সুফিয়া কামালের জন্ম হয়েছিল আলোর জন্যে প্রতীক্ষারত অন্ধকারাচ্ছন্ন উপনিবেশে। ঔপনিবেশিকতার ওই অন্ধকার ঘিরে রেখেছিল কেবল নারীকে নয়, পুরুষকেও। অন্ধকার ঘিরতে চেয়েছিল সুফিয়াকেও। যদিও অভিজাত পরিবারের কন্যা ছিলেন, আর সাত বছর বয়সে উকিল বাবাকে হারানোর পর বারো বছর বয়সে যাঁর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সেই সৈয়দ নেহাল হোসেন ছিলেন উদার মানুষ। সাহিত্যচর্চা আর সমাজসেবায় সুফিয়াকে তিনি প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। সুফিয়া বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন আভিজাত্যের অন্ধকার থেকে, তিনি তাঁর সেই আকাঙ্ক্ষার সহযোগী হয়েছিলেন। কিন্তু পারিপার্শ্বিকতা তাঁকে যত অনুপ্রাণিতই করুক না কেন, সমাজ ও রাজনীতিতে রাজত্ব করছিল অন্ধকারই — সে রাজত্বে গড়পড়তা সব মেয়েরই বিয়ে হত বাল্যকালেই, ব্যতিক্রম ছিলেন না সুফিয়াও। তবে তিনি সৌভাগ্যবতী, বাল্যবিয়ে হলেও শিক্ষার সংস্পর্শে থাকতে পেরেছিলেন, বাড়িতে উর্দুর চল থাকলেও বাংলা শিখেছিলেন, স্বামী তাঁকে বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের প্রতি উৎসাহী করে তুলেছিলেন, সাহিত্য ও সাময়িক পত্রপত্রিকার সঙ্গে তাঁকে পরিচিত করে তুলেছিলেন, তিনি এই সহমর্মিতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন এবং নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন এমন এক রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগ্রামের জন্যে, যে-সংগ্রাম নারীকে শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেবে।
সুফিয়া কামাল যে অন্যরকম একজন মানুষ হয়ে উঠলেন, তার একটি অন্যতর কারণ এই — পারিপার্শ্বিক সহমর্মিতাকে তিনি তাঁর মহৎ কর্মযোগে কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি জানতেন সবার জীবন তাঁর মতো নয়, এরকম সহমর্মিতা কোনও নারীর জীবনে বিরল, তাদের জীবন ও ভাগ্য বাঁধা গড়পড়তা অন্ধকারে, সেই অন্ধকারে দু’-একজনের চারপাশ থেকে যত দ্যুতিই বিচ্ছুরিত হোক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাই সবাই মিলে আলোর দিকে যাত্রা করা, আলোর অভিযাত্রী হওয়া। তিনি যত বড় হয়েছেন, নিজেকে ততই নিয়োজিত করেছেন আলোর অভিযাত্রায়, অন্যান্যদেরও আহ্বান করেছেন আলোর অভিযাত্রী হতে। নিজের জীবনে পাওয়া সহমর্মিতার ওই মাধুর্যকে তিনি সর্বজনীন করে তোলার অভিপ্রায়ে কাজ করে গেছেন। প্রায় উপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসনামল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধউত্তর কি সামরিক কি বেসামরিক অগণতান্ত্রিকতার যে-নগ্ন শাসনে সবখানেই তিনি উচ্চকিত হয়েছেন আর তাঁকে কেন্দ্রভূমিতে রেখে উচ্চকিত হয়েছে বাংলার নারীরাও। এইভাবে সুফিয়া কামাল পথিকৃৎ হয়েছেন, হয়েছেন প্রেরণাদায়ী, এমনকি তিনি যখন আর সক্রিয়ভাবে রাজপথে নামতে পারেন না, তখনও আন্দোলনকারীরা জানতেন, ধানমন্ডির একটি বাড়িতে একজন মানুষ আছেন, তিনিও তাঁদের সঙ্গে আছেন, তাঁর সেই বাড়ি ছিল আন্দোলনকারীদের খোলা প্রান্তর।
