অমীমাংসিত ওয়ালীউল্লাহ

ওয়ালীউল্লাহ ‘অমীমাংসিত’ পর্ব ছাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন; সত্যি কথা বলতে গেলে, তিনি তো মীমাংসার পরিধিতে দাঁড়িয়েই লিখতে পেরেছিলেন ওই গল্প। [. . .]

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২–৭১) | ছবি: সৈয়দ ফিদা হোসেন

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২–৭১) | প্রতিকৃতি : সৈয়দ ফিদা হোসেন

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের স্মৃতিচারণায় পাই, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম গল্প তিনিই ছাপেন। মাসিক সওগাতে ১৩৪৮ সনের পৌষে (নভেম্বর–ডিসেম্বর, ১৯৪২) প্রথম প্রকাশ পায় সেই গল্প। অনেক বছর ওই ধারণাই ছিল আমাদের, ‘চিরন্তন পৃথিবী’ নামের সেই গল্পই তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প। কিন্তু তার পর উদঘাটিত হয়, এর আগেও গল্প লিখেছেন তিনি; ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়ার সময় থেকেই সাহিত্যচর্চায় জড়িয়ে পড়েন তিনি, ১৯৩৯ সালের কলেজ বার্ষিকীতে প্রকাশ পায় তাঁর গল্প ‘সীমাহীন এক নিমেষ’। লেখাই বাহুল্য, প্রধানত ‘লালসালু’ উপন্যাসের কারণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা দেয় এবং তা ক্রমশই বাড়তে থাকে – এমন নয় যে, গবেষকদের কারণে পাঠকের কাছে নতুন করে উদ্ভাসন ঘটেছে ওয়ালীউল্লাহর। বরং পাঠকদের উৎসাহই বোধকরি গবেষকদের অনুপ্রাণিত করেছে তাঁর কর্মযজ্ঞকে নতুন করে খুঁজে দেখতে। এইভাবে গত কয়েক দশকে গবেষক ও পাঠকদের সম্মিলিত অনুসন্ধিৎসার মধ্য দিয়ে ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য এসেছে আমাদের সামনে। এসেছে তাঁর প্রকাশিত-অপ্রকাশিত নতুন নতুন লেখাও। কোনো কোনো একই লেখার দুই-তিন সংস্করণ আমাদের গবেষক ও লেখকদের তাঁর রচনাকৌশল ও রচনাশৈলী সম্পর্কে চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে। এমনকি তাঁর একটি গল্প ‘না কান্দে বুবু’কে আবদুল মান্নান সৈয়দ যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, তাতে আমাদের মধ্যে এমন চিন্তাও জন্ম নেয়, ষাটের দশকে পশ্চিম বাংলায় যে শাস্ত্রবিরোধী গল্প-আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল, সুব্রত সেনগুপ্ত, রমানাথ রায়, বলরাম বসাক, শেখর বসু, কল্যাণ সেন প্রমুখ ছিলেন যে স্রোতধারার লেখক, সেই আন্দোলনের ভিত্তিভূমি তৈরি করে গেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। শব্দ ও বাক্যের আবৃত্তি-পুনরাবৃত্তি, স্বগতকথন, আঞ্চলিক সংলাপ ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়ে ‘না কান্দে বুবু’ গল্প এগিয়ে গেছে; লেখার এই ভঙ্গিটিকে লক্ষ করে আবদুল মান্নান সৈয়দ মন্তব্য করেছিলেন, ষাটের দশকের শাস্ত্রবিরোধী গল্পকাররাও ‘শব্দের ও বাক্যের অবিরল আবৃত্তি-পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে’ নতুন একটি কাঠামো দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। অবশ্য শাস্ত্রবিরোধী গল্পকারদের ওপর ওয়ালীউল্লাহর এই প্রভাব কতটুকু পরিব্যাপ্ত হয়েছিল কিংবা ওয়ালীউল্লাহ নিজেই বা তাঁর গল্পসমূহে শব্দের ও বাক্যের অবিরল আবৃত্তি-পুনরাবৃত্তিকে কতটুকু ধারণ করেছেন, তা নিয়ে এখনও কোনও কাজ হয়নি। তাই আমাদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি এ সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট উপসংহারে পৌঁছানো। তবে এটি বলার জন্যে বোধকরি এই পর্যবেক্ষণটুকুই যথেষ্ট যে, পূর্ব বাংলায় কথাসাহিত্যে সচেতন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্ম ওয়ালীউল্লাহর হাতে। তাই কালপ্রবাহে নিজের সময়কে তিনি কীভাবে দেখতেন, সমসাময়িক লেখায় সে পর্যবেক্ষণের প্রকাশ ঘটেছে কীভাবে, নিজের লেখাকেই বা তিনি কীভাবে মূল্যায়ন করতেন, গল্পের গ্রন্থভুক্তিতে সেই মূল্যায়ন কীভাবে ছায়া ফেলেছে – এরকম বিষয়গুলোও গুরুত্ব পেতে থাকে তাঁর বিশেষ করে শুরুর দিকের বিভিন্ন লেখা পুনরাবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে।

