৫ আগস্ট ২০২৪-এ বাংলাদেশের তথাকথিত "গণ-অভ্যুত্থানে" ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রটি রাজনৈতিক ভাষায় যতটা নাটকীয়, বিশ্লেষণে ততটাই বিভ্রান্তিকর ও বাস্তবতা-বিচ্যূত। এটি ইতিহাস ও সংবিধানকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পক্ষের স্বার্থে রচিত। কেন? বলছেন জাহানারা নূরী।

অবৈধ জুলাই সনদ

অধ্যায় এক. 

রাষ্ট্র ও জনজীবনযাপনের ধারা উন্নয়নের নানা দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় রাষ্ট্রকে টিকে থাকতে হলে ব্যক্তি অধিকার ও বৈপ্লবিক ধ্বংসযজ্ঞের চেয়ে  রাষ্ট্র, আইন ও শৃঙ্ক্ষলা প্রাধান্য পায় । একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র কাঠামোই প্রকৃত মানবাধিকার রক্ষার শর্ত। যে কোনো বিপ্লবই যদি রাষ্ট্রের ভিত নাড়িয়ে দেয়, তা সভ্যতা, জনপদের জীবন ও নিরাপত্তার পরিপন্থী।  

যে কারণে ৫ আগস্ট ২০২৪এ বাংলাদেশের তথাকথিত গণঅভ্যুত্থানেঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রটি রাজনৈতিক ভাষায় যতটা নাটকীয়, বিশ্লেষণে ততটাই বিভ্রান্তিকর ও বাস্তবতাবিচ্যূত। এটি ইতিহাস ও সংবিধানকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পক্ষের স্বার্থে রচিত। রাষ্ট্রীয় ও আইনগত যুক্তির আলোকে এই ঘোষণাপত্রের মূল দাবিগুলো বিশ্লেষণ করা যাক। 

 ধারা ১ 

ঘোষণাপত্রটি স্বাধীনতার ইতিহাস পুনর্লিখনের উদ্দেশ্যে শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছে, যাতে মনে হয় ১৯৭১ সালের যুদ্ধের নেতৃত্ব ও সংগঠকদের ভূমিকা ম্লান করে জনতার স্পন্টেনিয়াস লড়াইকে কেন্দ্র করে একটি রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার বয়ান বলা যায়। এটি প্রকৃত ইতিহাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণমানুষের দীর্ঘ আন্দোলন, রক্তপাত, লড়াই এবং স্বাধীনতার পথে সচেতন উত্থানরাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক প্রতিরোধের সমন্বয়ের ফসল—এটি কোনো নেতাশূন্য লুকোনোছাপানো গণপ্রতিরোধ নয়। 

ধারা ৩ 

১৯৭২ সংবিধান ও বাকশাল নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা করে এতে নিন্দনীয় একটা ভূমিকা পালন করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধান ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় এমন কি বিশ্বে ও গৃহীত প্রশংসিত অন্যতম প্রগতিশীল একটি দলিল, যেখানে মৌলিক অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের কাঠামো নির্ধারণ করা হয়। একে কাঠামোগতভাবে দুর্বলবলা রাজনৈতিক অপপ্রচার ছাড়া কিছুই নয়। বাকশাল ব্যবস্থা নিয়ে একপাক্ষিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তকে কেবলমাত্র ক্ষমতা লোভের ফলাফল হিসেবে তুলে ধরা হয়। এই বয়ান শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার আগে থেকেই, যার পেছনে ছিল তৎকালীন দেশে নৈরাজ্য, দুর্নীতি ও বারবার সামরিক ষড়যন্ত্র। 

ধারা ৫ 

গণতন্ত্রের ইতিহাসকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ঘোষণাপত্রে ১৯৯০এর গণঅভ্যুত্থান ও ১/১১কে যথেচ্ছভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এবং বর্তমান গণতান্ত্রিক সংবিধানিক ধারাবাহিকতাকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। এই সনদ দিয়ে বাংলাদেশের জনগনের স্বাধীনতা ও জাতির গণতান্ত্রিক চেতনাকে চূড়ান্ত অপমান করা হয়েছে। সংবিধানের পরিবর্তন জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই সম্ভব, কোনো মুখোশধারী গোষ্ঠীর বা নির্বকারত্বের চেহানার ধারী ব্যক্তির অঘোষিত অভ্যুত্থান বা সন্ত্রাসী আন্দোলনের মাধ্যমে নয়। 

ধারা ৮১০ 

মানবাধিকার লঙ্ঘন ও উন্নয়নের সমালোচনা গুমখুন, নিপীড়ন ইত্যাদি অভিযোগগুলো যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা প্রমাণিত হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে। এছাড়া তথাকথিত উন্নয়ন—যেমন মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, বিদ্যুৎখাতের বিস্তার—এসবকে ফ্যাসিবাদী উন্নয়নবলে অস্বীকার করা, বাস্তবতাকে অস্বীকার করার নামান্তর। উন্নয়নদুর্নীতির প্রশ্নে আগের সরকারের আমলে বিচার বিভাগ সীমিত হলেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছে। দূর্নীতির বা গণহত্যার অভিযোগে সরকারপক্ষ বা তাদের প্রতিনিধিও বিচারাধীন হয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক Axel van Trotsenburg তার ২০২৩ এর বক্তৃতায় কি বলেছেন তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।  

”Fifty years later, Bangladesh is one of the world’s greatest development stories. 

Bangladesh tells the world a remarkable story of poverty reduction and development: From being one of the poorest nations at its inception, today Bangladesh is one of the fastest-growing economies in the world. Its steady economic growth of over 6 percent per annum since 2000 has lifted millions of people out of poverty. Its GNIpc has increased by a multiple of 21 times since 1972, reaching lower middle-income status in 2015. Bangladesh is now on its way to becoming an upper-middle-income country. The economy has made a strong recovery from the impacts of the COVID-19 pandemic.” 

Bangladesh made achievements in many areas. I want to highlight three areas as most striking – empowering women and girls; investing in people; and moving decisively on climate adaptation and resilience. 

First, the country recognized early on that empowering women is crucial to ending poverty. 

In 1991, Bangladesh had one of the lowest educational attainment levels for girls. Now, it is among the few developing countries to have achieved gender parity in school enrolment. Other countries have replicated its innovative Female Stipends Program, which has become a model for bringing girls into school. 

