মহাশ্বেতা দেবীর চলে যাওয়ার সংবাদে কেন জানি প্রথমেই মনে হলো, ‘হাজার চুরাশির মা’-এর কথা... আবার পরক্ষণেই খালেদ চৌধুরীর আঁকা ওই বইয়ের প্রচ্ছদটি কেমন এক জলস্রোতে ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠল নবারুণের মুখ। [. . .]

মহাশ্বেতা দেবীর চলে যাওয়ার সংবাদে কেন জানি প্রথমেই মনে হলো ‘হাজার চুরাশির মা’-এর কথা... আবার পরক্ষণেই খালেদ চৌধুরীর আঁকা ওই বইয়ের প্রচ্ছদটি কেমন এক জলস্রোতে ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠল নবারুণের মুখ। নবারুণের মৃত্যুর পর কলকাতার কোনও এক পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি, ‘আমাকে দুনিয়া হয়তো একজন নিষ্ঠুর মা হিসেবেই দেখবে।’ নিষ্ঠুরই কি? যাঁর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ‘হাজার চুরাশির মা’ হিসেবে, তাঁকে কেন এই পৃথিবী দেখতে যাবে নিষ্ঠুর মা হিসেবে? নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা এই ছোট্ট উপন্যাস আমাদের কেবল যে ওই আন্দোলনকেই নতুন করে চিনিয়েছিল, কেবল যে ওই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষগুলোর পরিবার-পরিজন আর কাছের মানুষের প্রতিপক্ষ-সময়কে অনুভব করিয়েছিল, তা তো নয় – আমরা মহাশ্বেতা দেবীকেও চিনেছিলাম নতুন করে। ইনি সেই মহাশ্বেতা নন যিনি কেবল আদিবাসীদের সঙ্গে নিজের জীবনের সুখ-দুঃখ গেঁথে নিয়েছেন। ইনি সেই মানুষ – যিনি তাঁর সমসময়ের তারুণ্যের দীর্ঘ যাত্রা আর প্রলম্বিত রক্তপাতকেও নিজের কপালের টিপ করে তুলেছেন। তাই সেই দেবী যখন কোনও এক সময় লেখেন, ‘হাজার চুরাশির মা’র ‘ব্রতীর শৈশবচিত্র তো আমার ছেলে নবারুণেরই শৈশবচিত্র’ – তখন এই কথা থেকে উপন্যাসটি সম্পর্কেও চিন্তার নতুন দিগন্ত খুলে যায়। নবারুণও বিখ্যাত হয়েছিলেন, মার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও ছিল আন্তরিক, কিন্তু তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল আগেই। দুই বছর আগে এই জুলাই মাসেই চলে গিয়েছিলেন তিনি। মহাশ্বেতাও চলে গেলেন প্রায় একই সময়ে। ঢাকাতে জন্ম – এই অর্থে ঢাকার মেয়ে তাঁকে আমরা বলতেই পারি। কিন্তু তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের – কেবল বাঙালির নন, কেবল ভারতের নন, সেই যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন না – ‘যেথায় থাকে দীনের অধম, দীনের থেকে দীন, সেইখানেতে চরণ তোমার রাজে...।’ মহাশ্বেতার চরণ গিয়ে পৌঁছেছিল শবরের ঘরে, সাঁওতালের ঘরে – বঞ্চিত লাঞ্ছিত সকল আদিবাসীর ঘরে। এ বিশাল ভারতবর্ষের সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সঙ্গে চলতে চলতে তিনি বাঙালিত্বের যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে গেছেন, বাঙালিত্বের মনুষ্যত্ববোধকে যে পর্যায়ে উন্নীত করে গেছেন – তা হয়তো জাতিত্ববোধের ভারে ন্যুব্জ আমরা সারা জীবনেও বুঝতে পারব না। ‘ঝাঁসীর রাণী’ লিখতে গিয়ে নিজের জীবনের গতিপথও পাল্টে ফেলেছিলেন। ছোট্ট ছেলেকে বাবার কাছে রেখে সেই যে ঝাঁসী-গোয়ালিয়রে গিয়েছিলেন, তার পর ফিরলেও ঘর আর তাকে পারেনি বেঁধে রাখতে। ‘অরণ্যের অধিকার’-এর ভূমিকার কথা মনে পড়ছে;…

ওয়ালীউল্লাহ ‘অমীমাংসিত’ পর্ব ছাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন; সত্যি কথা বলতে গেলে, তিনি তো মীমাংসার পরিধিতে দাঁড়িয়েই লিখতে পেরেছিলেন ওই গল্প। [. . .]

