শিবরাম চক্রবর্তীর (১৯০৩–১৯৮০) এই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন অমিতাভ বসু, কলকাতার ‘উল্টোরথ’ পত্রিকার জন্য। লেখকের প্রয়াণদিবস (২৮ আগস্ট) উপলক্ষে সাক্ষাৎকারটি এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো। [...]

উল্টোরথ পত্রিকার একটি নিয়মিত বিভাগ ছিল অমিতাভ বসুর ‘দৈনন্দিন জীবনে’; প্রতি সংখ্যায় একজন সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার নিয়ে সাজানো হতো এই বিভাগ। প্রশ্নগুলো পরিকল্পিত বা ছকবাঁধা থাকলেও উত্তরগুলো উপভোগ্য হয়ে উঠত ব্যক্তিবৈচিত্র্যের কারণেই। ১৮৯৩ শকাব্দের মাঘ সংখ্যায় (বর্ষ ২০, সংখ্যা ১১, জানুয়ারি, ১৯৭২) ছাপা হয় শিবরাম চক্রবর্তীর (১৯০৩–১৯৮০) সাক্ষাৎকার। অল্প কথার উত্তরেও চাপা থাকেনি সুরসিক শিবরামের আত্মপরিহাসপ্রিয়তা, যাঁর আহারনিদ্রার ধরনও পাঁচজন লেখকের চেয়ে আলাদা : রিকসাওয়ালা যেমন রিক্সা না টানলে খেতে পাবে না, আমারও প্রায় সেই দশা। লেখকদের ভেতর আমি এক মজুর, মেহনতি মানুষদের একজন। মোট নামিয়ে পয়সা কুড়নো, মোটের উপর আমার উপায়, মোটামোটি বলতে গেলে। লিখি আমি পরের দিন, কেননা আমি ভালই জানি, পরের দিন কোন লেখাই আমার টিকবে না। লেখকের প্রয়াণদিবস (২৮ আগস্ট) উপলক্ষে সাক্ষাৎকারটি এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো। শুনুন হর্ষবর্ধন-স্রষ্টা শিবরামের ‘অশ্বভাবিক’ কথাবার্তা। দৈনন্দিন জীবনে সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী সেটা ছিল অঙ্কের ক্লাস। আর এই অঙ্ক সাবজেক্টটা আমার কোনদিনই ভাল লাগতো না―সেই ছোটবেলা থেকে। তাই অঙ্কের ক্লাস এলেই আমি আমার ক্লেশ দূর করতে অন্য কিছুতে মনোনিবেশের চেষ্টা করতাম। আর সেদিনও সেই অঙ্কের ক্লাসেই সোজা ব্যাক-বেঞ্চে আত্মগোপন করে কিছু করছিলাম। আমার সামনের লম্বা ছেলেটা কখন যেন উঠে গিয়েছিল। তাতে পরিষ্কার আমি মাস্টারমশয়ের নজরে পড়ে গেলাম। তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন―ইউ বয়। আমি চমকে সোজা দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম―‘ইয়েস স্যার।’ মাস্টারমশয় তেমনি রাগত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন―‘হাতে কি?’ বললাম―‘মালাই বরফ স্যার।’ আমার কথা শুনে তিনি আরো চটে গেলেন―রসিকতা হচ্ছে? হাতে দেখছি একটা বই আর বলছো কিনা মালাই বরফ। মিথ্যে কথা বলা! এদিকে এস। সোজা চলে এলাম। মাস্টারমশয় আমার হাত থেকে বইখানা সজোরে টেনে নিলেন। আর দেখলেন সত্যিই মালাই বরফ। বইখানার নাম। এবারে হয়তো তিনি একটু অপ্রস্তুত হলেন। কারণ দেখলেন আমি মিথ্যে কিছু বলিনি। অন্যদিক দিয়ে তাই আক্রমণ করলেন―ক্লাসে বসে গল্পের বই পড়া! যাও, পেছনে গিয়ে ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাক। আমি চলে এলাম। তিনি বইখানা রেখে দিলেন। অবশ্য সেদিন আমাকে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হয়নি। একটু বাদেই মাস্টারমশয় বললেন―‘বোস। বসে ক্লাসের কাজ কর।’ তাহলে মালাই বরফেই বুঝি মাস্টারমশয় গলে গিয়েছিলেন। কারণ, দেখেছিলাম তিনি নিজেই তখন বইটার অনেকটা পড়ে ফেলেছেন। আর এই হল আমার শিবরাম-পাঠের প্রথম অভিজ্ঞতা।…

উল্টোরথ-এর 'মেলব্যাগ'-এ মেশানো থাকত কৌতুকের মিছরি আর মিসেস প্রসাদ সিংহ ছিলেন মিছরির বয়াম। [...]

