'প্রসাদ সিংহ পরিকল্পিত' মাসিক উল্টোরথ পত্রিকার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় শৈশবে―প্রয়াত মাতামহের (মুন্সেফ আদালতের সরকারি উকিল) দলিলপত্রভর্তি স্থূলকায় আলমারি লুঠ করে পেয়েছিলাম আরও অনেক বইয়ের সঙ্গে উল্টোরথ-এর একটি বিশেষ সংখ্যা (বর্ষ ২০, সংখ্যা ১০, পৌষ ১৮৯৩ শকাব্দ); ছোট মামা কর্তৃক স্বাক্ষরিত এই পত্রিকা আমার বহু দুপুরের অবকাশরঞ্জিনী হয়ে ছিল। [...]

Ultorath-01

‘প্রসাদ সিংহ পরিকল্পিত’ মাসিক উল্টোরথ পত্রিকার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় শৈশবে―প্রয়াত মাতামহের (মুন্সেফ আদালতের সরকারি উকিল) দলিলপত্রভর্তি স্থূলকায় আলমারি লুঠ করে পেয়েছিলাম আরও অনেক বইয়ের সঙ্গে উল্টোরথ-এর একটি বিশেষ সংখ্যা (বর্ষ ২০, সংখ্যা ১০, পৌষ ১৮৯৩ শকাব্দ); ছোট মামা কর্তৃক স্বাক্ষরিত এই পত্রিকা আমার বহু দুপুরের অবকাশরঞ্জিনী হয়ে ছিল। কণিষ্ক (রাম বসু) ও বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসদুটির (যে যার অজ্ঞাতবাসেবনের খেলা) কথা আমার আমৃত্যু মনে থাকবে। পরবর্তীকালে আরও বাইশটি সংখ্যা সংগ্রহ করেছি পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে; ধূসর কাগজে ছাপা কাটা-কাটা চেহারার অক্ষরগুলো আমাকে মোহগ্রস্ত করে রাখে এখনও। মূলত চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা হলেও উল্টোরথ-এর বড় অংশ জুড়ে থাকত গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, সাক্ষাৎকার ও রম্যরচনা; আর যা ছিল আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষক―’মেলব্যাগ’। নিয়মিত এ-বিভাগে পাঠকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হতো। একটি পূজা সংখ্যায় (১৮৯৯ শকাব্দ) ঘোষণা করা হয়েছিল যে শ্রেষ্ঠ প্রশ্নকর্তাকে ২৫.০০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। সাধারণত প্রশ্নের তুলনায় উত্তরগুলো সংক্ষিপ্ততর হলেও বুদ্ধিদীপ্তি ও সরসতায় উপভোগ্য হয়ে উঠত। উত্তরদাতা ছিলেন মিসেস প্রসাদ সিংহ ও প্রসাদ সিংহ স্বয়ং; কোনও-কোনও সংখ্যায় অবতার কিংবা শ্রীপঞ্চাননকেও দেখা গেছে, আবার কয়েকটি সংখ্যায় নামই ছাপা নেই কারও।

মার্চ ১৯৭২ সংখ্যায় (বর্ষ ২১, সংখ্যা ১, চৈত্র ১৮৯৪ শকাব্দ) প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানা যাচ্ছে : উল্টোরথ-এর মুদ্রাকর, প্রকাশক ও সম্পাদকের নাম মনোজ দত্ত; পত্রিকার ঠিকানা―দি ম্যাগাজিন্‌স্ প্রাইভেট লিমিটেড, ১২৪/বি, বিবেকানন্দ রোড, কলকাতা-৬। একই প্রকাশনালয় থেকে পাশাপাশি বেরোত একই আদলের আরেকটি মাসিক পত্রিকা : সিনেমাজগৎ। ‘মেলব্যাগ’ সেখানেও নিয়মিত বিভাগগুলোর একটি। পত্রিকাদুটির প্রকাশতারিখ উল্লেখিত হতো শকাব্দে (যার সঙ্গে ৭৮ যোগ করলে খ্রিস্টীয় সন মিলবে)। ‘মেলব্যাগ’-সূত্রে জানতে পারি, ‘উল্টোরথ’ নামের প্রবর্তক প্রসাদ সিংহ এবং এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৫২ সাল থেকে। আমার সংগৃহীত সর্বশেষ সংখ্যাটি (বর্ষ ৩৬, সংখ্যা ৯, বৈশাখ ১৩৯৫ বঙ্গাব্দ) একটু ব্যতিক্রমী (আকার : ১০.২৫‌” x ৮”; অন্যান্য সংখ্যার আকার : ৮.২৫” x ৫.২৫”)―শকাব্দের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে বঙ্গাব্দ এবং অন্তত এই প্রথমবারের মতো প্রারম্ভিক আখ্যাপত্র দেখতে পাচ্ছি, তাতে লেখা : প্রধান সম্পাদক―শক্তিপদ রাজগুরু, সম্পাদক―ডি. পি. আগরওয়াল, সহযোগী সম্পাদক―শ্যামল বসু। পালটে গেছে কার্যালয়ের ঠিকানাও : ১ বি রাজা সুবোধমল্লিক স্কোয়ার, কলিকাতা-৭০০০১৩। ‘পাত্র পাত্রী’ বা ‘আপনার প্রশ্ন ও আপনার ভাগ্য’ শিরোনামে নতুন বিভাগ সংযোজিত হয়েছে, কিন্তু নেই সাধের সেই ‘মেলব্যাগ’। সর্বার্থে এটি নিষ্প্রভ মনে হয়।