বাঙালি মুসলমান নারীর জন্যে শিক্ষার দরজা খুলে দিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন। সুফিয়া কামাল সেই দরজা পেরিয়ে নেমে পড়েন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামে। প্রায় ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালি যে-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগুতে থাকে, সে সংগ্রামে সুফিয়া কামাল সত্যি বলতে বাঙালি নারীর রাজনৈতিক ও সামাজিক অভ্যুদয়ই ঘটান। মধ্যবিত্ত নারীর আধুনিকতাকে তিনি যুক্ত করেন যৌথীকরণচিন্তার সঙ্গে এবং তার ফলে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত নারীরা প্রান্তিক নারীদের মুক্তির কথাও ভাবতে শেখেন, তাদের মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত হতে এবং যুক্ত করতে প্রয়াসী হন। নারীর রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্ষমতাকে তিনি উন্নীত করেন নতুন এক স্তরে, ফলে বাঙালি নারী খুঁজে পায় জীবনবোধের নতুন এক সংজ্ঞা, ব্যক্তিত্বের নতুন এক সংজ্ঞা। নারীর জন্যে তাঁর নেতৃত্বে সৃষ্টি হয় ক্ষমতায়নের নতুন এক পরিধি, ফলে নারীর সামাজিকীকরণের প্যাটার্নও পাল্টে যায়, পাল্টে যায় পারিবারিক সম্পর্কের এবং আত্ম-ভাবমূর্তি সৃষ্টির প্যাটার্ন। এখন অবশ্য অনেকেই এইসব কাজের কৃতিত্ব বিভিন্ন দারিদ্র্যবণিক ও তাদের দোকানপাটগুলোকে দিতে পারলেই খুশিতে আত্মহারা হন। কিন্তু সামাজিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে নিকৃষ্ট শিক্ষার্থীও জানেন, রাজনীতি পথ বেঁধে না দিলে ক্ষমতায়নের পথ কখনোই খোলে না। সুফিয়া কামাল এই কাজটিই করেছিলেন, তিনি নারীদের রাজনৈতিক অভ্যুদয়ের কাজে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন, নারীকে, বিশেষত গার্হস্থ্য মধ্যবিত্ত নারীকে রাজনৈতিকভাবে সক্ষম করে তুলেছিলেন।
বাবা সৈয়দ আবদুল বারী মারা যাওয়ার পর সুফিয়া কামাল বড় হয়েছেন বরিশালের শায়েস্তাগঞ্জে, নানাবাড়ির রক্ষণশীল কিন্তু অভিজাত পরিবেশে। কিন্তু ১৯১৮ সালে, সাত বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় যাওয়ার পর রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে পরিচয় ও সাক্ষাতের ঘটনা খুব গভীর থেকে তাঁকে পাল্টে দিতে শুরু করে, কলকাতা থেকে শায়েস্তাগঞ্জে ফিরে আসেন তিনি, ফের ছন্দোবদ্ধ রক্ষণশীল পরিবেশে বড় হতে থাকেন, কিন্তু নিজেকে পাল্টে ফেলার যে-আকাঙ্ক্ষা তাঁর মধ্যে দুর্মর হয়ে উঠেছিল তা বেঁচে থাকে সঙ্গোপনে এবং পাল্টে যাওয়ার পালে হাওয়া লাগে বিয়ের পরে। উর্দু ভাষায় অভ্যস্ত এক পারিবারিক পরিবেশে থেকেও তাঁর মেলবন্ধন ঘটে বাংলার সঙ্গে, বাংলার সাহিত্যের সঙ্গে, তাঁর কথ্যজীবনে আগমন ঘটে বাংলা ভাষার এবং এইভাবে ভেঙে পড়ে, সুফিয়া ভেঙে ফেলেন রক্ষণশীলতার একটি দেয়াল। উর্দু ভাষা বনেদিয়ানার একটি সুরম্য দেয়াল তোলার চেষ্টা করেছিল তাঁর চারপাশে, ভাষাগত দূরত্ব তৈরির মধ্যে দিয়ে বাঙালি নারীর থেকে দূরবর্তী করে তুলতে চেয়েছিল, এবং এইভাবে তাঁকে ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিল মূলত রক্ষণশীলতার