবর্ষকে। যার ডাকনাম হলো স্বাধীনতা।
–এই আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা ‘রাত্রিশেষ’ পর্বে আহসান হাবীবের দৈনন্দিনের সঙ্গী। ১৯৩৬ থেকে শুরু করে এ সময়ের পুরোটাই তিনি কলকাতায় অতিবাহিত করছেন। চাকুরি করছেন দৈনিক তকবীর, দৈনিক আজাদ, মাসিক বুলবুল, মাসিক সওগাত, শিশু সওগাত, দৈনিক কৃষক এবং ‘৪৩ থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট ও একই সঙ্গে দৈনিক ইত্তেহাদের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। ((আহমদ রফিক : আহসান হাবীব রচনাবলী (১ম খণ্ড), ১৯৯৫, ঢাকা)) একজন সাংবাদিকের এসব ঘটনা পরম্পরার কোনোটাই অজ্ঞাত থাকবার কথা নয়। এছাড়াও একজন কবির প্রস্তুতিপর্বে, তাঁর বেড়ে ওঠার কালপরিসরে যেসব বড়ো বড়ো উত্থান-পতন সংঘটিত হয়– তা-ও কবিচিত্তে রেখে যায় অনিবার্য ছাপ। সুতরাং তাঁর (কবির) আত্মপ্রকাশের যে সময়, তার বাইরে নিকট অতীতের ঘটনাবলিও এক্ষেত্রে গুরুত্ববহ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাক্রম ১৯২৮-এ ৫০৬৮৫১ জন ((সন্দীপ দত্ত : বাংলা কবিতার কালপঞ্জি ১৯২৭-১৯৮৯, ১৯৯৩, কলকাতা)) শ্রমিকের অংশগ্রহণে সংঘটিত শ্রমিক ধর্মঘট, বিলাতি দ্রব্যাদি বর্জন আন্দোলন। ‘৩০-এ সত্যাগ্রহ, লবণ আইন অমান্যকরণ আন্দোলন ও মাস্টার দা সূর্যসেনের নেতৃত্বে পরিচালিত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এবং জালালাবাদ পাহাড়ের আক্রমণ, ‘৩১-এ শ্রমিক ধর্মঘট, ‘৩২-এ ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্মোৎসর্গ, দিনাজপুরে সাঁওতাল বিদ্রোহ। ‘৩৪-এ সূর্যসেন ও তারকেশ্বরের ফাঁসি কার্যকর। ‘৩৫-এ ইউরোপে শিল্পী সাহিত্যিকদের ফ্যাসিবাদ বিরোধী সম্মেলন। ‘৩৭-এ মণিসিংয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত টঙ্ক আন্দোলন এবং পাট ও সূতাকলের শ্রমিকদের ধর্মঘট। ‘৩৮-এ চট ও ইস্পাতকল শ্রমিকদের ধর্মঘট ইত্যাদি।
মোটাদাগে মোটাভাগে
‘রাত্রিশেষ’-এর প্রায় সব কবিতাই ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৬ সময় পরিসরে রচিত। ((দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ, আহসান হাবীব : রাত্রিশেষ, ১৩৬২, ঢাকা)) সুতরাং উপরোল্লিখিত ঘটনাপরম্পরা এ কবিকে ছুঁয়ে গেছে এরকম মনে করাই সংগত। অর্থাৎ কিনা আমরা ধরে নিতে চাই এ কবিও সময় ও সমাজ কর্তৃক তাড়িত হয়েছেন। এখানে আরেকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, চল্লিশ দশকে সমাজ-সচেতনতার নিরিখে কবিতা-বিচার করার প্রবণতাটি প্রায় রেওয়াজে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু এ দশকে কবিতা লিখছেন এমন কবিদের মধ্যে নরেশ গুহ, অরুণকুমার সরকার, বিশ্ব বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখকে ছাড়া সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, দিনেশ দাশ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায়, রাম বসু, সিকানদার আবু জাফর, আবুল হোসেন, ফররুখ আহমদ (পরবর্তীসময়ে কাব্যদর্শনের ব্যাপক রদ), আহসান হাবীব, জগন্নাথ চক্রবর্তী, সানাউল হক, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিরীন্দ্র মৈত্র, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, রামেন্দ্র দেশমুখ্য, মৃগাঙ্ক রায়, সিদ্ধেশ্বর সেন, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় (পরবর্তীসময়ে সমালোচক হিসেবে খ্যাত), সৈয়দ নূরুদ্দীন, গোলাম কুদ্দুস, অসীম রায় (পরবর্তীসময়ে ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাত) প্রমুখ কবিগণ তাঁদের কবিতায় সমাজভাবনার রূপায়ণে আত্মনিবিষ্ট ছিলেন। ((ব্যক্তিগত মনীষায় জাতীয় মানস, আবদুল মান্নান সৈয়দ : অপ্রকাশিত)) ফলে কাব্যবিচারের এই প্রবণতাও সিদ্ধ ও যৌক্তিক পরিগণ্য হতে পারে। একজন কবি সমালোচিত হবার জন্যে লেখেন না বটে, কিন্তু সম-সময়ের প্রথাকে পুরোপুরি উপেক্ষাও তিনি করতে পারেন না বললে মোটেই অসত্য বলা হয় না বোধকরি। আহসান হাবীবের সমাজভাবনার উৎস সন্ধানে নিম্নোদ্ধৃত মন্তব্যত্রয়ের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। সৈয়দ আলী আহসানের মতে, ‘সে সময়কার [৪০ দশকের] অসহায় মানুষকে নিয়ে লেখা [আহসান হাবীবের] কোনোও কোনোও কবিতায় মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সামান্য আভাস পাওয়া যায় কিন্তু উক্ত দৃষ্টিভঙ্গি তৎকালীন কাব্যপ্রথার সমর্থনে এসেছে, প্রবল কোনোও বিশ্বাসের অন্তঃসার হিসেবে প্রকাশিত হয়নি।’ ((সৈয়দ আলী আহসান : আধুনিক বাংলা কবিতা : শব্দের অনুষঙ্গে, ১৯৯৩, ঢাকা)) তুষার দাশ নিশ্চিত জানান দেন, ‘ব্যক্তিগত জীবনে বাঁচার সংগ্রামও যে তাঁকে উদ্ধুদ্ধ করেছিলো সমাজ-সময়-সভ্যতা সম্পর্কে সচেতন হ’তে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।’ ((আহসান হাবীবের প্রেমের কবিতা, তুষার দাশ : সাহিত্যপত্র, ১৯৮৫, ঢাকা)) সাজ্জাদ শরিফ সিদ্ধান্ত দেন, ‘তাঁর সমাজ-চৈতন্য রাজনীতির পথ ধরে আসেনি কবিতায়, এসেছে ব্যাপ্ত জনস্থলির সাথে একাত্মতার উৎকাঙ্ক্ষা ও তার সংবেদনার পরিপ্রেক্ষণরূপে।’ ((বিদীর্ণ দর্পণে মুখ, সাজ্জাদ শরিফ : অধুনা, ১৯৮৬, ঢাকা)) অর্থাৎ ‘তৎকালীন কাব্যপ্রথার সমর্থন’, ‘বেঁচে থাকার সংগ্রাম’ এবং ‘ব্যাপ্ত জনস্থলির সাথে একাত্মতার উৎকাঙ্ক্ষা’ থেকেই তাঁর সমাজমুখীনতা, তিনি নিজে সমাজবাদী বলে নন। এ প্রতীতীর সঠিকতা অসঠিকতা সম্পর্কে, কবিতা বিশ্লেষণক্রমে পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আমরা নিশ্চিত হবো।
এবার তবে গহনে সাঁতার
গুণি উদ্বিগ্ন প্রহর
যুগের চিতায় দগ্ধ বিকলপক্ষ পাখির চোখে পঙ্গুতার রাত নেমে এলেও উড্ডয়নাকাঙ্ক্ষা তাক করে থাকে দিবালোকের দিকে। এরকম বিরূপ সময়কালে নীড় বাঁধতে হয় ভস্মস্তূপেই– কারণ স্বপ্নের ছায়া আজও বেঁচে আছে মরীচিকাময় হলেও। জাগে দূর অতীত, নারীরূপী গীতরসধারা। ভালোবাসার সুর-প্রস্রবনে লুকিয়ে থাকা দহনের তৃষা– অনেকানেক মেঘ, রজনী, চাঁদ ডিঙিয়ে ঝরে গেছে। মরে গেছে বাসনা-ব্যঞ্জনা। সব পর্যবসিত তাই ফাঁকিতে। কিন্তু তবু, সে নারী– সে মৃত্তিকা মাধুর্যময়ী। বন্ধন আর বঞ্চনা পাশাপাশি ফলে বলে ভস্মস্তূপে মণ্ডিত এ মৃত্তিকাকেই আপাতত ঠিকানা করতে হয়। আর তখন কাশ্মিরী মেয়ের কাছে কিছু আলো চাওয়াও অপরাধ মনে হয় না। কিন্তু এ এমন এক কাল যে, মেয়ে হয়েও তার সাপের মতো চোখ, ধারালো দাঁত, বিষময় দৃষ্টি। মৃত্যুতুহীন কত দীর্ঘ হবে তবে এ বিরহ ও জঠরাগ্নির শিখা? এসব ক্লেদে পুড়ে পুড়েই তবু ভীষণরকম বাঁচা। আকাশ দেয় না কোনো বন্ধুতার ছায়া, আশ্রয়– গতিতে নেমে আসে যতি। ভাঙা ডানাই হয় ভরসা। দাঁত খিচিয়ে ব্যঙ্গ করে দুর্বোধ্য সময়– প্রেম নেই কোথাও, শুধু বণিকবৃত্তি। কুকুরতুল্য এক ধীকৃত-যাপন। তবু, কেউ একজন বাদ্শাযাদীর আগমন আশায় কতরকম স্বপ্নই না চাড়া দিয়ে ওঠে মনে। স্বপ্ন দেখায় কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। হোক কেউ হারু মিয়ার বস্তিবাসী বিড়ি-বাঁধা কামলা। প্রোলেটারিয়ানদের কীসের নিষেধাজ্ঞা, লজ্জাই বা কীসের– যেখানে উলঙ্গ বক্ষের ওপর দিয়ে দাবড়িয়ে চলে যায় আরবীয় ঘোড়া? যাদের চকচকে সোনার ঘড়ি, উঁচু অট্টালিকা, তাদের সাথে বন্ধকী জীবনধারীদের একটি সেতু রচনার ভাবনাও আপোষকামী মস্তিষ্কে জাগে ক্লান্তিকর অবসরে। যেই স্বপ্নসেতু প্রণোদিত করতে পারে আকাশে নীড় বাঁধবার জন্যে– কোনো চাঁপাফোটা চৈত্রে। জেগে ওঠা আদিম বাসনা নিয়ে এসেছে যে হাওয়ার বারতা, অন্ধগভীর রাত্রিতেও তো সে হাওয়া আড়াল-আলোর কামনা জাগিয়ে তুলতেই পারে– যদিও ভিখারির মুরোদ ভিক্ষাদানে নিহিত নেই, থাকবার কথা নয়। একটি রেনকোটের ইচ্ছাও তবু দুর্মর হয়, হতে পারে। কিন্তু রোমান্টিক এই স্বপ্নই সব নয় মানুষের, তার চেয়েও বড়ো হয় ক্ষুধা। লাগাতার জঠরোত্তাপ সংগ্রামী করে তুলে ধুম্রবরণ দগ্ধদিনের বাসিন্দাদের, লজ্জাহীন চাতুরী আর অভিনয়ের বিরুদ্ধে। হায়, অসাম্য তবু দীর্ঘজীবী হয়! ব্যর্থ হয় সব মুক্তির উড়াল। নেমে আসে স্বপ্ন দেখায়ও ক্লান্তি। আহ অপঘাত, ভ্রান্ত-প্রহর!
