(মফিদুল হক এর জবানীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন)
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে শুনানি কক্ষ ভরে উঠেছিল অনেক আগে থেকে। দুই সারিতে আঠারোটি বেঞ্চ পাতা আছে আইনজীবী, কৌঁসুলি, পর্যবেক্ষক, দর্শক ও সাংবাদিকদের জন্য। আজ অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীরাও উপস্থিত। সবার স্থান না হওয়াতে অনেককেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। গাদাগাদি করে বেঞ্চে চারজনের আসনে সাত-আটজন করে বসেছেন। ঠিক সাড়ে দশটায় ধীরপায়ে আদালত-কক্ষে প্রবেশ করলেন চার অভিযুক্ত। তাদের চেহারা ভাবলেশহীন, এক বিষন্নতার ছায়াপাত দুর্লক্ষ্য নয়। আমি তাদের চোখের ভাষা পড়বার জন্য উদগ্রীব হই, কিন্তু ঘাতক-মানসের পাঠোদ্ধার আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। বোঝার চেষ্টা নেই কী তাদের মনোভাব আজ যখন তারা এসে দাঁড়ালেন কাঠগড়ার সামনে? ছোটলাট ভবনের শ্বেতপাথরের প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে যখন তারা ল্যান্ডিংয়ে উঠে পথ ঘুরেছেন তখন নিশ্চয় দেখেছেন কালো বোর্ডে সাদা হরফে সেই জ্বলজ্বলে লেখা, বাংলা ও ইংরেজিতে পরিচিতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম্স্ ট্রাইব্যুনাল। একাত্তর সালে মানবতার বিরুদ্ধে যে চরম অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশে সেই অপরাধের ভয়ঙ্কর মাত্রা জন্ম দিয়েছে এই অভিধান ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস। কোনো বিশেষ ধর্ম, নৃ, জাতিগত বা রাজনৈতিক মতাদর্শের গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে চিরতরে নির্মূল বা উৎখাতের লক্ষ্যে পরিচালিত হত্যা ও নৃশংসতা কেবল মামুলি হত্যার ব্যাপকতা নয়, এ-ভিন্নতর মাত্রার অপরাধ, যে অপরাধ গোটা মানবজাতির বিরুদ্ধে, মানবসত্তার বিরুদ্ধে, আর তাই এর জন্য দরকার পড়ে ভিন্নতর আইন, ভিন্নতর আদালত। সেই আইন বাংলাদেশ প্রণয়ন করেছিল ১৯৭৩ সালে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম্স্ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট, অপরদিকে সেই আদালত গঠন করা বাংলাদেশের আর হয়ে ওঠেনি। বাকি ইতিহাস আমাদের সবার জানা, বুড়িগঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে কত না জল, মুছে গেছে রক্তধারা, অস্বীকার করা হয়েছে ইতিহাস, বর্বরতার আস্ফালনে দীর্ণ হয়েছে স্বজনহারা অযুত বুক।
কতোকাল পর আজ চার অভিযুক্ত সিঁড়ি বেয়ে পায়ে পায়ে এগিয়েছেন আদালত কক্ষের দিকে, সেই জ্বলজ্বলে পরিচিতির দিকে তাকিয়ে তাদের কী মনে হয়েছে জানি না, তবে আদালত-কক্ষে প্রবেশকারী চার অভিযুক্তের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল বিচারের বার্তা তারা পেয়ে গেছেন। পুলিশ প্রহরায় তাদের ঢোকার সাথে সাথে অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবীরা উঠে দাঁড়িয়ে এক ধরনের অশিষ্ট আচরণের পরিচয় রাখলো। আদালতে আসামি প্রবেশ করলে যে উঠে দাঁড়াতে হয়, এমন উদ্ভট আচরণের শিক্ষা নিশ্চয় আইনের বিদ্যালয় থেকে পাওয়া যায় না। বোঝা যায় তারা ভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্র। অভিযুক্তদের মধ্যে সর্বাগ্রে মতিউর রহমান নিজামী, মাথায় জিন্না টুপি, তাতে কেবল মস্তক আবরণের চেষ্টা নয়, আরো অনেক কিছু আবৃত করে রাখার প্রয়াস লক্ষণীয়। মনে পড়ে নিজামীর বক্তৃতা, দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায় তার আহ্বান, ইসলামী রাষ্ট্রের মুসলমান সৈনিক হিসেবে ঐ সকল ব্যক্তিকে খতম করতে হবে, যারা পাকিস্তান ও ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। একাত্তরে সেই খতমের আহ্বানের অর্থ কি ছিল তা তো কারো অজানা নয়।
নিজামীর পেছনে আলী আহসান মুজাহিদ, কামারুজ্জামান এবং কাদের মোল্লা। নীরবে সবাই গিয়ে বসলো কাঠগড়ায় নির্ধারিত আসনে। আসামি পক্ষের আইনজীবীদের কেউ কেউ কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলছিল। পুলিশ কোনো বাধা দেয় নি, তবে কথাবার্তা চালাতে তাদের দিক থেকে বিশেষ উৎসাহও লক্ষিত হয় নি।
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল সদস্যরা আসন গ্রহণ করলে শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। আসামিপক্ষের কয়েকজন আইনজীবী পেশ করলেন ওকালতনামা। এরপর প্রধান কৌঁসুলি উঠে দাঁড়িয়ে ট্রাইব্যুনাল প্রণীত আদালত বিধির ৯-ধারা উল্লেখ করে অভিযুক্তদের গ্রেফতার দাবি করেন। তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে আসামিদের শনাক্ত করেন। আমি কোনো আইন সংবাদদাতা নই, আদালত বিশেষজ্ঞও নই, বস্তুত লাল দালাল থেকে সবসময়ে শত হাত দূরে থাকতে চেয়েছি। আজ সুযোগ হয়েছে ক্ষুদ্র পরিসর অথচ বিশাল তাৎপর্যময় এমন এক আদালতে হাজির হওয়ার যার বিবরণী সকলকে জানাতে ইচ্ছে হয় শতভাবে শত কণ্ঠে।
আসামি পক্ষের উকিল অভিযোগনামা সংক্রান্ত কাগজপত্র দাবি করলে বিচারক তাদের বিধি মোতাবেক অগ্রসর হতে পরামর্শ দেন। আদালতের রেজিস্ট্রারের কাছে আবেদন পেশ করে তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পেতে পারেন। এরপর বিচারক তাদের মতামত ব্যক্ত করেন, চার অভিযুক্তকে ট্রাইব্যুনালের আওতায় গ্রেফতার করবার যথাবিহিত ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ ব্যক্ত হয় রায়ে। এর ফলে একাত্তরে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার বরণ করলেন চার অভিযুক্ত। আসামি পক্ষের উকিল তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য সময় প্রার্থনা করলে বিজ্ঞ বিচারক বলেন যে, এজন্য পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ তারা পাবেন, তবে যথাবিহিত আবেদনের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা তাদের নিতে হবে। মাননীয় বিচারক স্থানাভাবের জন্য দুঃখপ্রকাশ করে উপস্থিতজনকে অভিযুক্তদের নির্গমন পর্যন্ত আসনে বসে থাকার অনুরোধ জানান।
এরপর মাথা নিচু করে পুলিশ প্রহরায় আদালত কক্ষ থেকে বের হয়ে যায় চার আসামি। সংক্ষিপ্ত এই অধিবেশন তৈরি করলো ইতিহাস। আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর, নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালের পথ ধরে; কিন্তু পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশির দশক জুড়ে কোনো বিচারই সংঘটিত করতে পারে নি বিশ্বসমাজ। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর আবার শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। রুয়ান্ডা ও পূর্বতন যুগোস্লাভিয়ায় যুদ্ধাপরাধের জন্য জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত ট্রাইব্যুনালের পথ বেয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসি। আইসিসির ঘোষণায় বলা হয়েছিল, “বিশ্বসমাজের কাছে সবচেয়ে গুরুতর বিবেচ্য অপরাধ যেন শাস্তি এড়িয়ে না যায় এবং এর কার্যকর বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে জাতীয় পর্যায়ে এবং বর্ধিত আন্তর্জাতিক সহায়তা দ্বারা।” আইসিসি জাতীয় পর্যায়ে যে উদ্যোগকে প্রাথমিক দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছিল আজ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সেই দায়িত্ব মোচনে অগ্রসর হয়েছে। ন্যায়, সত্য ও আইনের মহিমা প্রতিষ্ঠায় এ-এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ, বাংলাদেশের জন্য, বিশ্বসমাজের পক্ষে।
আদালতের দ্বিতীয় অধিবেশনে ন্যায়বিচারের মহিমা ও শক্তির এমনি এক ঝলক উদ্ভাসন আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। আরো দেখলাম মাথা হেঁট করে অভিযুক্তদের বের হয়ে যাওয়া, যে-পথ ছিল রাজভবনে খিদমতগারদের আসা-যাওয়ার জন্য নির্ধারিত, সেই সরুপথে তাদের নিয়ে তোলা হলো প্রিজন ভ্যানে। তাদের রাত কাটবে কারাগারে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী হিসেবে, অপরদিকে মানবতার চরম লাঞ্ছনার শিকার একাত্তরের লক্ষ শহীদের রক্তরঞ্জিত দেশ এই প্রথম প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া। কারো রাত কাটবে নির্ঘুম, এর বিপরীতে দেশজুড়ে বিপুল শক্তি নিয়ে জাগরণ ঘটবে নৈতিকতার।
আরো পড়ুন : মফিদুল হক এর জবানীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রথম দিনের অধিবেশন।