আভিজাত্যে। কিন্তু তিনি সেই রক্ষণশীলতার আভিজাত্য ভেঙে বেরিয়ে আসেন, বেরিয়ে আসেন পর্দার ঘেরাটোপ থেকে। ১৯৩২ সালে রোকেয়ার যখন মৃত্যু ঘটছে, সুফিয়ার বয়স তখন মাত্র ২১। কিন্তু ততদিনে রোকেয়ার পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে নিজেকে অনেকটাই প্রস্তুত করেছেন তিনি। ১৯২৩ সালে, তাঁর লেখা প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’ ছাপা হয়েছে বরিশালের তরুণ পত্রিকাতে আর ১৯২৬ সালে ছাপা হয়েছে সওগাত-এ প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’। পরে তিনি আরও অনেক কিছুই লিখেছেন, কিন্তু শুরুর এই সাফল্যগুলিই ছিল তাঁর নিজের জন্যে মহাপ্রাপ্তি, প্রতিটি সাফল্যের মধ্যে দিয়ে তিনি আস্থা খুঁজে পেয়েছেন নিজের ওপর, সবার ওপর। ১৯২৫ সালে মহাত্মা গান্ধী বরিশাল গেলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎও ঘটে সুফিয়ার। এই সাক্ষাতের আগেই সুফিয়া কিছুদিন চরকায় সুতা কেটেছেন, বর্জন করেছেন জাঁকালো মুগল পোশাক, সেসবের বদলে পরতে শুরু করেছেন সাধারণ তাঁতের শাড়ি — আর একটাই ছিল এসব কিছুর কারণ — স্বাধীনতা চেয়েছিলেন তিনি, ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবমুক্ত স্বাধীন একটি দেশ। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁর ওই আকাঙ্ক্ষাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার আন্দোলনে জন্মভূমির অর্ধেক জনশক্তিকে বাইরে রেখে সাফল্য দুরাশা — রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকেও সুফিয়া তাই রাজনৈতিক হয়ে উঠছিলেন, নারীদের রাজনৈতিক করে তুলছিলেন। এক অর্থে শূন্য থেকেই শুরু করতে হয়েছিল তাঁকে। নারীকল্যাণমূলক সংগঠন ‘মাতৃমঙ্গল’-এ যুক্ত হয়েছিলেন তিনি, যুক্ত হয়েছিলেন ১৯২৯ সালে রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত মুসলিম নারী সংগঠন ‘আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম’-এর সঙ্গে। এইসব সংগঠনের কার্যক্রমের ধরণ সীমিত ছিল — মাতৃসেবা, নারী শিক্ষা, বড়জোর সামাজিক সংস্কারের বেশি কার্যক্রমে যুক্ত ছিল না এসব। রাজনৈতিক প্রত্যয়ের ভারী ভারী সংজ্ঞা শেখানোর বদলে তিনি চেয়েছিলেন রাজনৈতিক চেতনাকে নারীদের মনে সঞ্চারিত করতে। তিনি তাই যুক্ত হয়েছিলেন নারীর প্রাত্যহিক জীবনযাপনকে ব্যবহারিকভাবে কার্যকর করে তুলতে এবং ব্যবহারিক জীবনের সূত্র ধরে নারীকে রাজনৈতিক জীবনবোধে উপনীত করতে।
এই কাজ এখনও কঠিন, আর তখন সাম্রাজ্যবাদী শাসনামলে কিংবা প্রায়-ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসনামলে ছিল আরও কঠিন। হিন্দু-মুসলমানে ভেদ তৈরি করা হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসনের স্বার্থে, ভেদের সামাজিক ভিতও তৈরি করা হয়েছিল সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে। রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিল না বাঙালি নারী। দৃষ্টান্ত হিসেবে কেউ কেউ অবশ্য এগিয়ে এসেছিলেন, প্রীতিলতা আত্মাহুতি দিয়ে পথিকৃৎও হয়ে উঠেছিলেন — কিন্তু দৃষ্টান্তের দৃষ্টি যতদিন