অনেকেই আমাদের বলেন আমরা নাকি ‘প্রিভিলেজড গ্রুপ’। সমাজের ‘ফরচুনেট’ অংশের প্রতিনিধি।
বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সন্তানই আমাদের অধিকাংশ। বিত্তবান না হলেও সচ্ছল বলা চলে আমাদের অনেককেই। খাওয়া-পরা-পড়াশোনা-টিভি দেখা-ঘুরে বেড়ানো এসব খাতে হিসেবের মধ্যে থেকেও আমাদের জন্য কিছুটা বিলাসি খরচ মাঝে-মাঝেই হয়তো করেন আমাদের অভিভাবকেরা। আবদার-আহ্লাদ করে খেলনা-জামাকাপড়-গল্পের বই দশবার চাইলে পাঁচবার তো নিদেনপক্ষে মিলেই যায়! কিন্তু সচ্ছলতার নির্ভরতার চেয়েও বড় ‘প্রিভিলেজ’ হল আমাদের জীবনের এক পুঁজি যা থেকে বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়েশিশু বঞ্চিত — সেই পুঁজির নাম ‘স্বপ্ন’।
আমাদের মা কিংবা বাবা যেদিন প্রথম আমাদের নির্ভরতার-আঙুল-পেলেই-মুঠি-মুড়ে-ধরে-ফেলার ছোট্ট হাত ধরে এই বিশাল চত্বরের মাঝে ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেদিন প্রথম নিজেদের স্বপ্ন আমাদের মাঝে সংক্রমিত করেছেন তাঁরা। তাঁদের মেয়েদের রয়েছে স্বপ্ন দেখার অধিকার, ব্যক্তিত্ববিকাশের অধিকার, বড় হয়ে সমাজ-গড়ায় নিজ নিজ হাতের ছাপ রাখার অধিকার — তাঁরা জানতেন এবং বিশ্বাস করতেন! বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক, প্রায়-নিষ্ঠুর পরীক্ষা—প্রথম শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার ভয়-ভীতি-বাধার তীব্রতা অতিক্রম করে অবলীলায় মা’কে স্কুলগেটের বাইরে পিছে ফেলে এসে নতুন বন্ধুর পাশে এসে বসতে পেরেছি আমরা শুধু ওই স্বপ্ন-সংক্রমণের কারণে। ওই সংক্রমণ আমাদের পুতুলের মত ঠুনকো শিশুশরীরে সঞ্চার করেছে অপার শক্তি। পাঁচ-ছয় বছর বয়সে মায়ের শ্রমে শিখে আসা বাংলা বর্ণমালা আর ইংরেজি এলফাবেট দিয়ে দুনিয়াটাকে দেখতে শিখেছি; পড়তে শিখেছি ক্লাসের আপার দেওয়া পাঠ; কাঁড়ি-কাঁড়ি হোমওয়ার্কের বোঝা বহন করেছি; সমাধান করেছি বীজগণিতের খটোমটো ফরমুলা; চোখ গোল করে গল্প শুনেছি ইতিহাসের; পাবলিক পরীক্ষার ভুতুড়ে সকালে চুলে তেল দিয়ে টান-টান করে বেণি বেঁধে কলমের খস-খসানিতে পৃষ্ঠা ভরিয়েছি; কেমিস্ট্রি ল্যাবের বীকারে সবজে-নীল অধঃক্ষেপ দেখে পৃথিবীকে রঙিন ভেবেছি; বিতর্কের মঞ্চে প্রতিপক্ষের তার্কিক আর বিচারক প্যানেলকে চমৎকৃত করেছি বৈশ্বিক অর্থনীতির ভরাডুবির খতিয়ান দেখিয়ে; বিশাল কাঠের বোর্ডে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে