ভাষা, শ্রেণি এবং স্ট্যালিন : ৬০ বছরের পূর্বানুবৃত্তি

ত্রিশ-চল্লিশের দশকে ভাষা নিয়ে এক ঝড় উঠেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। শ্রেণি বিপ্লব হয়েছে, ক্ষমতায়ন ঘটেছে সর্বহারা শ্রেণির, চলছে রাষ্ট্র ও সমাজের সবকিছু ঢেলে সাজানোর কাজ। এরকম কর্মযজ্ঞের মধ্যে একদল ভাষাবিদ তুলে ধরলেন শ্রেণিভাষার ধারণা।...

ত্রিশ-চল্লিশের দশকে ভাষা নিয়ে এক ঝড় উঠেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। শ্রেণি বিপ্লব হয়েছে, ক্ষমতায়ন ঘটেছে সর্বহারা শ্রেণির, চলছে রাষ্ট্র ও সমাজের সবকিছু ঢেলে সাজানোর কাজ। এরকম কর্মযজ্ঞের মধ্যে একদল ভাষাবিদ তুলে ধরলেন শ্রেণিভাষার ধারণা। ভাষাকেও হয়ে উঠতে হবে শ্রেণির ভাষা,- এককথায় এটিই ছিল সে ঝড়ের মূল বার্তা। ঝড়ের সেই ঝাপটা স্পর্শ করে জোসেফ স্ট্যালিনকেও, যিনি ছিলেন তখন সেই প্রথম ও নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির নির্মাণযজ্ঞের প্রাণকেন্দ্রে। ভাষা সমাজের কোনো কাঠামোভুক্ত কি না, শ্রেণিভাষা হতে পারে কি না ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে ভাষাবিতর্কের এক পর্যায়ে স্ট্যালিনও অংশ নেন। ‘প্রাভদা’ পত্রিকায় ১৯৫০ সালে বিভিন্ন প্রশ্ন ও চিঠির উত্তরে জোসেফ স্ট্যালিন যা লিখেছিলেন, সেগুলো নিয়ে পরে ১৯৫২ সালে, বাংলা ভাষা আন্দোলনের বছরে, প্রকাশ পায় ‘ মার্কসিজম অ্যান্ড প্রবলেমস অব লিঙ্গুয়িস্টিক্‌স’ নামের গ্রন্থটি। ইংরেজি ভাষার পাঠকদের কাছে বইটি পৌঁছায় আরও দু বছর পর – ১৯৫৪ সালে।
কালপর্বের হিসেবে সোভিয়েত রাশিয়ায় ভাষাবিতর্কের সময় বাংলাদেশেও (তৎকালীন পূর্ববঙ্গে) চলছে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। স্ট্যালিন এই রক্তঝরা আন্দোলন সম্পর্কে কী ভেবেছেন, জানা নেই আমাদের। তবে ভারতের অবমুক্ত হওয়া দুটি কূটনৈতিক নথিপত্র থেকে এটুকু বোঝা যায়, সোভিয়েত রাশিয়ার ওই ভাষাবিতর্কের সময় স্ট্যালিন চেষ্টা করেছেন ভারত ও পাকিস্তানের ভাষাগুলি সম্পর্কে ধারণা পাবার। সোভিয়েত রাশিয়ার ওই ভাষাবিতর্ক তুলে ধরেছে এমন সব ধারণা ও প্রসঙ্গ, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাষাচিন্তায় এখনও অর্থবহ। শ্রেণি-অঞ্চল-অর্থনীতি-প্রযুক্তি-সমাজ ইত্যাদির বিভিন্ন পরিবর্তনের সূত্রে ভাষায় নতুন নতুন যে-সব উপাদান সঞ্চারিত হয়, সেগুলি নিয়ে প্রায়ই কৃত্রিম বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়, খণ্ডিত ভাবনা থেকে সেগুলিকে জনগোষ্ঠী ও পাঠকশ্রেণির ওপর চাপিয়ে দিয়ে আসলে ভাষার প্রাণপ্রবাহকেই শ্লথ ও রুদ্ধ করে দেয়া হয়। স্ট্যালিনের ওইসব লেখাগুলি প্রকাশের পর প্রায় ৬০ বছর পেরিয়ে গেলেও তাই সেগুলি প্রকাশের প্রেক্ষাপট, বিষয়বস্তু ও উপসংহার এখনও অর্থবহ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাষাবিতর্ক স্ট্যালিনের নজরে আনেন জর্জিয়ান সেন্ট্রাল কমিটির প্রধান সম্পাদক ক্যানডিড শার্কভিয়ানী (Kandid Charkviani)। যার মাধ্যমে এই বিতর্ক শুরু হয়েছিল, সেই নিকোলাই ইয়াকভলেভিচ মার (১৮৬৪-১৯৩৪) অবশ্য অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন। কিন্তৃ ১৯২৪ সাল থেকে শুরু করে জীবনের শেষ পর্যন্ত নিকোলাই ইয়াকভলেভিচ মার (Nikolay Yakovlevich Marr) কাজ করে গেছেন ‘মার্কসীয় ভাষাবিজ্ঞানের’ কাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে। নিকোলাইয়ের ‘মার্কসীয় ভাষাবিজ্ঞান’ নিয়ে আপত্তি তোলায় ভাষাবিদদের অনেককেই হয়রানির শিকার হতে হয়েছে, অভিযুক্ত হতে হয়েছে নানাভাবে। কিন্তু সদ্য প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শ্রেণিতাড়না এত তীব্র ছিল যে, জীবদ্দশায় বিতর্কিত হতে হয়নি ককেশিয় ভাষাসমূহের বিশেষজ্ঞ নিকোলাই ইয়াকভলেভিচকে।
নিকোলাই মার ভাষাকে দেখেছিলেন আদর্শ বা ইডিওলোজিরই একটি ফর্ম হিসেবে। বলেছিলেন, ভাষা অবকাঠামোর অংশ, প্রতিনিধিত্ব করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি বা শ্রেণিসমূহের। ভাষার নতুন এক ব্যবহারিক দিক তুলে ধরেন তিনি; সমাজের মূল কাঠামোর বিভিন্ন আদর্শ ও ধারণা প্রতিষ্ঠার জন্যে, বহমান রাখার জন্যে, অবকাঠামোর অংশ হিসেবে ভাষার ভূমিকা নির্ধারণ করেন তিনি।
মার-এর এই শ্রেণিভাষার ধারণা ভাষাবিজ্ঞানে পরিচিত ‘জ্যাফেটিক তত্ত্ব’ নামে। জ্যাফেটিক শব্দটি নিকোলাই নেন নোয়াহ বা নূহের এক ছেলে জ্যাফেথের নাম থেকে। ককেসাস অঞ্চলের কার্টভেলিয় ভাষাগুলির সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সেমেটিক ভাষাগুলির সম্পর্ক দেখানোর লক্ষ্যে তিনি এ তত্ত্বায়ন করেছিলেন। কার্টভেলীয় ভাষাগুলির মধ্যে জর্জিয়ার ভাষাই ছিল একমাত্র লিখিত ভাষা। সম্ভবত এজন্যেই পরবর্তী সময়ে প্রসঙ্গটি বিশেষভাবে চোখে পড়ে সেখানকার কমিউনিস্ট নেতা শার্কভিয়ানীর। মার ধারণা দেন, ককেসিয়, সেমেটিক-হেমেটিক এবং বাসকিউ ভাষার উৎস অভিন্ন। এই তত্ত্বের আংশিক রূপরেখা তিনি তৈরি করেন অক্টোবর বিপ্লবের আগে। কিন্তু তা ভিন্ন এক পরিণতির দিকে এগোয় অক্টোবর বিপ্লবের পর। মার তাঁর তত্ত্বকে সম্প্রসারিত করেন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলির মূল ভিত্তির সন্ধানে, দাবি করেন যে এসব ভাষা আসার আগে ইউরোপ জুড়ে চালু ছিল জ্যাফেটিক ভাষাগুলি। খুঁজলে এসব ভাষাকে এখনও পাওয়া যাবে- এগুলো টিকে রয়েছে ভাষার উপস্তর হিসেবে, যার ওপর প্রতিস্থাপিত হয়েছে ইন্দোইউরোপীয় ভাষাগুলি। ভাষার এর মডেল ব্যবহার করার মধ্যে দিয়ে মার উদ্যোগী হন ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মার্কসীয় তত্ত্ব প্রয়োগের এবং মত দেন যে ভাষার বিভিন্ন স্তর বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছে। তিনি, এমনকি এমন দাবিও করেন, ভাষাবিজ্ঞানের দিক থেকে দেখতে গেলে, বিভিন্ন দেশের একই ধরণে বিন্যস্ত সামাজিক শ্রেণির ব্যবহূত ভাষার কথ্য সংস্ড়্গরণ অনেকটাই কাছাকাছি, যদিও তা অন্যান্য শ্রেণিগুলির ভাষার কথ্য সংস্করণের চেয়ে দূরবর্তী। ঠিক তেমনি বিভিন্ন দেশের অন্যান্য শ্রেণির ভাষাগুলির কথ্য সংস্করণ আবার অনেকটাই কাছাকাছি। এইভাবে মার একটি জনগোষ্ঠীর শ্রেণিনির্বিশেষে সকল মানুষের অভিন্ন ভাষার ধারণাটিকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
নিকোলাই মার-এর মৃত্যু হয় ১৯৩৪ সালে। কিন্তু তারপরও অবস্থা একই থাকে। তাঁর অনুসারী ভাষাবিদরা গুরুর ধ্যানধারণাই পল্লবিত করতে থাকেন সোভিয়েত রাশিয়া জুড়ে। এর মধ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, টালমাটাল এক সময়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলে নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আবারও এ নিয়ে তর্ক বাধে এবং কোরিয়া যুদ্ধের উন্মাত্তাল সময়টিতে এ ব্যাপারে মুখ খোলেন জোসেফ স্ট্যালিন। সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলি অবশ্য এ বিতর্ককে এবং তাতে স্ট্যালিনের অংশগ্রহণকে সন্দেহ ও সংশয়ের চোখেই বিবেচনায় নেয়। কেননা ঠিক ওই সময়েই শুরু হয় কোরিয়ার যুদ্ধ – যাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের পরাশক্তিগুলি বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
তবে বিরোধী পরাশক্তিগুলি এ বিতর্ককে যেভাবেই দেখুক না কেন, মূল ঘটনা ছিল অন্যরকম। নিকোলাই মার-এর অনুসারী জর্জিয়ারই এক ভাষাবিদ আরনল্ড স্টেপানোভিচ শিকোবাভার (Arnold Stepanovich Chikobava) ভাষাবিষয়ক কয়েকটি নিবন্ধ স্ট্যালিনের কাছে পাঠিয়েছিলেন জর্জিয়ান সেন্ট্রাল কমিটির প্রথম সম্পাদক ক্যানডিড শার্কভিয়ানী। লেখাগুলির সঙ্গে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত উদ্বেগ – ভাষাকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নিকোলাইয়ের পদ্ধতি কি সত্যিই মার্কসবাদসম্মত? প্রশ্ন তুলেছিলেন শার্কভিয়ানী, সব ভাষা যদি শ্রেণিভিত্তিকই হয়, তা হলে কি ভাবে বিশ্লেষণ করা হবে শ্রেণিহীন সময়ের, আদিম সাম্যবাদী পর্ব বিকাশের সময়কার ভাষা-ব্যবহারকে? প্রধান উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে, পৃথক পৃথক জাতীয় সংস্কৃতিগুলির সঙ্গে ভাষার সংশ্লিষ্টতাকেই বা ব্যাখ্যা করা হবে কীভাবে?
এরকম প্রশ্নের মুখে স্ট্যালিন ডেকে পাঠান ভাষাবিদ শিকোবাভা এবং জর্জিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল কমিটির সাদারণ সম্পাদক ক্যানডিড শার্কভিয়ানীকে। দু পক্ষের ভাষ্য শোনার পর স্ট্যালিন শিকোবাভাকে বলেন, ভাষাবিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর এ ধারণা প্রাভদার মাধ্যমে সবার সামনে তুলে ধরতে। ৯ মে ১৯৫০-এ প্রাভদা পত্রিকায় প্রকাশ পায় শিকোবাভার অভিমত। এরপর প্রাভদা পত্রিকা এ নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনার জন্যে প্রতি সপ্তাহে বরাদ্দ করে দু’টি পাতা। সম্পাদকের পক্ষ থেকে এ বিভাগের ব্যানারহেডিং-এর সঙ্গে নোট রাখা হয়, ‘সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার মধ্যে দিয়ে সোভিয়েত ভাষাবিজ্ঞান বিকাশের প্রতিবন্ধকতাগুলি অতিক্রম করতে প্রাভদায় আয়োজিত মুক্ত আলোচনা।’ বেশ কয়েক সপ্তাহ নিকোলাইয়ের ওই তত্ত্বের পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা চলে পত্রিকাটিতে। তারপর ২০ জুন, ১৯৫০-এ একদল সোভিয়েত ছাত্রের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরে ’অন মার্কসিজম ইন লিঙ্গুয়িস্টিকস’ লেখাটির মধ্যে দিয়ে এ বিতর্কে অংশ নেন জোসেফ স্ট্যালিন। অবশ্য, কট্টর স্ট্যালিনবিরোধীদের বলে থাকেন, স্ট্যালিন নন, কোনও এক ভুতুড়ে-লেখকই এইসব লেখা লিখেছেন এবং তাঁর শিকোবাভা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি!