প্রান্তিক অবসরে
কতদিন এসেছে, গেছে। সেসব দিনই চাপিয়ে দিয়ে গেছে এই উপনিবেশের জগদ্দল। এই ভার থেকে বাইরে বেরুনোর জন্যেই না নানারঙ স্বপ্ন বোনা, যদিও মঞ্জিল জানা নেই। আর এর মধ্যে বাইশে শ্রাবণ জুড়ে মৃত্যু নেমে আসে। যে-মৃত্যু, গৌরবে বেঁচে থাকবার জন্য জোগায় আরো আরো প্রেরণা। এ মৃত্যুবীজ নবদিনের জন্মের সম্ভাবনা নিয়ে মাটিতে ঘুমাবে। অস্তপারের আকাশকেও তাই জানিয়ে রাখা যায় প্রণতি। কেননা দুই শতাব্দীর গ্লানি চোখ ভরা– জল্লাদ মীরনের তীক্ষ্ণ তলোয়ারের ঝলসানি– ঘৃণা। হায় সিরাজ, হায় সিরাজ! প্রান্তর ব্যাপে ধ্বনিত হয়ে ওঠে ব্যাপ্ত হাহাকার।
ক্ষীণতর প্রাতিভাসিকতা
দামামা বিশ্বযুদ্ধের। জঙ্গি বিমান-বোমা-বেয়নেট। রক্তের স্রোত স্বপ্নহীন করে দিয়েছে সুবর্ণ আগামীকে। শরতের দশমী রাত তাই ঝরায় কেবল আঁখিজল। হায় বেদনা– একদিকে মনুষ্যনিধনে কামান দাগিয়ে মানুষ ব্যয় করে অঢেল অর্থ– অন্যদিকে দেহের বিন্দুবিন্দু ঘাম ঝরিয়ে, ক্ষয় মেনে নিয়ে বারোজন একসেরে আধপেটা খেয়ে বাঁচার মহড়া। যারা অপরের রক্তপান করতে সঙ্গীন উঁচু করে দণ্ডায়মান; তাদের চেয়ে এরা আরো বড়ো যোদ্ধা বৈকি! কিন্তু বঞ্চনা তো পদে পদে সমাসীন। না, এ ক্ষুধা ও যুদ্ধনগরী রেখে বরং পঁচিশ বছর পূর্বের পিরোজপুরে বেড়িয়ে আসা ভালো, শঙ্করপাশা গ্রামে– মধুমতি তীরে, হোক তা মনে মনে। না-থাকুক আজ সেখানে ঘুঘুর অশান্ত ডাক, ঘাসের গালিচা। সবুজ মাঠ তবু আছে, আছে কাজেম বয়াতীর গৃহ, দফাদার বাড়ি। নাই যদিও রাতভর লোকপালা-জাগা, বাঁশির ভাটিয়ালী। বদলে গেছে দিন। যারা সে-সময়ে মক্তবে পাঠ মকশো করত, তারা আজ কাটা চামচের ঝনঝন তোলে, মাথা বেচে দিয়ে বাঁচায় প্রাণ। কিন্তু ভয় এখানেও; কারণ, মৌমাছির গুঞ্জন নয়, আকাশ থেকে নিক্ষেপণযোগ্য বোমার আতঙ্ক গ্রামেও পরিব্যাপ্ত। গ্রাম নয় যেন ওটা, গ্রামের লাশ। ফিরে আসা কলকাতায়। ওয়েলিংটন স্কোয়ারে, এসপ্লানেডের মোড়ে মোড়ে ক্রূর হাসির শুধুই চাবুক। বিগত হয়ে যাওয়া শত প্রাণ, শত মমি কাঁদে। সরীসৃপের মতো হন্তারক ঘুরে বেড়ায়। হাজারো মৃত-আত্মার পাহারায় হাতে মশাল নিয়ে নতুন দিনের সন্ধানে তাই যাত্রাপাত। অনাগত সেই সূর্য-পরিক্রম দিনের জন্যেই তো এই বেঁচে থাকা।
নবতার দিকে দৃপ্ত পদক্ষেপ
মৃত্যুমুখী দিনের সীমায় আরো কতবারই যে নতুন দিনের জন্যে অপেক্ষা করেছে মানুষ। আবারও তবে অপেক্ষা। একাধটু সম্ভাবনা তো ঝিলিক দিয়েও উঠছে। যদিও বারবার ঝড় আসে, বারবার ভূলুণ্ঠিত হয় কামনা-বাসনা। মানুষ তবু নির্লজ্জের মতো আবারও আশায় মাতে। তার চেয়ে বরং এই ভালো, পলাশরূপী ঝরা বাসনারা এসে ইস্পাত কঠিন দিন রচনার সমস্ত ভার ছিন্ন করে দিক। কত কিছুই তো ছিল আমাদের। রুপালি জোয়ারে ভাসা সমুদ্র, দূর বনানীর ছায়া। সেসব রচিত ছিল যাদের স্বপ্নসূতোয়– আজ তারা নেই, দুর্বিষহ দিনের সৈনিক তারা আজ স্মরণনির্ভর। আগামী প্রজন্ম যদি বিগত সব স্বপ্নের ওপর বাঁধে ঘর– তাদের প্রতিও রেখে যেতে হবে সমর্থন। চাওয়াপাওয়া তো অশেষ। সকল প্রাপ্তির শেষেই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে নব-নব প্রয়োজন। তারারা আবার পার হয়ে আসে যুগের বেড়ী, আবারও উজ্জ্বল হয় পরীদের চোখ। সীমান্ত ঘিরে বিরোধ নেমে আসে আবারও। ফলে সুর নয়– বিদ্রোহী হুঙ্কারই প্রাসঙ্গিক। কোনো বাঁশি নয়, অসিই প্রার্থিত। অহিংসা-মন্ত্র পিছে থাক, এবার হিংস্র প্রতিরোধ। মৃত্যু দলিত হোক বাঁচার পণের কাছে। ছলচাতুরীর আড়ালে ফণা ধরে থাকা কেউটের প্রতি কোনো সহমর্মিতা নেই। আগুন হয়ে কাজেই জ্বলে ওঠা, রাজপথ প্রকম্পিত করে দিয়ে। জনতার মনের আগুন সহজে নেভে না। ক্ষমাহীন এ আগুনের জোয়ার হানা দেবে একদিন সিংহ দরোজায়। রাজপথে হাজার জনতার সাথে শামিল হবে আরো আরো হাত। দিনে দিনে জমিয়ে তোলা দুর্বহ পাপের বোঝা লঘু করবার পণে আজ এই গণরোষ। এই মানববন্ধন। মৃত্যু আসে নেমে। কিন্তু সব মৃত্যু মরে যাওয়া তো নয়। কেননা ‘মানুষ মরে গেলে তবুও মানব থেকে যায়…’। ঘরে ঘরে রেখে যায় জীবনের উন্মাদনা। এই উন্মাদনা, মৃত্যুহীন মানবের নাম-ধাম, নির্ভিক নবীনকে করে তোলে বহ্নিমান। আর এই বহ্নিই রাতের পাহাড় থেকে খসিয়ে দেয় পাথরের মতো অন্ধকার– যে অন্ধকার গোটা ভারত জুড়ে দু’শো বছর শুয়ে ছিল অতিকায় সাপের মতোন। রেড রোডে ঝলসে ওঠে উদয়াচল। বাজে নতুন দিনের ঘণ্টা।
সেই তো আমার আলো
গহন এই সন্তরণলীলা সমাপনান্তে বিস্তর ঝিনুক আমরা আহরণ করেছি বলে ভ্রমাকুল। সেসব আদৌ সত্য ঝিনুক, নাকি ঝিনুকের ছদ্মপোশাকে সমুদয় মৃত কঙ্কর, তা এখন মিলিয়ে দেখবার প্রয়াস নিতে পারি। যদি ভ্রম হয়, অচিরাৎ শুধরে নেবার কাজে হবো যত্নবান। এজন্যে আমাদের প্রবেশ করতে হবে তিমিরাকুল দীর্ঘ রাত্রির গভীরে। রাত্রির পথ যে দুর্গম সে অভিজ্ঞতা আমরা ইতঃপূর্বে অর্জন করেছি। সুতরাং হাতে থাকুক দশাসই একটা লণ্ঠন; আর পথের বন্ধুরতা থেকে বাঁচতে একটি আশাও সঙ্গে থাকতে পারে। সাপখোপ পেলে নির্মোহ আঘাত যেন হানতে পারি। নইলে তার বিষ ছোবলে যদি প্রাণ যায়, দায় নেবে কে? আমরা তো শুধু আমাদেরই নই। আগামীতে আছে আমাদের লাখো উত্তরারিকার। ফলে আমাদের সচেতন নিষ্ঠার জায়গা থেকে আমরা যদি এক আধবার চ্যুতও হই– ধরে নিতে হবে তা পা পিছলে যাবার কারণে, অমনোযোগিতার কারণে নয়।
তাঁর পরবর্তী গ্রন্থগুলোতে আহসান হাবীব পরিণতির নানা পর্যায়ে আরোহণ অথবা অবরোহণ করেছেন (এ সম্পর্কে এ প্রবন্ধপ্রয়াসে কোনো মন্তব্য করা হবে না), তবে ‘রাত্রিশেষ’ গ্রন্থে ‘তৎকালীন সামাজিক ও রাষ্ট্রিক পরিবেশে একজন সচেতন কবিকে [কবির] যতোটুকু সামাজিক দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজন ছিলো, আহসান হাবীব তা পরিপূর্ণভাবে পালন করেছেন।’ ((হোসেনউদ্দীন হোসেন : ঐতিহ্য আধুনিকতা ও আহসান হাবীব, ১৯৯৪, ঢাকা)) তো, সে দায়িত্ব পালনে তিনি কীভাবে নিয়োজিত হয়েছিলেন, এবার সেটা একটু কাছে থেকে দেখবার চেষ্টা করা যাক।
১.
তোমার আমার দিন ফুরায়েছে যুগটাই নাকি বৈপ্লবিক–
গানের পাখিরা নাম সই করে নীচে লিখে দেয় রাজনীতিক
থাকতে কি চাও নির্বিরোধ?
রক্তেই হবে সে ঋণ শোধ
নীড় প্রলোভন নিরাপদ নয় বোমারু বিমান আকস্মিক
আহত গান এইখানে শেষ আজকে আহত সুরের পিক।
আজকের কবিতা, প্রহর)
২.
প্রত্যয়ের দিন নাই, প্রতিশ্রুতি বিদ্রূপ-বিক্ষত
আশা ও আশ্বাস নাই, প্রেম হেথা স্বভাব বণিক;
নির্মাংশ অস্থির পাশে ভীড় করি কুকুরের মতো,
দীর্ঘদিন বাঁচি মোরা জীবনেরে নিত্য দিয়া ধিক!
(দ্বীপান্তর, প্রহর)
৩.
ক্ষুধার অনল চির লেলিহান জ্বলে অশান্ত বায়
সংগ্রাম জাগে মানুষের পায় পায়
……………………………………………
হেথায় শ্যামল ঘন অরণ্যে সূর্যের অভিশাপ
পুষ্পিত শাখে জ্বলে নির্মম জঠরের উত্তাপ
(দিনের সুর, প্রহর)
৪.
একটি সে মৃত্যু এসে দিয়ে গেলো তারে
লক্ষ লক্ষ মানুষের সিক্তপক্ষ আঁখির প্রসাদ
অশ্রুসিক্ত বন্ধনের স্বাদ।
বাইশে শ্রাবণ সে ঊর্ধ্বে তুলি সে মৃত্যুর মসিলিপ্ত কর
রেখে গেলো পৃথিবীতে চিরন্তন অক্ষয় স্বাক্ষর।
(বাইশে শ্রাবণ, প্রান্তিক)
৫.
এবার শরৎ রাত্রে পানপাত্রে মানুষের খুন;
আসিতেছে উড়ন্ত আগুন …
এবার শরৎ রাত্রে শ্যাম শষ্পে হানিয়া চরণ,
রক্তপায়ী প্রেতসম ক্রূর হাস্যে নাচিবে মরণ!
স্তব্ধ রবে বনতল হাতে রবে বাঁশরী নিরেট,
চারিদিকে উঁচু হ’য়ে ঝলকিবে তীক্ষ্ণ বেয়নেট।
(শরৎ, প্রতিভাস)
৬.
পাহাড়ের তট ভাঙে
আর ভাঙে হৃদয়ের তীর,
আবার উধাও পাখা সেই সব পুরনো পাখির।
তারপর হে আকাশ হে অরণ্য
আবার বিরোধ
আবার সীমান্ত ঘিরে সেই প্রতিরোধ
(হে আকাশ হে অরণ্য, পদক্ষেপ)
৭.
আরণ্য-স্বপন নয়
এবার আরণ্য প্রতিরোধ
নির্বিরোধ গুহাতলে
অহিংসার গৌরব নিঃশেষ
বহুকাল–
(হে বাঁশরি অসি হও, পদক্ষেপ)
৮.
আজ হতে
দুর্বহ পাপের বোঝা দিনে দিনে লঘু করিবার
প্রতিজ্ঞা আমার!
তোমাদের অনশনে আজ হতে আমি নিত্যসাথী
আমাকেও ঘিরে রবে তোমাদের নিদ্রাহীন রাতি।
(স্বাক্ষর, পদক্ষেপ)
৯.