উল্টোরথ-এর নিয়মিত লেখকদের মধ্যে ছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী, শ্রীকল্কে, শ্রীবিরূপাক্ষ, অমিতাভ বসু, তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী, জরাসন্ধ, ইন্দ্রধনু, ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বিমল চক্রবর্তী, কলিন পাল প্রমুখ। এছাড়া বনফুল, সমরেশ বসু, মনোজ বসু, বিমল মিত্র, বিমল কর, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, প্রবোধকুমার সান্যাল, প্রফুল্ল রায়, শক্তিপদ রাজগুরু, শঙ্কু মহারাজ, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, বারীন্দ্রনাথ দাশ, ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্ত, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কিংবা শংকরের গল্প-উপন্যাস-ভ্রমণকাহিনি তো থাকতই। প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু বা প্রতিভা বসুর গল্প-উপন্যাসও ছাপা হয়েছে কোনও-কোনও সংখ্যায়। প্রেমেন্দ্র মিত্রের পৃথক সম্মানও ছিল উল্টোরথ-এ; ১৯৬৫ সালের নববর্ষ সংখ্যার (বর্ষ ১৪, সংখ্যা ২, বৈশাখ ১৮৮৭ শকাব্দ) ‘আমাদের কথা’য় জানানো হয়েছে :

উল্টোরথ পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রতি বৎসর একজন কবিকে পাঁচশত টাকা অর্থমূল্যের একটি সম্মান-পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে বাংলা সাহিত্যে তাঁর উল্লেখযোগ্য কবি-কর্মের জন্য। এ বৎসর সে পুরস্কারটির জন্য নির্বাচিত হয়েছেন সুখ্যাত কবি শ্রীকামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। প্রতি বৎসরই এই নির্বাচন কর্মটি সমাধা করা হয়ে থাকে স্বনামখ্যাত কবি শ্রীপ্রেমেন্দ্র মিত্রের উপদেশে ও নির্দেশে।

(পৃ. ৩১)

১৯৬৯ সালে ‘উল্টোরথ পুরস্কার’ পেয়েছেন কবি সুনীলকুমার নন্দী; তাঁর জীবন ও কাব্যের উপর পরিচিতিমূলক প্রবন্ধ লিখেছেন সুমিতচন্দ্র মজুমদার (বর্ষ ১৮, সংখ্যা ৯, অগ্রহায়ণ ১৮৯১ শকাব্দ, পৃ. ৪৭)। অর্থাৎ, মূলত গদ্যকাগজ হলেও উল্টোরথ কবিতার জন্যও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে গেছে।

উল্টোরথ-এর পাতায়-পাতায় থাকত নায়ক-নায়িকার ছবি, পরিচালক-প্রযোজক ও কলাকুশলীদের ছবিও। ‘টালিগঞ্জিকা’, ‘বোম্বাই চিঠি’, ‘স্টুডিও পরিক্রমা’ ইত্যাদি বিভাগে পরিবেশিত হতো নির্মিত বা নির্মীয়মাণ বাংলা ও হিন্দি ছবির বিশদ সংবাদ। এই পত্রিকার মাধ্যমেই আমি প্রথম চিনেছি ‘বাংলা ছবির স্বর্ণযুগ’-এর উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেনকে; এছাড়া বাংলা ও হিন্দি ছবির জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, শমিত ভঞ্জ, অনুপকুমার, রঞ্জিৎ মল্লিক, দেবরাজ রায়, দীপঙ্কর দে, সুপ্রিয়া দেবী, মাধবী চক্রবর্তী, সন্ধ্যা রায়, শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সুব্রতা চট্টোপাধ্যায়, অশোককুমার, রাজ কাপুর, দিলীপকুমার, দেবানন্দ, রাজেশ খান্না, ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চন, জীতেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জীবকুমার, মীনাকুমারী, মমতাজ, হেমা মালিনী, সায়রা বানু, ওয়াহিদা রেহমান, জীনত আমন, জয়া ভাদুড়ি, বৈজয়ন্তীমালা, যোগিতাবালী, আশা পারেখ, মালা সিনহাকে; বসন্ত চৌধুরী, পাহাড়ী সান্যাল, বিকাশ রায়, উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, অরুন্ধতী দেবী, নবদ্বীপ হালদার, সবিতাব্রত দত্ত, ছবি বিশ্বাস, বঙ্কিম ঘোষ, রবি ঘোষ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায় বা চিন্ময় রায়ের মতো মঞ্চ-থিয়েটার-চলচ্চিত্রের কুশলী অভিনেতা-অভিনেত্রীকে বা দেবনারায়ণ গুপ্ত, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মতো নাট্যকার-নাট্যরসিককে; সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, দীনেন গুপ্ত, শক্তি সামন্ত, সত্যেন বসু, বি. আর. ইশারা, ঋষীকেশ মুখোপাধ্যায়, রামানন্দ সাগর, শচীন ভৌমিক, সলিল দত্ত, অজয় বিশ্বাস প্রমুখ প্রসিদ্ধ পরিচালককে এবং অজয় ভট্টাচার্য, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শচীনদেব বর্মন, পঙ্কজকুমার মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, রাহুলদেব বর্মনের মতো গীতিকার-সুরকারকে।