Bangladesh reduced fertility rates from 6.1 births per woman in 1971, to 2.1 births in 2018. 

Another element of this success is how the ready-made garments industry created jobs for millions of women. 

Second, Bangladesh realized early that investing in people is just as critical as investing in infrastructure. A child born in 1972 had a life expectancy of 46.5 years; newborns today are expected to live to more than 70 years. 85 percent of children are fully immunized. Almost all children go to school. 

Bangladesh has successfully navigated the COVID-19 pandemic, including an effective vaccination program. We are proud to have supported the government by financing 68 million doses of administered COVID vaccines.  It is extremely encouraging to see how seriously Bangladesh is taking its investments in human capital, and this attitude will be decisive as the country is aiming for much higher per capita income levels in the years ahead. 

Third, Bangladesh moving on climate adaptation and disaster preparedness. –Despite being severely affected by climate change, the country has been a frontrunner in climate adaptation. Thanks to its home-grown approach of early warning systems, a network of cyclone shelters, embankments and afforestation, deaths from cyclones have been reduced 100-fold since Independence. I look forward to visiting a multi-purpose cyclone shelter on Tuesday. 

I am interested with the model used in Bangladesh, where the cyclone shelters operate as a primary school in normal weather. Bangladesh has instituted disaster risk reduction policies and strategies, and globally, as chair of the Climate Vulnerable Forum for 2020-2022, it helped map out a sustainable and resilient pathway for countries vulnerable to climate change. Many countries could learn lessons from the work done in this area. 

Let me also mention something that is highly appreciated by the international community – and that is the country’s solidarity and generosity in times of need for people who suffer and need help. This has been particularly evident for the past five years, Bangladesh has provided shelter to 1.1 million Rohingya who have fled from violence in Myanmar.  The World Bank has mobilized – with the help of the Government of Canada – $590 million dollars in grant financing to help Bangladesh meet the basic needs of the host communities and the displaced Rohingya population until their safe and voluntary return to Myanmar. I just want to say thank you for your generosity and assistance.” 

(Axel van Trotsenburg’s speech, “ Celebrating a Journey Together: Bangladesh and the World Bank,”Managing Director,  World Bank, Dhaka) 

ধারা ১১১৩ 

নির্বাচনী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রহসনের যে সব অভিযোগ ঘোষণাপত্রে উত্থাপিত হয়েছে তা ঢালাওভাবে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার মতো।  ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে এ কথা স্বীকার্য, কিন্তু লোকে অভিযোগ তোলা মানেই তা সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য বা সত্য, তা নাও হতে পারে। এসব অভিযোগ বিচারব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জ হয়নি । এমন কি যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্বাচনী সংস্কারের প্রস্তাবও আসেনি।  

এ কথাও অনস্বীকার্য যে, নির্বাচনী ব্যবস্থায় যেসব অভিযোগ এসেছে, তা শুধুমাত্র সরকার বা নির্বাচন কমিশনের একক ব্যর্থতা নয়। বিরোধীদলগুলোরও রয়েছে সাংবিধানিক কাঠামোর প্রতি দায়িত্ব পালনে অনীহা ও অনুপস্থিতি। একদিকে তারা নির্বাচন বর্জন করে প্রক্রিয়াটিকে দুর্বল করেছে, অন্যদিকে বিচারিক পদ্ধতির মাধ্যমে সংস্কার আনার বাস্তবসম্মত প্রচেষ্টা চালাতে পারোত, তার কিছুই করে নি। বিরোধী দল বি এন পি আসলে গত পনের বছর রাজনীতিটাই করে নি। 

নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা, ‘ঘোষণাপত্র’ নামক একটি বিকল্প রাষ্ট্র কাঠামোর প্রস্তাব—এসব প্রকৃত গণতন্ত্র নয়।  বিতর্কিত নির্বাচন কিন্তু কোনো সংবিধান বাতিল বা রাষ্ট্রীয় অভ্যুত্থানের পক্ষে যুক্তি হতে পারে না। বরং তা বিপজ্জনক এক আত্মবিনাশী রাস্তা। 

ধারা ১৪১৭ 

ঘোষণা পত্রে ছাত্রআন্দোলনের নামে সহিংসতা ও বিকৃত ইতিহাসকে চালানোর যে প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা স্রেফ রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনী অসততা।  

নিয়মবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন বা বিক্ষোভ গণতন্ত্রের অংশ। কিন্তু যখন তার উদ্দেশৗ থাকে সহযাত্রীদের কাছে লুক্কায়িত, তার পরকিল্পনা করা হয় লোকচক্ষের অন্তরালে ও সাধারণ মানুষকে ছাত্রের ছদ্মবেশে প্রতারণা করা হয় তখন তা অপরাধ। আন্দোলনের আড়ালে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড: পুলিশ হত্যা, সরকারি ভবন জ্বালানো, সরকারি দলের  সদস্যদের হত্যা, নারী ও শিশুদের, ধর্ষন, হত্যা, বলাৎকার, এ গুলোকে কোনোভাবেই কারু স্বাধীনতার অংশ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। তখন এইসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আর কোনো আন্দোলন থাকে না, তা সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রদ্রোহীতা। ইতিহাসের যে কোনো অধ্যায়েই দেখা যাবে, বিপ্লবের ছদ্মবেশে পরিচালিত সন্ত্রাস দীর্ঘস্থায়ী গণতান্ত্রিক কাঠামো সৃষ্টি করতে পারে না। 

 ধারা ১৭২০ 

জুলাই ঘোষণাপত্রে সামরিক বাহিনীর ভূমিকাকে ভুলভাবে কিম্বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেনাবাহিনী কখনোই সরাসরি কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ নয়, হতে পারে না। বরং সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, তারা রাষ্ট্রপতির অধীন এবং সরকারপ্রধানের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের কর্মকাণ্ড চলার কথা। জুলাই ঘোষণায় সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে গণঅভ্যুত্থান সমর্থনের দাবি কেবল একটি অতি কল্পনা—যা অভ্যুত্থানকে বৈধতা দিতে উদ্ভাবন করা হয়েছে, এবং বাস্তব ঘটনা যে দাবীকে সমর্থন করে না।  

আরও বলা হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী।১০৬ অনুচ্ছেদ শুধু ‘আইনি মতামত’ প্রদানের ক্ষমতা দেয় রাষ্ট্রপতির অনুরোধে। এটি দ্বারা সরকার গঠন বা বাতিলের কোনো ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্ট বা জনগণকে দিয়েছে কি? প্রধানবিচারপতি ৮ তারিখে নিরাপত্তাহীনতায় সেনাবাহিনীর সুরক্ষায় ছিলেন। তিনি বা সুপ্রীম কোর্ট কিভাবে এ কাজ করলেন সে বিষয়ে জনগণ কিছু জানে না। কেন? 