[প্রথম পর্ব] উল্টোরথ-এর 'মেলব্যাগ'-এ মেশানো থাকত কৌতুকের মিছরি আর মিসেস প্রসাদ সিংহ ছিলেন মিছরির বয়াম। মাঝেমধ্যে প্রসাদ সিংহ উত্তর পরিবেশন করলেও মিসেস প্রসাদ সিংহেরই জনপ্রিয়তা ছিল সর্বাধিক, নীচের দুটি চিঠি তার প্রমাণ : কল্যাণী ভট্টাচার্য (আটীয়াবাড়ী বাগান) : আপনার উত্তর খুব ভাল লাগে। একমাত্র আপনার উত্তর পড়বার জন্যই আমি প্রতি মাসে উল্টোরথ রাখি। আশা করি, আপনি মেলব্যাগ ছেড়ে যাবেন না। -- তিনকাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। এখন কোন চুলোয় যাব বল। (বর্ষ ২০, সংখ্যা ১০, পৌষ ১৮৯৩ শকাব্দ, পৃ. ২৩) তাপস মুখার্জী (নদীয়া) : উল্টোরথে আপনার সুন্দর উত্তর পড়ে খুব অবাক হয়ে যাই। সেই জন্য আপনাকে জানাই আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা। ছোটভাইয়ের অভিনন্দন গ্রহণ করবেন কি? -- নিশ্চয়। (বর্ষ ২১, সংখ্যা ১, চৈত্র ১৮৯৪ শকাব্দ, পৃ. ২৭) কিছু-কিছু বিষয়ে (যেমন : ধর্ম-বর্ণ) পাঠকদের কৌতূহল মেটানো হয়েছে অত্যন্ত সরল উত্তরে, আবার কখনও-কখনও দেখছি শ্লেষ-বক্রোক্তির টান। মিসেস প্রসাদ সিংহের একটি উত্তর : শিপ্রা দাশ (গৌহাটি) : রাকেশ রোশন হিন্দু, না মুসলমান? -- হিন্দু। (বর্ষ ২০, সংখ্যা ১১, মাঘ ১৮৯৩ শকাব্দ, পৃ. ২২৫) এর আগে প্রায় একই প্রসঙ্গে প্রসাদ সিংহ উত্তর দিয়েছেন : মনোমোহন সরকার (গৌরীপুর) : বাংলায় কি সিডিউল্ড কাস্ট শিল্পী আছেন? -- এসব প্রশ্ন থাক। জাত নিয়ে আজ আর কেউ মাথা ঘামায় না। -- বিশেষ করে কলকাতায়। (বর্ষ ১৩, সংখ্যা ৪, মাঘ ১৮৮৬ শকাব্দ, পৃ. ২৩১) ষাট-সত্তরের দশকে বাংলা ছবির সঙ্গে সাহিত্যের যোগ যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল, উল্টোরথ-এর নিয়মিত বিভাগ 'বরণীয় সাহিত্যের স্মরণীয় চিত্ররূপ' বা 'সাহিত্যের চিত্ররূপ' দেখলেই তা বোঝা যায়। এ-ব্যাপারে পাঠকদের সাগ্রহ পরামর্শও লক্ষণীয়, যেমন প্রসাদ সিংহের প্রতি এক পাঠকের চিঠি : এস. টি. ডি (রঘুনাথপুর) : প্রসাদদা, গত বৎসর পূজা সংখ্যা 'বেতারজগৎ'-এ প্রকাশিত আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের 'মহাবিহার' গল্পটি চিত্রায়িত হলে খুব ভালো হবে এবং চলবেও। আমার হয়ে আপনি পরিচালক অজয় করকে অনুরোধ জানাবেন ছবিটি চিত্রায়িত করবার জন্য? -- আপনার অনুরোধ জানালুম। (বর্ষ ১৩, সংখ্যা ৪, মাঘ ১৮৮৬ শকাব্দ, পৃ. ২২৫) 'মেলব্যাগ' থেকে একগুচ্ছ চিঠি বেছে নিয়ে তুলে দেওয়া হলো (উত্তরদাতা : মিসেস প্রসাদ সিংহ) : ১ স্বপন ব্যানার্জী (লামডিং) : বহুরূপ যাঁর তাঁকে বলা হয় বহুরূপী। পাঁচটি মুখ যাঁর তাঁকে…

'প্রসাদ সিংহ পরিকল্পিত' মাসিক উল্টোরথ পত্রিকার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় শৈশবে―প্রয়াত মাতামহের (মুন্সেফ আদালতের সরকারি উকিল) দলিলপত্রভর্তি স্থূলকায় আলমারি লুঠ করে পেয়েছিলাম আরও অনেক বইয়ের সঙ্গে উল্টোরথ-এর একটি বিশেষ সংখ্যা (বর্ষ ২০, সংখ্যা ১০, পৌষ ১৮৯৩ শকাব্দ); ছোট মামা কর্তৃক স্বাক্ষরিত এই পত্রিকা আমার বহু দুপুরের অবকাশরঞ্জিনী হয়ে ছিল। [...]

'প্রসাদ সিংহ পরিকল্পিত' মাসিক উল্টোরথ পত্রিকার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় শৈশবে―প্রয়াত মাতামহের (মুন্সেফ আদালতের সরকারি উকিল) দলিলপত্রভর্তি স্থূলকায় আলমারি লুঠ করে পেয়েছিলাম আরও অনেক বইয়ের সঙ্গে উল্টোরথ-এর একটি বিশেষ সংখ্যা (বর্ষ ২০, সংখ্যা ১০, পৌষ ১৮৯৩ শকাব্দ); ছোট মামা কর্তৃক স্বাক্ষরিত এই পত্রিকা আমার বহু দুপুরের অবকাশরঞ্জিনী হয়ে ছিল। কণিষ্ক (রাম বসু) ও বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসদুটির (যে যার অজ্ঞাতবাসে ও বনের খেলা) কথা আমার আমৃত্যু মনে থাকবে। পরবর্তীকালে আরও বাইশটি সংখ্যা সংগ্রহ করেছি পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে; ধূসর কাগজে ছাপা কাটা-কাটা চেহারার অক্ষরগুলো আমাকে মোহগ্রস্ত করে রাখে এখনও। মূলত চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা হলেও উল্টোরথ-এর বড় অংশ জুড়ে থাকত গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, সাক্ষাৎকার ও রম্যরচনা; আর যা ছিল আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষক―'মেলব্যাগ'। নিয়মিত এ-বিভাগে পাঠকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হতো। একটি পূজা সংখ্যায় (১৮৯৯ শকাব্দ) ঘোষণা করা হয়েছিল যে শ্রেষ্ঠ প্রশ্নকর্তাকে ২৫.