দুই•
স্ট্যালিনের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার ভাষাবিতর্ক একটি উপসংহার খুঁজে পায়। স্ট্যালিন বলেন, ভাষা সামাজিক ভিত্তির কোনও অবকাঠামো নয়। সমাজের ভিত্তি হলো অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক, দার্শনিক, আইনগত, ধর্মীয়, শিল্পসাংস্কৃতিক বিভিন্ন মত ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ সেই অর্থনৈতিক কাঠামোর অবকাঠামো। এ কারণে কাঠামো যখন পাল্টায়, তখন অনিবার্য কারণেই অবকাঠামোও পাল্টায় বা পর্যায়ত্ক্রমে অপসৃত হয়। নতুন কাঠামোর প্রতিনিধিত্ব করে নতুন এক অবকাঠামো। কিন্তু ভাষা এরকম পরিবর্তনশীলতার স্রোতে পড়ে না, কেননা ভাষা অবকাঠামোর চেয়ে রেডিক্যালি আলাদা। ভাষার এই রেডিক্যাল দিক তুলে ধরেন স্ট্যালিন সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজ বিপ্লবের উদাহরণ দিয়ে। তিনি বলেন, এখানে বিপ্লব হয়েছে, বিপ্লবপূর্ব পুঁজিবাদী কাঠামো ও অবকাঠামোগুলিও অপসৃত হয়েছে, কিন্তু রাশিয়ার ভাষার তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তন হয়নি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্য কোনও ভাষার। নতুন এক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা, উৎপাদন ব্যবস্থা এবং নতুন সামাজিক সম্পর্ক ও নৈতিকতার কারণে, তা ছাড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশের সঙ্গে সম্পৃক্তি ঘটায় বিভিন্ন ভাষার শব্দভাণ্ডারে অবশ্য অনিবার্যভাবেই যুক্ত হয়েছে নতুন অনেক শব্দ, নতুন অনেক প্রকাশভঙ্গিমা। সামাজিক বিপ্লবের ফলে সমাজের শব্দভাণ্ডারে সংযুক্ত এসব নতুন শব্দের মধ্যে দিয়ে সমাজ সমৃদ্ধ হয়েছে, যোগাযোগের মাধ্যম খুঁজে পেয়েছে। ঠিক একইভাবে এর ফলে অনেক শব্দ ও প্রকাশভঙ্গিমার অর্থ পাল্টে গেছে, অনেক শব্দ নতুন করে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং কিছু শব্দ বাদও পড়ে গেছে শব্দের ভাণ্ডার থেকে। কিন্তু তার মানে এই নয়, ভাষা বদলে গেছে, কেননা ভাষার বুনিয়াদ নির্মিত হয় তার মৌলিক শব্দভাণ্ডার ও ব্যাকরণ পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে, যা সমাজ-রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তনের পরও কোনও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছাড়াই নিজের সামগ্রিকতা সংরক্ষণ করতে পারে।
কাঠামো ও অবকাঠামোর বিবরণ ছাড়া স্ট্যালিন তাঁর যুক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন না। স্ট্যালিনের লেখায় তাই রয়েছে কাঠামো ও অবকাঠামোর ভাষার সংক্ষিপ্ত ও সামগ্রিক বিবরণ। অবকাঠামের সঙ্গে ভাষার পার্থক্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি বিভিন্ন দিক থেকে এবং দেখেছেন অন্তত তিনটি দিক থেকে ভাষা রেডিক্যালি আলাদা। প্রথমত• ভাষা কোনও সুনির্দিষ্ট সমাজের নতুন অথবা পুরানো এক অথবা একাধিক ভিত্তির উৎপাদন নয়। ভাষা সৃষ্টি হয় বহু শতাব্দী ধরে সমাজ ও তার কাঠামোসমূহের ইতিহাসের সামগ্রিক ধারা থেকে। কোনও সুনির্দিষ্ট শ্রেণি একে সৃষ্টি করে না, তাকে সৃষ্টি করে পুরো সমাজ, সৃষ্টি করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিগুলি আর তা সৃষ্টি হয় শ শ প্রজন্মের প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে। ঠিক তেমনি এটি কোনও সুনির্দিষ্ট শ্রেণির প্রয়োজন মেটানোর জন্যে নয়, বরং পুরো সমাজের জন্যে, সমাজের সকল শ্রেণির প্রয়োজন মেটানোর জন্যেই সৃষ্টি হয়ে থাকে। কারণ ভাষার সৃষ্টি সমাজের জন্যে। সমাজের সকল সদস্যের একক ও অভিন্ন ভাষা হিসেবেই তা সৃষ্টি হয়ে থাকে। একটা শ্রেণি আরেকটা শ্রেণির ওপর প্রভূত্ব করবে, কর্তৃত্ব করবে,- এ জন্যে ভাষা গড়ে ওঠে না। ভাষা গড়ে ওঠে জনগণের মধ্যে যোগাযোগের সংযোগ হিসেবে, সমানভাবে গোটা সমাজের ও সমাজের সকল শ্রেণির সেবার করতে। এ কারণেই এটি কোনও আদর্শগত অবকাঠামোর অন্তভুক্ত হতে পারে না। নিজেকে আদর্শগত অবকাঠামোর বাইরে রাখতে সক্ষম বলেই ভাষা পারে একই সঙ্গে পুরনো ও মরমর ব্যবস্থা এবং নতুন ও উঠতি ব্যবস্থার, পুরনো ও নতুন কাঠামোর এবং শোষক ও শোষিত উভয়ের সঙ্গেই যোগাযোগ-সংযোগ ঘটাতে। ভাষার সৃষ্টি হয়েছে, ভাষার অস্তিত্ব নির্ভর করছে সমগ্র সমাজকে সেবা করার ওপর, জনগণের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কার্যকর থাকার ওপর, সমাজের সকল সদস্যের কাছে সাধারণ ও একক একটি ভাষা হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে শ্রেণিঅবস্থান ও শ্রেণিমর্যাদা নির্বিশেষে সমাজের সকল সদস্যের সমান সেবা করার ওপর। স্ট্যালিন বলেন, ভাষা তার এই অবস্থান থেকে, সমগ্র মানুষের সাধারণ ও একক ভাষা হয়ে ওঠা থেকে বিচ্যুত হয় তখন যখন এটি বিশেষ কোনও গোষ্ঠীকে সমাজের অপরাপর সামাজিক গোষ্ঠীগুলির ওপর কর্তৃত্ব করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয় ও সমর্খন করে। তখন সে তার শক্তি হারায়, সমাজের জনগোষ্ঠীগুলির যোগাযোগের উপায় না হয়ে প্রতিবন্ধক হয় এবং বিশেষ কোনও সামাজিক গোষ্ঠীর অপভাষা বা জার্গনে পরিণত হয়।
ভাষার দ্বিতীয় রেডিক্যাল দিকটি হলো এর দীর্ঘস্থায়িত্ব। অবকাঠামো সম্পৃক্ত সেটির অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে। এই দিক থেকে তা একটি বিশেষ যুগের উৎপাদন, একটি বিশেষ অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিপূরক। ওই অর্থনৈতিক কাঠামোটি যখন পাল্টে যায়, তখন অনিবার্যভাবেই অবকাঠামোও পাল্টায়। কিন্তু, স্ট্যালিন দেখেছেন, ভাষা, এসবের বিপরীতে, গড়ে ওঠে যুগ যুগ ধরে; দিনের পর দিন তা সমৃদ্ধ হয়, বিকশিত হয়। কাজেই কোনও ভাষার স্থায়িত্ব কোনও অবকাঠামোর চেয়েও অনেক বেশি। তিনি মন্তব্য করেন, সামাজিক জীবনে চূড়ান্ত এক নৈরাজ্য সংঘটনের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব হতে পারে একটি ভাষাকে বিনাশ করা এবং ডন কুইকজোট ছাড়া আর কেউই নিজেকে এ ধরণের কাজে জড়াবে না।
ভাষার তৃতীয় রেডিক্যাল দিক হলো উৎপাদনের সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ সংযুক্তি। স্ট্যালিন দেখতে পান এবং আমাদেরও দেখান, ভাষা উৎপাদনের সঙ্গে, মানুষের উৎপাদনশীল কার্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত; অন্যদিকে অবকাঠামো উৎপাদন ও মানুষের উৎপাদনশীল কার্যক্রমের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুত্ত্ন থাকে না। এসবের সঙ্গে তার সংযুক্তি ঘটে অপ্রত্যক্ষভাবে, অর্থনীতির মাধ্যমে, কাঠামোর মাধ্যমে। ভাষা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত বলেই ভাষা, আরও এগিয়ে দেখতে গেলে এর শব্দের ভাণ্ডার এক নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তনপ্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলে। কেননা মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে, শিল্পে ও কৃষিতে, বাণিজ্য ও পরিবহনে, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে এবং সেই পরিবর্তন তাদের কার্যক্রমের জন্যে প্রতিনিয়ত ভাষার কাছে নতুন নতুন শব্দ ও প্রকাশভঙ্গিমা দাবি করে চলেছে। ভাষাকে তাদের সেই প্রয়োজন সরাসরি মেটাতে হচ্ছে তার ব্যাকরণগত পদ্ধতিকে আরও যথাযথ করে তুলে, তার শব্দভাণ্ডারে নতুন নতুন শব্দ সংযুক্তির মাধ্যমে।