উল্টোরথ-এর ১৯৭১ বা তার পরের বছরের কয়েকটি সংখ্যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ডিসেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় (বর্ষ ২০, সংখ্যা ১০, পৌষ ১৮৯৩ শকাব্দ) ‘আমাদের কথা’র পুরো অংশ জুড়েই আছে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের কথা; প্রথম কয়েকটি বাক্য :

বাংলাদেশ থেকে বিদূরিত হয়েছে ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন। ভোর হয়েছে ওখানকার মানুষের দুঃখ-নিশা। অরুণাচলে উদিত হয়েছে নতুন সূর্য―ওদের নতুন আশা ও স্বপ্নের প্রতীক। আর যারা গত চব্বিশ বছর ধরে সোনার বাংলাকে লুণ্ঠন করেছে, বর্বর নিপীড়নে স্তব্ধ করে দিতে চেষ্টা করেছে মুক্তিকামী সংস্কৃতি-সচেতন গোটা একটা জাতির কণ্ঠকে, নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সহস্র সহস্র মানুষের জীবন-প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছে রাইফেলের অমানুষিক আক্রমণে, তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ভাষাকে বিকৃত করে তাদের পঙ্গু করে রাখবার উন্মত্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, তারা আজ কোথায়? ইতিহাস বড় নির্মম, বড় দুর্বিনীত। তার কাছে কোনদিন কোন অত্যাচারীই ক্ষমা পায়নি। রোমান সাম্রাজ্য আজ ইতিহাসের বিভীষিকা, নাৎসী জার্মানীর অভ্রংলিহ স্পর্ধা ও উগ্র জাতীয়তাবাদ আজ অতীতের দুঃস্বপ্ন। ইয়াহিয়া-চক্র আজ তাদের সাম্রাজ্যের বিরাট একটি অংশ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত। তাদের মূল ভূখণ্ডেও আজ তারা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের দুর্বার লাভাস্রোতে ভেসে যেতে চলেছে। ভেঙ্গে পড়েছে পাকিস্তানের ভিত্তিভূমি। ইয়াহিয়াকে বিদায় নিতে হয়েছে ইতিহাসের আবর্জনা-স্তূপে।

(পৃ. ১৭)

উল্টোরথ-এ প্রকাশিত বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ-প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহের একটি হ্রস্ব তালিকা :

১। ‘শূন্য বাড়ি’ (ছোটগল্প), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বর্ষ ২০, সংখ্যা ১০, পৌষ ১৮৯৩ শকাব্দ, পৃ. ১৭৯।
২। ‘পক্ষী রহস্য’ (ছোটগল্প), প্রমথনাথ বিশী, বর্ষ ২০, সংখ্যা ১১, মাঘ ১৮৯৩ শকাব্দ, পৃ. ৪৫।
৩। ‘বাংলাদেশ : একটা ভাবনা’ (প্রবন্ধ), সঞ্জয়, বর্ষ ২০, সংখ্যা ১১, মাঘ ১৮৯৩ শকাব্দ, পৃ. ১৭৫।
৪। ‘যুদ্ধ যখন খুলনায়’ (প্রতিবেদন), পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বর্ষ ২০, সংখ্যা ১১, মাঘ ১৮৯৩ শকাব্দ, পৃ. ১৮৬।
৫। ‘বাংলাদেশ যুদ্ধে পাকিস্তানের হার হল কেন’ (প্রবন্ধ), ড. দিলীপ মালাকার, বর্ষ ২০, সংখ্যা ১১, মাঘ ১৮৯৩ শকাব্দ, পৃ. ১৩।
৬। ‘ঢাকার ডায়েরি’ (প্রতিবেদন), পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বর্ষ ২১, সংখ্যা ৩, জ্যৈষ্ঠ ১৮৯৪ শকাব্দ, পৃ. ১৫।
৭। ‘ঢাকা থেকে লিখছি’ (প্রতিবেদন), বিমল চক্রবর্তী, বর্ষ ২১, সংখ্যা ৩, জ্যৈষ্ঠ ১৮৯৪ শকাব্দ, পৃ. ২৯।
৮। ‘বাঘা কাদের সিদ্দিকীর মুখে শোনা’ (নিবন্ধ), ড. দিলীপ মালাকার, বর্ষ ২১, সংখ্যা ৩, জ্যৈষ্ঠ ১৮৯৪ শকাব্দ, পৃ. ২৩৯।

ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রথম ছবি জহির রায়হান-পরিচালিত জীবন থেকে নেয়া (১৯৬৯) সম্পর্কে ‘মেলব্যাগ’ বিভাগে কলকাতার শ্রীলেখা দত্ত নামক একজন পাঠিকার প্রশ্নের উত্তরে মতামত লিখেছেন মিসেস প্রসাদ সিংহ :