সংবিধান নিয়ে ঘটনাক্রমের একটা কাল্পনিক তর্জমা করে অবৈধ ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টাকে জায়েজ করলেই তা জায়েজ হয়ে গেলো?    

 ধারা ২১২৭ 

নতুন শাসনব্যবস্থার নামে ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের অংশ করার প্রস্তাবটি রীতিমতো হাস্যকর একটি প্রস্তাব।  

ঘোষণাপত্র যেভাবে দাবি উপস্থাপন করছে তাতে এটি স্পষ্ট করার প্রয়াস আছে যে এই ঘোষণাপত্রটিই এখন কার্যকর সংবিধান এবং বিরাজমান সংবিধান সে ক্ষেত্রে “সাময়িকভাবে স্থগিত” হয়ে যাওয়ার কথা।
কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এ জাতীয় ঘোষণা দিয়ে বিরাজমান সংবিধান, রাষ্ট্রীয় ইতিহাস ও তার মৌলিক রূপ স্থগিত হয় না। এই ঘোষণা স্পষ্টতঃ একটি বেসামরিক চেহারায় অঘোষিত সামরিক অভ্যুত্থান বা অভ্যন্তরীণ Coup-এর ভাষা। যা রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার চরম লঙ্ঘন।  

কোনো ঘোষণা, তা যতই আবেগপূর্ণ বা জনপ্রিয় হোক, তা সংবিধান হয়ে যায় না। সংবিধান তৈরী ও  সংশোধনের সুস্পষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে, যেখানে গণপরিষদ বা সংসদের ভোট প্রয়োজন হয়। ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের তফসিলে সংযুক্ত করার দাবি আসলে সংবিধানকেই পাশ কাটানোর কৌশল মাত্র। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংবিধান ও জাতিসত্ত্বা কোনো তাত্ত্বিক বা ধর্মীয় কি বালসুলভ গবেষণাগারের বিষয় নয়। এগুলো কোটি কোটি মানুষের রক্তে, সম্মিলিত দুঃখদরদ ও লড়াইয়ের পথ ধরে অর্জিত ঐতিহ্য—যার প্রতি আনুগত্যে ঘাটতি ক্ষমার অযোগ্য।   

এই ঘোষণা যে “সংবিধান ও সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে” তা এক বিকল্প শাসনব্যবস্থার ধারণাকেই স্পষ্ট করে। ভিন্নভাবে বলা যায়, তা  গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মুখোশে ক্ষোভ প্রকাশের ছদ্মবেশে রাষ্ট্রদ্রোহের বহুবছরব্যাপী আলামতকে প্রকাশ করেছে। যে সব আলামতকে ব্যবহার করে একটি গোষ্ঠীর ও ব্যক্তির হাতে রাষ্ট্র কাঠামো তুলে দেওয়ার এক ধরণের উদ্দেশ্য এই নথিতে প্রকাশিত ।  

 অধ্যায় দুই 

জুলাই ঘোষণাকে বিশ্বের রাজনীতির আলোক দেখলে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা নজরে পড়ে।  

 

বিশ্বের সব ধরণের বিপ্লব বনাম কৌশলগত রাজনীতির একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ স্মরণ করুন পাঠক, দেখবেন, বিপ্লবের নামে ক্ষমতায় বসা ব্যক্তিদের অনেকেই রাষ্ট্রযন্ত্রের চেয়ে দমননীতিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন।  

জুলাই ঘোষণাপত্র একই ধাঁচে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারগঠন করেছে। বিগত এক বছরে যা কিছু এ সরকার করেছে, তা রাজনৈতিক রূপান্তরের চেয়ে কৌশলগত ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের ছক বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। 

 

এ প্রসঙ্গে ম্যাক্স ওয়েবারের বিশ্লেষণ কাঠামো ব্যবহার করে যদি আমরা জুলাই ঘোষণাকে মূল্যায়ন করি, তাহলে এটি স্পষ্ট হয়—এটি কোনো ধরণের কর্তৃত্বের প্রকৃত ভিত্তিতেই দাঁড়াতে পারে না।  

ওয়েবারের অথরিটির আলোকে “জুলাই ঘোষণা” – ক্ষমতার তিন ছাঁদেই ব্যর্থতা 

ঘোষণাপত্র নিজেকে “গণমানুষের প্রতিনিধি” ও “গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ঘোষণা” হিসেবে দাবি করলেও, সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারএর আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার বৈধতা (legitimacy) বিশ্লেষণের বিচারেকোথাও এই ঘোষণাপত্রের কোনো দৃঢ় অবস্থান দেখা যায় না। 

ওয়েবার ক্ষমতার তিনটি বৈধ ধরণ চিহ্নিত করেছিলেন:
) ঐতিহ্যভিত্তিক (Traditional Authority)
) চরিত্র বা নেতৃত্বভিত্তিক (Charismatic Authority)
) আইন ও নিয়মভিত্তিক (Legal-Rational Authority) 

জুলাই ঘোষণাপত্র ও তথাকথিত গণঅভ্যুত্থানকে এই তিন মাপকাঠির বিবেচনায় এসব  অন্তঃসারশূন্য। কিভাবে তা ব্যাখ্যা করা যাক: 

এক. ওয়েবারের মতে অথরিটি জন্মায় যদি যারা অথরিটি দাবী করে তাদের ঐতিহ্যভিত্তিক ক্ষমতা থাকে: এই সনদ ও তা যা থেকে উদ্ভূতজুলাইয়ের তথাকথিত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এর “ঐতিহ্য” নেই, আছে ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্নতা। যা ঐতিহ্যিক সব স্থাপনা পুড়িয়ে দিয়ে তারা গত এক বছরে প্রমাণ করেছে। তাদের রাজনীতিও ১৯৭১ থেকে আজ তক প্রমাণ করেই চলেছে। 