খানিকটা স্থির হয়ে সে থাকবে
তারপর সে চমকাবে
কাঁপবে
কেঁপে কেঁপে উঠে আসবে উপরে
ঝরাবে তার সোনা
ছড়াবে এই এখানে
এই রেড রোডের মরচে ধরা ঘাসে।
সকাল বেলার হাওয়ায় লাগবে জোর
পুরনো ধূলোরা এবার উড়বে।
(রেড্ রোড রাত্রিশেষ, পদপেক্ষ)
এখানে প্রথমোক্ত উদ্ধৃতিটিতে খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন কলকাতার শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থির পরিবেশ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় উদ্ধৃতি দুর্ভিক্ষকালীন। খাদ্যের জন্যে আস্তাকুড়ে কুকুরের সঙ্গে অস্থি নিয়ে মানুষের টানা হ্যাচড়া করবার চিত্র পরিস্ফুট একটিতে। পরের চিত্রটি নিরন্ন মানুষের ক্ষিপ্ত ও মরিয়া হয়ে খাদ্য গুদামের দিকে ধেয়ে যাবার ইঙ্গিত যেন। চতুর্থ চিত্রটি রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের। ভারতবাসী লক্ষ লক্ষ বাঙালির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল এটি সিক্ত বর্ণমালায় আঁকা তারই শব্দরূপ। পঞ্চম উদ্ধৃতিটিতে ধরা পড়েছে যুদ্ধকালীন বাস্তবতায় স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের করুণ পরিণতির ছবি। ষষ্ঠ উদ্ধৃতিটি ভারতবাসীর স্বাধীনতার-কাঙ্ক্ষাকে নিয়ে ব্রিটিশদের যে টালবাহানা, প্রবঞ্চনা, তার বাণীচিত্র ধারণ করতে চেয়েছে। সপ্তম উদ্ধৃতিটি অহিংস আন্দোলনের বদলে হিংস্র ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের রূপরেখাসন্নিষ্ঠ। অষ্টম উদ্ধৃতিটি স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের মিছিল, মিটিং, অনশনের সাথে কবির একাত্মতা ঘোষণার বাণীবহ। আর নবম উদ্ধৃতি ধারণ করেছে সেই স্বপ্নাদ্য চিত্রকল্প– যেভাবে ভারতবর্ষে পূর্বঘোষিত স্বাধীনতার সোনালি সূর্যটি উদিত হয়ে আসবে এবং ক্রমে দূর হয়ে যাবে পরাধীনতার সব পঙ্কিল আবরণ। হবে আঁধারের অবসান, রাত্রিশেষ।
ব্যক্তিগত টীকাভাষ্য
সময় ও সমাজসম্পৃক্তির এই যে চিত্র আমরা ‘রাত্রিশেষ’ গ্রন্থে প্রাপ্ত হলাম; এর প্রেক্ষিতে আমাদের সিদ্ধান্ত এরকম যে, তা অনেকটাই খণ্ডিত। যে সময়ে ‘রাত্রিশেষ’-এর কবিতাবলি লিখিত হচ্ছে, আগেই উল্লিখিত হয়েছে তখন ভারতবর্ষের ১৯টি জেলার ৬০ লক্ষ খেটে খাওয়া মানুষ তাদের ফসলের ন্যায্যতা নিয়ে আন্দোলনে মত্ত। অজস্র বিপ্লবী হত। হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারী প্রতিনিয়ত তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে হরতাল ধর্মঘট করছে ও নিহত হচ্ছে। হাজার হাজার কিশোরী যুবতী পেটের দায়ে দেহ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় কলকাতাসহ প্রায় গোটা দেশে রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে– আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করি, এসব ঘটনা ‘রাত্রিশেষ’-এর কবিকে মোটেই তাড়িত করছে না। অন্যদিকে গভীরতররূপে সমাজকে আঁকতে তিনি নিলেন গল্পগন্ধী কবিতা এবং ব্যঙ্গ কবিতার আশ্রয়, যেখানে স্বভাবতই কবি নিবিষ্ট নন, আত্মজ প্রতিফলন যেটা নয়– দৃষ্টিভঙ্গি ও দেখাটাই যেখানে প্রধান। –‘কাশ্মিরী মেয়েটি’, ‘সৈনিক’, ‘রেনকোট’, ‘একটি ঐতিহাসিক ভ্রমণ’, কোন এক বাদশা’যাদীর প্রতি’… এই উক্তির পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। ((হাসান হাফিজুর রহমান : আধুনিক কবি ও কবিতা, ১৯৭৩, ঢাকা))
চল্লিশের সামাজিক-রাজনৈতিক অত্যুজ্জ্বল একাধিক বিষয়সম্পৃক্তির অনুপস্থিতিজনিত দীনতার পক্ষ সমর্থনের একটি সুযোগ অবশ্য থাকে। যেটি কবির হয়ে তুষার দাশ বলে দিয়েছেন, ‘সৎ লেখক কখনোই অভিজ্ঞতার বাইরে খুব একটা পদচারণা করতে পারেন না।’ ((আহসান হাবীবের প্রেমের কবিতা : তুষার দাশ, সাহিত্যপত্র, ১৯৮৫, ঢাকা)) কিন্তু অভিজ্ঞতা বলতে আমরা যা বুঝি, তাতে তো মনে হয় তাঁর (আহসান হাবীবের) অভিজ্ঞতার মধ্যে এসব ঘটনার থাকবারই কথা। যদি তিনি প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকেই অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখে থাকেন, তবে সে সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করবার জন্যে গঙ্গার জলে প্রাণবিসর্জনকারী গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কিত গৌতম ভট্টাচার্যের নেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তাঁর আবাল্য বন্ধু কণ্ঠশিল্পী মান্না দে’র এ বিষয়ক মন্তব্যসার উঠিয়ে আনা যেতে পারে। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গীতিকার জীবনে প্রচুর সার্থক ও জনপ্রিয় বিরহের গান লিখেছেন। প্রশ্নকর্তা এ তথ্য উল্লেখপূর্বক মান্না দের কাছে জানতে চাচ্ছেন, পুলক বাবুর ব্যক্তিগত জীবনে এরকম বিরহের ঘটনা ঘটেছিল কি না। উত্তরে মান্না দে অনেকটা ক্ষেপে গিয়ে জানাচ্ছেন যে, ‘নিজের অভিজ্ঞতায় না থাকলে তা রূপায়ণ সম্ভব নয়, এটি একটি বাজে কথা। যিনি প্রকৃত শিল্পী তিনি সব পারেন। নইলে মৃত্যুর সিনে অভিনয়ের আগে শিল্পীর মরার অভিজ্ঞতা অর্জন করবার দরকার হতো।’ বোঝাই যাচ্ছে যে এখানে অভিজ্ঞতাকে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ হিসেবেই বোঝানো হচ্ছে। তদুপরি মান্না দে’র এ মন্তব্যটি যদি আড়াল করবার মানসিকতাপ্রসূত হওয়ার কারণে অসত্যও হয়, অর্থাৎ অভিজ্ঞতাকেই যদি শিল্পসৃষ্টির অবশ্য প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত ভাবি– তবু এ কথা সম্ভবত বলা যায় যে, অভিজ্ঞতা কেবল সশরীরে অংশগ্রহণের ভিতর দিয়েই অর্জিত হয় না। অভিজ্ঞতা অর্জনের আরো আরো বিকল্প পন্থা রয়ে যায়। তা নইলে এ প্রশ্নও তো উত্থাপন করা যায় যে, আহসান হাবীব কি ১৭৫৭ সালে জীবিত ছিলেন? অভিজ্ঞতার বাইরে তবে ‘সেতু-শতক’ তিনি লিখলেন কী প্রকারে? নিশ্চয়ই কবি নিজে অস্ত্র হাতে নেন নি, কিংবা জেটিতে চাকুরি করেন নি, তবে যে তিনি ‘সৈনিক’ কবিতা লিখলেন? আমরা জানি আহসান হাবীব রাজনীতির প্রতি ছিলেন নিরাসক্ত উদাসীন। ‘তাঁর নিশ্চিত নির্লিপ্ততার কারণে তাঁকে প্রায় চেনা যেত না।’ ((সৈয়দ আলী আহসান : আধুনিক বাংলা কবিতা : শব্দের অনুষঙ্গে, ১৯৯৩, ঢাকা)) তবে ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতিসংশ্লিষ্ট এত কবিতা এই কবির হাত থেকে বেরোল কী করে? এক্ষেত্রে কি আমরা কবি বা কবিতাকে অসৎ বলতে যাব? আহসান হাবীব নিজেও অভিজ্ঞতা বিষয়ে নির্মন্তব্য নন। তার মতে ‘…আমরা যাকে বলি অভিজ্ঞতা, আসলে স্মৃতি– সেই জমানো স্মৃতি বা অভিজ্ঞতাই কবির কবিতায় ছবির মতো ভেসে উঠতে থাকে।’ ((কবিতার শৈশব, আহসান হাবীব : আহসান হাবীব রচনাবলি (২য় খণ্ড), অপ্রকাশিত)) এ প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, ত্রিশ-চল্লিশ দশকীয় ওইসব রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনাবলি আহসান হাবীবকে মোটেই আলোড়িত করে নি– আর করে নি বলেই, সেগুলো তাঁর স্মৃতিতে জায়গা করে নিতে পারে নি। তা নইলে সেসব তাঁর কবিতায় ছবির মতো ভেসে উঠতে পারত।
একজন কবিকে সকল বিষয় সমানভাবে তাড়িত করবে এর কোনো সংগত কারণ নেই। একেক কবির মানস গঠন একেকরকম। চল্লিশের কবি দিনেশ দাশ, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়কে যা স্পর্শ করেছে, অরুণকুমার সরকারকে তা করে নি। এটাই স্বাভাবিক। তবু এটুকু বাখোয়াজি এখানে আমরা এটা প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে করেছি যে, আহসান হাবীব সময় ও সমাজসচেতন কবি বটেন কিন্তু সমাজবাদী কবি নন। ‘আহসান হাবীব নিহিলিস্ট বা নিঃসংশয় শূন্যবাদী নন, আশাবাদীও নন। অবচেতনার তিরষ্কার তাঁর মধ্যে নেই, প্রেম অথবা মৃত্যুর কবি তিনি নন, মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদ তাঁর চৈতন্যকে আলোড়িত করে নি। তিনি আপন সরলতায় নিমজ্জমান অস্তিত্বের একান্ত সত্যের মৃদু কম্পন, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত স্বভাবকে কাব্যে রূপ দিয়েছেন।’ ((সৈয়দ আলী আহসান : আধুনিক বাংলা কবিতা : শব্দের অনুষঙ্গে, ১৯৯৩, ঢাকা)) যেহেতু মার্কসবাদী রাজনীতিনিষ্ঠ তিনি নন, সুতরাং নিছক রাজনৈতিক প্রয়োজনে কবিতার খোলসে যে শব্দবাজি চল্লিশ দশকের অনেকেরই করতে হয়েছে– আহসান হাবীব তা থেকে সৌভাগ্যজনকভাবে মুক্ত। কবিতার এটাই সিদ্ধ পথ। রাজনীতির মঞ্চ আর কবিতার ক্ষেত্র মোটেই এক জিনিস নয়। এ দু’য়ের সম্মিলন ঘটতে পারে, তবে কখনোই একটি আরেকটির বিকল্প নয়। সেক্ষেত্রে কোনো স্বার্থই রক্ষিত হয় না। না কবিতার, না রাজনীতির। এ উপলব্ধি কিয়দংশ আহসান হাবীবেরও। যেজন্যে তাঁর কবিতা মূলতই উচ্চকণ্ঠের রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হয় নি। ‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’-এর ভূমিকায় তিনি জানাচ্ছেন, ‘কবিতাকে রাজনৈতিক বক্তৃতা করে তোলার পক্ষপাতী নই বলি। বরং কবিতা হোক রাজনৈতিক মঞ্চের বিশুদ্ধ প্রেরণা, আমি পেয়েছি। ((পরিক্রম এবং অবস্থান প্রসঙ্গ, আহসান হাবীব : বিদীর্ণ দর্পণে মুখ, ১৯৮৫, ঢাকা))
খুঁজে মেলে আরো যত ধন
ইতিহাস ও ঐতিহ্যসন্নিষ্ঠতা
চল্লিশ দশকের সময় ও সমাজচিত্রের যেটুকুই আহসান হাবীবের ‘রাত্রিশেষ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাবলিতে উঠে এসেছে, আজ তা ইতিহাসেরই অংশ। ভারতবাসী সমস্ত অসাম্য, অন্যায্যতা, অমানবিকতা, দুঃশাসন, বর্বরতা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তখন যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছে– সে বীরৈতিহ্য পরবর্তীসময়ে আমাদেরকে সামাজিক-রাজনৈতিক আরো আরো সংকটে, আরাধ্য উপল-উপকূলে পৌঁছতে সহযোগিতা করেছে। এটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের লিখিত হবার একটি প্রয়োজনীয়তাকেই ইঙ্গিত করে। ইতিহাস কেবল ইতিহাস শাস্ত্রের সীমায় সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবার বিষয় নয়। নানাভাবে চর্চিত না-হতে পারলে গ্রন্থের মোড়কে তা কেবল কতিপয় বিন্যস্ত বর্ণের সমষ্টি হয়ে থাকবে যুগের পর যুগ। শিল্প-সাহিত্যেও তাঁর রূপায়ণ অবশ্যকাম্য। কারণ এই সুকুমার-শিল্পের যাঁরা ভোক্তা তাঁরা অবশ্যই এসবে উন্মূলতার প্রতিচ্ছবি দেখতে চান না। যে কারণে নিজেরাও উন্মূল নন এমন সৎ শিল্পী-সাহিত্যিক-কবিগণ তাঁদের শিল্প-সাহিত্য প্রয়াসের একটা বড়ো জায়গা জুড়ে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে স্থান করে দেন অথবা দেবার যৌক্তিকতাকে শিরোধার্য করে নেন। তা নইলে একজন পাঠক কেন সহজে যৌন সুড়সুড়ি লাভ করা যায় এমন পর্নোর কাছে না-গিয়ে খটখটে কবিতা-গল্প-উপন্যাসের কাছে যাবেন? বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কবিতার ইতিহাস, ইতিহাস শাস্ত্রের মতো বিস্তারিত ইতিহাস নয়। সে প্রয়োজনে পাঠক ইতিহাস শাস্ত্রেরই সাহায্য নেন। সুতরাং কবিতার দায় নেই ইতিহাস শাস্ত্রের বিকল্প হয়ে ওঠার। কবিতার ইতিহাস– ইতিহাসের কোড, আভা, ঝলক। যা কবিতার কবিতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও একটি প্রথম সারির ব্যঞ্জনের ভূমিকা পালন করতে পারে।
‘রাত্রিশেষ’-এর আহসান হাবীব উন্মূল কেউ নন। এই দায়বদ্ধ কবি ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা জানতেন; এবং জানতেন কবিতায় তাঁর সঠিক ব্যবহার। কেবল কবিতায় ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতকে স্মরণে নিয়ে আসবে এমন কতিপয় শব্দ ব্যবহার করলেই কবির দায় মেটে না। পালন করতে হয় আরো কিছু দায়-দায়িত্ব। যে-দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন বলেই আমরা মনে করি। আহসান হাবীবের ব্যবহৃত ইতিহাস, ‘মৃতকল্প জীবনের ইতিহাস নয়। ইতিহাসের ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে নব জীবন নির্মাণের পরিকল্পনা [তাতে] আছে। ((হোসেনউদ্দীন হোসেন : ঐতিহ্য আধুনিকতা ও আহসান হাবীব, ১৯৯৪, ঢাকা))
১.