টেকনিক্যালি প্রচুর দোষ-ত্রুটি আছে। মেক-আপ মঞ্চসুলভ। অভিনয় চড়া সুরের। তথাপি ছবিটি অত্যন্ত উপভোগ্য হয়েছে। এর পশ্চাতে আছে পরিচালক রায়হান, সঙ্গীত পরিচালক খান আতাউর রহমান ও সমস্ত শিল্পীদের আন্তরিকতা। প্রাণের আবেগে ছবিটি প্রদীপ্ত। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ছবি বা নাটক সাধারণত থানইটের মত শক্ত রসহীন নিবন্ধে পরিণত হয়ে থাকে। কিন্তু ‘জীবন থেকে নেয়া’ একটি রসসমৃদ্ধ রাজনৈতিক ছবি। বক্তব্য রসে জারিত হয়ে ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিকে প্রাণময় করেছে।

(বর্ষ ২১, সংখ্যা ১, চৈত্র ১৮৯৪ শকাব্দ, পৃ. ২৮)

মাস কয়েক আগে এস. শুকদেব-পরিচালিত Nine Months to Freedom (১৯৭২) প্রামাণ্যচিত্রের একটি সিডি দেখার সুযোগ পাই; উল্টোরথ-এর পাতায় এ-ছবির প্রদর্শনী সম্পর্কে জানাচ্ছেন কলিন পাল (যিনি ‘বোম্বাই চিঠি’ বিভাগে হিন্দি ছবির খবরাদি লিখতেন) :

প্রখ্যাত ডকুমেন্টারী চিত্র-নির্মাতা শুকদেবের ছবি ‘নাইন মান্‌থ্‌স টু ফ্রিডম’ দেখবার জন্যে নিমন্ত্রণ পাই। ছবিটি সম্প্রতি দিল্লীতে দেখানো হয়েছে এবং শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, নন্দিনী সৎপাত্রী ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ. আর. মালিক ছবিটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ছবি শুরু হওয়ার আগে ছোট্ট একটি ভাষণে শুকদেব বলেন যে, তিনি যখন ইউনেস্কোর পক্ষে প্যারিসে একটা ছবি করছিলেন, তখন ভারতীয় দূতাবাসের একজন অফিসার তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি বর্বরতার কিছু ছবি তাঁর কাছে পাওয়া যাবে কি না। এই কথা শুনে শুকদেব রীতিমত ভাবিত হলেন। ভারতীয় প্রচার-যন্ত্রে নিশ্চয়ই কোন গলদ আছে, তা না হলে একজন ভারতীয় অফিসার নিজে প্রয়োজনীয় ছবি সংগ্রহ করতে পারছেন না কেন? শুকদেব সঙ্গে সঙ্গে ভারতে ফিরে এসে শরণার্থীদের উপর একটা ছবি তৈরীর কাজে লিপ্ত হন। কিন্তু ইতিহাস বড় দ্রুত এগিয়ে চলল। শরণার্থীদের সম্বন্ধে ছবিটি শেষ হবার পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বপ্রান্তে অনেক কিছু ঘটে গেছে। তার ছবির সুযোগ-সুবিধা ও চরিত্রও অনেক বদলে গেছে। ফলে শুকদেব মুক্তি-সংগ্রামের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং ছবিতে সংগ্রামের পরিসমাপ্তিতে বিজয়-উৎসব পর্যন্ত দেখানো হয়েছে।

শুকদেব অনেকগুলো ভালো ডকুমেন্টারী ছবি করেছেন। তার মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হল ‘অ্যান্ড মাইল্‌স টু গো’। কিন্তু ‘নাইন মান্‌থ্‌স টু ফ্রিডম’ তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। শুকদেবের মত একজন প্রতিভাবান চিত্রনির্মাতা যে কাহিনী-চিত্র নির্মাণে নিজের প্রতিভাকে নিয়োজিত করছেন না, এটা সত্যিই একটা দুঃখজনক ব্যাপার।

(বর্ষ ২১, সংখ্যা ৩, জ্যৈষ্ঠ ১৮৯৪ শকাব্দ, পৃ. ১০৮)

‘উপেক্ষার ডানায় অপেক্ষার উড়াল’ শীর্ষক প্রবন্ধে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে আবু হাসান শাহরিয়ার উল্টোরথ-এর কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে :

নীতিগত কারণে আনন্দবাজার-এর চাকরিটি ছেড়ে দেবার পর শ্যামলকে দীর্ঘদিন আমলই দেয়নি ‘দেশ’ পত্রিকা। ‘উল্টোরথ’-এর মতো রদ্দি পত্রিকাতেও লিখতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। সেখানেই ছাপা হয়েছিল ‘হিম পড়ে গেল’র মতো মহার্ঘ উপন্যাস।

(দৈনিক যুগান্তর-এর সাময়িকী ‘অন্য প্রান্তর’, বর্ষ ১, সংখ্যা ৬৫, ১০ মার্চ ২০০০, ঢাকা, পৃ. ১৭)

চলচ্চিত্র-সাংবাদিকতা ছাড়াও প্রধানত গদ্যসাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় উল্টোরথ যে-ভূমিকা রেখেছিল, তা বিবেচনা করলে একে নিছক ‘রদ্দি পত্রিকা’ বলে উড়িয়ে দেওয়া বেশ কঠিন।