মেধাবী সিনিয়ার আপুদের নাম, সেই ১৯৬১ সাল থেকে; ঘাড় কাত করে সেই নামগুলো দেখেছি আর ভেবেছি ওদের মত হতে পারব কিনা। আর বাড়ি এসে মাকে দিয়েছি তাচ্ছিল্যের ভর্ৎসনা — “ধ্যুত, আমাদের আপা বলেছেন এটাই ঠিক। মা, তুমি কিচ্ছু জানো না!” মা নিশ্চয়ই খুশি হয়ে ভাবতেন, “ছোট্ট মেয়েটা কত বড় হয়ে যাচ্ছে!” বাবাকে বলতেন, “জানো তোমার মেয়ে স্কুলে কী কী করে? কী কী শেখে?” বাবা আত্মপ্রসাদের হাসি হাসতেন। মুখে বলতেন না, কিন্তু মনে মনে জানতেন এই স্কুলে তাঁর মেয়ের স্বপ্নগুলো হেলায় মাটিতে গড়াবে না।
হ্যাঁ, আমাদের স্বপ্নই আমাদের অনন্য করেছে। গুঁড়ি-গুঁড়ি মাইক্রোঅর্গানিগজমের মত স্বপ্নরা অঙ্কুরিত হওয়ার জন্য বিদ্যায়তনে আসে। ফলবান বৃক্ষ হয়ে ওঠার চরম প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিতে শিক্ষাগুরুর কাছে আসে। এক আত্মা থেকে আরেক আত্মায় সংক্রমিত হওয়ার জন্য আকুল হয়ে আসে — অভিভাবক থেকে সন্তানের মধ্যে, শিক্ষক থেকে ছাত্রের মধ্যে, বন্ধু থেকে বন্ধুর মধ্যে, অগ্রজ থেকে অনুজের মধ্যে। কতই না চাওয়ার এই ‘সংক্রমণ’! এই সংক্রমণই তো সভ্যতার শুরু থেকে যুগ-যুগ ধরে মানুষের ‘হয়ে ওঠার’ কারণ। শারীরিক জন্ম নিয়ে বাবা-মায়ের আশ্রয় ছেড়ে বিদ্যালয়ে এই নতুন করে ‘হয়ে ওঠা’র দ্বিতীয় জন্মের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শিশুরা আসে দেখেই তো শিক্ষক হন পিতার সমান; মাতার সমান। নতুন জন্ম নিয়ে নতুন আতুঁড়ঘর পাই আমরা যার নাম স্কুল। স্কুল হয় নিরাপদ আশ্রয়। সহপাঠীরা হয় ভাই-বোন। সত্যিই তো! বাংলা দ্বিতীয় পত্রের ভাব-সম্প্রসারণ যখন করতাম ‘শিক্ষক জাতির কারিগর’ বা ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’, তখন এতটা তলিয়ে ভাবিনি। আজ যতটা তলিয়ে ভাবছি। এই স্বপ্নই তো আমাদের শিক্ষালয়ে এক-কে অন্যের সাথে ধরে রাখে। শিক্ষা-প্রক্রিয়াকে সচল রাখে।
কিন্তু স্বপ্নও ধাক্কা খায়। পৃথিবীর সব মূর্ত-বিমূর্ত বস্তুকণার মধ্যে একমাত্র স্বপ্নই ধাক্কা খেয়ে আঘাত পেয়ে কষ্ট পায় বেশি। কারণ স্বপ্নের সাথে প্রত্যাশা আসে; নির্ভরশীলতা আসে। পিতা কন্যাকে নিশ্চিন্তে স্কুল-প্রাঙ্গণে ছেড়ে যান শুধু অতটুকু নির্ভরতার কারণেই। মায়েরা মেয়েদের নিয়ে কোচিং ক্লাসে ছোটেন শুধু আরো ভালো শিক্ষা, ভাল ফলাফলের নিশ্চয়তা দেওয়া শিক্ষকের উপর নির্ভরতার জন্যই। বাবা-মায়েরা গভর্নিং বডির অভিভাবক-সদস্য নির্বাচনে অংশ নেন শুধু আদরের সন্তানের জন্য আরেকটু ভাল শিক্ষার পরিবেশের প্রত্যাশাতেই। অঙ্ক আর পদার্থবিদ্যার শিক্ষক গণিত অলিম্পিয়াডের দৌড়ে নামতে ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করেন শুধু ‘ওরা পারবে!’ — এই স্বপ্ন আর ওদের ক্ষমতার উপর নির্ভরতার ভরসাতেই। পারস্পরিক ভরসার এই জায়গাটা না থাকলে পৃথিবীর অনেককিছুই সম্ভবত অর্থহীন হয়ে পড়ে — কিন্তু সন্দেহাতীতভাবেই অর্থহীন হয়ে পড়ে মানুষ গড়ার এই প্রক্রিয়া — যার প্রাতিষ্ঠানিক নাম হল ‘শিক্ষা’।
কিন্তু আমরা ‘ফরচুনেট’ নই। আমরা আসলে দুর্ভাগা। আমাদের খুব অল্প বয়সেই—যে বয়সে সহজ, নির্মল জিনিস নিয়ে ভাবা ছাড়া, কাগজের প্লেন নিয়ে ক্লাসরুমে টার্গেট প্র্যাকটিস করা ছাড়া, টিফিন নিয়ে বন্ধুর সাথে কাড়াকাড়ি করা ছাড়া আর কোনো কঠিন চিন্তা আমাদের করার কথা না; শিক্ষকের চোখ ফাঁকি দিয়ে লাস্ট বেঞ্চে বসে গল্পের বই কমিক বই কীভাবে পড়ব — এই জটিল সমস্যার সমাধানেই যে বয়সে আমাদের দিন কেটে যাওয়ার কথা, সে বয়সে আমাদের মাথা অধিকার করে নিল অনেকগুলো বিষাক্ত, কঠিন, ভীতিপ্রদ, নিষ্ঠুর, এবং বাস্তব শব্দ। এর মাঝে আছে শিক্ষাবাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্য, যৌন-নিপীড়ন, ‘গোপালগঞ্জ’, গভর্নিং বডি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, বহিরাগতদের উস্কানি, মিডিয়া, এড-হক কমিটি—আরও নানান জটিল ধারণা এবং কঠিন কঠিন বস্তু। যে বয়সে আমাদের কোচিং ক্লাসের অলস দুপুরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চড়ুই পাখির তিড়িংবিড়িং দেখে মন-খারাপ করে অতঃপর সহপাঠীর সাথে খাতার পিছে কাটাকুটি খেলার কথা, সেই বয়সে কোচিং শিক্ষক আমাদের শেখালেন যে আমরা মেয়ে, তিনি পুরুষ, আমাদের বয়স যাই হোক না কেন, আমাদের দেহ একটি আকাঙ্ক্ষার বস্তু, এবং পুরুষ হওয়ার কারণে সেই আকাঙ্ক্ষা তিনি আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, নির্যাতন করে, ধর্ষণ করে, ইন্টারনেটে ছবি ছাপার ভয় দেখিয়ে, যেভাবে-ইচ্ছা চরিতার্থ করতে পারেন।