১৪০২ সনের শুরুর দিকে (১৯৯৫ সালে) এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ পুনরাবিষ্কার ছিল পুরানো একটি মাসিক পত্রিকায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অগ্রন্থিত একটি গল্প খুঁজে পাওয়া। গল্পটি নতুন করে প্রকাশ পায় ‘বাংলা একাডেমী পত্রিকা’র শ্রাবণ–আশ্বিন ১৪০২ সংখ্যায়। ততদিনে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনাবলীর দুই খণ্ড ১৯৮৬ ও ১৯৮৭ সালে সৈয়দ আকরম হোসেনের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়ে গেছে। ‘বাংলা একাডেমী পত্রিকা’য় অগ্রন্থিত এ গল্পের ভূমিকায় লায়লা জামান দাবি করেন, এটিই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম গল্প। তাঁর এই দাবি কতটুকু যৌক্তিক, সেটা পরে ভাবা যাবে। আপাতত বলি, ডিসেম্বর ১৯৯৬-এ অবসর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘গল্পসমগ্র’তে এটি যুক্ত করা হয়নি। অবশ্য অনেকে বলতে পারেন, ‘বাংলা একাডেমী পত্রিকা’র প্রকাশনা অনিয়মিত; এমনও হতে পারে যে এ সংখ্যাটি আসলে ১৯৯৬-এর ডিসেম্বরের অনেক পরে বেরিয়েছে। যুক্তির খাতিরে সেটা মেনে নিলেও যখন আমরা দেখি ২০০৫ সালে ‘গল্পসমগ্র’র দ্বিতীয় সংস্করণেও সেটি যুক্ত করা হয়নি, তখন খুব খটকা লাগে এবং গ্রন্থ সম্পাদনার মান নিয়েও প্রশ্ন জাগতে পারে। কেননা এর কয়েক বছর আগেই ২০০১ সালে কলকাতার চিরায়ত প্রকাশন থেকে পবিত্র সরকারের সম্পাদনায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘গল্প সংকলন’ বেরিয়েছে এবং তাতে ‘অমীমাংসিত’ গল্পটিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সত্যি কথা বলতে গেলে, ‘বাংলা একাডেমী পত্রিকা’ যেমন নানা কারণে বাংলাদেশে অদৃষ্ট এক পত্রিকা হওয়ার কারণে, তেমনি এ দেশে ওয়ালীউল্লাহর গল্পসংকলনগুলোর দায়সারা পুনঃপ্রকাশের কারণে ‘অমীমাংসিত’ গল্পটি পাঠকের দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেছে। এমনকি  আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’ গ্রন্থে পরবর্তী সময়ে এ গল্পটিকে অন্তর্ভুক্ত করার কারণে পাঠকদের একটি অংশ ‘অমীমাংসিত’ সম্পর্কে একটুআধটু জানলেও ব্যাপক পড়ুয়া এ গল্প সম্পর্কে এখনও অন্ধকারে।

কিন্তু এত গুরুত্ব দিয়ে ‘অমীমাংসিত’কে বিবেচনায় নেয়ার কারণ কী? লায়লা জামান যেমনটি ‘অনুমান’ করেছেন, এটিই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম গল্প, সে কারণে? ‘অমীমাংসিত’ যদিও মাসিক ‘শনিবারের চিঠি’তে প্রকাশ পেয়েছে ১৩৪৮ সনের চৈত্র সংখ্যাতে (মার্চ–এপ্রিল ১৯৪২), তবুও লায়লা জামানের এমন ‘অনুমানের’ কারণ এই যে, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর আদি রচনাদির অন্যতম এই গল্পটির ভাষাগত বৈশিষ্ট্য এই যে, রচনাটি সাধু ভাষায় লেখা। লক্ষণীয় যে, তার তিন বছর আগে প্রকাশিত তাঁর প্রথম লেখা  ‘সীমাহীন এক নিমেষ’ও চলিত ভাষায় রচিত। এই গল্পটি ছাড়া সাধু ভাষায় লেখা তাঁর আর কোনো গল্পের সন্ধান পাওয়া যায় না। (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম গল্প: ‘অমীমাংসিত’, লায়লা জামান, বাংলা একাডেমী পত্রিকা: শ্রাবণ–আশ্বিন ১৪০২)’। এ নিয়ে পরে আবারও তিনি লিখেছেন যে, ‘প্রকাশকাল কিছু পরে হলেও (অর্থাৎ ‘সীমাহীন এক নিমেষ’ ও ‘চিরন্তন পৃথিবী’র কিছু পরে হলেও) হয়তো ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদকীয় দপ্তরে প্রেরিত রচনাটি কিছুকাল প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল।’