মুয়িন পারভেজ

জন্ম চট্টগ্রামে। লিখে সময় কাটি, পড়ে জোড়া লাগিয়ে দিই আবার। ভালোবাসি মেঘবৃষ্টিজ্যোৎস্না আর ঝরনাকলম। প্রকাশিত কাব্য : ‘মর্গে ও নিসর্গে’ (ঐতিহ্য, ২০১১)।

১৫ comments

  1. ইমতিয়ার - ২১ ডিসেম্বর ২০০৯ (৬:৪২ পূর্বাহ্ণ)

    নস্টালজিয়া যে এভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়আশয়ে চলে আসবে, প্রথমে তা চিন্তাও করতে পারিনি। এইভাবে উল্টোরথ কতজনকে যে উত্তম-সুচিত্রাদের চিনিয়েছে, অলস দুপুর ও রাতে গল্প পড়তে শিখিয়েছে, কে জানে!
    ভারতে কিংবা আরও সব ভিনদেশে ওই সময় কিংবা তারপর বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে-সব গল্প ও কবিতা লেখা হয়েছে, সে-সম্পর্কে যে আমাদের তেমন ধারণা নেই, এ লেখাতে মুয়িন পার্ভেজের দেয়া নাতিদীর্ঘ তথ্যপঞ্জী তারই প্রমাণ। এভাবে উল্টোরথ, পরিচয় ও বিভিন্ন লিটল ম্যাগগুলির কথা যদি আমরা হিসেবে নেই তা হলে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের অন্তত পরিমাণগত অবয়ব অনেকটাই বেড়ে যাবে এবং কে জানে তা থেকে আমাদের স্তব্ধ করে দেয়ার মতো পুরানো কোনো মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত লেখারও সন্ধান পেতে পারি আমরা।
    মুয়িনকে ধন্যবাদ, ভিন্নমাত্রার এক উল্টোরথকে আমাদের সামনে তুলে ধরবার জন্যে।

    • মুয়িন পার্ভেজ - ২২ ডিসেম্বর ২০০৯ (৮:৩০ অপরাহ্ণ)

      হালকা চালেই লেখাটি শুরু করতে চেয়েছি; আমার অভীপ্সা ছিল উল্টোরথ-এর ‘মেলব্যাগ’ থেকে কিছু নির্বাচিত প্রশ্নোত্তর তুলে দেওয়া — এতে কৌতুকরসের সঙ্গে কিছু তথ্যও বা মিলে যেতে পারে। আপনার মন্তব্যের সঙ্গে আমি একমত :

      এভাবে উল্টোরথ, পরিচয় ও বিভিন্ন লিটল ম্যাগগুলির কথা যদি আমরা হিসেবে নেই তা হলে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের অন্তত পরিমাণগত অবয়ব অনেকটাই বেড়ে যাবে এবং কে জানে তা থেকে আমাদের স্তব্ধ করে দেয়ার মতো পুরানো কোনো মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত লেখারও সন্ধান পেতে পারি আমরা।

      ‘মকবুল’ নামের এক বেদনার্ত কিশোরের হাত ধ’রে ডা. অনন্ত সরকারের ‘শূন্য বাড়ি’তে এসে পৌঁছেন গল্পের কথক; তখনও যুদ্ধ চলছে। চোখের সামনে গোরস্থান হয়ে গেল প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা একটা হিন্দুবাড়ি। বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে কৌতূহলবশত উঠোনের নলকূপে চাপ দিয়ে দেখা গেল পানি পড়ছে তখনও — এভাবে এক স্মৃতি-আর্দ্র বিবরণ উঠে আসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মরমী কলমে। ‘পক্ষী রহস্য’ গল্পে প্রমথনাথ বিশী ভিন্ন এক প্রকাশকৌশলের মাধ্যমে রাজাকারের উস্কানিতে পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞের কথা শুনিয়েছেন — স্বল্প পরিসরে এই গল্পের ব্যঙ্গাত্মক কশাঘাতের তীব্রতা ও সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা অসম্ভবপ্রায়। যুদ্ধের সময় ও পরে বাংলাদেশে এসেছিলেন সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়; বিমল চক্রবর্তীও এসেছিলেন সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের (ছিলেন সত্যজিৎ রায়, শ্যামল মিত্র প্রমুখ) সদস্য হয়ে। তাঁদের লেখায় বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহৃদয়তা ও খোলা মনের পরিচয় পাওয়া যায়।

      ‘মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের’ কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

  2. মুয়িন পার্ভেজ - ২১ ডিসেম্বর ২০০৯ (২:০৬ অপরাহ্ণ)

    Nine Months to Freedom প্রামাণ্যচিত্রটির যে-লিঙ্ক দিয়েছি, তা সরাসরি কাজ করছে না। মূল সাইট থেকে দয়া ক’রে অনুসরণ করুন :

    ‘home page > Documentaries and Video Clips > Nine Months to Freedom: The Story of Bangladesh’.

    এখানে আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রামাণ্যচিত্র পাওয়া যাবে।

  3. ইয়াসিন আরাফাত - ২১ ডিসেম্বর ২০০৯ (১১:৩১ অপরাহ্ণ)

    উল্টোরথ – এর তথ্য জেনে ভালোলাগল। এর প্রকাশনা বর্তমানে তো বন্ধ না?