ঐতিহ্যভিত্তিক অথরিটি জন্মায় দীর্ঘস্থায়ী সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় রীতিনীতির ভিত্তিতে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্য, যেমন মুক্তিযুদ্ধ, সংসদীয় গণতন্ত্র, দলীয় রাজনীতি এবং আইনসভার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ—এসবের বাইরে দাঁড়িয়ে জুলাই ঘোষণাপত্র একটি ঐতিহ্যবিচ্ছিন্ন ও সাংস্কৃতিক শূন্যতাপূর্ণ দলিল 

এটি না মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যের ধারক, না সংসদীয় ঐতিহ্যের উত্তরসূরি। বরং এটি একটি ঐতিহাসিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে, যেখানে পুরোনো কোনো সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই। 

দুই. ওয়েবারের দ্বিতীয় বিচার ছিলো চরিত্রভিত্তিক ক্ষমতা। “চরিত্র” বলতেওেয়েবার এখানে কারিশমার ইঙ্গিত করেছেন। কোটা আন্দোলন শুরুতে একটি অধিকার আন্দোলন হিসেবে এর নেতৃত্বে এক ধরণের কারিশমা এনে দিয়েছিলো। বৈষম্য বিরোধিতা ও মিথ্যে প্রোপাগান্ডা এবং পরবর্তি ধ্বসাত্মক কাঠামোয় গিয়ে তা নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক যে মুহূর্তে তার সরকার পতন ঘটিয়ে দেয়, সে মুহূর্তেই তাদের কারিশমা যে একটা রোল প্লে, তা উন্মোচিত হয়ে পড়ে। 

চরিত্র বা “charisma” ভিত্তিক অথরিটি আসে নেতার ব্যক্তিত্ব, ত্যাগ ও স্বত্ত্বার মহত্তম আবেগ থেকে যা মানুষের মনের আবেগে এক ধরণের আস্থা সৃষ্টি করে। তার ওপর ভরসা করে মানুষ।  

জুলাই আন্দোলনের শুরুতে হয়তো কিছু ছাত্রনেতা কিছু আকর্ষণ বা আবেগ জাগিয়েছে। কিন্তু ঘোষণাপত্রে দেখা যায় তাদের কেউ এমন কোনো নেতা বা নেতৃত্ব নয় যিনি সারা জাতির আবেগ একত্র করতে পারেন এবং তার তেমন মহত্তম বোধ রয়েছে। বরং, ঘোষণাপত্রের ভেতর গোপন ইচ্ছা সক্রিয়। এখানে রচনাকারীরা নিজেরাই নিজেদের “নেতা” মনোনীত করার চেষ্টায় আছেন। চরিত্রভিত্তিক ক্ষমতার মৌলিক শর্ত—জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত গ্রহণযোগ্যতা। নিজেরা নিজেদের নেতা মনোনয়নের বিষয়টা এই শৌলিক শর্তের সম্পূর্ণ বিপরীত 

চরিত্রবলে ১৯৪৮ সাল থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শুরুর নেতৃত্ব নিজে টিকে থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মানুষকে স্বাধীনতার পথে লড়তে ও বাংলাদেশের স্বাধীন জন্ম নিশ্চিত করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তারা জেলজুলুমের নিগড়ে থেকেও বঙ্গবন্ধু ও তার সঙ্গীসাথীরা জনগণকে যে প্রেরণায় চালিত করেছেন, সেখানে চিন্তা ও যোগাযোগের স্বচ্ছতা, মানুষের সাথে তার চেতনার সংযোগ ছিল। তিনি ও তার সঙ্গীরা নিজেদের জীবনটাই দেশকে স্বাধীন করার কাজে উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের সে আত্মত্যাগের মহীমা বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে গিয়েছিল। বিগত পঞ্চাশোর্ধ বছর ধরে যে গোষ্ঠী সেই আশি বছরের মহীমামণ্ডিত ইতিহাসকে অস্বীকার ও কালিমালিপ্ত করার কাজে নিয়োজিত ছিল। সেই গোষ্ঠীই পুরণো সেই অস্বীকারকে, ইতিহাস মুছে ফেলে ছাপার অক্ষরে জুলাই ঘোষণাপত্র নাম দিয়ে, জনগণের সম্মতিহীন, বাকচাতুর্যনির্ভর ক্ষমতার উৎস করার প্রয়াস নিয়েছে।  

তিন. ওয়েবারের তৃতীয় যুক্তি হচ্ছে ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে আইনী পথে যুক্তিসম্মত উপয়ে। গোটা জুলাই আন্দোলনেরই তো আইনের তোয়াক্কা নেই। অগাস্ট ২০২৪ থেকে আইনশৃঙ্ক্ষলা, রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তারা ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছে। এইসব প্রতিষ্ঠানের সব দক্ষ কর্মচারীকে ছাঁটাই করেছে, জেলে পাটিয়েচে। কাউকে কাউকে মব সন্ত্রাসে  নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। সেই সব লাশ আবার ঝুলিয়ে রেখে জনগণকে শিক্ষা দিয়েছে যে তাদের ভয় পেতে হবে।  

ওয়েবারীয় তৃতীয় অথরিটির আইনসম্মত ও যুক্তিসম্মত (Legal-Rational), হওয়ার মূল ভিত্তি হলো সংবিধান, নির্বাচনী বৈধতা, ও প্রশাসনিক কাঠামো। 

জুলাই ঘোষণাপত্র এখানেই সবচেয়ে বড় ধসের মুখে পড়ে যায়। কারণ: 

  • এটি সংবিধানবিরোধীভাবে একটি নতুন শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে চায়। 
  • এটি কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত গোষ্ঠীর নয়, ফলে জনগণের অনুমোদন নেই। 
  • এটি আইন প্রয়োগের নিজস্ব কোনো বাহিনী বা প্রশাসনিক কাঠামো নেই—সোজা কথা, এটি বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্রকে দখল করেই টিকে থাকতে চায়। 