তিন•
অবকাঠামোর অংশ হিসেবে ভাষার অস্তিত্ব নাকচ করার মধ্যে দিয়ে স্ট্যালিন নাকচ করে দিয়েছিলেন ভাষার শ্রেণিচরিত্রের প্রশ্ন, শ্রেণিভাষার প্রশ্ন। ক্ল্যান-ভাষা থেকে ট্রাইব-ভাষা, ট্রাইব-ভাষা থেকে জাতিসত্বাসমূহের ভাষা এবং জাতিসত্বাসমূহের ভাষা থেকে জাতীয় ভাষা,- ভাষাবিকাশ ও উত্তরণের প্রতিটি পর্বেই, সমাজের জনগণের মধ্যেকার যোগাযোগের উপায় হিসেবে ভাষা ছিল ওই সমাজের সাধারণ ও একক ভাষা, যা তাদের সামাজিক মর্যাদা নির্বিশেষে সকল সদস্যের সমানভাবে সেবা করবে। শ্রেণিভাষার প্রশ্নটিকে নাকচ করতে গিয়ে স্ট্যালিন ভাষার সর্বশ্রেণিগামিতাকেই সামনে নিয়ে এসেছিলেন।
তবে স্ট্যালিন এ-ও জানান, ভাষা জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় হিসেবে সকল শ্রেণির প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন হলেও বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী ও শ্রেণির জনগণ ভাষার প্রতি সমভাবাপন্ন না-ও হতে পারে। এরকম অবস্থার সৃষ্টি হয়, কেননা মানুষ চায় ভাষাকে নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করতে এবং তাই বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি ও গোষ্ঠী ভাষার ওপর প্রয়োগ করার চেষ্টা করে তাদের বিশেষ ভাষাবাক্য, বিশেষ পদবাচ্য, বিশেষ প্রকাশভঙ্গিমা। জনগণ থেকে বিচ্যুত বিত্তবানদের উঁচ্চতর স্তরের ব্যক্তিরা, অভিজাত ও বুর্জোয়ার স্তরভুক্ত ব্যক্তিরা ভাষার বিভিন্ন মানদণ্ড হাজির করে চলেন নিজেদের পৃথকসত্বা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এভাবেই স্ট্যালিনের মতে, দেখা দেয় বহুল আলোচিত ‘শ্রেণি’ ডায়ালেক্ট, অপভাষা, উঁচু শ্রেণির ভাষা ইত্যাদি। এবং এইসব ডায়ালেক্ট আর অপভাষাগুলি প্রায় সময়ই ভুলবশত সাহিত্যে চালিয়ে দেয়া হয় ভাষা হিসেবে – কখনো অভিজাত অথবা বুর্জোয়া ভাষা হিসেবে, কখনো আবার এর বিপরীতে প্রোলেতারিয়েত কিংবা কৃষকের ভাষা হিসেবে, গণমানুষের ভাষা হিসেবে।
এ ধরণের ডায়ালেক্ট বা উপভাষা ও অপভাষাকে ভাষা হিসেবে দেখতে রাজি হননি স্ট্যালিন। কেননা, তিনি বলেছেন, এ ধরণের ডায়ালেক্ট ও অপভাষার কোনও ব্যাকরণগত পদ্ধতি থাকে না এবং নেই কোনও মৌল শব্দের ভাণ্ডার – এ কারণে তাদের নির্ভর করতে হয়, প্রতিনিয়ত ধার করতে হয় জাতীয় ভাষার ব্যাকরণ ও শব্দের ভাণ্ডারকে। আরও একটি কারণে এগুলিকে স্ট্যালিন ভাষার পর্যায়ভুক্ত করার সম্ভাবনা নাকচ করেছেন। তিনি দেখেছেন, এ ধরণের ডায়ালেক্ট ও অপভাষাসমূহ একটি সংকীর্ণ পরিসরে সীমাবদ্ধ, একটি শ্রেণীর উচুঁ স্তরেই ঘূর্ণায়মান এবং সমগ্র সমাজের মানুষের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অনুপযোগী। উপভাষা ও অপভাষাসমূহের স্বাধীন ভাষা হিসেবে বিকাশের প্রচেষ্টা স্ট্যালিনের কাছে মনে হয়েছে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে, মার্কসীয় অবস্থান থেকে বিচ্যুত হওয়ার প্রবণতা।
বুর্জোয়াদের ভাষা আলাদা, প্রলেতারিয়েতের ভাষা আলাদা এরকম যারা বলতেন, তাদের অন্যতম সহায় ছিল মার্কসের একটি নিবন্ধ ‘সেইন্ট ম্যাক্স’ – যাতে তিনি লিখেছেন, বুর্জোয়াদের ‘নিজস্ব এক ভাষার’ কথা, লিখেছিলেন যে বুর্জোয়াদের ওই ভাষা ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণির উৎপাদন’ (ফ্রান্সে, লেখাই বাহুল্য, এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই সংগঠিত করে বুর্জোয়া বিপ্লব)। কিন্তু স্ট্যালিন বুর্জোয়াদের ‘নিজস্ব ভাষা’র অস্তিত্ব নাকচ করে দিয়েছেন, কেননা, তার মতে, এ ধরণের ভাষা বলতে যা বোঝানো হচ্ছে তা ভাষার চৌহদ্দিতে প্রবেশ করেছে ‘বাণিজতন্ত্র ও ফেরিওয়ালার স্পিরিট নিয়ে।’ তিনি লিখেছেন, মার্কসের এ লেখা থেকে যারা উদ্ধৃত করতে ভালবাসেন, তারা একটু এগিয়ে গেলেই দেখতে পেতেন একই নিবন্ধেই মার্কস একক জাতীয় ভাষাসমূহের উত্থানের প্রসঙ্গ স্পর্শ করেছেন, কথা বলেছেন, ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রিকতার ফলে ডায়ালেক্টসমূহের একটি একক জাতীয় ভাষায় কেন্দ্রীভূত’ হওয়া নিয়ে। মার্কস আলোচনাক্রমে ‘সেইন্ট ম্যাক্স’ লেখাটিতে একক জাতীয় ভাষার আবশ্যকতাকে উচ্চতর পর্যায়ে এবং ডায়ালেক্টকে তার অধীনস্থ নিম্নবর্তী স্তর হিসেবে সনাক্ত করেছেন। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে মার্কস বুর্জোয়াদের ভাষাকে ‘বুর্জোয়াজি বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির উৎপাদন’ বলে আসলে সেটির অপভাষাগত দিকটিই তুলে ধরেছেন। স্ট্যালিনের এই বোধগম্যতায় কোনও ভুল নেই যে মার্কস বুঝাতে চেয়েছেন, এই তাদের বাণিজ্যতান্ত্রিক ও ফেরিওয়ালার চেঁচামেচি জাতীয় ভাষা দিয়ে একক জাতীয় ভাষাকে নোংরা করে চলেছে। বুর্জোয়াদের উত্থানের ইতিহাস ও রাজনৈতিক ভূমিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বুর্জোয়াদের এই ভাষা আর ভাষার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান জাতীয় কিছু মনে হয় না, বরং তার অপভাষাগত দিকই সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।
শুধু মার্কস নয়, স্ট্যালিনের লেখা থেকে দেখা যাচ্ছে, এঙ্গেল্‌সের একটি লেখাকেও শ্রেণিভাষার সমর্থকরা যুক্তি হিসেবে টেনে নিয়ে আসেন। এঙ্গেল্‌স তার একটি লেখায় ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, ব্রিটেনে ‘••• শ্রমজীবী শ্রেণিটি ক্রমান্বয়ে ইংলিশ বুর্জোয়াজির (মধ্যশ্রেণি) থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি রেস হয়ে উঠছে।’ তিনি লিখেছিলেন, শ্রমিকরা কথা বলছে ওইসব বুর্জোয়াজি বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির চেয়ে আলাদা ডায়ালেক্টে, তাদের চিন্তা ও আইডিয়ালসমূহ আলাদা, আলাদা তাদের কাস্টমস ও নৈতিকতার নীতিগুলি, আলাদা হয়ে পড়ছে ধর্মের দিক থেকে, রাজনীতির দিক থেকে। এঙ্গেলসের এই কথাগুলিকেই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে, দাঁড় করানো হয় শ্রেণিভাষার সপক্ষের যুক্তি হিসেবে। এঙ্গেলসের এই বাক্যগুলিকে ভিত্তি করে তখন দাবি করা হয়, তার মানে তিনি একটি সাধারণ, জাতীয় ভাষার প্রয়োজনীয়তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং ভাষার ‘শ্রেণিচরিত্রে’র কথাই বলে গেছেন। কিন্তু এঙ্গেল্‌সের বাক্যগুলি মন দিয়ে পড়লেই দেখা যায় তিনি এখানে ভাষার কথা বলেননি, ডায়ালেক্টের কথা বলেছেন। আর এর পেছনে এই উপলব্ধি কাজ করেছে যে, জাতীয় ভাষার প্রশাখা হওয়ার কারণে ডায়ালেক্ট বা উপভাষা জাতীয় ভাষার স্থান অধিকার করতে পারে না। তা ছাড়া এই পরিস্থিতি বর্ণনার সময় এঙ্গেলসের মূল বিবেচনা ভাষা ছিল না, ছিল মূলত শ্রেণিচিন্তা, শ্রেণিআদর্শ, নৈতিকতা, ধর্ম ও রাজনীতি।
একইভাবে, শ্রেণিভাষাপন্থীরা যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করেছেন ভ• ই• লেনিনের লেখা থেকে, পল লাফার্গের লেখা থেকে। দাবি করা হয়, পল লাফার্গ তাঁর প্যাম্পলেট ‘দ্য ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গুয়েজ বিফোর অ্যান্ড আফটার দ্য রেভ্যুলুশান ’-এ ভাষার শ্রেণিচরিত্র সনাক্ত করেছেন। লাফার্গের ওই প্যাম্পলেটও বিশ্লেষণ করেন স্ট্যালিন। দেখান, লাফার্গ প্রকারান্তরে একটি সাধারণ ভাষার অস্তিত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথাই বলে গেছেন। যারা তাঁকে ভাষাবিতর্কের মধ্যে টেনে এনেছিলেন, তারা এটি বিবেচনায় নেননি যে, লাফার্গ কথা বলেছেন অভিজাতদের ভাষাদম্ভ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের ‘অপভাষা’ নিয়ে। ভাষা ও অপভাষার মধ্যেকার পার্থক্য নিয়ে লাফার্গ আগ্রহ দেখাননি। ভাষার কৃত্রিমতা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। লাফার্গ তাঁর লেখায় ব্যবহূত উদ্ধৃতিগুলি দিয়ে তুলে ধরেছিলেন একটি বিশেষ সময়কে, যখন ইংল্যান্ডে সামন্ত শ্রেণির মানুষরা কথা বলত ফরাসি ভাষায়, যদিও ইংরেজ জনগণ কথা বলতো ইংরেজি ভাষাতে। কিন্তু এর মানে এই দাঁড়ায় না যে শোষকের ভাষা আর শোষিতের ভাষা আলাদা। যুক্তি হিসেবে এই পরিস্থিতিকে উপস্থাপনের চেষ্টা তাই নাকচ করে দিয়েছিলেন স্ট্যালিন। বলেছিলেন তিনি, এটি কোনও যুক্তি নয়, এটি বরং অ্যানিকডট। কেননা প্রথমত, সব সামন্তই তখন ফরাসি ভাষায় কথা বলতেন না, কোর্ট এবং কাউন্টির আসনগুলির ইংরেজ সামন্ত লর্ডদের একটি ক্ষুদ্র উচ্চতর অংশই কেবল ফরাসি ভাষায় কথা বলতেন। দ্বিতীয়ত, যে ভাষায় তারা কথা বলতেন, সেটি কোনও বিশেষ ‘শ্রেণিভাষা’ নয়, বরং সেটি ফরাসি জনগণের সাধারণ ভাষা। তৃতীয়ত, সামন্তদের ব্যবহূত ওই ফরাসি ভাষা কালক্রমে সমগ্র ইংরেজ জনগণের সাধারণ ভাষার মধ্যে কোনও গভীর চিহ্ন না রেখেই হারিয়ে গেছে। এই ক্ষেত্রে রাশিয়ার উদাহরণও স্ট্যালিনের পক্ষে ছিল। কেননা এক সময় রাশিয়ার অভিজাতরাও সমাজের বিশেষ উঁচু স্তরে এবং জারের কোর্টে শখ করে ফরাসি ভাষায় কথা বলেছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ক্ষমতাধরদের ভাষা হওয়াতে তখন রাশিয়ায় সর্বপ্রচলিত রুশ ভাষা তখন অবদমিত হয়েছিল, ফিকশনে পরিণত হয়েছিল এবং ‘শ্রেণি ভাষা’ই হয়ে উঠেছিল বাস্তবতা।
শ্রেণিভাষা, শ্রেণিব্যাকরণ এইসব প্রত্যয় দিয়ে নিকোলাই মারের অনুসারীরা ভাষাসংক্রান্ত যে-সংশয়াচ্ছন্নতা তৈরি করেছিলেন, তার সপক্ষে আরও এক যুক্তি ছিল লেনিন বর্ণিত বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত সংস্কৃতি। বুর্জোয়া আর সর্বহারার সংস্কৃতি ভিন্ন সংস্কৃতি – এই উপসংহারের সূত্র ধরে শ্রেণিভাষাপন্থীরা তখন বলেছিলেন, পুঁজিবাদের অধীনে জাতীয় সংস্কৃতির শ্লোগান একটি জাতীয়তাবাদী শ্লোগান, ঠিক তেমনি যারা জাতীয় ভাষা বা ভাষাসমূহের পক্ষে কথা বলছে তারাও প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদের ঘেরটোপে বন্দি হয়ে রয়েছেন। কেননা বুর্জোয়া ও সর্বহারার সংস্কৃতি যেমন ভিন্নরকম, তাদের ভাষাও ভিন্নরকম। এ যুক্তির উত্তর খুঁজতে গিয়ে স্ট্যালিনকে যেতে হয়েছিল লেনিনেরই লেখার কাছে, যাতে তিনি লিখেছেন :
ভাষা হলো মানুষের যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায়। একটি মুক্ত ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন আলাদা আলাদা শ্রেণির বিভিন্ন অংশের জন্যে, আধুনিক পুঁজিবাদের উপযোগী প্রকৃতই মুক্ত ও ক্রমবর্ধিষ্ণু বাণিজ্যিক যোগাযোগের জন্যে ভাষার ঐক্য এবং এর অব্যাহত বিকাশ একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ করে।
আর এ কারণেই নাজিপন্থী বানডিস্টরা যখন লেনিনকে জাতীয় ভাষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার এবং সংস্কৃতিকে ‘না-জাতীয়’ হিসেবে দেখার জন্যে অভিযুক্ত করেছিলেন, তখন লেনিন খুব জোর দিয়ে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, জাতীয় ভাষার বিরুদ্ধে নয়- তিনি সংগ্রাম করছেন বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। জাতীয় ভাষা বা ভাষাসমূহের প্রয়োজনীয়তা ছিল তাঁর কাছে তর্কাতীত একটি বিষয়।
এমনকি খোদ স্ট্যালিনকেই যুক্তি হিসেবে উত্থাপন করা হয়েছিল জ্যাফটিক তত্ত্বানুসারীদের পক্ষ থেকে। কমিউনিস্ট পার্টি অব সোভিয়েত ইউনিয়ন (বলশেভিক)-এর ১৬তম কংগ্রেসে দেয়া স্ট্যালিনের একটি লাগসই বক্তব্য খুঁজে এনেছিলেন তাঁরা। ওই বক্তব্যে স্ট্যালিন বলেছিলেন, যখন সমাজতন্ত্র সুসংহত হবে এবং প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে উঠবে তখন জাতীয় ভাষাগুলিও অপরিহার্যভাবে একটি অভিন্ন সাধারণ ভাষায় পরিণত হবে, যেটি, নিঃসন্দেহে রুশ অথবা জার্মান না হয়ে নতুন কোনও ভাষাই হবে। এর উত্তরে স্ট্যালিন পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে মার্কস এবং এঙ্গেলসের বিভিন্ন উপসংহারও যে নাকচ হয়ে গেছে, তা তুলে ধরে বলেছিলেন, সোভিয়েত রাশিয়ার রুশ, ইউক্রেনিয়, বেলারুশিয় এবং অন্যান্য সব সংস্কৃতিই এখন কনটেন্টের দিক থেকে সমাজতন্ত্রী কিন্তু ফর্মের দিক থেকে, উদাহরণত ভাষার দিক থেকে জাতীয়।