    • মুয়িন পার্ভেজ - ২২ ডিসেম্বর ২০০৯ (৮:৪৯ অপরাহ্ণ)

      ধন্যবাদ, ইয়াসিন আরাফাত। উল্টোরথ-এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে কি না আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না, বইপত্রের দোকানে অন্তত দেখি না। আমার সংগ্রহের সর্বশেষ সংখ্যাটি বেরোয় এপ্রিল ১৯৮৮-তে (বর্ষ ৩৬, সংখ্যা ৯, বৈশাখ ১৩৯৫ বঙ্গাব্দ), যার কথা মূল লেখায় উল্লেখ করেছি। এ-সংখ্যাকে ‘নিষ্প্রভ’ও বলেছি। মূলত আমার আগ্রহ ছিল ষাট-সত্তরের দশকের সংখ্যাগুলোর প্রতি, যেগুলোতে পাতায় পাতায় বাংলা ছবির বিবরণ ও বিজ্ঞাপন থাকত। শাদাকালো বিজ্ঞাপনও যে মন কেড়ে নিতে পারে গল্পের মতোই, উল্টোরথ তার প্রমাণ (যদিও জানি, মনের ব্যাপারস্যাপারে ‘প্রমাণ’ খাটে না)।

  4. রেজাউল করিম সুমন - ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (২:০৩ অপরাহ্ণ)

    এলোমেলোভাবে উল্টোরথ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা সংগ্রহ করেছিলাম পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে, প্রিয় লেখকের উপন্যাস পড়ার লোভে। মুয়িন পার্ভেজের নিবিড় পাঠ পত্রিকাটির বহুমাত্রিক চারিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল আমাদের। ধন্যবাদ, মুয়িন। দ্বিতীয় পর্বের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম।

    অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকার ( আমার সময়, পৃ ১৫-১৬, ডিসেম্বর ২০০৯) থেকে :

    ‘সমুদ্রমানুষ’ লিখেছিলাম বন্ধুদের আগ্রহেই। উল্টোরথ পত্রিকা ‘মানিক স্মৃতি’ পুরস্কার ঘোষণা করল। সেই সময় লিখি ওই উপন্যাস। দেবপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়, সাধন চৌধুরি, প্রশান্ত সেনগুপ্ত — আমার এই বন্ধুরা অনুরোধ করল — লেখ, লেখ। পাঠিয়ে দিলাম। বহরমপুরের এই বন্ধুরা পরে কলকাতায় চলে আসে। শুনেছি, সেই সময় পুরস্কারের যাঁরা বিচারক ছিলেন তাঁদের মধ্যে লীলা মজুমদার, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন। ওঁরা নাকি বিশ্বাসই করেননি যে একজন বাঙালি লেখক এরকম লেখা লিখতে পারে। ভেবেছিলেন আমি কোনও ইংরেজি উপন্যাস থেকে টুকে দিয়েছি। আমার উপন্যাস — ‘সমুদ্রমানুষ’ — প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়। দ্বিতীয় পুরস্কার পান পূর্ণেন্দু পত্রী তাঁর ‘দাঁড়ের ময়না’-র জন্য। প্রথম হয় মতি নন্দী।

    এবার পড়া যাক একই মাসিকপত্রের ঠিক আগের সংখ্যায় (আমার সময়, পৃ ১৬, নভেম্বর ২০০৯) প্রকাশিত মতি নন্দীর সাক্ষাৎকারের প্রাসঙ্গিক অংশ :

    আমার প্রথম উপন্যাস ‘ধুলোবালির মাটি’ — বই হয়ে যখন বের হল নাম হল — ‘নক্ষত্রের রাত’। ‘উল্টোরথ’ পত্রিকা আয়োজিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি প্রথম পুরস্কার পায় সেই উপন্যাস। […] এই প্রতিযোগিতায় পূর্ণেন্দু পত্রী দ্বিতীয় হয়েছিলেন। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় তৃতীয়। রঙমহলে পুরস্কার নেওয়ার সময় পূর্ণেন্দুর সঙ্গে দেখা হল। পরিচিত হলাম অতীনের সঙ্গে।

    এর আগে একটা গল্প আছে। মনে আছে, ছাপ্পান্নর ডিসেম্বরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মারা গেলেন। তাঁর জন্য শোকসভা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে। আমার বন্ধু মোহিত চট্টোপাধ্যায়, কবি শিবশম্ভু পাল — ওরা দু’জন নিয়ে গেল। কফিহাউসে প্রথম গেলাম, চোখে দেখলাম। তারপর সেখান থেকে শোকসভায় গেলাম। কিছু সাহিত্যিককে চাক্ষুষ করলাম সেদিন। ‘উল্টোরথ’ পত্রিকা ওই সভাতেই ঘোষণা করেছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে উপন্যাস প্রতিযোগিতার কথা। নতুন লেখকদের খুঁজে বার করাই ছিল সেই প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য।

    সম্প্রতি জানতে পারলাম, উল্টোরথ আয়োজিত ওই প্রতিযোগিতায় প্রায় শ-তিনেক নবীন ঔপন্যাসিক অংশ নিয়েছিলেন! দৌলতপুর কলেজের এক ছাত্রের পাঠানো উপন্যাস শামুক প্রথম পঁচিশ জনের তালিকায় স্থান পেয়েছিল। পরের ধাপে প্রথম সাতজনের মধ্যেও রইল সেই লেখাটি। শেষমেশ পুরস্কার-বিজয়ী তিনটি উপন্যাসের রচয়িতার তালিকায় যে নবীন লেখকটির ঠাঁই হয়নি তা বলাই বাহুল্য। সেদিনের সেই আঠারো বছর বয়সী ঔপন্যাসিকের নাম হাসান আজিজুল হক!