এই ‘অনুমান’ নিয়ে কথা বলার আগে একবার তরুণ বছর-বিশেকের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বিকাশমানতাও দেখে নিই আমরা, জেনে নিই গল্পের কাহিনীর সারসংক্ষেপও। তাঁর স্কুল ও কলেজ জীবনের বন্ধু ছিলেন এ কে নাজমুল করিম – যাঁর উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ। স্মৃতিচারণায় সৈয়দ আবুল মকসুদকে তিনি জানান, ১৯৩৫–৩৬ সালে সপ্তম–অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ফেনী হাইস্কুলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ছিলেন ‘হাজারো ছেলেমেয়ের মধ্যে চোখে পড়ার মতো ছেলে’। স্কুলে হোস্টেল ছিল এবং কর্তৃপক্ষ তাতে হাউজ সিস্টেম চালু করেছিল। সেখানে তাঁদের হাউসের ম্যাগাজিন বা দেয়াল পত্রিকার সম্পাদক করা হয় ওয়ালীউল্লাহকে। সেটির নাম তিনি নিজেই রেখেছিলেন, ‘ভোরের আলো’। প্রধান শিক্ষকও প্রশংসা করেছিলেন সে নামের। পরে তাঁরা যখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হলেন, তখন তাঁদের সহপাঠী হিসেবে আরও যুক্ত হন মোহাম্মদ তোয়াহা, সানাউল হক, খাজা খয়েরউদ্দিন। তখন থেকেই ওয়ালীউল্লাহর ওঠাবসা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সকলের সঙ্গে। তবে তিনি নিজে ছিলেন মুক্তচিন্তার মানুষ। ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায় ‘অমীমাংসিত’ যখন ছাপা হচ্ছে তখন তিনি কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে আনন্দমোহন কলেজে বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। এখান থেকে তিনি ডিস্টিংকশনসহ স্নাতক করেন। নিজেকে যেভাবে গড়ে তুলছিলেন তিনি কলেজ থেকে, তাতে পরে কলকাতায় গিয়ে যে তিনি আরও মুক্ত, বাধাহীন পরিবেশ খুঁজে নেবেন, তা খুবই স্বাভাবিক। অনুমান করি, ‘শনিবারের চিঠি’তেও লেখাটি তিনি ডাকযোগে পাঠিয়েছিলেন। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন তো স্মৃতিচারণাই করেছেন, ওয়ালীউল্লাহর লেখা ডাকে আসত। কবে তাঁদের সাক্ষাৎপরিচয় হয়, মনে নেই তাঁর। তবে ওয়ালীউল্লাহ যেদিন প্রথম ‘সওগাত’ অফিসে গিয়েছিলেন, নাসিরউদ্দীন অবাক হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর চেহারা-চরিত্র ও পোশাক-আশাক দেখে।

.

‘অমীমাংসিত’, লেখাই বাহুল্য, ব্যঙ্গাত্মক গল্প। আর এর বিষয়আশয় হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক অবস্থান এবং সে অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ। বাঙালিত্বকে সকলের ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্যে এ গল্পে দুই বন্ধু মহিম ও মহিউদ্দিন পরস্পরের বোনকে বিয়ে করে। ভারতবর্ষের একটি প্রধানতম সমস্যার সমাধান ঘটানোর লক্ষ্যে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে চলে তারা। তাদের উভয়ের কন্যা ও পুত্র ‘আশা ও ভরসা’র জন্ম তাদের কার্যক্রমকে আরও স্বপ্নময় করে তোলে। কিন্তু আশা ও ভরসা অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা উভয় পরিবারকে এত বিচলিত করে তোলে যে তারা পারিবারিক ধর্মেই ফিরে আসে। যিনি কলেজে থাকতেই চলিত ভাষায় ‘সীমাহীন এক নিমেষ’ লিখেছেন, তিনি কেন এ গল্পে সাধু ভাষাকে অবলম্বন করতে গেলেন? এ প্রশ্নের উত্তর গল্পের কাহিনীতেও লুকিয়ে আছে। একটি সিরিয়াস পটভূমিতে ব্যঙ্গাত্মক গল্প লিখতে চেয়েছেন তিনি, সেটির মধ্যে দিয়ে কোনো সূক্ষ্ম ও পরিণত ইঙ্গিতও দিতে চেয়েছেন। এরকম ক্ষেত্রে সাধু ভাষার বিকল্প আর কীই-বা হতে পারে? সে কারণেই বোধকরি তিনি এটি লিখতে গিয়ে অবলম্বন করেছেন সাধুভাষাকে। এবং স্পষ্টতই এর সঙ্গে প্রথম লেখা হওয়া বা না হওয়ার কোনো সম্পর্কই নেই। এরকমও হতে পারে, গল্প নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন তরুণ ওয়ালীউল্লাহ, তাই ব্যঙ্গাত্মক লেখাতেও আগ্রহী হয়েছেন এবং লেখার জন্যে বেছে নিয়েছেন সাধুরীতিকে। ‘অমীমাংসিত’ গল্পের শৈল্পিক মান তাই যেমনই হোক না কেন, এটি তাঁর চিন্তাকে বেশ সুস্পষ্টভাবেই প্রকাশ করেছে। তা ছাড়া, ওয়ালীউল্লাহর বড় ভাইয়ের বন্ধু হওয়ার সুবাদে তাঁর সঙ্গে পরিচিত কাজী আফসার উদ্দিন আহমদের স্মৃতিচারণায় পাওয়া যাচ্ছে, কলেজে পড়ার সময়েই তিনি গল্প লিখে নাম করেছেন। কাজেই ‘অমীমাংসিত’ গল্প হিসেবে প্রথম না হওয়াই স্বাভাবিক।