সবার দৃষ্টি না হয়ে ওঠে, ততদিন তা সর্বচেতনস্পর্শী হয়ে ওঠে না। সুফিয়া সংগঠনে যুক্ত হয়েছেন ওই চেতন-সঞ্চরণ প্রক্রিয়াকে সর্বজনগামী করে তুলতে, প্রত্যাশার পরিধি ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলতে, যাতে প্রত্যাশাই নারীদের নিয়ে যায় রাজনৈতিক প্রান্তরে। ১৯৩১ সালে ‘ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন’-এর সদস্য নির্বাচিত হন তিনি এবং এও ছিল এক বড় ঘটনা, কেননা ওই ফেডারেশনে তিনিই ছিলেন প্রথম নির্বাচিত বাঙালি মুসলিম নারী। তিনি যে বিস্তৃত হচ্ছেন, রাজনৈতিক চেতনা ও সাংগঠনিক দক্ষতায় সর্বশ্রেণির ও সর্বধর্মের নারীদের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছেন সেসবেরই প্রতিফলন ঘটেছিল এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে।
১৯৩২ সাল ছিল মাত্র একুশ বছর বয়সী সুফিয়ার জন্যে সব দিক থেকেই কঠিন সময়। ওই বছর একদিকে মৃত্যু ঘটে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের, অন্যদিকে ক্ষয়রোগের কারণে মৃত্যু ঘটে স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের। জীবনের নতুন ডাঙা তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন যাঁদের কর্ম ও জীবন থেকে, যাঁদের সাহচর্য থেকে, তাঁদের এই মৃত্যু তরুণী সুফিয়ার মনে কী বেদনা হয়ে বেজেছিল তা আমরা শুধু অনুমানই করতে পারি, বুঝতে পারি না। সেই বেদনার পাহাড়ও ঠেলতে হয়েছে তাঁকে। যে-রোকেয়া তাঁর পথিকৃৎ হয়ে উঠেছিলেন শৈশবের প্রথম দর্শনেই, যে-নেহাল তাঁকে প্রস্তুত করেছেন সমাজ ও সাহিত্যের জন্যে, পরিচিত করেছেন কাজী নজরুল ইসলামের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে, তাঁদের মৃত্যু তাঁকে নিঃসঙ্গ করে তুলেছে। নিঃসঙ্গতা ছেনে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, রোকেয়া বার বার ফিরে এসেছেন তাঁর স্মৃতিসত্তায়, অনেক কবিতা লিখেছেন তিনি রোকেয়াকে নিয়ে। ১৯৪৯ সালে তাঁর যুগ্মসম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সুলতানা পত্রিকা — যেটির নাম রাখার পেছনেও চেতনা যোগায় রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন। ১৯৭০ সালে তো মৃত্তিকার ঘ্রাণ নামের একটি সংকলনও উৎসর্গ করেন তিনি বেগম রোকেয়াকে। রোকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি গড়ে তুলতেও সহযোগিতা যুগিয়েছেন তিনি এবং এই কমিটির প্রস্তাবেই পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হলের নাম রাখা হয় বেগম রোকেয়ার নামে।
কিন্তু নিঃসঙ্গতা ছেনে তিনি প্রথম সবচেয়ে বড় কাজটি করেন ১৯৪৬ সালে; ওই বছর দাঙ্গাপীড়িতদের সাহায্য করতে লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে একটি আশ্রয়কেন্দ্র খুলতে ভূমিকা রাখেন তিনি। এর আগে আরও দু’টি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে তাঁর জীবনে — ১৯৩৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কবিতার বই সাঁঝের মায়া আর ১৯৩৯ সালে বিয়ে হয় লেখক ও অনুবাদক কামালউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। কালক্রমে সারা বিশ্বে তিনি পরিচিত হন বেগম সুফিয়া কামাল নামে। সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক হিসেবে যে-কাজ শুরু করেছিলেন তিনি ১৯৪৭ সালে, তাতে কেবল বেগম-ই সমৃদ্ধ হয় নি, বাঙালি নারীর সংগঠন-চেতনাও নির্মাণ হয়েছে বেগম-এর মাধ্যমে। ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি রাজনীতি ও সমাজসেবায় জড়িয়ে পড়েন প্রত্যক্ষ ও সার্বক্ষণিকভাবে। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষার লক্ষ্যে গঠিত শান্তি কমিটিতে যোগ দেন তিনি, তাঁকে সভাপতি করে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি। পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে বাঙালি মুসলমানের মনে যে-মোহঘোর তৈরি হয়েছিল, তা খসে পড়তে থাকে খুব দ্রুতই এবং সুফিয়া কামালের, সঙ্গত কারণেই, রাজনৈতিক কার্যক্রমের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়। ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন তিনি, সামরিক জান্তা আইয়ুব খান পূর্ববাংলার জনগণের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য হত্যার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন সুফিয়া কামাল। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষে ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন’ পরিচালনা করেন তিনি। তারপর ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম পরিষদ (বর্তমানে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ) গঠিত হলে সে-সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হিসেবেও ভূমিকা রাখেন তিনি, তারপর আমৃত্যু এ সংগঠনের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন তিনি। এইভাবে প্রতিরোধের প্রতিটি সোপানে নারী ও বাঙালির স্বতন্ত্র মাত্রা সৃজনে সুফিয়া কামাল অবতীর্ণ হন অপ্রতিরোধ্য ভূমিকায়। তাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত বিভিন্ন আন্দোলন নারীর আত্মপরিচয় নির্মাণের পরিসর বাড়িয়েছে। ফলে নারীর স্বাধীনতা এবং অধিকারও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যে-গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল একাত্তরে তিনি তার সঙ্গে যুক্ত থাকেন ঢাকাতে থেকেই, অবরুদ্ধ ঢাকায় গেরিলা যোদ্ধাদের কাছে তিনি ছিলেন বড় আশ্রয়, তিনি ছিলেন যুদ্ধযাত্রায় আকাঙ্ক্ষী তরুণ-তরুণীদের বড় পথপ্রদর্শক, ছেলে ও স্বামীকে তিনি এসব কাজে পাশে পেয়েছিলেন, দুই মেয়ে মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হয়েছিলেন ভারতের আগরতলায় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় হাসপাতাল স্থাপন ও পরিচালনার কাজে। ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন তিনি, সেই ঝুঁকি দেখা দিয়েছিল ১৯৬৯ সালেই — যখন ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারের দেয়া খেতাব ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ ছুঁড়ে ফেলেন সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে, জানতেন তিনি যে-কোনও সময় মৃত্যু আসতে পারে, তাই আরও একটি কাজও করেন তখন — নিয়মিত ডায়েরি লেখেন, একাত্তরের ডায়েরী নামের দিনলিপি রচনা হয় এ প্রক্রিয়াতেই।