    • মুয়িন পার্ভেজ - ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (২:০৩ পূর্বাহ্ণ)

      উল্টোরথ-আয়োজিত উপন্যাস-প্রতিযোগিতার কথা আমার জানা ছিল না — কৌতূহলোদ্দীপক এই তথ্যের জন্য রেজাউল করিম সুমনকে অনেক ধন্যবাদ।

      উপন্যাস নিয়ে অভিনব পরিকল্পনা ছিল উল্টোরথ-এর; একটি সাধারণ সংখ্যায় উপন্যাস ছাপা হয়েছে লেখকের নাম ছাড়াই! ভূমিকায় জানানো হয়েছিল যে পরবর্তী সংখ্যায় লেখকের নাম প্রকাশ করা হবে, তার আগে পাঠকগণ যেন সম্ভাব্য লেখকের নাম উল্লেখ ক’রে চিঠি পাঠান (নায়ক-নায়িকাদের ছবি ছাপিয়ে নাম-আবাহনের এমন উদ্যোগ প্রায় নিয়মিতই নেওয়া হত) — ঔপন্যাসিক ও সঠিক উত্তরদাতাদের নাম পরবর্তী সংখ্যায় ছাপা হবে। পরবর্তী সংখ্যাটিও আমার সংগ্রহে আছে, তবে দুর্ভাগ্য এই যে, সে-সংখ্যায়ও লেখকের নাম ছিল না। কর্তৃপক্ষ জানালেন, উত্তর পাওয়ার মেয়াদ উত্তীর্ণ না হওয়ায় লেখকের নাম প্রকাশ করা তখনই সম্ভব হয়নি। প্রচুর পাঠকের চিঠি জমা পড়েছিল উল্টোরথ-এর দপ্তরে। পরের সংখ্যাটি সংগ্রহে না থাকায় আমি এখনও জানি না কে ছিলেন বহুবচন নামক সেই উপন্যাসটির রচয়িতা।

      কখনও-কখনও মনে হয়, লেখকের নাম মুদ্রিত না থাকলেই ভালো — এতে পাঠক আরও নির্মোহচিত্তে লেখা-মূল্যায়নের সুযোগ পাবেন। কোনো-কোনো লেখার শৈলীতেই নিহিত থাকে লেখকের স্বভাবস্বাক্ষর; নিঃসঙ্গ সেই লেখকদের আবিষ্কার করার আনন্দও তো অনির্বচনীয়!


      হাসান আজিজুল হকের শামুক উপন্যাসটি কি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল? আগুনপাখি ছাড়া তাঁর আর কোনো উপন্যাসের নাম মনে পড়ছে না। তরুণ বয়সে যিনি উপন্যাস-রচনায় ঈর্ষণীয় নৈপুণ্য দেখিয়েছেন, পরবর্তীকালে তিনি কেনই বা উপন্যাসে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন, তাও খুব জানতে ইচ্ছে করে।

      • রেজাউল করিম সুমন - ৫ মার্চ ২০১০ (৫:৩৬ অপরাহ্ণ)

        হাসান আজিজুল হকের শামুক উপন্যাসটি কি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল? আগুনপাখি ছাড়া তাঁর আর কোনো উপন্যাসের নাম মনে পড়ছে না। তরুণ বয়সে যিনি উপন্যাস-রচনায় ঈর্ষণীয় নৈপুণ্য দেখিয়েছেন, পরবর্তীকালে তিনি কেনই বা উপন্যাসে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন, তাও খুব জানতে ইচ্ছে করে।

        ঠিক, আগুনপাখি-ই হাসান আজিজুল হকের একমাত্র পূর্ণায়তন উপন্যাস। তাঁর অন্য যে-রচনাত্রয় সম্প্রতি প্রকাশকের আগ্রহে তিনটি উপন্যাসিকা নামে একত্রে বেরিয়েছে সেগুলোকে লেখকও উপন্যাস বলেন না। বিধবাদের কথা তো গল্প-ই। শিউলি চার দশক আগে লেখা হয়েছিল একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসের অংশ হিসেবে। বৃত্তায়ন অর্ধশতাব্দী আগের রচনা। তারও বছর তিনেক আগে হাসান লিখেছিলেন ‘শামুক’ — উল্টোরথ-এর জন্য। মানিক স্মৃতি পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত পর্বে মনোনীত না-হওয়ায় লেখাটি সে-পত্রিকায় ছাপা হয়নি। পরে — (দূরালাপে হাসান জানিয়েছেন) ‘লেট সিক্সটিজ-এ’ — ‘শামুক’-এর অর্ধাংশ ঈষৎ রূপান্তরিত হয়ে ছাপা হয়েছিল রাজশাহী থেকে প্রকাশিত পূর্বমেঘ-এ। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত পত্রিকাটির পরবর্তী সংখ্যা আর কখনোই ছাপা না-হওয়ায় ‘শামুক’-এর শেষাংশ এখনো পর্যন্ত অমুদ্রিতই রয়ে গেছে!