ঘুম নেই নয়নে আমার,
এখনো নয়নে কাঁপে মীরণের তীক্ষ্ণ তলোয়ার …
দ্বারপ্রান্তে তোমাদের বন্দী আমি দুই শতকের,
আমার আত্মার তলে অগ্নিশিখা সাতান্ন সনের
আজো অনির্বাণ, তবু কি পাহারা দেবে হাসিমুখে আমার জিন্দান?
(সেতু-শতক, প্রান্তর)
২.
বিগত দিনের মৃত্যু আজো দেখি বহ্নিমান
আমাদের ক্ষুব্ধ চেতনায়
অসংখ্য মমীর কান্না আমাদের মনের গুহায়
যত রক্ত ঝরেছে মাটিতে
চিহ্ন তার রয়ে গেছে আমাদের ক্লান্ত করোটিতে!
(কয়েদী, প্রতিভাস)
৩.
ও বাড়ির বিরাট উঠানে
বিরাট জামাতে এসে দেখা দিয়ে যেত
‘ছয়ফলমুলুক’ আর ‘বদিউজ্জামাল’
বহুরাতে
সে উঠান আজকে নীরব!
(একটি ঐতিহাসিক ভ্রমণ, প্রতিভাস)
আহসান হাবীব প্রশ্ন তুলেছেন, ‘কেবলমাত্র কতোগুলো শব্দই কি ঐতিহ্য? কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কেবলমাত্রই ভাবাবেগই ঐতিহ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ও লালনে সক্ষম হবে কি? না তাকে নতুন পরিবেশে নতুন চেহারায় নতুন সম্ভাবনায় বিকশিত হবার সুযোগ দিতে হবে?’ ((পূর্ববাংলার সমকালীন কাব্যের ধারা ও সমস্যা, আহসান হাবীব রচনাবলি (২য় খণ্ড), অপ্রকাশিত)) এ উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়, ঐতিহ্যের কী ধরনের প্রয়োগ তিনি করতে চেয়েছেন। তাঁর ইতিহাসের ব্যবহার নতুন পরিবেশে নতুন চেহারায় নতুন সম্ভাবনায় বিকশিত হয়ে উঠেছে। ১৭৫৭ সালে সংঘটিত সিরাজউদ্দৌলার হত্যাকাণ্ড, ‘৪০ দশকীয় রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাঁর নিজেকেই অপরাধী করে তুলেছে– নিজের মৃত্যু, হন্তারক হাজারো তীক্ষ্ণ তরবারিসজ্জিত মীরণকে অবসিত করুক, এরকম কামনায় তিনি চান– তাঁর মতো অন্যেরাও ঘুমের কাফনে জড়িয়ে না-থেকে জেগে ওঠুক, হোক কলঙ্কের অবসান। কিংবা ভারতভূমিতে যত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে মুক্তিকাঙ্ক্ষায় তাঁদের কাউকে তিনি ভুলতে পারেন না– কবি ক্ষুব্ধ হয়ে জানান দেন যে, মমিসভ্যতার সুফল সেই মৃত্যুচেতনাকে রক্ষণ করেছে তাঁর মনোচৈতন্যে। যে-চেতনা মৃত্যু-পরিক্রম স্বপ্নরঙিন অনাগত জীবনের সন্ধান দেবে– এ হাতে বয়ে বেড়ানো হচ্ছে তারই মশাল। এসব ভালো; কিন্তু লোকঐতিহ্যের যে ব্যবহার কবি করেছেন ‘একটি ঐতিহাসিক ভ্রমণ’ নামক কবিতায়, সেখানে ‘ছয়ফলমুলুক’, ‘বদিউজ্জামাল’-এর নাম উল্লেখপূর্বকই কবি ক্ষান্ত হয়েছেন। কেবল এই বেদনাকর বিবৃতিটাই ওখান থেকে লভ্য যে একদিন শঙ্করপাশার এইবাড়ির বৃহৎ উঠানে বহুরাতে পালাকাব্যের নায়ক-নায়িকা ‘ছয়ফলমুলুক’, ‘বদিউজ্জামাল’কে দেখা যেত, কিন্তু আজ দেখা যায় না। এখানে এই চরিত্র দু’টোকে কোনো নতুন সম্ভাবনায় স্থাপন করা হয়েছে বলে আমাদের মনে হয় না।
প্রধানত নগরচিত্রী তবে গ্রামনিসর্গ প্রীতিও দ্রষ্টব্য
১৯৩৬-এ ১৯ বছর বয়সী যুবক আহসান হাবীব স্থায়ীভাবে অবস্থানের জন্য পদার্পণ করেছিলেন বরিশাল থেকে তখনকার বাংলা সাহিত্যের রাজধানী কলকাতায়, এবং সেটা ওই বয়েসি একজন বাঙালি মুসলমান যুবকের জন্যে ছিল খুব সাহসী সিদ্ধান্ত। সেই যুবক, যার মাথায় কবিতার বীজ। একজন কবিযশোপ্রার্থী স্বাপ্নিক যুবকের তখন কলকাতায় বসে জসিম-উদ-দীন মতো গ্রামীণ সৌন্দর্যে মগ্নতা প্রকাশ করবার জো ছিল না কবিতায়। কারণ কলকাতায় কবি হওয়া শুধু নয়– বেঁচে থাকার জন্যেও তখন তার সামনে একটিই পথ খোলা ছিল– আর সে পথ নাগরিক হয়ে ওঠায় নিহিত। হ্যাঁ, নাগরিক যে তিনি হয়েও উঠেছিলেন, তা তাঁর কবিতার দিকে তাকালেই উপলব্ধ হয়।
১.
লাল মাটি, কালো পীচ শাদা নীল বালবের বুকে
ক্রূর হাসি ফেটে পড়ে পরাক্রান্ত যুগের নিষাদ;
অক্লান্ত চাকার তলে বিস্মিত এ-নয়ন-সমুখে
দ্বীপান্তরে এ পৃথিবী অবিরাম করে আর্তনাদ!
(দ্বীপান্তর, প্রহর)
২.
কার্জন পার্কের মোড়ে তুমি দাঁড়িয়ে থেকো;
মাঠ থেকে ফিরে এসে
তোমায় লিফ্ট্ করবো।…
কোথায় যাবো?
কেন ‘তসবির মহল’
না হয় ‘পার্ক শো হাউজ’–
‘বাকে সেপাহীর খেল’ আছে একটাতে
আর একটাতে ‘বাপকা বেটা’।
(কোনো বাদশা’যাদীর প্রতি, প্রহর)
৩.
খানিকটা হেঁটে গিয়ে
মার্কুইস্ লেন ছাড়িয়ে
কিড স্ট্রীট পেরিয়ে
তারপর চৌরঙ্গি।
গড়ের মাঠ দু’টুকরো
মাঝখানে আড়াআড়ি পীচের পথ
পেরিয়ে
অতঃপর দীর্ঘ রেড রোড
(রেড রোডে রাত্রিশেষ, পদক্ষেপ)
বেঁচে থাকা বা কবি হয়ে ওঠার প্রয়োজনে যতটুকু নাগরিকই একজন হয়ে উঠুন না কেনো, গ্রামে যাঁর জন্ম তিনি কী করে পারবেন কখনোই গ্রামের কথা মনে না-আনতে। আহসান হাবীবও পারেন নি। স্মৃতিতে চাড়া দিয়ে উঠেছে গ্রাম। ফলে কখনো উপমা হয়ে, কখনো নিছক ছবি হয়ে গ্রাম তাঁর কবিতায় ধরা দিয়েছে, যদিও ‘রাত্রিশেষ’ গ্রন্থে নাগরিকতারই একচ্ছত্র আধিপত্য।
১.
মেঘলার দিনে নোন্তার মত বিয়েটা নেহাৎ মন্দ নয়। …
সর্ষের ক্ষেত আছে অবশ্য মানি,
মাঝে মাঝে ফুল ফুটবে তাও জানি;
তবে কিনা ওটা কারো চোখে আনে জ্বালা
কেউ তুলে নিয়ে সহজেই গাঁথে মালা।
(বিয়ে : দুই, প্রান্তিক)
২.
এই ত এখানে সেই পুরনো নদীটি
এই সেই মধুমতি-মাঠ।
এখানে সবুজ ঘাসে ঘুম আর ঘুম
ছিলো এককালে। …
ঐ যে দীঘির পাশে ঐ ছোট একচালা ঘর
ঐ ঘরে বাস করে কাজেম বয়াতী
(একটি ঐতিহাসিক ভ্রমণ, প্রতিভাস)
৩.