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের স্মৃতিচারণায় পাই, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম গল্প তিনিই ছাপেন। মাসিক সওগাতে ১৩৪৮ সনের পৌষে (নভেম্বর–ডিসেম্বর, ১৯৪২) প্রথম প্রকাশ পায় সেই গল্প। অনেক বছর ওই ধারণাই ছিল আমাদের, ‘চিরন্তন পৃথিবী’ নামের সেই গল্পই তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প। কিন্তু তার পর উদঘাটিত হয়, এর আগেও গল্প লিখেছেন তিনি; ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়ার সময় থেকেই সাহিত্যচর্চায় জড়িয়ে পড়েন তিনি, ১৯৩৯ সালের কলেজ বার্ষিকীতে প্রকাশ পায় তাঁর গল্প ‘সীমাহীন এক নিমেষ’। লেখাই বাহুল্য, প্রধানত ‘লালসালু’ উপন্যাসের কারণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা দেয় এবং তা ক্রমশই বাড়তে থাকে – এমন নয় যে, গবেষকদের কারণে পাঠকের কাছে নতুন করে উদ্ভাসন ঘটেছে ওয়ালীউল্লাহর। বরং পাঠকদের উৎসাহই বোধকরি গবেষকদের অনুপ্রাণিত করেছে তাঁর কর্মযজ্ঞকে নতুন করে খুঁজে দেখতে। এইভাবে গত কয়েক দশকে গবেষক ও পাঠকদের সম্মিলিত অনুসন্ধিৎসার মধ্য দিয়ে ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য এসেছে আমাদের সামনে। এসেছে তাঁর প্রকাশিত-অপ্রকাশিত নতুন নতুন লেখাও। কোনো কোনো একই লেখার দুই-তিন সংস্করণ আমাদের গবেষক ও লেখকদের তাঁর রচনাকৌশল ও রচনাশৈলী সম্পর্কে চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে। এমনকি তাঁর একটি

গল্প ‘না কান্দে বুবু’কে আবদুল মান্নান সৈয়দ যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, তাতে আমাদের মধ্যে এমন চিন্তাও জন্ম নেয়, ষাটের দশকে পশ্চিম বাংলায় যে শাস্ত্রবিরোধী গল্প-আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল, সুব্রত সেনগুপ্ত, রমানাথ রায়, বলরাম বসাক, শেখর বসু, কল্যাণ সেন প্রমুখ ছিলেন যে স্রোতধারার লেখক, সেই আন্দোলনের ভিত্তিভূমি তৈরি করে গেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। শব্দ ও বাক্যের আবৃত্তি-পুনরাবৃত্তি, স্বগতকথন, আঞ্চলিক সংলাপ ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়ে ‘না কান্দে বুবু’ গল্প এগিয়ে গেছে; লেখার এই ভঙ্গিটিকে লক্ষ করে আবদুল মান্নান সৈয়দ মন্তব্য করেছিলেন, ষাটের দশকের শাস্ত্রবিরোধী গল্পকাররাও ‘শব্দের ও বাক্যের অবিরল আবৃত্তি-পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে’ নতুন একটি কাঠামো দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। অবশ্য শাস্ত্রবিরোধী গল্পকারদের ওপর ওয়ালীউল্লাহর এই প্রভাব কতটুকু পরিব্যাপ্ত হয়েছিল কিংবা ওয়ালীউল্লাহ নিজেই বা তাঁর গল্পসমূহে শব্দের ও বাক্যের অবিরল আবৃত্তি-পুনরাবৃত্তিকে কতটুকু ধারণ করেছেন, তা নিয়ে এখনও কোনও কাজ হয়নি। তাই আমাদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি এ সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট উপসংহারে পৌঁছানো। তবে এটি বলার জন্যে বোধকরি এই পর্যবেক্ষণটুকুই যথেষ্ট যে, পূর্ব বাংলায় কথাসাহিত্যে সচেতন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্ম ওয়ালীউল্লাহর হাতে। তাই কালপ্রবাহে নিজের সময়কে তিনি কীভাবে দেখতেন, সমসাময়িক লেখায়…

৫ জানুয়ারির নির্বাচন শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মেরুকরণ সুস্পষ্ট করে তোলেনি, পরাশক্তিগুলোর ভূমিকাও বিন্যস্ত করেছে নতুন করে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে সহিংসতার মধ্য দিয়ে একটি বিতর্কিত নির্বাচনপদ্ধতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে গত কয়েক মাসে অসংখ্য হত্যার পাশাপাশি ৩৫ হাজার কোটি টাকার ধ্বংসস্তূপ তৈরি করে একটি মূল্যহীন নির্বাচনকে ‘বড় বেশি’ মূল্যবান করে তুলেছে নির্বাচনবিরোধী বিরোধী দলগুলো। [...]