ফলে এটি ওয়েবারের তাত্ত্বিক বিচারেও আইনি বা প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতার কোনো ধরণে পড়ে না—এটি বরং একটি আইনহীন, সংবিধানবিরোধী একটি নথি, যার ঘোষণার চেয়ে গভীরতর সংকট লুকিয়ে রয়েছে তার ক্ষমতার ভিত্তি সম্পর্কিত অস্পষ্টতায়।  

একই ধরণের অস্পষ্টতা রাখা হয়েছিল জুলাই ২০২৪ এর কোটা আন্দোলনের সময় যখন কোটা না থাকার পরও একই গোষ্ঠী কি উদ্দেশ্যে কোটা আন্দোলনকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন নাম দিয়ে চালিয়ে যেতে চাইলো। কি উদ্দেশ্যে ১০ জুলাইতে বাস্তবিক অর্থে কোটা বিলুপ্তিতে আপত্তি তুলে কোর্টে উত্থাপিত আপীলকে পূণঃর্বিবেচনা করতে স্বয়ং সরকার দরখাস্ত করেছেন তারপরও প্রতিবাদকে বৈষম্য বিরোধিতার নামে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো চূড়ান্ত মব সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড ও দেশধ্বংসের দিকে।  

কি উদ্দেশ্যে 

জনগণের মধ্যে থেকে যে সব ব্যক্তিকে রাজপথে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো মিথ্যে প্রচারণা ছড়িয়ে, তারা পেছনের সেই উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিন্তু একেবারেই অনবহিত। জনগণকে ধোঁকার মাধ্যমে রেখে দেয়া হলো। এমন কি তারা এটাও অবহিত ছিলেন না যে, আন্দোলনের ১৫৮ জন সমন্বয়কদের ১৩৮ জনই ইসলামিস্ট রাজনীতির পার্টি জামায়াতশিবিরের পরিচয় লুকিয়ে থাকা সদস্য।  

গণমাধ্যমে তাদের লোকই স্বয়ং বলে বেড়াচ্ছেতারা যেহেতু এ বিষয়ে সচেতন যে, ১৯৭১ এর গণহত্যার অন্যতম অংশীদার হওয়ার কারণে তাদের নাম শুনলেই বাংলার জনতা আর তাদের কথায় রাজপথে আসবে না, সুতরাং —তারা নাম, পরিচয় চেহারা লুকিয়েছে এবং হত্যাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। এমন কি বিভিন্ন মাদ্রাসার যে ছাত্ররা পাঞ্জাবী পায়জামা পরে ও দাড়ি রাখে, তাদের তুর্কী স্টাইলে দাড়ি কামিয়ে টি শার্ট ও জিনস্ পরে র‌্যালিতে আসতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।   

এ ধরণের কল্পনাকে আন্তর্জাতিকভাবে যাকে “সিভিল কুডেটা” বলে গণ্য করা হয় তার মধ্যে ফেলা যায় না, এটা সরাসরি দেশদ্রোহীতা। 

 

ফলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে জুলাই ঘোষণাপত্রের অগ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি উত্থাপন না করলেই নয়।  

জুলাই ঘোষণাপত্রের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা বাস্তবিক অর্থেই শূন্য।  

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একাধিক রেজল্যুশন (যেমন UNGA Resolution 2625, 63/301) সরাসরি সংবিধানবহির্ভূত ক্ষমতা দখলের নিন্দা করে এবং এমন কোনো পরিস্থিতিকে স্বীকৃতি না দেওয়ার আহ্বান জানায়। ২০০৯ সালে হন্ডুরাসে সামরিক অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রেও জাতিসংঘ এই অবস্থান নিয়েছিল। সেই একই যুক্তিতে, জুলাই ঘোষণাপত্রে প্রস্তাবিত ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইনের চোখে অবৈধ, অসাংবিধানিক ও অগ্রহণযোগ্য 

  

জুলাই ঘোষণাপত্রের ভাষাগত অসংগতি ও দ্বিচারিতা অগুণতি।  

এ এক অভূতপূর্ব ভাষার কারসাজি!
যারা সংবিধান বাতিলের আহ্বান দিচ্ছেন, তারা আবার সেই বাতিল সংবিধানেই শপথ নিচ্ছেন।
যারা জনগণের নামে কথা বলছেন, তারা জনগণের কোনো সম্মতি ছাড়াই নেতানিয়োগ করে দিয়েছেন।
গণতন্ত্রপূণঃপ্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে তারা জনগণের নিজস্ব ভোটাধিকারকে অবজ্ঞা করছেন — যেন গণতন্ত্রের প্রথম শর্তই হলো: জনগণ ছাড়া গণতন্ত্র! 

এ ঘোষণাপত্রের ভাষার খেল এমন, এখানে জনগণনামের শব্দটি আছে, কিন্তু জনগণের নিজস্ব মতটাই নেই।
এটা দিয়ে নতুন শাসনব্যবস্থা বানানো হচ্ছে, কিন্তু সেই ব্যবস্থার রূপরেখা তৈরী হচ্ছে রুদ্ধদ্বার কক্ষে, কেবল  এনজিওভ্রষ্ট বুদ্ধিজীবী গংয়ের আলোচনায় — যারা আবার নিজেরাই নিজ নিজ অবস্থান ভাগবাটোয়ারা করে ফেলেছেন! 

এ তো একধরনের লিঙ্গুইস্টিক ক্যু” — যেখানে শব্দ আর সত্যের মাঝে তফাত ক্রমেই গভীরতর ও তা বোঝার চেষ্টা মানে দূর্গম গিরিলঙ্ঘন। এই দ্বিচারিতার ভাষা শুধু এক বিভ্রান্ত রাজনীতিই শুধু নয়, এটি আদর্শগত ও নৈতিক বিভ্রান্তির অনন্য দলিল। দলিলটি যিনি পাঠ করলেন তারও নৈতিকতা এই বিভ্রান্তির অতল স্পর্শ করলো।  

.  