এখানে সমুদ্র ছিলো
ছায়া ছিল দূর বনানীর
(প্রদক্ষিণ, পদক্ষেপ)
সংশয়ায়িত স্বপ্নগ্রস্ত দেশাত্মবোধ
‘রাত্রিশেষ’ যখন লিখিত হচ্ছে তখন লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০)-এর ভিতর দিয়ে ‘পাকিস্তান’ নামক একটি নয়, দু’টি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের কথা ঘোষিত হয়ে গেছে। মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা সেভাবেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। কিন্তু আশা এবং আশাভঙ্গের এত এত নমুনা তাদের অভিজ্ঞতায় রয়েছে যে, (এই নিয়ে বারবার নতুন দিনের বাসনায় বেঁধেছি অনেক বাসা মৃত্যুমুখী দিনের সীমায়। ঝরা পলাশ : পদক্ষেপ) সম্পূর্ণ আস্থাশীল হবার মতো মানসিক জোরও তখন তৈরি হচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে কী করা উচিত, কী অনুচিত– সে ব্যাপারে সিদ্ধান্তগ্রহণ সম্ভব হলে ঔচিত্যবোধের আলোতেই পথ চলা সম্ভব হয়; কিন্তু মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে যে অনৈক্য বেড়ে উঠেছিল, তাতে স্থির নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্ত; যা ভারতবর্ষে আগামী সময়ে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে– তার কোনোই নির্দিষ্টতা ছিল না। এরকম প্রেক্ষিতে একজন মুসলিম কবির দেশপ্রেম ঠিক কোনভূমির প্রতি নিবেদিত হবে– তা কুয়াশাচ্ছন্ন। এমনকি নিশ্চিত হলেও, তা সতত অস্থির। বলে নেয়া যায় যে লাহোর প্রস্তাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত শেষপর্যন্ত বদলেই গিয়েছিল। ‘বাংগালীরা বেশি গুরুত্ব আরোপ করতো লাহোর প্রস্তাবের উপর যার ভেতরে তাদের মতে দু’টি স্বাধীন মুসলিম দেশের কথা বলা হয়েছিল। … অথচ ১৯৪৬ সালে জনাব সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে লাহোর প্রস্তাবে এইমতো সংশোধনী আনা হয়েছিল যে, পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র হবে।’ ((বিচ্ছিন্নতা, রাও ফরমান আলী খান : বাংলাদেশের জন্ম, ১৯৯৬, ঢাকা)) এ অবস্থায় কলকাতায় তখনো পর্যন্ত উদ্ধাস্তু-প্রায় একজন মুসলিম কবির দেশাত্মবোধের বীজ হিন্দু-বিদ্বেষের মধ্যে নিঃশেষিত হবার কথা, যার মাঝে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বিভাজন-সম্ভব পাকিস্তানের চেতনা সংগ্রথিত। ((পরাধীন দেশে জাতীয়তাবাদের নিয়তি সাম্প্রদায়িকতায় পর্যবসিত হওয়া। ভারতবর্ষের উনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্যে, চিন্তায় তাঁর অজস্র ছাপ রক্ষিত হয়েছে। যার মাশুল অগণিত মানুষকে নানাভাবে গুণতে হয়েছে এই বিংশ শতাব্দীতেও। … অতি উজ্জ্বল বুদ্ধিজীবীদের দেখা যাবে শেষপর্যন্ত আশ্রয় খুঁজছেন ধর্মের কাছে। ধর্ম অসহায়ের আশ্রয় বটে। তদুপরি ইংরেজ যেহেতু বিধর্মী তাই আপন ধর্ম নিয়ে বড়াই করতে পারা এক ধরনের ইংরেজ বিরোধিতা হয়ে দাঁড়াত; রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে যে বিরোধিতা বিপজ্জনক, ধর্মীয় ক্ষেত্রে তা ছিল নিরাপদ। বিক্ষোভও প্রদর্শন করা গেলো অথচ বিপদও ঘটল না। (পরাধীন দেশে জাতীয়তাবাদ : উনিশ শতকে বঙ্গদেশীয় অভিজ্ঞতা, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : এদেশ একাল, ১৯৯১, ঢাকা))) কিন্তু আহসান হাবীব কখনো তা করেন নি। ধর্মে খুঁজেন নি আশ্রয় বা হয়ে ওঠেন নি সাম্প্রদায়িক। প্রতিক্রিয়াশীল কবিকুল (কবি গোলাম মোস্তফা দ্রষ্টব্য) চাচ্ছিলেন সেরকমই। তাঁরা প্রবন্ধ লিখে তরুণ কবিদের প্রতি নিবেদন রাখছিলেন ধর্মীয় কূপমণ্ডূক হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু সে ডাকে পরবর্তীকালে ফররুখ আহমদের মতো শক্তিমান কবিরা সাড়া দিলেও, আহসান হাবীব দেন নি।
কাজেই তাঁর পক্ষে শোভন ছিল ইংরেজ বিরোধিতার ছলে হিন্দুর বিরোধিতা না-করে সরাসরিই ইংরেজের বিরোধিতা করতে পারা, সাম্রাজ্যবাদীদের থাবার নিচ থেকে দেশের স্বাধীনতার সূর্যকে নিজেদের আয়ত্তে আনবার জন্যে কলমী-প্রয়াস চালানো। সেটাই করে তিনি একজন দেশপ্রেমিক হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। অন্যদিকে জন্মভূমিকে (পূর্ববঙ্গ) আলাদা দেশ হিসেবে দেখবার মতো সংশয়ায়িত সুদূরকল্পনাই কেবল তখন সম্ভব ছিল।
তবে সে কল্পনাও আহসান হাবীব করতে পেরেছেন– যার মধ্যে দেখা যায় একাত্তর পটান্তরের বাংলাদেশেরও ছবি; এবং পরোক্ষভাবে হোক, সমূহ সে প্রয়াসের প্রতি তাঁর কলমে আঁকা হয়ে গেছে এক সুদূর সমর্থন। ((আগামী দিনের যারা–
এই মৃত স্তূপের উপর
তাঁরা যদি ঘর বাঁধে ;
ভাঙা চোরা দিনের ফাঁটলে
তারা যদি ভালোবেসে নতুন সূর্যের মতো জ্বলে,
তাদের কি দেব না হৃদয় ?
সূর্য থেকে এ পৃথিবী
আরেক সূর্যের পানে বিস্তৃত কি নয় ?
(প্রদক্ষিণ, পদক্ষেপ, রাত্রিশেষ : আহসান হাবীব)))
পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল, রংপুর শাখার উদ্যোগে রংপুরে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে কাব্য, কথাসাহিত্য ও রম্যরচনা শাখার অধিবেশনে ‘পূর্ব পাকিস্তানের কবিতা : তার অন্বিষ্ট এবং ভাষা প্রসঙ্গে’ শীর্ষক সভাপতির অভিভাষণে আহসান হাবীব বলেছিলেন, ‘আমরা যারা ইতিহাসের এক অন্ধকার অলিখিত পাতায় আবদ্ধ ছিলাম, তাদের পক্ষে সেই আলো থেকেই জীবনে আলো সঞ্চারের চেষ্টা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। এই নিরুপায় অনুসরণ আমাদের ক্রমশ হীনম্মন্য করেছে।…’ করুক হীনম্মন্য, অন্ধকার থেকে বাঁচার আকুতি তো তবু মরে যায় নি। প্রায় গোটা ‘রাত্রিশেষ’ জুড়েই এই আকুতির উৎসারণ সম্ভব হয়েছে দেশপ্রেম থেকেই। নইলে ঝরা পালকের ভস্মস্তূপে কেউ নীড় বাঁধবার আগ্রহ পেত না। এ বিষয়ে বিস্তারিত উদ্ধৃতিতে আমরা যাব না, কারণ গোটা ‘রাত্রিশেষ’ গ্রন্থটিই এর উদাহরণ। মাটির প্রতি কবির প্রেমের তীব্রতা যে একটা চরম বিশুদ্ধতার জায়গায় পৌঁছেছিল– এটি তার সাক্ষ্য বহন করবে।
মাটির গন্ধ এতই গভীর এমনি তাহার মোহ
তনুমনে আনে অনুরণনের সীমাহীন সমারোহ
কণা কণা করে তাইতো নিজেকে পথে পথে ছড়ালাম;
কোমল মাটির স্পর্শ-প্রসাদ– সামান্যতম দান…
নিবিড় মনের আবরণ-ঘন যে আভরণের তলে
এই পৃথিবীর কুৎসিত প্রাণ হীন কামনায় জ্বলে,
প্রেমহীন সেই বন্ধুর দেশে নীড় বাধলাম তবু,
এই মন আর এই মৃত্তিকায় বিচ্ছেদ নাই কভু।
(এই মন– এই মৃত্তিকা, প্রহর)
নিজের জন্মভূমিতে এসে ‘শতাব্দীর গ’ড়ে ওঠা এইসব গ্রাম’-এর মৃত্যুতে যে হাহাকার ফুটে উঠেছে কবির মনে, তা ‘একটি ঐতিহাসিক ভ্রমণ’কে বিরহাত্মক প্রেমের কবিতায় উত্তীর্ণ করেছে। যা মূলত গ্রামপ্রেম এবং প্রকারান্তরে স্বদেশপ্রেম। কেননা শঙ্করপাশা যে তাঁর নিজের গ্রাম সে বিষয়ে কোনো সংশয় ছিল না; যে সংশয় ভারত বা পাকিস্তান বিষয়ে থাকা সম্ভব ছিল।
প্রেমবোধ
‘রাত্রিশেষ’ পর্বে অকৃতদার আহসান হাবীবের বয়স প্রেমেরই, কিন্তু কলকাতার সময় বিপ্লবের। বিপ্লব এবং প্রেমের সুসমন্বয় বাংলা কবিতায়ই একাধিক কবি ঘটিয়েছেন। কিন্তু যে-কবি পরবর্তীসময়ে এত উত্তীর্ণ প্রেমের কবিতা লিখবেন (স্মরণ করা যাক, ছত্রিশটি কবিতা নিয়ে ‘৮১-তে বেরিয়েছে ‘আহসান হাবীবের প্রেমের কবিতা’), তিনিও কেমন সময়ের কাছেই আমূল সপে দিয়েছিলেন নিজেকে। তাঁর কাছে কলকাতার ওই অস্থির সময়কালকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর ‘রঙ খেলবার দিন নয় অদ্য’ মনে হয়েছে কি, যে কারণে বিপরীত লিঙ্গীর প্রতি প্রেম নিবেদনের চাইতে দেশের প্রতি নিবিষ্ট থাকাই হয়ে উঠেছে কাঙ্ক্ষিত? কিংবা একজন কোনো মানবীর প্রতি নিবিষ্ট না-থেকে অগণিত মানুষের প্রতি মগ্ন থাকা তাঁর কাছে মনে হয়েছে অধিক প্রয়োজনীয়?
বুঝেছি সেদিন মানুষ এমনি দীন,
এ-মাটির কাছে আমাদের এমনি অশেষ ঋণ
অনাদি কালের বন্ধন আর বঞ্চনা একসনে
চিরজীবনের শৃঙ্খলসম জড়ানো মানব মনে!
এই মন– এই মৃত্তিকা, প্রহর)
নইলে ওরকম একাধটি বিচ্ছিন্ন চেষ্টাও এমন বিফল মনে হতো না আমাদের কাছে। ‘কাশ্মিরী মেয়েটি’ ও ‘কোনো বাদশা’যাদীর প্রতি’ নামক বর্ণনাত্মক প্রেমের কবিতাদ্বয় ‘রাত্রিশেষ’ গ্রন্থের অন্যান্য কবিতার পাশে দারুণভাবে নিষ্প্রভ। কবিতা দু’টিকে এ গ্রন্থে দলছুট উচ্ছন্নে যাওয়া পোশাকি বালক বলে মনে হয়। যেন এদের এ গ্রন্থে না-দেখতে হলেই স্বস্তি পাওয়া যেত।
১.
কাশ্মিরী মেয়েটির ঘাগড়াটি লাল
কাশ্মিরী মেয়েটির তনু গোলগাল
ফরিদের ছোট ছেলে নাম আমজাদ
তার ছিলো সাধ,
খেলবে ম্যাজিক সেই ঘাগড়াটি নিয়ে
কাশ্মিরী মেয়েটিকে
পুরো এক পয়সার সিগারেট দিয়ে
(কাশ্মিরী মেয়েটি, প্রহর)
২.