তারপর দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু সুফিয়া কামালের কাজ শেষ হয় নি। বাংলাদেশ মহিলা পুনর্বাসন বোর্ডের হয়ে কাজ করেছেন তিনি, কাজ করেছেন দুস্থ পুনর্বাসন সংস্থা আর বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন কমিটির হয়ে। ছায়ানট, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন আর নারী কল্যাণ সংস্থার সভানেত্রীর দায়িত্বও পালন করেন তিনি। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন হয়েছে স্বাধীন দেশে, আন্দোলন হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে — বয়স শরীরকে স্পর্শ করলেও সুফিয়া কামাল মানসিকভাবে সঙ্গে ছিলেন সেসব আন্দোলনের।
এখন তাঁর বয়স একশ’ পেরিয়ে গেল। বেঁচে থাকলে বয়সের ভারে তিনি হয়তো আরও নুয়ে পড়তেন — কিন্তু সময়ের আহ্বানে নিশ্চয়ই সামনের দিকে ঋজু মাথা তুলে তাকাতেন। এখন, এই একবিংশ শতাব্দীতে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, নারীর ক্ষমতায়নের পরিধিও বেড়েছে, কিন্তু যে-শক্তি নারীকে সংঘবদ্ধ করে তা অনেকটাই হারিয়ে গেছে নেতৃত্বের দুর্বলতায়। এই শক্তি নারীকে খুঁজে নিতে হয়, যেমনটি আমরা দেখি সুফিয়া কামালের ক্ষেত্রে, সাংগঠনিক হয়ে উঠে, প্রতিদিনকার সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে, যদিও সেই সংযুক্তির লক্ষ্য চূড়ান্ত অর্থে বিযুক্তির নতুন রসায়নও তৈরি করা। এই ধরণের সংযুক্তি নারীর রাজনৈতিক ও সামাজিক অংশগ্রহণ বাড়ায় এবং তার পক্ষ থেকে বিরোধিতা করার ক্ষমতা এবং পরিসরও বাড়ায়। কিন্তু এই ধরণের সংযুক্তি কমে গেছে, কমে আসছে — তাই, যেমনটি আমরা দেখছি নারীনীতির ক্ষেত্রে, একে সমতাপূর্ণ ও কার্যকর করে তোলার দাবিতে রাজনৈতিক সক্রিয়তা আমাদের নেই বললেই চলে; এমনকি একে ঘিরে মৌলবাদীদের যে-অশুভ দাপট, তার সক্রিয় প্রতিবাদও ঘটছে না ওই সংযুক্তির অভাবে। ব্যক্তির দায়িত্বহীন প্রতিবাদ সমাজে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করতে পারে, ব্যক্তির পরিচিতি তৈরি করতে পারে — কিন্তু যাঁরা সত্যিই পরিবর্তন চান, তাঁদের এগিয়ে যেতে হয় সংগঠন নির্মাণ ও বিকাশের মতো শক্তিশালী ও নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, এগিয়ে যেতে হয় সমাজের আরও অনেককে সঙ্গে নিয়ে, বিশেষত পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এবং ক্রমান্বয়িক যাত্রায় এই পশ্চাৎপদ মানুষগুলির চেতনার পরিধি বাড়িয়ে চলার মধ্যে দিয়ে। সুফিয়া কামাল ছিলেন দ্বিতীয় ধারার মানুষ। এ সময়কে আমরা অন্যরকম হয়ে উঠতে দেখতাম তিনি থাকলে, তাঁর মতো কেউ থাকলে। বিশ্বায়ন নারীকে যে-প্রান্তিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, নারীর পণ্য হয়ে ওঠার যে-ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছে, বিশ্বায়িত মৌলবাদ নারীকে যে-প্রান্তিকে স্থাপন