বিশ্বাস করুন, এত কঠিন কঠিন কথা আমরা আগে জানতাম না। কী করে জানব? যে বয়সে আমাদের ছুটোছুটি, হুটোপাটি করে বেড়ানোর কথা, পোশাকের আবরু কাকে বলে — সেই নিয়ে মাথা-ঘামানোর দায়িত্ব মা আর বড়দের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে পৃথিবীকে চেনার আর জানার কথা, সেই বয়সে ধর্ষিত হওয়ার পর প্রথম আলো-র মত পত্রিকার রিপোর্টার ছেপে দিলেন ধর্ষিত হবার সময় আমাদের পারনে কী কাপড় ছিল, যেন দেশের সব তাঁতীদের বোনা লাখ লাখ ইয়ার্ড কাপড় দিয়ে আমাদের গা ঢেকে দিলেও আমরা পশুদের থেকে নিরাপদ, যেন এর অন্যথা হলেই পুরুষের জন্মগত অধিকার আছে আমাদের ধর্ষণ করার, যেন শাড়ি, কামিজ, বোরখা, হিজাব পরা কোনো নারী কোনোদিন যৌন-নির্যাতনের শিকার হন নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুর ছিলেন আমাদের প্রতিষ্ঠানেরই এক বড় বোন। তিনি স্বামীর হাতে নির্যাতিত হবার পর যারা বলাবলি করছিলেন, ‘এক হাতে তালি বাজে না; নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলার দোষ ছিল’, সেই তালি-বিশারদেরা আবার গর্ত ছেড়ে উঠে এলেন আমাদের বন্ধু ধর্ষিত হবার পর। তারা বলাবলি করতে লাগলেন যে মা-বোনেরা ‘শালীন’ কাপড় পরলে সমাজে এসব ঘটে না। ভিকারুননিসার একজন প্রাক্তন ছাত্রী এবং একজন বর্তমান ছাত্রী—দু’জনের উপরেই এক-মাসেরও কম ব্যবধানে এই তালি-তত্ত্ব প্রযুক্ত হবার পর আজকাল আমাদের নির্মল কৈশোরের অনেকগুলো ঘণ্টা কেটে যায় শালীন কাপড় কী জিনিস, এবং কতটুকু শালীন হলে আমরা কারো কদর্য আকাঙ্ক্ষার শিকার হব না — সেই গবেষণা করতে করতে। পত্রিকায়, টিভিতে, ফেসবুকে, ইন্টারনেটে, ব্লগে, ফোরামে যাঁরা এত কথা লিখলেন, বললেন, তাঁরা হয়তো কখনো ভাবেন নি আমাদের সুন্দর শৈশব-কৈশোর, আমাদের অবুঝ চাওয়াগুলো, আমাদের পথ-হারিয়ে-কোন-বনে-যাই মনটা তাঁরা সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে কীভাবে আলগোছে মাড়িয়ে গেলেন। পথ হারিয়ে আর কোন বনে যাওয়ার পথ কি আমাদের আদৌ আছে? বা কখনো ছিল? কবিগুরু লাইনগুলো বুঝি লিখেছিলেন শুধু আমাদের সমসাময়িক ছেলে-বন্ধুদের কথা মাথায় রেখে। আমাদের ধর্ষিত বন্ধুটি তার বাড়িতে যে ঘরে থাকে, তার বাইরেই হয়তো আছে কোনও মাঠ বা পার্ক, ওই পাড়ায় ১৩-১৪-১৫ বছরের ছেলেরা নিশ্চয়ই আছে, আর আমাদের বয়সী ওই ছেলেগুলো নিশ্চয়ই ঝুম বৃষ্টির দিনে কাদা মেখে ফুটবল খেলে, বা হরতালের দিনে খালি রাস্তায় ক্রিকেট খেলতে খেলতে ‘হাউজ দ্যাট’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে। জানালার পাশে বসে আমাদের বন্ধুটি আহত চোখে চেয়ে দেখে সেই উল্লাস, আর অলক্ষ্যে হাত বুলোয় ওর নিজের শরীরের ক্ষত আর কালসিটের উপর। বড়রা বলতেন বটে সবসময় — “ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের মেন্টাল ম্যাচিউরিটি আগে হয়; মেয়েরা অনেক কষ্টের সাথেও খাপ খাইয়ে নিতে পারে; ছেলেদের সেই ক্ষমতা কই?” হ্যাঁ, আমাদের আছে সেই ক্ষমতা; কিন্তু আমরা জানতাম না সেই ক্ষমতা এমনি এমনি আসে না। সেই ক্ষমতা মূল্য দিয়ে কিনতে হয়। সেই মূল্য হল আমাদের শৈশব। আমাদের কৈশোর। জীবনের এই কখনো-ফিরে-না-আসা সময়টা একবার স্বত্ব ত্যাগ করে দিয়ে দিলে আর কখনো ফেরত পাওয়া যায় না।
আমাদের যে সরল, প্রাণখোলা শৈশবকে আমরা আজ ত্যাগ করছি, গভর্নিং বডির রাজনীতি, নাবালিকা ধর্ষণের আইনানুগ শাস্তি আর পুরো ঘটনায় মিডিয়া কতটুকু ভূমিকা রাখল, তাই নিয়ে ছোট্ট মাথাটাকে জেরবার করছি, ধর্ষিত হয়ে শিক্ষক-নামের-অযোগ্য এক পুরুষের বিরুদ্ধে বিচার চাইতে গিয়ে আমাদের তৎকালীন ‘মাতৃশ্রেষ্ঠা’ প্রিন্সিপাল আপা’র কাছে শুনছি যে ধর্ষণ নয়, এটা আসলে উভয় পক্ষের সম্মতিতে ঘটেছিল, শহীদ মিনারের মানব-বন্ধনের মত অরাজনৈতিক সমাবেশে সরকারবিরোধীসহ আরো নানান পক্ষের রাজনৈতিক এজেন্ডার স্বার্থপর প্রচারের শিকার হয়েছি, অনমনীয় ব্যক্তিত্বের প্রশাসনিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাবিহীন আম্বিয়া আপাকে সঠিক সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছি, স্কুলে ধর্ষণের খবর নানা মহলের ধামাচাপা দেবার প্রয়াসের কারণ হিসাবে শুনছি যে ভিকারুননিসার সম্মান এতে নষ্ট হবে (যেন ভিকারুননিসা কোনো সামন্ত-প্রভুর ভেতর-বাড়ি; কলঙ্কের সংবাদে পারিবারিক ঐতিহ্যের মানহানি হবে), আমাদের সেই ত্যাগকে কেউ মহিমান্বিত করল না।
লৈঙ্গিক রাজনীতি আর রাষ্ট্রীয়-প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি আমরা আজ বুঝতে শিখেছি প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই; আমাদের একদা সংক্রমিত স্বপ্নগুলো ডালপালা মেলবার আগেই। বড় হবার আগেই আজ আমরা যে বড় হয়ে গেলাম, এত দ্রুত এত বড় কি আমরা আসলেই হতে চেয়েছিলাম? কাগজের প্লেনের পর কাগজ দিয়ে ওরিগামির ব্যাং বা চোখা-মুখের সারস পাখি বানিয়ে বন্ধুকে চমকে দেবার যে প্ল্যানটা গত মাসে করেছিলাম, সেই প্ল্যানটা কি আসলেই গতমাসের ছিল? নাকি কয়েক যুগ আগের ছিল? পরীক্ষার পড়া নষ্ট হবে দেখে মা যে আমাদের কমিক বইগুলো নাগালের বাইরে আলমারির উপর রেখে দিয়েছিলেন পরীক্ষার পর নামিয়ে দেবেন বলে, সেগুলো কি আর পড়া হবে? নাকি সেগুলোতে ধুলো জমতে থাকবে? বাসা বদলানোর সময় সেরমাপা দরে বেচে দেব?
