একাত্তরের গণহত্যা কেউ কি ভুলতে পারে? তারপরও বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদেছে বছরের পর বছর। কিন্তু সময় বদলে যায়, কেননা সময়ও চায় অতীতকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে। তাই গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের খুজেঁ বের করছে আইনের দীর্ঘ হাত। কেমন ছিল সেই দিনটি, যেদিন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সামনে হাজির করা হলো আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে? মফিদুল হক লিখেছেন সেই দিনটির কথা।

আদালত কক্ষে প্রবেশ করতে আমার কিছুটা বিলম্ব ঘটে গিয়েছিল। প্রধান ফটক দিয়ে এলাকায় প্রবেশের মুখে জেরা ও তল্লাশি থেকে বোঝা যাচ্ছিল আজকের আদালতের রয়েছে ভিন্নতা। একাত্তরে গণহত্যা, মানবতা বিরোধী অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আদালতে উপস্থিত করা হবে প্রধান এক অভিযুক্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। মূল ভবনে ঢোকার মুখে আবারও তল্লাশি এবং পরিচয়প্রদান ও পরিদর্শকের কার্ড সংগ্রহের জন্য বিলম্ব হয়ে গেল আরো। ঢোকার সময়ে গুঞ্জন শোনা গেল, বেশ কিছুটা হৈ-হল্লা ঘটেছে প্রবেশাধিকার নিয়ে। মূল এজলাশ সুপরিসর বটে, তবে ভেতরে প্রবেশের দাবিদার হয়েছেন যত মানুষ ততজনকে স্থান দেয়ার কোনো উপায় নেই। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে এজলাশে উপস্থাপনেও কিছু বিলম্ব ঘটেছে, প্রিজন ভ্যানে তিনি যখন পৌঁছলেন আদালত-প্রাঙ্গণে তখন পরিবারের সদস্য ও আইনজীবীদের কেউ কেউ পুলিশী বারণ উপেক্ষা করে অভিযুক্তের সঙ্গে পার করলেন দীর্ঘ সময়। ফলে ঘটেছিল অনভিপ্রেত বিলম্ব। আমি যখন প্রবেশ করি আদালত-কক্ষে তখন অভিযুক্তের আইনজীবীর জমাকৃত ওকালতনামা বৈধ হয় নি বিধায় বিচারকমণ্ডলী সে-বিষয়ে মত-প্রকাশ করছিলেন। অভিযুক্তের পক্ষের আইনজীবীকে সংযত থাকতেও উপদেশ দিচ্ছিলেন ট্রাইবুন্যালের মান্যবর প্রধান বিচারক। সেসব কথা শুনছিলাম বটে, কিন্তু আমার নজর পড়ে ছিল কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অভিযুক্তের দিকে। তিনি বলিষ্ঠ পুরুষ, তাঁর দাঁড়িয়ে থাকায় শারীরিক সেই বলিষ্ঠতার কোনো কমতি ছিল না। তাঁর চেহারায় বা শরীরে বা শরীরের ভাষায় নির্যাতনের কোনো ছাপ নেই। মনে পড়ছিল মাত্র ক’দিন আগে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য সাকা চৌধুরীকে পুলিশ রিমাণ্ডে নির্যাতন করা হয়েছে উল্লেখ করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দেয়া বিবৃতির কথা। সেই বিবৃতিতে অনেক ধরনের নির্যাতনের উল্লেখ করা হয়েছিল, পায়ের নখ উপড়ে ফেলা, যৌনাঙ্গে বিদ্যুৎ শলাকা প্রয়োগ, ক্ষুর দিয়ে তলপেটে চির ধরানো ইত্যাদি ইত্যাদি। অ্যামনেস্টির বাংলাদেশ সংক্রান্ত গবেষক আব্বাস ফায়েজ এইসব নির্যাতনের কথা বলে বাংলাদেশ সরকারের জবাবদিহিতা কামনা করেছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিবেকের বন্দিদের পক্ষে দাঁড়াবার জন্য সদা সচেষ্ট থাকে। কিন্তু পশ্চিমী দৃষ্টিভঙ্গি যে তাদের চিন্তা-চেতনা অনেকাংশে আচ্ছন্ন করে রাখে সেই পরিচয়ও তারা সময় সময় দিয়েছে। বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা বিচারের হাত থেকে নিজেদের জন্য অব্যাহতি নিশ্চিত করেছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু-হত্যা ছিল তাদের এই অব্যাহতি আদায়করণ প্রচেষ্টার অংশ। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পর বাতিল ঘোষিত হয় দালাল আইন, রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয় ঘাতক ও…