        ‘শামুক’-এর পাত্রপাত্রীরা ছিল লেখকের বাল্য-কৈশোরের (অর্থাৎ বর্ধমানের) চেনাজানা মুসলমান সমাজের মানুষজনের আদলে তৈরি। উল্টোরথ-এ পাঠানো আদিপাঠে কুশীলবরা ছিল হিন্দু। আর পরে, হাসান দৌলতপুর ছাড়তে বাধ্য হয়ে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হবার পর যখন লেখাটি পূর্বমেঘ-এ ছাপতে দেন, আখ্যানের চরিত্রগুলোকে মুসলমান করে দেন নিজেই!পূর্বমেঘ-এর অন্তিম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘শামুক’-এর প্রথমার্ধই কেবল লেখকের সংগ্রহে আছে। শেষার্ধের পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গেছে!

        • মুয়িন পার্ভেজ - ৬ মার্চ ২০১০ (১২:১৪ পূর্বাহ্ণ)

          উল্টোরথ-এর সূত্রে প্রিয় কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের উপন্যাসব্রতের প্রাথম দিনগুলো নিয়ে এমন চমৎকার তথ্য পরিবেশন করার জন্য রেজাউল করিম সুমনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে গল্প লিখেছেন হাসান — ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ যতবারই পড়ি নতুন মনে হয় — কিন্তু পত্রিকান্তরে ছাপানোর জন্য যে তিনি আখ্যান-চরিত্রেরও ধর্মান্তর ঘটিয়েছেন — এ-সংবাদ সত্যি অভূতপূর্ব মনে হল!

          উল্টোরথ-এ পাঠানো শামুক-এর আদিপাঠ যদি সংগ্রহ করা যায়, তাহলে দেশকালসচেতন হাসানের চরিত্রবীক্ষা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে আমাদের কাছে।

  5. Pingback: মুক্তাঙ্গন | উল্টোরথ-এর পাতা থেকে ২ | মুয়িন পার্ভেজ

  6. সৌরভ দত্ত - ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ (৬:১২ অপরাহ্ণ)

    নমস্কার । অল্প-জানা বিষয় নিয়ে আপনার এই লেখাটি ভীষণ ভাল লাগল ।
    প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা-কে ঘিরে ‘ঘনাদা গ্যালারি’ নামক একটি ওয়েবসাইট সাজাচ্ছি :
    http://ghanada.wix.com/ghanada-gallery
    সেই সূত্রে একটি তথ্য জানার প্রয়োজন ছিল । ১৮৯৪ শকাব্দ নাগাদ উল্টোরথ-এর কোনো সংখ্যায় কি ‘মঙ্গলগ্রহে ঘনাদা ‘ উপন্যাসটি বেরোয় ?
    একটি বই থেকে এই তথ্য পেলেও কেউ নিশ্চিতভাবে জানাতে পারেন নি ।
    যদি আপনাদের কাছে সংখ্যাটি থাকে, ‘মঙ্গলগ্রহে ঘনাদা ‘-র সঙ্গে প্রকাশিত অলংকরণ-এর স্ক্যান আমার ই-মেল -এ পাঠালে খুব উপকৃত হব ।
    অশেষ ধন্যবাদ ।।
    সৌরভ দত্ত
    datta.saurabh.saurabh@gmail.com

    • মুয়িন পারভেজ - ২ মার্চ ২০১৫ (১০:০৬ অপরাহ্ণ)

      অনেক ধন্যবাদ, সৌরভ দত্ত। হ্যাঁ, মঙ্গলগ্রহে ঘনাদা বেরিয়েছিল উল্টোরথ-এ, সংখ্যাটি সংগ্রহেও আছে। কিছুদিনের মধ্যেই গ্রামের বাড়িতে যাব ভাবছি; আশা করি আপনার জন্য অলঙ্করণের স্কেচ পাঠাতে পারব। ভালো থাকবেন।

  7. সৌরভ দত্ত - ৯ মার্চ ২০১৫ (৭:২৩ পূর্বাহ্ণ)

    অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে, মুয়িন পারভেজ ।
    সাগ্রহে ‘মঙ্গলগ্রহে ঘনাদা’-র অপেক্ষায় রইলাম ।
    এটা আমরা কোত্থাও পাচ্ছি না ।
    ভাল থাকবেন ।
    সৌরভ দত্ত ।।

  8. সৌরভ দত্ত - ১৫ মার্চ ২০১৫ (৪:৪৩ পূর্বাহ্ণ)

    আমার সংগ্রহে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কেনা দুটো মলাটহীন, ছেঁড়াখোঁড়া ‘উলটোরথ’ আছে । কার্তিক ১৮৮৮ শকাব্দ ও মাঘ ১৮৮৬ শকাব্দ । যদি আপনার কাজে আসে, সেগুলোর সূচিপত্র স্ক্যান করে পাঠাতে পারি । অনুগ্রহ করে জানাবেন । ভাল থাকবেন ।

  9. সৌরভ দত্ত - ২৪ এপ্রিল ২০১৫ (৪:১৯ পূর্বাহ্ণ)

    অশেষ ধন্যবাদ দাদা ! ভাল থাকবেন ।।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.