ওঃ, কেউ ভাববেন না যেন আমরা সস্তা করুণা চাইছি। মানবতা চাইছে ধর্ষকের বিচার। সুধীমহল চাইছে মানবিক, যৌক্তিক, ধামাচাপা-না-দেয়া পূর্ণাঙ্গ মিডিয়া রিপোর্টিং। শিক্ষানুরাগীরা চাইছেন রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন এবং শিক্ষাপ্রশাসন।
আর আমরা ফেরত চাইছি আমাদের স্বপ্নগুলো।
ফেরত চাইছি আবার স্বপ্ন দেখার অধিকার। এই ‘আমরা’ শুধু ভিকারুননিসা স্কুলের গুটিকয়েক ‘ফরচুনেট’ বা ‘প্রিভিলেজড’ ছাত্রী নই। পুরো বাংলাদেশের সবখানে ছড়িয়ে থাকা মেয়েরা, যারা নামী-দামী স্কুলে যাই, কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলের টিনশেড দেওয়া স্কুলঘরে সকালবেলা পড়তে বসি আর দুপুরবেলা ঘরের কাজ বা ক্ষেতির কাজে হাত লাগাই।
চড়া দামের শৈশবটা তো সস্তা দরে বিকিয়েই দিয়েছি। স্বপ্নগুলো ফেরত দিন।
____________________________________________________
(ভিকারুননিসা নুন স্কুল ও কলেজের বর্তমান ছাত্রীদের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রচিত।)
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৮ comments
নজরুল ইসলাম - ২৫ জুলাই ২০১১ (১১:৩০ অপরাহ্ণ)
এখন মানুষ নেই, যারা আছে তারা সব পশুর আকৃতি!
[আবুল হাসানের কবিতা একটু এদিক ওদিক করে]
মো জুবায়ের - ২৬ জুলাই ২০১১ (১:০৫ পূর্বাহ্ণ)
কাদের কাছে হারানো স্বপ্নগুলো ফেরত চাওয়া? একমাত্র পশু-পাখি-বৃক্ষরাই তো মানবিক, আর কেউ নয়! নিজের বিশ্বাসের জায়গা থেকেই বলছি!
বর্ণালী সাহা - ২৬ জুলাই ২০১১ (১:১৭ পূর্বাহ্ণ)
একমত নই। আপনার কথার কাব্যিক মূল্য অনেকখানি; কিন্তু যতদূর বুঝি, মুক্তাঙ্গনে উচ্চারিত কণ্ঠগুলো মানব-শ্রোতার জন্যই। তবে আপনার বক্তব্য আমি বুঝতে পেরেছি; শুধু মনে করি ‘হতাশা’ নিজেই মানবিক-প্রত্যাশা সৃষ্টির প্রথম ধাপ। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
রায়হান রশিদ - ২৬ জুলাই ২০১১ (৫:২৮ অপরাহ্ণ)
অসাধারণ।
মোহাম্মদ মুনিম - ২৭ জুলাই ২০১১ (৭:১৫ পূর্বাহ্ণ)
বুয়েটে একবার বিজ্ঞান মেলা বা এই জাতীয় কিছুতে ভিকারুন্নেসার ছাত্রীরা মঙ্গল গ্রহে মানব বসতির একটা মডেল নিয়ে এসেছিল। বেশ বড় একটি টেবিলে অনেক যত্নে সাজানো মডেল। মঙ্গল গ্রহের মানব বসতির feasibility নিয়ে কিছু কঠিন প্রশ্ন করতে খুব লোভ হয়েছিল। কিন্তু একটা চশমা পরা মেয়েকে এত আগ্রহ নিয়ে লোকজনকে সেই নকশা দেখাতে (এখানে বাতাস recycled হবে, ওখানে হবে water treatment, যেন নিজের পুতুলের সংসার) দেখলাম যে, কোন প্রশ্নই করতে পারিনি। মঙ্গল গ্রহের বসতির মডেলে বিজ্ঞানের চেয়ে রোমান্টিকতার পরিমাণই বেশী, কিন্তু কিশোর বয়সটাই তো স্বপ্ন দেখার। ওইটুকু বয়সের মেয়েদের feasibility-র কথা বলে স্মার্ট সাজার কোন মানে খুঁজে পাইনি।