ঠিক সাড়ে দশটায় ধীরপায়ে আদালত-কক্ষে প্রবেশ করলেন চার অভিযুক্ত। তাদের চেহারা ভাবলেশহীন, এক বিষন্নতার ছায়াপাত দুর্লক্ষ্য নয়। আমি তাদের চোখের ভাষা পড়বার জন্য উদগ্রীব হই, কিন্তু ঘাতক-মানসের পাঠোদ্ধার আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না [...]

(মফিদুল হক এর জবানীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন) আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে শুনানি কক্ষ ভরে উঠেছিল অনেক আগে থেকে। দুই সারিতে আঠারোটি বেঞ্চ পাতা আছে আইনজীবী, কৌঁসুলি, পর্যবেক্ষক, দর্শক ও সাংবাদিকদের জন্য। আজ অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীরাও উপস্থিত। সবার স্থান না হওয়াতে অনেককেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। গাদাগাদি করে বেঞ্চে চারজনের আসনে সাত-আটজন করে বসেছেন। ঠিক সাড়ে দশটায় ধীরপায়ে আদালত-কক্ষে প্রবেশ করলেন চার অভিযুক্ত। তাদের চেহারা ভাবলেশহীন, এক বিষন্নতার ছায়াপাত দুর্লক্ষ্য নয়। আমি তাদের চোখের ভাষা পড়বার জন্য উদগ্রীব হই, কিন্তু ঘাতক-মানসের পাঠোদ্ধার আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। বোঝার চেষ্টা নেই কী তাদের মনোভাব আজ যখন তারা এসে দাঁড়ালেন কাঠগড়ার সামনে? ছোটলাট ভবনের শ্বেতপাথরের প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে যখন তারা ল্যান্ডিংয়ে উঠে পথ ঘুরেছেন তখন নিশ্চয় দেখেছেন কালো বোর্ডে সাদা হরফে সেই জ্বলজ্বলে লেখা, বাংলা ও ইংরেজিতে পরিচিতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম্স্ ট্রাইব্যুনাল। একাত্তর সালে মানবতার বিরুদ্ধে যে চরম অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশে সেই অপরাধের ভয়ঙ্কর মাত্রা জন্ম দিয়েছে এই অভিধান ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস। কোনো বিশেষ ধর্ম, নৃ, জাতিগত বা রাজনৈতিক মতাদর্শের গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে চিরতরে নির্মূল বা উৎখাতের লক্ষ্যে পরিচালিত হত্যা ও নৃশংসতা কেবল মামুলি হত্যার ব্যাপকতা নয়, এ-ভিন্নতর মাত্রার অপরাধ, যে অপরাধ গোটা মানবজাতির বিরুদ্ধে, মানবসত্তার বিরুদ্ধে, আর তাই এর জন্য দরকার পড়ে ভিন্নতর আইন, ভিন্নতর আদালত। সেই আইন বাংলাদেশ প্রণয়ন করেছিল ১৯৭৩ সালে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম্স্ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট, অপরদিকে সেই আদালত গঠন করা বাংলাদেশের আর হয়ে ওঠেনি। বাকি ইতিহাস আমাদের সবার জানা, বুড়িগঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে কত না জল, মুছে গেছে রক্তধারা, অস্বীকার করা হয়েছে ইতিহাস, বর্বরতার আস্ফালনে দীর্ণ হয়েছে স্বজনহারা অযুত বুক। কতোকাল পর আজ চার অভিযুক্ত সিঁড়ি বেয়ে পায়ে পায়ে এগিয়েছেন আদালত কক্ষের দিকে, সেই জ্বলজ্বলে পরিচিতির দিকে তাকিয়ে তাদের কী মনে হয়েছে জানি না, তবে আদালত-কক্ষে প্রবেশকারী চার অভিযুক্তের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল বিচারের বার্তা তারা পেয়ে গেছেন। পুলিশ প্রহরায় তাদের ঢোকার সাথে সাথে অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবীরা উঠে দাঁড়িয়ে এক ধরনের অশিষ্ট আচরণের পরিচয় রাখলো। আদালতে আসামি প্রবেশ করলে যে উঠে দাঁড়াতে হয়, এমন উদ্ভট আচরণের শিক্ষা নিশ্চয় আইনের বিদ্যালয়…