এ পর্যন্ত আমরা যেমন জানি, তাতে এর আগে ওয়ালীউল্লাহর মাত্র দুটি গল্প ছাপা হয়েছে – একটি কলেজের ম্যাগাজিনে, আরেকটি মাসিক সওগাতে। সেদিক থেকেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প –  কেননা ‘অমীমাংসিত’ প্রকাশ পায় ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকাতে। যেটি তখন সাহিত্য জগতে নানা কারণেই আলোচিত-সমালোচিত। তা ছাড়া তখনকার অন্যান্য বেশির ভাগ বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে তখন যা ঘটেছে – সওগাত কিংবা মোহাম্মদীর মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ এবং এগিয়ে চলা – ‘শনিবারের চিঠি’তে লেখার প্রকাশ তাঁর নিজের আলাদা মানসিক প্রস্তুতি ও দূরযাত্রাকেই উচ্চকিত করে। মাত্র বিশ বছর বয়সেই তিনি স্থান করে নেন এমন এক পত্রিকায়, যেটি নতুন এক সামাজিকতার সঙ্গে পরিচিত করাচ্ছে পাঠক সমাজকে। প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের নাকচ করে দিচ্ছে, আবার পরিশীলিত রুচিরও প্রকাশ ঘটাচ্ছে। ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর সম্পর্ক কী ছিল, কীভাবে তা কতদূর পর্যন্ত বিকশিত হয়েছিল, অদূর ভবিষ্যতে সেসবের উদ্ঘাটনও নিশ্চয়ই গবেষকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ বলেছেন, ওই সময়েও লেখক সমাজে দলাদলি ছিল। মোহাম্মদী কিংবা সওগাত – দুই দলকেই এড়িয়ে চলতেন ওয়ালীউল্লাহ। হতে পারে, এই বিভাজনও তাঁকে লেখালেখির শুরুতেই অন্যান্য পত্রিকার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছিল। তিনি চলে এসেছিলেন ‘শনিবারের চিঠি’র বেশ কাছাকাছি। এবং এরই ফলে রচিত হয় ‘অমীমাংসিত’। কলকাতা যাওয়ার পর তিনি সওগাতের আড্ডায়ও যেতেন না খুব একটা। গেলেও সচরাচর যেতেন কাজী আফসার উদ্দিনের কাছে। আর তাঁর সঙ্গে থাকতেন শওকত ওসমান, গোলাম কুদ্দুস, জয়নুল আবেদিনরা। পরবর্তী সময়ে ‘শনিবারের চিঠি’তেও তাঁকে আর দেখা যায়নি – বোঝাই যায়, সম্পর্ক প্রগাঢ় হয়নি তাঁর এ পত্রিকার সঙ্গেও।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নিজে সচেতনভাবে তাঁর প্রথম দিকের এই  দুর্বল গল্পগুলো পাঠের অভিজ্ঞতা, আরও এগিয়ে হয়ত একথাও বলা যায় ‘বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা’ থেকে, পাঠককে মুক্ত করেছিলেন সেগুলো কোনও গ্রন্থে সংকলিত না করে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে দিয়ে যে আবেদন তিনি সৃষ্টি করেছেন, সে আবেদনই ক্রমাগত উদ্ঘাটন করে চলেছে তাঁর সেসব লেখাকে। কিন্তু কেবল এই সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতটুকুই নয় – ‘অমীমাংসিত’র গুরুত্ব বহুবিধ কারণে। এটির বিষয়বস্তু ও প্রকাশকালই আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে, একটি রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতও রয়েছে এ গল্পের। কেননা ১৯৪২ সালে প্রকাশিত এ গল্পের মাত্র একবছর আগে ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে গ্রহণ করা হয়েছে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’। এই প্রস্তাব ভারতবর্ষের রাজনীতিকে পাল্টে দিয়েছিল, প্যানডোরার বাক্স খুলে গিয়েছিল এবং অসহায় মানুষ যে সহিংসতার জালে জড়িয়ে পড়ছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসার ভিন্নতর কোনও পথ না খুঁজে রাজনীতিকরা বরং সেই পথ ধরে হাঁটছিলেন, যা এই উপমহাদেশের ভবিষ্যতের জন্যেও রেখে গেছে দীর্ঘ, গভীর ক্ষত। আপাতদৃষ্টিতে হাস্যরসাত্মক এবং দুর্বল একটি গল্প হলেও ‘অমীমাংসিত’ তাই গভীরতর কোনও অসুখকে উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টা। এ গল্পের মধ্য দিয়ে একজন তরুণ হিসেবে তিনি সমসাময়িক বিষয়ের দিকে যে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়েছেন, তাই তাঁকে ভবিষ্যতে নিয়ে গেছে ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ কিংবা ‘লালসালু’ লেখার দিকে। ‘অমীমাংসিত’ গল্পের গভীরতর অসুখ আর তার নিরাময়কে তিনি পরে আবারও অনেক পরিণত ও পরিশীলিত রূপে, ভিন্নতর কাঠামোতে বাংলার জনজীবনের মধ্য থেকে তুলে এনেছেন ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ লিখে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর এখন পর্যন্ত পাওয়া ছোটগল্পগুলোর মধ্যে বোধকরি এই দুটো গল্পই কেবল জনজীবনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কীভাবে চর্চিত হচ্ছে, তা তুলে এনেছে। অবশ্য তাঁর এমন একটি গল্পও রয়েছে, যাতে পাকিস্তান আন্দোলনের খানিকটা ছায়াপাত ঘটেছে বলে মনে হয়। সেটিও তাঁর প্রথম দিককার লেখা। এবং ওটাকেও আর তিনি গ্রন্থভুক্ত করেননি। মাঘ ১৩৪৮ (জানুয়ারি ১৯৪২)-এ প্রকাশিত ওই গল্প ‘চৈত্রদিনের এক দ্বিপ্রহরে’ এক তরুণ আনোয়ারকে আমরা দেখি অবস্থাপন্ন ঘরের ছালেহা নামের মেয়েকে টিউশনি করাতে। নিজের প্রেমের অনুভূতিকে ঢাকবার জন্যেই কি আনোয়ার বার বার তার কাছে মুসলমানদের দারিদ্র্য, দুর্দশা ও অক্ষম নিরুপায়তার কথা তুলে ধরে আর তাদের অতীত গৌরবকে মনে করে ঘুরে ফিরে? ছালেহাকে সে বলে, এদেশের দারিদ্র্যপীড়িত এই চাষাদের দেখে, তাদের করুণ বেহাল অবস্থা দেখে মনেই হয় না যে মুসলমানরা একদিন এ রাজ্য শাসন করেছে। কোন সে নির্মম ও করুণ অভিজ্ঞতার কারণে তারা এখন অপমানিত ও লাঞ্ছিত, তা ভেবে পায় না। কিন্তু সেই সুমহান অতীতকে ফিরিয়ে আনার প্রতিজ্ঞার নানা বর্ণনা দেয়ার পরও বরং নিজের অসহায়ত্বই ফুটে ওঠে তার নিজের কাছে এবং সে ছালেহাকে বলে আগামীকাল থেকে যেন আর না আসে সে। বোঝা যায়, পাকিস্তান আন্দোলনের গভীর মর্মবাণী নিয়েও সাহিত্য রচনায় প্রয়াসী হয়েছিলেন তরুণ ওয়ালীউল্লাহ কোনও একদিন। কিন্তু তা তুঙ্গ রূপ পায়নি, তিনি নিজেই পরিত্যাগ করেছেন তাঁর নিজের সেই প্রয়াসকে।