যদি ঘুমিয়ে যাও–
একটা জর্দা দেওয়া পান
তোমাকে খাওয়াবো।
তোমার ঘুম যাবে টুটে,
তোমার বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে উঠবে,
তুমি তখন আমার বুকে
মাথা রেখে খেল্ দেখবে
আর তখন আমি পড়বো ঘুমিয়ে।
(কোনো এক বাদশা’যাদীর প্রতি, প্রহর)
স্যাটায়ারপ্রবণতা
কেউ যখন অন্য কাউকে সমালোচনা করতে চায়, তখন তাঁর দু’টো পথ খোলা থাকে। একটা সরাসরি সমালোচনার কথাটি বলা, অন্যটি পরোক্ষ ইঙ্গিতে। ‘তোমার সবসময় দাঁত বের করে হাসাটা ঠিক নয়। ওতে কোনো সৌন্দর্য থাকে না, দেখতে ভীষণ কুৎসিত বোধ হয়।’ এটিকে যদি সরাসরি বলা ভাবা যায়, তবে পরোক্ষ ইঙ্গিত হতে পারে এভাবে– ‘দাঁত সুন্দর হলে হাসা ভালো, নইলে মুখ বন্ধ করে রাখা।’ অথবা ‘যাদের দাঁত সুন্দর নয়, হাসি কখনো তাদের নয়।’ কিংবা ‘মন্দ দাঁত, হাসির শত্রু।’ প্রথমোক্ত প্রকাশটি পরিপূর্ণ ম্যাসেজটি দিচ্ছে, তবে খুব কর্কশভাবে। অন্যদিকে পরবর্তী তিনটি, পরোক্ষভাবে, এমন এক কায়দায় বিষয়টি উপস্থাপন করছে, যা সদা কুৎসিত হাস্যকারকেও প্রথমে মজা দিচ্ছে এবং অচিরেই তাকে করে দিচ্ছে নিষ্প্রভ। এই দ্বিতীয়োক্ত প্রকাশটিই স্যাটায়ার। এ ভাষা, উদ্দীষ্টজন যদি প্রতিবন্ধী বা স্থূল বুদ্ধির না-হন, তবে দ্রুতই তাঁকে তীক্ষ্ণ এক খোঁচা দিতে সক্ষম হয়।
আহসান হাবীব সাধারণত বেশ সিরিয়াস ভাষায়ই কথা বলেন। তাঁর সাধারণ বৈশিষ্ট্যে রম্যতার কোনো বালাই নেই। তবে ‘রাত্রিশেষ’ কাব্যগ্রন্থের কতিপয় কবিতায় এ প্রবণতার কিয়ৎ উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এবং এখানে তাঁর উদ্দীষ্টও তেমন কেউ নেই। একটু হালকা হবার জন্যে স্রেফ মজার ছলেই তাঁর এই রম্যময়তা।
তার চেয়ে ভালো মনে রাখা বিশ্বাস
তারো চেয়ে ভালো শাকসব্জির চাষ,
আরো ভালো কিছু বালির বস্তা রাখা,
তা না হলে না কি বিয়েটা নেহাৎ পেট্টলহীন চাকা।
(বিয়ে – দুই, প্রহর)
‘রাত্রিশেষ’ গ্রন্থের ‘কাশ্মিরী মেয়েটি’, ‘সৈনিক’, ‘রেনকোট’ প্রভৃতি কবিতায়ও এ প্রবণতার সাক্ষাৎ মিলবে।
ক্লিশে ও বুদ্ধিজাত স্বপ্ন রচয়িতা
‘রাত্রিশেষ’ গ্রন্থটি, আগেই বলা হয়েছে, লিখিত হচ্ছে এমন এক সময়ে যখন ভারতের পরাধীনতার দুইশত বৎসর সমাপ্ত হতে যাচ্ছে প্রায়। আঠারো/উনিশ শতকে বাবু শ্রেণির ইংরেজ তোষণের মাত্রারিক্তির ফলে স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষাটি দীর্ঘদিন সুপ্তই ছিল। কিন্তু বিশ শতকে এসে তোষণের চেয়ে এই সাম্রাজ্যবাদের জগদ্দলকে দেশের কাঁধ থেকে সরিয়ে ফেলবার দিকেই সচেতন দেশপ্রেমিকদের ঝোঁক সৃষ্টি হলো। সে লক্ষ্যে নানা কর্মকাণ্ডও রইল অব্যাহত। স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষাটি একবার কোনো জাতির মধ্যে সৃষ্টি হলে তা পুরোপুরি কখনো অবদমিত হয় না। দিনে দিনে তা আরো বেগবান হয়ে ওঠে এবং একসময় ঠিকই সে জাতি স্বাধীনতার পতাকাতলে ছায়াপ্রাপ্ত হয়। তো, সত্যি সত্যি স্বাধীনতাকে বাগাতে হলে হতাশ হলে চলে না। এর জন্যে স্বপ্ন দেখতে হয়। কখনো কখনো হতাশা এসে জায়গা দখল করে নিলেও পরক্ষণেই বাঁধতে হয় নতুন স্বপ্নের সেতু। ‘রাত্রিশেষ’ গ্রন্থটি এই স্বপ্নরচনা এবং স্বপ্নবিনাশেরই আলেখ্য। আর এ কারণেই ‘স্বপ্ন’ শব্দটি এবং তার একাধিক প্রতিশব্দ নানাভাবে এ গ্রন্থে এত বেশিবার ব্যবহৃত হয়েছে যে, এটি একটি ক্লিশেতে পরিণত হয়েছে। যেখানে এ শব্দটি বা এর কোনো প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হয় নি, সেখানেও মূলত স্বপ্নই দেখা হয়েছে। এমনকি গ্রন্থটি যেখানে শেষ হয়েছে, সেই ‘রেড রোডে রাত্রিশেষ’ও আসলে রাত্রির শেষ নয়, রাত্রিশেষের স্বপ্ন মাত্র– ‘সকালবেলার হাওয়ায় লাগবে জোর/পুরনো ধুলোরা এবার উড়বে’। ফল হয়েছে এই যে আদ্যোপান্ত এই গ্রন্থটি যিনি পাঠ করবেন, তিনি আর যাই হোক স্বপ্নক্লান্তিতে ভুগবেনই। এমনকি পাঠক যদি হন নিজেও কবিতাকর্মী– তবে তাঁর নিজের কাব্য রচনার সময়ে এই ‘স্বপ্ন’ শব্দটি এসে গেলে তিনি আতঙ্কিত বোধ করতে পারেন এবং যতদূর অনুমান করা যায়, তিনি একটি বিকল্পের দিকে ধাবিত হওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে পড়তে পারেন। তাছাড়া এই যে বাড়াবাড়ি রকমের স্বপ্নজাত আশাবাদের আবির্ভাব গ্রন্থটিতে আছে। এর কোনো কোনোটি অন্ধবিশ্বাসীর মতো। অখণ্ডনীয় কোনো যুক্তির ভিতর দিয়ে সেই আশাবাদের জায়গায় কবিতাটি উত্তীর্ণ হচ্ছে না।
কবিতাকে শেষপর্যন্ত নৈরাশ্যের জায়গায় নয়, আশার জায়গায় উত্তীর্ণ করে তুলতে হবে– এরকম একটি ধারণায় সম্ভবত তিনি আশাকে, স্বপ্নকে কবিতাসমূহে আরোপ করেছেন। এ মতের সমর্থন মিলবে হাসান হাফিজুর রহমানেও। তিনি বলছেন, ‘ভবিষ্যতের আশাবোধ যা আছে তাও যেন কতকটা অন্ধবিশ্বাসের মত। সিদ্ধান্তটাও যান্ত্রিক, বুদ্ধিজাত, আর যার কোনো পরবর্তী স্রোতও নেই।’ ((হাসান হাফিজুর রহমান : আধুনিক কবি ও কবিতা, ১৯৭৩, ঢাকা)) ‘রেড রোডে রাত্রিশেষ’ ও ‘স্বাক্ষর’ কবিতায় এরকম আশাবাদ ও সিদ্ধান্তের দেখা মিলবে।
মুসলমানী রোগ
পূর্বে আমরা এরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে কীয়ের্কেগার্দের আদর্শ খ্রিষ্টান হয়ে ওঠবার দর্শনের মতো ফররুখ আহমদ আদর্শ মুসলমান হয়ে ওঠবার দিকে ধাবিত হলেও আহসান হাবীবকে সেরকম দর্শন তাড়িত করতে পারে নি। মানুষ কিংবা দেশের অধিক ধর্মকে তিনি বড়ো করে দেখেন নি। কাজেই ধর্মীয় রক্ষণশীলতা তাঁর কবিতাকে স্পর্শ করে নি। কিন্তু ‘রাত্রিশেষ’ গ্রন্থের একটি কবিতা ‘কোনো বাদশা’যাদীর প্রতি’র একটি পঙক্তি উপর্যুক্ত প্রতীতীকে সংশয়ে প্রতিপন্ন করে। সেখানে বলা হচ্ছে ‘ফারপোতে আমরা যাব না।/ খোদার দিন।/ আজ নাছারা খানা খেতে নেই।/ আমরা যাব ছকু মিয়ার হোটেলে’। বোঝা যাচ্ছে, ‘ফারপো’ হচ্ছে বিদেশী রেস্তোরা। যেখানে হয়ত ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ আছে এরকম খাবার, যথা : ব্যাঙ, কাঁকড়া, শূকর, কচ্ছপ ইত্যাদি তৈরি হয়। একজন কেউ এই খাদ্য উপকরণ না-ই খেতে পারেন। কিন্তু না-খাওয়ার কারণটি যদি হয় ফারপোতে তৈরি খানার অনৈসলামিক হওয়া, তাহলে সেটা অবশ্যই আপত্তিকর। আরবি কায়দায় এখানে ইহুদী-নাছারাদের প্রতি উপেক্ষা বাণী নিঃসৃত হচ্ছে। কিন্তু একজন প্রগতিশীল কবির কলমে এরকম প্রতীতী লিপিবদ্ধ হলে আমরা তা বিনা বাক্য ব্যয়ে গ্রহণ করতে পারি না। এখানে আরেকটি দৃষ্টিকোণেও বিষয়টি দেখা যায়। বলা হচ্ছে, খোদার দিন (ঈদের দিন) বলে আজ কেবল নাছারা খাবার খেতে নেই। তার মানে অন্যদিন হলে খাওয়া যেত। এখানে লুকিয়ে আছে আরেকটি আপত্তির জায়গা। তা হলো এই যে, এই কবিতার নায়ক ‘হারু মিয়ার বস্তি’বাসী লোকটি একজন বদলোক। সে কোনো কোনোদিন মানুষ হয়ে ওঠে আর কোনো-কোনোদিন মুসলমান। যে মুসলমান, সে প্রতিদিনই। একদিন মুসলমান, একদিন নয়– এটি কোনোই সততার প্রতি ইঙ্গিত করে না। আহসান হাবীবের প্রেমের কবিতার নায়কের এই পরিণতি অবিশ্বাস্য।
নব্বই দশকে রাত্রিশেষ-এর প্রাসঙ্গিকতা
চল্লিশ দশকে প্রকাশিত আহসান হাবীবের ‘রাত্রিশেষ’ কাব্যগ্রন্থটি নব্বই দশকে একজন পাঠককে কীভাবে তাড়িত করবে? আমরা এ বিষয়ে ভাবনাবিস্তারের চেষ্টা করে দেখতে পারি। মার্কসবাদী না-হয়েও ‘রাত্রিশেষ’ গ্রন্থে আহসান হাবীবের সবচেয়ে উজ্জ্বল অর্জন সময় ও সমাজ সন্নিষ্ঠতা। অন্যদিকে নব্বই দশকের যাঁরা কবিতাকর্মী, তাঁরা, মোটাদাগে সমাজবিচ্ছিন্ন। এই দু’প্রান্তের মধ্যে কোনোভাবে কি কোনো সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে?