জুলাই ঘোষণাপত্র রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কিন্তু অর্থনৈতিক দিশাহীনতার লালকার্ড। 

ঘোষণাপত্রটিতে নাকি রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার রূপরেখা  আছে, কিন্তু প্রশ্ন হলো: নতুন সরকার কীভাবে অর্থনৈতিক কাঠামো পরিচালনা করবে? কোথা থেকে আসবে রাজস্ব? বাণিজ্যনীতি হবে কেমন? দারিদ্র্য বিমোচনের পরিকল্পনা কী? কর্মসংস্থানের গ্যারান্টি কীভাবে নিশ্চিত হবে? এসব প্রশ্নের একটিও উত্তর নেই। 

জুলাই ঘোষণা শাসনের যে ঘোষিত মডেল দিয়েছে – তা বৈশ্বিক একই জাতীয় আরও বহু দেশের এমনতরো আন্দোলনটনের ব্যর্থতার কারণগুলো পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেবে। 

নতুন বাংলাদেশ” গঠনের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দিয়ে সরকার বদল ঘটিয়ে ফেলার পর অন্তর্বর্তী শাসনব্যবস্থা এসেছে। অন্তর্বর্তী শাসনব্যবস্থা জুলাই ঘোষণাপত্রের অংশ কি ভাবে হলো তা স্পষ্ট নয়। ঘোষণা তো এসেছে এক বছর পর। অন্তর্বর্তী শাসনব্যবস্থাও বাস্তবে না গণতান্ত্রিক, না সাংবিধানিক। গত এক বছরে এটি নিজেকে চূড়ান্ত ব্যার্থ একটি সরকার হিসেবে প্রমাণ করেছে।  

তথাপি ভুললে চলবে না বিশ্ব ইতিহাস। এ ইতিহাস জানিয়ে দেয় এ ধরণের তালবাহানার পথ কোথায় যায়। 

  • আরব বসন্তের মিশর, লিবিয়া ও সিরিয়ায় ঠিক এমন করেই ‘অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকার’এর ডাক এসেছিল। ফলাফল? গৃহযুদ্ধ, রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়, এবং বহু দেশে সেনা শাসনের প্রত্যাবর্তন। 
  • ল্যাটিন আমেরিকার বহু দেশে (যেমন: ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া) ‘জনগণের নামে’ ঘোষিত অসাংবিধানিক সরকার একে একে দুর্নীতি, সহিংসতা এবং আন্তর্জাতিক নিঃসঙ্গতার দিকে গিয়েছে। 
  • আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে সুদান ও মালি অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতার জ্বলন্ত উদাহরণ — যেখানে প্রথমে “তথাকথিত জনতার অভ্যুত্থান” হয়েছিল, পরে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়, এবং শেষমেশ আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ পড়ে। 

প্রশ্ন হলো, জুলাই ঘোষণাপত্র কোন ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তৈরী? বাংলাদেশের ইতিহাসের চেয়ে সেরা কোন্ ইতিহাসে আছে বিংশশতকে যা থেকে প্রেরণা নেয়া যায়যদি কোনো আন্তর্জাতিক উদাহরণ তারা সত্যিই অনুসরণ করতো, তবে সেই মডেলও উপস্থাপন করতো। কিন্তু এর অভাব প্রমাণ করে, এটি অনভিজ্ঞ ভাবুকের কল্পনা, বাস্তববাদী কোনো রাষ্ট্র পরিচালনার দলিল নয় 

.  

আরেকটি প্রশ্ন না করলে এ বিশ্লেষণ অসমাপ্ত থেকে যায়। জুলাই ঘোষণাপত্রে কথিত ”জনগণ” আসলে কারা 

ঘোষণাপত্রে জনগণকথাটি বহুবার ব্যবহৃত হলেও, জনগণের সঙ্গে কোনো আলাপ আলোচনা তো দূরের কথা, জনগণকে খুন হওয়া পুলিশ ও লীগের সদস্যদের ঝুলন্ত লাশ, রাস্তাঘাটে মবের সন্ত্রাস, মারপিট দেখিয়ে নিশ্চুপ রাখা হয়েছে। জনগণ বিষয়টিই এখানে বায়বীয়, মতামত যাচাইয়ের প্রক্রিয়া দূর কি বাত! 

২৭ ধারার মাধ্যমে ”বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে, ছাত্রগণঅভ্যুত্থান ২০২৪এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে।” এটা জনগণ কখন ব্যাক্ত করলো, কিভাবে, সেই জনগণ কারা? 

এই যে জনগণ নামক মানুষগুলোর কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে জুলআ ঘোষনা, ২০২৫ সালের অগাস্টের পাঁচ তারিখে জুলাইয়ের আনন্দ উপভোগ দিবসে তাদের মধ্যে শুধুমাত্র ইসলামী ছাত্র শিবিরকে গণভবনের সামনে মোটর সাইকেল নিয়ে ডেমেন্সট্রেশন করতে দেখা গেছে। আটটি ট্রেনের তিনটিতেই মোট লোক সংখ্যা শ’দুয়েকও ছিল না। অথচ জুলাই আন্দোলনে নিহত শিশু ও তরুণরা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভিত্তি। যত লোক জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ শুনতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কিভাবে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন তা দেখতে হাজির হয়েছেন তার দশগুণ মানুষ জেলখানায়, কেউ কেউ বিনা কারণে মারা যাচ্ছেন। পথে গাটে লাশ পড়ে থাকছে। কখন কার বাড়ি, কার কার্যালয় কেমিকেল দিয়ে দাউ দাউ আগুন জ্বারিয়ে দেয়া হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।  

 শত শত মানুষ ব্যাবসা হারিয়েছে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক চাকরীবিহীন। যত লোক বেকার তার ৭০৮০ ভাগ নারী, কারণ গার্মেন্টসসমূহ এবং তাদের সহযোগী প্রডাকশন প্রতিষ্ঠানগুলো, হয় পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, নয় দখল করা হয়েছে। কাজ করছে শুধুমাত্র মুহাম্মাদ ইউনুসের ট্যাক্সমওকুফ পাওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো।   

সরকারেরই কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই, জনতার ম্যান্ডেট নেই, নৈতিকতার বালাই নেই যাদের তারাই সরকারে ও রাজপথে। রাষ্ট্র কাঠামোর বাইরে থেকে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।  

সেই ক্ষমতার ছককে বালসুলভ কথাবার্তা দিয়ে লুকিয়ে রাখতে জনগণের সামনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র নিয়ে পি আর ক্যাম্পেইন চালালে কি তা জুলাই ঘোষনাপত্র রাষ্ট্র প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে যায়? 