আগেই বলা হয়েছে, খুব সাদামাটা কাহিনী ‘অমীমাংসিত’ গল্পের। অর্থশাস্ত্রের ছাত্র মহিম ও মহিউদ্দিন হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদ তুলে দিয়ে ভারতের প্রধান একটি সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গড়ে তুলেছিল ‘বাঙালী সংঘ’। একজন আরেকজনের নাম ধারণ করে তারা, সংঘ গড়ে তোলার পরের দিনই পরস্পরের বোনকে বিয়ে করে সম্প্রীতির দুয়ার খোলে। বাঙালির জাতীয় পোশাক-পরিচ্ছদের প্রতিও ‘কঠোর দৃষ্টি’ দেয় তারা, যেমন প্রায়শই আমাদের আলোর পথ দেখানো বুদ্ধিজীবীদেরও এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে দেখি আমরা, দেখি রাজনীতিকদেরও চিন্তিত হতে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ লিখেছেন :

ফলে এই হইল যে, চোস্ত পায়জামায় তাহারা পা চারখানি স্বচ্ছন্ন করিল, গায়ে চড়াইল পাঞ্জাবি ও কোট, এবং ধুতির পাড় উঠাইয়া মাথায় ঘুরাইয়া পরিল। দুই মহি আরম্ভ করিল এবং তাহাদের অগণিত সভ্যদল সেই আরম্ভকে অনুকরণ দ্বারা প্রচলিত করিয়া তুলিল।