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর মফিদুল হক বর্ণনা করছেন ঐতিহাসিক এই প্রথম দিনের চাক্ষুস অভিজ্ঞতা ...। চালু হয়ে গেল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কার্যক্রম, আমি বিস্ফারিত চোখে রুদ্ধশ্বাস হয়ে দেখছিলাম ইতিহাসের এই অপরূপ উদ্ভাবন[....]

মফিদুল হক লিখেছেন প্রথমদিনের চাক্ষুস অভিজ্ঞতা। ২৬ জুলাই সোমবার ঘড়ির কাঁটায় ঠিক সকাল সাড়ে দশটায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারকক্ষে প্রবেশ করলেন তিন বিজ্ঞ বিচারক। আইনজীবী, কৌসুলী, আদালত কর্মকর্তা, দর্শক, সাংবাদিক সকলে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো বিচারপতিদের। আসন গ্রহণ করবার পর তিন সদস্যের প্যানেলের প্রধান বিচারপতি নাজমুল হক ট্রাইবুন্যালের প্রধান কৌসুলীকে তাঁর বক্তব্য পেশ করতে বললেন। প্রবীণ আইনজীবী গোলাম আরিফ টিপু তাঁর নির্ধারিত স্থানে উঠে গিয়ে বক্তব্য প্রদান শুরু করলেন। চালু হয়ে গেল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কার্যক্রম, আমি বিস্ফারিত চোখে রুদ্ধশ্বাস হয়ে দেখছিলাম ইতিহাসের এই অপরূপ উদ্ভাবন। বাংলাদেশে একাত্তর সালে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সংহারক বাহিনী গঠন করে যারা ঘৃণ্য অপরাধ কর্ম করেছে তাদের চারজন নিজামী, মুজাহিদ, কামরুজ্জামান ও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগের মাত্রা মেলে ধরতে লাগলেন গোলাম আরিফ টিপু। ইউর লর্ডশিপ, বলে গোড়াতে এক সংক্ষিপ্ত বাক্যে তিনি স্মরণ করলেন সেই সমস্ত মহান শহীদদের যাঁদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমার আপনার সবার প্রিয় বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এই সূচনা বিশাল এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পথে বাংলাদেশের অভিযাত্রা সূচিত করলো। এই যাত্রা বিচারহীনতা থেকে বিচার প্রতিষ্ঠার দিকে, সত্য ও ন্যায়ের বিজয় নিশ্চিত করবার দিকে। বিচার যখন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো, দাঁড়িয়ে উপস্থিত সবাই সম্মান জানালেন বিচারপতি ও আদালতকে, তখন মনে হচ্ছিল শতবর্ষী লাটভবনে স্থাপিত বিচারশালায় উপস্থিতজনেরা কেবল নয় গোটা বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষ উঠে দাঁড়িয়েছে একত্রে, যে যেখানে রয়েছে সবাই যেন দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে আদালতকে। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে নব-নির্বাচিত সংসদ সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় - গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা যত বলবানই হোক, আন্তর্জাতিক চাপ ও সমর্থনে অপরাধীরা সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের নাগালের বাইরে চলে গেলেও বিচারের দাবির বাইরে তারা কখনো যেতে পারবে না। সঙ্গতভাবেই গণহত্যার মূল হোতা পাকিস্তানি শাসক ও সামরিক গোষ্ঠী ছিল আইনের প্রধান লক্ষ্য, সেই সাথে ছিল তাদের সহযোগী ও তাদের দ্বারা লেলিয়ে দেয়া হন্তারক বাহিনী হিসেবে ধর্মান্ধ মৌলবাদী দেশীয় গোষ্ঠীর সম-অপরাধমূলক ভূমিকার বিচার অনুষ্ঠান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে রক্তস্নাত জাতি ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁর যাত্রা শুরু করেছিল সেই চেতনা এবং মাহাত্ম্য ১৯৭৩ সালে গৃহীত এই আইনের পরতে পরতে মিশে আছে। তারপর বইয়ে দেয়া হলো কত…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.