এই যৌন নির্যাতনের ব্যাপারে ভিকারুন্নেসার অধ্যক্ষার মার্কিন ধাঁচের consensual sex-এর তত্ত্ব দেখে অবাক হয়েছি। Consensual হলেই কি অপ্রাপ্তবয়স্কার সাথে যৌন সম্পর্ক বৈধ হয়ে যায়? সেটা তো ধর্ষণের পর্যায়েই পড়ে। প্রকৃতপক্ষে এটা pedophilia. সাহিত্যের শিক্ষক পরিমল ধর নাকি অপ্রাপ্তবয়স্ক ধর্ষণ আগেও করেছেন। বছর কয়েক আগে ডালাস অঞ্চলের এক pedophile কে আদালতের আদেশে খোজা (voluntary castration) করে দেয়া হয়েছিল, দীর্ঘ কারাদণ্ডের পরিবর্তে। সাহিত্যের শিক্ষকের ক্ষেত্রেও এমন শাস্তি হলে সেটা তাঁর জন্য উপকারীই হবে, তিনিও ঠাণ্ডা মাথায় সাহিত্য চর্চা করতে পারবেন, তাঁর ভবিষ্যতের ছাত্রীরাও নিরাপদে থাকবে।
মাসুদ করিম - ২৭ জুলাই ২০১১ (১:১৮ অপরাহ্ণ)
এই যে বালক বিদ্যালয় বালিকা বিদ্যালয়, এই যে পুরুষ মহাবিদ্যালয় মহিলা মহাবিদ্যালয় — এগুলো কেন? এগুলোকে কেন বালক-বালিকা বিদ্যালয়, পুরুষ-মহিলা মহাবিদ্যালয় করে দেয়া হচ্ছে না? আমরা তো দেখতে পাচ্ছি বালিকা বিদ্যালয়ে পুরুষ শিক্ষক ও কর্মচারী এবং বালক বিদ্যালয়ে মহিলা শিক্ষক ও কর্মচারীরা কাজ করছেন। তাহলে স্কুল কলেজে একেবারে নির্ভেজাল নারীবিশ্ব বা পুরুষবিশ্ব তো কায়েম হচ্ছে না, তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পুরোপুরি সহশিক্ষা কেন চালু হচ্ছে না বা করা যাচ্ছে না, এটা আমার একটা বড় জিজ্ঞাসা। আমরা জানি সহশিক্ষা ‘সর্বরোগহর’ নয় কিন্তু একশভাগ সহশিক্ষা চালু করতে পারলে আমরা নারী-পুরুষের সমান অধিকারের দিকে অনেক এগিয়ে যেতে পারতাম।
সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ২৭ জুলাই ২০১১ (৪:০৬ অপরাহ্ণ)
সহশিক্ষাই সর্বরোগহর, এটা মানতে আমি নারাজ। যদি তাই হতো, তাহলে ইউনিভার্সিটিতে যৌন অপরাধের এমন প্রকোপ দেখা যেত না। আশা করবো, এই ঘটনাটা দেখবার পেরিস্কোপটা এখন উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকেও ঘুরবে।
আর অপ্রাপ্তবয়স্কার সম্মতি, সম্মতিজ্ঞাপক মৌন, মৌন যাই থাকুক না কেন, তার সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপনকে ধর্ষণ বলে। যে করেছে, তাকে ধর্ষকই বলে, শিশুনিপীড়ক/কিশোরনিপীড়ক বলে। শৈশবহন্তা-কৈশোরহন্তা এইসব মানুষের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক শাস্তি কামনা করি।
বর্ণালীকে ধন্যবাদ এমন প্রাঞ্জল তীক্ষ্ণ একটা লেখার জন্যে। নির্মাণের উঠানে নিয়মিত তাকে দেখতে চাই।
মাসুদ করিম - ১ আগস্ট ২০১১ (১:৪৫ পূর্বাহ্ণ)
‘বেশরমি মোর্চা’র উদ্যোগে দিল্লিতে রোববার হয়ে গেল উপমহাদেশের প্রথম ‘SLUT WALK’, বোম্বেতেও কয়েকদিনের মধ্যে আয়োজিত হবে ‘SLUT WALK’।
খবরের লিন্ক এখানে।
ঢাকায় কি নেই ‘বেশরমি মোর্চা’র মতো কেউ অথবা চট্টগ্রামে, আমরা কি আশা করতে পারি বাংলাদেশেও হবে ‘SLUT WALK’?