এরপর ওয়ালীউল্লাহ যা লিখেছেন, তা বর্তমান সময়ে লিখতে পারতেন কি না বলা কঠিন। দুই মহি এবার নিজেদের ধর্মের দিকে মন দিল। তিনি লিখেছেন :

অবশেষে মহিদ্বয় চাঁদা তুলিয়া একটি সাধারণ ঘর নির্মাণ করাইল, যাহার এক পার্শ্বে দেবমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হইল এবং আর এক পার্শ্বে তৈরি হইল ইমামের মঞ্চ।

এক পবিত্র সন্ধ্যায় একসঙ্গে ঘণ্টা বাজাইয়া পূজা এবং সমস্বরে উচ্চ কণ্ঠে নামাজ পড়া হইল। পুরোহিত ও ইমামের কার্য সাঙ্গ করিল দুই মহি।

এর পর সন্তান হয়েছে, দুই মহি তাদের সন্তানদের নাম রেখেছে, পরস্পর পরস্পরকে বলেছে, ‘তুমি যদি মুসলমানি নাম রাখ, তা হলে আমি আপত্তি করব, আর আমি যদি দেবদেবীর নাম রাখি, তা হলে তুমি আপত্তি তুলবে।’

সমস্যাগুলো যে আসলে কত হাস্যকর, আর হাস্যকর বলেই তার জটিলতা যে প্রয়োজনে কত সীমাহীন করে তোলা যায়, কত সীমাহীন হয়ে ওঠে, তা ওয়ালীউল্লাহর চেয়ে ভালো আর কে বুঝেছে। এবং শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছে এ গল্পটিতে, জটিলতাকে সীমাহীন করে ফেলা হয়েছে। ওয়ালীউল্লাহ হাস্যরসের মধ্য দিয়ে ১৯৪২ সালেই ১৯৪৭ সালের পরিণতি তুলে ধরেছেন:

তারপর কি কি সব হইল। দুষ্টু ছেলেরা ভারতের জাতীয় পতাকা ছিঁড়িয়া ফেলিল।

কিন্তু সমস্যার সমাধান কী? আশা ও ভরসাকে বাঁচানোর জন্যে দুই মহি শেষ পর্যন্ত যা করেছে – তা-ই কী? ‘পীর সাহেবের দাড়ি দেখা দিলে’ কিংবা ‘পুরোহিতের টিকি উঁকি দিলে’ই কি আশা বাঁচবে আর ভরসা মরবে না? ‘আশা’ ও ‘ভরসা’ রূপকার্থে এ দুটি নাম ব্যবহার করে ওয়ালীউল্লাহ আমাদের প্রকৃত আশা-ভরসার ইঙ্গিত তৈরি করেছেন উপসংহারে গিয়ে :

আমি কেবলই ভাবি, টাইফয়েড-রোগের বীজাণু প্রথমে ভারত হইতে তাড়াইতে হইবে, না হইলে আশা ও ভরসাকে বাঁচানো যে দায়। হে আল্লা, হে ঈশ্বর, তুমি আমাদের বল দাও, হিকমত দাও, এই দোয়া ও প্রার্থনাই করিতেছি।

এই উপসংহারের মধ্যে দিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যা বুঝিয়েছেন, তা পরিষ্কার করে বলা আজকের বাংলাদেশে কি সত্যিই সম্ভব?

.

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লেখাকে অবশ্য আমাদের বিদগ্ধ সাহিত্যিকদের অনেকেও নিতে পারেননি। হাসান হাফিজুর রহমান, আবদুল হক, মুনীর চৌধুরী ও আবুল হোসেনের মতো আধুনিক চিন্তার লেখকরা পর্যন্ত তাঁর লেখা সম্পর্কে উন্নাসিকতা দেখিয়েছেন। এর একটি কারণ হতে পারে, ওয়ালীউল্লাহর গল্পের চরিত্রগুলো মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তের হলেও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যই প্রধান বৈশিষ্ট্য তাদের। গত শতাব্দীর ষাটের দশক তো বটেই, এমনকি সত্তর-আশির দশকও কথাসাহিত্যে এমন চরিত্রের, তাও আবার নিম্নবর্গের মানুষগুলোর জন্য প্রস্তুত ছিল না। এত বিচিত্র নিম্নবর্গের মানুষজন তাঁর গল্পে উঠে এসেছে যে আমাদের বিস্মিত হতে হয়। এত বৈচিত্র্যময় পেশার নিম্নবর্গের মানুষের উপস্থিতি সত্যি কথা বলতে গেলে বিশ্বের খুব কম লেখকের গল্পেই রয়েছে। উন্মূল ভিক্ষুক, সারেং, খালাসী, মাঝি, গ্রামবাসী, পলাতক খুনি, বস্তিবাসী, ঘোড়াগাড়ির মালিক, চোর, মৌলভী এরকম বিচিত্র সব মানুষকে তিনি স্থান দিয়েছেন তাঁর লেখায় – তুলে এনেছেন তাদের ইহজাগতিক ও মনোজাগতিক দিকগুলোকে। কিন্তু তারপরও তাঁর গল্পসমূহ এক কথায় বলতে গেলে ঘটনাবিহীন। কেননা পেশাগত দিক থেকে তারা যত বৈচিত্র্যপূর্ণই হোন না কেন, তাদের জীবনযাত্রা খুবই সাধারণ, তাদের সম্পর্কেও নেই তেমন কোনও জটিলতা। তা সম্ভবও ছিল না বোধকরি তখনকার উৎপাদন কাঠামোর কারণেই। কিন্তু এদের একেকজনকে তিনি অমর করে তুলেছেন এসব মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারাপাত দেখিয়ে। একদিকে তাদের স্বাতন্ত্র্য, অন্যদিকে তাদের ভেতরের মানবিকতা দিয়ে তিনি পাঠকের সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি করেন। এই দ্বৈতসত্তা  চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত তাঁর ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পে। ১৯৪২-এ ‘অমীমাংসিত’ রচনা করে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার পারিপার্শ্বিকতা ওয়ালীউল্লাহ প্রকাশ করেছিলেন তীব্র ব্যঙ্গের মধ্যে দিয়ে; এ গল্পে তিনি এ সমস্যাকে উপস্থাপন করেন নিস্পৃহ ও নিঃশব্দ নিষ্ঠুরতা আবহের মধ্যে – যা ক্রমশই মানবিকতার কাছে হার মানতে শুরু করে।

‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ বহুল পঠিত গল্প – যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়কে নিয়ে ক্রমাগত বিষোদগার করে চলে একদল উদ্বাস্তু ও দখলদার নিম্নবর্গের মানুষ, অথচ তারাই আবার সংগোপনে যত্ন নেয় অযত্নে বেড়ে উঠতে থাকা, হঠাৎ করে খুঁজে পাওয়া একটি তুলসীগাছকে। আমরা দেখি দেশভাঙনে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে নিজেদের ভিটামাটি ছেড়ে চলে আসা এসব মানুষ এভাবে নতুন করে মানবিক বোধ ফিরে পেতে চলেছে. মানবিকতাকে লালন করছে নতুন করে। যে-পারিপার্শ্বিকতা, যে-পরিপ্রেক্ষিত তাদেরকে সাম্প্রদায়িকতার পথে ঠেলে দিয়েছিল, প্রতিহিংসা জাগিয়ে তুলেছিল, সেই পারিপার্শ্বিকতা ও পরিপ্রেক্ষিত থাকার পরও একটি তুলসী গাছ নতুন করে জাগিয়ে তোলে তাদের। কী এক শৈল্পিক প্রচ্ছন্নতার মধ্যে দিয়ে তাদের অনুভূতি ও প্রবৃত্তি পাল্টে যেতে থাকে। নিঃসন্দেহে এ গল্প সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সেরা দুই-তিনটি গল্পের একটি। শওকত ওসমান যে বলেছিলেন, ‘ওয়ালীউল্লাহর গল্পে নিসর্গ বা প্রকৃতি এসে উপস্থিত হয় চরিত্রসদৃশ শক্তি নিয়ে’ – এ গল্প যেন তারই দৃষ্টান্ত। গল্প পড়তে পড়তে আমরা অনুভব করতে থাকে, একটি তুলসী গাছই শেষমেষ বাস্তুভিটা হারানো, দেশ-সমাজ হারানো একটি মানবিক চরিত্র হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলি, গত কয়েক সপ্তাহ আগের একটি সংবাদ নিশ্চয়ই অনেকেরই চোখে পড়েছে: ঢাকা শহরের কোনও এক আবাসিক ভবনের ছাদে তুলসী গাছের টব রোদ পোহাতে দিয়েছিল এক পরিবার। কিন্তু ছাদে আসা-যাওয়া করা ওই ফ্ল্যাটের আরেক পরিবারের গৃহকর্তার তা পছন্দ নয়। তিনি নির্দেশ দেন সেটিকে সরিয়ে নেওয়ার। কথা কাটাকাটি, ধাক্কাধাক্কি – এরপর এই নিয়ে থানা-পুলিশ পর্যন্ত হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে এ খবর শেয়ার করার পর দেখা গেল, তুলসী গাছ নিয়ে বিবিধ মাত্রার তিক্ত অভিজ্ঞতা আরো অনেকেরই আছে। যেমন, একজনের টবের তুলসীগাছ থেকে অনেকেই আপদবিপদে পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যায়; কিন্তু নিজেদের টবে সে গাছ লাগানোর কথা বললেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান তারা। আরেকজন আবার নিজেদের বিভিন্ন ফুলগাছ গুল্মলতার গাছের টবগুলো ছাদে রাখার পর দেখলেন, সব টবই উধাও গেছে, পড়ে আছে কেবল তুলসী গাছটা! অভিজ্ঞতার বর্ণনায় একেকজনের পরিপ্রেক্ষিত কিংবা তিক্ততার মাত্রা হয়তো একেকরকম – কিন্তু সেগুলো থেকে আমাদের উপসংহার এটাই দাঁড়ায়: ওয়ালীউল্লাহ ‘অমীমাংসিত’ পর্ব ছাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন; সত্যি কথা বলতে গেলে, তিনি তো মীমাংসার পরিধিতে দাঁড়িয়েই লিখতে পেরেছিলেন ওই গল্প। কিন্তু আমরা এখনো ‘অমীমাংসিত’ পর্বেই পড়ে আছি। ওয়ালীউল্লাহ ‘অমীমাংসিত’ পর্ব ছাড়িয়ে পরিশীলিত হয়ে পৌঁছেছেন ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’র কাছে, কিন্তু আমাদের বাংলাদেশ কিংবা আমরা কেউই এখনও পৌঁছতে পারিনি সেইখানটায়। প্রতিটা ধর্মই এখন অসহায় বাংলাদেশে, এমনকি সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার ধর্মও – কেননা সহিংসতা, অসহিষ্ণুতা আর বিদ্বেষ দিয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের যেমন আঘাত করার আয়োজন চলছে, তেমনি সেই আয়োজনকে নির্বিঘ্ন করতে, উৎসবমুখর করতে স্বপক্ষের ধর্মাবলম্বীদেরও সহিংস ও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলা হচ্ছে। আমাদের এই দীনতা দিয়ে, অক্ষমতা দিয়ে কার্যত শেষ পর্যন্ত ওয়ালীউল্লাহকেও হয়তো ‘অমীমাংসিত’ করে ছাড়ব অদূর ভবিষ্যতে তাঁকেও সহিংস করে দেখানোর স্বার্থে… যদিও তিনিই আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তাঁর কথাসাহিত্য দিয়ে ‘টাইফয়েড-রোগের বীজাণু ভারত থেকে তাড়াতে’, চেয়েছিলেন আমাদের মননকে মীমাংসিত করে চারপাশের পশ্চাৎপদতা ও মৌলবাদিতা দূর করতে।