০০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। সাধারণত প্রশ্নের তুলনায় উত্তরগুলো সংক্ষিপ্ততর হলেও বুদ্ধিদীপ্তি ও সরসতায় উপভোগ্য হয়ে উঠত। উত্তরদাতা ছিলেন মিসেস প্রসাদ সিংহ ও প্রসাদ সিংহ স্বয়ং; কোনও-কোনও সংখ্যায় অবতার কিংবা শ্রীপঞ্চাননকেও দেখা গেছে, আবার কয়েকটি সংখ্যায় নামই ছাপা নেই কারও। মার্চ ১৯৭২ সংখ্যায় (বর্ষ ২১, সংখ্যা ১, চৈত্র ১৮৯৪ শকাব্দ) প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানা যাচ্ছে : উল্টোরথ-এর মুদ্রাকর, প্রকাশক ও সম্পাদকের নাম মনোজ দত্ত; পত্রিকার ঠিকানা―দি ম্যাগাজিন্‌স্ প্রাইভেট লিমিটেড, ১২৪/বি, বিবেকানন্দ রোড, কলকাতা-৬। একই প্রকাশনালয় থেকে পাশাপাশি বেরোত একই আদলের আরেকটি মাসিক পত্রিকা : সিনেমাজগৎ। 'মেলব্যাগ' সেখানেও নিয়মিত বিভাগগুলোর একটি। পত্রিকাদুটির প্রকাশতারিখ উল্লেখিত হতো শকাব্দে (যার সঙ্গে ৭৮ যোগ করলে খ্রিস্টীয় সন মিলবে)। 'মেলব্যাগ'-সূত্রে জানতে পারি, 'উল্টোরথ' নামের প্রবর্তক প্রসাদ সিংহ এবং এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৫২ সাল থেকে। আমার সংগৃহীত সর্বশেষ সংখ্যাটি (বর্ষ ৩৬, সংখ্যা ৯, বৈশাখ ১৩৯৫ বঙ্গাব্দ) একটু ব্যতিক্রমী (আকার : ১০.২৫‌" x ৮"; অন্যান্য সংখ্যার আকার : ৮.২৫" x ৫.২৫")―শকাব্দের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে বঙ্গাব্দ এবং অন্তত এই প্রথমবারের মতো প্রারম্ভিক আখ্যাপত্র দেখতে পাচ্ছি, তাতে লেখা : প্রধান সম্পাদক―শক্তিপদ রাজগুরু, সম্পাদক―ডি. পি. আগরওয়াল, সহযোগী সম্পাদক―শ্যামল বসু। পালটে গেছে কার্যালয়ের ঠিকানাও : ১ বি রাজা সুবোধমল্লিক স্কোয়ার, কলিকাতা-৭০০০১৩। 'পাত্র পাত্রী' বা 'আপনার প্রশ্ন ও আপনার ভাগ্য' শিরোনামে নতুন বিভাগ…

যে-কয়েকজন গৃহশিক্ষকের কাছে আমরা পড়েছি ছেলেবেলায়, তাঁদের মধ্যে তিনজনের কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে : সিলেটি স্যার, জসিম স্যার ও অলিউল্লা স্যার। সিলেটি স্যারের পরে―বেশ বিরতি দিয়েই অবশ্য―এসেছিলেন জসিম স্যার এবং আরও কয়েকজনের পরে অলিউল্লা স্যার। জসিম স্যারের বাড়ি ছিল সন্দ্বীপ, অলিউল্লা স্যারের ফেনি। আর সিলেটি স্যার? জীবনকাহিনির মতো তাঁর 'সিলেটি স্যার' অভিধাও ছিল রহস্যময়! [...]