৫ জানুয়ারির নির্বাচন শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মেরুকরণ সুস্পষ্ট করে তোলেনি, পরাশক্তিগুলোর ভূমিকাও বিন্যস্ত করেছে নতুন করে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে সহিংসতার মধ্য দিয়ে একটি বিতর্কিত নির্বাচনপদ্ধতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে গত কয়েক মাসে অসংখ্য হত্যার পাশাপাশি ৩৫ হাজার কোটি টাকার ধ্বংসস্তূপ তৈরি করে একটি মূল্যহীন নির্বাচনকে ‘বড় বেশি’ মূল্যবান করে তুলেছে নির্বাচনবিরোধী বিরোধী দলগুলো। নির্বাচন কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত হয়ে পড়ে মোটামুটিভাবে তিনটি ভাগে; যেগুলোর একটিতে রয়েছে ‘সেক্যুলার’ কিংবা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শক্তি হিসেবে ধর্মীয়-মৌলবাদী-জাতীয়তাবাদী ডানপন্থী রাজনৈতিক শক্তির কাছে অভিযুক্ত ডানপন্থী আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি বাম-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, সামরিক শাসনকালীন সময়ে গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি এবং কয়েকটি ধর্মবাদী দল। এ ধারার প্রত্যক্ষ প্রতিপক্ষ হল নির্বাচন বর্জনকারী ধর্মীয়-মৌলবাদী-জাতীয়তাবাদীদের ডানপন্থী রাজনৈতিক জোট, যেটির মধ্যমণি বা নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। এর বাইরে রয়েছে আরেকটি ক্ষীণ রাজনৈতিক স্রোতধারা, যেটিতে অবস্থান করছে বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক দল। এই ধারায় সংঘবদ্ধভাবে নির্বাচন বর্জনকারীদের সারিতে রয়েছে সিপিবি-বাসদের ঐক্যজোট– যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির সূত্রে বিএনপিসহ বিভিন্ন ধর্মবাদী-মৌলবাদী-জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে অভিন্ন অবস্থানে থাকলেও, মৌলবাদী রাজনীতির বিরোধী হওয়ায় ঐক্যবদ্ধ কিংবা যুগপৎ আন্দোলন থেকে দূরে ছিল। তা ছাড়াও রয়েছে কয়েকটি বামপন্থী দল– যারা তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির কারণে নয়, বরং নীতিগত কারণেই যে কোনো নির্বাচন বর্জন করে থাকে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তাদের সে সিদ্ধান্তের ব্যত্যয় ঘটেনি। ২ সুশীল সমাজের বিভিন্ন প্রতিনিধি গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে ‘নির্বাচনের পদ্ধতিগত বিতর্ক’ হিসেবে চিহ্নিত ও সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছে। তাই নির্বাচন বর্জনকারীরা ভবিষ্যতে যুদ্ধাপরাধী বিচারের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করার হুমকি দিলেও, বর্জনকারীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের প্রতিনিধিত্বশীল কোনো কোনো ব্যক্তি সে সম্পর্কে নিরব থেকেছেন। দেশজুড়ে গাছকাটার নৃশংস উন্মত্ততা চললেও গাছের গোড়া জড়িয়ে ধরে কাঁদতে সক্ষম কোনো সুশীলকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির সিদ্ধান্ত (পরে যা কার্যকরও হয়েছে) ঘোষণার পর তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার জন্যে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মীদের দৃষ্টিকটূ তৎপরতা দেখা গেলেও, বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় ঘোষণার পর তাদের কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। যে কোনো প্রাণদণ্ডের বিরুদ্ধে বলে দাবি করলেও তারা আসলে কখন সক্রিয় হন, কখন চুপ মেরে যান তা এখান থেকেই বোঝা সম্ভব। নির্বাচন কিংবা…

সুফিয়া কামালের জন্ম হয়েছিল আলোর জন্যে প্রতীক্ষারত অন্ধকারাচ্ছন্ন উপনিবেশে। ঔপনিবেশিকতার ওই অন্ধকার ঘিরে রেখেছিল কেবল নারীকে নয়, পুরুষকেও। অন্ধকার ঘিরতে চেয়েছিল সুফিয়াকেও। [...]