আমরা জানি, নব্বই দশকের কবিতার মূল প্রবণতা উত্তর আধুনিকতার দিকে বেগবান, যাকে গণ্য করা হয় মার্কসবাদের শত্রু পর্যায়ে। ‘উত্তর আধুনিকতার যুদ্ধ হলো মার্কসবাদের সঙ্গে। মার্কসবাদ চায় পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অবসান। রেনেসাঁস-এর যুগ থেকে মানুষ যে সাম্যের স্বপ্ন দেখে, মার্কসবাদ চায় সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে মার্কসবাদ ধাক্কা খেয়েছে, তার বাহিনীর মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। উত্তর আধুনিকতা চায় এই সংশয়াচ্ছন্ন বাহিনীকে হতোদ্যম করতে, যাতে বিদ্যমান অসাম্যের জগত স্থায়িত্ব অর্জন করে।’ ((মার্কসবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদ, রতন খাসনবিশ : উত্তর আধুনিকতা ও মার্কসবাদ, ১৯৯৭, কলকাতা)) রতন খাসনবিশের এই তত্ত্ব কতটা যৌক্তিক বা অযৌক্তিক এ প্রবন্ধে আমরা সে আলোচনায় যাব না। অযৌক্তিক হলে তো কথাই নেই। আর যৌক্তিক হলেও বলব, আহসান হাবীবের ‘রাত্রিশেষ’ থেকে এই দশকের কবিতাকর্মীরা সমাজসন্নিষ্ঠতার প্রেরণাটা লাভ করতে পারেন। যেহেতু আহসান হাবীব সমাজের প্রতি নিষ্ঠ হয়েছেন মার্কসবাদী না-হয়েও, ব্যাপ্ত জনস্থলির সাথে একাত্মতার উৎকাঙ্ক্ষায়। এই উৎকাঙ্ক্ষা একজন কবির জন্যে দূষণীয় নয়। যে মতবাদ মানুষ থেকে, সমাজ থেকে কবিকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে, সে মতবাদ অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কথা উঠতে পারে, চল্লিশ দশকে সমাজসন্নিষ্ঠতার যে ইন্ধনটি সমাজ থেকেই লভ্য ছিল, তা আজ লভ্য কি না এবং সে-রকম আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনা এ সময়ে ঘটেছে বা ঘটছে কি না। এর উত্তরে বলতে হবে যে, সব দশকে একই ধরনের ঘটনা ঘটে না বটে; কিন্তু মানুষের অধিকার হরণের ঘটনা, দলিত শ্রেণির ব্যাপকভাবে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা হামেশাই ঘটে থাকে। এখনো ঘটছে। একজন কবিকে সেটা কতটা স্পর্শ করতে পারছে, সেটা হলো প্রধান বিবেচ্য। খুব বেশি পেছনের দিকে তাকাবার দরকার নেই। দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসন লাভ করা পর্যন্ত কতজন কবিতাকর্মী তাদের ইস্যুটিকে নিয়ে ভেবেছেন কিংবা তাঁদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সমর্থন করে কবিতা লিখেছেন? একজন নির্বাহী পরিচালকের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বেসরকারি সংস্থা জিএসএস-এর ৬০০০ কর্মীর রাতারাতি বেকার হয়ে যাওয়া, কতজন কবিতাকর্মীকে ছুঁতে পেরেছে। পুনর্বাসনের নামে পতিতালয় ও বস্তি উচ্ছেদের মতো অমানবিক ঘটনা কি একটি কবিতা লিখবার মতো বিষয় নয়? সরকারি দলের ব্যানারে পুলিশের উপস্থিতিতে ব্যাংক লুট হবার ঘটনাটি কি একটি অরাজক পরিস্থিতির ইঙ্গিত বহন করে না? মহাকাল কি লিখে রাখবে না এই ইতিহাস? তখন এসব প্রসঙ্গ নিয়ে লিখিত একটিও কবিতা যখন আগামী প্রজন্ম খুঁজে না-পাবে– এ দশকের কবিদের তাঁরা ‘নীরো’ বলে গালি দিতেও পারে। সমাজসন্নিষ্ঠ হতে গেলেই যে স্লোগান লিখতে হয় না, আহসান হাবীব তারই একটি উদাহরণ হয়ে আছেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’ দিয়ে। একথা বলা এজন্যে যে, নব্বই দশকের কবিদের মধ্যে কোনোভাবে এই ভয় হয়ত ঢুকে গিয়ে থাকবে যে, সে প্রয়াস নিতে গেলে কবিতা না কি আবার স্লোগানে পরিণত হয়ে যায়। যে অভিযোগ নব্বইয়ের পূর্ববর্তী দু’টি দশকের (সত্তর ও আশি) কবিতার ওপর অসংখ্যবার করেছেন অসংখ্য আলোচক। কিন্তু মানতে হবে যে সেটা ছিল সময়েরই দাবি।
তখনকার যেসব কবি এই সামাজিক দায়টিও নিয়েছেন আবার শিল্পের প্রতিও সৎ থেকেছেন, তাঁরা অবশ্যই এ অভিযোগ থেকে মুক্ত। তেমন কবিও ওই দু’টি দশকে বিরল নন। কবিগণ যেহেতু বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপের অধিবাসী নন, ফলে এই সামাজিক দায় এড়িয়ে যাবার কোনো পথই তাঁদের সামনে খোলা নেই। কোনো-না-কোনোভাবে তাঁকে সে দায়িত্ব পালন করতেই হবে। সবাই এদিকে মনোনিবেশ না-করতে পারেন, কিন্তু এ দশকের শক্তিমান কবিদের কেউই সমাজসন্নিষ্ঠ হিসেবে বিশিষ্ট হয়ে না-উঠলে, এটি শতাব্দী শেষের একটি কলঙ্ক হিসেবেই পরিগণিত হবে। আর এদিকে পথ পরিক্রমণের জন্যে ‘রাত্রিশেষ’ হতে পারে একটি চমৎকার নির্দেশিকা।
আর যে কারণটির জন্যে ‘রাত্রিশেষ’-এর আহসান হাবীব নব্বই দশকেও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিভাত হতে পারেন, তা হলো তাঁর আশায় বসতি। ইতঃপূর্বে আমরা তাঁর এই অতিরিক্ত স্বপ্ন দেখার সমালোচনাও করেছি বটে, কিন্তু একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হাজারো সংকটে মানুষ বেঁচে থাকে তাঁর আশাকে অবলম্বন করেই। নৈরাশ্যের পীড়নকাঠি অধিক তৎপর হয়ে উঠলে মানুষ যাপনের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। সুতরাং একজন পাঠক চাইতেই পারেন– হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় তিনি একটি কবিতা পড়ে শক্তি সঞ্চয় করবেন। এরকম ঘটনা আদৌ ঘটে কি না আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। তবে এটুকুতে আমরা নিশ্চিত যে পাঠকের তেমন অনুভূতি প্রাপ্তির আশায় কবিতার কাছে যাবার অধিকার আছে। আর ‘রাত্রিশেষ’ তেমন পাঠককে বিমুখ করবে না– এ বিষয়ে আমরা একশত ভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করে রাখতে চাই। কারণ ‘প্রথম কাব্যগ্রন্থেই [‘রাত্রিশেষ’-এ] তিনি নৈরাশ্য অতিক্রমী আশার সুর আমাদের শুনিয়েছেন।’ ((তুষার দাশ : নিঃশব্দ বজ্র : আহসান হাবীবের কবিতা, ১৯৮৫, ঢাকা))
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১৭ comments
মুজিব মেহদী - ৬ অক্টোবর ২০০৯ (৩:০৭ অপরাহ্ণ)
হায়! লেখাটি দেখা যাচ্ছে না কেন?
আমার দিক থেকে প্রকাশে কোনো সমস্যা হলো নাকি মডারেশন টিমের আবশ্যিক দায়িত্ব পালনের শর্তে লেখাটিকে পোস্ট থেকে সাময়িককাল বা চিরকালের জন্য সরানো হয়েছে, তা ঠিক বুঝতে পারছি না!
মুক্তাঙ্গন - ৬ অক্টোবর ২০০৯ (৩:২১ অপরাহ্ণ)
সমস্যাটা কারিগরি মনে হচ্ছে, আমাদের দিক থেকেই সম্ভবত। সমাধানের চেষ্টা চলছে।
মুক্তাঙ্গন - ৬ অক্টোবর ২০০৯ (৪:০৩ অপরাহ্ণ)
সমাধান হল অবশেষে। সমস্যার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
মুজিব মেহদী - ৬ অক্টোবর ২০০৯ (৯:৩৯ অপরাহ্ণ)
একটু উদ্বিগ্ন ছিলাম।
সামলে আনা গেছে দেখে এখন স্বস্তি বোধ করছি।
মাহবুব কবির - ৬ অক্টোবর ২০০৯ (৫:২৯ অপরাহ্ণ)
প্রিয় মুজিব ভাই,
অসাধারণ লেখা! একটানে শেষ করলাম। এরপর ভাবলাম, কী অন্যায়টাই না করলাম! আবারও পড়ব! অভিবাদন!
মুজিব মেহদী - ৬ অক্টোবর ২০০৯ (৯:৫১ অপরাহ্ণ)
এত বড়ো লেখাটা একবার পড়লেন, আবারও পড়বেন শুনে নিজের দিক থেকে খুব অপরাধবোধে ভুগছি। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানবেন।
অফটপিক : আপনি বোধকরি দিনকয় আগে আয়ারল্যান্ডে চলে গেলেন, তাই না? মাসকয় আগে শুনেছিলাম আপনি এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। কিন্তু ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে চলেও যাবেন, তা ভাবি নি। আপনার চলে যাবার পরে ফয়সাল ভাইয়ের কাছে ঘটনাটা শুনলাম। কতদিন পরে আবার সামনাসামনি আপনাকে দেখব?
সদাই ভালো থাকুন।
রায়হান রশিদ - ৬ অক্টোবর ২০০৯ (৬:৩২ অপরাহ্ণ)
যুগ আর সময়ের এমন পরিক্রমা যেদিন প্রতিটি ব্লগের প্রতিটি পোস্টে উঠে আসতে শুরু করবে সেদিনকার কথা ভাবতে পারেন মুজিব ভাই? একবার পড়লাম, মাহবুবের মতোই এক নিঃশ্বাসে। আবার পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিস্তারিত আলোচনায় অংশগ্রহণের আশা রাখি।
অন্য প্রসঙ্গ:
এমন পরিশ্রম-সাধ্য একটা কাজ দাঁড় করানোর পর মুজিব ভাইকে আর কষ্ট দেয়ার মানে হয় না। মডারেশন টিমের কেউ যদি উদ্যোগ নিয়ে ফুটনোটগুলোর উপস্থাপন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসার কষ্টটুকু করতেন তাহলে লেখাটা আরও সুখপাঠ্য হোতো মনে হয়।
মুজিব মেহদী - ৬ অক্টোবর ২০০৯ (১০:১৯ অপরাহ্ণ)
এই লেখাটা এগিয়েছেই সময়কে ধরে। কাব্য বিশ্লেষণেরই এটি একটি বিশেষ ধরন আপনি জানেন, যে ধরনটি অনেকের কাছে অপ্রিয়ও। তবে সময়কে পাশে রেখে সে সময়ে রচিত সাহিত্যকে দেখার সুবিধা এই যে, এজন্য সাহিত্য বিষয়ে পাণ্ডিত্য না-থাকলেও চলে। ভিতরের খবর আমার কম জানা বলেই বোধকরি বাইরেটা নিয়েই এ পন্থায় কথা বলবার চেষ্টা করেছি। অবশ্য সব কবিকে এভাবে দেখা তাঁদের প্রতি সুবিচার না-ও হতে পারে। তবে এটা বলতে পারি যে, আহসান হাবীবকে এভাবে দেখায় তাঁর প্রতি অবিচার হয় নি।
আলোচনায় আপনার অংশগ্রহণ আমাকে আনন্দিত করবে।
না রায়হান ভাই, ঠিক এ সময়ে আমি লেখাটি তৈরি করি নি যে পরিশ্রান্ত হয়ে আছি এ দোহাই দিয়ে কোনোভাবে পার পেতে পারি। লেখাটি বছর দশেক আগে তৈরি হয়েছিল একটি ছোটকাগজের জন্য।
আমি আসলে স্বয়ংক্রিয় কায়দায় ব্লগে ফুটনোট ব্যবহার করতে জানিই না। কেবল পোস্ট করবার সময় যা কিছু বানানবিভ্রাট ছিল, পুরোটা আবার পড়ে তা ঠিক করে নিলাম। সাধ্যাতীত না-হলে ওটাও করতাম।
মুক্তাঙ্গন - ৭ অক্টোবর ২০০৯ (৪:২৯ পূর্বাহ্ণ)
ফুটনোট যুক্ত করা আসলেই বেশ সহজ। সাহায্য পাতার ৪-নম্বরে বিস্তারিত। পোস্টের মূল টেক্সট এর যে স্থানে ফুটনোট যুক্ত করতে চান সেখানে এসে পৌঁছুলে যে টেক্সটটুকু ফুটনোটভুক্ত করতে চান সেটির শুরুতে ‘((‘ , এবং শেষে ‘))’ বসিয়ে ফুটনোট-টুকু লিখে ফেললেই হল [উদ্ধৃতি চিহ্ন বাদ দিয়ে অবশ্য]। স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল টেক্সট-এ ক্রমিক নম্বরসহ ফুটনোটটি যুক্ত হয়ে যাবে।
মুজিব মেহদী - ৭ অক্টোবর ২০০৯ (৯:১২ পূর্বাহ্ণ)
জানা হলো, করা হলো। আর করতে করতে হলো শেখাও।
করতে করতে শেখা ব্যাপারটা চমৎকার। আর এ ধরনের অর্জনের স্থায়িত্বও বেশি। মানুষ যা কিছু করতে পারে তার বেশিরভাগই সম্ভবত আগে শিখে তারপর করা নয়, বরং করতে করতে শেখা।
মুক্তাঙ্গন - ৭ অক্টোবর ২০০৯ (৩:২৫ অপরাহ্ণ)
অনেক ধন্যবাদ।
রেজাউল করিম সুমন - ৭ অক্টোবর ২০০৯ (৮:০০ অপরাহ্ণ)
১
আহসান হাবীবের রাত্রিশেষ (১৯৪৭) কাব্যগ্রন্থের একটি নিবিড় পাঠ (বা চুলচেরা বিশ্লেষণ) উপস্থাপনের জন্য মুজিব মেহদীকে অজস্র ধন্যবাদ। কবিতাপাঠক হিসেবে ঋণী হয়ে রইলাম তাঁর এই লেখার কাছে।
চল্লিশের উত্তাল সমাজপট ও সে-সময়ের কবিদের উল্লেখের সূত্রে অরুণ সেনের একটি বইয়ের কথা মনে পড়ছে — কবিতার দায় কবিতার মুক্তি (প্রতিক্ষণ, ১৯৮৫)। ‘চল্লিশের পঞ্চাশের কবিতা’ নামেই একটা প্রবন্ধ আছে সে-বইটিতে, অন্য প্রবন্ধগুলো হলো ‘কবিতার দায় কবিতার মুক্তি’, ‘গ্রহণে বর্জনে’, ‘সহজ আশা কঠিন আশা’, ‘শিল্পের আলো অন্ধকারের শিল্প’ এবং ‘রাজনীতি ও কবিতার ভুলভ্রান্তি’। অরুণবাবু কথাপ্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন, ওই প্রবন্ধগুলো লেখার সময়ে তিনি অনেক ‘কট্টর’ ছিলেন, এখন আগের চেয়ে ‘লিবারাল’।
২
আহসান হাবীবের ‘কোনো বাদশা’যাদীর প্রতি’ কবিতাটি সংগত কারণেই অনেক পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলবে। মুজিব ভাইও লিখেছেন :
তার অল্প পরেই তিনি জানাচ্ছেন:
কবিতার নায়ক ‘হারু মিয়ার বস্তি’বাসী লোকটি যে আমাদের চোখে ‘একজন বদলোক’, উপরন্তু ‘অসৎ’ ধার্মিক — তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এরকম অনেকের সঙ্গেই কি আমরা প্রত্যেকেই পরিচিত নই যারা কেবল ‘কোনো কোনোদিন’ ধার্মিক? এ কবিতাটিকে যদি তেমনই একজনের বয়ান হিসেবে দেখি (আর সেভাবে দেখাই তো বোধহয় সংগত) তাহলেও কি খুব বেশি আপত্তি করার সুযোগ থাকে?