যে-কয়েকজন গৃহশিক্ষকের কাছে আমরা পড়েছি ছেলেবেলায়, তাঁদের মধ্যে তিনজনের কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে : সিলেটি স্যার, জসিম স্যার ও অলিউল্লা স্যার। সিলেটি স্যারের পরে―বেশ বিরতি দিয়েই অবশ্য―এসেছিলেন জসিম স্যার এবং আরও কয়েকজনের পরে অলিউল্লা স্যার। জসিম স্যারের বাড়ি ছিল সন্দ্বীপ, অলিউল্লা স্যারের ফেনি। আর সিলেটি স্যার? জীবনকাহিনির মতো তাঁর 'সিলেটি স্যার' অভিধাও ছিল রহস্যময়! জসিম স্যার জিজ্ঞেস করলেন এক সকালে, 'আচ্ছা, তোমরা কালো কালিতে লাল লিখতে পারো?' এ কেমন প্রশ্ন―কালো কালিতে লাল! কোনও বুদ্ধি মাথায় না আসায় এবং ব্যাপারটা একরকম অলৌকিক বিবেচনা করে আমরা হার মানলাম। জসিম স্যার গম্ভীরভাবে খাতা টেনে নিয়ে কালো কালিতেই গোটা-গোটা অক্ষরে লিখলেন : 'লাল'। ও, এই ঘটনা তাহলে! চমৎকৃত হয়েছিলাম কিছুটা। আর এত দিন পরেও যে জসিম স্যারকে ভুলিনি, তা সেই কালো কালির টানেই! অলিউল্লা স্যার ছিলেন বেজায় বেরসিক মানুষ। তাঁর ঘুম ভাঙত সকালে নির্বিকারচিত্তে অগ্নিসংযোগ করতে করতে। বিড়ি খেতেন প্রচুর। তাঁর শার্টের হাতায় কি বিছানার চাদরে অসংখ্য বিড়িপোড়ার সাক্ষ্য আর ছাই ছড়িয়ে থাকত যত্রতত্র। খুঁটিনাটি নিয়ে ছেলেমানুষিও করতেন আমাদের সঙ্গে। তবে রসবোধ না থাকলেও তিনি কখনও মারধর করতেন না। ছিলেন পাটিগণিতের জাদুকর। সুদকষার প্যাঁচ খুলতে তাঁর দুমিনিটও লাগত না। কিন্তু মেধায়, রসিকতায়, হুল্লোড়পনায় সিলেটি স্যারের সমকক্ষ ছিলেন না কেউই। দীর্ঘকায়, উন্নতনাসা, শ্যামবর্ণ এ-শিক্ষকটিকে ঘিরে অনেক রূপকথার জোনাকি জ্বলত সে-সময়েও। তাঁর আসল নাম না কি রাজু, ধর্ম কী আজও জানা নেই। বাড়ি আদৌ সিলেট কি না সন্দেহ। 'কমিউনিস্টের লোক', না কি কোন ব্যাংকডাকাতি করে পালিয়েছেন সবান্ধবে, আত্মগোপন করে থাকেন নানা জায়গায় ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের রক্ষণশীল বাড়ির কর্তারা কখনও তাঁকে এ-বিষয়ে প্রশ্নাক্ত করেননি, বরং তাঁর বন্ধুরা মাঝেমধ্যে এলে আপ্যায়নাদির পর খোশগল্প করতেন। এমন নিষ্কলুষ প্রশ্রয়ের প্রচ্ছন্ন একটি কারণ ছিল হয়তো এই : জংলি গ্রামের উপান্তে আমাদের বড় বাড়ি। ঝিঁঝির আহাজারি ছাড়া কোনো সাড়াশব্দ থাকত না সারাবেলা। সিলেটি স্যারের আগমনের পরেই (১৯৮৫ সালের দিকে) রাতারাতি জমে উঠল ভূতের বাড়িটা। আর না কি তিনি ঘুমাতেন না রাতে, টহল দিতেন এদিক-সেদিক―যা হোক, চোরডাকাতেরা অন্তত সন্ত্রস্ত থাকবে! সন্ত্রস্ত থাকারই কথা, যা বাজখাঁই গলা! খুব ভোরে উঠে (না কি জেগেই থাকতেন?) বাড়ির চৌহদ্দিতে বার কয়েক চক্কর মেরে এসে ঢক-ঢক করে…

কবিবন্ধু ফুয়াদ হাসানের ফোন পেলাম রবিবার (৫ জুলাই ২০০৯) দুপুরে, যদিও আগের দিনই খবরটা পেয়েছিলাম সুমন ভাইয়ের (রেজাউল করিম সুমন) কাছে। পত্রিকায় জানলাম, আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯) মারা গেলেন শুক্রবার রাতে। কিন্তু দেরিতে হলেও ফুয়াদের ফোনালাপে প্রচ্ছন্ন ছিল এক স্মৃতিপ্রাসঙ্গিকতা। [...]