সুফিয়া কামালের জন্ম হয়েছিল আলোর জন্যে প্রতীক্ষারত অন্ধকারাচ্ছন্ন উপনিবেশে। ঔপনিবেশিকতার ওই অন্ধকার ঘিরে রেখেছিল কেবল নারীকে নয়, পুরুষকেও। অন্ধকার ঘিরতে চেয়েছিল সুফিয়াকেও। যদিও অভিজাত পরিবারের কন্যা ছিলেন, আর সাত বছর বয়সে উকিল বাবাকে হারানোর পর বারো বছর বয়সে যাঁর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সেই সৈয়দ নেহাল হোসেন ছিলেন উদার মানুষ। সাহিত্যচর্চা আর সমাজসেবায় সুফিয়াকে তিনি প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। সুফিয়া বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন আভিজাত্যের অন্ধকার থেকে, তিনি তাঁর সেই আকাঙ্ক্ষার সহযোগী হয়েছিলেন। কিন্তু পারিপার্শ্বিকতা তাঁকে যত অনুপ্রাণিতই করুক না কেন, সমাজ ও রাজনীতিতে রাজত্ব করছিল অন্ধকারই -- সে রাজত্বে গড়পড়তা সব মেয়েরই বিয়ে হত বাল্যকালেই, ব্যতিক্রম ছিলেন না সুফিয়াও। তবে তিনি সৌভাগ্যবতী, বাল্যবিয়ে হলেও শিক্ষার সংস্পর্শে থাকতে পেরেছিলেন, বাড়িতে উর্দুর চল থাকলেও বাংলা শিখেছিলেন, স্বামী তাঁকে বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের প্রতি উৎসাহী করে তুলেছিলেন, সাহিত্য ও সাময়িক পত্রপত্রিকার সঙ্গে তাঁকে পরিচিত করে তুলেছিলেন, তিনি এই সহমর্মিতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন এবং নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন এমন এক রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগ্রামের জন্যে, যে-সংগ্রাম নারীকে শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেবে। সুফিয়া কামাল যে অন্যরকম একজন মানুষ হয়ে উঠলেন, তার একটি অন্যতর কারণ এই -- পারিপার্শ্বিক সহমর্মিতাকে তিনি তাঁর মহৎ কর্মযোগে কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি জানতেন সবার জীবন তাঁর মতো নয়, এরকম সহমর্মিতা কোনও নারীর জীবনে বিরল, তাদের জীবন ও ভাগ্য বাঁধা গড়পড়তা অন্ধকারে, সেই অন্ধকারে দু’-একজনের চারপাশ থেকে যত দ্যুতিই বিচ্ছুরিত হোক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাই সবাই মিলে আলোর দিকে যাত্রা করা, আলোর অভিযাত্রী হওয়া। তিনি যত বড় হয়েছেন, নিজেকে ততই নিয়োজিত করেছেন আলোর অভিযাত্রায়, অন্যান্যদেরও আহ্বান করেছেন আলোর অভিযাত্রী হতে। নিজের জীবনে পাওয়া সহমর্মিতার ওই মাধুর্যকে তিনি সর্বজনীন করে তোলার অভিপ্রায়ে কাজ করে গেছেন। প্রায় উপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসনামল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধউত্তর কি সামরিক কি বেসামরিক অগণতান্ত্রিকতার যে-নগ্ন শাসনে সবখানেই তিনি উচ্চকিত হয়েছেন আর তাঁকে কেন্দ্রভূমিতে রেখে উচ্চকিত হয়েছে বাংলার নারীরাও। এইভাবে সুফিয়া কামাল পথিকৃৎ হয়েছেন, হয়েছেন প্রেরণাদায়ী, এমনকি তিনি যখন আর সক্রিয়ভাবে রাজপথে নামতে পারেন না, তখনও আন্দোলনকারীরা জানতেন, ধানমন্ডির একটি বাড়িতে একজন মানুষ আছেন, তিনিও তাঁদের সঙ্গে আছেন, তাঁর সেই বাড়ি ছিল আন্দোলনকারীদের খোলা প্রান্তর। বাঙালি…

ত্রিশ-চল্লিশের দশকে ভাষা নিয়ে এক ঝড় উঠেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। শ্রেণি বিপ্লব হয়েছে, ক্ষমতায়ন ঘটেছে সর্বহারা শ্রেণির, চলছে রাষ্ট্র ও সমাজের সবকিছু ঢেলে সাজানোর কাজ। এরকম কর্মযজ্ঞের মধ্যে একদল ভাষাবিদ তুলে ধরলেন শ্রেণিভাষার ধারণা।...