৩
এই প্রবন্ধটি মুজিব ভাই লিখেছিলেন বছর দশেক আগে। সেই আদিলেখন সম্ভবত অবিকলই ছাপা হলো এখানে। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন :
২০০৯-এ দাঁড়িয়ে জেনে নিতে ইচ্ছে করে, ‘নব্বই দশকের কবিতার মূল প্রবণতা’কে এখন তিনি কীভাবে চিহ্নিত করেন। উত্তর আধুনিকতাকে যেভাবে মার্ক্সবাদ-বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন রতন খাসনবিশ (ও আরো কেউ কেউ) – তার যৌক্তিকতা/ অযৌক্তিতার বিষয়টি এ প্রবন্ধে সংগত কারণেই আলোচিত হয়নি। কিন্তু বলাইবাহুল্য, সে-বিষয়েও আমাদের কৌতূহল থেকে যাচ্ছে।
মুজিব মেহদী - ৯ অক্টোবর ২০০৯ (৪:৫৩ অপরাহ্ণ)
প্রিয় রেজাউল করিম সুমন,
আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে, দাপ্তরিক ও পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে আপনার ৭ অক্টোবরের মন্তব্যের জবাব বেশ দেরিতে ৯ অক্টোবরে দেবার প্রয়াস করছি।
১.
অরুণ সেনের কবিতার দায় কবিতার মুক্তি (প্রতিক্ষণ, ১৯৮৫) গ্রন্থটি এ প্রবন্ধটি লিখবার সময় হাতের কাছে ছিল না, পরে সংগ্রহ করতে পেরেছি। গ্রন্থটি এ লেখা লিখবার ক্ষেত্রে ভালো রেফারেন্স হতে পারত।
২.
আপনি ‘হারু মিয়ার বস্তি’বাসী লোকটিকে যেভাবে দেখতে চান, সেভাবেও দেখা চলে। ‘কোনো কোনোদিন ধার্মিক’রাও যেহেতু বদলোকই বটেন!
৩.
নব্বইয়ের কবিতার মূল প্রবণতা উত্তর আধুনিকতার দিকে বেগবান বলে যে ধারণা আমি বছর দশেক আগে করেছিলাম, তখনই সে দশক, বলতে কী, ফুরিয়েছে। পরে সে সময়ের কবিরা, যাঁরা অন্তত সক্রিয়, কবিতা লিখেছেন বা লিখছেন শূন্য দশকে এসে। শূন্যের স্থায়ী বাসিন্দা এবং নব্বইয়ের অভিযাত্রী কবিকুল মিলে শূন্যে এসে যেসব কবিতা লিখিত হয়েছে ও হচ্ছে, সেগুলোও মোটাদাগে একই প্রবণতা ধরে। তবে তাকে ওই এক নামে চেনানো মুশকিল হবে। একই যুগপর্বের এই লক্ষণ এখানে পোস্টমডার্ন, অধুনান্তিকতা, উত্তর আধুনিকতা ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত।
প্রকৃতপ্রস্তাবে, বিশেষ আর্থ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবস্থার ভিতর দিয়ে এসে মানুষের মানসপ্রবণতা বদলে যায়। এ বদলগুলো ঘটতে থাকে ধীরে ধীরে ক্ষীণ ধারায়, যা আকস্মিক কোনো চ্যুতি নয়, বরং ক্রমবিকাশশীল পরিপূরকতা। এটি বড়ো কোনো আকার ধারণ করতে অনেক দীর্ঘ সময় নেয়। এই একেকটা যুগপর্বই শিল্প-সাহিত্যে আলাদারকম ছাপ ফেলে। প্রাগাধুনিক যুগপর্বের ঈশ্বর, অদৃষ্ট ও প্রকৃতিবিশ্বাস যেভাবে আধুনিক যুগপর্বে এসে যুক্তিবাদিতা (ঈশ্বরহীনতা), ব্যক্তিস্বাধীনতা ও উদারনৈতিক চেতনায় রূপ পরিগ্রহ করে; সেভাবেই উত্তর আধুনিক যুগপর্বে এসে তাকে আবশ্যিকভাবেই বদলে যেতে হয়েছে। এটি স্বাভাবিকভাবেই ঘটে, যে ঘটনটা শনাক্তকৃত হয় পরে। এভাবেই শনাক্ত করা গেছে যে, প্রাগাধুনিক যুগের ভক্ত আমি, আধুনিক যুগের যুক্তিনিষ্ঠ আমি হয়ে উত্তর আধুনিক যুগের আমি চূর্ণ চূর্ণ হয়ে সীমাহীন বিবিধতায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এ সময়ের কবিতা পরিপূরকতা, বহুরৈখিকতা ও বিদিশার প্রতি নির্ভরতা রক্ষা করে চলে, যেজন্য জটিলতা তার অন্তর্সম্পদ হয়ে উঠেছে। এ অবস্থাটা ঘটেছে বিশ্বব্যাপী, তবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে, উন্নত বিশ্বে। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের দেশ হলেও এখানে এই ধারার চর্চা হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকার তাত্ত্বিকদের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত কবিকুল এবং বাংলাভাষায় এ তত্ত্বের মধ্যস্থতাকারী মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী, জহরসেন মজুমদার, প্রভাত চৌধুরী, রুদ্র কিংশুক প্রমুখগণ ও তাঁদের ভক্ত অনুসারী কবিকুল কর্তৃক। এ ধারাকে পোস্টমডার্ন, অধুনান্তিকতা ইত্যাদি নামে ডাকা হয়।
এই স্বাভাবিকতার পাশে সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে প্রকল্পিত আরেকটি সচেতন উত্তর আধুনিকতার ধারা ভারত ও বাংলাদেশে প্রবহমান, যেটি ঐতিহ্যসন্নিষ্ঠ দেশজ ধারা। ভারতের উত্তরসূরী, গাঙ্গেয়পত্র, আলোচনাচক্র, লালনক্ষেত্র, সাম্প্রত, শব্দশাব্দিক প্রভৃতি কাগজ এবং বাংলাদেশের লিরিক, একবিংশ, প্রান্ত প্রভৃতি কাগজ মিলে এই ধারার বিকাশ। তত্ত্বটির জন্ম ভারতে হলেও পরে সমভাবে এখানেও বিকশিত। এ ধারা প্রথমোক্ত ধারার উত্তর আধুনিক (অধুনান্তিক) কবিতাকে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বোধ্য, চিন্তা ও উদ্দেশ্যহীন, বিষয়কেন্দ্রহীন, যুক্তিশৃঙ্খলারহিত, প্রতিমানবিক আখ্যা দিয়ে বাংলা কবিতাকে ফিরতে বলেছে ‘মহাজন পদাবলী আর রামপ্রসাদের কবিতায়, শ্রীধর কথক আর নিধুবাবুর গানে’। কারণ এর প্রবক্তাগণ সেই আধুনিকতাকে মানেন না যার ভিত্তি ঔপনিবেশিক, কাজেই তার পরম্পরাবাহিত হয়ে জাত উত্তর আধুনিকতায়ও তাঁদের অনাস্থা জারি হয়েছে। অভিতাভ গুপ্ত, অঞ্জন সেন, উদয় নারায়ণ সিংহ, তপোধীর ভট্টাচার্য, এজাজ ইউসুফী, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, জিললুর রহমান, হাফিজ রশিদ খান প্রমুখের হাতে আদলপ্রাপ্ত স্থানীয় উত্তর আধুনিকতা যেসব কবিতাকে নিজের করে চিনিয়েছে সেসবের লক্ষণ ঐতিহ্যসংলগ্নতা, দেশ-কাল-লগ্নতা, সদর্থক চেতনার আশ্রয়, মননশীল কাব্যবীক্ষা, ঐতিহ্যের সংশ্লেষণ, প্রত্যন্ত অঞ্চলের কবিদের সৃষ্টিশীলতার স্বীকৃতি ইত্যাদি বলে আমরা চিনেছি।
এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে (বা অন্য কোথাও) মার্ক্সবাদের সাথে এর সংঘাতের জায়গাগুলো (যদি থাকে) একে একে চিনে নেয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে আলোকপাত করতে কেউ কি একটু হাত লাগাবেন দয়া করে?
রেজাউল করিম সুমন - ১১ অক্টোবর ২০০৯ (৭:১৪ অপরাহ্ণ)
১
মুজিব ভাই, অনেক ধন্যবাদ এই দীর্ঘ উত্তরের জন্য। (মাত্র একদিন সময় আপনি বেশি নিয়েছেন! কোনোরকম ‘দাপ্তরিক ও পারিবারিক ব্যস্ততা’ ছাড়াই অনেক সময়ে উত্তর দিতে বিশ্রী রকম দেরি করে ফেলি। অবশ্য বলা বাহুল্য, ব্লগের ক্ষেত্রেও আপনার মতো দায়িত্ববান নই আমি। আমাদের সময়জ্ঞানও তাই আলাদা! আবার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও গতকাল ব্লগ পড়ার সময় পাইনি। যাই হোক, প্রত্যুত্তর দিতে দেরি হওয়ায় আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।)
পোস্টমডার্ন, অধুনান্তিক, উত্তর আধুনিক বাংলা কবিতা বিষয়ে অল্প পরিসরে চমৎকার আলোচনা পেয়ে গেলাম। কয়েক ধারার কবিদের মধ্যে মত-পথের বিভিন্নতার কথাও অল্পস্বল্প জেনেছি নানাজনের লেখালেখি আর একাধিক সংকলনের সূত্রে। উত্তর আধুনিক যুগপর্বে রচিত এবং উত্তর আধুনিক ভাবনায় জারিত লেখা – উভয় বর্গের রচনাই নিশ্চয়ই উত্তর আধুনিক সাহিত্যের আলোচনায় প্রাসঙ্গিক।
২
আহসান হাবীবের কবিতা থেকে অনেক দিন দূরে ছিলাম। আপনার লেখার প্রণোদনায় আবারও যাওয়া যাবে তাঁর কবিতার সান্নিধ্যে। মুজিব ভাই, আবারও ধন্যবাদ আপনাকে।
তানবীরা - ৪ নভেম্বর ২০০৯ (৬:০১ পূর্বাহ্ণ)
মুক্তাঙ্গনে কোন লেখা নিজের ব্লগে যুক্ত করার ব্যবস্থা আছে কি? আমি খুঁজে পেলাম না। থাকলে জানতে আগ্রহী। এ ধরনের লেখা সংগ্রহে রাখার জন্য।
মুজিব ভাই, লেখাটা কয়েকটা ভাগে ভাগ করে দিলে, আমার মতো সাধারণ প্রকৃতির লোকজনদের জন্য ভালো হতো। শুধু লেখার গুনেই পড়ে নিলাম।
এতো পরিশ্রামসাধ্য লেখার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
ব্লাডি সিভিলিয়ান - ২৫ নভেম্বর ২০০৯ (৫:৩০ অপরাহ্ণ)
লিখতে মহা সমস্যা হচ্ছে। আমি বিজয়-এ অভ্যস্ত। আমার উপায় কী? কত কথা মনে গুঞ্জরিয়া োঠে। কিভাবে প্রকাশ করি? সুমন ভাই, দয়ধ্বম!
@ মুজিব মেহেদী: চমৎকার। দুএকটি বানান ভুল আছে।
ইত্যাদি। আর ভুল শব্দপ্রয়োগ-`উপরোল্লিখিত’। আশা করবো এমন অারো অনেক লেখার। জয়তু।
ব্লাডি সিভিলিয়ান - ২৫ নভেম্বর ২০০৯ (৫:৪৩ অপরাহ্ণ)
@ ব্লক-মডারেটর: Ctrl+g দিয়ে কোনোভাবেই বাংলা লিখতে পারলাম না। সাহায্য করবেন কি?