তৃতীয় অধ্যায় 

বিশ্বের জনপ্রিয় প্রধান রাষ্ট্রতত্ত্ব ও গণতন্ত্রতত্ত্ব সমূহের আলোকে উপরে জুলাই ঘোষণাপত্রেরমুখোশ খুলে দেখলে আমরা দেখবো এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যানযোগ্য একটি উদ্ভট বয়ান। 

   

জন লক (John Locke) এর জনগণের সার্বভৌমত্ব ও সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব (Social Contract Theory) কি বলে? জন লক বলেছিলেন, রাষ্ট্র গঠিত হয় জনগণ ও সরকারের মাঝে এক “চুক্তির” মাধ্যমে। জনগণ তাদের অধিকার রক্ষায় সরকারকে ক্ষমতা দেয়, কিন্তু সেই সরকার যদি অন্যায় করে, জনগণ তাকে শান্তিপূর্ণভাবে অপসারণ করতে পারে — কিন্তু নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য “প্রতিনিধিত্বশীল” ও “গণতান্ত্রিক” পদ্ধতি অনুসরণ অপরিহার্য।  

 জুলাই ঘোষণাপত্রে যে ‘গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শাসন’ নেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে তা কোনো “institutional consent” বা গণচুক্তি ছাড়াই, যা লকের কথিত মৌলিক চিন্তার পরিপন্থী। বরং তা জনগণ যে তাদের শান্তিপূর্ণভাবে দাবী তোলার অধিকারকে স্বীকার করে নিয়েছিল তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে প্রতিষ্ঠানগুলোকেই ধ্বংস করা হয়েছে মবতন্ত্র, অস্ত্রবাজি, হুমকী, ও শোষণ, ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধমে।  

 

ইয়ুর্গেন হ্যাবারমাস (Jürgen Habermas) – গণতান্ত্রিক আইনি রাষ্ট্রের ধারণা (Deliberative Democracy & Legal Rationality)টা কি? হ্যাবারমাস  বলেছেন গণতন্ত্রের মানে হচ্ছে সংলাপ ও যৌক্তিক নিয়মতান্ত্রিকতা। সব সিদ্ধান্ত নিতে হয় আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকে।জুলাই সনদ রাষ্ট্র ও সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে একটি আবেগনির্ভর ও সহিংস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্গঠনের প্রস্তাব দেয়, যা এই গণতন্ত্রের বিপরীত, যদি আমরা ধরে নিই যে জুলােই সনদ প্রবর্তক ইউনুস ও তার নেতৃত্বে যাওয়া জুলাই আন্দোলনকারীরা গণতন্ত্রই চায়। কিন্তু বাস্তব তা নয়। তারা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতেই পথে নেমেছিল।  

 

বিষয়টিকে মন্টেস্কিয়ু (Montesquieu)-র  ক্ষমতার বিভাজন তত্ত্বের (Separation of Powers) আলোকেও দেকা যেতে পারে। মন্টেস্কিয়ুর মতে, রাষ্ট্রক্ষমতা তিন ভাগে বিভক্ত—নির্বাহী, বিচারিক ও আইনপ্রণেতা। এই ক্ষমতার বিভাজন রক্ষা করাই গণতান্ত্রিক শাসনের মূলভিত্তি। 

ঘোষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে, এক অজ্ঞাত ও অস্বচ্ছ গোষ্ঠী নিজেদের উদ্দেশ্য আদর্শ লুকিয়ে নিজেদের বিপ্লবী শক্তি দাবী করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে, বিচারব্যবস্থা, আইন ও নির্বাহী ব্যবাস্থা ভেঙ্গে ফেলে ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়েছে। এটা সরাসরি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।  

 

হানা আরেন্ট (Hannah Arendt) সহিংসতার বিপরীতে রাজনীতি নিয়ে নিয়ে অনুসন্ধানে দেখেছেন প্রকৃত রাজনীতি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে গঠিত হয়, কিন্তু সহিংসতা রাজনীতিকে ধ্বংস করে দেয়। সহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে “ক্ষমতা” আসে না, আসে ভীতি।  

জুলাই ঘোষণাপত্রটি তেমন এক ভীতিকর পরিস্থিতিতে মুহাম্মদ ইউনুস পাঠ করেছেন যে খানে হাজারের ওপর গণমাধ্যমকর্মী চাকরীচ্যূত, লাখের ওপর বিরোধী মতাবলম্বী নির্বাচিত সাংসদ থেকে স্থানীয় নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা ও কর্মীরা কারাগারে, বিনা বিচারে কারাবন্দীদের মধ্যে ২৮ জন ইতিমধ্যে নিহত হয়েছেন।   

এই সনদ  সহিংসতায় সমর্থন দিয়েছে। ইসলামিক চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর গুপ্ত আন্দোলনকে সমর্থন করে ঘটা করে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে এর  জন্ম। এর সমর্থিত হত্যা, পুলিশ মেরে ঝুলিয়ে রাখা, পুড়িয়ে মারা, রাসায়নিক দিয়ে ব্যবসাক্ষেত্র ও সরকারী অফিস আদালত পুড়িয়ে দেয়া, রেল পোড়ানো—এগুলি গণতন্ত্র নয়, সন্ত্রাসের প্রমাণ। জুলাই সনদ সেই সন্ত্রাসের লব্ধ ফল।  

 

ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা (Francis Fukuyama)  কথিত  রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলার বিকাশ জোর দেয় কয়েকটি বিষয়ের ওপর: 

. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশের জন্য “rule of law”,  

. রাষ্ট্রকে শক্তিশালীকরণ বা “strong state” এবং 

. দায়বদ্ধতা বা “accountability”। 

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশের এই তিনটি স্তম্ভ অপরিহার্য। এগুলোর অভাবে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয় বা এগুলোকে ধ্বংস করার ধ্বংসাত্মক কর্মসূচী গ্রহণ বা সেসব সমর্থন রাষ্ট্রকে ব্যার্থ প্রতিপন্ন করারই উদ্দেশ্যে। 

মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু বা বিদ্যুৎ—এসব কেবল সরকারি প্রকল্প নয়, এগুলো জাতির সম্মিলিত শ্রম ও ত্যাগের ফল। এগুলোকে ‘ফ্যাসিবাদী উন্নয়ন’ বলা মানে জনগণের গায়ে থুথু ফেলা।   