চার•
ভাষাচিন্তাকে সমৃদ্ধ করতে স্ট্যালিন যে ভারত, চীন ও তৎকালীন পাকিস্তানের দিকেও দৃষ্টি দিয়েছিলেন সেটি জানা যায়, স্ট্যালিন ও ভারতের রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে ১৯৫০ সালের কয়েকটি কথোপকথনের বিবরণ থেকে। ভারতের রাষ্ট্রদূত সারভেপল্লী রাধাকৃষ্ণন ১৫ জানুয়ারি ১৯৫০-এ স্ট্যালিনের সঙ্গে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আন্তঃসম্পর্ক ও বিশ্বের পরাশক্তিগুলির স্নায়ুযুদ্ধের ক্ষেত্রে ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে লন্ডনে নেহেরুর পুনর্ঘোষণা সম্পর্কে আলোচনা করতে যান। ওই সময় স্ট্যালিন কথা প্রসঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে পাকিস্তানের অধিবাসীদের ভাষাপ্রসঙ্গ তোলেন। তিনি ভারতের ভাষা নিয়েও কথা বলেন। জানতে চান, ভারতের ভাষাগুলির মধ্যে কোনটির বেশি প্রাধান্য। হিন্দি একটি ফোনেটিক ভাষা- তা জেনে স্ট্যালিন আশ্বস্ত হন এবং জানান, হায়রোগ্লিফিক ভাষা হলে চীনের জনগণের মতো খবরের কাগজ পড়া শিখতেই পাঁচ বছর লেগে যেত! রাধাকৃষ্ণন তার কূটনৈতিক বিবরণীতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু লেখেননি। কৃষ্ণনের বিবরণ থেকে জানতে পারছি, আলোচনার শেষদিকে গিয়ে তিনি আবারও জানতে চাইছেন, ভারতের আদালতের ভাষার সঙ্গে ভারতীয় কোনও ভাষার সাদৃশ্য বা সম্পর্ক আছে কি না।
১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩-তে ভারতের নতুন রাষ্ট্রদূত কে পি এস মেনন যখন স্ট্যালিনের সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন স্ট্যালিন আবারও কথা তোলেন ভারত ও তৎকালীন পাকিস্তানের ভাষা নিয়ে। স্ট্যালিন মেননের কাছে জানতে চান, ভারতের প্রধান ভাষা কোনটি- উর্দু না হিন্দি (স্ট্যালিন অবশ্য বলেছিলেন ‘হিন্দু’)? সবগুলি ভাষাই একই উৎস থেকে আসা কি না? আর কিভাবে সেগুলির ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক বিকাশ ঘটেছে? আলোচনার শেষদিকে পাকিস্তান প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্ট্যালিন আবার ভাষা প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তিনি মেননের কাছে জানতে চান, এটি কি সত্যি যে পাকিস্তান তাদের একটি নিজস্ব ভাষার উদ্ভাবন ঘটিয়েছে? জবাবে মেনন তাকে বলেন, উর্দু ভারতের ভাষাগোত্রের একটি ভাষা হিসেবেই বিকশিত হয়েছে, কিন্তু পাকিস্তান এতে অনেক ফারসি ও আরবি শব্দ যুক্ত করেছে। শুনে স্ট্যালিন বলেছিলেন, ‘তা হলে এটি সত্যিকারের জাতীয় ভাষা হতে পারে না।’ স্ট্যালিনের ভাষাসংক্রান্ত কৌতূহল মেননের কাছে পুরোপুরি খাটিই মনে হয়েছিল। কিন্তু এক বছর আগে ভাষা নিয়ে পাকিস্তানে যে রক্তঝরা আন্দোলন হয়েছিল, কথোপকথনের এই বিবরণ থেকে মনে হয়, তা তাদের আলোচনায় উঠে আসেনি।