কবিবন্ধু ফুয়াদ হাসানের ফোন পেলাম রবিবার (৫ জুলাই ২০০৯) দুপুরে, যদিও আগের দিনই খবরটা পেয়েছিলাম সুমন ভাইয়ের (রেজাউল করিম সুমন) কাছে। পত্রিকায় জানলাম, আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২–২০০৯) মারা গেলেন শুক্রবার রাতে। কিন্তু দেরিতে হলেও ফুয়াদের ফোনালাপে প্রচ্ছন্ন ছিল এক স্মৃতিপ্রাসঙ্গিকতা। বহুদিন আগে, যখন আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্র, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে একসঙ্গে পড়েছিলাম ভোরের নদীর মোহনায় জাগরণ। এ-বইয়ের 'দুই আফসোস' কবিতাটি আমাদের দুজনকেই আক্রান্ত করেছিল শরব্যঞ্জনায়। পরে অনেকবার চিরকুট দিয়েও বইটির খোঁজ পাওয়া যায়নি। আজাদের লেখার সঙ্গে আমি আকৈশোর পরিচিত, বলা যায়, তিনি ছিলেন আমার প্রথম সাহিত্যনায়ক। নবম শ্রেণিতে, ১৯৯২-এ, পাঠ্যবাংলার কবিতাসঙ্কলনে 'আমার মা'কে যখন' নামের একটি সম্মোহক দীর্ঘকবিতা ছিল তাঁর। দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য এই : কবিতাটি পরীক্ষার পাঠ্যসূচির বাইরেই পড়ে ছিল সারাবছর। আমার এতই প্রিয় ছিল যে পাঠোচ্ছ্বাসে মুখস্থ হতে দেরি হয়নি। প্রথম স্তবক মনে আছে এখনও : আমার মা'কে যখন মনে পড়ে চলতি বাসের ভিড়ে জানালায় তাকাই করুণ আমি, রডধরা সহযাত্রীর হাতের যত ঘাম লাগে গালে ঝাঁকুনির তালে তালে এবং যদিও খুব নিরুপায় গরম নিঃশ্বাসে চাপে দেখি দূরে হলুদ-সবুজ বন, কালোজাম থোকা থোকা ধরে আছে আলগোছে ঠোকর মারে কাকেরা, উড়ে যায় ডাল থেকে ডালে, বসে কি যে খুশি দুপুররোদেও ডাকে অবিশ্রাম। আমি মুগ্ধ শিশু, চোখে এক হ্রদ বিস্ময়ের ঝিকিমিকি, মহাকায় বটগাছ খেলা করে বাতাসের স্রোতে―হাতে পাখি নীলকণ্ঠ নাম তখন ছন্দের কোনও ধারণাই ছিল না; পরে বুঝলাম, কবিতাটির গায়ে বোলানো হয়েছে অক্ষরবৃত্তের সোনারুপোর কাঠি, যা উতল গাঙের বুকেও এনে দিতে পারে নিঝুম অরণ্যের ঘুম। এ-ও দেখলাম, অষ্টাক্ষর পর্বকে মাঝেমধ্যেই ৩+২+৩ মাত্রার বিরলকর্ষিত বিলে চালিয়ে নিয়েছেন কবি অবলীলায়। অন্তর্মিলে ও অন্ত্যমিলে বহমান এক স্মৃতিকাতরতা মুগ্ধ করে রেখেছিল আমার কিশোরহৃদয় এবং এখনও ভিড়েলা বাসে কোথাও যেতে যেতে যেন 'গালে লাগে' 'রডধরা সহযাত্রীর হাতের যত ঘাম'। ২ কিন্তু কবিতা নয়, উপন্যাসের সূত্রেই আজাদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়, আমার এক খালাতো ভাই দুটি বই নিয়ে এসেছিলেন বাসায়। একটি পারস্য উপন্যাস, অন্যটি আজাদের শীতের শেষ রাত বসন্তের প্রথম দিন। বইদুটি ছিল মায়ের দখলে―দূর থেকে দেখতাম বিড়ালের কারুণ্য নিয়ে। আমার অভিশাপে মায়ের চোখে ঘুম নেমে আসত দুপুরে, তখন একটু-একটু পড়ার সুযোগ…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.