জুলাই আন্দোলনের সামনের ও পেছনের ধামাধরা ব্যক্তিরা তাদের জুলাই ২০২৪ থেকে অগাস্ট ২০২৫ তক কর্মকাণ্ডে এবং এই ঘোষণাপত্রে উক্ত তিন স্তম্ভের প্রতিটিকে দুর্বল করেছে হিংস্র বল প্রয়োগের মাধ্যমে, এবং জুলাই সনদের মাধ্যমে তা তারা বৈধ করতে চায়। তারা আইনের শাসন অস্বীকার, নির্বাচিত রাষ্ট্র বাতিল করাকে বৈধ করতে চায়। জুলাই ঘোষণা যে কোনো জবাবদিহিতাহীন “গোষ্ঠী” দেশ চালাতে পারবে সে অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি হীন প্রস্তাবনা মাত্র। 

 

টমাস হোবস (Thomas Hobbes) সুস্পষ্টভাবে অরাজকতার বিপদ নিয়ে সতর্ক করেছেন। হোবসের মতে, রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যই ছিল “অরাজকতা” এড়ানো। রাজনৈতিক শূন্যতা বা দ্বৈত শাসন সবসময় গৃহযুদ্ধ ও সহিংসতার দিকে নিয়ে যায়। 

জুলাই ঘোষণাপত্র একটি অজ্ঞাত “আন্তর্বর্তীকালীন শাসন” প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছে, যেখানে কারা শাসন করবে, কীভাবে করবে—তা অস্পষ্ট। এটি বাস্তবে একটি Hobbesian নৈরাজ্যের প্রস্তাব করেছে। কেবল ভোটের অধিকার নাগরিক অধিকার নয়—এটি বিকল্প চিন্তা ও সমালোচনার অধিকারও নাগরিক অধিকার। জুলাই ঘোষণাপত্র পুরো জাতিকে একটি রূপরেখা বল প্রয়োগের মাধ্যমে চাপিয়ে দিতে চায়, যেখানে কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেই “ফ্যাসিবাদী” বলে গাল দেওয়া হয় ও চাকরী চ্যূত হয়, সেখানে এটি নৈরাজ্যের স্বীকৃতি, তবে তা জামাতের সালতানাতকেন্দ্রিক মিথ্যে কথার রাজনীতির ইসলামিক পবিত্রতার আড়ালে পোক্ত করতে চায়। 

যারা স্বাধীনতাকে দলবাজির হাতিয়ার বানাতে চায়, তাদের ঘোষণাপত্রে ইতিহাস থাকে না—থাকে প্রতিহিংসার মুখোশ।   

বিশ্বের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রতাত্ত্বিক ভিত্তিগুলো—লক, হ্যাবারমাস, মন্টেস্কিউ, আরেন্ট, ফুকুয়ামা, হোবস, সেন—সবাই একমত যেসংবিধান, আইনের শাসন, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া ব্যতীত কোনো রকম রাষ্ট্র বিনির্মাণ বা সরকার গঠন ‘বৈধ’ হতে পারে না। 

তাই “জুলাই ঘোষণাপত্র” শুধু বাংলাদেশের সংবিধান নয়, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক নীতিমালার আলোতেও পরিত্যাজ্য। 

. 

পরিশেষে বলতে হয়, জুলাই ঘোষণাপত্রটি নিঃসন্দেহে একটি রাজনৈতিক দলিল, যাতে দীর্ঘদিন ধরে লালিত আক্রোশ পুঞ্জিভূত। যার উদ্দেশ্য একটি বিশেষ ব্যক্তি ও দলের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা। এখানে জনগণের আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং ক্ষমতাহীনতার গ্লানি, প্রতিশোধের রোমান্টিসিজম এবং ইতিহাসের একচোখা পাঠ প্রতিফলিত হয়েছে। এই অনুভূতিগুলো শুধু যে জামাত শিবিরের তা নয় বি এন পিরও।   

 ঘোষণাপত্রের নোবেল ঘোষক মুহাম্মদ ইউনুসের পাশে দণ্ডায়মান জুলাই আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম এবং বিএনপির প্রতিনিধি ফখরুল ইসলামএর উপস্থিতিতে এই অনুভূতিগুলোকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়ার বিনিময়ে নির্গমন পথ পরিষ্কার করার একটা চেষ্টা হয়েছে। এই ঐতিহাসিক দৃশ্যে স্বয়ং উপস্থিত থেকে জোনায়েদ আব্দুর রহিম সাকি, মাহমুদুর রহমান মান্না, মজিবুর রহমান মঞ্জু, জামায়াত নেতা, ইসলামী আন্দোলনের নেতাসহ অন্যান্যরা জীবন সার্থক করেছেন। 

 ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই তারিখে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদে জোহরের নামাজের পর গায়েবানা জানাজা শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম যদিও  সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে ‘সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি যুক্তিসংগত’ কিন্তু  ‘খুব দ্ব্যর্থ কণ্ঠে’ বলতে বলতে চাই, এই আন্দোলনের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা সরাসরি জড়িত। আমরা এই আন্দোলনের সঙ্গে কখনোই সরাসরি জড়িত নই। আমরা তাদের নৈতিক সমর্থন দিয়েছি। সেই সমর্থন আমরা দিয়েই যাব।’ সরাসরি জড়িত নইবললেও আন্দোলনের অন্যতম স্টেকহোল্ডার তারা। এই সাফল্যে বি এন পি এক্সিট রুট নিয়েও আলোচনা করা শুরু করতে পারে।  

 গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় অবাধ নির্বাচন, সুশাসন, সংবিধান অনুসারে সংস্কার এবং আইনের শাসন—যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা দখল নয়। তাই এই ঘোষণাপত্রে ব্যাখ্যাত ইতিহাস ও প্রস্তাবিত রূপান্তর আমাদের রাষ্ট্রের ভিত্তির বিরোধী এবং জনগণের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষার বিকৃতি। এটা বি এন পি এবং যে ক্যান্টনমেন্টে বি এন পির জন্ম সেই ক্যান্টনমেন্ট অধিবাসীরা বুঝবেন আশা করি। 

বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে এর মহতি স্বাধীনতার ঘোষণা এবং সংবিধানের আলোয়, সন্ত্রাসের অন্ধকার ইতিহাসে নয়।  

 

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

3 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
3
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.