ত্রিশ-চল্লিশের দশকে ভাষা নিয়ে এক ঝড় উঠেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। শ্রেণি বিপ্লব হয়েছে, ক্ষমতায়ন ঘটেছে সর্বহারা শ্রেণির, চলছে রাষ্ট্র ও সমাজের সবকিছু ঢেলে সাজানোর কাজ। এরকম কর্মযজ্ঞের মধ্যে একদল ভাষাবিদ তুলে ধরলেন শ্রেণিভাষার ধারণা। ভাষাকেও হয়ে উঠতে হবে শ্রেণির ভাষা,- এককথায় এটিই ছিল সে ঝড়ের মূল বার্তা। ঝড়ের সেই ঝাপটা স্পর্শ করে জোসেফ স্ট্যালিনকেও, যিনি ছিলেন তখন সেই প্রথম ও নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির নির্মাণযজ্ঞের প্রাণকেন্দ্রে। ভাষা সমাজের কোনো কাঠামোভুক্ত কি না, শ্রেণিভাষা হতে পারে কি না ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে ভাষাবিতর্কের এক পর্যায়ে স্ট্যালিনও অংশ নেন। ‘প্রাভদা’ পত্রিকায় ১৯৫০ সালে বিভিন্ন প্রশ্ন ও চিঠির উত্তরে জোসেফ স্ট্যালিন যা লিখেছিলেন, সেগুলো নিয়ে পরে ১৯৫২ সালে, বাংলা ভাষা আন্দোলনের বছরে, প্রকাশ পায় ‘ মার্কসিজম অ্যান্ড প্রবলেমস অব লিঙ্গুয়িস্টিক্‌স’ নামের গ্রন্থটি। ইংরেজি ভাষার পাঠকদের কাছে বইটি পৌঁছায় আরও দু বছর পর - ১৯৫৪ সালে। কালপর্বের হিসেবে সোভিয়েত রাশিয়ায় ভাষাবিতর্কের সময় বাংলাদেশেও (তৎকালীন পূর্ববঙ্গে) চলছে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। স্ট্যালিন এই রক্তঝরা আন্দোলন সম্পর্কে কী ভেবেছেন, জানা নেই আমাদের। তবে ভারতের অবমুক্ত হওয়া দুটি

কূটনৈতিক নথিপত্র থেকে এটুকু বোঝা যায়, সোভিয়েত রাশিয়ার ওই ভাষাবিতর্কের সময় স্ট্যালিন চেষ্টা করেছেন ভারত ও পাকিস্তানের ভাষাগুলি সম্পর্কে ধারণা পাবার। সোভিয়েত রাশিয়ার ওই ভাষাবিতর্ক তুলে ধরেছে এমন সব ধারণা ও প্রসঙ্গ, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাষাচিন্তায় এখনও অর্থবহ। শ্রেণি-অঞ্চল-অর্থনীতি-প্রযুক্তি-সমাজ ইত্যাদির বিভিন্ন পরিবর্তনের সূত্রে ভাষায় নতুন নতুন যে-সব উপাদান সঞ্চারিত হয়, সেগুলি নিয়ে প্রায়ই কৃত্রিম বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়, খণ্ডিত ভাবনা থেকে সেগুলিকে জনগোষ্ঠী ও পাঠকশ্রেণির ওপর চাপিয়ে দিয়ে আসলে ভাষার প্রাণপ্রবাহকেই শ্লথ ও রুদ্ধ করে দেয়া হয়। স্ট্যালিনের ওইসব লেখাগুলি প্রকাশের পর প্রায় ৬০ বছর পেরিয়ে গেলেও তাই সেগুলি প্রকাশের প্রেক্ষাপট, বিষয়বস্তু ও উপসংহার এখনও অর্থবহ। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাষাবিতর্ক স্ট্যালিনের নজরে আনেন জর্জিয়ান সেন্ট্রাল কমিটির প্রধান সম্পাদক ক্যানডিড শার্কভিয়ানী (Kandid Charkviani)। যার মাধ্যমে এই বিতর্ক শুরু হয়েছিল, সেই নিকোলাই ইয়াকভলেভিচ মার (১৮৬৪-১৯৩৪) অবশ্য অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন। কিন্তৃ ১৯২৪ সাল থেকে শুরু করে জীবনের শেষ পর্যন্ত নিকোলাই ইয়াকভলেভিচ মার (Nikolay Yakovlevich Marr) কাজ করে গেছেন ‘মার্কসীয় ভাষাবিজ্ঞানের’ কাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে। নিকোলাইয়ের ‘মার্কসীয় ভাষাবিজ্ঞান’ নিয়ে আপত্তি তোলায় ভাষাবিদদের অনেককেই হয়রানির…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.