করতে চাইছে সে-সবের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসার যে-প্রত্যাশা তা আরও ঘনীভূত হতে পারত তিনি থাকলে। পুঁজির এই কর্পোরেট-যুগ ব্যক্তিনারীর অবয়ব নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতি হলেও তার জন্যে নারীর কাছ থেকে আদায় করে চড়া মূল্য, নারীকে সে নিঃসঙ্গ করে, নারীর কাছ থেকে সে সংঘবদ্ধতার চেতনা হরণ করেন, নারীর ভুবন হয়ে ওঠে বিলবোর্ডের ভুবন। সমাজের প্রচলিত ধারণাগুলি চূর্ণ করে কর্পোরেট-যুগ ব্যক্তিনারীর এই অবয়ব নির্মাণ করছে না, বরং প্রচলিত ধারণাগুলি জিইয়ে রাখার কাজে ইন্ধন দিয়েই চেষ্টা করছে এই অবয়বনির্মাণযজ্ঞ। দারিদ্র্যবণিকদের পক্ষেও সম্ভব নয় ওইসব ধারণা চূর্ণ করা। ফলে পুঁজিতন্ত্র যে-ব্যক্তিবাদী নারীমনন তৈরি করতে সক্ষম সে-কাজও রক্ষণশীলতায় বাঁধা পড়ছে।
সুফিয়া কামালের কাজও এখানে এসে থেমে গেছে, কেননা তিনি চলে গেছেন এবং দারিদ্র্যবণিক ও বিলবোর্ডের ভুবন যে-সব ব্যক্তিনারীর অবয়ব নির্মাণ করছে সেইসব ব্যক্তিনারীর পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় ওই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক অভ্যুদয়কে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবেই সুনিশ্চিত করা।
রাজশাহী, ১০-১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২ comments
মাসুদ করিম - ১৯ জুলাই ২০১১ (৬:৩৭ অপরাহ্ণ)
নারীশিক্ষা, সাহিত্য ও গণ আন্দোলনের পথে অসম সাহসের সাথে কাজ করেছেন সুফিয়া কামাল। তার কাজ শেষ হয়ে গেছে, কারণ তার মৃত্যু হয়েছে। রাজনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষিতে নারী জাগরণকে নারীর ক্ষমতায়নে রূপান্তরের কাজটিতে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে সুফিয়া কামালের মতো উজ্জ্বল কেউ আজ আমাদের সামনে নেই। একথা সত্য।
‘দারিদ্রবণিক’ বলতে নিশ্চয়ই ক্ষুদ্র্রঋণ সংস্থা ও এনজিওকে বোঝানো হয়েছে আর ‘বিলবোর্ড’ বলতে নিশ্চয় বিজ্ঞাপন মাধ্যমকে বোঝানো হয়েছে। অবশ্যই এসবের কুপ্রভাব আমাদের সমাজের উপর পড়েছে — কিন্তু এগুলোর সুপ্রভাব অনেক নারীর আর্থিক ও মানসিক অবস্থানকে উন্নতও করেছে। আর ব্যক্তিগত স্তরে এই উন্নতি যখন অনেক ব্যক্তির মধ্যে সাধিত হয়, তখন তার প্রভাব সংখ্যাগত দিক থেকে সমষ্টির উপরও পড়ে। নষ্ট রাজনীতির মাঠে দাঁড়িয়ে যখন আমরা বুঝি তারপরও জনগণের অধিকারের কথা বলতে রাজনীতির বিকল্প নেই। তেমনি ক্ষুদ্র্রঋণ সংস্থা, এনজিও ও বিজ্ঞাপনের জগতের ইতিবাচক দিকটি আমরা হারাতে চাই না — কারণ আমরা দেখেছি আমাদের সমাজের অনেক গভীরে অনেক ব্যক্তির জীবনে এর শক্তিশালী প্রভাব আমাদের সমাজকে অনেক কিছু দিয়েছেও। আমাদের অনেক সমন্বয়ের কাজ করতে হবে। যেরকম বাংলাদেশ রাষ্ট্র তসলিমা নাসরিনকে দেশছাড়া করে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের গতিকে অনেক স্তিমিত করে দিয়েছে — সেরকম ক্ষুদ্র্রঋণ সংস্থা, এনজিও ও বিজ্ঞাপনের জগতের ইতিবাচক নির্দেশনাগুলোকে অবহেলা করলে নারীর ক্ষমতায়ন আরো বাধাগ্রস্তই হবে।
মাসুদ করিম - ২২ জুলাই ২০১৪ (১:১৮ অপরাহ্ণ)