তবে ভাষা সম্পর্কে স্ট্যালিনের ওই সময়ের অবস্থান থেকে বোঝা যায়, তত্ত্বগতভাবে তিনি পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলনকারী জনগণেরই পক্ষে ছিলেন। স্ট্যালিনের পর ভাষাবিজ্ঞান আরও বিকশিত হয়েছে, সমৃদ্ধ হয়েছে। যেমন, দেরিদা তাঁর রুশো ও লেভি-স্ট্রাউস পাঠের মধ্যে দিয়ে, তাঁদের তীক্ষ্ণ ও কোনও কোনও সময় বিদ্রুপাত্মক সমালোচনার মধ্যে দিয়ে অবনির্মাণবাদী এক কৌশলের বিকাশ ঘটান। তাঁর বিশ্লেষণাত্মক সমালোচনার মুখে পড়েন প্রতীতীবাদ বা ফেনোমেনোলোজির দার্শনিক এডমান্ড হুর্সেল এবং ফার্ডিনান্ড দ্য স্যসুরও। অবনির্মাণবাদী মতাদর্শের রাজনৈতিক রক্তপ্রবাহ লুকিয়ে রেখে দেরিদাকে পশ্চিমে বাজারজাত করা হয় সুপরিকল্পিতভাবে। কিন্তু ভাষাকে প্রতিনিয়ত সময়ের ফাক গলে বিচরণে সক্ষম অস্থির বিচিত্রময়ী হিসেবে উপস্থাপন করায়, অতীতের সত্যরূপ হিসেবে ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করায় অবনির্মাণবাদী মতাদর্শ খুব দ্রুতই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিশ্লেষণপ্রক্রিয়ায় প্রাক-সক্রেটিস ও সক্রেটিস যুগের সফিস্টদের সঙ্গে অবনির্মাণবাদীদের গভীর মিল, দার্শনিক ঐতিহ্যকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে অস্বীকার করার ক্ষেত্রে তাদের অভিন্নতা অচিরেই তাদের ভিত্তি টলোমলো করে দেয়। এইভাবে নয়া সমীক্ষা বা নিউ-ক্রিটিসিজমের ব্যর্থতা ও সংশয়াচ্ছন্নতার পর অবনির্মাণবাদকে ঘিরে তত্ত্বের জগতে যে আশাবাদ জেগে উঠেছিল, তাও মিলিয়ে যায়। ইতিহাসের চোখে শিল্পকে না দেখে, শিল্পের চোখে ইতিহাসকে দেখার এইসব অস্বাভাবিকত্ব সমাজের একটি অংশকে গ্রাস করলেও সত্যের সন্ধানে নিয়ত মানুষকে কব্জায় নিতে পারেনি।
আশার কথা, স্ট্যালিন ইতিহাসের চোখেই সমগ্র বিষয়টিকে দেখতে চেয়েছেন। তাই নিজের পূর্বাবস্থানকেও পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে দ্বিধা করেননি। ভাষাবিজ্ঞানের বিশেষ কিছু দিক পর্যালোচনা করলেও ভাষার সামগ্রিকতার সঙ্গে এসব দিক অবিচ্ছেদ্য হওয়ায় স্ট্যালিনের পর্যালোচনা এখনো প্রাসঙ্গিক। স্ট্যালিন যেমন দেখেছিলেন, এখনও আমরা দেখি, ভাষাবিতর্কের বিভিন্ন পর্যায়ে আসলে ভাষার প্রতি বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী ও শ্রেণির জনগণের সমভাবাপণ্ন না হওয়াটাই প্রধান সমস্যা হয়ে ওঠে। ‘জনগণের ভাষা’ ‘মুখের ভাষা’ ‘সাহিত্যের ভাষা’ ইত্যাদি বিভিন্ন কথিত পদবাচ্যের যে-বিতর্ক আমরা বাংলাদেশেও দেখতে পাই, তার উৎসও ভাষার প্রতি এই সমমনোভাবাপণ্ন না হওয়া। এবং এর পেছনে কাজ করে কোনো কোনো সাহিত্যিকের বিতর্ক সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখানোর মারাত্মক এক প্রবণতা। তাই আমরা দেখি, প্রচলিত শব্দভাণ্ডারকেই ভাষার মূল গাঠনিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে, কখনো জনগণের ভাষায় বক্তব্য তুলে ধরার নামে, কখনো আবার মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনার নামে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়, ভাষাকে উপভাষা অথবা অপভাষাক্রান্ত করে তোলা হয়। এ ধরণের প্রচেষ্টা কারও কারও ক্ষেত্রে বিষয়টি না বোঝার ফল, কারও ক্ষেত্রে নেহাৎই চটকদার ডায়ালেক্ট ব্যবহারের নামে জনপ্রিয় হওয়ার কিংবা এর মধ্যে দিয়ে যেন-তেনভাবে এক বিতর্ক তৈরি করে নিজেদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসার অপচেষ্টা, কারও কারও ক্ষেত্রে সুপরিকল্পিতভাবে ভাষার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা।
আমরা দেখেছি, শব্দের ভাণ্ডার বা ভোকাব্যুলারি ভাষাকে গঠন করে না, যেমনটি স্ট্যালিন বলেন, শব্দের ভাণ্ডার বরং নির্মাণ করে ভাষার ম্যাটেরিয়াল। একটি ভাষার শব্দভাণ্ডার তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যখন তা ব্যাকরণের নিয়ন্ত্রণে আসে,- এই ব্যাকরণই নির্ধারণ করে বাক্য বা বাক্যসমূহে বিভিন্ন শব্দের সংমিশ্রন ঘটবে কোন নিয়মে, শব্দসমূহের অর্থকে বিশেষিত করা হবে কোন নীতির ভিত্তিতে। এই নীতিমালাগুলিই ভাষাকে সক্ষম করে তোলে সম্মিলিত ও তাৎপর্যপূর্ণ কাজে।
ব্যাকরণ হলো, স্ট্যালিনের ভাষায়, সুদীর্ঘ সময় ধরে মানুষের মনের মধ্যে উপস্থাপিত বিমুর্তায়ন প্রত্র্নিয়ার ফসল। এ কারণে স্ট্যালিন এর সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন জ্যামিতির সঙ্গে। ভাষা ও শব্দের ভাণ্ডারের নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তনের কথা তিনি অস্বীকার করেননি বটে, কিন্তু ভাষার ওপর প্রভূত্ব তৈরির জন্যে, ভাষাকে ব্যবহার করে নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্যে বিশেষ গোষ্ঠী যে অপভাষা বা সাধারণ জনগোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন ডায়ালেক্ট-এর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে থাকে, সেটি স্পষ্টই বলেছেন। তাঁর এই পর্যবেক্ষণকে ভাঙচুর করে বলা যায়, কোনও সাহিত্যিক কোনও ডায়ালেক্ট অথবা জারগন সফলভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হলে তা ভাষার শব্দভাণ্ডারে যুক্ত হতে পারে, কিন্তু তা জীবন্ত শব্দ হিসেবে ব্যবহূত নাও হতে পারে। শক্তিমান সাহিত্যিক কোনও ডায়ালেক্টকে সামগ্রিক সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে জীবন্ত করে তুলতে পারেন, মানুষ কিছুদিন তা বলাবলিও করতে পারে রাস্তাঘাটে, আড্ডায় আর পানশালাতে; কিন্তু তার মানে এই নয় যে তা সমগ্র জনগোষ্ঠীতে সুদীর্ঘ সময়ের জন্যে ব্যবহারোপযোগী হয়ে উঠবে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ডায়ালেক্টকে এখন সাহিত্যে কিংবা নাটকে খুব কমই ন্যায়সঙ্গতভাবে এবং শৈল্পিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশে কর্পোরেট পুঁজির দাপট ক্রমশই বাড়ছে, কর্পোরেট সে পুঁজির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষকে কাতুকুতু দিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার স্বভাব আর প্রবণতাও বাড়ছে, তারুণ্যকে এই কাতুকুতু দেয়া-নেয়ার প্রক্রিয়ায় শামিল করার জন্যেও চলছে নিত্যনতুন বিচিত্র আয়োজন। আর এই আয়োজনকে বৈধতা দেয়ার জন্যে দোহাই দেয়া হচ্ছে জনগণের ভাষার – যদিও জনগণের সেই ডায়ালেক্টকে, তাদের জীবনযাত্রাকে গভীর তলদেশ থেকে তুলে আনার লক্ষ থেকে নয়, বরং ব্যবহার করা হচ্ছে মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে বসে হাসাহাসি করার করার কাজে, অবসর বিনোদনের কাজে। সাহিত্যে কিছু আঞ্চলিক শব্দ বা ব্যবহারিক জীবনের কিছু শব্দ যুক্ত করলে, ক্রিয়াপদকে বিচিত্র এক কথ্যরীতিতে লিখলে কিংবা নিজের পছন্দ অনুযায়ী একটি বানানরীতি ব্যবহার করলেই ভাষাকে পাল্টে দেয়া যায় না। এ সবের মধ্যে দিয়ে শ্রেণিবোধের প্রকাশ ঘটাচ্ছি, জনগণের ভাষাকে সাহিত্যে গ্রহণযোগ্য করে তুলছি, নতুন ভাষা সৃষ্টি করছি বলে আমরা আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে পারি – কিন্তু ভাষার তাতে কোনও কিছুই আসে যায় না, ভাষা তাতে পাল্টেও যায় না। কিছুদিনের জন্যে হয়তো সে অস্বস্তিতে ভোগে, অস্বস্তির কারণে দাপাদাপি করে, আর সেই দাপাদাপিকে আমরা কেউ কেউ আবার ‘এই ভাষা দারুণ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে’ ভেবে তাদের পদানুসরণ করার জন্যে ঝাপিয়ে পড়ি; কিন্তু, স্ট্যালিন যে বলেছেন, ভাষা অবকাঠামো থেকে রেডিক্যালি আলাদা- শেষ পর্যন্ত তাই দেখা যায়, ভাষা এত রেডিক্যাল যে খুব সহজেই ওইসব অস্বস্তি-উৎপাত হজম করে ফেলেছে অথবা সেসব ফেলে দিয়েছে পরিত্যক্ত বর্জ্য হিসেবে।

ইমতিয়ার শামীম

আপনারে এই জানা আমার ফুরাবে না...