 

 

বণিকবার্তা পত্রিকার  ‘সিল্করুট’ -এ ২০ মে ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত প্রবন্ধের ঈষৎ পরিমার্জিত পাঠ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রতিকৃতি : ‘সিল্করুট’-এর সৌজন্যে।

 

 

ইমতিয়ার শামীম

আপনারে এই জানা আমার ফুরাবে না...

১ comment

  1. মাসুদ করিম - ৮ জুন ২০১৬ (১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ)

    লেখাটি পড়তে বেশ দেরি হয়ে গেল। বাংলাদেশের মানুষ বা এঅঞ্চলের মানুষের একটা বড় ‘এনিগমা’ হয়ে আছে তারা অসাম্প্রদায়িক মানুষ হতে পারছে কি না? কিন্তু সেই প্রশ্নের আগেই তার হাতে চলে এল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সংবিধান ( ভারতে ও বাংলাদেশে[যদিও বাংলাদেশ পাকিস্তান আমল ও ৭৫ পরবর্তী আমলের ধর্মঅনিরপেক্ষ/ধর্মনিরপেক্ষতবুও সংবিধান দেখেছে/দেখছে]) এবং এই চলে আসাটা ভারতের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ সত্বেও বলতে গেলে আদতে পশ্চিম থেকে পড়ে পাওয়া, ফলে ব্যক্তির অসাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠার সামাজিক মানদণ্ডে সন্তোষজনক অবস্থানের আগেই রাষ্ট্রের পড়ে পাওয়া ধর্মনিরপেক্ষতার যাত্রা শুরু হয়ে যাওয়ায় আজো কোনো দিকেই কুল কিনারা তো হলই না, তার মধ্যে বিষফোঁড়ার মতো জেগে রইল ১৯৭১ সালে উদ্ভূত নৃশংস ইসলামি মৌলবাদী দাপট। আমরা তারপর কোন দিকে যাব? সব সময় সেদিকেই যেতে হবে যা ব্যক্তির অসাম্প্রদায়িক হওয়ার প্রবণতাকে প্রত্যয়ে আনবে, সমাজে ব্যক্তির অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা ছাড়া রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা দিয়েও কিছু হবে না, বড় জোর এধরনের বাজে কথা আরো বাড়তে থাকবে ‘আলম সাহেব খুব সেকুলার মানুষ’, এটা না বুঝেই যে ‘আলম সাহেব’ নয় সেকুলার হতে হবে প্রতিষ্ঠানকে ‘আলম সাহেব’ যত অসাম্প্রদায়িক হবেন প্রতিষ্ঠান/রাষ্ট্রের কাগজে কলমে নয় বাস্তবে সেকুলার/ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়বে।

    তাঁর স্কুল ও কলেজ জীবনের বন্ধু ছিলেন এ কে নাজমুল করিম – যাঁর উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ।

    এ কে নাজমুল করিম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে স্বতন্ত্র কোনো বই লিখেছিলেন?

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.