৯ comments

  1. kamruzzaman Jahangir - ১৬ এপ্রিল ২০১০ (৮:৪০ পূর্বাহ্ণ)

    ইমতিয়ার শামীমকে ধন্যবাদ। জোসেফ স্ট্যালিনের ভাষাবিষয়ক লেখা শুধু নয়, তার পাণ্ডিত্য, লিডারশীপ, সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের নায়কোচিত কর্ম ইত্যাদির উপর মানুষের আগ্রহ কম নয়। আপনি এদিক থেকে নিশ্চয়ই দরকারি একটা কাজই করেছেন। তবে আপনার কাজটি একেবারে মার্কসিজম আর স্ট্যালিন চিন্তাধারাকে বহনের জায়গা থেকে লেখা। ভাষার বিষয়টিই দেখেন, এটিকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে স্ট্যালিন দেখছেন, এর ভিতর বস্তুতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতা দাঁড় করাতে চাইছেন। এখানে ব্যক্তির সৃজনমুখরতার মূল্য আছে কি?
    সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, তিনি অপরাপর বিষয়ের মতো ভাষাকে কেবলই উপরিকাঠামোর একটা বিষয় মনে করছেন। একজন প্রগতিশীল বস্তুবাদী নায়ক সেটাই করবেনÑতাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার এই যে পতনশীল অবস্থা এর জন্য কি কেবলমাত্র অর্থনৈতিক বিষয়টিই এস্টাব্লিস্ট করার ভিতরে নেই? সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অন্যসব বিষয়, দর্শন, শিল্প-সংস্কৃতি, আইন, ভাষাতত্ত্ব ইত্যাদিসহ অন্যকিছুর চর্চা সেভাবে হয়েছে? ‘সামগ্রিক চর্চাবিহীন পলিটিক্যাল ক্যাডারশীপ’ই তো প্রগতিশীলতার বারোটা বাজিয়েছে। সমাজতন্ত্র বিনির্মাণ একটি চলমান প্রক্রিয়া, এতে গণতন্ত্র একটি অপরিহার্য বিষয়। ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে তা হবে না। আমি বলতে চাইছি, ব্যক্তির সৃজনশীলতাকে বাদ দিয়ে মানবসভ্যতার স্থায়ী বস্তুতান্ত্রিক অগ্রগতি টিকবে না।
    তিনি যে ভাষার মৌলিকতার কথা বলছেন, যোগাযোগের দিকটি তুলে ধরছেন, তাতে মানুষের চলমান সাংস্কৃতিক তাড়নাকে খাটো করা হয়।
    ভাষার শব্দভাণ্ডার ফেলে দেয়ার মতো কোনো বিষয় নয়। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীকে যত মানুষ তত ভাষা। ভাষাকে অর্থনৈতিক যান্ত্রিক খাঁচায় আটকে ফেলে মানুষের মানবিক মুক্তি অসম্ভব।
    আপনি ভাষার নৈরাজ্য নিয়ে বেশ শঙ্কিত! নৈরাজ্য সবসময় নেগেটিভ ধারণাকে বহন করে না। কোনো কোনো নৈরাজ্য সমাজের প্রকৃত গতিশীলতাকে বাড়িযে দেয়ার তাড়নায় থাকে। রাষ্ট্রের অনেক আগেই ভাষার সৃষ্টি। তখন রাষ্ট্রপালিত কোনো ব্যাকরণ ছিল না। রাষ্ট্রব্যবস্থাই তার প্যাদানির স্বার্থে একটা ভাষাকে লালন করে, দুধ-কলা খাওয়ায়। সরকার মহোদয় সবসময় ছোবলের ভয়ে থাকে। কাজেই একটা মানভাষাকে তার লালন করতেই হয়। কিন্তু সৃজনশীলতা রাষ্ট্রের প্যাদানিকে অস্বীকার করে। একটা বিষয় স্পষ্ট যে ভাষার মৌলিকত্ব, ব্যাকরণসিদ্ধতা একটি সমকালীন ধারণা। ব্যাকরণ তো কোরাণ শরীফ নয়। এতে ওহি নাযেল হওয়ার কোনো সিস্টেম নেই। বরং এর আছে প্রবহমানতা। সান্ধ্যভাষা, চলতি ভাষা, মানভাষা, লৌকিক ভাষা ইত্যাদি নানান প্রয়োজনকে আমরা ব্যবহার করি। মানভাষা অলওয়েজ একটি সিস্টেমকে রিপ্রেজেন্ট করে। এটি তৈরি করা জিনিস। কারও মাতৃভাষাই মানভাষাাকে রিপ্রেজেন্ট করে না; এটি সভ্যতার প্রয়োজনে বানানো হয়। আবার বানানো জিনিসকেই বানানো জিনিস দ্বারা খণ্ড-বিখণ্ডও করা হয়।
    যাই হোক, শেষ কথা হচ্ছে, ভাষারও শেষ কথা বলে কিছু নেই। গণতন্ত্রের প্রগতিশীলতার প্রয়োজনে প্রতিজনের নান্দনিক ভাষাকেই স্যালুট করতে চাই। রাষ্ট্রপালিত ভাষার সৃজনশীলতায় আরও উন্মুক্ত অবস্থাই আশা করি। রাষ্ট্র-ফর্মান জারি করে, কিংবা উপরিকাঠামোর ফর্মুলা দিয়ে ভাষার প্রবহমানতা রুদ্ধ করা যায় না।

    • ইমতিয়ার - ১৬ এপ্রিল ২০১০ (৫:০৬ অপরাহ্ণ)

      জাহাঙ্গীর ভাই, আপনার মন্তব্য সম্পর্কে সময় নিয়ে লেখার ইচ্ছে রাখি। তবে যারা এ লেখা পাঠ করবেন, তারা যাতে ভুল না বোঝেন, সে কারণে একটি মৌলিক বিষয় পরিষ্কার করে রাখি। আপনি লিখেছেন,

      ভাষার বিষয়টিই দেখেন, এটিকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে স্ট্যালিন দেখছেন, এর ভিতর বস্তুতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতা দাঁড় করাতে চাইছেন। এখানে ব্যক্তির সৃজনমুখরতার মূল্য আছে কি?
      সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, তিনি অপরাপর বিষয়ের মতো ভাষাকে কেবলই উপরিকাঠামোর একটা বিষয় মনে করছেন। একজন প্রগতিশীল বস্তুবাদী নায়ক সেটাই করবেনÑতাই তো স্বাভাবিক।

      আসলে স্ট্যালিনের নাম শুনে কেউ কেউ প্রথম দফাতেই এরকম ভেবে নেন। কিন্তু স্ট্যালিন ভাষাকে কাঠামো কিংবা অবকাঠামো অর্থাৎ উপরিকাঠামোর কোনওটির অংশ হিসেবেই বিবেচনা করেননি। এবং এ অবস্থানের কারণে তিনি শ্রেণিভাষার দাবিও নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি ভাষাকে রাষ্ট্রেরও বাইরে বিবেচনা করেছেন, কেননা রাষ্ট্রের ভাঙাগড়া উভয় ক্ষেত্রেই ভাষা ভূমিকা রাখে।

  2. মাসুদ করিম - ১৬ এপ্রিল ২০১০ (২:১৭ অপরাহ্ণ)

    ভাষা সবার, ভাষা দীর্ঘস্থায়ী এবং ভাষা উৎপাদন সম্পর্কিত। এই তিন মৌলিক স্বভাব ভাষাকে শ্রেণী নিরপেক্ষ করেছে। সংক্ষেপে এটাই আমি বুঝতে পারলাম স্ট্যালিনের ভাষাভাবনা থেকে। আমাদের মান ভাষা প্রমিত ভাষা বিতর্কে শ্রেণি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত নাট্য পরিচালক কামালউদ্দিন নীলু তার ‘মেটামরফসিস’ নাটকের মঞ্চায়নের পর, কাফকার গল্প অবলম্বনে করা ওই নাটকের ভাষা বিষয়ে আমার এক বন্ধুর আপত্তির উত্তরে বলেছিলেন, মাম্মি ড্যাডিদের কথা মাথায় রেখে আমি আমার সংলাপ তৈরি করেছি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, যেমন আমার বন্ধুরও মনে হয়েছিল, আসলে নীলু যেমন তেমন ভাবে সংলাপ লিখেছিলেন এবং তার এই যা-ইচ্ছা-তা সংলাপের কারণে তার ‘মেটামরফসিস’ মঞ্চে কিছু বিন্যস্ত লাফালাফি ছাড়া আর কিছুই সৃষ্টি করেনি। অবশ্য আমাদের ভাল না লাগলেও এই ‘নেশাগ্রস্ত শারীরিক কসরত’ এখন থিয়েটারের একটা বড় ফর্ম। আমাদের শ্রেণিবাদী যা-ইচ্ছা-তা লেখকরাও থিয়েটারের এই ‘নেশাগ্রস্ত শারীরিক কসরত’ ভাষায় প্রয়োগ করে বাড্ডা থেকে বারিধারাকে তাদের সাহিত্যকর্মে রূপদান করছেন। তবে এখনো পর্যন্ত কেউই তেমন সাহিত্যিক সফলতার মুখ দেখতে না পেয়ে, দৃশ্য মিডিয়াকেই আক্রান্ত করে যাচ্ছেন : ফলে বিরতিহীন ভাবে টিভিনাটক সিরিয়াল ও সুস্থধারার ছবিতে এই ভাষার প্রতাপ আমাদের মূল ভাষাকে বিকৃতই করছে, আর লেখার চেয়ে সেকাজ অভিনেতাদের মুখের ভাষায় করানো সহজ বলেই হঠাৎ করে দেশে শয়ে শয়ে নাট্যকারের (আসলে স্ক্রিপ্টরাইটার) দেখা মিলছে। আমি নিজে মান ভাষা প্রমিত ভাষা নিয়ে খুব একটা ভাবি না, কিন্তু ভাষার ব্যাকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এটা আমার উপলব্ধি। আমাদের রাজধানী ঢাকার এখনকার ভাষা, যা এক খিচুড়ি ভাষাই, তার রূপকে আমরা যেভাষায় প্রকাশ করব, সেতো বাংলাই, কাজেই বাংলা ব্যাকরণের নিয়ম মেনেই তাকে প্রয়োজন মতো ভেঙ্গেচুরে শিল্পসৃষ্টি হলে তো খারাপ ছিল না। কিন্তু লেখকদের ব্যাকরণ বিষয়ে উন্নাসিকতা ও বানান নিয়ে মামদোবাজি এসব তো শিল্পসৃষ্টির লক্ষণ নয়। স্ট্যালিন হয়তো যেকথা বলেননি, কিন্তু যা বলতেই পারতেন, ভাষা স্থিতিস্থাপক, কাজেই তার সব প্রয়োজনীয় ব্যাকরণ মেনেই বা নতুন ব্যাকরণ সৃষ্টি করেও, ভাষা অনেক টানাপোড়েন সহ্য করেও টিকে থাকতে পারে। ভাষাটাকে তাই জানতে হয়, ভাবতে হয়, বলতে হয়, দেখতে হয়, খেতে হয়, নিতে হয়, দিতে হয়, রাখতে হয়, ফেলতে হয়, ঢালতে হয়, ছাঁচতে হয়, ছেনতে হয়। আর ব্যাকরণ তো এসব ক্রিয়াকাণ্ডেরই স্বীকৃতি। তাই আমাদের উচিত ‘শ্রেণিভাষা’ না খুঁজে ভাষা ও আঞ্চলিক ভাষার পরিসরে থেকে ভাষার সৃষ্টিক্ষমতা বাড়ানো। সব সৃষ্টিশীল ভাষাভাষি ও ভাষাকর্মীদের নিজের ভাষার প্রতি এই দায়িত্ব পালন করা উচিত। ‘শ্রেণিভাষা’ খুঁজে মরা ভাষাভাষি ও ভাষাকর্মীরা সেই দায়িত্বেই অবহেলা করছেন।

  3. kamruzzaman Jahangir - ১৭ এপ্রিল ২০১০ (১:৫৬ পূর্বাহ্ণ)

    @ ইমতিয়ার শামীম, আপনি সময় নিয়ে কথা বলবেন জেনে আরও ভালো লাগছে। কথাক্রমে বলে রাখতে হয়, স্ট্যালিনের নাম শুনে অনেকের ভিন্ন ধারণা হতে পারে, এধরনের পূর্বধারণা থেকে আমার মন্তব্যসমূহ নয়। আমি তাঁকে নায়কই বলছি। আরও বলে নিতে হয় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর অবদান, প্রাভদা’র সাথে তাঁর সম্পাদকীয় সম্পর্ক, ওপেনলি রাজনৈতিক বিচার করার দৃষ্টান্ত অনুকরণীয় কর্মই হয়ে আছে। অনেক ভাই-বেরাদরের মতো তাঁকে আমি এন্টিহিরো মনে করছি না। আমি এও মনে করি, আমার এই কথাবার্তাই তা প্রাসঙ্গিকও নয়। আমি মূলত দুইটি জায়গায় সরাসরি আমার মত রেখেছিÑ
    ১. সর্বহারার একনায়কতন্ত্র নয়, সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের নানান পর্যায়ে সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের স্থলে সর্বহারার গণতন্ত্র থাকা উচিত। যে কোনো ধরনের একনায়কতন্ত্র ক্রমশ একধরনের এরশাদীয় প্রবণতা তৈরি করে। কেউ কেউ হিটলার মুসোলিনিও হয়ে যেতে পারে।
    ২. ভাষা কিংবা ব্যাকরণের মৌলিকত্বে আমার আস্থা নেই, কারণ এটি একটি জীবন্ত অধ্যায়, এতে পরিবর্তনশীল প্রবহমানতা থাকবে।
    @ মাসুদ করিম, আপনি মূল ভাষা বলতে কোনটাকে বোঝাচ্ছেন? ভাষা তো গার্হস্থ জিনিস নয় যে আমি একে নিজের আমানত মনে করব। চর্যাপদ থেকে আপনার উল্লিখিত কামালউদ্দীন নীলুর প্রেরিত ভাষার ভিতর পর্যন্ত ভাষার প্রচুর ভাঙচুর হয়েছে, এখনও হচ্ছে। তাহলে মূলভাষা বলতে আপনি কী জিনিসকে বোঝাচ্ছেন, এবং তা আমার মতো অধমের মগজে প্রেরণ করতে চাচ্ছেন, তা কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না।
    আবারও বলছি, ব্যাকরণ সৃষ্টির পূর্বে ভাষার নির্জন রূপ আমরা পেয়েছিলাম। তখন কাউকে এ প্রশ্ন করার স্কোপ ছিল না, জনাব শামসুজ্জামান খান, প্রমিত ভাষার বাইরে ভাষাচর্চা করলে কি আমায় জেল-ফাঁসি দিবেন?

  4. মোহাম্মদ মুনিম - ২১ এপ্রিল ২০১০ (১০:২১ পূর্বাহ্ণ)

    স্তালিনের ভাষা বিষয়ক আলোচনার লিঙ্ক এখানে

  5. মোহাম্মদ মুনিম - ২২ এপ্রিল ২০১০ (১:০২ পূর্বাহ্ণ)

    মার সাহেবের জ্যাফেটিক তত্ত্বটির কথা জানা ছিল না, মানবজাতি এক ভাষা থেকে এসেছে, আবার শ্রেণীহীন সমাজের মাধ্যমে এক ভাষাতে ফিরে যাবে। এই দর্শনের মাঝে একটা রোমান্টিকতা আছে। Wikipedia পড়ে মনে হচ্ছে এই রোমান্টিকতার খানিকটা প্রয়োগও হয়েছিল, মধ্য এশীয় দেশগুলোর ভাষাগুলোকে রুশিকরনের একটা প্রচেষ্টা হয়েছিল। সেটা হয়েছিল স্তালিনের আমলেই। মার সাহেব মৃত্যু পর্যন্ত দারুন প্রতাপশালী ছিলেন। স্তালিন নিজেই জ্যাফেটিক তত্ত্ব প্রয়োগ করে কেন নিজের জীবনের শেষের দিকে এসে এই তত্ত্বের বিরোধিতা করলেন কেন সেটা ঠিক বোঝা গেল না। সোভিয়েট ইউনিয়ন যেহেতু বহু জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল, জ্যাফেটিক তত্ত্ব বাতিলের পরে অনুন্নত জাতিগুলোর ভাষাগুলোকে রুশিকরনের প্রক্রিয়া কি বন্ধ হয়েছিল?

  6. ইমতিয়ার - ১২ মে ২০১০ (৪:০৯ অপরাহ্ণ)

    স্তালিন নিজেই জ্যাফেটিক তত্ত্ব প্রয়োগ করে কেন নিজের জীবনের শেষের দিকে এসে এই তত্ত্বের বিরোধিতা করলেন কেন সেটা ঠিক বোঝা গেল না।

    লেখার সময় এ বিষয়টি আমাকেও ভাবিয়েছে। কিন্তু কোথাও এমন কোনও সূত্র পাইনি, যা থেকে মনে হয় যে, স্তালিন নিজেও প্রত্যক্ষভাবে ওই তত্ত্ব প্রয়োগের প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন। তিনি যদি কোনওভাবে ওই তত্ত্বে মোহগ্রস্থ হয়েও থাকেন, তারপরও পরবর্তী সময়ে নতুনভাবে পর্যালোচনা করা অস্বাভাবিক নয়। সেই পর্যালোচনার প্রক্রিয়া বোধহয় খানিকটা হলেও এ লেখায় তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে।
    আরেকটি বিষয় হতে পারে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর এমন সব আশু বিষয় রাষ্ট্রের সামনে ছিল যে স্ট্যালিন মার-এর কর্মকাণ্ড নিয়ে আলাদাভাবে চিন্তা করার সুযোগই পাননি। সোভিয়েত রাশিয়ার চারদিক থেকে সামরিক আক্রমণের সম্ভাব্যতা সে সময়ের রাষ্ট্রপক্ষের সামনে সামরিক শক্তি বাড়ানোর বিষয়টিকে বিশেষভাবে বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে। সে হিসেবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পৃথিবী ঠাণ্ডা যুদ্ধের যুগে প্রবেশ করায় হয়তো স্ট্যালিনের পক্ষে সম্ভব হয়েছে বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করা (যেমনটি দেখা যাচ্ছে ভারতের কূটনীতিকদের সঙ্গে তিনি বহু ভাষার দেশ ভারত ও পাকিস্তানের ভাষা নিয়ে কথা বলছেন, হতে পারে- বহুভাষী অন্যান্য দেশের সঙ্গেও তিনি এ নিয়ে কথা বলেছেন)।

    সোভিয়েট ইউনিয়ন যেহেতু বহু জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল, জ্যাফেটিক তত্ত্ব বাতিলের পরে অনুন্নত জাতিগুলোর ভাষাগুলোকে রুশিকরনের প্রক্রিয়া কি বন্ধ হয়েছিল?

    এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এপ্রিল ২০১০ সংখ্যা কালি ও কলমে ‘মাতৃভাষা ও সোভিয়েত ভাষা-পরিকল্পনা’ নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন, কয়েকটি সোভিয়েত রাষ্ট্রীয় ভাষার কবিতার অনুবাদ-এর ভূমিকা হিসেবে। লেখাটি যদিও দুর্বল, তারপরও প্রসঙ্গত এখানে তুলে ধরছি :

    আমরা ভাষাকে অনেক সময় মাতা, পিতা, মাটি বা দেশের উত্তরাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে থাকি। রুশ ভাষায় মাতৃভাষার শব্দ রাদৈজিনিক-এ ওইসব উত্তরাধিকারের একত্রে সমাহার ঘটেছে।
    জাঁ জাক্‌ রুশো তাঁর ‘এসে অন দি অরিজিন অব ল্যাঙ্গুয়েজ’ (ভাষার উৎপত্তিবিষয়ক প্রবন্ধ)-এ বলেন, রাজনীতির সম্ভাব্যতার পূর্বেই ভাষার বিকাশ ঘটতে হবে। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ্য ছিল প্রভঁসাল, ব্রতঁ বা বাস্ক ইত্যাদি আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব গৌণ পর্যায়ে রেখে মান ফরাসি বা ইল দ্য ফ্রাঁসের ফরাসিকে জাতীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে জাতির সংজ্ঞা-নিরূপণে ভাষার গুরুত্বের ওপর দৃষ্টি পড়ে। জাতিগঠনে আজ ভাষা-পরিকল্পনার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ করা হচ্ছে।
    অক্টোবর বিপ্লবের আগে রুশ সাম্রাজ্যে রুশভাষাই ছিল সরকারি ভাষা। সংখ্যালঘুদের ভাষার ব্যাপারে তেমন সহিষ্ণুতা ছিল না। এক জার (সম্রাট), এক ধর্ম ও এক ভাষা ছিল রাষ্ট্রনীতি। শ্রেণি, ধর্ম ও জাতিগত পরিচয়ের সীমান্ত অতিক্রম করে সোভিয়েত নীতি চিন্তা করে সেই সমাজের যেখানে এক অনন্য সংস্কৃতি গড়ে উঠবে সকল সংস্কৃতির সম্মিলিত প্রয়াসে তিনটি পর্যায়ে – রাস-ভেত (বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রস্ফুটন), এসব্লিজেনিইয়ে (তাদের সম্মিলন) এবং স্লিইয়ানিয়ে (এক সুষম ঐক্য)। ভাষার ক্ষেত্রে সে-প্রক্রিয়া এক বিশ্বভাষার দিকে অগ্রসর হবে। সমাজতন্ত্রের জয়ের পর জাতীয় ভাষাগুলোর উন্নয়ন, সম-অধিকারসম্পন্ন সকল জাতীয় ভাষার মধ্য থেকে এক ভাষার নির্বাচন, পর্যায়ক্রমে আন্তঃভাষার রূপান্তরণের মাধ্যমে যোগাযোগের প্রধান বাহন এবং আন্তঃভাষাসমূহের একটি ভাষাকে বিশ্বভাষায় রূপান্তরণ।
    ‘মার্কসবাদ ও জাতীয় প্রশ্ন’ (১৯১৩) শীর্ষক প্রবন্ধে স্তালিন জাতির সংজ্ঞা দিয়েছেন : ‘একটি জাতি ইতিহাস-বিবর্তিত, ভাষা, বাসস্থান ও অর্থনৈতিক জীবনের স্থায়ী সমাজ এবং এশটি সমাজ-সংস্কৃতিতে মানসিক গঠনের অভিব্যক্তি।’
    জাতিগঠনে ভাষার স্থান অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। এক ভাষা থাকলেই একটি বিশিষ্ট মানবগোষ্ঠীকে জাতি আখ্যা দেওয়া যায় না। আমেরিকান, ইংরেজ ও আইরিশরা যেমন এক জাতি নয়, তেমনি নরওয়েজিয়ান ও ডেনরাও এক জাতি নয়। কিন্তু এক ভাষা না থাকলে এক জাতি হয় না। জার্মানরা ও ডেনরা এক স্থানে বাস করে ও এক অর্থনৈতিক জীবনে যুক্ত হয়েও এক জাতি হয়ে যায় না।
    জাতীয় মনোভাবের মূল চরিত্রটা কী যা আজ পৃথিবীতে বিরাট শক্তি আকারে দেখা যাচ্ছে এবং যা স্বাভাবিক পরস্পরনির্ভরশীলতার সম্মুখে এত জোরে নিজকে আঁকড়ে ধরেছে। জি. ডি. এইচ. কোল মূল চরিত্রটি বর্ণনা করেছেন, ‘যে দল নিজেকে জাতি হিসাবে মনে করে সে চায় পূর্ণ স্বাধীনতা তার ভাষা ব্যবহারের জন্য – তার ভাষা যা তার কাছে স্বাভাবিতভাবেই আসে এবং তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক প্রধান অংশকে রূপ দেয়; সে চায় তার ভাষাকে অফিসে, ব্যক্তিগত কাজকর্মে ব্যবহার করা হোক, সে চায় তার ভাষা আদালতে, কোতওয়ালিতে ও শাসনব্যবস্থায় কথ্য হোক। সে চায় স্কুলে তার ভাষার শিক্ষা হবে মূল এবং অন্যান্য ভাষার শিক্ষা দেওয়া হবে তার ভাষার মাধ্যমে। সে চায় তার ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশিত হোক, পুস্তক রচিত হোক, নাটক মঞ্চস্থ হোক। অন্য কথায়, সে চায় তার ঐতিহ্যশালী ভাষা অভ্রান্তভাবে হোক তার দেশের ভাষা।’
    সোভিয়েত দেশ ছোট-বড় ১৮০টি জাতির মিলনস্থল। ১৮০টি জাতির মধ্যে ৬০টি বৃহত্তর ও সুগঠিত জাতি। সোভিয়েত বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ায় ছিল রুশ ভাষার একচ্ছত্র রাজত্ব। বিপ্লব ভাষার সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে বাড়িয়ে দিলো বহুগুণে। সোভিয়েত বিপ্লবের পূর্বে, উদাহরণস্বরূপ, কিরঘিজিয়ার কোনো বর্ণমালা ছিল না। আজিমভ্‌ ও বালিয়েভ্‌ অনেকগুলো কথ্যভাষার বর্ণলিপি স্থির করেন। ১৯৩৪ সালের সোভিয়েত লেখকদের প্রথম অধিবেশনে উপস্থিত ৬০০ জন প্রতিনিধির মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ছিল অ-রাশিয়ান জাতিগুলোর অন্তর্ভুক্ত এবং তাঁরা পঞ্চাশাধিক ভাষার মাধ্যমে তাঁদের সৃজনীশক্তির বিকাশ ঘটায়। ত্রিশ হাজার কিউরিনস্ককে ভাষা পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন সুলেমান স্তালস্কিকে। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনান্তে ১১০টি ভাষায় পুস্তক প্রকাশ করা হয়েছিল। রুশ ও পশ্চিম য়ুরোপের শ্রেষ্ঠ লেখকদের রচনা সোভিয়েত দেশের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। সারভেন্টেস ১১টি ভাষায় ও শেক্‌সপিয়র ১৭টি ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯১৩ সালে বাইলো-রুশ ভাষায় মাত্র তিনখানি বই প্রকাশ করা হয়। ১৯৩৩ সালে সেখানে ৬৯৩টি পুস্তক প্রকাশিত হয় এবং ৮০ লাখ বই ছাপানো হয়। অনুরূপ একাধিক উদাহরণ রয়েছে অন্যান্য ভাষার ক্ষেত্রে।
    যাঁরা লাতিন বর্ণমালা সম্পর্কে বাকু কংগ্রেসে সোচ্চার হন তাঁরা স্তালিনের বিরাগভাজন হন। অনেকে নিখিল তুর্কবাদ প্রচারের জন্য নির্বাসিত হন, অনেকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। স্তালিন আশঙ্কা করেন, ব্যাপক লাতিন হরফের চল তুর্কিভাষীদের মধ্যে যে ঐক্য গড়ে তুলবে তা সোভিয়েত প্রাধান্য ক্ষুণ্ন করবে। ১৯৩৭ সালে স্তালিন সকল তুর্কি প্রজাতন্ত্রের জন্য সিরিলিক বর্ণমালা বাধ্যতামূলক করেন। স্তালিনের জন্মস্থান জর্জিয়া ও তাঁর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা মিকোইয়ানের দেশ আর্মেনিয়ায় চালু বর্ণমালা অবশ্য অপরিবর্তিত থাকে। ১৯৩৯ সাল সোভিয়েত তুর্কি প্রজাতন্ত্রগুলোতে লাতিন বর্ণমালার পরিবর্তে রুশ ভাষায় ব্যবহৃত সিরিলিক বর্ণমালা চালু করা হয়। কিছু-কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধ্বনি, বিশেষ করে স্বরবর্ণের সিরিলিক হরফের জন্য আজারবাইজানিদের কাছে তাদের পরিচিত ভাষা উজবেক, তুর্কমেন বাসকিরিন বা চুভাল ভাষায় লিখিত কোনো কোনো শব্দ কিছু দুষ্পাঠ্য হয়ে গেল। তুর্কি জাতিসমূহের একত্রকরণের সম্ভাবনা হলো সুদূরপরাহত। সিরিলিক বর্ণমালা এমন একটি শ্রীহীন বর্ণমালা যার ‘ংয’, ‘র’, ‘স’, ‘ঃ’ যখন পরপর লেখা হয় তখন তাদের চেনা দায় হয়ে ওঠে। লক্ষ লক্ষ লোক হঠাৎ করে অশিক্ষিত হয়ে গেল। বয়স্কদের পক্ষে নতুন হরফ আয়ত্ত করা বেশ দুরূহ হয়ে পড়ল।
    জ্বালানি তেল-উৎপাদন প্রবৃদ্ধির সময়ে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে হরফ ব্যাপারটা বিশেষ পর্যালোচনা করে ভাবা হয় আজারবাইজান ভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে একেবারে নতুন একটি লাতিন বর্ণমালা তৈরি করা যায় কি না। যখন ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে এবং আজারবাইজান স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে খুব স্বাভাবিকভাবেই লাতিন বর্ণমালা পুনঃপ্রবর্তিত হয়।
    রাতারাতি হরফ বদলালে যা হয় তা-ই হয়েছে সম্প্রতি আবার লাতিন বর্ণমালার প্রত্যাবর্তনে। প্রত্যেকবার বর্ণমালার পরিবর্তনে জাতীয় ঐতিহ্যের এক মূল্যবান অংশ হারিয়ে যায় বা দুর্গম হয়ে পড়ে। লাতিন হরফের জন্য আরবি ঐতিহ্য এবং সিরিলিক হরফের জন্য লাতিন ঐতিহ্যে তোলপাড় চলে। কারো কারো ক্ষেত্রে এক জীবদ্দশায় চার-চারবার আরবি-লাতিন-সিরিলিক-লাতিন হরফের পরিবর্তন ঘটে।
    সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পূর্বের সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মধ্যে একটা ভাষাভিত্তিক পুনরুজ্জীবন ঘটে। আর্মেনিয়া, এস্তোনিয়া, জর্জিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং ইউক্রেনে মাতৃভাষার অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন প্রজাতন্ত্রের জন্ম হয়। মধ্য-এশিয়ার আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, কিরঘিজিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান পূর্বের রুশ প্রভুদের সিরিলিক বর্ণমালা ত্যাগ করে তুর্কি জ্ঞাতিগোষ্ঠী কর্তৃক গৃহীত পশ্চিমা বর্ণলিপি গ্রহণ করে। তাজিকিস্তান আরবি বর্ণমালা বেছে নেয়।
    সোভিয়েত রাশিয়ার ভাষা-পরিকল্পনার বদৌলতে বেশকিছু লিপিহীন ভাষার বর্ণলিপি উদ্ভাবিত হয়, শিক্ষার প্রসার ঘটে এবং নিরক্ষরতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। স্বাভাবিকভাবে রুশভাষার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। রুশ ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার আত্তীকরণের পেছনে কোনো দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রেরণা কাজ করেনি। সমগ্র সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে বিভিন্ন ভাষার আধুনিকীকরণে সত্তর থেকে আশি ভাগ রুশভাষা থেকে ঋণ করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সিরিলিক ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটে। ১৯৩৮ সালে রুশভাষার শিক্ষাদান বাধ্যতামূলক করা হয়। দুইস্রোতের তথ্য অনুযায়ী দেশি কাজকর্ম আঞ্চলিক বা স্থানীয় ভাষায় এবং সরকারি, বৈজ্ঞানিক বা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কার কাজ রুশ ভাষার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ১৯৭৫ সালে তাসকেন্তের এক কনফারেন্সে রুশভাষাকে কিন্ডারগার্টেন থেকেই শিক্ষাদানের সুপারিশ করা হয়। দুই বৎসর পরে ওই শহরে আরেকটি কনফারেন্সে বলা হয় যে, ছাত্রদেরকে গবেষণাপত্র রুশভাষায় লিখতে হবে। এই পদক্ষেপে রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিবাদ ওঠে। রুশভাষীর মধ্যে মাত্র শতকরা ৩.১ ছিল দ্বিভাষী এবং অরুশভাষীদের মধ্যে দ্বিভাষীদের সংখ্যা ছিল শতকরা ৪২.৬ এবং তারা রুশভাষায় কথা বলতো। এর ফলে অরুশভাষীদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায় এবং আশঙ্কা জন্মে তাদের মাতৃভাষা রুশভাষার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। কালক্রমে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ভেঙে গেল।

    তথ্যবহুর নিবন্ধ, সন্দেহ বা সংশয় নেই। তবে মার-এর, চূড়ান্ত অর্থে স্ট্যালিনের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত সরকারের প্রথম পর্বের, ভাষা নীতির ব্যাপ্তির কিছু বিপরীত চিত্রও পাওয়া যাচ্ছে তথ্যসমূহ থেকে। তবে রুশ ভাষার আধিপত্য যে ক্রমশ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছিল, বিশেষত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও বিজ্ঞান গবেষণায়, তা লেখাই বাহুল্য।

  7. ফয়সল অভি - ২১ মে ২০১০ (৩:৪১ অপরাহ্ণ)

    দাদা আপনার সাথে যোগাযোগের কোন মেইল আইডি পাওয়া যাবে ।

  8. Sohail Chowdhury - ৭ মার্চ ২০১১ (৯:২২ অপরাহ্ণ)

    একটু অপ্রাসঙ্গিক ভাবে আপনাকে লিখছি বলে ক্ষমা করবেন… আমি আজই মুক্তাঙ্গনে নিবন্ধন করলাম…উদ্দেশ্য আপনার সাথে একটি বিষয়ে যোগাযোগ করা

    অনেকদিন আগে একটি ঈদসংখ্যা ম্যাগাজিনে আপনার লেখা একটি উপন্যাস পড়েছিলাম.. নাম ছিল “আমরা হেটেছি যারা”। উপন্যাসটি আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল.. সংগ্রহে রাখার জন্য সবজায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজে ও প্রকাশিত উপন্যাসটি পাইনি

    খুব উপকৃত হব আপনি যদি বলেদেন কোথায় আমি এ উপন্যাসটি পেতে পারি… আমার ই-মেইল sohail.chowdhury(at)gmail.com

    (বানান ও ভাষার ভুলের জন্য দু:খিত)

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.